সত্যি বলতে একরকম রাতারাতিই গৌরীসেনের ভাণ্ডার লুটে এনেছিল তারা। কি দিনই না গিয়েছে সব। আর্থকাটিং, জাঙ্গলক্লিয়ারিং, হাটিং, ব্রিকসলোডিং, আর আনলোডিং, – এক একটা কন্টাক্ট-এর সঙ্গে রানিং পেমেন্ট। আরাং নেই এক পয়সার অথচ টাকা এসেছে যেন স্রোতের মতো – উপড়ে পড়েছে গিয়ে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে। আর সে কি কর্মচঞ্চল জীবন। রয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের এস, ডি, ও, থেকে শুরু করে গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারের হেড কোয়াটার্স অবধি কি ছুটোছুটিটাই না করতে হয়েছে। একদিকে কর্ণফুলির ব্রীজ অন্যদিকে সীমান্তবর্তী রামু-আরাকান রোডের প্রতিটি ধূলিকণাই যেন চিনে নিয়েছে তাদের মোটরের চাকার দানব টায়ারগুলোকে।
তখন চলেছে যুদ্ধ এ্যাসেনসিয়্যাল মিলিটারী ওয়ার্কের সর্বগ্রাসী প্রাধান্য আর প্রায়োরিটি, মাথায় ঘুরেছে কেবল নূতন নূতন কন্ট্রাক্ট বাগাবার ফন্দি-ফিকির। মুখে মুখে ক্যাপ্টেন মেজর আর লেফ্টেনেন্ট কর্ণেলদের মধু-নাম সংকীর্তন। তোয়াজ তদবির। ফুরসৎ ছিল না এক মুহূর্তেরও, যেন ঝড়ের গতিতে বয়ে গিয়েছে এক একটা দিনের কর্মবহুল জীবন! তবে হ্যাঁ, এই অমানুষিক ব্যস্ততার মধ্যেও এক একবার মনে হয়েছে : সত্যি, খোদা মেহেরবানই বটে – যিসকো দেতা ছপ্পর ফাড়কে দেতা। চলুক, চলুক এই যুদ্ধ – এই লড়াই – বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে চলুক!
বড় আপসোস্ করে নজুমিয়া, – বলে, “এমন যুদ্ধটাই থেমে গেল ডাক্তার! কি ছাই যে এখন করি? ভেবে ভেবে মাথাটা একেবারে গুলিয়ে যেতে বসেছে।”
উদাস ভঙ্গিতে সিগারেটের টান দেয় গোলাম রহমান, আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়ে, “তা যা বলেছে, – উহু, কী ডোবানটাই সত্যি ডোবালে এই জাপানী শালারা। ভেবেছিলাম ব্রিটিশরা আকিয়াব ফিরে দখল করলেও সেখানে বেশীদিন টিকতে পারবে না – আবার এক ধাক্কায় জাপানীরা বেটাদের মংডুর দরিয়ায় ফেলে আচ্ছা করে নাকানিচোবানি দিয়ে ছাড়বে। বলতো’ কী ভাবলাম আর আর কী হলো! বদকিমতি আর কাকে বলে।”
পিট্ পিট্ করে ওঠে নবীন ডাক্তারের চোখদুটো – কথা বলে না যেন চিবোয়, “যে যাই বল, যুদ্ধটা থেমে গিয়ে সবদিক থেকে কিন্তু ভালই হলো। ওষুধ পত্তরটাও রেগুলার পাওয়া যাবে এবার।”
– “কোন দিক থেকে ভাল হলো শুনি।” – প্রতিবাদে যেন ফোঁস করে ওঠে গোলাম রহমান, “ওষুধপত্তর তখনও কী পেতে না? গ্লুকোজ থেকে শুরু করে কুইনিন পর্যন্ত কোন মালটা তুমি আগুন দরে বেচনি বলত পার? আর তার ওপর সুদ বাবদ এই যে হাজারে হাজার টাকা কামালে, বলি যুদ্ধ না বাধলে আসমান থেকে বুঝি অতগুলো টাকা তোমার সিন্দুকে ঝরে পড়তো? দেখ ডাক্তার যখন তখন অমন সাধু সেজো না, ভারী রাগ ধরে বুঝেছ?”
