সৈয়দ জাহাঙ্গীর
শৈশব-কৈশোর
মায়ের কাছে শুনেছি আমরা ছিলাম চার ভাই আর এক বোন। বোনটা মারা যায় মাত্র ১২ বছর বয়সে। ওর মুখে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। কুলগাছের একটা কাঁটা লেগে ফোঁড়াটা ছিঁড়ে গেলে টিটেনাস হয়ে সে মারা যায়। সে-সময় টিটেনাসের লাগসই চিকিৎসা ছিল না। এক ভাই মারা যায় দু-তিন বছর বয়সের সময়। আমরা তিন ভাইয়ের মধ্যে সিকান্দার আবু জাফর সবচেয়ে বড়। এরপরই কোহিনূরভাই (সৈয়দ কোহিনূর আকবর), তিনি আমার চেয়ে ছয় বছরের বড় ছিলেন। জাফরভাই আমার চেয়ে পনেরো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ। আববা সৈয়দ মঈনউদ্দীন হাশেমী, মা জোবায়দা খানম। তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে এসেছিলেন আমার দাদা মৌলানা সৈয়দ আলম শাহ।
তিনি প্রথমে কলকাতায় আসেন এবং সেখানকার এক মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। তেঁতুলিয়া গ্রামের তৎকালীন জমিদার কাজী মিন্নাত উল্লাহ ওই মসজিদে নামাজ পড়তে যান এবং মৌলানা সাহেবের বয়ানে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তেঁতুলিয়া গ্রামের মসজিদে ইমামতি করার আমন্ত্রণ জানান। মিন্নাত আলী সাহেবের পিতামহ কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয় মোগল স্থাপত্য নকশার অনুকরণে। দিল্লি এবং আগ্রা থেকে প্রকৌশলী ও কারিগর এনে এই মসজিদ তৈরি করা হয়। মসজিদের দুটি গম্বুজ এবং বড় ও ছোট মিনারসহ বিশটি স্থাপনার শিরোভাগ তামার পাত দিয়ে চার ফুট পর্যন্ত স্থান মুড়িয়ে দেওয়া আছে। মনে হয় আবহাওয়ার হাত থেকে সেগুলো রক্ষা করার জন্যেই। মসজিদটি আড়াইশো বছর পরও সুন্দরভাবে অবস্থান করছে এবং মুসল্লিরা নিয়মিত ব্যবহারও করছেন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আলম শাহ তেঁতুলিয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। গ্রামের ওই মসজিদে ইমামতি শুরু করা এবং ধর্মীয় জ্ঞানদানের মাধ্যমে বহু ভক্ত তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। জমিদার পরিবারের দূরসম্পর্কের এক মহিলাকে বিয়ে করে দাদা গ্রামেই থেকে যান। কিছুকাল পর যখন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। দাদা মারা যাবার সময় আববা মোটে তেরো বছরের কিশোর। আববাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে উপার্জনে নেমে পড়তে হয়েছিল ভাইবোন-মায়ের সংসারের হাল ধরতে। মা ছাড়াও পরিবারে ছিলেন আরো দুই ভাই আর এক বোন। খুব কষ্টেই কেটেছে তাঁদের দিন। মাত্র একটা ঘরে বসবাস করতেন তাঁরা। বারান্দায় ঘুমাতে হতো কাউকে কাউকে। এভাবে মানুষ হয়েছিলেন চাচা সৈয়দ জালালউদ্দীন হাশেমী এবং ছোট চাচা শরফুদ্দীন হাশেমী। জালালউদ্দীন হাশেমী পরবর্তীকালে হন অবিভক্ত বাংলার এমএলএ। হয়েছিলেন কলকাতা করপোরেশনের প্রথম মুসলমান মেয়র। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার। স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছিলেন কিছুকাল। শুনেছি তিনিই প্রথম অ্যাসেম্বলির কার্যক্রম বাংলায় লেখা শুরু করেছিলেন। চাচা লাল-নীল পেনসিল ব্যবহার করতেন অফিসের কাজে। লাল-নীলের আঁকিবুঁকি আমার বালকমনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করত। ডেপুটি স্পিকার চাচার এক আরদালি ছিলেন উড়িয়া এক ভদ্রলোক। ব্রিটিশদের নিয়মানুযায়ী তার ছিল লাল রঙের জমিনের ওপর সোনালি সব বেল্ট ও রশি দিয়ে তৈরি ঝকমকে সুন্দর এক পোশাক। সে চাচার ওই লাল-নীল পেনসিল দিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকত। আমার বয়স তখন বছর চারেক। আমাকে খুব স্নেহ করত আর তাই আমাকে ছবি এঁকে দেখাত – ডানাওয়ালা দুলদুল ঘোড়া তীরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। আমিও শুরু করলাম ছবি আঁকা সেই তখন থেকেই। তেলমাখা মাথায় কাগজের ঘষা দিলে কাগজ অনেকটা ট্রেসিং পেপারের মতো হয়ে যায়। সেটাকে অন্য ছবির ওপর রেখে ড্রইং করা খুব সহজ হতো। আমিও তাই করতাম। পাশাপাশি কাঠকয়লা দিয়ে মাটির দেয়ালে নানা অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। এজন্যে বাবার কাছে উত্তম-মধ্যম খেতে হয়েছে। একদিন প্রতিবেশীর বাড়ির ভিটা মাটি দিয়ে লেপে ঝকঝকে করে তোলা দেখে ছবি আঁকার শখ হলো। এতো পরিচ্ছন্ন জায়গাটা কাঠকয়লার আঁকিবুকি না থাকলে কি মানায়। হাত নিশপিশ করতে লাগল। মনের সুখে ছবি আঁকতে থাকলাম। ওই বাড়ি থেকে নালিশ এলো। বাবাকে ব্যবস্থা নিতেই হলো। শরীরের ওপর দিয়েই গেল, মনে এতটুকু আঘাত লাগেনি। ছবি অাঁকায়ও ছেদ পড়নি। আমি একটানে মানুষের চোখ-মুখ-ঠোঁট এঁকে ফেলতে পারতাম। এভাবে : আমাদের প্রাথমিক স্কুলের অঙ্কের স্যার হরেনবাবু একবার ছুটিতে গেলে তাঁর জায়গায় এলেন তাঁর ভাই গগনবাবু। তাঁর কাছেই একটানে প্রোফাইল অাঁকার শিক্ষাটা পেয়েছিলাম। তিনি স্লেটে চক দিয়ে কীভাবে ড্রইং করতে হয় দেখিয়ে দিতেন। আমার ভারি পছন্দ হয়ে গেল ব্যাপারটা। তাঁর ন্যাওটা হয়ে গেলাম। পেছন পেছন ঘুরে নাছোড়বান্দা হয়ে তাঁর কাছ থেকে নতুন নতুন ড্রইং শিখে নিতাম। তিনি ছবি আঁকতেন, আর আমি হুবহু কপি করতাম। যশোর থেকে পাইকগাছা যেতে রওনা হলে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পেরোলে আমাদের গ্রাম তেঁতুলিয়া। তেঁতুলিয়া জামে-মসজিদ পেরোলে একশ গজ দূরে হাশেমী বাড়ির পরিবার-পরিচিতি স্তম্ভ।
ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময় গ্রামের বাড়িতে চাচার ঘরে তেলরঙে অাঁকা একটা পোর্ট্রেট চোখে পড়ে। কংগ্রেসি চাচা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর নেহরু টুপি পরতেন। চশমা চোখে পোর্ট্রেটটা নাকি কলকাতার এক 888sport live chatী (চাচার পরিচিত) চাচাকে মাত্র একবার দেখে এঁকেছিলেন। এটা আমার কাছে জাদুর মতোই মনে হলো। মাত্র একবার দেখেই একটা ছবি অবিকল অাঁকা যায়! প্রবোধ দত্ত নামে ওই 888sport live chatী ভদ্রলোক একবার এলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে। তাঁর সাইকেলের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিল। আমি সেটা সারানোর কাজে লেগে পড়লাম ভদ্রলোকের নজর কাড়বার জন্য। একসময় সফল হলাম। তিনি বললেন, আগে লেখাপড়া শিখতে হবে। তারপর ছবি অাঁকা শেখা। আমাদের বাড়িতে কলকাতা থেকে যেসব পত্র-পত্রিকা ও 888sport free bet login আসত সেসব উলটেপালটে দেখতাম। সেসবের ভেতর যত ছবি বা ইলাস্ট্রেশন থাকত সেসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম আর কপি করতাম।
