আমরা নিঃসন্তান দম্পতি। বিয়ের পনেরো বছর পর হানিমুন। মানে ওই ভারতে আর কি। আমি একরকম এক লেঠেল পরিবারের মেয়ে। খুব লেখাপড়া জানা ঘরের কেউ না। তবে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আশুতোষ, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন চুটিয়ে পড়তাম। আমার দুই চাচার একজন আদালতের দলিল লেখক (শুনেছি দলিল লেখার নামে তিনি অনেকের জমি কায়দা করে হাতিয়ে নিতেন), আরেকজন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ছোট কেরানি। তার কুকীর্তির কথা আশপাশের গ্রামে সবাই জানতো। আমার বাবা ভুসিমালের ছোটখাটো আড়তদার। এই তিন ভাই মিলে অনেক জমির মালিক। আমরা ছোটবেলায় অজপাড়াগাঁয়ে থাকতাম। গ্রামের নাম ছিল ভাতারমারি। যখন শহরতলিতে এসে আমার বাবা-চাচারা একটা ছোটখাটো জমিদারবাড়িতে বসত গাড়লেন, তখন কেউ গ্রামের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলতাম ভুজঙ্গমারি। এসএসসি পাশের পরপরই চাচাতো-ফুপাতো বোনদের অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হয়ে গেল। চাচাতো ভাইদের কেউ কেউ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালিতে শ্রমিকের চাকরি করতে চলে গেল। আমিই একমাত্র গোবরে পদ্মফুল হয়ে কলেজে যাতায়াত শুরু করলাম। আমার বাবা ছিলেন পাকিস্তানের সমর্থক, বড় ফুপা পাঁড় আওয়ামী লীগার। তারা তর্ক করতেন নিজেদের মধ্যে কিন্তু দারুণ বন্ধুত্বও ছিল। বাবা বলতেন –
‘আপনি যা-ই বলেন দুলাভাই, স্বাধীন হলে এ-দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে। আমাদের মুসলমানিত্ব রাখাই দায় হয়ে পড়বে।’
‘তোমাকে একটু বুদ্ধিমান ভাবতাম। এমন গাঁড়লের মতো কথা বলো যে তোমার সঙ্গে তর্ক করাই বৃথা।’
‘তাহলে আমাদের সহযোগিতা করতে ভারতের ইন্টারেস্টটা কী আমাকে বুঝিয়ে বলেন।’
‘তুমি রাজনীতির ক খ-ও জানো না। যা জানো তা নিয়ে আসো। চলো এ-বেলা দাবায় বসি।’ – বলে ফুপা আমার বাবার নির্বুদ্ধিতাকে পাশ কাটিয়ে শান্তির সহাবস্থানের আমন্ত্রণ জানাতেন। মুখে পাকিস্তানের সুনাম করলেও আবার অন্যদিকে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা ছেলেদের জন্য মা-চাচিদের রান্নার হুকুম দিতেন বাবা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার তিন মাসের মাথায় আমরা ভাতারমারির টিনের দোচালা বাড়ি থেকে দুর্লভপুরের লাল ইটের দোতলা বাড়িতে এসে উঠলাম। জমিদারবাড়ির মতো ঝরকাকাটা লোহার রেলিং দেখে আমি যেন মুহূর্তে রাজকন্যা বনে গেলাম। পিঠের ওপর চুল খুলে দিয়ে ঝুলবারান্দার এ-মাথা ও-মাথা গান গেয়ে গেয়ে ফিরলাম। যেন এ-বাড়িতে সাদা ঘোড়া থামিয়ে চুড়িদার পাজামা আর ঝলমলে কটি পরে রূপকথার রাজপুত্তুর এসে দাঁড়াবে আর আমি তাকে না দেখার ভান করে উদাস হয়ে আকাশ দেখবো।
এক মাসের মধ্যে আমার লাল রাজপ্রাসাদ ক্যাটকেটে সবুজ রঙে রাঙিয়ে তুললো আমার দুই চাচা। দরজা-জানালা হয়ে গেল দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ। ঝরকাকাটা কালো রেলিংয়ে লাগানো হলো কমলা রং। আমার ভেতরের রাজকন্যা গুমরে মরে। রঙের আয়োজনের সময় আমি ভয়ে ভয়ে বাবাকে বললাম –
‘আব্বা, বাড়িটার যে-রং আছে সেটাই নতুনভাবে লাগানো যায় না?’