রাগ অবশ্য ধরবারই কথা। হাজারে মাসিক একশ টাকা সুদে কর্জ দিয়ে যুদ্ধের দিনে গোলাম রহমানদের মতো নামগোত্রহীন অনেককেই রাতারাতি কন্ট্রাক্টার বানিয়ে ছেড়েছে ডাক্তার। আর্মি মেডিকেল কোর থেকে পেটিপেটি মেপাক্রিন গাপ করে এ অঞ্চলে ‘কুইনাইন-মাষ্টর’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। লালে লাল হয়ে গিয়েছে কালো বাজারে ওষুধ বেচে। তার ওপর এই তল্লাটে বিশ বর্গ মাইলের মধ্যে সেই একমাত্র পাশ করা এল, এম, এফ্ ডাক্তার। একবার ভেবেছিল সব ছেড়েছুড়ে রাতারাতি কন্ট্রাক্টর বনে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুলটা বুঝতে পেরেছিল নবীন। চাটগাঁয়ের এই ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বর অধ্যুষিত দরিদ্র পল্লীঅঞ্চলে কুইনাইনের পরিবর্তে স্রেফ ডিস্টিল্ড ওয়াটার পুরে ইঞ্জেকশন চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশী অর্থকরী আর নিঝঞ্ঝাট। উপরন্তু হালের এই সব রাতারাতি সাত রাজার ধন পাওয়া ভাগ্যবানেরা তো রয়েছেই – তাদের বিবিসাহেবাদের গর্ভাবস্থায় এক শিশি অটো ক্যালসিয়াম আর নবজাতকের জন্য নিয়মিত মিল্ক ফুডের যোগান চালিয়ে যেতে পারলে আর চাই কি? এ মুনাফার কাছে কী ছার সাত রাজার ধন।
সৎ বা সাধু নয় ডাক্তার। নিজেও জানে তা ভালভাবেই। আর সত্যি বলতে, কেইবা এমন সাধু এই দুনিয়ায়। ম্যান ইজ্ এ রেশনাল এনিম্যাল যার স্বার্থবুদ্ধিতে যত শান পড়েছে সে তত রেশন্যাল। পশুর সঙ্গে তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার কুট বুদ্ধিতে, তার স্বার্থ চেতনায় – এমনি একটা থিওরিতে ডাক্তার আস্থাবান। বলাবাহুল্য, যুদ্ধ থামতে সে নিজেও কম আঘাত পায়নি। কিন্তু তবু সাধুতার ভান করে গোলাম রহমানদের চটাতে বেশ আমোদ পায় ডাক্তার, বেশ খানিকটা কৌতুক অনুভব করে।
গোলাম রহমানের সরোষ উক্তিতে মিট মিট করে ডাক্তার হাসে, বলে – “আমরা হলাম গিয়ে ডাক্তার মানুষ – সেবাব্রতী। গরীব দুঃখীর মঙ্গলের দিকে চেয়ে কথা বললেই তোমাদের গা জ্বালা করে ওঠে – কিন্তু কী করি বল? খাঁটি কথা বলা যে আমার বদ অভ্যেস।”
– খাটি কথা! – চাপা ক্রোধে গোলাম রহমানের সারা শরীরটা রি রি করে ওঠে। অধৈর্যভাবে পকেটে হাত চালিয়ে বের করে নেয় সিগারেট কেসটা, “ওরে আমার দরদীরে – লোকের দুঃখে রাতে তার ঘুম হচ্ছে না! খুব বলতে শিখেছ যা’ হোক ডাক্তার।”
– “আহা রাগ কর কেন, তোমরা রাগ করলে আমি বেচারা যাই কোথায় বলতো?” – অমায়িক হাসিতে মোমের মতো গলে ওঠে ডাক্তার; “আসল কী জানো, যুদ্ধ না থাকলেই যে টাকা কামানো যায় না তা নয়। এ্যাদ্দিন ফোকটে টাকা কামিয়েছ; যখন তখন বিল দিয়ে টাকা পেয়ে গেছ – এতটুকুও তার জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তাই এখন যুদ্ধ থামতেই হন্যে হয়ে উঠেছ, ভেবে পাচ্ছ না কী করবে। আরে বাবা কিঞ্চিৎ বুদ্ধি খরচ করলে অমন কত টাকা ঘরে আসবে। তোমরা তো আর শুনবে না আমার কথা, নইলে – কই, দাও একটা সিগারেট। চা’টা আনাও।”
– “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই”; মন্ত্র বলে সবাই যেন মুহূর্তে উৎসাহিত হয়ে চটপট পকেটে হাত পুরে দেয় মণিব্যাগের জন্য। কার আগে কে চায়ের অর্ডার দিয়ে ডাক্তারকে তুষ্ট করবে তারই যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ প্রায় সঙ্গেই ডেকে ওঠে : ওরে হাবিব, চা আন খারা খারা, – ছ কাপ আর ছয়ান বিস্কুট।
ডাক্তারের দিকে সিগারেট কেসটি বাড়িয়ে ধরে গোলাম রহমান, বলে; “কী করে বুঝলে যে তোমার কথা শুনবো না? তালিম-টালিম দাও তবে সে বুঝি তুমি দোস্ত। দু’একটা ট্যাক্সি খাটিয়ে পয়সা হয় না ছাই।”
গেদুমিয়া ফোড়ন দিয়ে বসে, “তাও যদি শালার পেট্রোল পাওয়া যেত ঠিক মতো। তার ওপর আমাদের গুলো মোটর নাকি? আজ স্প্রিং ভাঙছে কাল টায়ার ফুটছে – বাজনার চেয়ে খাজনা বড়। বল, ডাক্তার বল, বুদ্ধিটুদ্ধি বাৎলাও একটা – শালার লেগে পড়ি – এমন নিষ্কর্মা বসে থাকা চলে না আর।” অন্তরে যতই বিদ্বেষ থাক, বাইরে ডাক্তারকে খাতির করে এরা। ডাক্তারের ধূর্তমির একটা কণা পেলেও এরা বর্তে যেতো। এ জন্যও দুঃখ তাদের কম নয় – গোপন একটা ঈর্ষার ভাবও রয়েছে এদের ডাক্তারের প্রতি।
ডাক্তার অবশ্য সবই জানে, সবই বোঝে। ঝোপ বুঝে কোপ মারার কৌশল তার জানা আছে আর সেই জন্যই তার ঠোঁটের কোণে আভাস লাগে ক্ষীণ বাঁকা হাসির। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সিগারেট টেনে টেনে বলে, “তোমরা দুটো পয়সা কামাবে এতো সুখের কথা – তবে হ্যাঁ, চুনোপুঁটি মেরে হাতে গন্ধ করে লাভ নেই। টাকা কামাতে হলে এয়শা কামাবে যাতে দেদার উড়িয়েও সাত পুরুষ নিশ্চিত্তে চলে যায়। এখন যুদ্ধ নেই যে তিরিশ টাকার কাজ করে তিরিশ হাজারের বিল করবে।
সে যুগ গেছে। পয়সা অত সহজে আর এখন আসবে না। রীতিমতো মাথা ঘামাতে হবে। আচ্ছা, ভেবে তোমাদের বুদ্ধি একটা বাৎলাব’খন!”