আমাদের ক্লাসে ফার্স্ট হতো একটা হিন্দু ছেলে। আমি হতাম সেকেন্ড। সে-সময় স্কুলের শতকরা ৯৫ ভাগ ছাত্রই ছিল হিন্দু পরিবার থেকে আসা। সত্যি বলতে কী, জনাদশেক মুসলমান ছাত্র ছিল গোটা স্কুলে। তার ভেতর আমাদের পরিবারেরই সদস্য বেশি। আমাদের ক্লাসের এক ডানপিটে ছেলে ঘুসি মেরে ব্ল্যাকবোর্ডের কোনা ফাটিয়ে দিয়েছিল একবার। মনে মনে তাকে কাবু করার ফন্দি অাঁটলাম। একবার বাগে পেয়ে গেলাম। ক্লাসের হাই বেঞ্চির সঙ্গে ওর মাথা চেপে ধরে বললাম, এইবার মাতববরি কর হে। তারপর থেকে ওর বাহাদুরি ছুটে গেল। ছোটবেলা থেকে আমার বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করার অভ্যাস ছিল। আববার একটা দোনলা বন্দুক ছিল, যা দিয়ে আববা শিকার না-করলেও জাফরভাই এবং পরে কোহিনূরভাই শিকার করতেন। আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ শিকারি। একবার পাশের বিলে একটা ডাহুক শিকার করতে গিয়ে উড়ন্ত ডাহুককে গুলি করলে একটা ছররা গ্রামের এক মহিলার হাতের আঙুলে গিয়ে লাগে। সেদিন ছিল হাটবার। হাটে রটে গেল মুনি মিয়ার (মঈনুদ্দীন হাশেমী) ছেলে এক মহিলাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। কদিন পর থানার দারোগা এলেন তদন্তে (ইংরেজ দারোগা)। চাচা জালালউদ্দীন আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই বাচ্চা ছেলে, বারো বছর বয়স, ও তো বন্দুক উঁচুই করতে পারে না। মহিলা আমাদের বাড়িতে কাজ করত। হাত দেখিয়ে বললো, আমি জঙ্গলে গিয়েছিলাম, সেখানে আঘাত পেয়েছি। সে-যাত্রা রেহাই পেয়েছিলাম। পরবর্তী জীবনে বহুবার শিকার করেছি। পাকিস্তানের ঝিলাম নদীর তীরে বেশ কজন বাঙালি সিনিয়র সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে। চাঁদপুরের মেঘনা-যমুনা মোহনায়ও হাঁস শিকার করেছি কয়েকবার। সিলেটের হাকালুকি হাওরেও শিকার করেছি একবার।
আমি আর মেজভাই কোহিনূর, ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতাম। আমি স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হই ক্লাস নাইনে পড়ার সময়েই। আমি ফরোয়ার্ডে খেলতাম, স্কোরার ছিলাম। মেজভাই ছিলেন ডিফেন্ডার। পনেরোটা মতো দল ছিল ওই অঞ্চলে। অনেক সময় বিভিন্ন দল আমাদের টাকা দিয়ে খেলাতে নিয়ে যেত। খেলার মধ্যে মারামারিও কম হতো না। আমরাও জড়িয়ে পড়তাম মারামারিতে। একবার আমাদের বাড়ি তালা থেকে বেশ দূরে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলাম দুভাই। খেলা শেষে কোহিনূরভাই বললেন, তুই সাইকেল নিয়ে চলে যা, আমি পরে হেঁটে চলে আসব। ভাই বেশ সাহসী ছিলেন, আর আমি ছিলাম ভীতু। ভূতের ভয় ছিল খুব। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সাইকেল চালাতে লাগলাম জোরে জোরে। পথে একটা বিশাল বটগাছ পড়বে। ওটার ছায়া খুব ভীতিপ্রদ মনে হতো ছোটবেলায়। ওই বটগাছের নিচে দিয়ে যেতে যেতে ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। ভূতেরা যদি আমাকে সাইকেলসহ গাছে তুলে নেয়। একটু যেন ভেজা-ভেজা কিছু পড়ল এসে গায়ে। ভুতেরা নাকি পেশাব করে দেয় বলে শুনেছি। আরো জোরে চালাতে লাগলাম সাইকেল। গ্রামের কর্দমাক্ত পথে গরুর গাড়ি চলায় চাকার দাগ বসে গর্ত হয়ে গিয়েছিল। তার ওপরের জায়গা দিয়ে সাবধানে সাইকেল চালাতে হয়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পড়ে গেলাম সাইকেল নিয়ে। চিৎকার করে উঠলাম ভয়ে। অবশ্য ততক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। খুব ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। পরে জানতে পারলাম, ওখানে খানিকক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিল। বটগাছ থেকে আমার শরীরের ওপর জমে থাকা সেই বৃষ্টিরই পানির ছাঁট এসে পড়েছিল। ওটা ভূতমূত্র নয়। বটগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার বিক্রমশালী চেহারা এখন আর নেই। জায়গাটাও হারিয়েছে সেই নির্জনতা। দোকানপাট নিয়ে তৈরি হয়েছে ছোটখাটো বাজার।
আমাদের বাড়ি থেকে কপোতাক্ষ নদ ছিল দু-মাইলের হাঁটাপথ। বর্ষার সময় একহাঁটু কাদার মধ্যে স্কুলে যেতাম। স্কুলশেষে বাড়িতে ফিরে এসে আবার বিকেলে ফুটবল খেলতে কাদামাখা পথ পেরুতাম। শীতের সময় কপোতাক্ষ নদী দিয়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্টিমার চলত। তালা থেকে স্টিমারে ঝিনাইদহ যাওয়া ছিল খুব সহজ। ঝিনাইদহ থকে ট্রেনে সোজা কলকাতা যাওয়া যেত। ওটাই ছিল কলকাতা যাওয়ার শর্টকাট রুট। স্টিমারের হুইসেল শুনে দু-মাইল ছুটে আমরা ঠিকই পৌঁছে যেতাম স্টিমার দেখতে। দুর্গাপূজার সময় মেলা বসত ওই কপোতাক্ষ নদের তীরে তাই জায়গার নামকরণ হয়েছিল মেলাখোলা। মেলাখোলায় দাঁড়িয়ে স্টিমারের ছুটে চলা কত দেখেছি। দড়ি বেঁধে পাটাতন নামিয়ে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে জানান দেওয়া হতো যাত্রাবিরতির। ঘাট থেকে যাত্রীরা উঠতেন, অনেকে আবার স্টিমারের পেট ফুঁড়ে ওই অজপাড়াগাঁয় নেমেও আসতেন। হুইসেল বাজিয়ে যতক্ষণ না স্টিমার পাটকেলঘাটা বা সাগরদাঁড়ি রওনা হতো, আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম চোখভরা আনন্দ আর বিস্ময় নিয়ে। ছেলেবেলায় স্টিমার আমাদের চোখে আকর্ষণীয় এক স্বপ্নের জলযান হয়ে উঠেছিল। আজ এতকাল পরে কপোতাক্ষের সেই যৌবন আর নেই। স্টিমারও আর চলে না। মেলাখোলায়ও বসে না পুজোর মেলা।
জমিদার পরিবারের রেজওয়ানুল্লাহ ছিলেন আমার চাচা আলালউদ্দীন হাশেমীর সহপাঠী, আর একই পরিবারের শফিউল্লাহ ছিলেন অপর চাচা শরফুদ্দীন হাশেমীর সহপাঠী। আমার দুই চাচা জমিদার পরিবারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
