\ ১২ \
হাইভি এক সুবিশাল বাজার। যে যার মতো ঠেলাগাড়ি নিয়ে ছুটতে শুরু করল রাইটাররা। অমলিনীও একখানা ঠেলাগাড়ি নিলো। আমি শূন্য শরীরে, হাওয়ায় হাওয়া হয়ে মিশে তার পাশে পাশে রইলাম। সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। ব্রেড ফ্যাক্টরি থেকে সে চাল ও 888sport app দ্রব্য খরিদ করেছে। আজ কী কেনে?
হাইভি যেন বিপণি নয়, এক শহর। ঝকঝকে, ঝলমলে, রঙিন। অমলিনী ইতিপূর্বে যখন আমেরিকা আসে, তখন ওয়ালমার্ট, আলডি, কোট ফ্যাক্টরি, টার্গেট, মাইয়ার প্রভৃতি বাজার ঘুরে দেখেছে। কোলস বাজারে গিয়েছে বহুবার। কিন্তু হাইভি এই প্রথম। বিগ লট নামে এক মাঝারি মাপের বাজার সে খুবই পছন্দ করেছিল। খাদ্যদ্রব্য হিসেবে কাঁচা ফল, সবজি, মাছ বা মাংস সেখানে পাওয়া যায় না, কিন্তু সংসারের 888sport app প্রয়োজনীয় বস্ত্ত নানান দামে পাওয়া যায়। আলডি সে পছন্দ করেনি। কেমন যেন গরিবিয়ানা আছে ওই বাজারে! পণ্যগুলি কম মূল্যে মেলে কিন্তু ঠিক যেন ভরসা হয় না। বাকি সব বাজারই মধ্য ও উচ্চবিত্তের। অথচ হাইভি যেন শুধুই উচ্চবিত্তের। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রামেত্ম হেঁটে যেতেই দশ মিনিট লাগবে।
অমলিনীকে তাড়া দিলাম আমি। আমার সেই ইচ্ছে তার চুলের কুচি উড়িয়ে দিলো। সে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল ফলের সম্ভারে। দীর্ঘ টেবিলের দুপাশে খোপ কাটা। প্রত্যেক খোপে নানাবিধ ফল। ফল আমার ভারি পছন্দের। আমি আনন্দে দ্রব হয়ে গেলাম দেখে চেরি, কিউই, বস্নু বেরি আর স্ট্রবেরি নিল অমলিনী। সবই আমার পছন্দের! আমি স্বাদ হয়ে ঢুকে পড়ব অমলিনীর জিভের কোরকে। ফলরসে তৃপ্ত হবো আমি!
আল্লাহ, আমাকে দেহ ধারণ করতে দাও। আববাজান আমাকে মাটির শরীর থেকে করে দাও রক্তমাংসের!
ফল নিয়ে সে গেল সবজির কাছে। শাকপাতা, লংকা, টম্যাটো নিল। পায়ে পায়ে চলে যাচ্ছে যেখানে সালামি আর সসেজ বিক্রি হচ্ছে। দুরকমই আছে। কাঁচা সালামি, সসেজ – সেদ্ধ করো, বা ভেজে খাও। আবার সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত সালামি, সসেজ। মুরগির, গরুর, শূকরের। সে নিল মুরগি ও শূকর। নিল আধরাঁধা। যাকে বলে সেমিকুকড। কাউন্টারে মেয়েটি প্যাকিং করতে করতে বলে উঠল, ‘ইউ ইন্ডিয়ান?’
অমলিনী হেসে বলল, ‘ঠিক। কী করে বুঝলে?’
মেয়েটি হাতের গস্নাভস খুলে করমর্দন করে বলল, ‘আমি সারা। সারা রোজেনস্টেইন। আমি হায়দ্রাবাদে জন্মেছি। বারো বছর পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। হিন্দি, উর্দু জানি। তেলুগুও জানি। নিজেকে ভারতীয় ভাবতে দারুণ লাগে আমার।’
অমলিনী : তোমার দেখা পেয়ে ভারি ভালো লাগছে সারা। আমি অমলিনী গুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছি। আমার ভাষা বাংলা।
সারা : আমি অল্প বাংলা জানি। ভেরি সুইট লিঙ্গো।
অমলিনী : ধন্যবাদ সারা। আমি তোমাকে দেখে বিস্মিত। তুমি আমার দেশের চারটে ভাষা জানো। এ যে অবিশ্বাস্য!
