স্বকৃত নোমান
চৌত্রিশ বছর পর ক্যাপ্টেন সৈয়দ ওয়াসেত আলি করাচি জুমা মসজিদের অজুখানায় অজু শেষে সাদা লম্বা দাড়িতে হাত বুলিয়ে পানি ঝরাতে ঝরাতে তারই মতো সাদা লম্বা দাড়িওয়ালা, গায়ের রং বাঙালিদের মতো কালো, বেঁটেখাটো, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি ও পরনে সাদা লুঙ্গি পরা, দেখতে অনেকটা ডিসি আবদুল আহাদের মতো, বুড়ো লোকটাকে দেখে চমকে ওঠে।
চেহারার মিল থাকতে পারে। থাকেও। লাহোরে তার যমজ ফুফাতো ভাইরা প্রায় কাছাকাছি চেহারার। সারা জীবনেও তাদের চেহারা সে আলাদা করতে পারেনি, প্রায়ই গুলিয়ে ফেলে। আসলামকে মনে করে আমজাদ, আর আমজাদকে আসলাম। এই করাচি শহরেও কাছাকাছি চেহারার মানুষ সে দেখেছে, কিন্তু বিস্মিত হয়নি। এসব ছোটখাটো ব্যাপার তাকে বিস্মিত করে না। অথচ ডিসি আবদুল আহাদের মতো
লোকটাকে দেখে তার বিস্ময় কাটে না। নামাজে দাঁড়িয়েও চোখের সামনে থেকে সরাতে পারে না তার মুখ। একই মুখ, একই চোখ, একই দাড়ি। কালো থেকে দাড়িগুলো সাদা হয়েছে – তফাৎ শুধু এটুকুই। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও চৌত্রিশ বছর আগের চেহারা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
সেজদায় যেতে ভুল করে ফের রুকুতে গিয়ে সানা পড়তে পড়তে ক্যাপ্টেন ওয়াসেত আনমনে মুণ্ডুটা ডানে-বাঁয়ে দোলায় – না, হতেই পারে না। অবিশ্বাস্য! ডিসি আবদুল আহাদের এতদিন তো বেঁচে থাকার কথা নয়। চৌত্রিশ বছর তো কম সময় নয়। চৌত্রিশ বছর আগে তার বয়স ছিল প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। সে হিসেবে এখন তো পঁচাত্তর ছাড়িয়েছে। ভেতো-বাঙালি কি এতকাল বেঁচে থাকে?
হতে পারে আবদুল আহাদ বেঁচে আছেন, বয়স তার চুয়াত্তর বা পঁচাত্তর ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে কেন তিনি 888sport apps থেকে এতদূরের পথ পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানের করাচি শহরে আসবেন? তবে কি যুদ্ধ শেষে তার মতো তিনি পাকিস্তান চলে এসেছিলেন? তা কেন আসবেন? 888sport appsে তার চৌদ্দপুরুষের বসতি, তিনি বড় সরকারি চাকরিজীবী, সমুদ্রবর্তী জেলাশহর পটুয়াখালীর জাঁদরেল ডিসি, যুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে কাজ করেছেন, জীবন বাজি রেখে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করেছেন, শেষ বয়সে হয়তো সচিব-টচিব হয়ে রিটায়ার্ড করেছেন, তার তো টাকা-পয়সার অভাব থাকার কথা নয়, দেশ ছেড়ে কেন তিনি বিদেশে আসবেন! তাও এই পাকিস্তানে!
পাকিস্তানি আর্মির অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন ওয়াসেত তার ঊনসত্তর বছর বয়সে এসে চেনাজানা বহু মানুষের নাম ভুলে গেছে। করাচি শহরে তার পুরনো বন্ধুদের সব নামও এখন ঠিকমতো মনে রাখতে পারে না। হঠাৎ মনে পড়ে, আবার ভুলে যায়। বহু চেষ্টা করেও ভুলে যাওয়া নামটি আর মনে করতে পারে না। অথচ কোথায় 888sport appsের কোন জেলার ডিসি আবদুল আহাদের নাম সারা জীবনে একবারের জন্যও ভোলেনি!
