অশ্রু ও আগুনের নদী

‘হায় আল্লাহ…’

‘চুপ কর হারামজাদা! তোর জিব আমি কেটে নেব।’

 লোকটির লুঙ্গির সঙ্গে গোঁজা চল্লিশ হাজার টাকা টান দিয়ে কেড়ে নিল ইউসুফ।

‘হায় খোদা, আমার এক জোড়া গরু বেচার টাকা। আমার সর্বস্ব, আমি পথের ভিখিরি হয়ে যাব’ Ñ বলতে বলতে কাশেম ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে ইউসুফের হাত আঁকড়ে ধরল। সাপের মতো পেঁচিয়ে। নাছোড়বান্দা হয়ে। ইউসুফের পিস্তল একটুও দেরি না করে শব্দ করে উঠল। সঙ্গে ছিল কাশেমের ছেলে আবুল। বাপ-বেটায় হাট থেকে ফিরছিল। আবুল চেঁচিয়ে কাঁদল। কান্নার চ্যাঁচামেচি ইউসুফের সিনার বাইরে বাড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। খুব জোরে উড়ে যাওয়ার সময় কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পাখি যেমন মাটিতে আছড়ে পড়ে।

মৃত কাশেম ও জীবিত আবুলের মুখের দিকে তাকাবার দরকার নেই ইউসুফের। ফিনকি দিয়ে কাশেমের বুকের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রাতের বিল পাড়ি দিয়ে গুলির শব্দ তখন বহুদূরে গিয়ে হারিয়ে গেছে। এরোপ্লেন যেমন শব্দ নিয়ে যেতে যেতে শব্দসহ আকাশে অদৃশ্য হয়ে যায়। ধুলোর মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে শব্দ ঝরে পড়ে। কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ উঠছে পুবদিকে। রক্তরবির মতো চাঁদ, দিগন্তে আগুন দিতে এসেছে যেন। পাড়ার ভেতর দিয়ে এশার আজানের আহ্বান এল। জীবিত আবুল বিড়বিড় করে জবাব দিল। তার বাবার মতো ভালো মানুষের প্রতি একি ন্যায়-বিচার হলো! মৃত কাশেমের পক্ষেও সে অভিযোগ করল তার আল্লাহকে।

প্রার্থনার এই আহ্বানে কী যেন শুনতে পেল ইউসুফ। সেটা কী, সে ঠিক বুঝতে পারল না। বিলের মাঝখান দিয়ে সে হেঁটে চলল। নীরবে ও আক্রোশে।

বিল থেকে উঠে গ্রামে পা রাখল। কয়েকটি ঘর ফেলে সে থমকে দাঁড়াল। সামনে বিধবা সর্বজয়ার বাড়ি। বাড়ির পেছনদিকে সুপুরির ছোট বাগান। আর একমাত্র মেয়ে দীপিতা। সে মাকে গীতা পড়িয়ে শোনাচ্ছিল। ইউসুফের মনে হলো সুরা ইয়াসিন পড়ছে বুঝি! ইউসুফ হারিয়ে যায়।

ইউসুফ!

একদিন সে বিলের মাঝ দিয়ে যাওয়া কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে গঞ্জে যাচ্ছিল। ঝাঁ ঝাঁ রোদ। পথে লোকজন নেই। দূর থেকে তাকে দেখে ভীত লোকজন পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ ধরে।

ইউসুফ দূর দিয়ে ঘুরে যাওয়া একটি মানুষ ও রোদের কাণ্ড দেখছে। সেই রোদও কি সরে যাচ্ছে? সূর্যও কি সামলে নিচ্ছে তার তেজ?

এ-সময় একটি গাড়ি একমাত্র কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে আসছিল। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে। গাড়ির লোকটি চেনে না কে ইউসুফ। কোনোদিন সে ইউসুফকে দেখেনি। শুধু নাম শুনেছে। সে জানত না সামনের লোকটি ইউসুফ।

‘দাঁড়া!’

গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। ইঞ্জিন তখনো চলছিল।

‘ইঞ্জিন বন্ধ কর!’

এবার লোকটি বুঝতে পারল সে কার সামনে পড়েছে। এক টুকরো মেঘ এসে সূর্যকে আড়াল করে দাঁড়াল। রাস্তার ধুলো আস্তে আস্তে সরে গেল। ওপাশের একমাত্র নিঃসঙ্গ বটগাছও ছায়ায় পড়ে নিজের ছায়া হারিয়ে ফেলল।

ইউসুফ হুকুম দিল, ‘নেমে আয়।’

 লোকটি একটুও বিরক্ত না হয়ে, একটুও দেরি না করে নেমে পড়ল। ইউসুফ পিস্তল বের করল। মেঘের জন্য পিস্তলের ইস্পাত থেকে ঝিলিক দেখা গেল না।

 ‘কোথায় তোর টাকার তোড়া? বের করে দে।’

 লোকটি হাসিমুখে বলল, ‘এজন্য এত কথা?’ লোকটি গাড়ি থেকে ব্যাগ খুলে টাকার তেরোটি বান্ডিল বের করে ইউসুফের হাতে উপহারের মতো করে তুলে দিল। বলল, ‘ঈশ্বরের কৃপায় এই টাকা আপনার পরিবারের মঙ্গল করুক। অভাব দূর করে দিক।’

ইউসুফ কথাগুলো শুনতে শুনতে কী যেন ভাবল! তার কাছে খুব নতুন মনে হলো কথাগুলো। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে এভাবে এতগুলো টাকা এত সহজে দেয়নি। লোকটা অন্যদের মতো ভয়ে একটুও কাঁপল না। কান্নাকাটি, চ্যাঁচামেচি কিছুই করল না। ওর ড্রাইভারটাও দুহাত স্টিয়ারিংয়ে দিয়ে বসে আছে। পিস্তল বা লোহার রড নিয়ে বেরিয়ে এল না। একটি কথাও বলল না।

‘তোর ব্যাগের মধ্যে আর কী আছে?’