সারা : ভাষা শেখার স্বাভাবিক আগ্রহ আছে আমার। তাছাড়া ভারতকে আমি ভালোবাসি। ভারত আমার শৈশব ও বাল্যের মধুর দিনগুলি! প্রতি দুবছর বাদে আমি হায়দ্রাবাদ যাই। 888sport app শহর ঘুরি। ওখানকার ধুলোয় ধুলোয় মাখা আমার ছোটবেলা।
অমলিনী : কী সুন্দর কথা বলো তুমি সারা।
সারা : হা হা! কী যে বলো! তোমাদের দেশে, যা নাকি আমারও দেশ, কবি আর গীতিকারে ভরা। উর্দু শেরের কি কোনো তুলনা হয়? ভারতীয় মার্গ সংগীতের কোনো বিকল্প আছে পৃথিবীতে? অমলিনী, ভারতীয় দেখলেই আমি চিনতে পারি আর খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। এত কথা বলতে ইচ্ছে করে যে, নিজেকে থামানো মুশকিল। আইওয়ায় ভারতীয় কম নেই; কিন্তু তারা যেন সব আমেরিকান হওয়ার ব্রত নিয়েছে। গা থেকে ভারতের গন্ধ মুছতে পারলে বাঁচে। নিজেদের মধ্যেও যখন কথা বলে, আমেরিকান উচ্চারণে, ইংলিশে, পাছে বাচ্চারা ভারতীয় ভাষাটি শিখে নেয়, ভুল করে স্কুলে বলে ফেলে! ওদের সঙ্গে ভারত নিয়ে কথা বলতে গেলে ওরা যেন পালাতে পারলে বাঁচে! আচ্ছা অমলিনী, অনেক সময় নিয়ে নিলাম তোমার। তুমি কি রাইটার? ইয়াপে যোগ দিতে এসেছ?
অমলিনী : ঠিক ধরেছ সারা।
সারা : দারুণ ব্যাপার! তুমি কি কবি?
অমলিনী : 888sport app download apk লিখি বটে; কিন্তু এখানে 888sport live footballিক হিসেবেই আমন্ত্রণ পেয়েছি!
সারা : খুব ভালো। অভিনন্দন তোমাকে অমলিনী! তুমি আর কী কিনবে? আমি তোমায় কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
অমলিনী : আজ আর কিছু কেনার নেই। ধন্যবাদ তোমায় সারা।
সারা : আমাকে এবার কাজে লেগে পড়তে হবে। বিশ্বাস করো, তোমার সঙ্গে আরো অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে! এরপর এই বাজারে এলে অবশ্যই আমার কাছে এসো অমলিনী।
আবার আসবে এই প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে অমলিনী পস্নাস্টিকের কৌটো কিনতে গেল। তারপর ফিরে চলল ফুলের বাজারে, এক নম্বর দরজায়।
সারা মার্টিন চেয়ারে বসে আছে। সের্গেই ছাড়া আর কেউ বাজার সেরে ফেরেনি। সে তার ঠেলাগাড়িতে জিনিসপত্র রেখে চুপ করে বসে আছে। প্রভূত পরিমাণ ফলের রস, শুকনো ফল, দ্রম্নত রাঁধার দ্রব্য এত কিনেছে যে ঠেলাগাড়ি উপচে পড়ার দশা। অমলিনীকে দেখে সের্গেই মৃদু হাসল। অমলিনী বলল, ‘তুমি কি সারা মাসের বাজার করে নিলে নাকি?’
সের্গেই বলল, ‘এসব আমার জন্য নয়।’
‘তবে?’
‘ভেরোনিকার।’
‘ওঃ!’
‘ভেনেজুয়েলার অবস্থা জানো তো। বস্তা বস্তা টাকা দিয়েও খাবার পাওয়া যায় না। এখানে ব্রেকফাস্টে আমাদের এত কিছু দেয়। ভেরোনিকা খেতে পারে না। কাঁদে। বলে, কে জানে, বাড়িতে সবাই হয়তো না খেয়ে আছে! এক পাউন্ড পাউরুটির জন্য এক মাইল লম্বা লাইন। বাচ্চারা দুধ পায় না। বুড়োরা ওষুধ পায় না। ওর পরিচিত একজন দেশে ফিরছে। তার হাতে এইসব খাবার পাঠানো হবে।’
অমলিনী কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তখন সারা হাতছানি দিয়ে ডাকল তাকে। ‘এদিকে এসো।’ বলল সে। অমলিনী সারার কাছে গেল। সারা বলল, ‘কী অত বলছিল সের্গেই?’