জমিদার পরিবারের কুখ্যাতি ছিল প্রজা-পীড়নের জন্য। একবার হোসেন আর ইসমাইল নামে দুই গ্রামবাসীর পিতাকে কী অভিযোগে যেন জমিদারবাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রহারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়। হোসেন, ইসমাইল ছিল বাপ-চাচাদের খুব ঘনিষ্ঠ। এ-ধরনের আরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর সে-সময় আববা-চাচারা মিলে ঠিক করলেন, যে করেই হোক এই জমিদারকে প্রতিহত করতে হবে। অন্যায় আর সহ্য করা হবে না। তাঁরা হাশেমীর দল নামে পৃথক গোত্র প্রতিষ্ঠা করেন। জনগণও অতিষ্ঠ ছিল জমিদারের অত্যাচার-অনাচারে, তাই দল গঠনে কোনো অসুবিধা হলো না।
শ-পাঁচেক লাঠিয়াল যোগ দিলো এই দলে। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভালোমতোই চলল প্রতিপক্ষ দুই দলের ভেতর। এ নিয়ে নানা কাহিনি আছে। আমার চাচা জালালউদ্দীন হাশেমী একবার বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে পা হারান। তিনি চলতেন ক্রাচে ভর দিয়ে। জমিদারবাড়ির পাশেই ছিল মসজিদ। সেখানে ঈদের নামাজ পড়ে ফেরার পথে তাঁকে জমিদারের লোকেরা আক্রমণ করে। ছোট চাচা ছিলেন শক্তিমান পুরুষ। তিনি একাই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। জমিদারের বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। জমিদারের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হলো। ছোট চাচা আবার মামলা-মোকদ্দমায় বেশ ওস্তাদ ছিলেন। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে আস্তে আস্তে জমিদারের জমিজমা শেষ হতে লাগল। এক পর্যায়ে জমিদারের অধিকাংশ জমিই আমাদের পূর্বপুরুষের দখলে চলে এলো। পরে অবশ্য জমির প্রকৃত মালিকদের কাছেই সেসব জমি বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সরকার জমিদারপ্রথা বিলোপ করে দেয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, জমিদারি গ্রহণের পর বাৎসরিক পুণ্যাহর দিন প্রজারা আমাদের বাড়িতে এসে খাজনা দিয়ে যেত। লাঠিখেলা হতো। ঢোল-বাদ্যসহ নাচ-গান হতো।
আমার ছবি অাঁকার উৎসাহের নেপথ্যে আরেকটি কারণ ছিল দুর্গাপূজা। পুজো শুরু হওয়ার এক-দেড় মাস আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হতো উৎসবের। প্রতিমা গড়ার কাজ চলত। হিন্দুদের বাড়িতে আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। হাশেমী বংশের কারণে ওদের সমীহও পাওয়া যেত। তাছাড়া জাফরভাই নাটক ও গানের কারণে হিন্দুপল্লিতে (বিশেষ করে আমাদের গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ভায়ড়া নামের গ্রামে) প্রিয় ছিলেন। থানা চত্বরে বিরাট নাট্যমঞ্চ তৈরি করা হতো। তিন থেকে সাতদিন পর্যন্ত সেখানে নাটক অভিনীত হতো (রাতে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে)। জাফরভাই এর দায়িত্বে থাকতেন। তিনি নিজে নাটক লিখতেন, অভিনয় করতেন। আবার বিখ্যাত নাট্যকারদের লেখা নাটক মঞ্চায়নে ভূমিকা রাখতেন।
পুজোর সময় প্রতিমা বানানোর কাজ দেখতাম মনোযোগ দিয়ে। একটি দুর্গা এবং 888sport app মূর্তির জন্য বাঁশ আর কাঠ দিয়ে একটা কাঠামো তৈরি হতো, মাটিও প্রস্ত্তত করা হতো, আর লাগত বিচালি বা খড়। সবশেষে রং অবলেপন। পুরো প্রক্রিয়াটিই শৈল্পিক, বিশেষ করে দেবী দুর্গার মুখাবয়ব – চোখ, কান, নাক, চুল অাঁকার পারদর্শিতা আমাকে মুগ্ধ করত। খুব কাছে থেকে এগুলো লক্ষ করতাম। এমনকি প্রতিমা বিসর্জনের সময় ওদের সঙ্গে কখনো কখনো কপোতাক্ষ নদে একই নৌকায় যেতাম। গ্রামীণ মেলা ছিল আমার কাছে আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয়। কত রকমের জিনিসই না সেসব মেলায় পাওয়া যেত। মাটি দিয়ে নৌকা বানানো হতো, তার নিচে থাকত চাকা। দড়ি বেঁধে তা টেনে নিয়ে যাওয়া যেত গাড়ির মতো। পোড়ামাটির এই খেলনাগুলোতে সাদা আর লাল রং লাগানো হতো। শিশুদের কাছে এটা দারুণ উপভোগ্য ছিল। একইভাবে পাখি, পাল্কি ও ঘোড়ার পায়ের নিচেও চাকা লাগানো থাকত। আরো থাকত মহিলা, সন্তান-কোলে মহিলা ইত্যাদি। মেলায় নানা ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি হতো – গজা, কদমা, বাতাসা, রসগোল্লা আরো কত কী। এসব বানানো লক্ষ করতাম, বিশেষ করে, জিলাপির নকশা বানানো খুব আকর্ষণীয় ছিল।
গরমের সময়ে পুকুরে দেড়-দুই ঘণ্টা কাটানো নিয়মে পরিণত হয়েছিল। পুকুরপাড়ে একটা গাছ ছিল ‘কদমার কাঁঠালগাছ’। কদমার মতো ছোট আর মিষ্টি ছিল কাঁঠালের কোয়া। গ্রীষ্মকালে গোসল করতে যাওয়ার আগে ওই কাঁঠালগাছের ডালে ডালে উঠে টোকা মেরে দেখতাম কাঁঠাল পেকেছে কিনা। পাকা কাঁঠাল পেলে গাছেই ওটাকে সাবাড় করে দিতাম। আমাদের ছিল বিরাট আমবাগান, নারকেল বাগান, কলা, কাঁঠাল, সুপারি, জাম, জামরুল, আতা, বেদানা, বাতাবি লেবু (জাম্বুরা) ইত্যাদি।
দুটো বড়সড় পুকুর ছিল আমাদের। একটার নাম লম্বা পুকুর, অন্যটা গোল পুকুর। গোল পুকুরের পাড়ে ছিল বড় আকারের বাঁধানো ঘাট। ঘাটের দুপাশে চওড়া করে বসার জায়গা বানানো ছিল। পাঁচ-ছজন একসঙ্গে নামাজও পড়তে পারত। আমাদের ছোটদের জন্যে ওটা ছিল পুকুরে লাফিয়ে পড়ার পূর্বে দৌড়ের জন্যে একটা সুন্দর ডাইভিং বোর্ডের মতো। মনে পড়ে ওই ঘাটে বসে সাত সকালে কোরান পড়াতেন আমার দূরসম্পর্কের চাচা, শামসুল হুদা (আমার দাদার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে)। মাঝে মধ্যে আসতেন সুদূর সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জেলা থেকে। তখন যাতায়াত ব্যবস্থার তেমন সুবিধা ছিল না, তাই আমাদের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে লেগে যেত প্রায় মাসখানেক। তিনি পশতু ভাষায় কথা বলতেন। উর্দু ও বাংলাও বলতে পারতেন মোটামুটি। আমার কোরান পড়ায় কখনো ভুল-ভ্রান্তি হলে খুব রেগে যেতেন এবং মোটা সাইজের একটা তসবিহ দিয়ে রাগ মেটাতেন। শুদ্ধ ও সুন্দর করে কোরান পড়া শিখেছিলাম। বেশ কয়েকবার শেষও করেছিলাম কোরান পড়া। কয়েক সিপারা মুখস্থও হয়ে গিয়েছিল। এই পুকুরপাড়েই ছিল আমাদের বৈঠকখানা। বৈঠকখানা আর পুকুরপাড়ের মধ্যে ছিল একটা পিচফল গাছ। গাছের ডালগুলো ঘাটের ওপর ঝুঁকে পড়ে রোদকে আড়াল করে রাখত। আর পিচফল পাকলে তো আর কথাই ছিল না। ভাইবোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত ওগুলো শেষ না-হওয়া পর্যন্ত। দুই