\ ৭ \
কে তুমি কে আমি, এসো
হাতে হাত রেখে সূর্যের আড়ালে পথে নামি
| পৃ |
থিবীর একেবারে অন্য গোলার্ধে এসে পড়ায়, সময়ের বিপরীত চক্রে, শরীরের মধ্যে এক টানাপোড়েন চলছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শরীরের কলকব্জা যখন বিশ্রাম চায়, আমেরিকায় তখন জাগরণের সময়! অমলিনীর উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল।
আজ প্রথম দিনের সম্মেলন। ইমুর ভিতর এই হাউজ হোটেল অংশটুকু যাঁদের, তাঁরা বিশেষ প্রাতরাশের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন 888sport live footballিক ও ইয়াপের কর্মীদের। একতলায় একটি বড় সভাঘরে এই আয়োজন!
অমলিনী ভেবেছিল, প্রথম দিন শাড়ি পরবে। কিন্তু তার সময় পেল না। সাত মিনিট বিলম্ব হয়েছে। দ্রম্নত তৈরি হয়ে যখন নিচের লবিতে গেল, দেখে সুনসান, কেউ নেই। এখানেই সকলের একত্রিত হওয়ার কথা! হয়েছিলও হয়তো! ঘড়ির কাঁটা ধরে প্রাতরাশে যোগ দিয়েছে! অমলিনীর মন খারাপ হয়ে গেল! কেন হলো? সে কি আশা করেছিল কেউ তার জন্য অপেক্ষা করবে? কেউ কড়া নাড়বে দরজায়?
সে একে-ওকে জিজ্ঞেস করে সেই কক্ষি পৌঁছল। সারা বলল, ‘যথারীতি তোমার বিলম্ব হলো। আমি জানতাম এমনটা হবে। যে কজন বাঙালি লেখক এখানে দেখলাম, সববার এক রোগ। নাও, খাবার নাও!’
লজ্জিত মুখে খাবারের পাত্র নিল অমলিনী। বসল একটি টেবিলে। পাশের চেয়ারে একজন শ্বেতকায় মহিলা। তার ত্বক, চুল, এমনকি চোখের মণিও যেন সাদা। আসলে মণির নীলাভা এমনই ফিকে যে চোখ সাদা ও স্বচ্ছ মনে হয়। পুরো চুল টেনে ডান কানের পাশে এনে একটি ছোট্ট বিনুনি-পাকানো অমলিনীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমি বেটসি। বেটসি ফেরেট। নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছি। কবি ও ঔপন্যাসিক।’
‘আমি অমলিনী গুপ্ত। ইন্ডিয়া।’
‘আমোল? আমোলী? নামটা আর একবার বলবে পিস্নজ?’
‘অমলিনী। আমাকে মোলি বলে ডেকো।’
বেশি কথা না বলে মন দিয়ে খেতে লাগল সে। তার মুখে তৃপ্তির আভা। আমি বুঝলাম, খাবার সুস্বাদু। সে আরো কয়েকটি বেকন নিল। অনেকদিন পর আমারও বেকন খেতে ইচ্ছে করল। বুঝলাম, মৃত্যুর পরে দেহধারী জীবিত মানুষের মধ্যে ফিরে এলে জীবন নিজস্ব দাবি নিয়ে সমস্ত সত্তা অধিকার করে।
অমলিনীকে ভালো করে দেখব বলে, ছোট্টখাট্টো, রোগা বেটসির পাশে দাঁড়ালাম। এই প্রথম বুঝতে পারছি, পেট ভরে খেলাম কি না, ভালো করে খেলাম কি না, কেন খুঁটিয়ে বুঝতে চাইত বাবা। চাইত, কারণ প্রিয়জন তৃপ্তিতে আহার করছে, এই দৃশ্য বড়ই আনন্দের।
এ-টেবিলে ও-টেবিলে গল্পগুজব চলছে। সারা এসে অমলিনীর পাশে বসল। বেটসি আর সারার মধ্যে কে বেশি ছোটখাটো আর কে বয়সে বড় বলা মুশকিল।
সারা বলল, ‘এখান থেকে সোজা শাম্বাগ হাউজ যাবে। আর যেন দেরি না হয়।’
