আবুবকর সিদ্দিকের ভূমিহীন দেশ ও মরে বাঁচার স্বাধীনতা : ব্রাত্য জীবনের গল্প888sport live chat

আবুবকর সিদ্দিক বাংলা 888sport live footballের একজন নিষ্ঠাবান লেখক। 888sport live footballের সব শাখাতেই রয়েছে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এটা তাঁর সমাজজীবন ও 888sport live chatের প্রতি গভীর অনুরাগ এবং একজন লেখক হিসেবে দক্ষতার পরিচায়ক। তাঁর দৃষ্টি দেশ-কাল-মানুষ ও প্রকৃতির গভীরতম তল স্পর্শ করে এবং তা নিখুঁত 888sport live chatনৈপুণ্যে বিধৃত। কবি হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত হলেও ছোটগল্প রচনায় তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ভূমিহীন দেশ (১৯৮৫) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭)। দুটি গ্রন্থের প্রতিটি গল্প  মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলে। ঘা-খাওয়া জীবন ও 888sport live chatের বেদিতে নির্ভেজাল আলো ফেলেন গল্পকার।

এক

ভূমিহীন দেশ এ-নামটি প্রথম দর্শনেই মনে বিভ্রান্তি আনে। দেশ, অথচ তা ভূমিহীন; সত্যিকার অর্থে ভূমিবর্জিত কোনো দেশ কী পৃথিবীতে আছে বা থাকা সম্ভব? গল্পগ্রন্থের ভেতরে প্রবেশ করে আমরা জানতে পারি, দেশটির নাম ‘888sport apps’ – বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর 888sport apps। ভূমিহীন দেশ Ñ এ-শব্দবন্ধের মধ্যে এক নির্মম সত্যকে বিস্ময়কর প্রতীকী ফ্রেমে আবদ্ধ করেছেন লেখক। এই নামকরণের নেপথ্যে আছে একটি নবলব্ধ স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পটভূমির আবেগবর্জিত ইতিহাস। ষাটের দশকব্যাপী গণআন্দোলন ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ যে-স্বাধীনতা ও স্বাধীন জনপদের জন্ম দেয়, তা ভোগের অধিকার থেকে দুঃখজনকভাবে বঞ্চিত করা হয় সেই দেশের অনেক মানুষকে। স্বাধীনতার সৌভাগ্য ও সম্পদ চিরাচরিত কায়দায় সুবিধাবাদীদের ভোগদখলে চলে যায়। সাধারণ মানুষের পায়ের তলায় বেঁচে থাকার প্রত্যয়পুষ্ট মাটিটুকুও বেহাত হয়।

আবুবকর সিদ্দিক নিরাসক্ত জীবনদ্রষ্টা। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তিনি একজন মোহমুক্ত রাজনৈতিক  পর্যবেক্ষক। 888sport appsের শোষিত মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনসত্যকে তিনি আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। সাহসী দায়বদ্ধতার প্রেরণা থেকে আবুবকর সিদ্দিক জানান, নির্বাচন জনগণের একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্যে তা প্রহসন মাত্র। এ-বইয়ে গ্রন্থিত বেশিরভাগ গল্পে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার সারাৎসার বর্ণিত হয়েছে।

বইয়ের মোট সাতটি গল্পের প্রথম পাঁচটিতে আমরা দেখি স্বৈরাচারী নির্বাচনের পাঁকে আবদ্ধ সাধারণ মানুষের অসহায় দুর্দশা ও মরিয়া প্রতিবাদ। বাকি দুটি গল্পের বিষয়ও রাজনীতিঘেঁষা। স্বাধীনতা-উত্তর সুবিধাবাদী রাজনীতি সাধারণ মানুষের জীবনধারণের অবলম্বন কেড়ে নেয় Ñ এ হচ্ছে গল্পদুটির বিষয়। সেদিক থেকে সাতটি গল্পই সমধর্মী বক্তব্যসূত্রে অবিচ্ছিন্ন। প্রথম গল্পের নাম ‘ভূমিহীন দেশ’। সাধারণ মানুষ মানচিত্রে চিহ্নিত একটি দেশ পায়, পায় না পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মাটি। আবার শেষ গল্প ‘চন্দনের ঘূণ’-এ উচ্চশিক্ষিত পুরুষ তার আপন দেশেই অনিকেত। শুধু জৈবিকভাবে টিকে থাকার তাড়নাতেই সদ্যলব্ধ প্রিয় স্বাধীন স্বদেশ ছেড়ে একজন উচ্চশিক্ষিত মেধাবী অধ্যাপক সুইপারের চাকরি নিয়ে পালান বিদেশবিভূঁই মধ্যপ্রাচ্যে। অর্থাৎ কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত, সবারই ললাটলিপির অভিন্ন অর্জন Ñ ভূমিহীন দেশ।

