বিশ্বজিৎ ঘোষ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিবেশে বাংলা 888sport live footballে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) উজ্জ্বল আবির্ভাব। বস্ত্তত, তাঁর চেতনার শিকড় প্রোথিত ছিল নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণির মানস-মৃত্তিকায়। রাজনীতিসচেতনতা ও জনমূলসংলগ্নতা নজরুলের কবিচৈতন্যে এনে দিলো নতুন মাত্রা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং নব-জাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-সম্ভাবনা নজরুলের কবিমানসকে করে তুলেছিল আলোকোদ্ভাসিত। তাই রোমান্টিক অনুভববেদ্যতায় তিনি বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক সমাজের পরিবর্তে কল্পনা করেছেন শোষণমুক্ত সুষম সমাজের; অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের সূর্যসম্ভব বাণী।
পরম আশাবাদী নজরুল স্বদেশের মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন; ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। উপনিবেশকে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে; ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারংবার। এর পশ্চাতে ছিল কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পূজারি নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষের মুক্তি। বস্ত্তত, সাম্যবাদী চিমত্মা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে – হিন্দু ও মুসলিম বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার দুই পরিপূরক শক্তি। তাই আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতিকামী সাম্যবাদী নজরুল বলেন :
কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা
ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।
(‘বিংশ শতাব্দী’, প্রলয় শিখা)
প্রসঙ্গত 888sport app download for android করা যায়, সর্বহারা কাব্যের ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ 888sport app download apkয় নজরুলের বহুল-উচ্চারিত এই পঙ্ক্তি চতুষ্টয় :
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সমত্মরণ,
কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।
… … …
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কা-ারী! বল ডুবিছে মানুষ, সমত্মান মোর মার।
(‘কা-ারী হুঁশিয়ার’, সর্বহারা)
– উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিদ্বয়ে ব্যক্ত হয়েছে যে-মানবধর্মের কথা, তা-ই আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতির মৌল ভিত্তি। সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির বাসনা নজরুলের জীবনদর্শন ও কর্মসাধনার মর্মকোষে সর্বদা ছিল ক্রিয়াশীল। তাঁর আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতিভাবনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনালোকে নিত্য বহমান ছিল মানবতা, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য-পরম্পরা ও সামূহিক সাম্যচিমত্মা।
দুই
আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভারতবর্ষীয় সমাজ ও সভ্যতার কেন্দ্রীয় ভিত্তি। এই ভূখণ্ড একত্র হয়েছে বহু ধর্ম, এখানে পাশাপাশি বাস করেন নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ। একের মধ্যে বহুর অসিত্মত্ব ভারতবর্ষীয় সমাজের মতো পৃথিবীর আর কোন অঞ্চলে আছে? হিন্দুধর্মের মৌল ভিত্তিতে ক্রিয়াশীল আছে সম্প্রীতির বাণী; কবির-নানক-বুদ্ধের দর্শনেও আছে মানবমৈত্রীর কথা। পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মও মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীর কথা বলেছে। ইসলাম ধর্মের ‘লা কুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দিন’, হিন্দু ধর্মের ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ, সর্বে ভদ্রানি পশ্যমিত্ম, মা ক্বচিৎ দুঃখভাগভবেত’ বৌদ্ধ ধর্মের ‘সবেব সত্তা সুখিতা ভবন্তু’র মৌল বাণী যে অভিন্ন তা সহজেই অনুধাবনীয়। খ্রিষ্টধর্মেও আছে প্রায় অভিন্ন কথা – ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’। এ-কথাও তো মানবপ্রীতিরই স্মারক। সন্দেহ নেই, উপর্যুক্ত ধর্মীয় বাণীসমূহই বাঙালি সংস্কৃতির সম্প্রীতিচেতনার অমত্মহীন