হোটেলের অধিকর্তা মি. ম্যাকেঞ্জি এসে দাঁড়াল। পাশে একটি মেয়ে। সকলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলল, ‘রোজি এখন নিয়মকানুন পড়ে শোনাবে। সমস্ত নিয়ম ছাপার অক্ষরে প্রতিটি ঘরে টাঙানো আছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাইটাররা ইতিপূর্বে এমনসব কা- ঘটিয়েছে যে প্রত্যেককে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে যে হোটেলের নিয়ম ভাঙলে দেড়শো থেকে হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এমনকি তার বেশিও হতে পারে, যদি ক্ষতির পরিমাণ, আমরা দেখি, খুবই বেশি। এবং প্রয়োজনে, পুলিশ ডাকতেও আমরা দ্বিধা করব না। এখানে রাইটাররা মাইক্রোচুলিস্নতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। মদ্যপ অবস্থায় ধূমপান করে আগুন লাগিয়েছে। ওই একই কারণে বেহুঁশ হয়ে শাওয়ার খুলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। এছাড়া বিছানা পোড়ানো, টিভি ভেঙে ফেলা, ঘর নোংরা করে রাখা তো আছেই। আমি আশা করব, তোমরা নিয়ম মেনে চলবে। এবং তোমাদের কৃতকর্মের জন্য ইয়াপ কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না বা জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে না। আজ যে-চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হবে, তাতে এসব লেখা থাকবে।’
রোজি নিয়মকানুন পড়তে লাগল। অমলিনীর মন লাগল না। শোনার প্রয়োজনও বোধ করল না সে। ম্যাকেঞ্জির কথায় সে অপদস্থ বোধ করছে। তারা আমন্ত্রিত অতিথি। এভাবে কি তাদের বলা উচিত? তার মনে হলো, প্রাতরাশের আয়োজনগৌণ। এই মৌখিক শাসানিটাই মূল উদ্দেশ্য।
সারা তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার বেঙ্গল থেকে এসেছিল একজন, ঘর এত নোংরা করত সে, পরিষ্কার করার সব ছেলেমেয়েগুলো নাসত্মানাবুদ হয়ে গিয়েছিল। আর একজন তো কিছুই নিজে করতে পারত না। তার আলুসেদ্ধ করে দেবার জন্য সেডার র্যাপিড থেকে তার ভক্তরা আসত।’
তার নিজের জাত্যভিমান আছে কি না ভেবে দেখেনি অমলিনী। কিন্তু স্বজাতীয়ের নিন্দেমন্দ শুনে তার খারাপই লাগছিল। তবে এ-কথা সে বুঝে যাচ্ছে, নিন্দে ও সমালোচনা, পরচর্চা ও রটনায় বিশ্বের কোনো দেশ, কোনো জাতি পিছিয়ে নেই। আসলে তো মনুষ্য চরিত্র!
প্রাতরাশপর্ব সকাল ন-টায় মিটে গেল। রাইটাররা দলবেঁধে শাম্বাগ হাউজের দিকে যাচ্ছে। অনেকখানি চরাই ভেঙে অনেকেরই হাঁপ ধরে গেল। ঝকঝক করছে রোদ। পথের ধারে কত না গাছের সমারোহ। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় সবুজে সবুজ। গুচ্ছ গুচ্ছ ছেলেমেয়ে কেউ খেলছে, কেউ আড্ডা মারছে।
ইয়াকভ আর জেরেমিস অমলিনীর পাশে চলে এলো। ইয়াকভ বলল, ‘মোলি, ঘুমিয়েছ ভালো করে?’