পুকুরে থাকত দুটো তালগাছের ডোঙ্গা। গরমের সময় সে-দুটোকে পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হতো। লম্বা পুকুরে আমরা ডুব-সাঁতার দিতাম আড়াআড়িভাবে। এপার থেকে ওপারে। একবার উলটে-রাখা ওই ডোঙ্গায় আঘাত লেগে আমার নাক-মুখ রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। নাকটা এখনো সামান্য বেঁকে আছে। তবু মনে হয় সুযোগ পেলে এখনো ওই পুকুরে আমি ডুব-সাঁতার কাটতে পারি। বৈঠকখানাটি ছিল মূলত জালালউদ্দীন হাশেমীর গ্রামের দফতর। রাজনীতির কাজে বেশিরভাগ সময় চাচা থাকতেন কলকাতার বাড়িতে। পার্ক সার্কাসের সোহরাওয়ার্দী অ্যাভিন্যুর পি-২ ছিল বাড়ি। পি-৪-এ ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়ি। চাচা গ্রামে আসতেন তাঁর কালো রঙের একটা ফোর্ড প্রিফেক্ট গাড়ি নিয়ে। তখন কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়ি আসতে হলে দুটো নদী পার হতে হতো। একটা ইছামতি, যেটা এখন সাতক্ষীরা অঞ্চলে
888sport apps-ভারতের সীমান্ত নদী। অন্যটা কপোতাক্ষ। তখন গাড়ি পারাপারের একমাত্র উপায় ছিল দুটো বড় সাইজের খোলা নৌকা একত্রে বেঁধে একটা পাটাতনের ওপর গাড়িটাকে রাখতে হতো। নদীতে ভাটার সময় গাড়ি পার করতে হতো, যার ফলে ঘাটের অনেক নিচে নেমে যেত পানি। তাই ঘাটের ঢাল দিয়ে গাড়ি নৌকায় ওঠাতে নেওয়া হতো বাড়তি সতর্কতা – গাড়ির পেছনের বাম্পারে রশি বেঁধে টেনে রাখতে হতো যাতে গাড়িটা নৌকা ডিঙিয়ে নদীতে পড়ে না যায়।
চাচা বাড়ি এলে এলাকার লোকদের ভিড় লেগে থাকত। ভেতর থেকে আসত কেতলি ভরে ভরে চা। বৈঠকখানার চারপাশে ছিল প্রায় আট ফুট চওড়া বারান্দা আর মাঝখানের ঘরটা ছিল বেশ বড়সড়। একপাশে ছিল চাচার একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। দুপাশে চার-পাঁচটা করে ড্রয়ার আর ওপরটা ছিল সবুজ রেক্সিন দিয়ে মোড়ানো। নিষ্ঠাবান রাজনীতিক হয়েও চাচা বেশ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতেন। সময়মতো গোসল করা, নিজের কাপড় (খদ্দরের লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং টুপি) নিজে ধুতেন। দুপুরে আধা ঘণ্টা ঘুমানো। এসবই আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করত। নিজের জীবনে এ- ধরনের ডিসিপ্লিন আনতে চেষ্টা করি।
বারান্দার পুবপাশটা ঘেরা ছিল দেয়াল দিয়ে। ওখানে থাকত চাচার ছয় বেহারার একটা সুন্দর নকশি করা, হালকা নীল রঙের পালকি। আমাদের বাড়ি থেকে ছ-মাইল দূরে পাটকেলঘাটায় কপোতাক্ষ নদী পার হয়ে যেতে হতো আরো আট মাইল দূরে সাতক্ষীরায়। যেখান থেকে বাস চলত কলকাতা যাবার জন্যে। বর্ষাকালে কাঁচা রাস্তায় যাবার জন্যে চাচা ব্যবহার করতেন ওই পালকি। ভেতরটাও ছিল বেশ প্রশস্ত, প্রায় শুয়ে থাকা যেত। সামনের দিকে ছিল একটা শেলফ যেখানে চাচা টুপি, চশমা, খবরের কাগজ, বই ইত্যাদি রাখতে পারতেন। পালকিটা অবশ্য আমাদের মা-চাচিদের যাওয়ার জন্যেও ব্যবহৃত হতো। চাচাকে পালকি নিতেই হতো, কারণ তাঁর বাঁ পা ছিল না। বাঘ শিকার করতে গিয়ে পা হারান। ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনে কংগ্রেস নেতা, চাচা বহুবার পাবলিক মিটিংয়ে বলতেন, এক পা দিয়েছি বাঘের পেটে আরেক পা দেবো ইংরেজের পেটে, তবু ভারত স্বাধীন করে ছাড়ব। ইংরেজ দেশ ছেড়েছিল কিন্তু চাচা তা দেখে যেতে পারেননি। তিনি ১৯৪৭ সালের জানুয়ারির ১০ তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নেন।
ড. বিধান চন্দ্র রায় চাচার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন – ব্যক্তিগত চিকিৎসকও। তাঁরা একত্রে জেলও খেটেছেন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের শিকার হয়ে। চাচা অবশ্য মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, সুভাষ বসু, ফজলুল হক, শ্যামা প্রসাদসহ আরো অনেকের সঙ্গে কারাবরণ করেন। দেশ বিভাগের ঠিক পূর্বে চাচাকে মুসলিম লীগে যোগ দেওয়ার জন্যে অনেকেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু চাচা বলতেন, সারাজীবন কংগ্রেসি থেকে এখন মুসলিম লীগার হওয়া সম্ভব নয়। আদর্শ-বিচ্যুত হননি কখনো তিনি। নিষ্ঠা, সততা, আত্মনির্ভরশীলতা ছিল জালালউদ্দীন হাশেমীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। বাঘের আক্রমণে বাঁ-পা হারাতে হয়। তখনকার সময় মাংসে পচন ঠেকানোর চিকিৎসা তেমন ছিল না। তবু কলকাতা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে অন্তত চারবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল পায়ের স্থিতাবস্থা আনতে। ততোদিনে তার পায়ের প্রায় সম্পূর্ণটাই হারাতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি হার
না-মেনে এক পা দিয়েই সাইকেল চালাতেন, যখন গ্রামে কোথাও যেতে হতো। এক পায়ে পামশু পরতেন এবং ওই পায়ের পাতা সাইকেলের প্যাডেলে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকে দিতে হতো। তিনি দিবিব চালিয়ে যেতেন দু-চার মাইল। গন্তব্যে পৌঁছালে তাঁকে ধরে নামানো হতো। ক্রাচ দুটো থাকত হ্যান্ডেলে আটকানো।
আমাদের স্কুলের নাম ছিল বি. দে. (ব্রজলাল দত্ত) এইচ. ই. স্কুল। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ত না প্রথম দিকে। পরে আমাদের বাড়িরই চার-পাঁচজন এবং সেইসঙ্গে অন্য আরো কয়েকজন মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ফলে একধরনের কো-এডুকেশনই প্রচলন হলো সেখানে। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের সময় আমি আর কোহিনূরভাই 888sport app download apk আবৃত্তি করতাম। বহুবার আমরা পুরস্কৃতও হয়েছি। অবশ্য আমরা তালিম নিতাম জাফরভাইয়ের কাছ থেকে। প্রধান শিক্ষক জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ছবি অাঁকতাম, আবৃত্তি করতাম, ফুটবল খেলতাম, বিতর্কে অংশ নিতাম, আবার ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। এমন ছাত্রকে পছন্দ করাটা স্বাভাবিক। পরবর্তীকালে আমেরিকা 888sport slot gameশেষে দেশে ফিরে এলে জ্ঞানস্যার স্কুলে আমার সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে আমি আমেরিকা 888sport slot gameে আমার অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। এ-সংবর্ধনা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি বলেই মনে করি। প্রধান শিক্ষক আমাকে নিয়ে খুব গর্ব করেছিলেন। তখনকার সময় গোটা পাকিস্তান থেকে একজন 888sport live chatী আমেরিকা ঘুরে এসেছেন, তিনি আবার তাঁরই ছাত্র – এটা তাঁর জন্যে আনন্দের বিষয় ছিল।