শক্তি-উৎস হিসেবে আদিকাল থেকে ক্রিয়াশীল। কাজী নজরুল ইসলামের মানস-গঠনে এই সম্প্রীতিবোধ পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সম্প্রীতিবোধের এই ধারণা বাঙালি সমাজে যত গভীরভাবেই ক্রিয়াশীল থাকুক না কেন, যুগে-যুগে এই ধারণা পৌনঃপুনিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, এ-কথাও মিথ্যা নয়। ধর্মের উদার বাণীসমূহ 888sport appsসহ পৃথিবীর সর্বত্রই বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। পরমতসহিষ্ণুতা সকল ধর্মের আহবান হলেও একদল মানুষ সবসময়ই এর বিপক্ষে আছেন। যারা প্রচলিত ধর্ম পালন করেন, তারাও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন – এমন কথা বলা যাবে না। যারা প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করে না বলে আত্মম্ভরী ঘোষণা দেন, তারাও এক্ষেত্রে শামিত্ম ও মৈত্রীর কোনো বাতাবরণ নির্মাণ করতে সমর্থ হননি। ফলে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সর্বদা লেগেই ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এই সুযোগটা গভীরভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগিয়ে সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব ও বিরোধটাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজের এই অপপ্রবণতা দেখেই নজরুল দ্রোহীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। যে-শক্তি আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আঘাত করতে চায়, নজরুলের সারা জীবনের যুদ্ধ ছিল সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে।
অসাম্প্রদায়িকতা ধর্মহীনতা নয়, বরং তা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে 888sport apk download apk latest version করার এক পরম অভিজ্ঞান। যেহেতু বাঙালি সমাজে বিরাজমান আছে একাধিক ধর্ম, তাই এখানে পরমতসহিষ্ণুতার ধারণাটি শতাব্দী-পরম্পরায় গুরুত্ব পেয়ে আসছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রচলিত ধর্মের চেয়ে আরেক ধর্ম বড় হয়ে ওঠে – যার নাম মানবধর্ম বা মনুষ্যত্ববোধ। এই দার্শনিক ডিসকোর্স সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাটা 888sport app download for android করা যায় : ‘জলের জলত্বই হচ্ছে ধর্ম, আগুনত্বই হচ্ছে আগুনের ধর্ম। তেমনি মানুষের ধর্মটিই হচ্ছে তার অমত্মরতম সত্য’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৩৫৪ : ২৭)। রবীন্দ্রনাথের এই অমত্মরতম সত্য যে মনুষ্যত্ববোধ তথা মানবধর্ম, তা লেখার অপেক্ষা রাখে না। কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনারও মূল কথা এই মানবধর্মের বন্দনা। সকল ধর্মের প্রতিই ছিল তাঁর গভীর 888sport apk download apk latest versionবোধ – পৃথিবীর সব ধর্মবেত্তাকেই তিনি মানবের পরম সম্পদ জ্ঞানে মান্য করেছেন – ধর্মগ্রন্থ বা উপাসনালয়ের চেয়ে তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে মানুষ – দ্বিধাহীনচিত্তে উচ্চারণ করেছেন মানববন্দনার অসামান্য এই পঙ্ক্তিমালা :
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভ–র দল! – মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; – গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর, – বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে বাজে!
… … …
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!
(‘মানুষ’, সাম্যবাদী)
তিন
সূচনা-সূত্রেই ব্যক্ত হয়েছে যে, সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতিবোধে নজরুলের মানসলোক ছিল আলোকোদ্ভাসিত। এক্ষেত্রে তাঁর ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার-চেতনা যেমন কাজ করেছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তাঁর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা। নজরুল-প্রতিভার উলেস্নখযোগ্য স্বাতন্ত্র্য এই যে, ভারতীয় মিথ-পুরাণ এবং পশ্চিম এশীয় ঐতিহ্য ব্যবহারে তিনি অর্জন করেছেন সমান সাফল্য। নান্দনিক ঐকামিত্মকতায় এবং জৈবসমগ্র ঐক্যসূত্রে দুই ভিন্ন উৎসের 888sport live chat-উপাদান নজরুল-888sport app download apkয় সৃষ্টি করেছে অভিজ্ঞানের একক সুর। এ-সূত্রে এখানে উলেস্নখ করা প্রয়োজন নজরুলের ঐতিহ্যিক-উত্তরাধিকার