খোদাতালা সত্যি মেহেরবান। যার প্রতি তিনি সদয় তার খোস্-কিসমতি আর দেখে কে! মাথা খেলিয়ে নবীন ডাক্তার কিছু একটা বাৎলাবার আগেই একদিন বিস্ময়করভাবেই গোলাম রহমানের মগজে এক সুতীব্র চমক লাগলো – অতিন্দ্রীয় প্রেরণার আলো যে ভাবে আলো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি করেই উদয় হলো বুদ্ধির। আকস্মিক হলেও সেটা দৈব ব্যাপার। এই সেদিনকার ঘটনা, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ প্রতিবেশী আমির হামজা ফুঁসতে ফুঁসতে এসে হাজির। চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলছে, নিরুদ্ধ ক্রোধে সর্বাঙ্গ কাঁপছে ঠক্ ঠক্ করে। “মগরপুৎ হালা, আইন দেখাইতো আইস্যেদে তে আঁরে। বাইনঞ্চৎ, বেয়াদপ।”
– “ওবা কি অইল, এত গোসা কার উঅর?” – বিস্মিত কৌতূহল প্রকাশ করলো গোলাম রহমান।
আমির হামজা বিদ্যুৎগর্ভ মেঘের মতোই গুরুগর্জনে যেন চিড় খেয়ে উঠলো, “হালার ফইরার পোয়া ফইরা, – পিনর যে একখান তেনা যোগাইৎ ন পারে তারে কনে কইল্ বিয়া গইরতো? আচ্ছা, কন তো মিয়া” – আমির হামজা অগ্নিমূর্তি হয়ে বলে চললো।
অভিযোগ গুরুতর; “বেটা ভিখারীস্য পুত্র ভিখারী, পরনের যে একটুকরো ন্যাকড়া যোগাতে পারে না সে এসেছে বৌকে নিয়ে যেতে। স্বামীত্বের অধিকার দেখিয়ে আইনের ভয় দেখাচ্ছে – শরিয়তের নজির টানছে! মেয়েকে জবাই করতে হয় তাও সই তবু এমন স্বামীর ঘর করতে আর কখনই তাকে পাঠাবে না আমির হামজা। দুবেলা দুমুঠো খাওয়া যোগান চুলোয় যাক যে মরদ লজ্জা নির্ধারণের জন্য বিয়ের এই দু’বছরের মধ্যে এক ফালি কাপড় দিতে পারলো না বৌকে, তার এত তড়পানি।” – আমির হামজার রাগটা চরমেই উঠেছিল।
গোলাম রহমান আজকাল মিয়ামানুষ, ধন দৌলতের অধিকারী প্রতিপত্তি আর সম্মানে গ্রামের দশজনের ওপর আসন এখন তার। চাষাভূষোদের সালিস নিষ্পত্তি তো তারই করার কথা। অতএব রায় একটা তাকে দিতে হলো – “তালাক নিয়ে ফেলো গে; সত্যি তো, খাওয়া পরার অভাবে দলুর বৌয়ের মতো গলায় দড়ি দিয়ে মরতে তো আর পাঠাতে পারো না মেয়েকে। মেয়ে যখন তোমার সুন্দরী তখন অত ভাবনাই বা কিসের – কত ভাল ভাল জামাই পাবে তুমি” – হাকিমী গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রতিবেশীর অকৃত্রিম হমদরদী মেশাতে গিয়ে একবার ঢোঁক গিলে নিলে গোলাম রহমান। “আর শোনো, যদ্দিন মেয়ের জন্য জামাই একটা না পাচ্ছ তদ্দিন ও আমার বাড়ীতেই থাক। খাবে দাবে, একটু আধটু ঘরের কাজকর্ম করবে। গরীব দুঃখী মানুষ তুমি, নিজের একটা পেট চালানোই ভার – বুঝতে তো পারি সব। যাও, ওকে পাঠিয়ে দাওগে। আহা বেচারী! অমন মেয়ের কপালে কী দুর্ভোগ দেখ না। আজ একটা কাপড়ও না হয় এনে দেবো ওকে এজাহার মিয়ার কন্ট্রোল থেকে।”
কথাগুলো বলতে বলতে গোলাম রহমান তার বহুদিনের আরাধ্যা সুন্দরী জমিলার যৌবন উদ্বেল দেহ-তনুর একটা কাল্পনিক সান্নিধ্যের উষ্ণতা অনুভব কোরে সচেতন অবচেতনায় কামনার যে স্পন্দিত শিহরণ অনুভব করছিল শিরার উপশিরায়, কিসের একটা চকিত চমকে মুহূর্তে তলিয়ে গেল সেই বিচিত্র অনুভূতিটা। ‘কন্ট্রোল!’ শেষের কথাটা উচ্চারণ করবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভীষণ চমক লাগলো গোলাম রহমানের। আর পরমুহূর্তেই যেন উন্মেষ লাভ করলো তার দিব্যদৃষ্টির। … চোখের সম্মুখে এদেশের সাম্প্রতিক বস্ত্র-সংকট জ্বল জ্বল করে উঠলো। কাফনের অভাবে মুর্দার অবধি বিড়ম্বনার অন্ত নেই। অথচ কন্ট্রোলওয়ালাদের কাছে কাপড় আসে, – দরবেশহাট সাতকানিয়ার বড় বড় বস্ত্র-ব্যবসায়ীদের গুদামগুলো যে খালি পড়ে নেই সে সবাই জানে। তবু দিনের আলোয় একখানা কাপড়ও দেখতে পায় না কেউ, – অলক্ষ্যে সব পাচার হয়ে যায় কাল-ধামে। কিন্তু তাতেই বা এমন কী মুনাফা করছে এজাহার মিয়ার দল? অনেক, অনেক বেশীগুণ মুনাফার সন্ধান সে জানে। … গুমদুম, বাউলিবাজার মংডু ভুথিদং … ছায়া ছবির মতো পর পর ভেসে উঠলো তার মনশ্চক্ষে যুদ্ধের দিনের সেই ফ্রন্ট লাইন – বিবস্ত্র হয়ে আদিম অরণ্য যুগে ফিরে গিয়েছে যে সব অঞ্চল! – গোলাম রহমানের কুটিল ভ্রূদু’টোর নীচে অতি প্রকট তীক্ষèতায় চোখের তারা দুটো নেচে উঠলো : এই তো সুযোগ!