‘তোমার এতো মাতব্বরির কী দরকার বাবা? মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতো থাকো। এটাকে নতুন না দেখালে ভবিষ্যতে ফ্যাসাদে পড়তে হবে।’
স্বাধীনতার পর বাবা-চাচারা যে ফ্যাসাদে পড়েনি তা নয়। হিন্দুর বাড়ি দখল করার ঝামেলা তো পোহাতেই হবে! কিন্তু আওয়ামী লীগার বড় ফুপার জন্য সে-যাত্রা সবাই বেঁচে গিয়েছিল। কেবল আমিই আর রূপকথায় ফিরে যেতে পারিনি। তবে এমন কোনো কোনো গল্প কারো কাছ থেকে শোনা বা পড়া বারবার চর্চায় তা যেন একদিন একান্ত নিজের হয়ে পড়ে। মনে হয় আমি সেখানে ছিলাম বা অমুক চরিত্রটা আমিই তো। কোনো এক চৈত্রের বিষণ্ন দুপুরে আমি কি ঘুমাচ্ছিলাম না? তাহলে তো সে-রূপকথা আমার স্বপ্নেরই। সাদা ঘোড়ায় চেপে সে আসেনি ঠিকই, কিন্তু ওরকম রূপবান এক পুরুষ বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল। বাবা-চাচারা মিলে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ফটকের বাইরে বের করে দিয়েছিল। সে দোতলার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। আনমনে কী দেখছিল সে? সে কি আমাকে নিতে এসেছিল? চোখ রগড়ে তাকাতে গিয়ে সে নেই হয়ে গেল। নাকি তা ছিল আমার দিবাস্বপ্ন? তারপর কতদিন কুয়াশার ঢিমে জ্যোৎস্নায়, বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়, ঝরাপাতার নির্জনতায় কেবল মনে হতো সে আসবে। আবার এলে আমি তাকে লুকিয়ে ঘরে নিয়ে আসবো। তার বুকে মাথা দেবো। চুম্বনের জন্য বেতস লতার মতো তার বাহুর ’পরে ঢলে পড়বো। সে-ই আমার প্রথম প্রেম। তাই বলে স্বপ্ন নিয়ে তো জীবন চলে না। তার ওপরে লেঠেল পিতা-পিতৃব্যকুল। দূরের জেলার এক মাঝারিমানের সরকারি অফিসারের সঙ্গে আমার বিয়ে হলো।
আমার বরের কী দেখে মনে হলো আমি এক তুখোড় প্রেমবাজ মেয়ে আমি জানি না। কদিন পরপরই জিজ্ঞাসা –
‘সত্যি করে বলো, কবে কার প্রেমে পড়েছিলে? সে কি তোমাকে চুমু খেয়েছিল?’
‘আরে আজব! প্রেম করলে তো তাকেই বিয়ে করতাম।’
‘তাহলে তো তোমার জল্লাদ বাপ তোমাকে কেটেই ফেলতো।’
‘প্রেম করলেও কেটে ফেলতো।’
‘কথা ঘুরিও না। লক্ষ্মীটি বলো, লুকিয়ে লুকিয়ে কার সঙ্গে প্রেম করতে?’
‘কী মুশকিল! না করলে কি মিথ্যামিথ্যি বলবো?’
