জল চুইয়ে পড়া ছাদের সিলিংয়ের গায়ে যে ছোপ ছোপ দাগ হয়েছে সেই দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে আগামীদিনের কথা ভাবছিল শবনম। গত দু-বছর ধরে নানারকম তাবিজ শরীরে বেঁধে রাখার পর, আজ সকালে সে একটা নতুন মাদুলি কিনেছে এক ফকিরের কাছ থেকে। গত বছরটায় মসজিদে মসজিদে দিন-রাত্রি চোখের জল ফেলেছে সে। তারপরও আজ সকালে যখন মসজিদে যাচ্ছিল সে-পথে এই ফকিরটাকে দেখে একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল। ফকিরটি তার ঝুলি থেকে কী যেন বের করছিল উবু হয়ে বসে। শবনমের চোখে চোখ পড়তেই ডাকল, এদিকে আয়। সম্মোহনী স্বরটাকে এড়াতে পারে না সে। পা টিপে টিপে কাছে এগোলেই ফকিরটি তাকে ডেকে বলল, নে এটা ধর! শক্ত করে ধর! শবনম অবাক হয়, ভয়ে তার হাতের আঙুলগুলি কাঁপতে থাকে। নিজের হাতের ভেতর সে বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করে একটি ছোট্ট মাদুলি। কোনো এক বাইরের ইচ্ছেশক্তি যেন তাকে প্রাণপণে মাদুলিটিকে নিজের শরীরে ধারণ করতে বলে।
ফকিরটি হঠাৎ তার কাঁচা-পাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ভয় করিস না, ভালো হবে তোর। তারপর মাটিতে হাত ঠেকিয়ে গলার রঙিন মালাগুলোর পুঁতি গুনতে গুনতে বিচিত্র ভঙ্গিতে ফকিরটি উঠে পড়ে আর চোখের পলকেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
বিছানায় শুয়ে আজ রাতে ঘুম আসছে না শবনমের। সারাক্ষণ ছটফটাচ্ছে সে। তার জীবনের গল্পটার যেরকম শুরু তা কোথায় গিয়ে শেষ হতে পারে, সে-বিষয়ে কিছুই আঁচ করতে পারে না সে। সকাল থেকেই ফকিরের বিষয়টা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ওই যে কথাটা! ‘ভালো হবে তোর’ সত্যিই ভালো হবে! কে জানে, আগামীকাল তার জন্য কি সংবাদ অপেক্ষা করছে! সত্যিই চমৎকার বেহায়া সে। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও সে অপেক্ষা করে ভালো কিছু ঘটবে তার সঙ্গে। সে জানে আর বিশ্বাস করে, সে শুধু ভালোবেসেছিল। আজো সেই জায়গাটিকে আঁকড়ে ধরেই তার সবটুকু লড়াই। ভালোবাসাই কি তবে ভালো থাকার মূলমন্ত্র!