প্রসঙ্গটি। উত্তরাধিকারের ব্যাপকতায় নজরুল ইসলাম ছিলেন ঋদ্ধিশালী (মোতাহের, ১৯৭২ : ৩৪)। নজরুল জন্মসূত্রে ভারতীয়, তাই ভারতীয় উত্তরাধিকারকে তিনি আপন উত্তরাধিকার বলেই জেনেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে ধর্মসূত্রে তিনি ছিলেন পশ্চিম এশীয় তথা ইসলামের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। তিনি সচেতনভাবে উভয় ঐতিহ্যকে লালন করেছেন আপন 888sport live chatীসত্তায়। তাই একই 888sport app download apkয় ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সার্থকভাবে তিনি মেলাতে পেরেছেন পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য। যে-হাতে তিনি লিখেছেন শ্যামাসংগীত, সেই হাত দিয়েই লিখতে পেরেছেন গজল আর ইসলামি গান। আপন ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা নজরুলকে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐকামিত্মক হতে বিসত্মার করেছে অনেকামত্ম সহযোগ (বিশ্বজিৎ, ২০০৮ : ৪৯)।
নজরুলের আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতাও সম্প্রীতিচেতনা নির্মাণে পালন করেছে দূরসঞ্চারী ভূমিকা। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ন’বছর বয়স থেকেই নজরুলকে উপার্জনের পথ বেছে নিতে হয়। শৈশবেই তাঁকে মোলস্নাগিরি, মাজারের খাদেম, মসজিদের ইমামতি – এসব কাজে নিয়োজিত হতে হয়। ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি জানতে এসব পেশা নজরুলকে ব্যাপক সহায়তা দান করে। ধর্মীয় ও পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে অল্প বয়সেই নজরুল জেনেছিলেন ইসলামি রীতিনীতি ও আদর্শ। ইসলামি রীতিনীতি আত্মস্থ করলেও নজরুল কেবল ইসলাম ধর্মের মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। শৈশবেই তিনি পেয়েছিলেন মানবধর্মের সারসত্তা। তাই বিশেষ কোনো ধর্ম নয়, বরং সকল ধর্মের প্রতিই তাঁর চিত্তে নির্মিত হলো ভক্তি ও ভালোবাসার অফুরান এক ফল্গুধারা। প্রসঙ্গত 888sport app download for android করা যায় সুশীলকুমার গুপ্তের এই মমত্মব্য :
যেখানে কীর্তন হত, কথকতা হত, যাত্রাগান হত, মৌলবীর কোরান পাঠ ও ব্যাখ্যা হত, দুরমত্ম বালক গভীর আগ্রহ ও মনোযোগের সঙ্গে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। বাউল, সুফী, দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে তিনি অমত্মরঙ্গভাবে মিশতেন। (সুশীলকুমার, ১৩৮৪ : ৩৫)
জীবিকা নির্বাহের জন্য নজরুলকে লেটোর দলে গান রচয়িতার কাজ নিতে হয়েছিল। নিজস্ব ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে এবার তাঁকে জানতে হলো রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত পুরাণের নানা গল্প ও অনুষঙ্গ। এর ফলে তাঁর মানসলোকের চেতনা হয়েছে আরো দৃঢ়মূল। ভারতীয় পুরাণ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে তাঁর চিত্তলোক নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হলো এবং আপন ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে তিনি নির্মাণ করতে সমর্থ হলেন তৃতীয় এক মাত্রা। উত্তরকালে নজরুলের 888sport app download apk এবং গানে ভারতীয় মিথ-পুরাণের যে অনেকামত্ম ব্যবহার, তার বীজ উপ্ত হয়েছিল লেটোর দলে গান বাঁধতে গিয়ে তাঁর আলোকোদ্ভাসিত মানস-মৃত্তিকায়।
বৈবাহিক-সূত্রে হিন্দুধর্মের নানাকিছু নজরুলের পক্ষে জানা সহজ হয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। প্রমীলার সঙ্গে বিয়ের অনুষঙ্গটি একবার 888sport app download for android করলে মানবধর্মের পূজারি নজরুলকে বোঝা অনেক সহজ হয়ে যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কুমারী কন্যাকে বিবাহের মুহূর্তে নজরুল নানামাত্রিক বাধার মুখে পড়েন, কেউ-কেউ প্রমীলাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু মুক্তচিত্তদ্রোহী এবং মানবপূজারি নজরুল সংকীর্ণ ধর্মবোধ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে মানবধর্মকে বড় করে দেখেছেন, উচ্চারণ করেছেন এই ভাষ্য :
…আমরা বললাম : ‘কনেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে বলা হোক।’ কবি এতে রাজি হলেন না। বললেন : ‘কারুর কোনো ধর্মমত সম্বন্ধে আমার কোনো জোর নাই। ইচ্ছে করে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে, পরেও করতে পারবেন।’ (মঈনুদ্দীন, ১৯৭৮ : ৪৯)
কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর বড় নয়, বড় হয়ে উঠেছিল মনুষ্যত্ববোধ। ভাগ্যের ছন্দহীন পথে তাঁকে কিছুদিনের জন্য থাকতে হয়েছিল ময়মনসিংহের দরিরামপুর ও কাজীর সিমলায়। অল্পসময় থাকলেও ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকায়ত জীবনে বহমান অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ ও সম্প্রীতি দেখে নজরুল ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এ-অঞ্চলে প্রচলিত গীতিকা, জারি, যাত্রা, কবিগান, পালাগান ও পুঁথিপাঠের আসরে তিনি ছিলেন কৌতূহলী শ্রোতা। রাত জেগে-জেগে তিনি নানা ধরনের পরিবেশনা দেখেছেন এবং এভাবে নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে তিনি পেয়েছেন অফুরান শক্তি। প্রসঙ্গত উলেস্নখ করা যায় সমালোচকের এই ভাষ্য :
…এ অঞ্চলে [ময়মনসিংহ] বেশ যাত্রা, কবি ও খেমটা গান হ’ত – আনাতেন অবস্থাপন্ন স্থানীয় হিন্দু জমিদারগণই। তখন পৌষসংক্রামিত্ম, দোল, দুর্গাপূজা ও 888sport app উৎসবে পূর্বধলা ও বৈলর জমিদার বাড়িতেও খেমটা, কবি, যাত্রা ইত্যাদি গানও হত – চলতো ৭/ ৮ দিন। … এছাড়া স্থানীয় বা বাইরের জারি, ঘাটু এবং পুঁথির গান তো ছিলই। – জায়গীর বাড়িতে বালিশ কাঁথার নিচে শুইয়ে রেখে ছনের সেই ঘরের খোলা জানালা দিয়ে বের হয়ে যেত – আসতো শেষ রাতে ঘুম ঢুলুঢুলু।… নজরুল পরদিন শুকনির বিলের ধারে এসব গান আমাদের গেয়ে শোনাতো – অবিকল, বিশেষ করে যাত্রার বিবেকের গান। (মাহ্ফুজউলস্নাহ, ১৯৩৭ : ৪৯)
জীবিকার তাগিদে নজরুল যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এবং সে-সূত্রে তাঁর স্বল্পকালীন করাচি-বাস। করাচি-পর্ব নজরুলের মানসলোকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে পালন করে দূরসঞ্চারী ভূমিকা। এ-সময় তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হলেন ওমর খৈয়াম, রুমি, হাফিজ প্রমুখ কবির 888sport app download apk ও জীবনাদর্শের সঙ্গে। পারস্যের এই কবিদের রচনায় প্রচলিত ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে উঠেছে। পরমত বা অন্য ধর্মকে সম্মান জানানো, সংস্কারমুক্তি ও প্রচল প্রথার বাইরে গিয়ে জীবনযাপন ও মানবমুক্তির বাণী নজরুল পেয়েছিলেন এইসব কবির কাছ থেকে। করাচিফেরত নজরুল কলকাতাবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের সাহচর্য পেলেন – তাঁর জীবনাচরণ ও ভাবনায় আবার ঘটল পালাবদল। সাম্যবাদী নেতৃত্বের স্পর্শে মানবসম্প্রীতি ও সাম্যচিমত্মায় নজরুল পেলেন ভিন্ন দর্শন – কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমদ, বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ সমাজবাদী ও মানবতন্ত্রী নেতৃত্ব প্রচলিত ধর্ম ও সংস্কারের চেয়ে যে মানুষ অনেক বড় – এই বোধে উজ্জীবিত করেছেন তাঁকে। কবিচিত্তের সহজাত মানবতাবোধ ও আত্মজৈবনিক এইসব অভিজ্ঞতা নজরুলের মানসলোকে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে নানামাত্রিক প্রণোদনা সঞ্চার করেছে। ফলে বাঙালি সমাজে তিনি আবির্ভূত হতে পেরেছেন একজন প্রকৃত মানবতাবাদী লেখক হিসেবে, একজন প্রকৃত দ্রোহী সাম্যবাদী কবি হিসেবে।
চার
ব্যক্ত হয়েছে যে, ব্যক্তির সহজাত মানস-প্রবণতা এবং আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা নজরুলের আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মৌল-ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই প্রেরণাতেই তিনি 888sport live football রচনা করেছেন, লিখেছেন একের পর এক গান। কিন্তু নজরুলের এই সম্প্রীতিবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রথম থেকেই কায়েমি স্বার্থবাদী মহল সহ্য করতে পারেনি। উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষী চক্র তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে, তাঁর 888sport live footballে পেয়েছে সংকীর্ণতার গন্ধ। মুসলিমরা ক্ষেপেছেন নজরুলের 888sport app download apkয় ভারতীয় দেব-দেবীর নাম দেখে, আর হিন্দুর রক্ত মাথায় উঠেছে, যখন দেখেছেন নজরুলের 888sport app download apkয় পশ্চিম এশিয়ার ঐতিহ্য জায়গা পেয়েছে, আর যখন তিনি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন, তখন। বস্ত্তত, বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই তিনি 888sport app download apkয়-গানে একই সঙ্গে আলস্নাহ্-ভগবান, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, মুহম্মদ (সা.)