আমি কিন্তু একবারও তাকে তার প্রেম নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কেন জানি মনে হতো লোকটা ভালো। ভালো মানে এই নয় যে, জীবনে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি, ছ্যাঁকা খায়নি বা দেয়নি – তা নয়। আমাকে ভালোবাসে সে। ভালোবাসে কারণ আমি তার প্রতি উদাসীন। আমার নিজের রূপকথার প্রেমের গল্পও তাকে বলিনি। ওটা কি আসলেই রূপকথা ছিল কিংবা রূপকথার মতো? বলতে গেলে নিশ্চয় ওটাকেই সত্যিকার প্রেম ভেবে মিছে ডালপালা বিস্তার করতে হয়। উপায়ান্তর না দেখে সে নিজের প্রেমের কথা বলে কৌশলে আমারটা বের করার চেষ্টা করেছিল –
‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের মাঝামাঝি আরো দুই বন্ধু মিলে আমরা ভারতে চলে যাই। একজন সরাসরি ক্যাম্পে। আমি আর জয়নুল আগে শান্তিনিকেতন দেখবো ঠিক করলাম। আমরা দুজনে খুব রবীন্দ্রভক্ত। আগে আমাদের তীর্থ তারপর ক্যাম্প, ট্রেনিং, যুদ্ধ। শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেনে উঠে বসলাম। গাদাগাদি, গরম, শরণার্থীদের ভিড়। ওরই মধ্যে বাউল গলা ঝেড়ে গানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘লেডিসকে বসতে দিন দাদা’ বলে আমাদের সিট ছাড়তে অনুরোধ করলেন ঘামে স্নানরত এক ফেরিওয়ালা। আমরা একে পলাতক, বিপর্যস্ত দেশমাতৃকার অসহায় সন্তান, তার ওপরে এই প্রথম বিদেশে আসা। উঠে দাঁড়ালাম। ধন্যবাদ দিয়ে যারা বসে পড়লেন তারা এক বৃদ্ধ বাবা ও তার কন্যা। 888sport apps থেকে পালিয়ে এসেছেন। মেয়েটির নাম সুপ্রভা সাহা। যেন স্নিগ্ধতার প্রভা ছড়ানো এক জ্যোতির্ময়ী। মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। জয়নুলের অবস্থাও তথৈবচ। আরো সঙ্গিন। সামনের স্টেশনে একটা সিট খালি হতেই বৃদ্ধ মেয়েটির পাশে আমাকে বসতে বললেন। আমি গা বাঁচিয়ে বসতে চাইলেও মেয়েটির ভেতর কোনো জড়তা ছিল না। ওর হাতে আমার হাত ছুঁয়ে গেল। মনে হলো রাজশাহীর এক নম্বর রেশমের শাড়ির ছোঁয়া পেলাম। গভীর কালো চোখে সর্বস্ব হারানোর বাণী। জলহীন। প্রতিবাদহীন। কিন্তু প্রতিশ্রুতিময়। দাঁড়িয়ে থেকে জয়নুল আমার মৃত্যু কামনা করছিল নিঃসন্দেহে। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধের পাশে ওর বসার সুযোগ এলো। উসখুস করছিল কোনো ছুতোয় জায়গা বদল করা যায় কি না। বৃদ্ধ দুঃখের কথা বললেন। মেয়েটিও দু-একটা করুণ ঘটনা সংযোজন করলো। বৃদ্ধ যেন আনমনেই বলতে লাগলেন –
‘পলাইয়া আইছি তো সেই ছাব্বিশে মার্চেই। মাইয়া লইয়াই বেশি ডরাইছি। তয় মাইয়া আমার বুদ্ধিমান। কালিঝুলি মাইখা সাত-আটদিন গেরামে গেরামে ঘুইরা পরে ভারতে আয়া পড়ছি। ভগমানে মানসম্মান বাঁচাইছে। চইক্ষের সামনে ভাইগ্নেডারে ন্যাংটা কইরা গুলি করছে। বউমারে উঠাইয়া নিয়া গেছে। স্বাধীন হোক আর না হোক আমি আর দ্যাশে ফিরুম না’ – বলে বৃদ্ধ চোখের জল মুছলেন।
মেয়েটি তার চাঁপাকলি আঙুলে কপাল চেপে নতমুখে বসেছিল। আঙুল সরাতেই কপালে ফুটে উঠলো রক্তজবার কুঁড়ি। আহা রাজকন্যে! তুমি এদেশে কোথায় থাকবে? তোমার এ-মোমের দেহ কার তরে গলে গলে সারা হবে? তোমাকে পাবে কে সেই ভীষণ পুরুষ? এতো অসহায়ত্ব-অপারগত্ব আমি কোনোদিনও বোধ করিনি। মেয়েটির গা থেকে ওই গরমে শিউলির ঘ্রাণ ভেসে আসছিল। ট্রেনের দুলুনি আমরা কেউই উপেক্ষা করিনি। একেকটি ধাক্কা যেন আমাকে শত বছরের আয়ু দিয়ে যাচ্ছিল। মহুয়া মাতাল বউগো, আগলে রাখো মউগো।
‘আমরা নৈহাটি নেমে যাব। এক দূরসম্পর্কের মামাবাবু আছেন। ওখানে উঠবো গিয়ে। তারপর তো ভবিতব্য’ – মেয়েটির গলার স্বরে বিপ্লুত বেহাগ।
জয়নুল যতটা পারে মেয়েটির দিকে ঝুঁকে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞাসা করলো –
‘নৈহাটির কো-কোথায়? কী না-আ-আ-ম আপনার মামাবাবুর?’