দুই
সেই যে মংলা পোর্টে তার দেখা হয়েছিল সেলিমের সঙ্গে। জায়গাটি অচেনাই ছিল, ওখানে যাওয়ার কথাও তার নয়। নিয়তির খেলা। হঠাৎ এক খালাতো বোনের বিয়ে ওই এলাকায় হওয়াতে 888sport app থেকে খালাতো বোনের সঙ্গেই বেড়াতে গিয়েছিল সে। দুলাভাই চাকরি করত মংলা পোর্টে। সেলিম হঠাৎ একদিন এসেছিল তার দুলাভাইয়ের বাসায়। ব্যবসায়িক কোনো উদ্দেশ্যেই হয়তো। সেখানেই শবনমের সঙ্গে প্রথম দেখা। প্রথম দেখার মুহূর্তটি তার এখন ঠিকঠাক মনে পড়ে না। তারপর আরেকদিন, মংলা পোর্টের রাস্তায় পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের কথাবার্তার ভেতর দিয়ে সেলিমের মুখটি চোখে পড়ে। হুম, এই দৃশ্যটিই যেন এক নিমিষে বালির ঘরের মতো ভেঙে দিতে থাকে তার বাকি সব অতীতকে। এখন তার প্রায়ই মনে পড়ে, সেসব সময়ের কথা। সে-সময় কেমন করে অবলীলায় সেলিমের মুখটি ছাড়া আর সব কিছুই যেন ঠিক সেই মুহূর্তেই রাস্তার নাম, দোকানের সাইনবোর্ডের লেখা, সবকিছুই যেন দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল তার কাছে। সেলিম ছাড়া আর সবকিছুই তখন দুর্বোধ্য আর ক্লিশে। তখন যে সে সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে গিয়েছিল! আর খুব প্রবলভাবেই।
তারপর দু-একদিন পার না হতেই একদিন সেলিমই এলো তার বোনের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
‘ছেলে দেখতে-শুনতে মাশা আল্লাহ। শবনমেরও চয়েস হইছে, তাইলে আর দেরি ক্যান।’ খালাতো বোন খুব খুশি হয়েই জানাল বড় ভাইকে।
‘মাত্র এসএসসি পাশ করল শবনম। এখনই বিয়ে! ভালো করে খোঁজখবর করা দরকার।’ মৃদু আপত্তি ছিল বড় ভাই আব্বাসের। পুরান 888sport appয় খাবার হোটেলের জমজমাট ব্যবসা আছে আব্বাসের। আর্থিকভাবে খুবই সচ্ছল আব্বাস ও তার পরিবার। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে কবেই। ছোট বোন শবনম বড় আদরের। বোনটাকে ভালো ঘরে শাদি দিতে পারলেই আর ভাবনা নেই। আব্বাসের বউ আর ছেলেমেয়ে দুটোও শবনমকে চোখের আড়াল করতে চায় না। কিন্তু পড়াশোনাটা শেষ করার আগে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার একেবারেই নেই। খালাতো বোনকে সেই কথা সে স্পষ্ট করেই বলল, ‘আব্বু-আম্মু আমার কাছে শবনমরে রাইখা গেছে, ওর লেখাপড়া শেষ করাটা খুব দরকার।’
‘লেখাপড়ার কী সমস্যা! করবে! তাছাড়া সেলিম তো চাকরি করে জাহাজে। তিন মাস ছয় মাস পরে আসবে। শবনমের পড়ালেখার কোনো অসুবিধা হবে না। সেলিম তো এক বাপের এক ছেলে। ওদের পরিবারটাও ভালো, ছিমছাম। ওর বাবা, ওর মা আমাকে বারবার বলছে, বিয়ের ব্যাপারে। সেলিম নিজেও এসেছিল। মনে হয়, ছেলেটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।’
শবনমের বড় বোন ও তার স্বামী এ-প্রস্তাবে খুবই খুশি ছিল। ছেলে দেখতে সুন্দর, জাহাজে চাকরি করে, টাকার অভাব নেই। তাই বিয়েটাও খুব দ্রুত হয়ে গেল পারিবারিকভাবে, সবার মিলিত সিদ্ধান্তে, আনন্দে-উত্তেজনায়। শর্ত একটাই, শবনম ইন্টার পাশ করার পর সংসার করবে।
বিয়ের পর তিনটি মাস শবনম ছিল আনন্দে আত্মহারা। কয়েকদিন 888sport app, কয়েকদিন শ^শুরবাড়ি, কয়েকদিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি আর নানা রিসোর্টে ঘুরেফিরে তিন মাস কেটে গেল চোখের পলকে।