উৎসাহের উত্তেজনায় কখন যে উঠে পড়ে বেরিয়ে পড়েছিল তা সে নিজেই জানতে পারেনি গোলাম রহমান।
আর সে দিন রাত্রেই যখন চারিদিক নিঝুম হয়ে এসেছে, আরাকান রোডের খুলি উড়িয়ে কাপড়ের গাঁট বোঝাই গোলাম রহমানের বাস দুটো সেই প্রথম দক্ষিণ মুখি হাওয়া হয়ে যেতে শুরু করলো।
শনিবার হাটের দিন।
একটু বেলাবেলিতেই রহমান বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়লো। পুকুরের ধার দিয়ে, ক্ষেতের বুক চিরে চলা আল বেয়ে সে এগিয়ে চললো শিস্ দিতে দিতে।
মনটা আজ খুশীতে ভরে আছে রহমানের। একটা নয়, দুটো নয়, ছ’ ছ-জোড়া শাড়ী উপহার পেয়েও পাঁকাল মাছের মতো বার বার পিছলে যাচ্ছিল জমিলা। কিন্তু আজ তার ভাবে-ভঙ্গিতে যেন এই প্রথম আত্ম-নিবেদনের একটা সম্মতি সূচক ইঙ্গিত পেয়েছে গোলাম রহমান। সত্যি সত্যিই এবার হয়তো ধরা দেবে বন-হরিণী। তবে এইটেই একমাত্র খুশীর কারণ নয়। আরো একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে আজ সকালে। – সি, ও, আর থানার বড় দারোগা এসেছিল বীটে। তার বিরুদ্ধে নাকি সদরে দরখাস্ত গিয়েছে পল্লীমঙ্গল সমিতি থেকে। স্থানান্তরে কাপড় পাচার করছে নাকি সে। অন্যায় করছে! স্বয়ং ডি, এম, এন্কোয়েরী চেয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সে-ও গোলাম রহমান। কত ঘাগী সাদা চামড়া মেজর কর্ণেলদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে এনেছে সে, আর এরা তো সব চুনোপুঁটি। গোলাম রহমান ব্যবস্থা করে ফেলেছে চট্ চট্। বীটের মুন্সির ছোট রুমটির গণ্ডীর মধ্যেই এন্কোয়ারীর পরিসর সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে চির দিনের জন্য। যাওয়ার সময় দারোগাবাবুরা একটু সাবধানেই কারবার চালাতে উপদেশ দিয়ে গিয়েছে বটে কিন্তু সেই সঙ্গে আশ^াসও দিয়ে গিয়েছে এই পল্লীমঙ্গল সমিতির প্রাণ স্বরূপ মোখ্তারকে কিছু দিনের জন্য হাওয়া বদলাবার ব্যবস্থা করবেনই তারা 888sport live chatীর। হাতে তাদের অস্ত্রের কমি নেই। এ সবলোক মারাত্মক – এ্যাটম বোমার চেয়েও নাকি ভয়ানক।
খুশীটা আজ যেন একটু উপচেই পড়ছে রহমানের। আলের দু’পাশে জমিগুলোতে গ্রামের চাষীরা ধান কাটছে। রহমান সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে। শীতের সোনালী অপরাহ্ণ – মাঠে মাঠে মধু-গন্ধী সোনার ধানের সম্ভার। অদূরে আরাকান রোড বেয়ে হাটের লোকের গতায়াত। নির্মেঘ আকাশের তলা দিয়ে মিঠে রোদে পাখনা মেলে এক ঝাঁক মরালী বিদ্যুৎ গতিতে উড়ে চলে গেল দক্ষিণের টেপার দিকে। এবার আরো খানিকটা লঘুতর ছন্দে জোরে জোরে বাজতে লাগলো – রহমানের শিসে ‘ম্যায় বন কি চিড়িয়া বন বন’ –
– আঁরার মিয়া নাকি? কডে যাইতো লাইগ্যান? (আমাদের মিয়া নাকি? কোথায় যাচ্ছেন?) – মাঠ থেকে কাস্তে হাতে এক চাষী প্রশ্ন করলে!