না ভোলার কারণ আছে। চৌত্রিশ বছর আগে, নভেম্বরের সেই হিমঝরা রাতে, ক্যাপ্টেন ওয়াসেত মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী কমান্ডারের মরচেধরা ছুরির আঘাতে খুন হতে পারত। অথবা চৌত্রিশ বছর আগে এপ্রিলের প্রচণ্ড তপ্ত দুপুরে ডিসি আবদুল আহাদও পাকিস্তানি আর্মির সেই বদমেজাজি ল্যান্স-নায়েকের রাইফেলের গুলিতে খুন হতে পারতেন। অথচ দুজনই বেঁচে গেল।
যেদিন পাকিস্তানি আর্মিরা পটুয়াখালীর আকাশে হেলিকপ্টারে চড়ে গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে এপ্রিলের গরম বাতাসকে আরো গরম করে তুলছিল, ডিসি আহাদ তখন শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে এক গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে গোপন মিটিং করছিলেন। দুপুরে তিনি অফিসে ফিরে এলে এক পাঞ্জাবি ল্যান্স-নায়েকের নেতৃত্বে সশস্ত্র একদল পাকসেনা তার অফিসকক্ষে ঢোকে। মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার অভিযোগে ল্যান্স-নায়েক তাকে কঠোর ভাষায় শাসাতে থাকে। আবদুল আহাদ বারবারই অস্বীকার করেন – না, আমি কোনো মুক্তিবাহিনীকে কোনো অস্ত্র দিইনি। আমার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই, আপনারা ভুল শুনেছেন। প্রমাণ ছাড়া মিথ্যে অভিযোগ তুলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই।
তার কথাগুলো ছিল প্রশাসকসুলভ ঝাঁঝাল, সিএসপি অফিসারদের ভাষা যেমন হয়। তাদের ভাষা কঠিন হতে হয়, নইলে তো কেউ কথা শুনবে না। তা ছাড়া স্বভাবগতভাবেই তার গলাটা ছিল ঝাঁঝাল, কথা বলতেন ধমকের সুরে। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার আগে দোয়া-দরুদ পড়ে একবার বুকে ফুঁ দিয়ে নিত। সরকারি নিয়ম-কানুনের কোনো হেরফের হলে তার ধমকে গোটা অফিস থরথর করে কাঁপত।
সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তিনি হয়তো নরম সুরে কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে তারা যে অভিযোগ তুলেছে তা তো মিথ্যে নয়। নরম সুরে কথা বললে পাছে তার দুর্বলতা প্রকাশ পায়! তখন তো আর রেহাই নেই। হত্যার নেশায় উন্মত্ত পাকিস্তানি আর্মিরা কি আর সিএসপি অফিসারের ধার ধারে?