-কৃষ্ণ-খালেদ-অর্জুন, কোরান-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে হজরত মুহম্মদ (সা.) বিদ্রোহী সাম্যবাদী, কৃষ্ণ কংসরূপী অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ত্রাস, খালেদ নিপীড়িত মানুষের সেনাপতি, খলিফা ওমর সাম্য, সুবিচার ও মানবতার প্রতীক, আর নটরাজ শিব ধ্বংস-সৃষ্টির যুগল 888sport app download for android। এ-প্রসঙ্গে তাঁর দ্বিধাহীন উচ্চারণ :
এঁরা কি মনে করেন হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাঙলা 888sport live football সৃষ্টি কোন কালেই সম্ভব হবে না জৈগুন বিবির পুঁথি ছাড়া।… বাঙলা 888sport live football হিন্দু-মুসলমান উভয়ের 888sport live football। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুর তেমনি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাঁদের লিখিত 888sport live footballে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী; তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই।
(সওগাত, ১৩৩৪ : ৫৮০)
নজরুল জানতেন এবং বুঝতেন শোষকশ্রেণিই সচেতনভাবে মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে। শোষকের ভিত যাতে সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর আঘাতে ভেঙে না যায় তাই তারা সর্বদাই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখে – ধর্মকে শোষণের মৌল শক্তিতে পরিণত করে। এই শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে, এই ভ- ধার্মিকদের বিরুদ্ধে, এই নব্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিল নজরুলের আমৃত্যু সংগ্রাম। তাই মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিকের মতো তিনি ঘোষণা করেন এই অসামান্য উচ্চারণ : ‘হিন্দু-মুসলমানের দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব – অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-সত্মূপের মতো জমা হয়ে আছে – এই অসাম্য, এই ভেদ-জ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।’ (নজরুল ইসলাম, ১৯৬৯ : ৩০০)
নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, বিদ্রোহ করেছেন ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। এ-কালে যেমন, তেমনি সে-কালেও, ধর্মকে শোষণের উলেস্নখযোগ্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভ- মোলস্না-মৌলবি আর পুরোহিতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন সোচ্চার। রুদ্র-মঙ্গল গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : ‘হিন্দুত্ব-মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়তো প–ত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, এটা মোলস্নাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি। আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে, সেটাও এই প–ত-মোলস্নায় মারামারি; হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।… অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি, – আলোর মতো, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তেরা বললে, কৃষ্ণ হিন্দুর; মুসলমানের ভক্তেরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানের; খ্রিষ্টের শিষ্যেরা বললে, খ্রিষ্ট ক্রিশ্চানদের। কৃষ্ণ-মুহম্মদ-খ্রিষ্ট হয়ে উঠলেন জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তিত্ব নিয়েই যত বিপত্তি। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করে না মানুষে, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’ (নজরুল ইসলাম, ১৯৬৬ : ৭০৭)
বস্ত্তত, মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল, স্বদেশের স্বাধীনতা। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, বিদ্রোহের জন্য মানুষের প্রতিই ছিল তাঁর উদাত্ত আহবান। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ :
গাহি সাম্যের গান –
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি? পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে’ যাও, বল আরো।