‘ও হো! টাকার সঙ্গে ব্যাগটা দিতে ভুলে গেছি। তাইতো, ওগুলো আপনি নেবেন কী করে! ব্যাগের কাগজপত্রগুলো ব্যাগে থাকবে? না-কি নিয়ে নেব? ব্যাঙ্কের চেকবইও আছে। ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকা আছে। লিখে দিচ্ছি।’- এই বলে সে চেকবই বের করে, কলমটা নিয়ে গাড়ির উপরে ধুলোবালিতে রেখে খচখচ করে লিখে শেষ করল। চেকটা ছিঁড়ে ইউসুফের হাতে নিবেদন করল, যেন নৈবেদ্য।

‘এই নিন, এতে আপনার পরিবারের অভাব দূর হলে আমি বড় উপকৃত হবো। নিন, ব্যাগটাও আপনার কোনো কাজে লাগতে পারে। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।’

ইউসুফ ব্যাগের মধ্যে সব পুরে নিল। বটগাছটা সব দেখল। তার উঁচু ডালে একটা শিকারি বাজ বসেছিল, সে তীক্ষ্ম গলায় ডাক দিল। বটগাছের পাশের পুকুরে একটা বড় মাছ ঘাই মারল। ঘুপুৎ।

‘গাড়িতে আর কী কী আছে!’

‘ও হো! বড় ভুল হয়ে গেছে। কোন দিকে যাবেন বলুন! ড্রাইভার আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেবে। গাড়িটাও কি আপনার দরকার? দরকার থাকলে রেখে দিতে পারেন।’

ইউসুফ গাড়িতে গিয়ে বসল।

লোকটি পেছনের সিটের একপাশে রাখা পদ্ম ফুলের তোড়াটা নিয়ে বলল, ‘এটা কি আপনার দরকার হবে? না হয় তো আমি নিই!’

‘তোর দরকার থাকে তো নে।’

‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।’- বলে লোকটি আফোটা পদ্মের গোছাটা দুহাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। ঋতুর প্রথম পদ্ম গঞ্জের ফুলের দোকানে পেয়ে অপসরার জন্য নিয়েছে। ভালো পাটের চালান কম এসেছে বলে বেশি কিনতে পারেনি। অন্য সময় তার লোক কেনাবেচা করতে আসে। আজ তার জ্বর হয়েছে বলে আসতে পারেনি। গঞ্জের একদিনের হাটে কেনাবেচা না করা ব্যবসায়ীর ধর্ম নয়। পদ্ম ফুলগুলো নিয়ে সে সামনের দিকে হাঁটতে যাবে তখন ইউসুফ কথা বলে উঠল।

‘শোন!’

‘গাড়িতে খাবার আছে। খিদে পেলে খেয়ে নেবেন। অর্জুনকে বলবেন, সে সব ঠিকমতো দেবে।’

‘তা নয়।’…

‘আমার এই কলমটা? ভুলেই গেছিলাম। চেক লিখে ওটা ব্যাগে রাখা উচিত ছিল। ২০ ক্যারেট সোনার কলম। এই নিন।’

‘তা নয়।’…

‘তবে কি ঘড়িটা? খুব ভালো ঘড়ি। নিখুঁত সময় দেবে। একটা মানুষের জীবন কেটে যাবে। এই নিন, দোষ নেবেন না। আপনার ছেলেকেও দিতে পারেন। মেয়েরাও আজকাল বড় ঘড়ি পরে।’

‘তা না।…’

‘গাড়ির লাইসেন্স ইত্যাদি সব অর্জুনের কাছে আছে। সামনে লাইসেন্স-বক্সে আছে সব। নাম পালটানোর ব্যাপারে আমি কোনো আপত্তি করব না। আমি কথা দিলাম। তোমার কোনো অসুবিধা আমি করব না। ঈশ্বরের নামে আমি শপথ করছি।’

 লোকটি নিজের অজান্তে ইউসুফকে তুমি সম্বোধন করল। ইউসুফ সেদিকে নেই। কিন্তু তার কাছে কেমন যেন লাগছে। এমন শিকার সে এই জীবনে পায়নি। লোকটির ব্যবহার সুন্দর। ভয় পেয়েছে বলা যায় না। একেবারে পায়নি তা-ও কি হয়? লোকটার মনে কী আছে সেটাও বোঝা মুশকিল! লোকটা নিজেকে ব্যবসায়ী বলছে। লোকজনকে তার মতো ঠকিয়ে টাকার পাহাড় গড়েছে। ফুলগুলো কার জন্য নিয়ে যাচ্ছে সেটা জানা দরকার। তার চেয়ে নামটা কী সেটা জানা বেশি জরুরি। লোকটাকে কোনোদিন সে দেখেনি। কোথাকার লোক হতে পারে? ঘরে কে কে আছে? দেখে মনে হচ্ছে ছেলেপুলে বড় হয়েছে। শেষে ঠিক করল নামটা জানলেই হবে।

‘শোন!’

 লোকটি দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘আর তো কিছু সঙ্গে নেই আমার। ওহো, আমার পোশাক? জুতো জোড়া চাই?’

‘না।’

‘তবে কি আমাকে মেরে ফেললে খুশি হবে?’

‘চুপ কর!’

‘…’

‘তোর নাম কী?’