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের খুব আদরের ছিলাম। একে তো ছোট ছেলে, তার ওপর সারাক্ষণ মায়ের কাছাকাছি থাকতাম। মায়ের কাছে স্কুলের পড়া দেখিয়ে নেওয়া, রাতে ঘুম-পাড়ানি ছড়া শোনা, মায়ের সঙ্গে কাঁথা সেলাই করা – এসব মিলিয়ে এক কথায় মায়ের ন্যাওটা ছিলাম। মা কাঁথা বানাতেন, পুরনো শাড়ির পাড় কাঁথার চারদিকে জুড়ে দিতেন এবং মাঝখানে সুন্দর ডিজাইন করা সেলাই ফোঁড় দিতেন। আমার কাছে খুব অবাক লাগত কী করে নকশা ছাড়া মন থেকে এক-একটা নকশা তৈরি করতেন এবং তা বারবার একইভাবে উপস্থাপন করতেন! আমিও মায়ের সঙ্গে কাঁথা সেলাই করতাম। দারুণ উপভোগ করতাম। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকায় অবসর বলতে গেলে খুব কমই পেতেন। তবু সময় বের করে গল্পের বই পড়তেন। ওই সময় শরৎচন্দ্রের গল্পের বই ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় পাঠ্য। মহিলারা বিশেষ করে ওইসব গল্প পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কাঁদতেন। মায়ের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হতো না। একবার খুব ছোটবেলায় মা আমাকে দুপায়ের পাতার ওপর বসিয়ে দোলা দিচ্ছিলেন, হঠাৎ আমি চৌকির ওপর থেকে পড়ে যাই এবং নিচে রাখা একটা হারিকেনের চিমনি ভেঙে আমার পায়ের হাঁটুর ওপরের প্রায় দু-ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা কেটে যায়। পরে পাঁচ-ছটা সেলাই করতে হয়েছিল। আমার পায়ের ওই কাটা দাগটা কী করে হলো, জিজ্ঞেস করায় মা একদিন আমাকে এটা জানিয়েছিলেন। একবার ডাব-নারকেল কাটতে গিয়ে দায়ের এক কোপে আমার বাঁ-হাতের বৃদ্ধাঙুলি এবং তর্জনী দুটোই কেটে যায়। সামান্য চামড়ায় আটকে ছিল বৃদ্ধাঙুলি আর তর্জনীর অগ্রভাগ পড়েছিল মাটিতে। মা বিচ্ছিন্ন অংশটা পুনঃস্থাপন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলী যথাস্থানে স্থাপন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। ঘটনাটা আববা জানতে পেরে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে উত্তম-মধ্যম দিতে উদ্যত হলে মায়ের সহানুভূতিতে তা করতে পারেননি। মনে পড়ে আমি যখন আমেরিকা 888sport slot game থেকে গ্রামে ফিরে আসি, মা আমার জন্যে এক অাঁচল ভরে ফুল সংগ্রহ করে রেখেছিলেন আমার মাথায়, শরীরে, ফুল দিয়ে আশীর্বাদ জানাতে। গভীর আবেগে 888sport apk download apk latest versionয় আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা একান্নভুক্ত পরিবার ছিলাম। মঈনউদ্দীন (আমার আববা), জালালউদ্দীন ও শরফুদ্দীনের ছেলেমেয়ে মিলে পনেরো-ষোলোজন থাকতাম একটা দোতলা ছয় কামরার বাড়িতে। প্রত্যেক ভাইয়ের পরিবারের জন্য বরাদ্দ ছিল ওপর-নিচের দুটো করে কামরা। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এই দালান তৈরি হয় যখন আমার বয়স সাত কি আট বছর। তার পূর্বে, ঘেরা পাঁচিলের (২০ ইঞ্চি চওড়া প্রায় এক একর জমির ওপর) ভেতরে দক্ষিণে আববার, পশ্চিমে সেজ চাচার এবং উত্তরে ছোট চাচার একটা করে ঘর ছিল। মাঝখানে প্রশস্ত উঠান। পুবদিকের দরজা খুললেই ছিল একটা পুকুর – কেবলমাত্র মহিলাদের জন্যে। আমাদের ঘরটাই ছিল কেবল টিনের ছাত। ছাতের উপরে টিন কেটে লেখা ছিল : ‘স্বাধীনতা মানবের জন্মগত অধিকার’। চাচার নির্দেশেই হয়েছিল ওটা। পুবদিকে ছিল বড় আকারের খাবার ঘর আর রান্নার ঘর। এরপর ধানের গোলা, ঢেঁকির ঘর এবং সবশেষে হাঁস-মুরগির ঘর। সমবয়সী ভাইবোন মিলে পড়া এবং রাতে খাওয়া শেষ করে দোতলার বারান্দায় বসে খোলা গলায় গান গাইতাম! তখনকার সময় কলকাতার ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ ও ‘কলাম্বিয়া’, ‘হিন্দুস্তান’, ‘পাইওনিয়ার’, ‘টুইন রেকর্ড কোম্পানি’র যত রেকর্ড (ডিস্ক) বেরোতো তার প্রায় সবই চলে আসত আমাদের গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে ছিল বড় সাইজের উঁচু বাক্সের মতো একটা কলের গান। ওই যন্ত্রের সুবাদে আমরা পাঁচ-ছয় ভাইবোন প্রায় সব গান শুনে মুখস্থ করে ফেলতাম। গানগুলো ঝালাই করা হতো। দোতলার বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে সম্মিলিত এবং পৃথক পৃথকভাবে গেয়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে। দুই চাচার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল বিজু, বুচু, পরি, কাল্লু এবং মায়া। মোটামুটি ভালোই গাইতাম সে-সময়। পরবর্তীকালে পার্টি জমানো, বিশেষ করে মহিলাদের আকৃষ্ট করার কাজটা সহজ হয়ে যেত। যেসব 888sport live chatীর গান তখন শুনতাম তাদের মধ্যে কানন বালা, কিশোর কুমার, সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, কেসি দে, ধনঞ্জয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
এই সব 78 RPM রেকর্ডের মধ্যে আরো ছিল নাটক এবং কৌতুক। নাটকের কিছু কথা এখনো মনে আছে। আমার বয়স তখন আট কি নয় বছর, নাটকগুলো মুখস্থ করে অভিনয় করে শোনাতাম। কথাগুলো ছিল : ‘বারোটা বেজে গেল অমাবস্যার কিংসরাত্রি ভেদ করি কে ঐ চলিছে যাত্রী, সম্মুখে বুঝি গ্রহতারা পথ দেখায়, শ্মশানের ভেজাগন্ধ পাওয়া যায়, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক, ভীম ভয়ঙ্করী একটি কালো মূর্তি সমুখে এসে হাজির হলো। তোমাকে আমি চিনেছি… এত তাড়াতাড়ি চিনলে? হ্যাঁ অন্ধকারেই তো আসল পরিচয় মতিলাল, দিনের আলোয় যা 888sport app থাকে রাতের অন্ধকারে তা প্রকাশ পায়…। শোন, যেজন্যে তোমায় আমি ডেকেছি… চন্দননগরে আগুন লেগেছে… ও-আগুন শুধু চন্দননগরে নয়… সারা ভারতের ভাগ্যাকাশে আজ আগুনের লেলিহান শিখা, দেখছ না সারা শ্মশান আগুনের ঝলকে লাল হয়ে গ্যাছে… দে-না… দে-না তোর কোমরের ছোরাখানা বুকের রক্ত ঢেলে দিই… বুকের রক্ত দিয়েও তুই এ আগুন নেভাতে পারবি না কানুলাল…।’ আর একটা কিছু কৌতুক নাটক – এক ট্রেনযাত্রী ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, দেখছে সে কোনো এক সমুদ্রতীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এক সুন্দরী রমণীর শাড়ির অাঁচল ধরে টানছে আর প্রেম নিবেদন করছে। মেয়েটি বারবার বলছে, আহা ছাড়ুন না…। না ছাড়ব না। পরে মেয়েটি সজোরে একটা চড় মারলে ভদ্রলোকের ঘুম ভেঙে গেল এবং দেখল সে এতক্ষণ পাশে বসা একজন ভদ্রলোকের ধুতির কাছা ধরে টানাটানি করছিল। আরো একটা কৌতুক নাটকের কথা মনে পড়ে। ভদ্রলোক এক হোটেলের কামরায় ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন, তাকে জোর করে ধরে নিয়ে একটা কামানের মধ্যে পুরে ফায়ার করে দেওয়া হলো। তিনি স্বর্গের বাগানে গিয়ে পড়লেন। ওখানে অনেক সুন্দরী রমণী ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুলের বাগানে। তিনি এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কী? জবাব এলো, উর্বশী। ভদ্রলোক বললেন, তাহলে আমি এখানে একটু বসি! এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো দেবতার কাছে তখন অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধ চলছিল। ভদ্রলোক তা জানতেন না। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি যুদ্ধ করতে পার? ভদ্রলোক জবাবে বলেন : এই হাতে কত মানুষ কেটেছি কচা-কচ, কচা-কচ, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি কত গ্রাম… ইত্যাদি। তখন দেবতা হুকুম দিলেন তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। হুকুম শুনে ভদ্রলোক সেপাইদের হাত-পা ধরে ক্ষমা চাইতে লাগলেন যেন তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো না হয়। সৈনিকরা বললো, আপনি তো ভালো যোদ্ধা – তলোয়ার দিয়ে মানুষ কেটে ফেলেছেন… না, না আমি মিথ্যে বলেছি, ওটা তো আমি দা দিয়ে কলাগাছ কেটেছি আর চুরি করতে গিয়ে কাঁচি দিয়ে লোকের পকেট কেটেছি। তাও ধরা পড়ে গেছি। আর আগুনে গ্রাম জ্বা্লিয়ে দেওয়া… ও তো শীতের সময় গাছের শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে গরম হয়েছি… মিথ্যা বলার জন্যে তাকে আবার মর্তে ফেলে দেয়া হলো। ভদ্রলোক দারুণ চিৎকার করতে লাগলেন আর বিলাপ করতে লাগলেন – … ওরে বাবা গো, মা-গো আমার হাত-পা ভেঙে গেছে, চোখে দেখতে পাচ্ছি না। হোটেলের লোকজন এসে দেখল ভদ্রলোক খাট ভেঙে মাটিতে পড়ে অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করছেন…।
গান শোনা এবং শেখার অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। শীতের সময় ধান কাটা হয়ে গেলে সেইসব মাঠে রাতে যাত্রা অনুষ্ঠিত হতো। দুটো চৌকি একত্রে বিছিয়ে হারিকেন বাতি জ্বালিয়ে অভিনীত হতো বিভিন্ন পালা। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চলত ওইসব যাত্রাভিনয়। মাঠে কিছু শুকনা বিচালি বিছিয়ে অথবা কেউ কেউ বাড়ি থেকে কাঠের পিঁড়ি নিয়ে যেত মাটিতে বসে যাত্রা দেখতে। পালাগান শুনতে। বেহুলার পালা…? …ইত্যাদি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতাম দেখতে দেখতে।
দাদাভাই (সিকান্দার আবু জাফর) গ্রামে এলে আমাদের সবাইকে নিয়ে গান শেখাতেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুরে, তালে গাইতে বলতেন। আমার বয়স যখন চার-পাঁচ বছর তখনই জাফরভাই কলেজে পড়তে কলকাতা চলে যান। তাই যখন গ্রামে আসতেন তখন আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। খেলাধুলা, শরীরচর্চায় জাফরভাই ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। বাড়িতে বাঁশ কেটে বানিয়েছিলেন একটা প্যারালাল বার, ওয়েট লিফটিংয়ের সব সরঞ্জাম ছিল তার এবং একটা ঝুলানো লোহার রিং এবং আরো কত কী। ‘হিন্দুস্তান শিল্ড টুর্নামেন্ট’ নামে একটা ফুটবল প্রতিযোগিতাও শুরু করেছিলেন তিনি। মনে আছে, ওই শিল্ড টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলতে আসে সাতক্ষীরা এবং খুলনার দুটো নামকরা দল। খেলার আগে রাতে জমিদারের আজ্ঞাবাহী একদল লোক ফুটবল মাঠের গোলপোস্টের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত মাঠ কোদাল দিয়ে কেটে ছিন্নভিন্ন করে খেজুরের কাঁটা ছড়িয়ে দিয়েছিল যাতে খেলা না-হতে পারে। রাত দুটার দিকে সংবাদ পেয়ে জাফরভাই গ্রামের প্রায় পঞ্চাশজন তরুণ নিয়ে ওই খেজুরকাঁটা বেছে, পিটিয়ে মাটি সমান করে ওপর দিয়ে পানি ঢেলে মাঠ খেলার যোগ্য করে তোলেন দুপুরের মধ্যে। ওই ফাইনাল খেলার প্রধান অতিথি ছিলেন চাচা জালালউদ্দীন। প্রথমবারের মতো চাচার ভাষণ শুনেছিলাম এবং প্রায় মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। আগেই শুনেছিলাম চাচা একজন নামকরা বক্তা ছিলেন। ইংরেজি ও বাংলায় পারদর্শী বক্তা ছিলেন। পরবর্তীকালে আমার সেজচাচা মারা যাওয়ার পর ওটা ‘হাশেমী মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট’ নামে পরিবর্তিত হয়।
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করত। বাড়ি থেকে কিছুদূরে একটা মজা পুকুরপাড়ে বাঁকানো একটা নারকেল গাছের ওপর বসে পাশের বিস্তীর্ণ মাঠে সবুজ ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে হিন্দোলিত ধানক্ষেত দেখে মনে হতো একটা স্রোতস্বিনী সবুজ নদীর মতো। গভীর বিস্ময়ে দেখতাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। জ্যৈষ্ঠের খুব ভোরে দোয়েলের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে যেত। একলাফে চলে যেতাম আমবাগানে। ভয় হতো কেউ আগেই সেখানে গিয়ে আম কুড়িয়ে নিল কিনা। খুব ভোরে আম কুড়াতে যেত ছেলে-বুড়ো সবাই। তবে একটু ঝামেলাও ছিল একটা বাগানে – ওখানে ছিল আনারস বাগান। আনারসের পাতার কিনার দিয়ে থাকে ধারালো সব কাঁটা। ওই কাঁটা বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতে অাঁচড় খেতেই হতো। আর আম যদি ওই পাতার ফাঁকে গিয়ে পড়ত, সেটা উদ্ধার করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। আমগাছের বিচিত্র সব নামও ছিল : সিন্দুরে, সড়েঙ্গা, চুষে, ভুইর মধ্যি, রসগোল্লা, দলদলে, নাইতোলা, গোপালভোগ, বোম্বাই, জালিবান্দা আরো কত কি!
