নদী আর গ্রাম পাশাপাশি। ইলশা আর সোনাকান্দি। সোনাকান্দি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। হাট, বাজার, মন্দির, মসজিদ, হিন্দু, মুসলমান, চাষাভুষা, জোতদার, জমিদার মিলে একাকার। কিন্তু পাশ দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা নদী আর নদী নেই। ক্রমশঃ উটের পিঠের মত কাঁচা মাটির স্তর জমাট হয়ে চর পরিধি বাড়াচ্ছে। সবুজ ঘাসের আস্তরণের নীচে নতুন মাটির জীবন আবাদ হচ্ছে। নদী মজে যাচ্ছে। কেবল বর্ষাকালে ইলশা তার পূর্বরূপ ফিরে পায়। দুকূল প্লাবিত বিপুল বন্যাবেগে সংহারী মূর্তির মত ইলশা তার মহাসামুদ্রিক বাহুর বেষ্টনে যেন সোনাকান্দিকে মুছে ফেলতে চায়।

প্রতি বছর এই বর্ষাকালে তরঙ্গায়িত মেঘনার বুকে জেলে নৌকায় রঙিন পাল ওড়ে। জোয়ারের তীব্র টানে সারি সারি নৌকা ইলশার দিকে পাড়ি জমায়। বর্ষার পানিতে ডোবা সোনাকান্দির চরের কাছাকাছি নৌকা বাঁধে। বাজারে নতুন মাছের ধুম পড়ে। “বেবুজ্জে” মেয়েরা পিঠে কাপড়ের আঁচল বেঁধে তার দোলনায় শিশু সন্তানকে রেখে, ঘোমটাহীন নির্মুক্ত মাথায় মাছের ঝাঁকা নিয়ে হাটে বাজারে ঘুরে বেড়ায়। আবার কখনো তেমনি সন্তানকে পিঠে বেঁধে, নৌকার গলুইয়ে বসে, পা-বৈঠা বেয়ে তীব্র গতিতে নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়। স্বাস্থ্য পুষ্ট দেহের রেখায় রেখায় শানিত তরোয়ালের আভা যেন চমকায়। সোনাকান্দির আদিম রক্তে ঝড় ওঠে।

এবারও নৌকা এলো সারি সারি। ঘাটে বাঁধা নৌকার ব্যূহ থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। মাথায় ঝাঁকা, বয়স বিশ কি বাইশের কোঠায়। লতানো গাছের মত একটা লাল ডুরে রঙের তাঁতের শাড়ী সঙ্কোচমুক্ত, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহের দীপ্তি বাড়িয়ে, বরং আরো কিছুটা বিস্ফারিত, রহস্যময় করে একহারা দেহটাকে পেঁচিয়ে ঘাড়ের কাছে উঠে যেন গতিহীন ঝর্ণার মত হয়ে গেছে। সঙ্গের লোকটি অর্ধ প্রৌঢ়। তালগাছের মত শক্ত, ঋজু, ক্রূর চেহারা।

সোনাকান্দির মনসুর তালুকদার তাদের উভয়কে বাড়ীতে দেখে বিস্মিত হল। বাপ হজ্বে যাবেন। নিজেই সে জমিজমা দেখাশোনা করছে। সদ্য উঠতি বয়স, সঙ্গে দায়মুক্ত অর্থ ব্যয়ের অধিকার। দুটো মিলে দেহের রক্তে তালুকদার বংশের আদিম আভিজাত্য কথা কয়ে উঠছে। মেয়েটিকে দেখে লোভে তার চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু সঙ্গের লোকটিকে দেখে সে মনের আনন্দ প্রকাশ করতে পারলো না।