‘নামে কী আসে যায়? কী হবে তোমার জেনে? জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে যাওয়া এক মানুষ। তোমার মতো, সবার মতো। পথের পাশের ওই বটগাছটাও মরবে একদিন।’

‘মৃত্যুকে ভয় পাস?’

‘পাই। আবার পাই না-ও হয়।’

‘কী রকম?’

‘কুপিয়ে কুপিয়ে মারলে, হাত-পা একে একে কাটলে খুব কষ্ট। সেভাবে মরতে চাই না। ভয় পাই। গুলি করে মারলে, মাথায় একটা গুলি মেরে দিলে ভয় নেই। মারব মারব, মরব মরব Ñ এরকম ঝুলন্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ অনিশ্চয়তায় থাকতে হলে ভয়ের কথা।’

‘তোর বউ?’

‘ওটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন খুনের আসামিকেও আদালতে সব প্রশ্ন করা ন্যায়সঙ্গত হয় না। তাছাড়া এই নির্জন জায়গায় কোনো মেয়েকে টেনে না আনাই ভালো। অনৈতিক ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।’

‘ফুলগুলো কার জন্য?’

‘…’

‘বল?’

‘অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। অপ্রয়োজনীয়ও।’

‘ফুলের নাম কী?’

‘নেলুম্বো ন্যুচিফেরা গার…’

‘আর দরকার নেই। রং কেমন?’

‘নীল।’

‘জঘন্য। নীল রং আমার অসহ্য।’

‘দুনিয়ায় এরকম মানুষ আছে। কেউ কেউ আম পছন্দ করে না।’

‘চুপ কর।’

‘…’

 লোকটি জানত না যে ইউসুফ আম পছন্দ করে না। এখন জানতে পেরে চুপ করে গেল। সে হাঁটতে লাগল। রাস্তার এদিকে-ওদিকে শূন্য বিল। ইরি ধান কাটা হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। এত রোদ ও গরম যে একটা গরু-ছাগলও নেই। মানুষ নেই। একটা হট্টি-হট্টি পাখি কর্কশ চিৎকার করে বিল পাড়ি দিচ্ছে। অনেকক্ষণ লাগছে তার। করুণ।

ইউসুফ হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে লোকটিকে খুঁজতে লাগল। লোকটি তখন রাস্তা ছেড়ে বিলে নামছে। ইউসুফ ওকে থামতে বলল। লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। সে ঘেমে গেছে। মাথার ঠিক উপরে সূর্য। গনগনে। যেতে যেতে ইউসুফ দেখল তার ছায়াটি নেই। সে তখন লোকটিকে কী বলতে ডেকেছিল সে-কথা ভুলে গেল। সে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। বলার কথা খুঁজে পেল না। ইউসুফ তখন ভাবল, ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের চেয়ে লোকটির শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? কেন তাকে বড় মনে হচ্ছে? তার নিজের বলার কিছু রইল না কেন?

লোকটি তখন বলল, ‘তোমার বলার কিছু না থাকলে আমিই বলি?’

ইউসুফ এবার একটা কথা খুঁজে পেল, ‘না।’

‘ভয় পেয়েছ?’

‘না।’

‘মৃত্যুর কথা মনে পড়েছে?’

‘না।’

‘জীবনের অন্ধকার দিক জ্বলে উঠেছে?’

‘না।’

‘বিয়ে করোনি?’

‘না।’

‘ঈশ্বরের কথা মনে পড়েছে?’

‘…’

‘মা-বাবার কথা?’

‘…’

‘পরকাল?’

‘…’

‘কার জন্য এত করছ?’

ইউসুফ এবার রেগে গেল তপ্ত রোদের মতো। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে শত্রুর মতো। লোকটি এবার তার কাছে অসহ্য হয়ে গেল। ইউসুফ প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে ফেলে দিল, বিলের খোঁচা খোঁচা শূলের মতো উদ্যত নাড়ার উপরে। লোকটি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল এক বিঘৎ পরিমাণ উঁচু নাড়ার উপর। শরশয্যা যেন, হাত-পা ছড়িয়ে লোকটি সেখানে শুয়ে আছে আর ইউসুফকে দেখছে, যেন লোকটি ভেসে যাচ্ছে…।

এই প্রথম ইউসুফ তার ছোরা বা পিস্তল চালাতে ভুলে গেল। হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। আর যদি পেয়ে থাকে তাহলে জীবনে এই প্রথমবার। ইউসুফ তাড়াতাড়ি ফিরে চলল। লোকটির গায়ে ধবধবে সাদা আধা আস্তিনের জামা ও সাদা পাতলুন। রোদ পড়ে সাদার ধাঁধা সৃষ্টি করেছে; এত সাদা যে তাকানো যায় না। এত শুভ্র জ্যোতি বিকিরণ করছে যে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। গনগনে একখণ্ড শ্বেত বস্ত্র সেখানে পড়ে আছে। মধুর কোনো স্বপ্নের মতো, সফল উত্তীর্ণ হওয়া পরীক্ষার্থীর মতো। ইউসুফের মনে পড়ল কাফনের সাদা নতুন কাপড়ের কথা, কিন্তু কার সেটা মনে করতে পারল না।

ইউসুফ!