আবদুল আহাদের সাজানো-গোছানো অফিসকক্ষে গজারি কাঠের বড় টেবিলটার সামনে চার-পাঁচটা চেয়ার ছিল, পাকসেনাদের তিনি বসতে বলতে পারতেন। প্রচণ্ড গরমে এক গ্লাস লেবুর শরবত, দুটো সবরি কলা, নিদেনপক্ষে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আর দুটি বেলা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করতে পারতেন। অথচ আপ্যায়ন তো দূরে থাক, তিনি তাদের বসতে পর্যন্ত বললেন না। ল্যান্স-নায়েক টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অনর্গল খিস্তিখেউড় করছিল, আবদুল আহাদ বিরক্ত হয়ে ‘বাজে কথা রাখুন’ বলে তার কারুকাজ করা কাঠের হাতল চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলেন। তাতেই বুঝি মেজাজ চড়ে যায় বদমেজাজি যুবক ল্যান্স-নায়েকের। রাইফেলটা উঁচিয়ে হঠাৎ সে ডিসিকে লক্ষ্য করে ট্রিগার চাপল। ‘আল্লাহ গো’ বলে তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন ডিসি। নিস্তব্ধ দুপুরে হঠাৎ গুলির শব্দে আশপাশের কক্ষ থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেরিয়ে প্রাণের ভয়ে সদর রাস্তার দিকে ছুট লাগাল। গুলিটা ডিসির পেটে অথবা বুকে অথবা খুলিতেও লাগতে পারত। কিন্তু ল্যান্স-নায়েককে রাইফেল উঁচাতে দেখে আবদুল আহাদ ডানদিকে সরতে গেলে তার হাতল চেয়ারটা উল্টে যায় এবং তার পা দুটি উল্টানো চেয়ারের পায়ায় আটকা পড়ে। গুলিটা বিদ্ধ হয় তার ডান পায়ে।
গুলিবিদ্ধ জায়গাটা একহাতে চেপে ধরে আবদুল আহাদ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। রক্তাক্ত পা-টা ছড়িয়ে টেবিলের নিচে পাকা মেঝেতে বসে পড়লেন। ল্যান্স-নায়েক তখনো খিস্তিখেউড় করে চলেছে। ‘বাস্টার্ড’ বলে গালি দিলে আবদুল আহাদ বিস্মিত চোখে ল্যান্স-নায়েকের মুখের দিকে তাকালেন। চোখের সামনে আজরাইল ফেরেশতাকে দেখে অথবা গুলিবিদ্ধ পায়ের তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে তিনি মেঝেতে শুয়ে পড়ে দোয়া ইউনুস পড়তে গিয়ে ভুল করে সুরা ফাতেহা পড়তে শুরু করলেন। ক্ষিপ্ত ল্যান্স-নায়েক আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আবদুল আহাদের খুলি লক্ষ্য করে আবার গুলি করতে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে বারান্দা থেকে একটা ঝাঁঝাল কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘ঠেরো’।
ল্যান্স-নায়েক থামে। রাইফেলটা কাঁধে ফেলে ঘুরে দাঁড়ায়। আহত আবদুল আহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন, কোমরে পিস্তল, হাতে মোটা জালিবেত, কড়া ইস্ত্রি করা উর্দি পরা ক্যাপ্টেন ওয়াসেত মুখে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আবদুল আহাদ দারুণ অসহায় বোধ করেন। এমন অসহায় সারা জীবনে আর বোধ করেননি। তার চোখ যায় দরজার দিকে চলে যাওয়া রক্তের একটা ক্ষীণ ধারার দিকে। তাজা রক্ত দেখে বুক কেঁপে ওঠে তার, ‘আল্লাহ গো’ বলে আবার আর্তনাদ করে উঠলেন। মৃত্যুর কালো ছায়া ঘনিয়ে এলো তার চেহারায়। চোখের দুই কোণ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্র“ গড়িয়ে পড়ল। দোয়া ইউনুসটা এবার মনে পড়ল তার, বিড়বিড় করে তিনি দোয়াটা পড়তে শুরু করলেন। তার মনে হচ্ছিল তিনি মরে যাচ্ছেন। বড় ছেলের ফুটফুটে মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল, একবার তিনি তার নাম ধরে ডাকলেন।
ক্যাপ্টেন ওয়াসেত সিগারেটে শেষ টান দিয়ে গোড়ালিটা ছুড়ে ফেলে ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে ডান হাতের তর্জনী নাড়াতে নাড়াতে আবদুল আহাদকে উদ্দেশ করে ইংরেজিতে যে-কয়টি কথা বলেছিল তার অর্থ ছিল, তুমি যদি ফের মুক্তিবাহিনীকে কোনো রকমের সহযোগিতা করো, তবে তোমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না ডিসি সাহাব। হুঁশিয়ার!
