অমিয় দেব
তলকুঠুরির গান 888sport alternative link। লেখক ওয়াসি আহমেদ। প্রকাশক ‘প্রথমা প্রকাশন’, 888sport app। প্রকাশ ২০১০-এ। এর দ্বিতীয় মলাটে এক বয়ানও আছে এর
বিষয়ে :
তকবির চানের খেপলা জালে যেদিন বড় বোয়াল মাছ ধরা পড়েছিল, সে ভাবতে পারেনি এর ফলে কী দুর্ভোগ তাকে পোহাতে হবে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিজের রক্তের স্বাদ জিবে পেতে পেতে ঘোর ঘোর চোখে সে দেখতে পেয়েছিল স্বাদটা সে একাই পাচ্ছে না, পাচ্ছে তার দশ বছরের ছেলে শুকুর চানও।
সেই দুঃসহ 888sport sign up bonus নিয়ে তার মেয়ে আম্বিয়া খাতুন কয়েক বছর পর এক অত্যাশ্চর্য হারিকেন মিছিলে যোগ দিয়েছিল। আরো পরে, শুকুর চান যেদিন এক মরণপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার মাথায় তখন শুধু প্রতিশোধ নয়, নানকারদের মুক্তির স্বপ্নও ছিল। কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে আত্মমগ্ন এক ভুবনে ঠাঁই নিয়ে সে জানতেও পারেনি তার স্বপ্নের ফলাফল।
দীর্ঘদিন পর শুকুর চানের শহরবাসী শিক্ষিত সমত্মান শরীফ অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে এক অবোধ্য গানের মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষের সঙ্গে একাত্ম হতে চায়। হয়তো পারেও খানিকটা! কিন্তু করপোরেট সংস্কৃতিতে লালিত শরীফ কত দূর যাবে!
আর বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে : ‘প্রাচীন সিলেট অঞ্চলে নানকার পরিচয়ে বংশপরম্পরায় আমৃত্যু হদবেগারিতে বন্দি অগণিত মানুষের 888sport sign up bonusতে।’ সেই সঙ্গে তাঁর ভূমিকায় বলেছেন লেখক : ‘অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন সিলেট জেলায় নানকার প্রথা এক অব্যক্ত অধ্যায়, যা সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ ও রাজনৈতিক ডামাডোলে চাপা পড়ে প্রায় অকথিতই রয়ে গেছে।… (অনুচ্ছেদ) ইতিহাসের ধারাকে আবছাভাবে ধরার চেষ্টা থাকলেও এ রচনা সর্বতোভাবেই একটি আখ্যান। নানকাররা যে তাদের দীর্ঘ ও অসম সংগ্রামে এক বিসত্মৃত জনপদকে আলোড়িত করেছিল তার বিশদ বয়ান এটি নয়, কোনোক্রমেই নয়।’ লেখকের এই স্বীকারোক্তি মাথায় নিয়েই আমরা এ-আখ্যান করব। গোড়ায় লক্ষ করব, ওই দ্বিতীয় মলাটে ছাপা বয়ানটি কোনো কালানুক্রমিক আখ্যানসার নয়, এক আমন্ত্রণ মাত্র – পাঠকের কাছে লেখা এক চিঠি।
আখ্যান আরম্ভ হচ্ছে বর্তমানে, কিন্তু টাল খাচ্ছে অতীতের দিকে। অতীতই নিয়মত্মা আমাদের নায়কের প্রথম কৃতির। এক পদবি সে একদিন জুড়ে দিলো তার নামের পেছনে, যা তার মতে তার আত্মপরিচয়। সে আর শুধু শরীফউদ্দিন নয়, শরীফউদ্দিন ‘নানকার’। ‘নানকার’ কারণ তার বাপ-দাদা ছিল ‘নানকার’, ‘নানকার’ কারণ তার শিরায় বইছে ‘নানকার’ রক্ত। অথচ ‘নানকার’ কথাটা বহুকালবিস্মৃত : কেউ জানে না, কাকে বলা হতো ‘নানকার’। তাই শরীফের এই আকস্মিক পদবি ধারণে সকলেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত। তার আপাত-সুখের অভাব কোথায় – কর্মক্ষেত্রে সুনাম, এবং স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে নির্বিঘ্ন মধ্যবিত্ত জীবন! কিন্তু কিছু একটা তাকে কুরে খাচ্ছিল, সম্ভবত বছরখানেক আগে যে-গান তাকে হানা দিয়েছিল তা শোনার পর থেকে। যাচ্ছিল লঞ্চে করে কর্মসূত্রে ভাটি দেশে, হঠাৎ ভোরবেলা এক অস্পষ্ট সুর তাকে কেবিন থেকে নিচে খোলে নামিয়ে নিল। এক বৃদ্ধ অন্ধ গায়ক একতারা বাজিয়ে গাইছিল :
দিন তো গেল, নিশা অইল, ঠাঁই পাইলাম না
চৌদ্দ জনম বিনালে গেল, মানুষ অইলাম না-
ও আমার নানকারি জিন্দেগি
এমন জিন্দেগি ভবে আর না মিলে
ও আমার… (পৃ ৮৩)
শরীফ চমকে উঠেছিল। ছোটবেলায় তার বাবার গোঙানিতে এমন জিন্দেগি নিয়ে বিলাপ শোনেনি? এ তো তার বাবারও গান। ওয়াসি আহমেদ যে তাঁর 888sport alternative linkের নাম রেখেছেন তলকুঠুরির গান, তা কি একাধিক অর্থে : ‘তলকুঠুরি’ কি অবচেতনও? আর শরীফের এই অতীতবাহী পদবি ধারণে কি সেই ‘তলকুঠুরি’ও ক্রিয়াশীল নয়?