মোলি : হ্যাঁ। ঘুমোলাম। সকালে উঠতে দেরি হলো।
জেরেমিস : আমার একটুও ঘুম হচ্ছে না। প্রথম রাতে আমার জানালার বাইরে ধুমধাড়াক্কা গানাবাজানা চলল মাঝরাত পর্যন্ত! এদিকে আমার ঘরের উলটোদিকে যন্ত্রঘর। ভেন্ডিং মেশিন থেকে সারাক্ষণ শব্দ আসছে। বেশি শব্দ সহ্য করতে পারি না আমি।
শাম্বাগ হাউজের বারান্দায় দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে গ্রেগ। আমিও তার পাশে বসে দোল খেতে লাগলাম। খবরের কাগজের ব্যবসায়ী গ্রেগ 888sport live football ভালোবাসে। তার গায়ে সবসময় হকআই মার্কা কালো টি-শার্ট। ফুটবলের জার্সি গায়ে এক সবল হক পাখি, যার চোখ দুটি ক্রুদ্ধ ও কুটিল, এই ইউ-আইওয়ার প্রতীক। হার্কি দ্য হক। হার্কি এক কাল্পনিক ছাত্র, তার শক্তিশালী হক পাখির মুখ। এই বিশ্ববিদ্যালয় সংশিস্নষ্ট প্রত্যেকেই হকাইয়ান।
রাইটারদের জন্য দুরকম দৈনিক সংবাদপত্র এক পাঁজা করে দিয়ে যায় গ্রেগ। আড্ডাঘরের টেবিলে রেখে দেয়। হাউজ হোটেল থেকেও সৌজন্যমূলক সংবাদপত্র পাওয়া যায়। সেসব প্রাতরাশের ঘরে রাখা থাকে। শাম্বাগ হাউজের ভেতরে এখন রাইটাররা নানাবিধ চুক্তিপত্র বীমাপত্রে সইসাবুদ করছে। এরপর স্থাগতভাষণ দেবেন ইয়াপের প্রধান পার্ক এডওয়ার্ড। তারপর রাইটাররা নিজেদের পরিচয় দেবে। অবশেষে মধ্যাহ্নভোজনের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যগ্রহণ দর্শন। মোলি তার নির্দিষ্ট জায়গা এবং ইয়াপ-প্রদত্ত ঝোলা ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাকে আরো একটি দেওয়া হলো। চুক্তিপত্রের সঙ্গে সূর্যগ্রহণ দেখার চশমা।
আমি গ্রেগকে দেখছি। লম্বা মানুষটা একটু ঝুঁকে পড়েছে। হাতে একটি 888sport app download apkর বই। জিয়াং জাও জেনের চৈনিক 888sport app download apkর ইংলিশ 888sport app download apk latest version। একটু পড়ছে, আবার বাইরে দেখছে। দেখার মতোই দিন। এই ঝরাপাতার মরশুমে আইওয়ার সৌন্দর্যের তুলনা নেই। আর জিয়াং জাও জেং হয়তো দশ হাজার 888sport app download apk লিখে থামবে। তার সময়-অসময় নেই, আবেগ-নিরাবেগ নেই, প্রেম-প্রকৃতি নেই, তার 888sport app download apk-নির্ঝর থামা জানে না। কালস্রোতের মতো।
ইয়াপের হিসাবরক্ষক মার্থা এসে দাঁড়াল। সারাক্ষণ হাসিখুশি মার্থা যেন এক শ্বেতকায় ফুটবল।
মার্থা : এসে পড়েছ দেখছি গ্রেগ।
গ্রেগ : এই তো কেমন আছ তুমি? ওজন বাড়ল, না কমল।
মার্থা : বেড়েছে। গত ফল রেসিডেন্সিতে আমার ওজন ছিল ১৫২ পাউন্ড। এবার একশ পঁয়ষট্টি। রাইটারদের সঙ্গে পরিচয় হলো?
গ্রেগ : হ্যাঁ, আজ হোটেল থেকে লেখকদের জন্য বিশেষ প্রাতরাশ ছিল। তখন অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। সবার জন্য খবরের কাগজ ফ্রি। আমার গাড়িও তৈরি। কেউ কোথাও যেতে চাইলে গ্রেগ প্রস্ত্তত।
মার্থা : নির্দেশ মেনে চলো গ্রেগ। কাউকে একা নিয়ে যাবে না। অন্তত দুজন মেয়ে রাইটার হলে তো আরো সাবধান হবে। তোমাকে অবশ্য বুড়োই বলবে লোকে। কিন্তু মেয়েরা আজকাল বুড়োদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেও ছাড়ে না। বুড়োরাও অবশ্য মেয়ে পেলে ছাড়ে না। হিঃ হিঃ! রাগ করলে নাকি গ্রেগ? অনেকগুলো যুবতী ও সুন্দরী কবি-888sport live footballিক এবার! তুমি তো রাইটারদের আড্ডাঘর ছেড়ে নড়বেই না মনে হচ্ছে। বিনে পয়সার খিদমতগার হয়ে যাবে! কী যে পাও লেখকদের সেবা করে।
গ্রেগ : ইয়ে, নিয়ম মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। আর জানো তো বন্ধু পাতাতে আমি ভালোবাসি। সারাবিশ্বে আমার বন্ধু ছড়িয়ে আছে। কয়েকজন মরেও গিয়েছে। আগে যখন চিঠি লেখার যুগ ছিল, সপ্তাহান্তে দুজনকে চিঠি লিখতাম। এখন ফেসবুক হয়ে খুব সুবিধা। চ্যাট করো, কথা বলো, কোনো খরচ নেই। প্রযুক্তি কোথায় পৌঁছে দিয়েছে আমাদের। বিস্ময়কর।
মার্থা : তা দিয়েছে। তবে আমার এই নেটদুনিয়ার বন্ধুত্বে ভরসা নেই। সবই বড় বায়বীয় মনে হয়। বন্ধুর হাতে হাত রাখব, জড়িয়ে ওম নেব, দুঃখ হলে কাঁধে মাথা রেখে কাঁদব, এমন চমৎকার পাতাঝরার দিনে বন্ধুর সঙ্গে বসে কফি খাব, তবে তো মজা।
গ্রেগ : অর্থাৎ তোমার রক্তমাংসের বন্ধু চাই।
মার্থা : অবশ্যই। শুধু চোখ-কান নয়। গন্ধ-স্পর্শ স্বাদ, নইলে জীবনে জীবন যোগ হয় না। তাহলে তো অশরীরী ভূতের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হতো।
গ্রেগ : তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?