পরবর্তী আট মাসে ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের সঙ্গে তার বহুবার দেখা হয়েছে, একসঙ্গে বসে চা-নাশতাও করেছেন, একই কাতারে দাঁড়িয়ে একদিন জুমার নামাজও পড়েছেন, অনিচ্ছাসত্ত্বেও নানা সরকারি কাজকর্ম বিষয়ে তাকে অবহিত করেছেন। প্রতিবারই তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তুলেছে ক্যাপ্টেন ওয়াসেত। কখনো তিনি অভিযোগ খণ্ডাতে পেরেছেন, কখনো বা ‘ভুল হো গ্যায়ে’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শেষবার যখন সরকারি কলেজের মাঠে তার সঙ্গে দেখা হয়, জালিবেতটা নাড়াতে নাড়াতে সে বলেছিল, তুম ফের মুক্তিবাহিনী কি হেল্প কিয়া ডিসি সাহাব। মেরে পাছ নালিশ আয়া, সবুত ভি আয়া। ম্যায় তুমকো কিছ তরাহ বাঁচায়োঙ্গা?
আবদুল আহাদ সেদিন অভিযোগটা খণ্ডানোর চেষ্টা করেননি। তার মনে হয়েছিল, স্বভাবে লম্পট হলেও ক্যাপ্টেন ওয়াসেত লোকটার মধ্যে একটা ভালো মানুষ আছে, পাকিস্তানি অন্য আর্মি অফিসারদের মতো অতটা বদমেজাজি নয়। যে-কোনো কারণে হোক তার প্রতি এক ধরনের গোপন 888sport apk download apk latest versionবোধ বা মমত্ববোধ আছে লোকটার। তার ‘ম্যায় তুমকো কিছ তরাহ বাঁচায়োঙ্গা’ কথাটা সেই 888sport apk download apk latest version বা মমত্ববোধেরই বহিঃপ্রকাশ। শান্তি কমিটির লোকেরা তার বিরুদ্ধে যতই নালিশ করুক, সহজে তার কোনো ক্ষতি সে করবে না। অথবা পাকবাহিনীর পরাজয়ের ব্যাপারটা তিনি আগাম টের পেয়েছিলেন। তাই ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের অভিযোগটা গুরুত্ব দেননি, অভিযোগ খণ্ডিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি।
প্রায় সাত মাস পর নভেম্বরের কনকনে শীতের রাতে গেরিলা মুক্তিবাহিনী পটুয়াখালী আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ করলে পাকসেনারা তিষ্ঠোতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের কক্ষে মধ্যবয়সী বিবস্ত্র এক বাঙালি 888sport promo codeকে ভয়ে কাঁপতে দেখে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তার ছুরি দিয়ে ওয়াসেতের পিঠে আঘাত করে। কিন্তু ছুরিটা ছিল মরচেধরা, উর্দি ভেদ করে মাংস পর্যন্ত পৌঁছল না। ওয়াসেতকে মারতে মারতে, তার উর্দি ছিঁড়ে প্রায় নেংটো করে দিঘির ঘাটে নারিকেলগাছের সঙ্গে পিছমোড়া বেঁধে রাখে। প্রচণ্ড শীতে ক্যাপ্টেন ওয়াসেত থরথর করে কাঁপে, সারারাত তাকে লাল পিঁপড়া কামড়ায়, একটা ধোড়া সাপ পায়ের পাতা ছুঁয়ে দিঘির পানিতে নেমে যায়।
তার গোপনাঙ্গ কেটে তাকে নারিকেলগাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ডিসি আবদুল আহাদ গেরিলা কমান্ডারের কাছে খবর পাঠালেন, তিনি ভোরে ক্যাম্প পরিদর্শনে আসবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন ক্যাপ্টেন ওয়াসেতকে বাঁচিয়ে রাখা হয়।