‘একবার আইছিলাম অনেক আগে। প্রফুল্ল সেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ঠিক পশ্চিমে। অবিনাশ মিত্তিরের বাড়ি কইলেই লোকজনে দেখাইয়া দিবো। অহন তো আর জামাই-আদর করবো না। কী আছে কপালে কে জানে?’ – হতাশার সুর বৃদ্ধের কণ্ঠে।
তারপর মিলিয়ে গেল জনারণ্যে আমার ভোরের শিশির। শান্তিনিকেতন আমারে দু-দণ্ড শান্তি দেয়নি। যাব যাব করে আর কোনোদিন ভারতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। জয়নুলের বৃদ্ধ মা এখনো ছেলে ফিরে আসবে ভেবে রাতে দরজার খিল লাগায় না।
‘খোকন খোকন করে মায়, খোকন বলে ‘মা,
যুদ্ধে গেলে কোলের ছেলে কোলে ফেরে না।’
সুপ্রভাই আমার প্রথম প্রেম। মাঝে দুটো হতে হতেও হয়নি। নিতান্তই গৌণ। তারপর তোমাকে পেলাম। তুমি বড় বেশি অধরা, যেন এই আছো, এই নেই, কোনোদিনও ছিলে নাকো। শারীরিক শাড়ির আড়ালে থাকা তুমি এক রূপকথা মেয়ে।’ – বলে আমার বর তার প্রেমের কথা শেষ করে আমার মুখের দিকে নিখেকো ভিখিরির মতো তাকিয়ে থাকে।
আমি তা-ও কিছু বলিনি। আমার এতটুকু ঈর্ষা হয়নি তার প্রেমের গল্প শুনে। আবার বানানো গল্পও মনে হয়নি। তাহলে কি লোকটাকে আমি ভালোবাসি না? না হলে বিয়ের পনেরো বছর পর ভারতে যাবার সময় কী করে আমি বললাম –
‘শান্তিনিকেতন যাবার পথে আমরা কিন্তু নৈহাটি নামবো। তুমি সুপ্রভাকে একবার দেখে যাবে। আমিও দেখতে চাই।’
‘আরে দূর পাগল! সে সব কবে ধুয়েমুছে শেষ। খামোকা ঝামেলা বাড়ানো।’
‘শেষ সে তো আমিও জানি। কিন্তু বড়ই কৌতূহল হচ্ছে।’
দেখলাম সেও যে খুব অরাজি তা নয়।
প্রফুল্ল সেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় খুঁজে পেতে সময় লাগলো না। অবিনাশ মিত্তিরের বাড়িও দেখিয়ে দিলেন পাড়ার দোকানদার। বরের মুখের দিকে লুকিয়ে তাকাচ্ছি। বারবার রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছছে। দুবার সমতল রাস্তায় হোঁচট খেল। আমারও অস্থির ঠেকছে। জ্যোতির্ময়ীর উদয় হবে। কী পরে আছে সুপ্রভা? লালপেড়ে শাড়ি? কপালে ডগডগে সিঁদুর? একটু কি মুটিয়ে গেছে? পুরনো বাড়িতে কড়া নাড়তে গিয়ে স্পষ্ট দেখলাম আমার বরের হাত কাঁপছে। ক্যাঁচক্যাঁচ করে দরজা খুলে বিরক্তিমুখে বিধবার পোশাকে একজন প্রবীণ 888sport promo code বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন –
‘কাকে চাই বলুন দেকি?’