মার্থা : আমার বাড়ির সামনে যে কবরখানা, ওখানে অনেকে ভূত দেখেছে। আমি ভূত-প্রেত, ডাইনি, পুনর্জন্ম, জাতিস্মর, ভবিষ্যৎ দর্শন – যতরকম কল্পনা সম্ভব, সব বিশ্বাস করি। বিশ্বাস জীবনকে মধুর করে গ্রেগ!
গ্রেগ : কী জানি, আমি কখনো ভূত দেখিনি। বিশ্বাস কখনো কখনো মারাত্মক মার্থা। হন্তারক। ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার উদ্রেককারী।
মার্থা : তা ঠিক। কার 888sport app download apk পড়ছ? চায়নিজ নাকি?
গ্রেগ : জিয়াং জাও জেন। হংকংয়ের কবি। ম্যান্ডারনে 888sport app download apk লেখে। ওদের তো দুরকম 888sport live footballের ভাষা। ক্যান্টোনিজ আর ম্যান্ডারিন।
মার্থা : কাব্য-888sport live football আমার মাথায় ঢোকে না। আমার খুব অবাক লাগে, কিছু লোক বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখে, বা অর্থহীন কিছু বাক্য, বাকিরা তা-ই পড়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। এমনকি মাতামাতির বহরটা দেখ। কী খরচ। তবে আমারও এই বিভিন্ন দেশের মানুষদের ভালো লাগে। ওরা যেন পরিযায়ী পাখি। যখন এখানে থাকে, কত আপন, যেই দেশে ফিরে যায়, আর মনে রাখে না।
গ্রেগ : তা নয়। এই তো আমার কত বন্ধু। আমি কী বলো? সামান্য ব্যবসাদার। পাঠকমাত্র। তবু তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। বন্ধুত্ব করতে জানা চাই।
মার্থা : বাজে বোকো না। আমার অনেক বন্ধু। তবে, ওই যে বললাম দূরের বন্ধু আমার হয় না। রোজকার জীবনের সঙ্গে যদি যোগই না থাকল তবে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলব কী নিয়ে? যাই। গুচ্ছের কাজ পড়ে আছে। কবে যে এই যজ্ঞ শেষ হবে, লম্বা ছুটি নেব।
গ্রেগ : সবে তো শুরু।
মার্থা : শুরু হলেই শেষ গ্রেগ। যে কোনো উৎসবের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।
একেবারে খাঁটি কথা বলে গেল মার্থা। শুরু হলেই শেষ। আমারও এই শেষবারের মতো মানবজীবন 888sport slot gameের এক-একটি দিন খসে পড়ছে।
যে কবরখানার কথা মার্থা বলছিল, সেখানেই আমার বাস। আমারই মতো বহু আত্মা সেখানে ঘুরে বেড়ায়। জীবিত কেন মৃতকে ভয় পায়? মৃত্যু – মানে অন্য ভুবন। মৃত্যু – মানে থেমে যাওয়া। এ-ভুবনে অতীত হয়ে যাওয়া। মানুষ যদি নিজের অতীতের মুখোমুখি হয়, ভয় পাবে? যদি ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়, যদি আমার মতো বাইশ বছরের তরুণকে দেখানো হয় সে বিরানববইয়ে কী হবে, কত অপরাধ-ভ্রান্তি-অপমান-আঘাত অসুস্থতা থাকবে তার জীবনে, সে কি ভয় পাবে না?