ভোরে কুয়াশা888sport app দিঘির ঘাটে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, প্রায় বিবস্ত্র, তীব্র শীতে কাঁপতে থাকা এবং বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়তে থাকা ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের সামনে দাঁড়িয়ে এপ্রিলের তীব্র গরমের সেই দুপুরের কথা মনে পড়ে গিয়ে থাকবে ডিসি আবদুল আহাদের, যেদিন ক্যাপ্টেন ওয়াসেত তাকে বদমেজাজি ল্যান্স-নায়েকের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল এবং তার নির্দেশে তার সেপাইরা আহত অবস্থায় তাকে জিপে তুলে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে ক্যাপ্টেন ফুঁপিয়ে উঠল, দুই গাল বেয়ে অশ্র“ গড়াতে লাগল। মাথা নুইয়ে কাতর কণ্ঠে মিনতি করল, ম্যায় মাফি মাংগতা হোঁ, মুঝে ছোড় দো ভাই।
ডিসি আবদুল আহাদ তার চোখের দিকে তাকালেন একবার, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। গেরিলা কমান্ডারকে বললেন, তাকে মাফ করে দিন। যে মার খেয়েছে, কদিন পর এমনিতেই মারা যাবে।
হট্টগোলের মধ্যে ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের ক্ষীণকণ্ঠ শুনতে পেলেন আবদুল আহাদ, ‘থ্যাংক্যু ডিসি সাহাব।’ ওয়াসেতের দিকে ঘুরে মুচকি হাসি দিয়ে তিনি তার জন্য অপেক্ষমাণ জিপটার দিকে পা বাড়ালেন।
দুই
করাচি শহরের এ-মসজিদটা তাবলিগ জামাতের ঘাঁটি, দূরদূরান্ত থেকে লোকজন চিল্লা লাগাতে প্রথমে এই মসজিদে এসে জড়ো হয়। শুক্রবার ভোরে জামাতের আমির বারো-চৌদ্দজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিয়ে শহরে এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন মসজিদে পাঠিয়ে দেয়। তিন দিন, সাত দিন বা চল্লিশ দিন পর গাট্টি-বোঁচকা মাথায় নিয়ে আবার এই মসজিদে জড়ো হয় সবাই।
888sport apps থেকে তাবলিগ জামাতের যেসব লোক পাকিস্তানে চিল্লা লাগাতে আসে, তারাও প্রথমে এই মসজিদেই ওঠে। করাচি শহরে চাকরি-বাকরি করতে আসা দোভাষী বাঙালিরা তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। ক্যাপ্টেন ওয়াসেত সুন্নি তরিকার মুসলমান, দেওবন্দ তরিকার অনুসারী তাবলিগ জামাতকে সে ভালো চোখে দেখে না। তাবলিগের লোকদের ওয়াজ-নসিহত শুনতে কোনোদিন সে মসজিদে বসেনি। তাবলিগের লোকেরা তাকে কতদিন বলেছে, ‘ভাই, কুছ টাইম দো, বহুত নেকি হাসিল হোগা।’ ক্যাপ্টেন ওয়াসেত চোখ বড় বড় করে তাদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, ‘আপনা চরকা মে তেল দো। বকোয়াস্ বন্ধ কর।’
সেদিনও আমিরের বয়ান চলছিল। কিন্তু সেদিকে তার কান নেই। তার দৃষ্টি আবদুল আহাদের মতো বুড়ো লোকটার দিকে। মসজিদের দ্বিতীয় কাতারে বসে চুপচাপ তসবিহ গুনছে আর ফিরে ফিরে বুড়ো লোকটাকে দেখছে। বুড়ো মিম্বারের সামনে অন্য মুসল্লিদের সঙ্গে বসে আমিরের বয়ান শুনছেন।
আমিরের বয়ান শেষ হলে পরে শ্রোতারা গাশ্তে বের হওয়ার জন্য বারান্দায় জড়ো হতে থাকে। গাশ্ত মানে দল বেঁধে জিকির করতে করতে রাস্তায় বের হয়ে লোকজনের সঙ্গে দেখা করে মাগরিবের নামাজের পর আমিরের বক্তব্য শোনার জন্য দাওয়াত দেওয়া। বুড়ো লোকটাও দ্রুতপায়ে বারান্দার দিকে হাঁটছিলেন, পেছন থেকে ক্যাপ্টেন ওয়াসেত তার উদ্দেশে বলল, জরা ঠেরো এয়ার, জরা ঠেরো।
বুড়ো ঘুরে দাঁড়ালেন। তর্জনীর ডগায় মোটা ফ্রেমের কালো চশমাটা ওপরে ঠেলে ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের মুখের দিকে তাকালেন এবং মুসাফার উদ্দেশে ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। ক্যাপ্টেন ওয়াসেত মুসাফা করে বলল, আচ্ছা, আফ বাঙালি হোঁ? 888sport apps সে আয়া?