ইউসুফ জানে বেড়ার ঘরের ভেতর মা ও মেয়ে আছে। আজ সে শেষটা দেখে নেবে। এতদিন সে অপেক্ষা করেছে, সময় দিয়েছিল একমাস। কিন্তু মেয়েটির মা একমাসের মধ্যে মেয়েকে ইউসুফের হাতে তুলে দেয়নি। ছিপছিপে শ্যামল লম্বা মেয়েটি। ইউসুফের মনের মাঝে ঝড় তুলেছে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো, আঁটি বাঁধা তুফানের মতো, শিকারি বাজের তীক্ষ্ম চিৎকারের মতো।

 মেয়েটির নাম দীপিতা। মায়ের একমাত্র মেয়ে। ভিটের সুপুরি বিক্রি করে ওদের চলে। দীপিতার কারণে ইউসুফ এতদিন দীপিতাদের সুপুরি গাছের সুপুরি ছিনিয়ে নিয়ে যায়নি। বড় বড় মটকায় ভেজানো     সুপুরিতে থাবা মেরে বসেনি।

দীপিতার বাবা নেই, ভাই নেই। বিধবা মা সর্বজয়া মেয়েকে আগলে রেখেছে বাঘিনীর মতো। কোনো মতে সংসার চলে যায় ভিটের আয় থেকে। তবুও চলতে চায় না। ইউসুফ সাহায্য করতে আসে দীপিতাকে পাওয়ার আশায়। ভয় দেখায়। দীপিতাকে ওর হাতে তুলে দিতে বলে। কাজির কাছে গিয়ে ধর্মমতে বিয়ে করে নেবে। না দিলে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে। তুলে নিয়ে যাবে। শুনেই ভিটের সুপুরি গাছগুলো মাথা নেড়ে, এ ওর গায়ে পড়ে আশ্রয় খোঁজে, একে অন্যের গায়ে বাড়ি মেরে প্রতিবাদ ও রাগ প্রকাশ করে। পুকুরপাড়ের বড় বড় বৃষ্টি শিরীষ গাছের আগার ডালে বসে কুরকাল ডাক পাড়ে।

ইউসুফের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়ে যায়।

গ্রামের ভরত, কমল, রঘুনাথ সব কথা শুনেছে। ইউসুফের কাছে ওরা খড়কুটোরও অধম। মহব্বত আলী মেম্বারও চুনোপুঁটি। ইউসুফের বিরুদ্ধে আড়ালে-আবডালে কিছু বলার হিম্মত তারও নেই। ওর আশীর্বাদ নিয়েই সে মেম্বার হয়েছে, সেই চেয়ার রক্ষা করে আছে। নিবারণ বিশ্বাস, সুধীর সাহা, যামিনী কবিরাজ বা সুখলাল চৌধুরী নিয়মিত চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করছে। ইউসুফের কড়ে আঙুলটা কাঁপলে গাঁয়ে গাঁয়ে ভূমিকম্প হয়ে যায়।

সর্বজয়া ভেবেছিল দীপিতাকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাবে। আবার মনে মনে বলল, না, আমি যাব না। এই গ্রামের শ্মশানেই শেষ বিশ্রাম নেব। রাধামাধবকে ডাকল সে। মনে মনে বলল, ঈশ্বর সহায়। ঈশ্বর তুমি এসে দেখে যাও। রক্ষা করো।

ইউসুফের চাপ দাড়ি, মণিবন্ধের ঘড়ি ও চেন, তীক্ষ্ম বড় বড় চোখ, ইন্দোনেশীয় লুঙ্গি, কোমরের ছয় গুলিভর্তি আমেরিকান পিস্তল গ্রামবাসীরা ভয়ের চোখে একবার দেখে আবার চোখ বুজে থাকে। ওকে দেখলে মায়েরা শিশুকে বুকে চেপে ধরে, তরুণী মেয়েরা লুকিয়ে পড়ে, পুরুষেরা ভয়ে কাঁপে। সবার কাছে সে যেন খুনির তীক্ষ্ম তলোয়ার অথবা প্রহারের চাবুক। বিষধর গোখরোর হিসহিস!

ঘরের দরজার সামনে গিয়ে ইউসুফ ডাক দিল, ‘দীপিতা! দিলরুবা!’

এক ডাকেই মা ও মেয়ে সব বুঝে নিয়েছে। ওরা চুপ। ঘরের দরজা বন্ধ।

পাঁচ ঘড়ির অন্ধকার অথবা কৃষ্ণপক্ষের নবমী। ঝিরি ঝিরি হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় প্রথম ফোটা কামিনীর সুবাস। হাওয়া ও সুবাস বন্ধ হয়ে গেল।

ইউসুফ আবার ডাক দিল, ‘দীপিতা, আমার ভাবী বউ, দরজা খোল। তোর নাম রাখব দিলরুবা।’

সর্বজয়া রামদা হাতে তুলে নিল। দীপিতার কামিজের নিচে ছোরা গোঁজা, যেন পূর্বঘোষিত যুদ্ধে চলেছে। ইউসুফ একা। একাই একশ। সে দাওয়ায় উঠে দরজা লাথি মেরে ভাঙবে ভাবল। খারাপ গালি মুখের শেষপ্রান্তে চলে এসেছে। কিন্তু ভাবী বধূর জন্য ওটা খরচ করা যায় না, এইটুকু সে জানে। কিন্তু এই দুটি অসম বয়সী 888sport promo code এত সাহস কোথায় পায়! ঘরে কি আর কেউ লুকিয়ে আছে? কার এত বুকের পাটা! ইউসুফ স্বভাববিরুদ্ধ শঙ্কা বা সন্দেহ করে বসল।

সর্বজয়া বলল, ‘দরজা খুলব না।’

‘মেয়েকে বের করে দে।’

‘না। মেয়ে আমার।’

‘কাজির কাছে গিয়ে বিয়ে করব।’

‘না। আমার মেয়ে হিন্দু।’

‘বিয়ে না দিলে তোর সামনে লজ্জা হরণ করব।’

দাওয়ায় উঠে সে লাথি মারল। তার মুখের উপর এরকম কেউ কোনোদিন করেনি, কোনো মেয়ে না, এমনকি পুরুষও নয়।