… … …
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
(‘সাম্যবাদী’, সাম্যবাদী)
নজরুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, ‘মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’; তাই মানুষকেই তিনি নিবেদন করেছেন তাঁর সকল 888sport apk download apk latest version, সকল ভক্তি ও ভালোবাসা। মানুষকেই তিনি সর্বদেশ সর্বযুগ সর্বকালের পরম জ্ঞাতি হিসেবে মেনেছেন এবং জেনেছেন, লিখেছেন এই অসামান্য পঙ্ক্তিমালা :
গাহি সাম্যের গান –
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্।
নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
(‘মানুষ’, সাম্যবাদী)
১৯১৮ সাল থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কবি নজরুলকে তীব্রভাবে ব্যথিত করে। দাঙ্গার অমানবিকতা থেকে স্বদেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য তিনি লেখনী ধারণ করেন। ১৯২৬ সালের জাতীয় কংগ্রেসের বঙ্গীয় শাখার প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে তিনি দাঙ্গার পটভূমিতে লিখলেন বিখ্যাত ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ 888sport app download apk। ইতিহাসের নানা বাঁকেই হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি কামনায় নজরুলের সৃষ্টি-ক্ষমপ্রজ্ঞা বারবার জ্বলে উঠেছে, মানুষকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ।
মানুষের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল বলেই চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখেও নজরুল ইসলাম অবলীলায় শ্যামাসংগীত আর বৃন্দাবন-গীত রচনা করেছেন, লিখেছেন গজল, ব্যাখ্যা করেছেন তৌহিদের একেশ্বরতত্ত্ব। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। তাই যখন খ–তভাবে ইসলামের সেবক হিসেবে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাঁর 888sport live chatীসত্তাকেই অপমান করা হয়। তাঁকে গ্রহণ করতে হবে সমগ্র দৃষ্টি দিয়ে। মনে রাখতে হবে, তিনি যেমন হামদ্-নাত-গজল লিখেছেন; তেমনি লিখেছেন কীর্তন আর শ্যামাসংগীত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালীকীর্তন ও না’ত রচনায় তিনি প্রায় সমার্থক চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন (মনিরুজ্জামান, ১৯৭২ : ৬১)। যেমন তাঁর একটি বিখ্যাত কালীকীর্তনে আছে :
আমার কালো মেয়ের পায়ের নীচে
দেখে যা আলোর নাচন
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন \
আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
মায়ের একটুখানি রূপের ঝলক
ঐ স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগন \
(‘বনগীতি’)
– চাঁদ-সূর্যের এই চিত্রকল্প নজরুলের একটি অতি পরিচিত না’তে একই ব্যঞ্জনায় নির্মিত হয়েছে :
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে \
(‘জুলফিকার’)
নজরুলের গানে পৌনঃপুনিকভাবে উচ্চারিত হয়েছে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতির বাণী। নজরুলের সমকালে, কিংবা উত্তরকালেও আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা তাঁর মতো স্পষ্ট করে এবং দ্বিধাহীনচিত্তে আর কেউ উচ্চারণ করেননি। তিনি প্রত্যাশা করেছেন মানবমৈত্রী, স্বপ্ন দেখেছেন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন মানুষের একক অভিন্ন সত্তা। সুর-সাকী গ্রন্থের ১৮ সংখ্যক গানে তিনি লিখেছেন অসামান্য এই বাণী :
মোরা এক বৃমেত্ম দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ\
… … …
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই,
মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান\
(‘১৮ সংখ্যক গান’/ সুর-সাকী)
হিন্দু ও মুসলমানের মিলন-আকাঙক্ষায় নজরুল ছিলেন সবসময় পরম-আশাবাদী। উভয় ধর্মসম্প্রদায় নজরুলের চেতনায় ধরা দিয়েছে জৈব-ঐক্য একাগ্রতায়, পরম অভিন্ন সত্তায়। নিচের চিত্রকল্পে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রাতি-কামনায় নজরুলের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়টি চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে :
হিন্দু-মুসলমান দুটি ভাই,
ভারতের দুই আঁখি-তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম-চারা।
(‘৮০ সংখ্যক গান’/ সুর-সাকী)