সেলিম তিন-চার মাস পরপর আসে। তবে তার আসার সময়ের তেমন ঠিক থাকে না। আবার যাওয়ার সময়েরও ঠিক থাকে না। হঠাৎ করেই তার আসা-যাওয়া। বিষয়টা নির্ভর করে জাহাজের গতির ওপর। জাহাজের মালপত্রগুলির সুপারভিশন করে সে। আসার সময় নিয়ে আসে প্রচুর টাকা, মোবাইল ফোন, আরো অনেক কিছু। শবনমকে সে অনেক দূরের সমুদ্রের গল্প শোনায়। ঢেউ কেমন করে ছড়িয়ে ছড়িয়ে উজ্জ্বল সাদা হয়। কেমন রুপালি আলোতে চকচক করে রুপালি ঢেউ। বলে অচেনা শহর আর বন্দরের গল্প। গাঢ় কুয়াশায় 888sport app অনেক দ্বীপের গল্প। সমুদ্রের ঘন কুয়াশার নিচে যেমন করে বয়ে যায় কালো জলেরা – তার গল্প। কখনো বা নীল রঙের উজ্জ্বল সমুদ্রের গল্প। এসব গল্প শুনতে শুনতে শবনমের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন মিলিয়ে যায় সেলিমের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সঙ্গে। গল্পগুলি স্থান, কাল ও পাত্র নিয়ে তার 888sport sign up bonusতে মিশে যেতে থাকে, কখনো জীর্ণ হবে না এমন প্রতিজ্ঞায়।
শবনমের এই দিনগুলি দারুণ রঙিন। তার আকাশে তখন কেবলই শরৎকাল, চারপাশে বসন্তের হাওয়া গুনগুন। বড় ভাইয়ের যাত্রাবাড়ীর বাসার ছাদের ঘরটাই তাকে দেওয়া হয়েছিল। শবনম চাইলে অন্য জায়গায় একটা ঝকঝকে ফ্ল্যাট নিতেই পারত। কিন্তু যেহেতু সেলিম সবসময় থাকে না, তাই ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে একই বাসায় থাকাটাই নিরাপদ। সঙ্গে চেষ্টা করছিল ভালোভাবে পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে।
বিয়ের বছর পাড় হয়ে গেছে। তার ইন্টার পরীক্ষার আর কয়েকদিন বাকি। পরীক্ষা সামনে বলে সেলিমের এবারের আসাটা অনেকটা পিছিয়ে যায়। কিছুটা ব্যবধান তৈরি হয়। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন রাতে সেলিম আসে, আর মাত্র একটি দিন থেকেই সে চলে যায়। বলছিল, চট্টগ্রাম বন্দরে একটা জাহাজ লোড হতে সময় নিচ্ছে, তাই সে একদিনের জন্যই প্লেনের টিকিট কেটে এসেছে। তারপর শবনমের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর, সব মিলিয়ে পাক্কা চার মাস পর সেলিম আসে। কথা ছিল পরীক্ষা শেষের পর ওরা কিছুদিন মংলায় গিয়ে থাকবে, সেলিমের বাবা-মায়ের সঙ্গে।
কিন্তু চার মাস পর হঠাৎ এক গভীর রাতে মাইক্রোবাস নিয়ে সেলিম আসে। সঙ্গে কয়েকজন লোকও থাকে। বিষয়টি 888sport appবারের মতো নয়। লোকগুলো সেলিমকে খুব যত্ন করে নামিয়ে দিয়ে তখনই মাইক্রোবাসে নিয়ে চলে যায়। মাঝরাতে, সঙ্গে আরো কয়েকজন নিয়ে আসার বিষয়টা ভাবতে ভাবতেও ভাবনাটা উড়ে যায় শবনমের। সে তখন বিষয়টি আর ভালোভাবে খেয়ালই করে না হঠাৎ আনন্দে ও উত্তেজনায়। কিন্তু ঘরে ফেরার পর সেলিমকে দেখে সে আঁতকে ওঠে। এই মানুষটি কি সেই মানুষ! একি চেহারা হয়েছে সেই দীর্ঘদেহের স্বাস্থ্যবান মানুষটির! তার পাঁজরের হাড়গুলি বেরিয়ে পড়েছে। চোয়াল ভাঙা। গায়ে বনমানুষের মতো লোম। সময়ে-অসময়ে যে মানুষটি এসে পড়ত, সে গত কয়েকটি মাস আসেনি কেন! সে