স্বাধীনতা, নির্বাচন এসব রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শোষিত মানুষের জন্যে একধরনের মোহভঙ্গের অভিজ্ঞতা। শেষ পর্যন্ত প্রাপ্তি জোটে শুধু বঞ্চনা। গ্রাম বা শহর, সর্বত্রই তারা ঠাঁইহীন পথের মানুষ। অবস্থাপন্ন, জোতদার, ক্ষমতাবান চৌধুরীরা নেছার-মালিহাদের ভোট-পুঁজি করে অর্থ, মান ও স্বার্থের পাহাড় গড়ে। ‘ভূমিহীন দেশ’  গল্পে এসব সুবিধাভোগীর মুখোশ লেখক উন্মোচন করেন।

ব্রাত্যজনের ভূমিহীনতা Ñ এই বীজপ্রসঙ্গটি আরো বড় মাত্রায় মূর্ত হয়ে উঠেছে গল্পের শেষ সিকোয়েন্সে। স্বামী-স্ত্রী মিলিয়ে একটি করে জোড়, একটি জোড় শহর থেকে উৎখাত হয়ে শূন্য হাতে যাচ্ছে গাঁয়ের দিকে, ঠিক অনুরূপ আরেকটি সর্বহারা জোড় গ্রাম থেকে উন্মূল হয়ে যাত্রা করেছে শহরের উদ্দেশে Ñ দুটি জোড়েরই প্রত্যাশিত লক্ষ্য পায়ের তলায় একটুখানি মাটি; জীবনধারণের ন্যূনতম অথচ নিশ্চিত একটু ঠাঁই। শেষে এই দুটি নিরাশ্রয় পরিবারকে পথের মধ্যবিন্দুতে এক আদিগন্ত নাস্তির সামনে এনে মুখোমুখি দাঁড় করান

লেখক।

‘ভূমিহীন দেশ’ গল্পের সমাপ্তিতে মোহভাঙা মানুষের অভিজ্ঞানচিত্র যেমন নিষ্ঠুর তেমনি 888sport live chatসফল। একটু দৃষ্টান্ত – সেই শেষবিকেলের কনে দ্যাখা আলোয় গ্রামত্যাগী এ্যাক বুড়োমানুষ ছানিপড়া চোখে চেয়ে দ্যাখে। একটি গ্রামগামিনী মেয়ের মুখের মাংস শহুরে ব্যাধিতে খুবলে খেয়ে নিয়েছে। চাকা চাকা ঘায়ের অজস্র গর্ত। পুঁজভরা ফুসকুড়িতে ফাঁপা।

মাংসপচা গন্্ধে গ্রামের মানুষের গলার গোড়ায় তরল বমি গুলিয়ে ওঠে। (পৃ ১১)

সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ নেতা নির্বাচনের লগ্নে ভোটভিখারির ভেক ধরে দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়ে ফেরে। তাদের হাতে থাকে মেকি প্রতিশ্রুতির তালিকায় ফাঁপানো বিশাল বেলুন। ‘বেলুনওয়ালা’ গল্পের সমাপ্তিতে বেলুনওয়ালার রঙিন বেলুনটি ফাঁসিয়ে দিয়ে লেখক তাঁর নিজের সুনির্দিষ্ট মানববাদী চরিত্রটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।

ভোটপ্রার্থী বেলুনওয়ালাকে লেখক পর্যায়ক্রমে ভোটার নামক যে পাবলিকের কাছে নিয়ে যান, সে প্রথমে নিরন্ন-পীড়িত মানুষ এবং পরিশেষে শ্যাওলা ধরা প্রাচীন কংকাল। এই ভিন্ন ভিন্ন মানুষ তাৎপর্যগত অর্থে আসলে এক অভিন্ন চরিত্র, যার নাম পাবলিক, যে আপাতজীবিত কিন্তু প্রকৃত অর্থে শোষণজীবী সমাজব্যবস্থায় বহু পূর্বেই মৃত। প্রতীকের এই পরিকল্পনা ও তার ব্যবহারের মাধ্যমে যে অতিলৌকিক পরিবেশ রচনা করেছেন লেখক। গল্পের এক জায়গায় লেখক বলেন :

এবারের অভিজ্ঞতায় বেলুনওয়ালা স্বয়ং জমে হিম হয়ে যেতে থাকে। এ্যাকঝলক আগুন কান ও নাকের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসে আরো শীত লাগিয়ে দিয়ে যায় স্নায়ুতে।