মাথা থেকে ঝাঁকা নামিয়ে মেয়েটি ততক্ষণে একটা বিরাট মাছ মনসুরের পায়ের কাছে রেখে দিয়েছে। মনসুর কথা বলার পূর্বেই সে একান্ত বিনম্র কণ্ঠে বলল – হুজুরের মেহরবাণী। আমার নাম লক্ষ্মী। আমি বেবুজ্জে। আমার সোয়ামী। বলে সে সঙ্গের লোকটাকে দেখালো। ‘তার নাম যুগল চাদ।’ সে তার কর্কশ গলা যথাসম্ভব মোলায়েম করে বলল – হুজুরের গাঁও গ্রামে এলাম। তাই সেলাম দিতে এসেছি। মাছ বেঁচে খাই। গরীব মানুষ। তাই হুজুরের যুগ্যি কিছু দিতে পারলাম না।

মনসুর সরাসরি লক্ষ্মীর দিকে তাকাতে না পেরে উভয়ের উপর চোখ বুলিয়ে বলল – না, না সেলাম কিসের? তারপর লক্ষ্মীর দিকে চেয়ে বলল – তুমি বুঝি আগেও এ গ্রামে এসেছো?

লক্ষ্মীর চঞ্চল চোখ কিছুক্ষণ মনসুরের সম্মোহিত চোখের উপর নেচে বেড়াল। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে মৃদু হেসে বলল – না আমি আসিনি। আমার মা এসেছে, ভানুমতী। আপনাদের বাড়ীতেও অনেকবার এসেছিল। তার কাছে কত গল্প শুনেচি সোনাকান্দির। দেখেন নি তাকে?

মনসুর শৈশবে দেখা এক স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী 888sport promo codeমূর্তির কথা কল্পনা করতে লাগলো। লক্ষ্মী তার প্রতিবিম্ব। তাই তাকে দেখে প্রথমেই তার চমক লেগেছিল।

যুগল আর লক্ষ্মী উভয়েই সেদিন লম্বা সেলাম ঠুকে বিদায় নিল।

দুদিন পর লক্ষ্মী আবার এলো। মাথার ঝাঁকা থেকে আবার একটা বড় মাছ বেরুল। কিন্তু মনসুর সবচেয়ে খুশী হল তাকে একা আসতে দেখে। কণ্ঠে নির্মুক্ত আনন্দ ছড়িয়ে সে বলল – কি মনে করে লক্ষ্মী? তাতে নৈকট্যের সুর চাপা রইল না। লক্ষ্মীর চঞ্চল চোখ যেন আবেশে নত হল। বলল – একটা নিবেদন আছে হুজুর, গরীবের নিবেদন।

মনসুর উঠে দাড়ালো, বলল, – বলো।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। লক্ষ্মী তারপর দ্বিধা জয় করে মুখে হাসি টানল – ইলশার চরে এবার জোয়ারের পানি দেখেছেন হুজুর? নদী আর চর একাকার। বড় করে বাঁধ দিতে পারলে বহু মাছ ধরা পড়তো। দু’পয়সা লাভ হত, হুজুরেরও লোকসান হত না। বরং বেশ মোটা টাকা পেতেন।

জবাবের প্রত্যাশায় লক্ষ্মী চোখ তুলে তাকাল। সে চোখের দিকে তাকিয়ে মনসুর কিছুক্ষণ ভাবল, বর্ষার মেঘাবৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ জটিল সমস্যা সমাধানে বিষণ্ন মুখে দাড়ি চুলকালো। তারপর জিজ্ঞেস করল – তোমরা তো প্রতিবার মাছ বেছতে আসো। এবার হঠাৎ চর ঘেরাও করে মাছ ধরবার দিকে নজর দিলে কেন?

– লাভ আর লক্ষ্মী যে এক কথা হুজুর। নিজের রসিকতায় লক্ষ্মী নিজেই হেসে উঠল।

মনসুর নিজ দেহের শিরায় শিরায় সেই হাসির প্রতিধ্বনি শুনলো। চঞ্চল হবে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় লক্ষ্মীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল – চরে আমি তোমাদের বন্দোবস্তী দেব লক্ষ্মী। সে কেবল তোমার খাতিরে। চরের লাগসই সোনাকান্দির চাষীদের জমি। এবার যে রকম পানি উঠেছে তাতে ভাদই ফসল বাঁচানো কষ্ট। তার উপর মাছ ধরার জন্য বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে রাখলে তাদের জমির পানি সরে যাবার পথ পাবে না। ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। এ সব ক্ষয় ক্ষতি দেখে শুনে …