মুহূর্তখানেক হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে নিরুত্তরেই আবার চলতে শুরু করলো রহমান : কোথায় যেন একটা খোঁচা রয়েছে লোকটার প্রশ্নে, প্রচ্ছন্ন খানিকটা বিদ্বেষ। – নিজের অজ্ঞাতেই রহমানের চলার গতি দ্রুত হয়ে উঠলো : রীতিমতো বেতমীজ আর উদ্ধত হয়ে উঠেছে এই অঞ্চলের চাষীগুলো।
কি জানি কী কার্য কারণ যোগ হঠাৎ কোন্ এক ফাঁকে তার মানশ্চক্ষে ঝলসে উঠলো শানিত তরবারীর মতো একটা মুখ। আর সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলো বিছের কামড়ের মতো সর্বাঙ্গময় এক সঞ্চরমান জ্বালা অনুভব করলো গোলাম রহমান।
কিন্তু সেখানে শেষ হলো না ব্যাপারটা।
হাটে যেতেই পাশর্^বর্তী খাল পাড় থেকে কার উচ্চ কণ্ঠের ভাষা ভাষা কথার রেশ কানে এলো। কৌতূহলী বিস্ময়ে গোলাম রহমান এগুতে লাগলো সেদিকে। হাটের লোকগুলো খাল পাড়েই এসে যেন ভেঙে পড়েছে। মিটিং। কিন্তু কে এই লোকটা যাকে এখনো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না অথচ যার উদ্দীপ্ত কণ্ঠ আগ্নেয় তীরের মতোই এসে বিঁধছে রহমানের মর্মমূলে।
বক্তাটি যে কে তা বুঝতে পেরে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই রহমান কেমন যেন ভয়ে ভয়ে সভার পেছন দিকের একটা বাঁশঝাড়ের ধার ঘেঁষে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়ালো : চারিদিকে আগুন লাগাবে নাকি লোকটা! কী সব বলে চলেছে। … দিকে দিকে বস্ত্র সঙ্কট অথচ আমাদের চোখের সামনে দিনের পর দিন গাঁটকে গাঁট কাপড় লোপাট হয়ে যাচ্ছে কালো-বাজারে। – একটা আকাল যেতেই আবার আর একটা আকাল আসছে। আমাদের পরনের কাপড়, মুখের গ্রাস দেহের প্রাণ সমস্তই কেড়ে নিচ্ছে অত্যাচারীর দল। – সংকটের পর সংকট আঘাতের পর আঘাত অত্যাচারের পর অত্যাচার! আর আমরা – যত দুঃখী কিষান ভাইরা নির্জীবের মতো অত্যাচারীর হাজার জুলুম সয়ে চলেছি। কিন্তু আর নয় – মানুষের মতো বাঁচবার অধিকার আমাদের আছে। আমরা বাঁচবোই – এসো আমরা ভাই ভাই জেগে উঠি – দাবানলের মতো জ্বলে উঠে –
গ্রাম-গ্রামান্তরের নিশ্চুপ জনতা রুদ্ধনিঃশ্বাসে শুনে চলেছে। রক্তে কল্লোল জেগেছে তখন ওদের। জ্বলন্ত মুখ – জ্বলন্ত চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে আগুন। ঠিক আগুন নয়, খুন – আর সেই খুনই যেন লাল হয়ে জ্বলছে সান্ধ্য গোধূলির রক্তিম চক্রতীর্থে।
হঠাৎ কোন এক ফাঁকে বক্তার মুখটা এক মুহূর্তের জন্য রহমানের চোখে পড়েই আবার জনতার আড়ালে মিলিয়ে গেল। শানিত তরবারির মতো সেই মুখ। মোখ্তার, গোলাম রহমানের মনে হলো একটা ছুটন্ত উল্কার মতো অগ্নিপিণ্ড তার চোখদুটোকে যেন ঝলসে দিয়ে গেল ভীষণ ভাবে।
কিন্তু এবার আর বিছের কামড় নয় – খানিকটা তরল আগুনের দহন জ¦ালাই যেন সঞ্চারিত হয়ে গেল রহমানের সর্বাঙ্গে। জ¦লন্ত-বিদ্বেষে ফিরতে যাবে এমন সময় সে দেখতে পেলো মন্থরচালে বীটের মুন্সী এগিয়ে আসছে গোটা দুয়েক কনষ্টবলের আগে আগে।
রহমানের পাশ কেটে এগিয়ে যেতে যেতে মুন্সী অভয়ের হাসি হাসলো। চাপাগলায় বললো “ভয় কি? আজই তো মৌকা এসে গেল। দুর্ভিক্ষের নাম গন্ধ নেই অনর্থক প্যানিক সৃষ্টি করছে লোকটা। বুঝুক ব্যাটা এবার ছ’মাস অন্ততঃ হাওয়া বদলে আসুক।” বলেই একবার চোখ টিপলো মুন্সী : আজই যাব কিন্তু, থাকবেন বাড়ীতে।
খানিকটা স্বস্তিবোধ নিয়েই রহমান এসে ডাক্তারের ডিপেনসারীতে ঢুকলো। বাইরে তখন একটা তুমুল শোর উঠেছে – সহস্র কণ্ঠ প্রতিবাদে যেন ফেটে পড়ছে খালপারে।
– “হুঁ, মুখতার ব্যাটা দেখছি চাষাগুলোর ভারী পেয়ারের লোক হয়ে উঠেছে!” – প্রেস্ক্রিপসনের ওপর থেকে চোখ না তুলেই মন্তব্য করলে ডাক্তার!