কি অসুস্থ! নানা প্রশ্নে শবনমের ভেতরটা জ্বালাপোড়া করতে থাকে। যে লোকগুলো ওর সঙ্গে এসেছিল, ওরা কারা! এসব ভাবনা তাকে সারা রাত ধরে তোলপাড় করে, কিন্তু সে মুখে টুঁ-শব্দটিও করে না। জানালার লাল ভারী পর্দাটা টেনে দিয়ে সেলিমকে জড়িয়ে ধরে রাখে আগের মতোই। মানতেই পারে না যে, কোথাও একটা বড় বকমের পরিবর্তন ঘটে গেছে। মনে মনে ভাবে, হয়তো বেশ কিছুদিন মাটির দেখা না পেয়ে সমুদ্রে থাকার কারণে শরীর খারাপ হয়ে গেছে। সে তার ভালোবাসা দিয়ে দুদিনেই সেলিমকে ঠিক করে ফেলবে।
দু-চারদিন পর সেলিম সেবাযত্নে একটু সুস্থ হয়। কিন্তু সুস্থ হওয়ার তিন-চারদিন পর হঠাৎ একদিন শবনম দেখে সেলিম বাথরুম থেকে দীর্ঘক্ষণ বেরুচ্ছে না। দীর্ঘক্ষণ পর বাথরুম থেকে বের হয়েই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। শবনম একটু পরে বাথরুমে গিয়ে আবিষ্কার করে কমোড ভরে আছে রক্তে। দিশাহারা হয়ে যায় শবনম। ভাই-বোনকে ডেকে বলে। তারপর এ-ডাক্তার ও-ডাক্তার খুঁজে খুঁজে যতই সময় পার হতে থাকে সে দেখতে পায়, সেলিমের শরীরের সব কলকব্জা যেন বিগড়ে যাচ্ছে। এত দুর্বল! শরীর একেবারেই ভেঙে পড়ছে ক্রমশ। সেলিমের বাবা-মা বিষয়টা জানার পর ডাক্তারের পাশাপাশি কবিরাজি ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এদিকে নিজের শরীরে শবনম টের পেতে থাকে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব। কখন যে এটি ঘটে গেছে ঠিক মনে করতে পারে না। সেলিমের কি মনে আছে, সেই যে লম্বা সময়ের বিচ্ছেদের ভেতর একদিন যে সে হঠাৎ এসেছিল কাউকে না জানিয়ে! সে সময়ের তারিখটা 888sport sign up bonusর ভেতর জেগে উঠতেই তার নিজের শরীরের ভ্রূণটি নড়ে ওঠে। প্রথম সন্তান : কিন্তু তার এই আনন্দের খবর সে কাকে বলবে! সেলিমের রক্ত যেতে যেতে এমন অবস্থা যে তার চোখ নিষ্প্রভ, ঠোঁটা সাদাটে আর শরীর যেন বরফের মতো ঠান্ডা। একটা বিষম আতঙ্ক যেন জড়িয়ে রেখেছে চারপাশ।
শেষ পর্যন্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, সেলিম এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের চেম্বারেই জ্ঞান হারিয়েছিল শবনমের বড় ভাই। মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল বড় বোন। অসহ্য দুঃখের ভেতর বীভৎসভাবে সেলিমের মৃত্যুর আশঙ্কা ক্রমেই তাড়িয়ে বেড়াত তাকে। সেলিমের পুরো শরীরে তখন পচন ধরছিল। হাসপাতালে ভর্তির পর ভয়ে নার্সরা রুমে আসতেই চাইত না। সমস্ত ড্রেসিং শবনম নিজেই করত। সবারই ধারণা ছিল, এইডস রোগ ছোঁয়াচে। আপনজনরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ডাক্তাররা সেলিমের আয়ু নির্ধারণ করেছে বড়জোর এক সপ্তাহ।