দরজা সর্বজয়ার পক্ষ নিল। আবার লাথি মারল। দরজা অনড়, অবিচল। দু ইঞ্চি পুরু কাঁঠাল কাঠের দরজা। সর্বজয়ার স্বামী মেয়ে ও স্ত্রীর পাহারায় একে নিয়োগ করে গেছে। মাটি খুঁড়ে চৌকাঠ না খুললে নড়বে না। ভাঙবেও না।

ঘরের পেছনের বুড়ো লিচু গাছের শালিকগুলোর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম মুছে নিয়ে প্রথমে সব শুনল। তারপর চ্যাঁচামেচি জুড়ে ডাকল। একসঙ্গে অনেকগুলো শালিক। সকাল-সন্ধে অনেকক্ষণ ধরে ঐকতান ধরে। সুরেলা, ঝঙ্কারময়, নিক্কন মনে হয়। কুলগাছে থাকে তিরিশ-চল্লিশটা চড়ুই। ওরাও প্রতিবাদে যোগ দিল। দুটি শেয়ালও।

ইউসুফ একটা গাল দিল দীপিতার মাকে। তারপর বলল, ‘তাহলে ঘরের ভেতর থেকে অন্যভাবে বের করছি। ইউসুফকে চিনে রাখ।’

দীপিতা মাকে ধরে বলল, ‘এখন কী করবে?’

‘প্রাণ দেবো, তবুও মান দেবো না।’

কিন্তু ওরা বুঝতে পারেনি নদীর পানি কোনদিকে গড়াচ্ছে। নিচের দিকে, না-কি টিলা বেয়ে! সাগরে, অথবা মরুতে!

 পেছনদিকে চালের সঙ্গে লাগোয়া একটা সুপুরি গাছে তরতর করে উঠে পড়ল ইউসুফ। চালের ছনে লাইটার জ্বেলে আগুন ধরিয়ে দিল। শুকনো খনখনে ছন আগুন পেয়ে উল্লাস শুরু করে দিল। মাটির ঘরের উঁচু চাল, কিন্তু ঘর খিলানো নয়। দীপিতার বাবা পারেনি। মৃত্যু তখন তার দিকে তাক করে শিকারে বসেছিল। মাটির ঘরে বেড়ার ছাদ দিয়েছিল।

দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। হামলে পড়ল হাওয়া।

দীপিতা ডাকল, ‘মা, মা!’

হাতড়ে হাতড়ে দরজার সবগুলো হুক খুলল। ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে।

দীপিতা মায়ের পেছনে। ইউসুফ উঠোনে এসে দাঁড়াল। পাশের বাড়ির বাদল প্রথমে আগুন দেখতে পেল। সে চিৎকার করে উঠল ‘আগুন আগুন’ বলে। লোকজন আসতে শুরু করল। ইউসুফকে উঠোনে দু হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মুখে সিগারেট। তপ্ত ও গলিত সোনার মতো আগুনের শিখা।

বাদল ডাক দিল, ‘মাসিমা? দীপিতা?’

‘এই শুয়োরের বাচ্চা’ – বলে ধমক দিল ইউসুফ।

 তেমিয়কুমার আমতা আমতা করে চুপ করে গেল।

‘কুত্তি দুটা এখুনি বেরিয়ে আসবে। একটাকে নিয়ে যাব’ – বলে ইউসুফ হাঁ করে রইল।

দরজা খুলে সর্বজয়া ও দীপিতা বেরিয়ে এল। গুনে গুনে উনিশ-কুড়ি কদম এসে দুজনে দাঁড়াল। একজনের কুড়ি, অন্যজনের উনিশ। আরো দশ পা দূরে ইউসুফ। তারপর বাদল, তেমিয়কুমার। তাদের পাশে তোতলা আবু মোনাফ, লম্বা কুদ্দুস ও বুড়ো মোতালেব। রজনী, সুপলাল, মতির মা, দুলু মিয়া অনেকে এসে গেছে। কেউ আগুন নেভাতে সাহস করে এগিয়ে যাচ্ছে না।

ইউসুফ আস্তে আস্তে কেমন যেন ভড়কে গেল মনে হয়। সে অর্ধেক গাল দিয়ে সর্বজয়াকে বলল, ‘মেয়েটাকে দে।’

‘আমার ঘর গেছে। কিন্তু মেয়ে পাবি না।’

‘ভিটে খুঁড়ে ফেলব। পুরো গ্রাম জ্বেলে দেব।’

‘তবুও পাবি না।’

তারপর চিৎকার করে ইউসুফ বলল, ‘গ্রামবাসী বুড়ো-বুড়ি, মেয়ে-পুরুষ, শোন তাহলে। আমি সবার সামনে মায়ের হাত থেকে মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।’

ইউসুফের চেলা কাদের, মোল্লা ও ফেচু এসে পাশে দাঁড়াল। ওদিকে আগুন জ্বলছে। চালের বাঁশের গিরা ফেটে শব্দ হচ্ছে। হাওয়া ছুটে আসছে চারপাশ থেকে। এতক্ষণ হাওয়াই ছিল না। পাড়ার কুকুর এসে চিৎকার জুড়ে দিল। বাগানের শালিকগুলো অন্ধকারে উড়ে চলে গেছে কোথায় কোনদিকে। চড়ুইগুলোও।

ইউসুফ এগিয়ে গেল দীপিতার দিকে। কী যেন বলতে গেল। সর্বজয়া ডান হাতে রামদা বাগিয়ে ধরল, বাঁ হাতে ধরল মেয়েকে। মুখে বলল, ‘খবরদার। এক পা এগুবি না।’