আমি ভিতরে গিয়ে রাইটারদের আত্মপরিচয় শুনতে লাগলাম। তাদের চুক্তিপত্রে সই করা শেষ। এতজনের পক্ষে এই ঘরটি অপ্রশস্ত। কোনো দিন পঞ্চাশজন লোক চুক্তিপত্র সইসাবুদ করবে বলে তো এই ঘর তৈরি হয়নি। গায়ে গা লাগিয়ে বসা রাইটাররা অবশ্য এতে খানিক পরস্পরসহা হয়ে উঠেছিল। এখন চলছে নিজের পরিচয়দান। অধিকাংশই নিজের কথা বলতে শুরু করে আর থামতেই চায় না। অমলিনী অবশ্য সংক্ষেপেই সারল। ভেনিজুয়েলার ভোরোনিকাকে কেউ কিছু বলাতেই পারল না। যাদের দেশ ভেঙে গিয়েছে, যেমন কাজাখসত্মানের সের্গেই ইরোনভস্কি, কিংবা আদি যুগোশস্নাভিয়া ভাঙা ম্যাসিডোনিয়ান ইয়াকভ করচাগিন, সেস্নাভেনিয়ান জেরেমিস মিকালোকা – তারা আত্মপরিচয় নিয়ে সংশয়ের কথা বলল। ‘আমরা আমাদের অবিভক্ত দেশের নাগরিক। আবার এখন একটি খ–ত দেশের নাগরিক। আমার যে মাটিতে জন্ম, তাকেই যদি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়, নতুন পরিচয় দিয়ে বানিয়ে দেওয়া হয় নতুন মাটি, তাহলেই কি আমাদের চেতনায় যে গর্ভটান তা পালটে যাবে?’ রুবা ইলিয়ানা বলল, ‘আমার বাবা সোমালি, মা ইতালিয়ান। ১৯৯১-এ গৃহযুদ্ধের সময় আমি ইতালিতে পালিয়ে এসেছিলাম। মা আমাকে ইতালিতেই জন্ম দিয়েছিল। আমি সোমালিয়ান নাকি ইতালিয়ান। সোমালিয়াকে আমি আজো ভুলতে পারিনি। আজো আমি সোমালি গান শুনি, গল্প পড়ি। আমার লেখায় সোমালি উপকথা আপনা-আপনি এসে পড়ে। নিজেকে ইতালিয়ান বলতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু এক অর্থে ইতালি আমার দেশ। একজন মানুষের কি একাধিক দেশ থাকতে পারে না? ভৌগোলিক রাজনৈতিক সীমানার সত্যিই কি কোনো মানে আছে?’
রুবার বলা শেষ হতেই মারকাটারি রূপবতী প্যালেস্টিনিয়ান কবি শবনম আল মুসান হাত তুলল। সে এবার বলতে চায়। অগ্নিশিখার মতো পোডিয়ামে উঠে দাঁড়াল সে। ঝলমলে পোশাক তার শরীরের বিভঙ্গ ফুটিয়ে তুলতে লাগল। মাথায় পরা রঙিন হিজাবের নিচে চাপা পড়া চুল তার তীক্ষন মুখখানি আরো শাণিত করে তুলল। তার ঠোঁটের টকটকে রং তার প্রতিটি উচ্চারণকে করে তুলল সম্মোহক। সে বলল, ‘আমার কোনো দেশ নেই। রুবার সমস্যা তার দুটো দেশ। সের্গেইয়ের সমস্যা সে আগে নিজেকে রাশিয়ান বলে জানত, এখন কাজাখি বলতে তার দ্বিধা হয়। তার সমস্যা তার অতীত পরিচয় ও বর্তমান পরিচয় আলাদা। আর আমার পরিচয়? বন্ধুরা, ভাঙা হোক, টুকরো হোক, গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হোক, তোমাদের দেশ আছে। আমার কোনো দেশ নেই। আমি দেশ থেকে বিতাড়িত। আশ্রয়হীন। রিফিউজি। আমি রিফিউজি বন্ধুগণ। উদ্বাস্ত্ত! আই দোনত হ্যাভ হোম। আই নিদ মাই ওন হোম। পরিচয়? আমি যে-কোনো দেশের পরিচয় নিতে রাজি। যে কোনো দেশের নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট। যে দেশ আমায় খেতে-পরতে দেবে, দেবে কাজের অধিকার, উপার্জন, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, আমি তাকেই আমার দেশ বলতে