সন্দেহটা যাচিয়ে নেবার জন্যে সে এবার সাবধানে উবু হয়ে হাত বাড়িয়ে দ্যায়। হ্যাঁ তাই। তার দেয়া লিফলেটের কাগজখানা পড়ে আছে পাঁচটা চামড়াহীন মাংসহীন খটখটে সরু হাড়ের মধ্যে। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সবটাই ছুঁতে পায় এ্যাখন। কঠিন করোটি। শূন্য অক্ষিকোটর। মাংসরিক্ত দাঁতপাটি। সরু পল্কা কণ্ঠাদ্বয়। পাঁজরের ব্যাঁকা কাঠি। তলপেটের তলদেশে আদিগহ্বর আর মেরুদণ্ডের মূলসন্ধি। সব, সবি হাতিয়ে হাতিয়ে পেয়ে যায় সে।

বমি নয়, হোঁৎ করে এ্যাকটা বিজাতীয় শব্দ ঠিকরে উঠে আসে বাক্যন্ত্র থেকে। স্থাণুর মতো বসে বসে সময়ের অনিবার্য চাপ গ্রহণ ও ধারণ করে সে।

বাইরে অশরীরী শব্দ শোনা যায় র্ভর্ র্  । না, ঘোড়ার নাক ঝাড়ার আওয়াজ ও। আর শনন্ন্ তীব্র তীক্ষè শিস্। চাবুকের ডগায় বাতাস কাটার আওয়াজ। ছুটে বাতাসে বেরিয়ে আসে বেলুনওয়ালা। (পৃ ৩৪)

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে ভিখুর কাটা ক্ষতের পচা দগদগে বর্ণনা পড়তে পড়তে মনে হয় দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগছে। আবুবকর সিদ্দিকও ক্ষেত্রবিশেষে সেই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর ‘বেলুনওয়ালা’ গল্পে।

গ্রামবাংলার মানুষ নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয় বারবার। ভোটপ্রার্থীর বাকচাতুর্যে বশীভূত হয়ে নতুন করে আশান্বিত হয়। বিপুল উৎসাহে সেজেগুঁজে গিয়ে ভোট দিয়ে আসে। কিন্তু পরিণামে দেখা যায়, তারা শুধু সাহায্য করেছে চোরকে ডাকাতে উন্নীত হতে, লুটেরাকে বড়দরের শোষকে পরিণত করতে। এ অভিজ্ঞতা ঠেকে ঠেকে শিখে একদিন তারা জোটবদ্ধ হয়। একপ্রান্ত  থেকে আরেকপ্রান্তে নির্দেশ চলে যায়, ভোটবয়কট। নির্বাচন নামক ব্যাপারটার রংচংয়ে চামড়া খসে গেলে ভণ্ডামির সত্য কংকাল বেরিয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী গ্রামবাসী সমাজ-শোষণের প্রতীক এই উচ্ছিষ্ট উদোম কংকালটিকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যায় তাদের জীবন-সীমানার ওপারে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্যে। এক অসাধারণ রূপকনির্মিতির মাধ্যমে লেখক ‘খালখসা লাল কংকাল’ গল্পে প্রতিবাদী মানুষের রেখাচিত্র তুলে ধরেন।

‘খালখসা লাল কংকাল’ গল্পে ভোটভিক্ষুক ধনীনেতা ও ভোটাভুটির প্রতি ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী, এই দুই যুযুধান পক্ষ। শেষ পর্যন্ত পোড়খাওয়া ওমেদালী মাতবোরের অতিসচেতন প্রত্যাখ্যানে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয় ভোটপ্রার্থীকে। গল্পটি মামুলিভাবে এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু এরপর আমরা দেখি, গ্রামবাসী একটা খালখসা গরুর লাল কংকাল কাঁধে নিয়ে চলেছে গ্রামের বাইরে দূরে ফেলে দিয়ে আসার জন্যে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রতীকের এই ব্যবহার চমকপ্রদ। যে নির্বাচনপ্রথা নিজেই দূষিত, যার পচনশীল অস্তিত্ব গোটা জনপদের বাতাস বিষাক্ত করে দিতে পারে, খালখসা গরুর লাল লাশটিকে বয়ে নিয়ে গ্রামের বাইরে রেখে আসার মধ্য দিয়ে যেন সেই পরিত্যক্ত নির্বাচনের লাশ বর্জনের ইঙ্গিতই সুকৌশলে ব্যক্ত করা হয়েছে।