বাবা শুকুর চানের কাছে শরীফ দফায় দফায় তাদের ‘নানকারি’ বা রুটির গোলামগিরির কথা শুনেছে। আখ্যান তখন অতীতে! তার খানিকটা পর্যায়ক্রমে, খানিকটা ইতস্ততবিক্ষেপ্ত। সেই সঙ্গে নানকার আন্দোলনের কথাও আছে, বিশেষ করে ‘কানা রাজা’ তথা অনবহিত থেকে যাওয়া জেলা শাসককে তাদের অবস্থা জানানোর জন্য নানকার বউ-ঝিদের এক হারিকেন মিছিলের বৃত্তান্তও আছে, যাতে তার দিদি আম্বিয়া বেগমের বড় ভূমিকা ছিল। বস্ত্তত, সেই ‘রূপকথা’ দিয়েই বালক শরীফের জ্ঞানযোগ সূচিত হয়। এসবই ঘটেছে সিলেট জেলায়, যেখানে দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল ‘নানকার’ প্রথা। ‘নানকার’ জমিদারের-মিরাশদারের রায়ত নয়, বেগারখাটা দাস। তাকে, তার বউ-ঝিকে যা করতে বলা হবে তাই করতে হবে। করতেই হবে। না করলে, শাসিত্ম। এবং শাসিত্মরও মাত্রা আছে। আছে ‘শাসিত্মরাম, হাতদেড়েক লম্বা চামড়ার জুতো, ডগাটা নৌকার গলুইয়ের মতো বাঁকানো’, আছে ‘লেজ ঝোলানো বেড়ি পাকানো শঙ্খিনী সাপের মতো তেলতেলে জামরঙ চাবুক’ (পৃ ৩৮)। তারও ওপরে আছে তক্তাচাপা (যাকে ইংরেজিতে বোধহয় w/rack বলা হতো)। আর কিল-চড়-ঘুষি কি বুকে-পিঠে ছ্যাঁকা তো লেগেই আছে। ‘নানকার’ কন্যাদের চেহারা একটু ভালো হলেই বাবুদের বাড়িতে তাদের দাসী করে নেওয়া হতো। আর সেই দাসীদের কখনো কখনো জমিদার-মিরাশদার-কন্যার লেজ ধরে তার শ্বশুরবাড়ি যেতে হতো – আর ফিরত না। এই ‘পাখি’ হয়ে যাওয়ার ভয় যে তার সুন্দরী বুয়া আম্বিয়াকে নিয়ে তার মা মতিজানের ছিল তা বালক শুকুর চান জানত। বিন্দুমাত্রও স্বাধিকার ছিল না ‘নানকারে’র।
বাবা শুকুর চানের কাছে যে-দ্বিতীয় পাঠ পেয়েছিল বালক শরীফ তা মুখ্যত তার দাদা তকবির চানকে নিয়ে হলেও তাতে জড়িয়ে পড়েছিল তখন দশ বছরের শুকুরও। বছরপঞ্চাশের আগের ঘটনা (তখনো সুরমা নদীর পুল হয়নি) যার দূরপ্রসারী ফল হয়েছিল। তকবির ছিল কমজোর ও তার খেপলা জালে বিশেষ মাছ উঠত না, কিন্তু যেটুকুই উঠত তা জমিদারবাড়িতে দিয়ে আসতে হতো; নিজেদের মাছ খাবার বা লুকিয়ে-চাপিয়ে একটু-আধটু বেচে দুপয়সা কামাবার উপায় ছিল না। সেদিন তার খেপলা জালে এক দশসেরি বোয়াল দৈবাৎ ধরা পড়ল এবং বড়ো বাড়িতে না দিয়ে তা বেচে দিলো। খালি নিজেরা মাছ খেতে পায় না বলে নিজেদের জন্য এক ছোট ভাগা রেখে দিলো। আর কর্তাস্বরূপ ঈশ্বরের কাছে যেহেতু নানকারদের কোনো কথাই গোপন থাকে না, তাই পাইক এসে তকবিরকে ডেকে নিয়ে গেল। চরম শাসিত্মই পেতে হলো তকবির চানকে, তক্তাচাপা, যদিও তার বুক-পেটের ওপর দিয়ে যখন পাইক হাঁটছে তখন হঠাৎ ছুটে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দশ বছরের শুকুর। মুখে রক্তের স্বাদ ও বুকে ব্যথা নিয়ে তকবিরের তক্তামুক্তি ঘটল