‘অবিনাশবাবু …’ বলে আমার বর নিমেষে এক চক্কর চারদিক দেখে নিল।
‘দুগ্গা! দুগ্গা! তিনি তো দশ বছরের ওপরে স্বর্গে গেছেন’ – বলে প্রবীণা জোড়হাত দুবার কপালে ঠেকালেন।
‘আপনারা কি 888sport apps থেকে আসছেন? সুবিমলদার কেউ? তিনিও তো বাবু মারা যাবার আগেই গঙ্গা পেয়েছেন।’
ঠিক। সুপ্রভার বাবার নাম সুবিমল সাহা বলেছিল আমার বর।
‘ভেতরে এসে বসুন’ – বললেন তিনি অনাগ্রহের স্বরে।
আমরা একপ্রকার ঠেলেগুঁজে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। ঘরের দরজাগুলোর পর্দা দুলছে। কোন পর্দা ভেদ করে সুপ্রভা এসে দাঁড়ায় আমরা দুই তৃষ্ণার্ত দর্শক তার ব্যাকুল অপেক্ষায়। একটা থেকে দুই তরুণ-তরুণী স্বামী-স্ত্রী সেজেগুঁজে বেরিয়ে এলো। সিঁদুর পরা মেয়েটি সুন্দরী। কুড়ি-888sport cricket BPL rate বছর বয়স হবে। ও কি আর সুপ্রভা হতে পারে?
‘সন্ধের আগেই ফিরিস কিন্তু।’ আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রবীণা বললেন, ‘আমার ছেলে-বউমা। দেড় মাস হলো বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে সম্বন্ধীর ছেলের অন্নপ্রাশনে। এই দেখো (ছেলেকে ডাকলেন) ওরা 888sport apps থেকে এসেছেন। তোর পিশেমশাইয়ের খোঁজ করছিলেন।’
‘ও নমস্কার। তিনি তো গত হয়েছেন। তবে দিদিরা ওড়িষ্যায় চলে গেছে অনেকদিন। আমরা আসছি এখন।’
ফুটো টায়ারের মতো হুস করে আমাদের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। একটু যেন ঘাম দিয়ে জ্বরও ছাড়লো। সুপ্রভার নাম করে আনা আমাদের দেশের আফলাতুন মিষ্টির প্যাকেট ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। তিনি গদগদ হয়ে (আমাদের দেশে তাদের আপ্যায়ন নিয়ে যেসব গল্প প্রচলিত, অবিকল তা-ই বললেন) আফসোস করলেন –
‘বউমাও চলে গেল। এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবো হাঁটুতে সে-শক্তিও নেই। আপনারা পুরী যাবেন না? সি-বিচের কোল ঘেঁষে সুপ্রভাদের হোটেল। হোটেল ‘সূর্য দেবতা’। খুব চলে। ওখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।’
আমরা তখন হতাশ হলেও পুরীর সূর্যমন্দির দেখা আমাদের 888sport slot gameে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমার বর একবার মিনমিন করে বললো, ‘শালা যাবই না পুরীর পুঁচকি সমুদ্রদর্শনে। আমাদের বিচ কত বড়!’