কিছুদিন পরে –
সম্মুখে এক কাপ চা নিয়ে রহমান দেউড়ীতে বসে হিসেবপত্তর দেখছিল। এমন সময় নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবেই নবীন ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটলো। রীতিমতো বিস্ময় বোধ করলো রহমান, “বলি, ডাক্তার যে! হঠাৎ কী মনে করে? ভুলেও তো কোনদিন এপথ মাড়াও না।”
ঠোঁটের কোণে একবার আলগাভাবে হেসে ডাক্তার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো। পকেট থেকে বের করে নিজের সিগারেটের প্যাকেটটাই এগিয়ে দিল রহমানের দিকে (কোনদিন দেয় না, এই প্রথম), বললে – “কেমন চলছে তোমার কাপড়ের ব্যবসা? হাজার বিশেক নাকি কামালে? ভালো, ভালো, যেভাবেই হোক ঘরে মোটা কিছু এলেই হলো।”
রহমান একটা নিঃশ^াস ফেললো, “হচ্ছিল তো ভালই ভাই, কিন্তু কী জানো, পল্লীমঙ্গল সমিতির লোকগুলোই খোদার কসম, সব পণ্ড করে দিচ্ছে। শালারা যেন ওঁত পেতে আছে চারদিকে। অত ভয়ে ভয়ে কি কাজ-কারবার করা যায়? বেটা মুখতারটাকে ধরবার পর থেকে যেন কী হয়েছে চাষাগুলোর – প্রত্যেক গ্রামে গ্রামেই যেন এক একটা সমিতি গজাচ্ছে। কে জানতো ওকে এরেষ্ট করলে এমন উল্টো ফল ফলবে! তা হলে কী আর আমি -” ডাক্তারের কানে কিন্তু কথাগুলো ঢুকছিলো না। সে তখন গভীর তত্ত্ব-চিন্তায় বিভোর। মুহূর্ত খানেক সে নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ গম্ভীরভাবে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ বের করে নিলে। রহমানের সামনে সেটা এগিয়ে দিয়ে বললে, “এই দেখ।”
রহমান কৌতূহলী দৃষ্টি বুলালে কাগজটার ওপর : বড়লাটের বেতার বক্তৃতা; সমারোহে আগত প্রায় দুর্ভিক্ষের বিজ্ঞপ্তি প্রচার। নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি গুরুগম্ভীর বাণী দিয়েছেন লর্ড ওয়াভেল।
ডাক্তার সিগারেট ধরিয়ে নিলে একটা, “বুঝলে কিছু?”
– “পল্লী মঙ্গল সমিতির লোকগুলো দেখছি এ্যাদ্দিন মিথ্যেই চেঁচায় নি!”
– “চুলোয় যাক তোমার সমিতি-টমিতি। আমি জিজ্ঞেস করছি, এখন কী করবে?”
– “কী আবার করবো। যার ভাবনা সে ভাববে, আমার কী?”
– “নাঃ তুমি দেখছি একটা আস্ত মূর্খ, এখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না।” একটু ভড়কে গিয়ে গোলাম রহমান ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালো! এবার রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠলো ডাক্তার, “বলি, টাকা কামাতে চাও? চাও তো বল। তোমার সঙ্গে একটা বিজনেস ডীলে লেগে পড়ি।”
টাকা! ডীল! ব্যাপারটা আগাগোড়া একটু রহস্যজনক বলে মনে হলেও এবং সঠিক কোন কিছুর আঁচ করতে না পারলেও রহমান বুঝলে ডাক্তার একটা ভাল মতলবই এঁটেছে! মুহূর্তে সে উৎসাহিত হয়ে উঠলো : “নিশ্চয় – নিশ্চয়।”
তারপর খানিকক্ষণ ধরে চা আর ঘন ঘন সিগারেট ধ্বংসের পালা। পরিশেষে ডাক্তার যখন উঠলো রহমানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম তখন চিক চিক করে জ্বলছে হীরের কণার মতো।
ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে দিতে চিন্তিত মুখে রহমান বললে, “বুঝলাম তো ভাই সব – কিন্তু যাই বল – একটু ভয় ভয় করছে!”
– “ভয়, কিসের ভয়?” – যেন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলো ডাক্তার।
– এই শালার সমিতির লোকগুলোকে। বেটাদের চোখ তো নয়, শকুন ফেল মেরে যায়। বললে বিশ্বাস করবে না, সেদিন রাতে কতকগুলো র্ফিতি মিলিটারী ট্রাক থেকে কয়েক টিন পেট্রোল কিনে রাতারাতিই ধান ক্ষেতে পুঁতে রাখলাম। অবাক হয়ে যাই, সে খবরটা পর্যন্ত জেনে ফেলেছে শালারা! আর এবার তো ধান-চাল – মুখের গ্রাস।
– “ওদের চোখে ধুলো দিয়ে কী করে পাচার করতে হয় সে বুদ্ধি বাৎলাবো আমি। তা ছাড়া দক্ষিণে সবখানেই তো আর সমিতি-টমিতি নেই। আর থাকলেই বা, ভয় যদি পাও তবে ভাই এসো না। জানোই তো লোকের অভাব হবে না আমার।”
– “অমনি তোমার রাগ হলো বুঝি? আমি কী বলেছি যে করবো না? নাও, আর একটা সিগারেট নাও।”
সাইকেলে উঠবার জন্য তৈরী হলো ডাক্তার, “তাহলে ওই কথাই রইল। এখন আমি আসি – রাত্রে একবার দেখা করো – চালানের কী ব্যবস্থা করতে হবে বলবো!”