বটে, কিন্তু জমিদারের তীব্র চাবুকে শুকুরের কপাল চিরে দুভাগ হয়ে গেল। এই তক্তাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছিল তকবির চানের, আর শুকুর চানের নাক থেকে চাঁদি বরাবর যে চামড়ার দড়ি বালক শরীফকে কৌতূহলী করে রাখত, তা ওই মর্মান্তিক চাবুকের 888sport sign up bonus। বস্ত্তত, ওই ক্ষতস্থান দড়ির আকার নিত না, এবং তকবির চানকেও কিছুকাল অন্তত বাঁচিয়ে রাখা যেত না, যদি না সেইদিন মাঝরাতে তাদের ঝুপড়িতে দুই ‘ফিরিশতা’র আবির্ভাব হতো। দুই কমিউনিস্ট তারা, নানকার আন্দোলনে জড়িত, বিশেষ করে একজন যে ডাক্তারিও জানে।
ইত্যাদি ইত্যাদি অতীত আমরা শুকুর চানের জবানে বালক শরীফের সঙ্গে শুনি। আবার এই তিরিশ-চলিস্নশের দশকের অনেকটা অতীত আমরা লেখকের মুখেও শুনি। মুখ্যত নানকার পরিস্থিতি ও ইতস্তত হলেও ক্রমবর্ধমান নানকার বিক্ষোভ এবং আসামে পার্টি প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে কমিউনিস্ট-চালিত নানকার আন্দোলনের কথা শুনি। এই আন্দোলনের এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল কৃষক-নানকারের দূরত্ব। বলা বাহুল্য, কৃষক আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল প্রজাস্বত্ব অর্জন। সেখানে নানকারদের কোনো ভূমিকা ছিল না, কারণ তারা প্রজা নয়, গোলাম। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে আওয়াজ উঠছিল : ‘নানকার-কিরান ভাই-ভাই/ জমিদারির খতম চাই’ (পৃ ২২৬)। এই আওয়াজ যে সংগঠিত করে তুলছিল তার নাম নইমউলস্না। কিন্তু একটা সময় এলো যখন লড়াইটা আর জমিদার-নানকারেতে রইল না, হলো নানকারে-পুলিশে। এবং পুলিশের বহর দেখে আর স্থানীয় নানকারদের কোনো আশা রইল না। তার ফলেই হয়তো শুকুর চান যে লাঠি বাগিয়ে এক চরম লড়াইতে একবার মেতে উঠেছিল, মা মতিজানের সঙ্গে পালাতে রাজি হলো। পালাল পশ্চিমে, সিলেট জেলা ছেড়ে মেঘনা পারে। তবে ভৈরবে গিয়ে পৌঁছল শুকুর চান একা, মেঘনায় পৌঁছতে পৌঁছতেই মা কলেরায় মারা যায়। ‘বহু বছর পর জায়নামাজে বসে দুই হাতের তালে মুখ বাঁচিয়ে সে যে বিদঘুটে মোনাজাতে মেতে উঠেছিল, নানকারের বাচ্চা বলে খোদাতালাকে শুনিয়ে নিজেকে গাল পেড়েছিল, তাতে সে তার ঝুরঝুরে অতীতকে ভোজবাজির মতো হঠাৎ খোলামেলা করে প্রমাণ করেছিল, পার পাওয়া যায় না, দুনিয়া বদলে গেলেও না।’ (পৃ ২৫০)