বুড়ো মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, জি বাঙালি। তাবলিগ জামাত কি সাথ আয়া।
: আচ্ছা, আপ ডিসি আবদুল আহাদ হোঁ?
: জি, আবদুল আহাদ। আফ?
: আলহামদুলিল্লাহ। সব কুছ খোদা তালা কি ইশারা।
বুড়ো আবদুল আহাদের খানিকটা অবাক লাগে। এই করাচি শহরে তার পরিচিত কোনো বাঙালি নেই, যে তার ডিসি পরিচয়টা জানে। লোকটাকে তো বাঙালি বলে মনে হচ্ছে না, বাঙালিরা এত লম্বা হয় না, নিশ্চয়ই পাঠান-পাঞ্জাবি। এই মসজিদে আসার পর করাচি শহরের কোনো পাঠান-পাঞ্জাবির সঙ্গে তো তার পরিচয় হয়নি। লোকটা তবে তার নাম জানল কীভাবে?
: আপ কৌন হোঁ?
: মেরে নাম ক্যাপ্টেন সৈয়দ ওয়াসেত আলি।
ক্যাপ্টেন ওয়াসেত আলি? বুড়ো আবদুল আহাদ 888sport sign up bonus হাতড়ে নামটা মনে করার চেষ্টা করেন। বেশি সময় লাগল না, মনে পড়ে যায়। সেইসঙ্গে মনে পড়ে যায় এপ্রিলের সেই তপ্ত দুপুরের কথাও। কোলাকুলির উদ্দেশ্যে তিনি দুই হাত বাড়িয়ে দিলে ক্যাপ্টেন ওয়াসেত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আবদুল আহাদের চোখের পাতা ভিজে আসে। ভেজা গলায় বললেন, আপনি এখনো বেঁচে আছেন ওয়াসেত সাহেব!
ক্যাপ্টেন ওয়াসেত হাসতে হাসতে বলল, আপনারা তো বাঙালি, আপনাদের মনটা পদ্মার পলি দিয়ে গড়া, খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে যান। আমি কিন্তু ভুলিনি, চৌত্রিশ বছর পরও ঠিকঠিক আপনাকে চিনতে পেরেছি।
উর্দু বুঝতে অসুবিধা হয় না আবদুল আহাদের, বলতেও পারেন বেশ। ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের সঙ্গে সেদিন বেশ জমে উঠল। গল্প করতে করতে মাগরিবের আজান পড়ে যায়। নামাজ শেষে আবদুল আহাদকে একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল ক্যাপ্টেন ওয়াসেত, চা-নাশতা করতে করতে 888sport appsের খুঁটিনাটি নানা বিষয় জানতে চাইল। 888sport apps তো নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো নেই? অনেক উন্নতি হয়েছে, তাই না? শেখ সাহেবকে আপনারা কেন মারলেন? লোকটা খুব সাহসী ছিল। গোলাম আযম সাহেব কি এখন হাঁটাচলা করতে পারেন? শুনেছি নিজামী ও মুজাহিদ সাহেব মিনিস্টার হয়েছেন। বুঝলেন ভাই, সবই খোদার ইশারা। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দেন, যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন, হালাক ও বরবাদ করে দেন। মুসলমানের দেশটাকে ভেঙে যারা দু-টুকরো করে দিলো, তারা কি আখেরে শান্তি পেয়েছে? পায়নি তো। খোদা তাদের শান্তি দেননি। এই যে তার কথাই ধরুন…
আবদুল আহাদ গ্লাসে পানি খাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার নাকেমুখে পানি উঠল। তিনি কাশতে শুরু করলেন। হাঁচি দিতে গিয়ে হাত থেকে স্টিলের গ্লাসটা পাকা মেঝেতে পড়ে ঝনঝনাৎঝন আওয়াজ তুলল। বেয়ারা ছুটে এলো। ক্যাপ্টেন ওয়াসেত একটা টিস্যু এগিয়ে ধরল, কিন্তু তিনি টিস্যুটা না নিয়ে দ্রুত বেসিনের দিকে হাঁটা ধরলেন।