‘ভেনেজুয়েলার দুর্দশার কথা।’
‘মরবে ছেলেটা।’
‘কেন সারা?’
‘প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডুবে যাবে। যাবেই। ভেরোনিকা খুব চালাক মেয়ে। এই যে এত বাজার, পুরো একশ তিরিশ ডলার, সব সের্গেই নিজে দিয়েছে।’
‘তাই! হয়তো ভেরোনিকা ওকে শোধ করে দেবে সারা!’
‘তোমার যেমন বুদ্ধি! তাই যদি হবে তাহলে সে নিজে এলো না কেন?’
এ-বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছিল না অমলিনীর। আমারও লাগে না। পরচর্চা বিষয়টাই বিবমিষা উদ্রেককারী। অথচ 888sport live footballিক হিসেবে, চরিত্র বুঝতে গেলে, অমৃত বা গরল – সকলই ঘাঁটতে হয়।
অমলিনী সারার পাশে বসল। সারা বকবক করতে লাগল, ‘এতক্ষণে মাত্র দুজন। এখনো কত জায়গায় যাওয়া বাকি। এরপর তোমরা কিচেনে যাবে। ছ-টার মধ্যে কিচেন ছেড়ে দিতে হবে। আরে বাবা, আবার তো পরের সপ্তাহে আসব।’
অমলিনী ফুল দেখছে। কতরকম ফুল। কতরকম গাছ। ঘরের ভেতর রাখার বাহারি গাছ সব। সে পায়ে পায়ে তাদের কাছে চলে গেল। ঘুরে ঘুরে দেখছে। একেকটির মূল্য দেখছে, হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছে অন্যটির কাছে। তার নিরিখে চড়া দাম। আমার কাছে কিছুই নয়। এ-জগতে কে বৃক্ষক্ষর দাম নির্ণয় করে রাখে? কোন মূর্খ?
তার জন্য ভারি কষ্ট হলো আমার। একটি পুষ্পহীন পাতাবাহার, লম্বা সবুজ সতেজ পাতার ছোট রঙিন টব, নয় ডলার, সবচেয়ে কম দাম এতসবের মধ্যে। আমি ওই ছোট গাছটির পাতা নড়িয়ে দিলাম। তার চোখ পড়ল। নয় ডলার! ঠোঁট কামড়ে ভাবছে, খরচ করবে কী করবে না।
তাকে এত মন দিয়ে গাছ বাছাই করতে দেখে ছুটে এলো সারা মার্টিন। অভিভাবকের মতো প্রশ্ন করল, ‘কী করছ মোলি? গাছ কিনছ নাকি?’
মোলি বলল, ‘ভাবছি কিনব। কিন্তু এত দাম!’
‘আরে এখানে কেউ গাছ কেনে! আর গাছ নিয়ে করবেই বা কী। দুদিনের জন্য কেউ গাছ নেয়! পরে সব ফেলে যেতে হবে! শুধু শুধু টাকা নষ্ট কোরো না।’
‘কিন্তু ঘরে একটা গাছ না থাকলে কেমন নিঃসঙ্গ লাগে সারা।’
‘হাঃ হাঃ হাঃ! পাগলের কথা শোনো। এই এত বছর ধরে দেখছি, তবু কবি-888sport live footballিকদের বুঝে উঠতে পারলাম না। গাছ কি কথা বলে?’