অথচ দুনিয়া বদলাল। নানকারি উঠে গেল, জমিদারিই উঠে গেল। ‘এত কষ্ট, সংগ্রাম-আন্দোলনেও যা হলো না তা এমনি এমনি মিটে গেল! মিটেই যদি যাবে, লাখ লাখ নানকারের ওপর জুলুম-নির্যাতন তাহলে শুধুই কপালের ফের!… (অনুচ্ছেদ) মরার আগ পর্যন্ত এই খেদ থেকে শুকুর চানের রেহাই মেলেনি। যুগ যুগ ধরে আন্দোলনের ফলেই যে নানকারি উঠে গেল বা দুনিয়া বদলে গেল, এ-কথা তাকে তখন কে বলবে!… (অনুচ্ছেদ) শরীফ ভাবে, এই খেদটা যদি না থাকত, অন্তত একবারের জন্য হলেও শুকুর চান ভাবত, এত বড় সংগ্রাম বিফলে যায়নি, তাহলে দূরে (ভৈরবে) বসেও কিছুটা শান্তি কি পেত না! বলা যায় না শান্তিটা সুখ হয়ে কবর পর্যন্ত তার সঙ্গী হতে পারত। পারেনি বলেই বুঝি শরীফের উপর ভর করল! নাকি খেদটা শুকুর চানের একার না, নানকারি উঠে গেলেও চোদ্দোপুরুষের দুর্দশা তার গলায় যেমন খেইহারা গোঙানিতে রূপ নিত (তলকুঠুরির গান?), তেমনি কপালের দড়িটা বেঁচে থাকার শেষ দিন অবধি চাপ দিলে শক্ত হয়ে ফুলে ফুঁসে উঠত। শরীফের দুই কান সাক্ষী, দুই হাতের দশ আঙুল সাক্ষী। (পৃ ২৫০-৫১, নিম্নরেখ আমার)
এত এত উদ্ধৃতির কারণ একটাই : শরীফের এই মুহূর্তের আচার-আচরণ। সে যে শুকুর চানের সমত্মান তা ভুলবে কী করে! তার দিদি শরীফা, যার ম্যাট্রিক
পাশের সময়ই শুকুর চান উপরোক্ত অদ্ভুত মোনাজাত করেছিল খোদাতালার কাছে, ছোট ভাইয়ের এই পিছুটান মেনে নিতে পারে না। মানুষকে তো এগোতে হবে, সুখ পাক বা না পাক সুখের চেষ্টা তো করতে হবে। তার স্ত্রী আছে, ছোট দুই ছেলেমেয়ে আছে – তাদের কথা ভাবতে হবে না! স্ত্রী মুনিরা তো শরীফের এই নানকার আত্মপরিচয় সন্ধানে ও বিপরীত বাঁধনে রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তারও তো ছিল এক হাভাতে অতীত, প্রায় অশস্নীল এক পরিবেশ। কিন্তু সে তো তা খুঁড়ে বেড়াচ্ছে না – চিটাগাংয়ের ওই নরক পেছনে ফেলে যে 888sport appর মিরপুরে সে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে, তা কি কম কথা! কোনো সম্ভাবনাই তো ছিল না তার এখানে আসার। কপাল ঠুকে এক 888sport appই কোম্পানিতে এক নিতান্ত নিচু পদে আবেদন করে ফেলেছিল, এবং রাতের বাসে করে 888sport app পৌঁছে যখন এই কোম্পানির বিশাল ভবনে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে কোথায় হাজিরা দিতে হবে, তখন দৈবাৎ, একেবারেই দৈবাৎ, এই মানুষটির সঙ্গে দেখা। এবং তারই জের টেনে তাদের পারস্পরিক টান এবং বিয়ে। সোনারই তো সংসার – এক ছেলে এক মেয়ে – তাদের স্কুলে নিয়ে যেতে ও স্কুল থেকে নিয়ে আসতে যে কী আনন্দ, তা কি শরীফ জানে না! কেন তবে এই উলটো হাঁটা, খালি ‘নানকার’, ‘জানকার’! নিরাগ্রহের চোটে প্রমোশনটা খুইয়ে বসল; আবার এক কলিগের মৃত্যু নিয়ে তার মেয়েকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টায় কেমন বাড়াবাড়ি করে ফেলল; তার ‘নেমসেক’ এমডি (শরীফ খান) শেষ পর্যন্ত তাকে এক নির্ভেজাল দফতরে বদলি করে দিলেন। আর এদিকে বুককেসের আড়ালে এনে লুকিয়ে রেখেছে এক সদ্য তৈরি ‘নানকারি’ তক্তা – সে কি দেখতে চায় তার পিতামহ তকবির চান কীভাবে ‘চাপা’ পেয়েছিল?