মিষ্টিমিষ্টি অঙ্গীকারের লোভে ভুলিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট আদায় করে বিত্তবান সমাজপতি। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর সেই সমাজপতি অবাধ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে বঞ্চিত বুভুক্ষু মানুষের জমিজমা ও মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়। ক্ষুধায়, ব্যাধিতে, মামলায়, ষড়যন্ত্রে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়; কিন্তু তাদের অশান্ত আত্মা বুঝি বায়ুলোক চষে ফেরে প্রতিহিংসার আক্রোশে। পুরনো শত্রুকে মুঠোর মধ্যে পেলে যেন মনের মতো প্রতিশোধ নিয়ে তবে ছাড়বে তারা। ‘ভূতপ্যাদানী’ গল্পে লেখক এমনি এক প্রেতলোকে জনৈক শঠ জননেতাকে নিয়ে হাজির করেছেন। এ নেতার হাতে সর্বস্বান্ত ও মৃত মানুষের প্রেতাত্মারা বাগে পেয়ে নেতাটির ওপর চরম প্রতিশোধ নিয়েছে। এককথায়, এজাতীয় নেতাদের নির্বাচনে নামা ও ধাপ্পাবাজি করার শখ ইহজন্মের মতো মিটিয়ে দিয়েছে। জীবনে আর নির্বাচনে নামবে না, এ-রকম তওবা করে তবে পার পেয়েছেন নেতা।

‘ভূতপ্যাদানী’ গল্পটি বিষয়ের দিক দিয়ে একই সুরে বাঁধা হলেও এর আঙ্গিক বড় বিচিত্র। পরিবেশ ভৌতিক কিন্তু মেজাজ একেবারেই কৌতুকরসাত্মক। কতগুলি অত্যাচারিত ও প্রতিশোধকামী রসিক ভূতের অত্যাচারে জেরবার হয়ে তরফদারের প্রাণান্ত দশা। লেখকের প্রচ্ছন্ন রসবোধ সারা গল্পে প্রস্ফুট।

আগের গল্পের সুর ‘খাদ্যমন্ত্রণালয় কতো দূর’ গল্পেও বজায় রয়েছে। অবহেলিত ও ক্ষুধিত মানুষ খাদ্যমন্ত্রীকে দৈবক্রমে কবলে পেয়ে ভাতের দাবিতে ধাওয়া করে। গাড়ি থেকে উৎখাত বিবস্ত্র ভীত খাদ্যমন্ত্রী সাহেব তাঁর মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান। এই চড়া রঙের উত্তেজক তথা স্যাটায়ারিক ছবিটি ধরে রেখেছে গোটা গল্প। এ ক্ষেত্রেও লেখকের স্বচ্ছ, নির্ভীক ও অভিজ্ঞ দৃষ্টির পরিচয় বিধৃত।

‘খাদ্যমন্ত্রণালয় কতো দূর’ গল্পে বুভুক্ষু জনতা, উলঙ্গ চন্দ্রালোক, ক্ষুধার্ত জনগণের অস্থিকংকালে রূপান্তর, আর তাদের আনুনাসিক খাদ্যপ্রার্থনার আর্তনাদ; সব মিলিয়ে এক পরাবাস্তবময় বীভৎস পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন লেখক। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য, অথচ প্রতীকী প্রয়োগে সফল ও বক্তব্যের দিক দিয়ে যৌক্তিক।

যে ছাত্র-যুবসমাজ রাইফেল কাঁধে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে শরিক হয়েছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা গেল, তাদের জৈবশক্তিকে ক্ষমতাধর সুবিধাবাদী রাজনৈতিক প্রশাসন নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্যে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছে। পরিণামে আদর্শবাদী যুবক সমাজবিরোধী চরিত্রে পরিণত হচ্ছে। মানুষ হয়ে সাধারণ মানুষের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল যে-যুবকের, পরিশেষে দেখা যায়, সেই মানুষ থেকে সে সুদূরে নির্বাসিত। যুবসমাজের এই বিচ্ছিন্নতার ট্র্যাজেডি অতি দরদের সঙ্গে আবুবকর সিদ্দিক অঙ্কিত করেন ‘মানুষ থেকে দূরে’ গল্পে।

এ-গল্পেও লেখকের প্রতীক নির্মাণ যেমন সূক্ষ্ম তেমনি কাব্যময়। একটি সম্ভাবনাপূর্ণ জীবনের নেতিবাচক পরিণামের দিকে এগিয়ে যাওয়া স্তরগুলি অত্যন্ত কৌশলে চিত্রিত হয়েছে।