শবনম এই অবস্থায় হাসেও না কাঁদেও না। সেলিমের উপার্জিত টাকাগুলি জলের মতো চলে যাচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসায়। ডাক্তার খুবই চিন্তিত শবনম ও তার সন্তানের বিষয়ে। এখন শবনমের অ্যাবরশনের কোনো সুযোগ নেই। বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে শবনম সবার কথা শোনে, যন্ত্রণার নির্মম দৃশ্যগুলি দেখে। একদিন ডাক্তারের রিপোর্টে জানতে পারে, তার নিজের শরীরেও ছড়িয়েছে এইচআইভি। তবু যেহেতু সময়মতো তাকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তাই শবনম হয়তো বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে। তবে আশঙ্কা আছে তার গর্ভস্থ শিশুর ক্ষেত্রেও। শবনম নিজের দিকে তাকায়। চূর্ণ-বিচূর্ণ 888sport sign up bonusগুলির দিকে অবশ মনে বসে থাকে। কী করবে ভেবে পায় না। শুধু ধৈর্য্য ধরে ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে থাকে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পড়ে যেতে থাকে তার চুল, খসে পড়ে চামড়া, শরীরের ভয়ংকর ব্যথারা জেগে থাকে রাত-দিন। তলপেটের ভেতরে গর্ভস্থ শিশুর ওজন কমে যায়। তবু সে টের পায় ভ্রƒণের অস্তিত্ব। আর অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে তার গর্ভে হাত রেখে বলে, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, তুই মরে যাইস না।’ যেন এই শব্দ-কয়টির বিড়বিড় করা উচ্চারণ তার ভালোবাসার মন্ত্র। শব্দগুলি যেন ভালোবাসার তাবিজ।
শবনম এই রকম শরীর নিয়েও মৃদু বেঁচে থাকা স্বামীর সেবা করে যায়। এমনকি তার রাগও হয় না। না, তার একেবারেই রাগ হয় না, এমন জীবন্মৃত মানুষটির প্রতি। সে কি তাকে জেনেশুনে ঠকিয়েছে! না, না, সেলিম তাকে ভালোইবাসত। সেলিম নয়, নিয়তিই তাকে ঠকিয়েছে। মনে পড়ে, সমুদ্রের গল্প বলতে বলতে সেলিম তাকে থাইল্যান্ডের এক 888sport promo codeর কথা বলত। মাঝে মাঝে সব অনুভূতি পাথরের মতো ভারী মগজের ভেতর জমে থাকে। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সাতদিনের মাথায়ই সেলিমের মৃত্যু হলে দু-একজন আপনজন আসে। তবে তারা তখনো মেনে নিতে চায় না, এই মরদেহের অসুখের বিভীষিকাকে। যদিও পারিবারিক কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়; কিন্তু তা নিয়ে আত্মীয়জনদের বাকবিতণ্ডার অন্ত থাকে না।
তিন
গত তিন বছর ধরে ডাক্তারের প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলেছে শবনম। ওষুধের প্রভাবে পড়ে গেছে তার অসাধারণ সুন্দর লম্বা রেশমের মতো চুল। সেলিম তার ঘন-গাঢ় চুলে নাক ডুবিয়ে আদর করত। সেসব দিনের ঘোর সারা মনে ভরে থাকে শবনমের। এত যে বিপরীত দৃশ্যের ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে, শবনম কিন্তু কিছুতেই ভয় পায় না। ডাক্তাররা ওর মানসিক শক্তি দেখে অবাক হয়। নার্সরাও আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকায়। কয়েকটি এনজিও আসে তার সঙ্গে কথা বলতে। যদিও ওষুধের প্রভাবে এখন তার দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ। তবু বিদেশি কয়েকজন ডাক্তারের একটি গ্রুপ নিয়মিত তাকে পর্যবেক্ষণে রাখছে। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, রোগীকে সুস্থ করে তার শিশুটিকেও বাঁচানো। শবনমের কেসটা তাদের কাছে অনেক স্পেশাল। পরিবারের মানুষরা শবনমকে এখনো পুরোপুরি এড়িয়ে চলে। ডাক্তার ও এনজিওকর্মীরা চারপাশের মানুষদের বোঝাতে চায়, এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কখনো কখনো শবনমের ভাইবোনেরা আসে ঠিকই খোঁজখবর নিতে; কিন্তু কিছু টাকাপয়সা দিয়ে যায় হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে বা নার্সের কাছে। ভয়ে ওরা শবনমের কাছে আসে না। অস্পৃশ্য ছোঁয়াচে রোগে বড় ভয়।