‘বলে সারা। ওদের রঙে, পলস্নবে, শাখা-প্রশাখার বিস্তারে ওরা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। বুঝিয়ে দেয় যে, ওরা ভালোবাসা অনুভব করে। ওরা দুঃখে দুঃখী হয়। বেশিক্ষণ কাছে না পেলে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।’
‘ঠিক! একদম ঠিক!’ সারার পেছন থেকে বলে উঠল রুবা ইলিয়ানা।
‘আমিও গাছ ছাড়া থাকতে পারি না।’
‘পাগলের দল। উন্মাদ!’ হতাশ হয়ে চেঁচিয়ে উঠল সারা। অমলিনীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘একদম বেশি খরচ করবে না।’
‘করব না সারা।’
সে নয় ডলার দিয়ে ছোট সরল সবুজ গাছটি কিনে নিল। রুবা কিনল পঁচিশ ডলার দিয়ে, লাল-হলুদ ফুলে ভরা ভারী সুন্দর অর্কিড।
ফুলের দাম, গাছের দাম দেবার জায়গা
আলাদা। যেমন মাছের বা মাছ-মাংস ও তৎজাত দ্রব্যাদির পে-কাউন্টার পৃথক। সেখানে দাম
মিটিয়ে গাছটি বুকে জড়িয়ে হাসতে লাগল রুবা। তার খোলা কোঁকড়া চুলের
ঝাড় সেই হাসির তরঙ্গে উছলে উঠল। তার নির্মেদ, দীর্ঘ শরীর বেয়ে নামতে লাগল হাসির
লহর। অমলিনী নিজের গাছ কেনার আনন্দ ভুলে রুবা ইলিয়ানার খুশি দেখতে লাগল দুচোখ ভরে। যে যার ঠেলাগাড়িতে সযত্নে রাখল
তাদের গাছ। মোলি দেখল, বেশ কয়েক বোতল মদ কিনেছে রুবা। বিয়ার, ক্যান, হুইস্কি। ভারি ভালো লাগল তার। গোপন করার প্রয়াস নেই,
সংকোচ নেই, কত সহজ, কত অনায়াস এই মেয়েরা! সে নিজেকে যথেষ্ট স্বাধীনচিত্ত বলে মনে
করে। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু মদ্যপান করতে ভালোও লাগে তার। এখানে কেউ দেখার নেই, কেউ
সমালোচনা করবে না, তবু সে মনে মনে স্বীকার করল, এমন খোলাখুলি মদ কিনতে তার লজ্জাই
করবে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই শ্বাস পতনের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিলাম আমি। ফের
অন্যতর শ্বাস বায়ু হয়ে প্রবেশ করলাম আমার অমলিনীর ভেতর। অমলিনী, আমার অ্যামেলিয়া।
সে ভাবছে, মনে মুক্তি আনা সহজ নয়। সহজ নয়।
ইতিমধ্যে প্রায় সবাই এসে গিয়েছে। সময় শেষ। এবার ফিরতে হবে। আরব, এশিয়ান, ইন্ডিয়ান ও কোরিয়ান মার্কেটে একটু সময় থামতে হবে। একই জায়গায় এই বাজারগুলি। তবু সময় তো লাগবেই। সারা অস্থির হয়ে উঠেছে। মিশরের রোজানা আল গিয়াসি এবং বেলজিয়ামের আশ্রয়ে থাকা প্যালেস্টাইনি শবনম আল মুসান এখনো পৌঁছেনি। সারা মার্টিন ব্যসত্ম পায়ে এগিয়ে গেল ইরাকের হারিক এল ওমেরের দিকে। বলে উঠল, ‘এই যে, হারিক, তোমার সাঙ্গোপাঙ্গ সব কই?’
হারিক তার অপরূপ সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে হেসে বাদামি-সবজে চোখ বড় করে বলে উঠল, ‘আমার সাঙ্গোপাঙ্গ? কে সারা? ইরাক থেকে হারিক এল ওমের একলাই তো এসেছে!’
সারা : দুষ্টু মেয়ে। তুমি ভালোই জানো আমি কী বলছি। রোজানা আর শবনম কোথায়?
হারিক : তা তো জানি না!
সারা : উফ্! ইউ রাইটার্স! তোমরা আমায় পাগল করে দেবে।
অমলিনী : হারিক, এখানে ইয়াসমিনকে দেখছি না! সে কোথায়?
হারিক : ইয়াসমিন
খাবার কিনে খাবে। এই তিনমাস সে
হাতা-খুন্তি ধরবে না।
সারা : ইয়াকভ, জেরেমিস – তোমরা কি জরুরি কিছু করছ?
ইয়াকভ : না না! গপ্পো মারছি। বাজার তো শেষ। আর আমার আলাদা করে ম্যাসিডোনিয়ান বাজারও দরকার নেই।
সারা : তোমার শুধু ফাজলামি। চলো আমার সঙ্গে। মেয়েদুটোকে খুঁজে আনবে। সময়ে ফিরতে হবে তো। আড়াইটেতে তোমাদের কিচেনে নিয়ে যাওয়া হবে।
ইয়াকভ : চলো জেরেমিস! মেয়ে খোঁজার চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে!
অ্যালেক্স : আমিও যাই চলো।
সারা, তুমি চিন্তা কোরো না। আমরা ওদের ধরে আনছি। তুমি এখানেই থাকো।
সারা : না না। আমি যাব। না হলে তোমাদের ধরে আনার জন্য আবার একটা টিম পাঠাতে হবে!