লক্ষ্মী তাকে কথা শেষ করতে দিল না, বলল – যুগলও এ কথা বলেছিল হুজুর। বলেছে, বাঁধ বেশীদিন রাখা লাগবে না। আর হুজুরের লোকসানটা সেলামীর টাকায় পুষিয়ে দেওয়া যাবে।

মনসুর তার সর্বাঙ্গে তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি লুকোল। বলল – লাভ লোকসান আমি বুঝি না। কেবল তোমার খাতিরে বুঝেছো লক্ষ্মী।

লক্ষ্মী হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলো। মনসুর শশব্যস্ত হওয়ার ভান করে নুয়ে তার হাত চেপে ধরল, ঠাণ্ডা নরম হাত।

চঞ্চল চোখের দৃষ্টিতে স্থির সন্ধ্যাতারার আলোটা একটা ধূর্ত হাসিতে নুয়ে পড়ল যেন। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, মাথায় ঝাঁকাটা তুলে সে তড়িৎ গতিতে রাস্তায় নেমে গেল।

বংশীর সাথে যুগলের মনোমালিন্য বহুদিনের। যুগলের একই সম্প্রদায়ের একই দলের লোক বংশী। বিবাদটা
লক্ষ্মী-ঘটিত। বংশী যুগলের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। সে লক্ষ্মীকে ভালবাসতো, তার ধারণা ছিল লক্ষ্মীও তাকে ভালবাসে। কিন্তু বাদ সাধল যুগল। সামাজিক প্রতিপত্তি, আর টাকা পয়সার জোরে লক্ষ্মীকে বিয়ে করে বসল। 888sport promo codeর হৃদয়হীনতায় যতখানি মর্মাহত হল বংশী সেদিন থেকে তার চেয়ে বেশী বিদ্বেষ পুষতে লাগল যুগলের উপর।

ইলশার তীরে বাঁধা সারি সারি বেবুজ্জে ডিঙ্গির সামনে উন্মুক্ত মাঠে গানের আসর বসেছে। এক হাতে ঢোল বাজাচ্ছে আর গান গাইছে যুগল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠের আওয়াজ ফুরিয়ে আসছে। কাঁসার আওয়াজ থেমে থেমে আসছে, আর গানের ধুয়া ধরে যারা হল্লা করে নাচছে, তাদের তালে তালে ফেলা পা ক্রমশঃ বেতাল হয়ে আসছে। দোষ অবশ্য সবাইর নয়। যৌবনে যুগলের অভ্যাস দোষটা অসম্ভব রকম তীব্র ছিল। এখনো তার প্রভাব সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নেশার ঘোরে ঢোলের উপর বেতাল হাত চালিয়ে গান গাইতে গিয়ে বার বার তার স্বর জড়িয়ে আসছিল।

রস মা রসময়ী, তোমারে কেমনে ভুলি

এ দীনতারণ অধম তোমার বইবে নামের ঢুলি।

বংশীও দাঁড়িয়ে গান শুনছিল, রস-মা …

দু’একজন বিরক্ত হয়ে চাপা স্বরে বলল – বংশী ঢোলটা ধর না। বেটা পাঁড় মাতালের পাল্লায় পড়ে আসরটাই মাটি হয়ে গেল।

বংশী এতক্ষণ কথাটা আমলে আনেনি। হঠাৎ লক্ষ্মীর দিকে চোখ পড়তেই যুগলের কাছে এগিয়ে এসে অতর্কিতে ঢোলটা ছিনিয়ে নিল। নেশার আমেজ কেটে যেতেই যুগল চোখ মেলে তাকাল। ব্যাপারটা আঁচ করে কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল – ঢোল ছেড়ে দে বংশী।