রাজি। কিন্তু আমার বুকের মধ্যে যে বাড়িটা, সে তো বোমায় ছিন্নভিন্ন, আগুনে পোড়া। শান্তির নামে সেখানে হত্যালীলা চলছে যুগের পর যুগ। সেখানে আমার ভাই মরছে, বোন মরছে। বন্ধুরা, গাজা স্ট্রিপে আমার ঘর। আমার এই শরীরের মান রাখতে, আমি যাতে ইসরায়েলি সেনার হাতে ধর্ষিত না হই, সেজন্য আমার বাপ-দাদা অনেক অর্থ ব্যয় করে গোপনে সীমান্ত পার করিয়ে আমাকে ইজিপ্ট পাঠিয়ে দিলো। আমি ইজিপশিয়ান জাতীয় সংগীত গাই বন্ধুরা। আমার গলা কাঁপে না। ইজিপ্ট আমাকে চার বছর আশ্রয় দিয়েছিল। ওখানে আমি খেতে পেতাম। আমার নিরাপত্তা ছিল। আমার মিশরীয় হতে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু মিশরও টালমাটাল হয়ে গেল। আমরা প্যালিস্তিনীয় উদ্বাস্ত্তরা বিপন্ন হয়ে পড়লাম। আবার আমাকে পালাতে হলো। এবার বেলজিয়াম। কয়েক বছর হলো আমি বেলজিয়ামে আশ্রিত। বেলজিয়ামের আরব উদ্বাস্ত্ত। এখানে আসার কয়েক মাস আগে বেলজিয়াম আমাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। বেলজিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে আমি আমেরিকায় এসেছি। বেলজিয়ান হতে আমার কোনো আপত্তি নেই। চেষ্টা করছি। খুব চেষ্টা করছি। এখনো সরকারি অনুদানে আমার দিন কাটে, কারণ সত্যিটা হলো আরব রিফিউজিকে কেউ বিশ্বাস করে না। চাকরির জন্য আবেদন করলে কেউ বলে, এ কাজের জন্য তুমি বড্ডই বেশি শিক্ষিত। কেউ বলে, তোমার তো অভিজ্ঞতাই নেই। তবু আমি বেলজিয়ান। আই হ্যাভ গত এ পাসপোর্ত! এবার বলো, আমি নিজেকে নিয়ে কী করি। প্রতিদিন রাতে যখন শুতে যাই, ভাবি কাল আমার মা-বাবা-ভাই ও বাচ্চাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবো তো? আমি বলি কী বন্ধুগণ, যে দেশ তোমায় খেতে পরতে দিচ্ছে সে তোমার নয় কেন? পালক-পিতাও তো পিতা! কিন্তু তোমার বুকের মধ্যে যে দেশ, তাকে কেউ কেড়ে নিলে বড্ড কষ্ট হয়। রিফিউজি হওয়ার বড্ড কষ্ট বন্ধুরা।’
নৈঃশব্দ্য।
চেয়ার ঠেলার শব্দ হলো। ইসরায়েলি জিনেট ইনসানি উঠে গেল। আবার চেয়ার ঠেলার শব্দ হলো। স্পেনীয় ইয়েরমেন ভেরালট গেল সঙ্গে। মার্ক জুমের একটু কাশল। মেডেসা বসা-বসা গলায় বলে উঠল ইউগান্ডার মানঘিল ঘিলা, সিঙ্গাপুরের জেনিফার জুং বাকি আছে।
সাড়ে ছ-ফুট মানখিল একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। সে বলে উঠল, ‘আমরা সবাই সবাইকে চিনে গিয়েছি। সূর্যগ্রহণ শুরু হলো বলে। আমি আবার গ্রহণ দৃশ্য শুট করব।’
জেনিফার বলল, ‘আমার উচ্চতা চার ফুট। পোডিয়ামে কেউ একটা টুল দাও।’
হা-হা করে হেসে উঠল সকলে। শবনমের বক্তব্যের পর এই হাসিটুকু দরকার ছিল। মেডেসা একটা টুল দিলো। জেনিফার তার ওপর দাঁড়িয়ে বলল, ‘মানখিল, এসো একটা পাঞ্জা লড়াই হয়ে যাক পোডিয়ামে। টলেস্ট রাইটার ভার্সেস ডোয়ার্ফ রাইটার।’
আবার হাসি।
জেনিফার : মানখিল আর ইয়াকভকে দেখলে আমার একটা পুরনো রসিকতা মনে পড়ে। বন্ধু ওপরের তাপমাত্রা কত?