সারার কথার মাঝেই দূরে রোজানাকে দেখা গেল। মাথায় হিজাব পরা, এক-গা গয়না পরা, ধবধবে, মাখনের মতো রোজানা, গোলগাল, রাজহংসীর মতো আসছে। তার সামনে সত্মূপীকৃত বস্ত্ত বোঝাই ঠেলাগাড়িটি সম্পূর্ণ বেমানান। সারা চেঁচিয়ে উঠল, ‘রোজানা। বিল তো করেছ? শবনম কোথায়?’
রোজানা হাতের ইশারায় পে-কাউন্টারের দিকে দেখাল। ওখানে যাবে। ‘ও মাই গড!’ সারার মুখখানা লাল হয়ে উঠছে। চরম হতাশায় বলে উঠল, ‘ও এখনো দামই মেটায়নি! এত জিনিস! পাগল করে দেবে।’ প্রায় ছুটতে ছুটতে সে বলে উঠল, ‘দাঁড়িয়ে পড়ো। যে-কোনো কাউন্টারে লাইন দাও! শবনম কোথায়?’
ইয়াকভ, জেরেমিস, অ্যালেক্স এগিয়ে যাচ্ছিল। রোজানা বলল, ‘শবনম ওষুধের বিভাগে গেল। ওর কীসব কিনতে হবে!’
সারা : আমি ওকে খুঁজে আনতে যাচ্ছি। ইয়াকভ, তোমরা ওকে কাউন্টারে সাহায্য করো!
রোজানা : আমি কারো সাহায্য চাই না সারা। জিনিসপত্র কেনাকাটা যার যার ব্যক্তিগত।
সারা : যা ভালো বোঝো!
সারা ছুটল। ইয়াকভরাও আর এগোল না। সাইয়ুন এসে অমলিনীর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। সারা একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাইকে অনুরোধ করছি, তোমরা গাড়িতে চলে যাও। বসে পড়ো। এদের হলেই আমরা রওনা দেবো।’
সাইয়ুন বলল, ‘রোজানা এত কী কিনেছে বলো তো!’
অমলিনী : কে জানে! চলো সামনে একটু ঘোরাঘুরি করে আসি!
সাইয়ুন : না না বাবা! দেখলে না, ও কারো সাহায্য চায় না।
রুবা : তো? আমরা ওর জিনিস দেখতে যাব নাকি? আমরা ক্যাশ কাউন্টারের সামনে ঘুরঘুর করব। চাইলে এক প্যাকেট চিউয়িংগাম কিনতে পারি। দু’প্যাকেট সিগারেট। একটা লাইটার ওখানে কি অন্য ক্রেতারা নেই?
সাইয়ুন : না বাবা। আমার ভয় লাগে। যদি রেগে যায়! যদি ঝগড়া করে!
মোলি : না না, ঝগড়া করবে কেন? মেয়েটা খুবই মিষ্টি। প্রথম দিন কেমন উপহারভর্তি ঝুড়ি নিয়ে সবার কাছে ঘুরছিল। পরিচয় করার খুব ভালো উপায় তাই না? আমি একটা ছোট সিস্নপ প্যাড নিলাম! এই পুঁচকি একটা জিনিস। চিরকুট লেখা যায়। খুব মজার ছবি দেওয়া।
সাইয়ুন : আমিও নিয়েছি। একটা কফি টেবিল বই। মিশরের ছবি দেওয়া।
রুবা : ওই হাসিন এদিকে আসছে। ওর সঙ্গে চ্যাং চুন চেনের খুব ভাব হয়েছে। কেউ কারো ভাষা বোঝে না। একজন আলজেরিয়া, আরেকজন তাইওয়ান। কেউই ইংলিশ বলতে পারে না তেমন। অথচ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ইয়াপ ইজ আ ম্যাজিশিয়ান। দেখি এই বন্ধুত্ব তোয়ালে ভেজাতে পারে কিনা।
মোলি : তুমি খুব দুষ্টু রুবা।
রুবা : দুষ্টু হতে ভালো লাগে না? আমার বর আমার দুষ্টুমিতে পাগল! সেসব সামলাতে আমাদের চারটে বাচ্চা হয়ে গেল।
মোলি : বলো কী! তুমি চার সন্তানের জননী! তোমার শরীর দেখে কেউ বলবে? মডেলদের মতো সুন্দর তুমি!
রুবা : দ্যাটস আই অ্যাম মোলি!