বংশী ঢোলের উপর হাত চালিয়ে বাজাতে বাজাতে বলল – মাতলামী কোর না। যাও। তারপর নির্বিকার গান ধরল রস’মা রসময়ী। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল যুগলের। দীর্ঘ ঋজু দেহটা ক্ষণকাল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ক্রুদ্ধ গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ল বংশীর উপর। ঘাড় ধরে তাকে টেনে তুলে প্রচণ্ড এক চড় কষিয়ে দিল তার গালে। বংশী কিছুক্ষণ জগৎ অন্ধকার দেখল। চোখ মেলে ঢোল, যুগল, আসরের সবাইর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কেবল লক্ষ্মীকে এড়িয়ে গেল। তারপর অস্ফুট হাস্য ধ্বনিকে পেছনে রেখে ধীর পায়ে চলে গেল সে। সবচেয়ে জোরে হাসল লক্ষ্মী।

পরদিন বাঁধের কাজ আরম্ভ করার দিন। বংশী নৌকা ছেড়ে সোনাকান্দিতে চলে গেল। রমজান আলী প্রতিপত্তিশালী চাষী। তার বাড়ীর দাওয়ায় এসে বসল। রাত জাগরণে দু’চোখ লাল। মনের হিংস্র উত্তেজনা কথার আওয়াজে ফুটে বেরুতে চায়। যথাসম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বংশী বলবার চেষ্টা করল – এদিকেই আসছিলাম। ভাবলাম একটু তামাক টেনে যাই। সেকান্দার মিঞা কই?

সেকান্দার রমজান আলির বড় ছেলে। মাছ কেনা বেচা নিয়েই সেকান্দারের সঙ্গে বংশীর বহুদিনের আলাপ। রমজান জানাল, সে বাড়ীতে নেই। তারপর হুঁকো আনতে ভিতরে চলে গেল।

হুঁকো টানতে টানতে ধীরে সুস্থে বাঁধ দেওয়ার কথাটা পাড়ল বংশী। শুনে রমজান চেঁচিয়ে উঠল – সর্বনাশ, আমাদের উপায়?

উপায় নেই-ই বটে। নদী লাগোয়া রমজান আলির জমি এমন কি তার প্রায় খোরাকি ফসলের জমিও। নদীতে বর্ষার পানি নেমে যাবার পথে বাঁধ দিলে ধীরে ধীরে পানি সরবে আর মাছ ধরা পড়বে। কিন্তু চরের আশে পাশে যে সমস্ত জমি আছে, তাতে পানি জমে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। এখনই – কিছু একটা বিহিত করা দরকার। সেকান্দার বাড়ী নেই, 888sport app চাষীরাও দিনের কাজে বেরিয়ে গেছে। উপায় ভেবে না পেয়ে রমজান বংশীর হাত চেপে ধরল। বংশী হেসে বলল – আপনি ভাববেন না। সেকান্দার মিয়া ফিরলে তাকে পাঠিয়ে দেবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বংশীর মনের উত্তেজনা কিছুটা লাঘব হল। চরে সকলের সাথে একত্র হয়ে বন্দোবস্তী নিতে পারলে মাছ ধরে তারও মোটা লাভ হত। কিন্তু টাকার জন্য কি বংশী বিড়াল বনে যাবে? তাহলে বেবুজ্জে মেয়েরা পর্যন্ত কেন কোমরে ধারাল ছুরি লুকিয়ে রাখে?

পূর্বের সূর্য পশ্চিমে সরে আসার পর সেকান্দার বাড়ী ফিরল। বাপের কাছে খবর শুনেই সে ছুট্ল চরের দিকে। এমনিতেই জমিতে ঢের পানি জমে আছে। তার উপর বাঁধ! স্ত্রী সখিনা বাধা দেবার চেষ্টা করল – ভাত খেয়ে যাও। এমন কি ব্যগ্র দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে রাখতে চাইল। কিন্তু তার আগেই সে রাস্তায় নেমে গেছে।