ইউসুফ থমকে দাঁড়াল। কাদের ও মোল্লা পাশে এসে দাঁড়াল।

‘বাঘিনীর বাচ্চার গায়ে হাত দিবি না।’

ইউসুফের পা মাটিতে আটকে গেল। মোল্লা, ফেচু ও কাদের বাক্য ভুলে গেল। পাড়ার মানুষ যে যেখানে আছে সেখানে স্থির। বুড়ো মোতালেব হাতের লাঠি চেপে ধরেছে জোরে। মোচড়াচ্ছে। মোনাফ কী যেন বলতে গিয়ে গোঁ গোঁ করছে।

সর্বজয়া দীপিতার হাত ধরে বলল, ‘চল মা। এখানে বেঁচে থাকার চেয়ে তোর বাপের দিনের ঘরের আগুন ভালো।’

দীপিতা তাকাল মায়ের মুখের দিকে। দেখল মায়ের চোখ গনগন করে জ্বলছে। মায়ের হাত থেকে শক্তির তরল স্ফুলিঙ্গ নিজের শরীরে প্রবেশ করছে। গলা দিয়ে যেমন পানি নেমে পেটে যায়, কালবোশেখির ঠান্ডা হাওয়ার পরশ যেমন তপ্ত শরীরে বুলোয়…।

মা ও মেয়ে হেঁটে চলল ঘরের দরজার দিকে। ঘরের পুরো চালে আগুন। মাঝে মাঝে ভেঙে পড়েছে নিচে। কাঠের দরজা ঠেলে ধোঁয়া বের হচ্ছে তীব্র স্রোতের বেগে, বাঁশখালির বঙ্গোপসাগরের গর্কির ঢেউয়ের উন্মত্ততায়… মা ও মেয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে হেঁটে চলল। ইউসুফের পা আটকে গেছে। বুড়ো মোতালেব দু কদম সামনে এগিয়ে গেল। লেদু ও ফেচু অস্ফুট গলায় বলে উঠল, ‘হায় আল্লাহ!’ আগুনের শব্দে ওদের বিস্ময় ডুবে গেল।

দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল মেয়ে ও মা। ইউসুফ নিজের অজান্তে হাতটা বাড়িয়ে দিল। দেবতারা এসে দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে দিল।

বাতাসের ঝাপটা এল জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের শক্তিতে। গলিত সোনা আকাশে উৎক্ষিপ্ত হলো গনগন শব্দে।

ইউসুফের হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে শব্দ হলো। পরিচিত গ্রামবাসীরা সেই শব্দ শুনতে পেয়ে দস্যু ইউসুফের দিকে এগিয়ে চলল। ইউসুফ গলা ঝাড়ল। সে দীপিতাকে বারণ করতে চেয়েছিল। গলায় স্বর ফুটল না।

ঘরের চাল আগুন ও ধোঁয়া নিয়ে ঘরের উপর ভেঙে পড়ল। পুড়ে ছাই হয়ে যেতে যেতে প্রজাপতির পাখার রেণুর মতো স্বর্ণভস্মে রূপান্তরিত হতে লাগল।

মা ও মেয়ের কাপড় পুড়ল প্রথমে। তারপর কপাল ও গায়ের ত্বক। দীপিতার কোমরের ফিতের বন্ধনী পুড়ছে। তার নিচের থেকে অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। মা ও মেয়ে তখন আলিঙ্গনাবদ্ধ। জগতের সমস্ত সৌন্দর্য তখন ওদের ঘিরে ধরেছে তা কেউ দেখল না। কোনোদিন দেখতে পাবে না।

বাইরের লোকগুলোর মধ্যে গুঞ্জন উঠল। বুড়ো মোতালেব বিড় বিড় করে বলল, ‘শত্রুর কোনো কিছুরই না আছে অর্থ, না আছে সৌন্দর্য।’

বাদল চমকে উঠে দেখল, ‘কে বলল?’

বুড়ো মোতালেবের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে কলকল শব্দে। হ্যাঁ, সেই শব্দ শুনতে পেয়ে সে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। বুড়ি, ছেলেপুলে, মেয়েরা সবাই এগিয়ে চলল।

 লেদু ও ফেচু চলল। দৃঢ় তাদের পদক্ষেপ।

ওরা সবাই দীপিতার পক্ষের সৈন্য হয়ে গেল। ওরা শুনতে পেল, ‘মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

আগুন থেকে কী করে কথাগুলো হেঁটে এসে ওদের জানিয়ে গেল ওরা বুঝতে পারল না। ওরা অস্থির হয়ে পড়ল। ওদের ভেতরটা ঘরের মতো পুড়ছে।

একটু পরে আবার শুনতে পেল, ‘মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

মা বলল, ‘এই তো! আর একটু সহ্য কর, মা! এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে।’

মাটির ঘরের পোড়া দেয়ালগুলো শুধু দাঁড়িয়ে রইল। সব শেষ হয়ে গেল। তপ্ত হয়ে রইল চারদিক। অন্ধকার হয়ে এল চারদিক। বঙ্গোপসাগরে রাতের শান্তি বয়ে যাচ্ছে। কখন চাঁদ উঠে দশ-বারো বাঁশ উঁচুতে ঝুলে আছে ওরা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ইউসুফ যে অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ করেছে তাতে তারা একমত। আক্রোশে তপ্ত হয়ে উঠছে তারা…।

ইউসুফ!