আজো দোয়েলের ডাক শুনলে সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। এখনো যখন দেখি নানা বর্ণের সুবজ গাছের গা ঘেঁষে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত যার মাঝে মধ্যে পাকা ধানের সোনালি বিস্তার, নিমেষেই 888sport sign up bonusর আয়নায় ভেসে ওঠে পৌষের বিকেলে কৃষকের ধান কাটা শেষে গরুর গাড়িতে তুলে নেওয়ার সেই দৃশ্য। সেই সোনালি ধানক্ষেত, আলট্রামেরিন আকাশ, মাটি আর মানুষ এখন আমার ক্যানভাসে।
দুই পুকুরের ডোঙ্গা দুটোর ব্যবহার হতো প্রধানত মাছের খাবার ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য। এছাড়া পুকুরের ঠিক মাঝবরাবর লম্বা বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো খাদ্যভরা এক-একটা চটের বস্তা। বস্তাগুলোতে ছোট ছোট ফুটো করা থাকত। ঠুকরে ঠুকরে ওই খাবার খেত মাছ। ফলে রুই, কাতলা, মৃগেল, গলদা চিংড়ি এক-একটা দশাসই সাইজের হয়ে যেত প্রতিবছর। গলদা চিংড়ি ধরার গল্পও আছে অন্যরকম। শীতের দুপুরে গোসলের আগেই চলে যেতাম বাড়ি থেকে চার-পাঁচ হাজার গজ দূরে আমাদের নারকেল বাগানের সামনে একটা ছোট পুকুরে (নাম বুড়ির পুকুর)। পাড়েই ছিল একটা নুয়েপড়া আমগাছ। বেশকিছু ডাল ছিল একেবারে পানি ছুঁইছুঁই অবস্থায়। আমরা বাড়ির এবং প্রতিবেশীর কিছু তরুণ ওই গাছের ডালে চড়ে পা দিয়ে পানি ছিটিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করে নেমে পড়তাম পানিতে। ডুব দিয়ে ধরতাম বড় বড় গলদা চিংড়ি। মাছগুলো তলার কাদার মধ্যে পায়ের ছাপের গর্তে আরাম করে বসে থাকত। ডুব দিয়ে পা দিয়ে আস্তে আস্তে অনুভব করতে হতো মাছের উপস্থিতি। তারপর শরীরটাকে আরো খানিকটা নিচে নিয়ে হাত দিয়ে গলদাকে ভালো করে ধরে এক লাফে পানির উপরে উঠে ক্ষীপ্রতার সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিতে হতো পাশের মাঠে। একটু দেরি হলেই গলদা ঠ্যাং বাঁকিয়ে কামড়ে ধরত। খুবই পীড়াদায়ক সেটা। মাঠ তখন ধান কাটা শেষে ফাঁকাই থাকত। আসলে এই পুকুরটা ছিল ওই মাঠের সঙ্গে সংযুক্ত। ধানক্ষেতে থাকত গলদা চিংড়ির অবাধ বিচরণ। ধানগাছের শেকড় আর শুকনা পাতাই হতো চিংড়ির আকর্ষণীয় খাবার। প্রতিবছর ছোট ছোট চিংড়ির পোনা ছাড়া হতো পুকুরে। সেগুলোই তিন-চার মাস ধানক্ষেতে চরে বেড়াত এবং মাঠের পানি শুকিয়ে গেলে চলে আসত পুকুরে। আবার বর্ষায় ধরতাম কই মাছ। ভরা বৃষ্টির মধ্যে কই মাছ পুকুর থেকে উঠে আসত বাগানে। ওরা পানির উজানে চলে বেড়াত বাগানের পায়ে হাঁটা রাস্তার ওপর দিয়ে। কই মাছ ঠিকমতো হাতে ধরতে না পারলে ওদের চোয়ালের কাঁটার আঘাত খেতে হতো অনিবার্যভাবে।
সেজ চাচা জালালউদ্দীন হাশেমীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অভ্যাস ছিল ছিপ দিয়ে মাছ ধরা। চাচা পারিবারিক বা রাজনৈতিক কোনো বিষয়েই তেমন টেনশন নিতেন না। এটা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। পুকুরের পানি কিছুটা জমে গেলে লম্বা পুকুরের সিঁড়ির পাঁচ-ছ ধাপ পরের সিঁড়িতে একটা কুশনের ওপর বসে হুইল ছিপ দিয়ে মাছ ধরতেন। পিতলের হুইল লাগানো ছিপে থাকত সাত-আটটা হুক, যার ভেতর দিয়ে সুতা বেরিয়ে যেত বড়শি পর্যন্ত। ঘাট থেকে তিন-চার ফুট দূরে একটা বাঁশের খুঁটির ওপর রাখা হতো ছিপটার মাথা এবং পেছনের অংশটা থাকত সিঁড়ির ওপর। সামনে ছিটানো হতো মাছের খাদ্য। বড়সড় একটা মাছ গেঁথে গেলে সারাপুকুর চষে বেড়াত মাছটা। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ত। মাছে ওই রশি টানাটানি আর হুইলের ঘ্যার-ঘ্যার শব্দ যেন এখনো শুনতে পাই যখন গ্রামের ওই পুকুরপাড়ে যাই।
গোল পুকুরপাড়ে ইটের ঘর আর পোড়ামাটির টালি দিয়ে 888sport app বারান্দাওয়ালা বৈঠকখানা তৈরির পূর্বে ছিল উত্তর পাশের দেয়াল ঘেঁষে মাটির ঘরের ওপর টিন দিয়ে ছাউনি করা প্রথম বৈঠকখানা। ওখান থেকে গোল পুকুর আর লম্বা পুকুরের মাঝে ছিল বেশ প্রশস্ত খেলার জায়গা। মার্বেল, ডাংগুলি, হা-ডু-ডু, বুড়িচ্ছু নিয়মিতই খেলা হতো ওখানে। এসব খেলায় প্রতিবেশী এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের ছেলেরাও আসত খেলতে। বৈঠকখানা এবং ঘাটে বসে মুরবিবরাও উপভোগ করতেন এসব খেলা। মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ এবং বিচারকের ভূমিকাও পালন করতেন তাঁরা।
ছোটবেলায় অনেক কিছুতেই ভয় সওয়ার হতো : যেমন পড়ার সময় গল্পের বই পড়া, জ্বর গায়ে বর্ষার মধ্যে ফুটবল খেলতে গিয়ে আববার নজরে পড়া, পুকুরে পানির নিচে ডুব দিয়ে কিছু না-দেখতে পাওয়া… তবে সবচেয়ে বেশি ভয় হতো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে না-আসা পর্যন্ত। অবশ্য প্রশ্নগুলো একবার পড়ে ফেললে ভয় চলে যেত। একবার জ্যৈষ্ঠ মাসে আমাদের পুরনো আমবাগানের কাছাকাছি একটা আমগাছের পাকা আম পাড়তে আমার এক মামাতোভাই হাবিবুল ইসলাম, ডাকনাম আবুকে গাছে চড়িয়ে দিলাম। নিচে থাকলাম আমি আর চাচাতোভাই বুচু। প্রায় পনেরো ফুট ওপরে একটা ডালের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা পাকা আম পাড়তে যাচ্ছিল। তার হাত আম পর্যন্ত পৌঁছার আগেই ডালটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। আবু উলটা হয়ে অর্থাৎ মাথাটা নিচের দিকে করে পড়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। ডালটা তার ওপরে গিয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেল। বুচু একদৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে সাহস করে গেলাম আবুকে দেখতে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। গাছের