সেদিনের মত বাঁধের কাজ শেষ। নিকটে উঁচু ডাঙায় দাঁড়িয়ে যুগল আর লক্ষ্মী সব দেখছিল। বাঁধের উঁচু মাথা ছাপিয়েও ঢল হয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি নেমে যাচ্ছে। ইলশার মহা সামুদ্রিক ব্যাপ্তি দিগন্তের কোণে মিশে গেছে। আকাশের খণ্ড খণ্ড মেঘে অস্তাচলের রং লেগেছে। বর্ষার কালো মেঘের রক্তাভা। লক্ষ্মী দেখছিল এসব, আর যুগল দেখছিল বাঁধ।

সেকান্দার দু’জনকে দেখেই থমকে দাড়াল। মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে বলল – তোমরা বাঁধ দিলে কার হুকুমে? যুগল মুখ ফিরিয়ে চাইল। সেকান্দারের কথা শুনে তার ক্রূর চোখমুখের রং আরো ক্রূর হয়ে উঠল। কর্কশ কণ্ঠে বিদ্রƒপের সুর গোপন না করে বলল, যিনি হুকুম দেবার, তার হুকুমে।

লক্ষ্মী তাকে থামিয়ে দিল। তারপর চঞ্চল ঘূর্ণিত চোখ সেকান্দারের চোখের উপর রেখে লীলায়িত ভঙ্গীতে হাসল, ঠিক যেমন করে হেসেছিল, মনসুরের চোখে চোখ রেখে। বলল – আপনার জমি আছে বুঝি এখানে। তা পানি দেখেছেন এবার। বাঁধ না দিলেও দু’দশ দিনে পানি সরবে না। তাই বাঁধ দিয়ে আমরা গরীব জেলেরা মাছ ধরে দুটো পয়সা পেলে আপনাদের ক্ষতি কি? বাঁধও তো ভেঙে দেওয়া হবে তাড়াতাড়ি।

সেকান্দারের মুখচোখে ভাবান্তর দেখা গেল না। সে বলল, তা হয় না। বাঁধের ফাঁক দিয়ে পানি সরবে ধীরে ধীরে। তদ্দিনে ফসল একেবারে পচে যাবে।

যুগল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কেন হবে না? চর আমারো নয়, আপনারো নয়, যার চর সে দিয়েছে, আপনি চোখ রাঙাবার কে?

যুগলের মেজাজ এম্নিতেই রগচটা। তার উপর ক্ষেপে আছে। লক্ষ্মী তাকে থামাতে গিয়ে ধমক খেল। সেকান্দারও সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল – আলবাৎ রাঙাবো। চর মনসুর মিয়ার। জমি আমাদের। ধান আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না।

বলেই সে উত্তেজনাভরে বাঁধার জন্য ডাঙার নিকটে পোঁতা বাঁশগুলির দিকে এগিয়ে গেলো। যুগল কঠিন কণ্ঠে বল্‌ল – মালিকের হুকুম ছাড়া যে বাঁধে হাত দেবে, তার জান থাকবে না।

সেকান্দার তখন ক্রোধে কাঁপছে। চকিতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে একটা বাঁশ টেনে ছুড়ে ফেলল। যুগল বিস্মিত হল। বংশীকে দেখে দেখে এতদিন নিজের ঋজু সবল দেহ সম্পর্কে সে উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছে। সেকেন্দারকে তা উপেক্ষা করতে দেখে তড়িৎপদে ক্রুদ্ধ গর্জনে ছুটে আসলো। কিন্তু তার আগেই সেকান্দার সাবধান হয়ে গেছে। যুগলকে আসতে দেখে সে একটু সরে দাঁড়াল মাত্র। তারপর পাশ কাটিয়ে এমন আঘাত হানল যে যুগল মাটিতে পড়ে গেল। দ্বিতীয়বার উঠবার উপক্রম করতেই সেকান্দার তাকে সাপ্টিয়ে ধরল। দুই মত্ত হাতীর মত দু’জনে লড়েই চললো। লক্ষ্মী এতটা হবে ভাবেনি। যুগলকে মার খেতে দেখে সে সেকান্দারের ফেলে দেওয়া বাঁশটাই তুলে নিল। তাক্ বুঝে প্রচণ্ড আঘাত হানল তার মাথায়। একটা আর্তনাদ করে নিষ্পন্দ হয়ে গেল সেকান্দার।