উঠোন থেকে বেরিয়ে একশ কদমও যেতে পারেনি। হোঁচট খেয়ে কুয়োয় পড়ে গেল। ওটা লঙ্কা ও বেগুন খেতে পানিসেচের জন্য। ইউসুফের প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছিল। এখানে কুয়ো আছে তা-ও জানে। কুয়োর পাড়ে আধ ভাঙা বালতিটা দড়িতে বাঁধা। চাঁদের ম্লান আলোয় চারদিক ঘোলাটে হয়ে আছে। বোশেখের রাতেও কুয়াশার জাল দেখা যায় গ্রামে। মায়াজাল।

কুয়োতে পড়ে সে হাত-পায়ের ঠেকা দিয়ে ভেসে থাকবে বলে ঠিক করল। হাত বাড়িয়ে দিল কিন্তু শক্ত ভেজা কাঁকরময় মাটিতে ধরার মতো কিছু পেল না। ইউসুফ হাতড়ে হাতড়ে খুঁজল। কিছু পেল না। কুয়োর দেওয়াল নরম হলে হাতটা ঢুকিয়ে দিয়ে ঝুলে থাকতে পারত ভাবল। মাথা ও পা ঠেকিয়ে চিৎ হয়ে ভেসে থাকতে পারত। কিন্তু কুয়োর বেড় তার থেকে বড়।

বুকটা ধাঁ করে শুকিয়ে গেল। ধড়ফড় করতে লাগল। আর ভেসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তার শক্তির উপর এতদিন যে-আস্থা ছিল তার একভাগও সে কোথাও খুঁজে পেল না। চিৎকার করে উঠল ‘আল্লাহ’ বলে। সে জানে আল্লাহ তাকে কোনোরকম সাহায্য করবে না। তবুও ডাকল। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে অদৃশ্য সাহায্যকারীর কাছে ডাক পাঠাল। নিচ থেকে সে কাউকে তো দেখতে পাচ্ছে না! তবুও ডাকল। যদি কেউ শুনতে পায়!

কুয়োর তলায় সে শুয়ে আছে। সে বুঝতে পারল সে মরে গেছে। তার তীক্ষ্ম বড় বড় চোখদুটো দিয়ে দেখছে কুয়োর মুখে সাত-আটটি মুখ। অন্ধকার থেকে সে সকলকে দেখতে পাচ্ছে। কাউকে সে চিনতে পারছে না। সবাই আলখাল্লা পরে আছে, মুখে শ্বেতশুভ্র দাড়ি, মাথায় সাদা কাপড়। রোদ থেকে বাঁচার জন্য? উপরে কি রোদ? সূর্য উঠেছে? না-কি চাঁদ। ওরা কি তার জানাজায় অংশ নিতে এসেছে? রাত না দিন!

পাপ, না-কি পুণ্য!

জীবনে সে কোনো পুণ্য কাজ কি করেছে? নাফরমান।

ঠিক কথা।

দীপিতাকে সে বিয়ে করত কিন্তু চিরদিনের জন্য নয়। তার অভিজ্ঞ লিপ্সা পূর্ণ হলে সে তাকে ছুড়ে ফেলে দিত। দীপিতার নতুন নামও সে ঠিক করে রেখেছিল। দিলরুবা।

কুয়োর উপরের মুখগুলোর অনেক পেছনে এক টুকরো মেঘের মতো ছেঁড়াখোড়া আকাশ আছে দেখল। এত বড় আকাশটাও তার জন্য রইল না।

কিছুই তার জন্য নেই। কবুল করতে হলে তার গায়ে বেইমানের ছাপ পড়বে। সাঙাতরাও একে একে ছেড়ে গেছে তাকে।

কুয়োর মুখগুলো একটুও ভয় পাচ্ছে না তাকে। বেদীন। বেশরা।

ভয় দেখাবার ক্ষমতাও তার নেই।

কুয়োর পাড় থেকে একজন বলল, ‘লোকটি এখনো কবরই পায়নি।’ অন্যজন বলল, ‘লোকটি গুনাহগার। সে যত দিবস মৃত্যুপ্রাপ্ত হয়েছে তত দিবস আল্লাহর শাস্তিতে ধৃত রয়েছে।’

আর একজন বলল, ‘এই আজাব থেকে মুক্তি পাবার যোগ্যও সে নয়।’

প্রথমজন বলল, ‘কেন? আমরা তার জন্য দোয়া পড়তে পারি।’

দ্বিতীয়জন বলল, ‘তার জীবনে কোনো ভালো কাজ নেই।’

তৃতীয়জন বলল, ‘আমরা খুঁজে দেখি।’

আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখল তারা। এমনকি তার খারাপ কাজের জন্য মর্মবেদনাও তার মধ্যে ছিল না। অনুতাপ কখনো হয়নি। শুধু হত্যা করেছে। টাকা, সোনা-গয়না লুট করেছে। দানধর্ম করেনি; ইহকাল-পরকাল কোনোকালের জন্য কিছু করেনি। বিয়েও করেনি, ছেলেও নেই। কে তার জন্য দান-খয়রাত বা দোয়া করবে!

‘সর্বজয়া ও দীপিতা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।’ Ñ পাড়ার লোকেরা বলতে লাগল। কুয়োর পাশে তারা বলাবলি করছে। তখনো ভোর হয়নি। একজন বলল, ‘বিধর্মীর সাক্ষীর মূল্য নেই। দুজন বিধর্মী সমান একজন ইমানদার।’ অন্যজন বলল, ‘কোনো ইমানদার তার পক্ষে কি সাক্ষ্য দেবে?’

‘সে ঠিক কথা অবশ্য।’ পাড়ার প্রবীণ লোকটি আবার বলল, ‘ওর নিজেরই ইমান নেই।’

‘আরতির বিধবা মেয়েটি তার জন্য গলায় দড়ি দিয়েছে।’ ‘সোমনাথের ভিটের সব গাছ কেটে নিয়ে গেছে ইউসুফের ইঙ্গিতে।’ ‘অন্তত দশটা খুন সে নিজের হাতে করেছে। অনেকের পুকুরের মাছ শেষ হয়েছে।’

ইউসুফ!