বর্তমান-অতীতের এই জোড় বুনুনিতে আখ্যান এগোয়। মাঝে মাঝে মুনিরার গল্পও শোনা যায় : বেশ কটা পরিচ্ছেদে তা ছড়িয়ে আছে। ভাইবোনের খাই খাই ও মার খিসিত্ম শুনতে শুনতে সে বড় হয়েছে; পড়াশোনায় ভালো হতে পারেনি। তবু দাদার উৎসাহে কলেজে ঢুকেছে; স্ট্র্যাপছেঁড়া স্যান্ডেলে হেঁটে গিয়ে কোনোমতে শেষ বেঞ্চিতে বসেছে, কাজের চেষ্টা করতে করতে ফাদার পিটারের বাঁশের ঘরের ‘মিশনারি স্কুল’ – তবু তো চাকরি। চাকরিতে-টুইশনিতে মিলিয়ে মাসামেত্ম কিছু টাকা; ইত্যাদি ইত্যাদি এক নিষ্প্রাণ জীবনসংগ্রাম। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী বিহারি চাচিজির উদ্দাম পরামর্শ, ‘ভাগ যা, নিকাল যা’। কিন্তু যে-জোর তাকে এতদিন চালিয়ে নিয়ে এসেছে তারই যেন এক নতুন পরীক্ষা চলছে এখন, দাম্পত্যে কি দেয়াল উঠছে? শরীফের আত্মপরিচয়ের উদ্ভ্রান্তিতে তার সায় নেই, আবার চোখ বুজে থাকাও সম্ভব নয় তার পক্ষে। ফলে দূরত্ব গজায়। আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে এই দূরত্ব আমরা দেখি, আর সম্পর্কের সত্যাসত্য নিয়ে আন্দোলিত হই।
সেই তলকুঠুরির অন্ধ গায়ক শরীফকে বলেছিল, ‘নানকার নই, আছে নানকারি’ (পৃ ৮৪)। সে এখন যা করছে তা কি এক ধরনের ‘নানকারি’, মানে দাসত্ব? তার এক স্পষ্টবক্তা কলিগ মনে করে, তাদের চাকরি আসলে দাসত্বই। কিন্তু কোম্পানি ঠিক দাসত্ব চায় না তাদের কাছে, চায় তার রকমফের, আনুগত্য ও উদ্যম। আনুগত্য, কারণ বাজার প্রতিযোগী, তথা লোভের ডিপো। আর উদ্যম ছাড়া কী করে কোম্পানি বাজার বাড়াবে! বাজার-ব্যতিরেকে কোনো সদসৎ বা ভালোমন্দ বোধ নেই কোম্পানির। তার আনুগত্য ও উদ্যমের দাবি তার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের কাছে, যারা ভালো মাইনে পায় ও বাতানুকূল পরিবেশে কাজ করে। শরীফের প্রাপ্য প্রমোশন যে দেওয়া হলো তার এক অধস্তনকে, তার কারণ শরীফের উদ্যমহীনতা। আর শরীফের ওই স্পষ্টবক্তা কলিগকে যে বরখাস্তকরা হলো, এবং পরে সাজানো মামলায় জড়ানো হলো, তা আনুগত্যের অভাবে। এটাই করপোরেট জগতের দস্ত্তর। তক্তাচাপা এখানে নেই বটে, তবে মামলাচাপা আছে। দেখা যাক তুমি কতদূর লড়তে পার। আর যে অন্য কলিগের মেয়েটি তার বাবার আকস্মিক অসুস্থতায় কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে তেজ দেখিয়েছিল, সেই কলিগ মারা যাওয়ার পরে কিন্তু সেই তেজ সংবরণ করে নিল। নিল যে তার কারণ অঢেল কম্পেসেশন। চাবুক খাবার অবকাশই এখানে তৈরি হলো না: বরং যে-অবকাশ তৈরি হলো তা কোম্পানির বশংবদ হওয়ার।