ধুলো শয্যা ছেড়ে উঠে গা ঝাড়তে ঝাড়তে যুগল নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল – যাক্‌ শালা মরুকগে।

হঠাৎ কি মনে পড়ায় সে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল, লক্ষ্মীকে বলল – কাজটা ভাল হল না লক্ষ্মী।

লক্ষ্মী তখন অজ্ঞান সেকান্দারের রক্ত ফাটা মাথা দেখছে। ফিনিক দিয়ে রক্ত ছুটছে, রক্ত বন্ধ করার জন্য সে কাপড়ের গিঁট পাকাচ্ছে। যুগলের কথা শুনে বলল, কথা পরে শুনব, চলো একে ধরাধরি করে নিয়ে যাই। নইলে কেউ আবার দেখে ফেলবে।

নৌকায় এসে যুগল আবার বলল – কাজটা ভালো হল না লক্ষ্মী। আমরা বাধ দেওয়ার হুকুম এনেছি ব্যস। একে মনসুর মিয়ার কথা বলে দিলে সেখানে গিয়ে যা হয় করবার করত! এখন এর ফাটামাথা দেখলে গ্রামের সব লোক ক্ষেপে ছুটে আসবে। আমরা আর ক’জন? উপায় নেই।

লক্ষ্মী চোখের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল – তুমি ওদিক দেখো। এসব তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি দেখবো যাও।

জ্ঞান হতেই সেকান্দার মাথার কাছে যে 888sport promo code মূর্তিকে দেখল, তার মুখ বিষণ্ন, চোখে করুণ আভা। সেকান্দারের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। তাকে চোখ খুলতে দেখে লক্ষ্মী মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে তুলল। তার চোখ, নাক, ঠোঁটের উপর হাত বুলাল। সেকান্দার সম্মোহিত হয়ে গেল। তার স্পর্শ লিপ্সু মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।

হঠাৎ মনে পড়ল তার সখিনার কথা। ভাত খাওয়ার জন্য সখিনার করুণ মিনতি, তার উদগ্র বাহুর বেষ্টন। সেকান্দারের মোহ ভেঙে গেল। লক্ষ্মীর দিকে কিছুক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তাকে বিস্মিত করে সে তড়িৎ পদে নৌকা থেকে নেমে গেল। মাথার যন্ত্রণা তাকে আটকাতে পারল না।

বংশী যা চেয়েছিল, তাই হল। একবার চুপি চুপি যুগলের নৌকার কাছে যেয়ে লক্ষ্মীর কোলের কাছে অজ্ঞান সেকান্দারকে সে পড়ে থাকতে দেখেছে। দেখে সে হেসেছে। কৌশল তাহলে তার ব্যর্থ হয়নি। সোনাকান্দির মানুষ এবার ক্ষেপবে, জাগবে। সেকান্দারকে মারার প্রতিশোধ বাঁধ ভেঙে তুলবে। আর এই সুযোগে বংশী যুগলকে পৃথিবী থেকে সরাবে। কেউ তাকে সন্দেহ করবে না, ভাববে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে বিবাদে খুন হয়ে গেছে। তারপর লক্ষ্মীকে নিয়ে এখান থেকে বংশী চলে যাবে গ্রামের ভিটায় নয়, অথই সাগরের নিরুদ্দেশ বুকে। লক্ষ্মী রাজি না হোক, যুগলকে সে ক্ষমা করবে না। যুগল তাকে জীবনে বহুবার নাকাল করেছে। তারপর চরমতম আঘাত হেনেছে লক্ষ্মীকে কেড়ে নিয়ে। জীবনের স্বপ্ন সাধ টুটে গেলে মানুষ বেঁচে থাকে কিসের টানে?

রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই বংশী প্রস্তুত হয়ে বের হল। যুগলকে নৌকায় পাওয়া গেল না। সে তখন থাকবে না জেনেই বংশী এসেছে। লক্ষ্মী বলল – কি চাও? বংশী এক ফুয়ে পিদিমটা নিবিয়ে দিল। বলল – চুপ করে থাক, চেঁচাসনে।

মনে মনে সে যুগল এলে তাকে অতর্কিতে আক্রমণের কায়দাটা রপ্ত করতে লাগল। লক্ষ্মী চীৎকার করার চেষ্টা করতেই বংশী সজোরে তার মুখ চেপে ধরল। লক্ষ্মী অন্ধকারে কোমরের ছোরাটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু বংশীর শক্ত হাতের দৃঢ় চাপ খেয়ে যন্ত্রণায় কাতরে উঠে তার বুকে ঢলে পড়ল। আদিম হিংসা আর কামনা। বংশী থর থর করে কাঁপতে লাগলো উত্তেজনায়। ইলশার বুকে দীর্ঘ এক শতাব্দী যেন কেটে গেল। বাইরে হঠাৎ মৃদু ডাক শোনা গেল – লক্ষ্মী। বংশী লাফিয়ে উঠল, নিশ্চিয়ই যুগল ফিরে এসেছে। ফিসফিসিয়ে ধমকানির স্বরে সে লক্ষ্মীকে বলল – চুপ করে থাক। চেঁচাবি তো তোকেই আগে শেষ করবো।

অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে ছোরা হাতে সে বাইরে এলো। ভালো করে ঠাহর করল মূর্তিটাকে। লক্ষ্মীদের নৌকা ঘেঁষে আর একটা ছোট ডিঙ্গি। তার উপর একা দীর্ঘ ঋজু দেহ দাঁড়িয়ে। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত বংশী লাফিয়ে পড়ল। ক্ষীণ আর্তনাদটা তখনো থামেনি। দেহটা নদীতে ফেলে দেবার জন্য দু’হাতে উঁচু করে তুলতেই বংশী নিজেই আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল। তার হাত থেকে লাশটা অতর্কিতে নদীতে পড়ে গেল। দেহটা যুগলের নয়, মনসুরের। সে এখানে কি জন্য এল বংশী ভেবে পেল না। ভাববার সময়ও পেল না। অতর্কিতে পেছন থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সে নদী গর্ভে পড়ে গেল। ধাক্কা মারল লক্ষ্মী। বর্ষার অন্ধকার আকাশ মৃত্যুর মত নিথর স্তব্ধ। তার নীচে ইলশার মহা পানির স্রোত সগর্জনে ছুটে চলেছে। সামুদ্রিক বুকে তল নেই। প্রবল স্রোতের টান থেকে আত্মরক্ষার জন্য বংশী দু’বার মাথা তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু পৃথিবীর বাতাস যেন ক্রমশঃই ভারী হয়ে আসছে। ততক্ষণে সে বহুদূরে চলে এসেছে। অতি কষ্টে মাথা তুলতেই বহু কণ্ঠের গর্জন তার কানে এসে বাজলো। সোনাকান্দির মানুষ বাঁধ ভাঙছে। বংশী শিউরে উঠল। সেই বাঁধ ভাঙা প্রচণ্ড ঢলের স্রোতে সে চলে যাচ্ছে।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর বরিশাল জেলার উলানিয়া গ্রামে। তিনি কবি, কথা888sport live footballিক, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। ১৯৫৮ সালে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স পাশ করেন। কর্মজীবনে ছিলেন সাংবাদিক ও কলাম লেখক। অমর 888sport cricket BPL rateের গান – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারী’-এর রচয়িতা তিনি। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, 888sport cricket BPL rateে পদক, বাংলা একাডেমি 888sport live football 888sport app download bd, ইউনেস্কো 888sport app download bd, শেরেবাংলা পদকসহ দেশি-বিদেশি বহু সম্মাননা। ২০২২ সালের ১৯শে মে লন্ডনে মারা যান তিনি।