888sport app download apk এবং সংগীতের মতো নজরুলের গদ্য-রচনাতেও ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় ধর্মীয় সম্প্রীতির বাণী, পাওয়া যায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা। একটি অভিভাষণে নজরুল সরাসরি বলেছেন : ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি’ (নজরুল ইসলাম, ১৯৬৯ : ৪০৭)। নজরুল মনে করেন, হিন্দু-মুসলমান পরস্পর একত্র হতে পারেনি বলেই ভারতবর্ষের এত দুর্গতি। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধটাকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষকে শাসন ও শোষণ করে চলেছে। আর তাদের ‘divide and rule’ নীতিও অবলীলায় মেনে নিয়েছে হিন্দু কিংবা মুসলমান নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যমত্ম। তাই হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পরিক মিলনের জন্য নজরুল লিখেছেন অসামান্য এই বাক্যস্রোত :
ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি – শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে – তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অ888sport apk download apk latest version। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অ888sport apk download apk latest version করে।
(নজরুল ইসলাম, ১৯৬৯ : ৪৩১)
মানবাত্মার মুক্তিসাধনাই নজরুলের 888sport live footballকর্মের প্রধান অন্বিষ্ট। মানুষের অবচেতন সত্তায় তিনি জ্বেলে দিতে চেয়েছেন মানবিকতার আলো। ধর্মীয় কুসংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন মানবিকতার শক্তি দিয়ে – তাঁর কাছে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষের জন্যই ছিল ধর্ম। এই প্রাতিস্বিক মানববন্দনার পশ্চাতে নজরুলের সৃষ্টিশীল ঐতিহ্যচেতনা ছিল সদা-সক্রিয়। উত্তরাধিকারের ব্যাপকতা সম্পর্কে সচেতন নজরুল পশ্চিম-এশীয় ইতিহাস এবং ভারতীয় ঐতিহ্যে শক্তির উৎস সন্ধান করেছেন বিদ্রোহকে বাসত্মব রূপ দেওয়ার প্রত্যাশায়। তাঁর এই শক্তি-সঞ্চয় মূলত ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য, অসত্য-অমঙ্গল-অকল্যাণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য, স্বৈরাচারী শাসককে আঘাত করার জন্য এবং ঔপনিবেশিক শক্তির ভিতকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই নটরাজ শিব আর অসুরনাশিনী দুর্গার শক্তি, কিংবা মহররমের আত্মত্যাগ আর মরুভাস্কর মুহাম্মদের (সা.) বিদ্রোহ তাঁর কবিআত্মাকে উদ্দীপ্ত করে মানুষের মুক্তি কামনায়। সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে জন্ম-বিদ্রোহী নজরুল সংগ্রাম করেছেন একক শক্তিতে – আমৃত্যু কামনা করেছেন আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি – কল্পনা করেছেন সুষম সমাজ ও মানুষের মুক্তি।
তথ্যপঞ্জি
কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল রচনাবলী, সম্পাদক : আবদুল কাদির, ১-৪ খণ্ড, 888sport app : বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪।
কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল রচনাসম্ভার, সম্পাদক : আবদুল কাদির, 888sport app : বাংলা একাডেমি, ১৯৬৯।
খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, যুগস্রষ্টা নজরুল, বাংলা একাডেমি, 888sport app, ১৯৭৮।
বিশ্বজিৎ ঘোষ, নজরুলমানস ও 888sport app প্রসঙ্গ, নিউ-এজ পাবলিকেশন্স, 888sport app, ২০০৮।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী, ‘নজরুল ইসলাম ও রিনেসাঁস’, নজরুল সমীক্ষণ, সম্পাদনা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, 888sport app, ১৯৭২।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ‘নজরুল ইসলাম ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’, নজরুল সমীক্ষণ, পূর্বোক্ত।
মোহাম্মদ মাহফুজউলস্নাহ (সম্পাদক), কাজীর সিমলা ও দরিরামপুরে নজরুল, নজরুল ইনস্টিটিউট, ১৩৯৭।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্ম-পরিচয়, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৩৫৪।
সওগাত, 888sport app : পৌষ ১৩৩৪।
সুশীলকুমার গুপ্ত, নজরুল চরিতমানস, দে’জ পাবলিকেশন্স, কলকাতা, ১৯৭৭।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.