কিন্তু তুমি যদি কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে কাজ করো, ধরা যাক গোড়া থেকেই কাজ করছো, এবং শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করো, এবং তার জন্য শ্রমিকদের ইউনিয়ন বানাও, তবে কোম্পানি তার পেটোয়াদের দিয়ে একটা পালটা ইউনিয়ন বানিয়ে নেবে; এবং দুই ইউনিয়নের হাঙ্গামায় পুলিশ ডাকতে পারে কোম্পানি, সেই সঙ্গে ছাঁটাইও করতে পারে তোমাকে – ইত্যাদি ইত্যাদি যত চেনা গল্প। হাঙ্গামায়, পুলিশের গুলিতেই এক শ্রমিকের মৃত্যুও হতে পারে এবং আহতদের একজনও পরে মারা যেতে পারে। তোমাদের আন্দোলন এতে জোরদার হবে, ধর্মঘট জারি থাকবে, কিন্তু কোম্পানি কিছুতেই তোমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না – তার কাছে বৈধ ইউনিয়ন ওই অন্যটা – যাক কিছুদিন ফ্যাক্টরি বন্ধ, সামান্য ক্ষতি স্বীকার করেও কোম্পানি চাইবে নিরঙ্কুশ বশ্যতা। করো না তোমরা মিছিল শহরের এ-রাস্তায় ও-রাস্তায় – কোম্পানি অনমনীয় থাকবে। তারপর যেদিন তোমরা কোম্পানি ঘেরাও করবে, সেদিন সব দরজায় তালা দিয়ে দেবে কোম্পানি – কেউ ঢুকতে পারবে না, কেউ বেরোতেও পারবে না। আর তুমি, কালাম, ধর্মঘটী শ্রমিকদের সাহস জোগানোর জন্য যতই তুমি ‘জানকার’ আমলের নইমউলস্নার মতো বক্তৃতা করে যাও না কেন, বিকেল হওয়ার আগেই কটাকট গুলির শব্দ শোনা যাবে – ধৈর্যেরও সীমা আছে অপেক্ষমাণ পুলিশের। শরীফউদ্দিন নানকার কাচের দেয়ালে দু-চারটে ঘুষি লাগিয়ে একসময় অজামেত্মই উবু হয়ে বসে পড়বে। ‘যন্ত্রণায় মুঠো পাকানো হাতটা শরীফ নাড়াতে পারছে না। তাকে ঘিরে আছে একটু আগে আগপাশে ভিড় করা অফিসের লোকজন।… উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই কয়েকজন চেপে ধরে বসিয়ে দিল। তার এ-অবস্থায়ও খেয়াল না করে পারল না উদোম কানের পর্দায় সুড়ঙ্গ কেটে মগজের খাঁজে-ভাঁজে যা ছড়িয়ে পড়ছে, তা মাতমই। আধো, আধো বোলে অধরা আর বেসুরোও’ (পৃ ২৫৬)। এ না হলে তলকুঠুরির গান! এ না হলে ‘নানকারি জিন্দেগি’!
ওয়াসি আহমেদ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন কেবল সংলাপে, বিশেষ করে আখ্যানের সিলেট পর্বে। সিলেটি বুলি একেবারে না বুঝতে পারলেও প্রসঙ্গ থেকে অনুমান করা যায়। অন্যত্র কথাবার্তা মোটামুটি মান-ভাষাতেই। আর কথন তো আগাগোড়া তাতেই। তবে এই মান্যতা 888sport appsে প্রচলিত বাংলা ভাষার মান্যতা। শব্দগত (যেমন ‘পানি’, ‘গোসল’) ও প্রচলগত (যেমন ‘ফোন দেওয়া’) একটু-আধটু তফাত সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে এর অনুধাবনে কোনো অসুবিধা হয় না। আর এমন যদি হয়ও যে, ওয়াসি আহমেদের এই 888sport alternative linkের উদ্দিষ্ট পাঠকম-লী মুখ্যত 888sport appsি, তবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গীয়ের তা আস্বাদনে বাধা কিসের? না হয় অন্য মান্যতায় অভ্যস্তহতে একটু অতিরিক্ত পরিশ্রমই করতে হলো!
888sport alternative link আমি সহজে পড়তে পারি না, ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। ছোটগল্পে বেশি আরাম পাই। আর 888sport app download apkতে তো বটেই। কিন্তু তলকুঠুরির গান আমাকে মজিয়ে রেখেছিল। এতটাই যে, তা দুবার পড়েছি। এর অনুপুঙ্খ নিয়ে কোনো মৌখিক পরীক্ষায় হয়তো আমি পাশ করেও যাব। তার বাহাদুরি ওয়াসি আহমেদের। তাঁকে আমার নমস্কার।