ওদিকে সাদা আলখাল্লা পরা লোকগুলোর চেষ্টায় ইউসুফকে কুয়ো থেকে তোলা হলো। পানিতে ডোবা মানুষের প্রাথমিক সেবা যেভাবে করতে হয় তারা করল। পেট থেকে পানি বের করল। তেষ্টার অতিরিক্ত পানি সে খেয়েছিল। বাধ্য হয়েছিল।

আশ্চর্য! নিশ্বাস ফিরে এল! আলখাল্লা পরা লোকগুলো চলে গেল। কথা বলল ইউসুফ। ভোরের কাকের ডাক শুনল। পাড়ার লোকজন কেউ নেই। চলে গেছে। গরম দুধ খেল। নিজের হাতে মুখ মুছল। জাফরি কাটা পাতার সরসর শব্দ শুনে বলল, ‘ওটা নারকেল পাতার শব্দ।’ এমন সময় পাড়ার একটা ছেলে ইউসুফের পিস্তলটা এনে দিল। ওটা গতরাতে সে দীপিতাদের উঠোনে ফেলে এসেছিল।

ইউসুফের মা-বাবা মুখ ফিরিয়ে রইল।

ইউসুফের বোন সুরাইয়া দীপিতার সমবয়সী। একই ক্লাসে পড়ে। ওরা বন্ধু। দীপিতার মর্মান্তিক ঘটনা আগাগোড়া সে শুনল।

সুরাইয়া !

দীপিতার জন্য সারা সকাল সে মনে মনে কাঁদল।

দীপিতা ও সর্বজয়ার আধপোড়া লাশদুটি পাড়ার লোকেরা চিতা সাজিয়ে বাকি কাজ শেষ করল। শ্মশানে নিয়ে যাবার আগে মৃতদেহকে তেল মেখে স্নান করাতে হয়। পাড়ার মেয়েরা তা-ও করল। সর্বজয়ার আদ্যকর্ম করল প্রতীক হিসেবে। দীপিতার পোড়া কপালে একজন সিঁদুর পরিয়ে দিল। ওর নাম অসীম। সে খুব কাঁদল। সুরাইয়া খুঁটে খুঁটে সব শুনল। দীপিতার দেওয়া দেবদাসী বইটা নেড়েচেড়ে দেখল। অনেকক্ষণ।

ইউসুফের মা-বাবা একবারও ওর ঘরে গেল না। রাত নামল। সুরাইয়া চোখ মুছে ইউসুফকে রাতের খাবার দিল।

ইউসুফ পিস্তলটা বোনের দিকে বাড়িয়ে দিল বলল, ‘নে, এটা ও-ঘরে রেখে দে।’

‘ওটা তো তোমার কাছেই থাকে।’

‘আজ রাখব না। ভয় করছে।’

‘কেন? মরতে তুমি ভয় পাও?’

‘মারতে যখন পারি মরতেও পারা উচিত নয়।’

‘কী করে মারতে হয়?’

‘এটা লোড করা। গুলিভর্তি আছে। একের পর এক ছয়টা।’

‘দেখা যায় না?’

‘যায়। এভাবে ট্রিগারে টান দিতে হয়’Ñ বলে ট্রিগারে টান দিল।

‘কই, গুলি তো হলো না। বললে যে লোড করা!’

ইউসুফ তখন সেফটি ক্লাচ অন করে দেখাল।

সুরাইয়া ইউসুফের তর্জনীর উপর তর্জনী রাখল। ইউসুফের তর্জনী ট্রিগারের উপর। সুরাইয়ার মনে পড়ল অসীমের কথা। দীপিতার কারণে অসীমের কথা মনে করল। অসীম খুব খুব ভালো ছেলে। বাঁশখালী কলেজে পড়ে। ভালো ছাত্র। সুরাইয়ার সঙ্গে তিনবার কথা হয়েছে। প্রত্যেক বার সঙ্গে দীপিতা ছিল। অসীমের সুন্দর হাসি সে দেখতে পেল। মনে মনে ডাকল।

সুরাইয়া আস্তে আস্তে পিস্তলের নলটা ইউসুফের বুকের দিকে ঘোরাতে লাগল। নিচে ইউসুফের হাত, উপরে সুরাইয়ার। ট্রিগারের উপরে ইউসুফের তর্জনী, তার উপর সুরাইয়ার।

সুরাইয়া দীপিতাকে ডাকল। অসীম আকাশকে ডাকতে বাধ্য হলো।

ইউসুফের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে দেখাল। মনে একটুও জোর নেই। সে নিজেই বুকের বাঁ দিকে     পিস্তলের নল ঠেকাল। হৃৎপিণ্ডের মাঝখানে। সাইলেন্সার বসানো খুব দামি অস্ত্র। অদ্ভুত একটি শব্দ হলো। সুরাইয়া বুঝতে পারল না সে তার তর্জনীতে চাপ দিয়েছিল কি-না। সর্বনাশ!

সঙ্গে সঙ্গে হাতটা তুলে বাঁ হাতটাও নিয়ে নিজের চোখ চেপে ধরল। চিৎকার করে উঠল। গোলাঘরে তক্ষকটা ডাক শুরু করল। সুপুরি গাছে বাদুড়।

ইউসুফের হাতে অস্ত্র ধরা। নল বুকে ঠেকানো। রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। বিছানায় পড়ছে। পাশে খাবারের থালা। নরম ভাত। মরলা মাছের ঝাল। জিরে বাটা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল।

মা-বাবা ও-ঘর থেকে ছুটে এল।

-০৭/০৬/২০০৪