আরাকান রোডের ওপর গভীর রাতের স্তব্ধতা নেমে এসেছে। দু’পাশের অরণ্যানী যেন পিচ-কালো অন্ধকারে প্রেতায়িত। আকাশে বাতাসে একটা আসন্ন ঝড়ের মহড়া চলেছে। কোথায় যেন একটা বাঘ ডাকছে দূরে, – অরণ্যমণ্ডিত পাহাড়ের গায়ে গায়ে তারি ধ্বনি-তরঙ্গের রেশ।
আর বাতাসে পোড়া পেট্রোলের গন্ধ ছড়িয়ে উত্তরমুখী মিলিটারী ট্রাকের একটা ছোট্ট কনভয় হু হু ছুটে চলেছে। দোলাহাজারার ‘ঢালা’ – দীর্ঘ আট-মাইল ব্যাপি ভয়ঙ্কর সেই অরণ্যপথ। ছুটন্ত হেড লাইটগুলোর তীর্যক আলোয় দু’পাশের নিবিড় বনানী উঠেছে রহস্যঘন হয়ে।
কনভয়ের পুরোভাগে একখানা জীপ – কর্তব্য-দৃঢ়হাতে ষ্টিয়ারিং ধরে বসেছে রহমান নিজেই। রেখাঙ্কিত ললাট, ঠোঁটের ফাঁকে অসহায়ভাবে সিগারেট পুড়ছে। পাশের সিটখানাতে বসে এক হাব্শি সেনা – নেশায়-নির্বাপিত চোখ-দুটো তার এক একবার বুজে আসছে জীপের দোলানিতে।
সমিতির লোকগুলোর শকুন-চোখে ধূলি দিয়ে নিশ্চিন্তে পাচারের উপায়টা ডাক্তার ভালই বাৎলেছে বই কি। বাউলিবাজার, গুমদুম, রামু, – যুদ্ধকালীন সেইসব সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলো থেকে মধ্যে মধ্যে এখনো দু’একটা করে খালি ট্রাক ফিরছে চাটগাঁ শহরের স্যালভেজ ডিপোতে। ধান তো ধান, ডাকাতি করে লুটের মাল এতে বোঝাই করে নিয়ে গেলেও ধরছে কে তোমাকে? কার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি পড়তে পারে এই সব মিলিটারী ট্রাকের ওপর?
দগ্ধপ্রায় সিগারেটটির আগুনে আর একটা সিগারেটই ধরিয়ে নিলে রহমান। আর খানিকটা পথ অতিক্রম করলেই ‘ঢালা’র জিরানী খোলা। এক দফা ধান বোঝাই করতে হবে সেখানেও। ফোড়েরা হয়তো ইতিমধ্যে অধীর হয়ে উঠেছে। তা উঠুক, রহমান নিজেও কম অধীরতা অনুভব করছে না। অনেকখানি পথ তার পরেও যেতে হবে তাকে। দোলাহাজারা ছাড়িয়ে চিরিঙ্গা আর চকরিয়া পেরুলে তবেই আসবে হারবাং। সেখান থেকে সাম্পান বোঝাই করে জলপথে রাতারাতি ধানচাল চাটগাঁ শহর, হাতিয়া, সন্দিপ, নোয়াখালি এমন কি সেই সুদূর কোলকাতার উদ্দেশে পাচার করে না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি কোথায় রহমানের?
অবশেষে চারদিক ভয়ঙ্কর হয়ে কাল-বৈশাখীর ঝড় উঠলো। ঢালার ‘জিরানী-খোলা’ পেরিয়ে ততক্ষণে অনেকখানি পথ এসে গিয়েছে কনভয়। মাইল খানেক আর এগুলেই শেষ হবে ভয়াল এই অরণ্য পথটা। হাওয়ার তীব্র গতির সঙ্গে তাল রাখতে গিয়েই যেন এক্সিলেটারে আরো খানিকটা চাপ দিয়ে দিলে রহমান।
নিবিড় নিবদ্ধ এই অরণ্যালোকেও জেগেছে ঝড়ের প্রলয় নৃত্যের দোলা। অভ্রভেদী গর্জন সামালিশের ডালে ডালে ক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝার দাপাদাপি শুরু হয়েছে। হুহুঙ্কারে ছুটছে হাওয়া – আর তারই সঙ্গে আরাকান রোডের রাঙামাটির ধুলো উড়ছে।
বাতাসের একটা অতি প্রচণ্ড ঝাপটার সঙ্গে হঠাৎ মুসলধারে বর্ষণ শুরু হলো! হেড-লাইটের তীব্র আলোতেও খানিকটা দূরের পথ তেমন আর দেখা যায় না। ঘষা কাঁচের মতো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। সশব্দে সামনের কাঁচে ছিটকে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। অর্দ্ধচন্দ্রাকারে একটানা ওয়াইপারটা ঘুরছে। এক্সিলেটরের চাপটা খানিকটা আলগা করে দিয়ে স্পিড মিটারের কাঁটাটা ধীরে ধীরে তিরিশের ঘরে নামাতেই হলো রহমানকে।
ঢালার মুখটা অতিক্রম করতে না করতেই হঠাৎ ভীষণভাবে চমকে উঠে রহমান আচমকা ব্রেক কষে দিলে। সম্মুখের দিকে তাকাতে গিয়েই বিস্ফারিত হয়ে উঠলো হাবশী সেনার চোখদুটো। হেড্ লাইটের তীক্ষè আলোকচ্ছটায় খানিকটা দূরে ঘষা কাঁচের মতো পর্দার আড়ালে কতকগুলো ঝাপসা মূর্তি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে। হাতে তাদের কিরিচ দা’গুলো ঝক ঝক করছে : গাড়ী থামাও, গাড়ীর ভেতর কী আছে আমরা দেখবো।
এখানেও ওরা! – মাত্র একটি মুহূর্তের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। ঝাপসা মূর্তি-গুলো দু’পা এগিয়েছে কি অমনি একহাতে হাবশীটার পকেটে এক তাড়া নোট গুঁজে দ্বিয়ে রহমান ক্রূর আনন্দে গাড়ী ছুটিয়েই টপ্ স্পীড দিয়ে দিলে। এবং পলক ফেলতে না ফেলতেই ছুটন্ত গাড়ীটা জনকয়েকের ওপর দিয়েই সাঁ করে বেরিয়ে গেল। পেছনের ট্রাকগুলোও যেন হাওয়ার মুখে উড়ে গেল নির্বিকারে। তারপর একরকম রুদ্ধনিঃশ্বাসেই একটানা চালিয়ে সেই চিরিঙ্গা। বৃষ্টি বা ঝড়ের কোন নিশানাই নেই এখানে। চিরিঙ্গার ব্রীজটা পার হতে না হতেই আচমকা গাড়ী থামালে রহমান।