হাতমুখ ধুয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলে বেয়ারা দুকাপ কফি দিয়ে গেল, কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করল না। ক্যাপ্টেন ওয়াসেত কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ রেস্তোরাঁর বাইরে শোরগোল উঠল। সে জানতে চাইল, কেয়া হুয়া। বেয়ারা জানাল, রেস্তোরাঁর সামনে পানদোকানিটার ওপর এক খদ্দের ছড়াও হয়েছে। দুজনই বাঙালি।
ক্যাপ্টেন ওয়াসেত হাসতে হাসতে বলল, বড় বেহায়া জাতটা। সারাক্ষণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ মারামারিতে ব্যস্ত। খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে মাঝেমধ্যে। পুলিশ মার দিয়েও তাদের 888sport appsে পাঠাতে পারে না। আসলে ভাই, বাঙালিদের পাকিস্তান ছাড়া উপায় কী, বলুন? আপনি তো খুব পাকিস্তানবিরোধী মানুষ, অথচ যে-কারণেই হোক আপনাকে ঠিকই পাকিস্তান আসতে হলো। করাচি শহরটা ঘুরে দেখুন, দশজনের একজন পাবেন বাঙালি। পোকামাকড়ের মতো গিজগিজ করছে।
আবদুল আহাদ তেরচা চোখে একবার ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে তাকালেন। টেবিলে ঝুঁকে কফির কাপে চুমক দিচ্ছে ক্যাপ্টেন। হাতের ইশারায় বেয়ারাকে ডেকে বিল পরিশোধের জন্য পকেট থেকে একটা নোট বের করলেন আহাদ। ক্যাপ্টেন ওয়াসেত তার হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘আপ কিছ লিয়ে বিল দোগা?’ হাতটা ছাড়িয়ে আবদুল আহাদ নোটটা বেয়ারার হাতে দিয়ে ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে ফিরে তার স্বভাবসুলভ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘নেহি।’
রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনোর সময় ক্যাপ্টেন ওয়াসেতের জোর অনুরোধে আবদুল আহাদ অনেকটা বাধ্য হয়ে কথা দিয়েছিলেন পরদিন দুপুরে তার বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু পরদিন জোহরের নামাজের পর তাকে মসজিদের কোথাও দেখতে না পেয়ে ক্যাপ্টেন ওয়াসেত 888sport apps থেকে আসা তাবলিগ জামাতের আমিরের সঙ্গে দেখা করে তার খোঁজ নিলেন। আমির বললেন, আহাদ সাহেব তো সকালের ফ্লাইটে 888sport appsের উদ্দেশে রওনা করেছেন। কেন বলুন তো?
ক্যাপ্টেন ওয়াসেত খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর কোনো কথা না বলে মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা ধরল। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখে কাল সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনোর সময় আবদুল আহাদের বেজার মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.