আবার হাসির শব্দ। পার্ক হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়ছে। পার্কের হাসি নিঃশব্দ কিন্তু পরিপূর্ণ। এমনকি অনাবিল হাসিতে ভরে আছে শবনমের মুখ। তার মুখে একটু আগের আগুনের তাপ নেই, যে-আগুন সইতে না পেরে চলে গেল জিনেট। এতকাল নানা দেশে, নানা সভায়, আবেদনপত্রে, সাক্ষাৎকারে, 888sport app download apkয় নিজের যন্ত্রণার কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত শবনম। সে চাইলেই কাঁদতে পারে। চাইলেই জল মুছে হতে পারে মোহময়ী।
জেনিফার : আমার হাতে কতটা সময়?
পার্ক : দু-মিনিট।
জেনিফার : যথেষ্ট। আমি জন্মসূত্রে চায়নিজ, কর্মসূত্রে সিঙ্গাপুরি, বিবাহসূত্রে ভিয়েতনামি, লেখার সূত্রে এখন আমি হকাইয়ান। বড্ড খিদে পেয়েছে। পেট বলছে খাই খাই। আর আমার কিছু বলার নাই।
সবাইকে হাসিয়ে, ঘরের দুঃসহ ব্যথাতুর এবং অস্বস্তিকর হাওয়া উড়িয়ে পোডিয়ামের টুল থেকে নেমে এলো পুঁচকে জেনিফার। বাষট্টি বছর বয়স তার ত্বকের টানটান যৌবনশ্রী হরণ করেছে, কিন্তু হাসিটি বড় সরল, সুন্দর। সিঙ্গাপুরে উচ্চপদস্থ আমলা ছিল জেনিফার। জীবন ও জগতের জটিলতা সে ভালোই জানে। কিন্তু তার আচরণে বুদ্ধি, রসবোধ ও পরিমিতিজ্ঞান স্পষ্ট। তার কথায় শিশুর মিষ্টত্ব, প্রাজ্ঞের উপযোগিতা। অমলিনী তাকে বলল, ‘তুমি সুবক্তা ও মনে মনে শান্ত।’
জেনিফার বলল, ‘ধন্যবাদ। আমি শান্ত কারণ প্রতিদিন আমি ধ্যান করি। না হলে লিখতে পারব না। এমন একটা দেশ থেকে আমি 888sport live football কর্মশালায় এসেছি, যে দেশে 888sport live footballের কোনো মূল্য নেই। সিঙ্গাপুরের স্কুলে কাব্য-888sport live football আর পড়ানো হয় না।’
‘কী বলছ?’
‘হয়। তবে ঐচ্ছিক। ছোটরা 888sport live football কী তা জানবেই বা কী করে যে তাদের গল্প-888sport app download apk পড়তে ভালো লাগবে। তারা অ্যাকাউন্টেন্সি শিখছে, 888sport apk ও প্রযুক্তি শিখছে। যে কজন অভিভাবক জোর করে 888sport live football পড়ান, সেটুকু। খুব শিগগির সেটাও উঠে যাবে। সিঙ্গাপুরে মাঠ নেই, 888sport live football নেই, আকাশ ঢেকে যাচ্ছে বড় বড় বিল্ডিংয়ে। সেখানে 888sport live footballচর্চার প্রেরণা কী! একমাত্র ভরসা সিঙ্গাপুরের বাইরেও আমার পাঠক আছে কারণ আমি ইংলিশে লিখি।’
প্রকৃতি নেই? সারা সিঙ্গাপুরে প্রকৃতি নেই? সেখানে কি সূর্য ওঠে না? অস্ত যায় না? আকাশ দেখার একটু ফালিও কি নেই? এবং, শেষ পর্যন্ত এটাই অমলিনীর মনে হয়, নগরের মধ্যে প্রকৃতি সম্পূর্ণ লোপ পায় না, পেতে পারে না, কারণ আকাশ ঢেকে ফেলবে, সেই সাধ্য মানুষের নেই, যা হারায় তা প্রকৃতির হৃদ্স্পন্দন শোনার ইচ্ছা। নগর মানুষের হৃদয় থেকে প্রকৃতি হরণ করে।
শুধু সিঙ্গাপুর কেন, প্রতিটি ঊর্ধ্বগতি নগর একইরকম।