আমি জানি ভদ্রলোক একটু খুশিই। সমুদ্রদর্শন বড় কথা নয়, প্রিয়া সন্দর্শন অপ্রতিরোধ্য। আহা! যদি সুপ্রভার মামি বলতেন – ওরা তো দক্ষিণে চলে গেছে। তাহলে! যেন খুব দায়ে পড়ে আমার বর ওড়িষ্যা যাচ্ছে – এমন ভাব। অথচ কোনার্কের মন্দির আমাদের 888sport slot gameের তালিকার শীর্ষে। বুঝিরে ভাই, সবই বুঝি। আমি কি একটু ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ছি? তাহলে ও-বাড়িতে সুপ্রভাকে না দেখে কেনই বা স্বস্তিবোধ হলো, আর কেনই বা পুরীর কথা শুনে আবার বুকের মধ্যে চিনচিন করছে? মুখে বললাম – ‘তুমি না গেলেও আমি যাবই। আগে সূর্যদেবতা, পরে সূর্যমন্দির।’
ভেবেছিলাম হোটেল সূর্যদেবতা না জানি কি এক পাঁচতারা! টিনের চালের বেড়া দেওয়া বাংলা হোটেল। পাশাপাশি আর দশটা হোটেলের মতোই। তবে সূর্যদেবতা বেশ পরিচ্ছন্ন। লোকজন একনামে চেনে। খাবার নাকি ঝাক্কাস! আমার বর অস্বস্তি বোধ করছে দেখে আমিই হোটেলের বেয়ারাকে বললাম –
‘হোটেলের মালিক কোথায় থাকেন? একবার দেখা করতে চাই। আমরা 888sport apps থেকে এসেছি বলবেন।’
‘দিদিই হোটেল চালাতেন। দাদাবাবু আজকাল আর পারেন না। ওদের ছেলে এখন দেখছে সবকিছু। পেছনটাতেই থাকেন। আপনারা বসুন। আমি ওদের ডেকে দিচ্ছি।’
আমরা খাবারের অর্ডার দিয়ে হাত ধুয়ে বসলাম। যদিও আমার বর ছদ্ম বিরক্তি তুলে বলতে লাগলো, ‘সূর্যমন্দিরটা আগে দেখবো তা না …’
যাকে দেখার সে এসে দাঁড়ালো। আমার এক বন্ধু খুব বৈষ্ণব পদাবলি আওড়াতো। ও বলতো – রাধাকে তোর কেমন লাগে? আমি বলতাম – ওই আর কি ‘থির বিজুরি, বরণ গৌরী, পেখিনু ঘাটের কূলে …’। ও বলতো, দূর! আমার মনে হয় রাধা একটু গোবদা-গাবদা ছিল।
আমার বন্ধুর রাধাকে পেলাম। কপালে অস্তমিত সূর্য খানিক বিক্ষিপ্ত। চওড়া সিঁথিতে স্বামীগরবিনীর রক্তিম প্রশস্তি। মুখে পান, ঠোঁট টুকটুকে।
‘আমাকে চেনা যায়?’ বলে আমার বর একবার সুপ্রভার দিকে, একবার আমার দিকে লাজুক চোখে চায়।
তর্জনী দিয়ে মুখের পান ঘুরিয়ে নিয়ে আঁচলে হাত মুছে সুপ্রভা চিকন চোখে ওকে দেখে।
‘আরে, কী আশ্চর্য! আপনি হারুনদা না? কতকাল পরে দেখা! কীভাবে খোঁজ পেলেন? আপনার সেই বন্ধুটি কোথায়? জানেন, বাবা খুব আপনাদের কথা বলতেন। স্বাধীনতার পর বেশিদিন বাঁচেননি। আমি একবার দেশে যাব যাব করে দেখুন আজো যাওয়া হলো না। কে উনি? আপনার স্ত্রী? বাহ্, খুব মানিয়েছে।’ একনাগাড়ে বলে গিয়ে পেছনে তাকালেন। গলায় খুশির দমক ছড়াতে ছড়াতে পেছনের ভদ্রলোককে ডেকে বললেন –
‘এই এদিকে দেখবে এসো। 888sport apps থেকে আমাদের বন্ধুরা এসেছে।’
ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কুশল বলে নির্বাক হয়ে তাকে দেখলাম। আমি আমার জোতদার বাবাদের সেই ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে কোনো চৈত্রের বিষণ্নতাকে আর আমলে নিলাম না। আমার ভেতরের মৃত রাজকন্যার কপালে কে যেন সোনার কাঠি ছোঁয়াল। সাদা ঘোড়ার রাজপুত্রকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে দেখলাম আমার জোতদার পিতৃকুলকে। তেপান্তরে সাদা ঘোড়ার খুরের ধ্বনি পাতাঝরার শব্দের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। আমি অনুচ্চ কণ্ঠে কাউকে তোয়াক্কা না করে আমার বরের বিহ্বল মুখের পানে চেয়ে বলে উঠলাম –
‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি
কুড়ি বছরের পার
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই
আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পেছনে …’


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.