থ্যাংক ইউ! ইউ অ্যান্ড সাইয়ুন – তোমরা দুজনেই এশিয়ান বিউটি!
অমলিনী দেখল, ইয়াকভ আলজেরিয়ার হাসিন সুহালির গালে চুমু খেল। এবার সকলেই যার যার ঠেলাগাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার সঙ্গে ভালো করে কথা বলার সুযোগ হয়নি এখনো তার। সে-ও নিজের ঠেলাগাড়ি নিয়ে চলেছে। হাসিন ও ইয়াকভ হেসে হেসে কথা বলছে। যখন-তখন জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়া ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। আর শুধু ভারত কেন, এশিয়ার কোনো দেশেই এই সংস্কৃতি ছিল না। যতটুকু হয়েছে ইউরোপীয় প্রভাবেই হয়েছে। মোলির তা একটুও নিন্দনীয় মনে হয় না। চুমু খাওয়া – যেমন খেল ইয়াকভ হাসিনকে, জড়িয়ে ধরা – যেমন ধরে জেরেমিস রুবা বা ওকিওকি একাগামিকে, তার সমসত্মই অমলিনী দেখে অমল দৃষ্টিতে। স্পর্শ এক পৃথক ভাষা। সে-ভাষায় জগতের প্রতিটি প্রাণীর সঙ্গে কথা বলা যায়।
তারা পার্কিং লটে আসা মাত্র ড্রাইভাররা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। মোলি আর রুবার গাছ দেখে হাসছে তারা! যে যার গাড়ির ট্রাংক খুলে প্যাকেটগুলি ঢুকিয়ে নিচ্ছে। অমলিনী তাদের সামূহিক ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ। ড্রাইভাররা গাঢ় রঙের মার্কার কলম দিয়ে প্রত্যেকটি থলের গায়ে নামের আদ্যক্ষর লিখে দিচ্ছে।
অমলিনী গুপ্তা – এ/ জি, রুবা ইলিয়ানা – আর/ আই!
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের মতো নিখুঁত ও দক্ষ সবার কাজ। পঞ্চাশ বছর ধরে অতিথিসেবা করে আসছে ইয়াপ। ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, দেশ, ধর্ম, বর্ণ একত্রিত করছে সাতদিন-আটদিনের জন্য নয়, পুরো তিনমাসের জন্য। কাজটা কতখানি কঠিন, আজ খানিক বুঝতে পারছে অমলিনী। কারণ আমন্ত্রিত অতিথিরা প্রাপ্তবয়স্ক। স্বরাট। বিবিধ মানসিকতার। সেইসঙ্গে সে নিজের মনে স্বীকার করে নিচ্ছে, সৃজনশীল মানুষ খুব সহজ হয় না। একটু বিটকেল। একটু জটিল!
আমি হাওয়ার মতো ছুঁয়ে দেখছি তাকে। বলছি, অমলিনী, অমল আমার, তুমিও কি জটিল, বিটকেল, আত্মপরায়ণ?
ইতোমধ্যে সকলেই যাওয়ার জন্য তৈরি। সকলে হাইভির ফটকের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা মার্টিন প্রায় ছুটতে ছুটতে শবনম আর রোজানাকে নিয়ে আসছে। তার মুখ ঘর্মাক্ত। চোখে বিরক্তি। কণ্ঠে উদ্বেগ। এখনো অনেক বাজার ঘুরতে হবে। প্রত্যেকের দেশীয় বাজার। সময় কুলোবে?
অমলিনী দেখছে দেরি করিয়ে দেওয়ার জন একটুও দুঃখিত নয় শবনম ও রোজানা। তাদের সত্মূপীকৃত প্যাকেট গুছিয়ে তুলছে মার্ক। রোজানা মুখ গোমরা করে আছে। শবনম চেঁচাচ্ছে, ‘এভাবে বাজার হয়? অসম্ভব! না না, এত নিয়ম আমি কিছুতেই মানব না!’
আবার সারিবদ্ধভাবে চলতে লাগল গাড়িগুলি। যে যে নিজস্ব দেশীয় বাজার পেল, কিনল কিছু-না-কিছু। আরব মার্কেট থেকে বড় মাংসের খ- কিনল রোজানা-শবনম-হারিক। সাইয়ুন নানারকম কৌটোর খাবার কিনল। আর আমার অমলিনী নিল মুড়ি আর চানাচুর! প্রথমবারের বাজার শেষ হলো। r (চলবে )


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.