তারা বারান্দায় এলো। আকাশের রং ধূসর হয়ে আসছে। সূর্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। রাইটার এবং ইয়াপের সদস্যরা চোখে কাগজের রঙিন চশমা এঁটে সূর্যগ্রহণ দেখছে আর সোল্লাসে চিৎকার করছে। ওই গেল গেল গেল। ওই আধখানা। আরে চাঁদের চেয়েও ফিকে। দেখো দেখো কালো হয়ে যাচ্ছে। গ্রাস, গ্রাস! এঃ পাখিরা ভয় পাচ্ছে।
খাবারের ধামা এসে গেল। বার্গার। যারা বিফ খায় না তাদের জন্য হ্যাম বার্গার। যারা হ্যাম খায় না তাদের জন্য বিফ বার্গার। অমলিনী ছাড়া আর কেউ নেই যে বিফ খায় না। কিন্তু বিফ খেলেও অনেকেই শূকরের মাংস বেশি পছন্দ করে। তরমুজ, স্ট্রবেরি, আঙুর, ফুটি প্রভৃতি ফলও এসেছে প্রচুর। কিছুক্ষণ সূর্য দেখে অমলিনী খাওয়ায় মন দিলো। বার্গার কামড়ে খাবে, এদিক-ওদিক দিয়ে টুকরো-টাকরা পড়বে না, এমনটা হতে পারে না। সে বেশ সতর্ক হয়ে রইল। অ্যালেক্স আর ভেরোনিকা সামনে। তারাও খাচ্ছে।
অ্যালেক্স : শবনম এটা খুব খারাপ করল। জিনেট কান্নাকাটি করছে। ইয়েরমেন মেসেজ করেছে।
ভেরোনিকা : ও ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নিল কেন?
অ্যালেক্স : নেবে না? ওকে লক্ষ্য করেই এগুলো বলা হয়েছে।
মোলি : আমার তা মনে হয় না। শবনমের কথাগুলো হৃদয়ের গভীর থেকে এসেছে। ভেবে দেখো ওর জীবন! ওর নিরাপত্তাহীনতা। আমাদের দেশও ভেঙে টুকরো হয়েছিল। রিফিউজি সমস্যার খানিকটা আমি বুঝি।
অ্যালেক্স : আজ আমাদের এখানে প্রথম দিন। পরিচয়ের দিন। আজ এসব না বললেই হতো না? শবনম কি ওর দেশ ফিরে পেল?
ভেরোনিকা : তুমি জিনেটের পক্ষ নিচ্ছ অ্যালেক্স?
অ্যালেক্স : আমি কোনো পক্ষ নিচ্ছি না। আমি শুধু রাইটারদের কাছে আরো একটু সহানুভূতি, আরো বিবেচনাবোধের প্রত্যাশা করছি।
মোলি : আবেগের প্রত্যাশা করছ না?
অ্যালেক্স : এটা আবেগ প্রকাশের উপযুক্ত জায়গা? আমরা একটা ইউনিভার্সিটিতে লেখক হিসেবে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি।
মোলি : শবনম কার প্রতিনিধি?
অ্যালেক্স : ও তো বললই, বেলজিয়ামের।
মোলি : ব্যস! মিটে গেল। একজন মানুষের এটুকুই সব?
অ্যালেক্স : তা আমি বলছি না। কিন্তু এভাবে না বললেও হতো।
মোলি : দেখো, কে কখন কোন কথায়, কোন পরিবেশে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে, তা কি আগে থাকতে বলা যায়?
ভেরোনিকা : আইডেনটিটি ক্রাইসিস নিয়ে কথা বলা কিন্তু শবনম শুরু করেনি। অন্যরা শুরু করেছে। সেসব ওকে প্ররোচিত করেছে।
অ্যালেক্স : ও ঠিক করেই রেখেছিল এগুলো বলবে।
মোলি : কেন?
অ্যালেক্স : সহানুভূতি আদায় করবে! নজর কাড়বে!
মোলি : প্রথমত, এটা সবাই জানে আমেরিকা চিরকাল ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, শবনম যদি আমেরিকার নাগরিকত্ব পায় তবে জিনেটের কিছু আসে-যায় না। তৃতীয়ত, এটাই ওর উদ্দেশ্য যদি প্রমাণিত হয়ে যায় তাহলে জিনেটকে অপমান করা ওর উদ্দেশ্য ছিল না!
অ্যালেক্স : তুমি এবার শবনমের পক্ষ নিচ্ছ। মাই ডিয়ার মোলি! [চলবে]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.