ডালটা সরিয়ে দেখলাম আবুর নিঃসাড় দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। জায়গাটা ছিল বেশ নরম; কাদামাখা। ওর মাথাটা যেখানে পড়েছিল তার ঠিক দুপাশেই ছিল জংলি গাছ কেটে নেওয়ায় ধারালো শক্ত ডালগুলো। যে-কোনো একটার ওপরে পড়লে মগজ ভেদ করে যেতে পারত। আবুকে টেনে ওপরে তুললাম এবং বগলের নিচে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে হাঁটাতে লাগলাম। ও বেঁচে ছিল। বোকার মতো কাজটি করেছিলাম। জানতাম না যে, এরকম সময় মানুষকে শুইয়ে রেখে চিকিৎসা করতে হয়, যাতে তার মস্তিষ্কে রক্ত-সঞ্চার সহজ হয়। পরে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকায় প্রতিবেশীরা এসে আবুকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। সে-যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল, তবে মাসতিনেক বিছানায় থাকতে হয়েছিল, মেরুদন্ডে আঘাত পেয়েছিল বলে।
সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়িতে চলত পড়াশোনার ধুম। আর একই সঙ্গে চলত শেয়ালের ডাক, প্রতি সন্ধ্যায় ওপরতলার তিনটা কামরায় ভাইবোনদের চিৎকার করে পড়া মুখস্থ করার একটা মহড়া প্রতিদিনই চলত। জোরে জোরে পড়লে নাকি পড়া সহজে মুখস্থ হতো এবং অন্যের পড়ার চিৎকার যেন কানে না আসে, সেটাও ছিল আরেকটি কারণ। অবশ্য এর মধ্যে হঠাৎ কেউ সশব্দে পড়া বন্ধ করলে বুঝতে হতো সে গল্পের বই পড়ছে। ‘মোহন সিরিজে’র সব বই-ই তখন আমরা গোগ্রাসে পড়তাম। ভাগাভাগি করে সবার হাত ঘুরত বইগুলো। এর মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো কে কত তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করতে পারে। জিত্ত বিজু (চাচাতো বোন)। সন্ধ্যার আরেকটি রূপ এখনো 888sport sign up bonusতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পঞ্চাশ সালে যখন 888sport appয় এলাম, তখন থাকতাম ওয়ারী অঞ্চলে। ওখানে তখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছেলেমেয়েরা গানের রেয়াজ করত। কত সন্ধ্যায় কোনো কোনো বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান শুনতাম। কী অপূর্ব ছিল সেসব অভিজ্ঞতা! এখন আর সন্ধ্যায় কোথাও কোনো বাড়িতে গান শোনা যায় না।
বাড়ির ভেতরে ছিল দুটো কুল গাছ। বড় সাইজের গোলাকৃতি কুল ছিল খুব সুস্বাদু। প্রতিবছর শীতকালে গাছের ডাল কেটে ফেলে একেবারে ন্যাড়া করে ফেলা হতো। আবার নতুন ডালে ভরে যেত গাছ আর অগুনতি কুল। চলত অপেক্ষা, কবে পাকবে। ডালগুলোর গোড়ার দিকে থাকত বেশ মোটা আর শক্ত কাঁটা। ওগুলোর মধ্যে দিয়ে ওপরে ওঠা যেত না। তাই, ছুরি দিয়ে কাঁটাগুলো কেটে জায়গা তৈরি করতাম সহজে উপরে ওঠার জন্যে। এ-কাজটা করতাম কুল পাকার আগেই। কুল পাকলে হাত দিয়ে পাকা কুল পেড়ে খেতাম এবং ডাল ধরে ঝাঁকি দিয়ে পাড়তাম। অবশ্য ঝাঁকি দেওয়ার সময় 888sport app ভাইবোন নিচে একটা বিছানার চাদর লম্বালম্বি করে টেনে ধরে রাখত যেন কোনো কুল মাটিতে পড়ে নষ্ট না হয়।
পূর্বদিকের কুলগাছটায় বড় একটা ডাল কাটার পর ওখানে একটা ফোকর তৈরি হয়ে যায় এবং সেখানে বাস করতে শুরু করে একজোড়া তক্ষক। খুশিমতো ওরা যখন-তখন ডাক দিত। ছেলেমেয়েরা ভয়ে সন্ধ্যার পর ওদিক মাড়াতো না। তক্ষকের ডাককে বলা হতো সত্যি সত্যি… পাঁচবার-ছবার। ওই মুহূর্তে আলোচনার সত্যতা যাচাই হতো ওই ডাকে। আর টিকটিকির ডাককে বলা হতো ঠিক, ঠিক, ঠিক…। ছেলেবেলার কত কিছুই না এখন মনে আসে। একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। আমার অগ্রজ কবি সিকান্দার আবু জাফরের (আমার দাদাভাই) স্ত্রী নার্গিস জাফর যার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় সম্ভবত ১৯৪৮ সালে কলকাতায় দাদাভাইয়ের পার্ল রোডের বাসায়। আমার বয়স তখন প্রায় ষোলো। হাসিমুখ আর বুদ্ধিদীপ্ত ভাবির সেই চেহারাটা এখনো 888sport sign up bonusতে অম্লান হয়ে আছে। দাদাভাই তখন উদীয়মান তরুণ কবি ও 888sport live footballিক হিসেবে সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত। নার্গিস ভাবি সবে চাকরি ছেড়েছেন নবজাতক পুত্রসন্তানের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকার কারণে। কলকাতায় নিয়মিত যাওয়া-আসা তেমন হতো না, যদিও চাচা জালালউদ্দীন হাশেমী কলকাতা করপোরেশনের মেয়র ও অ্যাসেম্বলি মেম্বার হওয়ার সুবাদে আমরা যখন ইচ্ছা কলকাতা যেতে পারতাম।
আটচল্লিশের শেষের দিকে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এড়াতে জাফরভাই, ভাবি এবং তাদের শিশুপুত্র সৈয়দ আলমগীর জাফর, শমুকে (বর্তমানে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর প্রফেসর) সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম। কয়েকদিন পর ভাবি আর শমুকে রেখে দাদাভাই কলকাতা ফিরে যান। ভাবি অবশ্য বেশ কয়েক মাস গ্রামে থাকার পর ছেলে শমুকে তার দাদি অর্থাৎ আমার মায়ের হেফাজতে রেখে আবার কলকাতা ফিরে যান। আমার মায়ের সময়স্বল্পতার কারণে বছর দেড়েক বয়সী শমুর দেখভালের দায়িত্বটা প্রায় আমার ওপরেই এসে পড়ে। কাজটি একদিকে যেমন ছিল অপ্রত্যাশিত, অন্যদিকে ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতার। প্রায় বছরখানেক কেটে গেল এভাবেই। অবশেষে ভাবি তার ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। সেখান থেকে 888sport app। দাদাভাই অবশ্য ইতিপূর্বেই কলকাতা ছেড়ে 888sport app চলে গেছেন।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.