সর্বাঙ্গে তখন তার এক ভীষণ কাঁপুনি লেগেছে। গলাটা উঠেছে শুকিয়ে। হাবশীটাকে লক্ষ্য করে রহমান জড়িত কণ্ঠে বললো – “নাও ইও ড্রাইব সর্জেন্ট। মি ভেরি টায়ার্ড।” বলেই সে সিট থেকে নেমে পড়লে পথে। কেন কি জানি একবার অত্যন্ত ভয়ে ভয়েই সে তাকালো পেছনের ফেলে আসা পথের দিকে। অকারণে, অত্যন্ত অকারণেই তার মনে হলো সেই ফেলে আসা দূর দিগন্তে যেখানে কালো অন্ধকারে একাকার হয়ে মিশে আছে অরণ্য রেখা – ঠিক সেইখানে কোথায় যেন তুমুল সোর উঠেছে একটা।
অনুমানটা অবশ্য একবারে মিথ্যে নয় রহমানের। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা সোর কিন্তু সত্যই উঠেছিল অন্য কোথায় – অন্য কোনখানে।
ফেলে আসা দূর পশ্চাতে নয় – ক্রোশ আট সম্মুখে, এপথেরই পার্শ্ববর্তী কোনো পল্লীর সুষুপ্তি ভঙ্গ করে দিয়ে তখন জ্বলন্ত করগেটের টিনগুলো রাত্রির আকাশ পথে উড়ে চলেছে। আগুন লেগেছে রহমানেরই বাড়ীতে আর সে আগুনের লেলিহান শিখা বাতাসের তালে তালে নাচছে প্রলয়ঙ্করী মূর্তিতে! জ¦লন্ত বাড়ীর আতঙ্কগ্রস্ত স্ত্রী পুরুষের বিহ্বল কলকণ্ঠ তলিয়ে দিয়ে আকুল চীৎকারে রহমানের বৃদ্ধ পিতা সাহায্যের নিষ্ফল আর্জি জানাচ্ছে। আর অনড় হয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা উপভোগ করছে সমস্ত বৃত্তটাই।
– জ¦লুক, জ¦লুক! – মাইনসের বদদোয়া পইড় গে দে তার উয়র।
পুকুরের ওপারে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ হালিম স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য করলে পাশে দাঁড়ানো প্রতিবেশীদের লক্ষ্য করে।
নিজ বাড়ীর উঠোন থেকে আমির হামজাও তাকিয়ে দেখছে ভয়ঙ্কর কালো আকাশের পটভূমিকার খানিকটা অংশ জুড়ে রুধিরাক্ত সেই দীপ্তিচ্ছটা উল্লসিত হয়ে মনে মনে সিন্নীই বুঝি সে মানছে এই মুহূর্তে। দশ দশ কানি জমি তার বাকী খাজনার দায়ে নিলামে তুলে কবজ করে ফেলেছে ওই রহমান। এতদিনে গজব পড়েছে তার ওপর খোদার।
কিন্তু আমির হামজা একটু ভুলই বুঝেছে। খোদার গজব নয় – মানুষের ক্রোধই জ্বলে উঠেছে আগুন হয়ে।
উপহারের শাড়ীগুলো বগলদাবা করে খিড়কির পথে উঠানে ঢুকে অলক্ষ্যে বাপের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিল জমিলা। সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই গোলাম রহমানের আশ্রয় ছেড়ে চলে আসা উচিত ছিল তার। কিন্তু তবু সে সহ্যই করেছে ধৈর্য ধরে। প্রতীক্ষা করছে প্রতিশোধের দিনটির। জমিলা জানতে পেরেছিল গোলাম রহমান কত শত দুঃখী মা বোনদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্রখণ্ড নিষ্ঠুরভাবে হরণ করে চলেছে। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সে কয়েকটা উপহারের শাড়ীর বিনিময়ে বার বার কলঙ্ক লেপন করতে চেয়েছে তার 888sport promo code সত্তার উপর। এতদিনে তার প্রতীক্ষা সফল হয়েছে। প্রতিশোধ নিয়েই ফিরে এসেছে জমিলা।
তার সর্বাঙ্গ থেকে হঠাৎ বাতাসে এক ঝলক তীব্র গন্ধ ভেসে এলো পাশে দণ্ডায়মান আমির হামজার নাসারন্ধ্রে। পেট্রোলের তীব্র গন্ধ!
আমির হামিজ ভীষণভাবে চমকে উঠে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকালো মেয়ের দিকে।
জমিলা জ্বলন্ত বাড়ীর দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই অকম্পিত কণ্ঠে বললো, “আঁই অইন লাগাইদে ও বা’জি।”
বুলবুল চৌধুরী
জন্ম ১৯১৯ সালের ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতি গ্রামে। তিনি নৃত্য888sport live chatী এবং এদেশে মুসলমানদের মধ্যে নৃত্যকলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চার প্রচার-প্রসারের জন্য অধিক পরিচিত। তবে 888sport live footballচর্চার প্রতিও তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল, বিশেষ করে কথা888sport live footballে। তিনি ১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে কলা 888sport live chat বিভাগে মাস্টার্স করেন। মূলত নাচকে কেন্দ্র করেই তাঁর কর্মজীবন আবর্তিত। তিনি ১৯৫৪ সালের ১৭ই মে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রাইড অফ পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড এবং পরবর্তীকালে 888sport apps সরকার ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা পদক প্রদান করেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.