নানা জটিলতা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত শবনমের একটি ছেলেশিশু হয়। শিশুটির ওজন খুবই কম, তবে সুস্থ। ডাক্তার বিনীত অনুরোধ করে শবনমের বোনকে। বাচ্চাটা দুই বছর মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকবে। মায়ের দুধ খেতে পারবে না। দু-বছর পর শিশুটিকে টেস্ট করে জানা যাবে তার এইচআইভি আছে কি না। শবনমের বোনের কাছে বাচ্চাটির দায়িত্ব দেন ডাক্তার।
চার
শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। শবনম শিশুটির জন্মমুহূর্তটিকে 888sport app download for android করতে করতে দু-চোখের জলে ভাসে আরেকবার। কী ভয়ানক যন্ত্রণা! রক্তক্ষরণে সে বিবর্ণ। শিশুটির কান্না থামছে না। সে এইডস রোগী বলে তার কাছে শুধু একজন নার্স। অনেকটাই অবহেলিতভাবে রয়েছে শিশুটি ও সে। বাচ্চাটা খুব জোরে কাঁদছিল! তারপর একসময় কোনো এক অদৃশ্য বন্ধনের কারণে শিশুটি নিজে নিজেই কান্না থামায়। সে তার মুখটি দেখে, শিশুটিও যেন তাকায়। সে দু-হাত তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলে, ‘আল্লাহর দোহাই, বেঁচে থাকুক আমার বাচ্চাটা’ আর কাঁদতে থাকে।
শবনমের পুরো জীবনটাই একটা অসম্ভব জীবন। সামনে থেকে যা পায়নি, তাকে পেয়েছে অন্য অনুভবে। এই অসম্ভব জীবন নিয়েও এখন সে কিছুটা সুস্থ। তার পড়ে যাওয়া মাথার সব চুল আবার গজিয়েছে। চামড়াটাও মসৃণ হয়ে ফিরে এসেছে গায়ে। সঙ্গে ফিরেছে অদম্য মানসিক শক্তি। কিছু ওষুধ এখনো তাকে খেতে হয়, আর তা বিনামূল্যে দিয়ে থাকে নানা এনজিও। এমন একটি এনজিওতে কাজ করে সে কিছু টাকা আয়ও করে। তার কাজ হলো মানুষকে বোঝানো যে, ‘এই রোগটি ছোঁয়াচে নয়, আর প্রথম অবস্থায় রোগ শনাক্ত হলে ওষুধ খেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া যায়।’
দুদিন পর তার শিশুটির এইচআইভি পরীক্ষাটি হবে। বড় বোন শিশুটিকে নিয়ে এসেছে 888sport appয়। পুরো পরিবার উদগ্রীব হয়ে আছে এ বিষয় নিয়ে। দু-বছর ধরে বিচ্ছেদ, দুঃখ, আঘাত, অপমান, সম্পর্ক, উপেক্ষা, সবকিছুই তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করেছে। তবু তার আস্থা ভালোবাসায়। মৃত্যুর গলায় পা রেখে তো সে বেঁচেছে! সে যেন জেনেই নিয়েছে শিশুটির এইচআইভি পজিটিভ রিপোর্ট আসবে না। আর যদি আসেও তবে দ্রুত চিকিৎসা তো আছেই।
ঘোরের মধ্যে সে যাচ্ছে, হাসপাতালের পথে নির্দিষ্ট বাসটি ধরবে বলে। একটা বাসকে টপকে দ্রুত চলে যাচ্ছে আরেকটি বাস। শবনম মরিয়া হয়ে ছুটছে সমস্ত হাহাকারকে অতিক্রম করে। হঠাৎ গলার কাছ থেকে খসে পড়ে ফকিরের কাছ থেকে পাওয়া গতকালের মাদুলিটি। সে বিচলিত হয়ে চারপাশের খোলা জায়গায় মুখ ঘুরিয়ে তাকায়, না কোথাও নেই।
নিজের অন্তঃশক্তি নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে শবনম সামনের দিকে পা চালিয়ে জোরে হাঁটতে থাকে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.