যে-আদর্শের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর 888sport appsের মাটি থেকে সেসব আদর্শের মূল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে উপড়ে ফেলার চেষ্টা চলে। ফলে দেখা যায়, মেধা ও যোগ্যতা অপমূল্যায়নে নির্বাসিত। অর্থ ও ক্ষমতার জোরে অযোগ্য শক্তি সমাজের মাথায় ডাণ্ডা ঘোরায়। একজন শিক্ষক পর্যবসিত হন অসহায় শিকারে। আদর্শবাদ তো দূরের কথা, সামান্য চাকরির উপার্জনে সৎভাবে পারিবারিক অস্তিত্বটুকু ধরে রাখাও তাঁর হাতের বাইরে চলে যায়। আর পরিশেষে শুধু বাঁচার জন্যেই এই সোনার বাংলা ছেড়ে সুইপারের চাকরি নিয়ে তাঁকে চলে যেতে হয় মধ্যপ্রাচ্যে। এভাবেই ‘চন্দনের ঘূণ’ গল্পে একজন জনপ্রিয় কৃতি অধ্যাপকের করুণ পরিণতি বর্ণিত হয়েছে।

মনে হতে পারে, ‘চন্দনের ঘূণ’ গল্পের মূল বক্তব্যে কিছুটা বাড়াবাড়ি আছে। কিংবা বলা যেতে পারে, একজন প্রগতিশীল লেখকের হাতে বেলাতালীর এই পরিণতি আশা করা উচিত নয়। আসলে এগুলি গল্পের বাহ্য বা স্থূল ব্যাপার। একাত্তর-পরবর্তী 888sport apps এবং আলোচ্য গল্পের অন্তর্নিহিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এমনটিই অনিবার্য ছিল। এক্ষেত্রে লেখকের সমাজসচেতনতার অভাব কিংবা অভিজ্ঞতার পুঁজিতে ঘাটতি পড়েনি।

এই সাতটি গল্পের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী 888sport appsের একটি যুগের জনজীবনের ইতিহাস নির্মোহ রেখাচিত্রে তুলে ধরেছেন আবুবকর সিদ্দিক। এদিক দিয়ে তিনি অবশ্যই তাঁর কালের সৎ ও বিশ্বস্ত রূপকার। সমকালীন রাজনীতি, আর্থসামাজিক সমস্যা ও অবস্থা নিয়ে গল্প লেখায় একধরনের ঝুঁকি আছে। একটু বেখেয়াল হলেই হতে পারে সে-লেখা স্থুল, হতে পারে প্রচারধর্মী। কিন্তু আবুবকর সিদ্দিক এ-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরিমিত বাচনভঙ্গি, সুনির্বাচিত শব্দপ্রয়োগ, নিপুণ প্রতীক ও একেবারে জীবন্ত সংলাপ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে লেখক গল্পগুলি সফল সৃষ্টির পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।

আবুবকর সিদ্দিক অত্যন্ত বাস্তব জীবনঘেঁষা ভাষা নির্মাণ করেন। যেমন –

১. আমাগো ভোট আমরা কুচোয়ে খাবো। গুলে খাবো। তিতেল দিয়ে খাটা খাবো। কচু দিয়ে ব্যানন খাবো। (‘খালখসা লাল কংকাল’)

২. আসাদের বাবা পনচান্নোর পাকানো শরীর; নার্ভের ধার মনে হয় সবটুকু ক্ষয়ে শেষ। ভীষণ ঘামতে পারে ভদ্দরলোক। করে যা হোক এ্যাকটা ছাপোষা চাকরী। আসাদের ব্যাপারটা তাকে কেচে পিটিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। তার ধারণা আসাদের দ্বারা এ খুন হয় নি। তাই এ্যাখনো আশা করছে ছেলে দুএ্যাকদিনের মধ্যে বাড়ি    ফিরে গিয়ে মায়ের হাতে ভাত খাবে। (‘মানুষ থেকে দূরে’)

ভূমিহীন দেশ গ্রন্থের সব গল্পের বক্তব্য মূলত অভিন্ন। তবে বস্তুনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির বেলায় অভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও গল্পের পটভূমি, পরিবেশ-পরিকল্পনা, চরিত্রচিত্রণ, পরিমিত ভাষা ও আঙ্গিকের বিচারে এদের স্বতন্ত্র মর্যাদা অনিবার্যভাবে উপস্থিত। আর সেখানেই লেখকের সার্থকতা নির্ণীত হয়েছে। তিনি সস্তা প্রেম কিংবা নিছক আজগুবি গল্প লিখতে বসেননি। সূক্ষ্ম প্রতীকের আশ্রয়ে একটি বিশেষ সময়ের গ্রামীণ ও শহুরে জীবনধারা তথা সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে লালিত ও পিষ্ট মানুষের জীবনচিত্র এঁকেছেন।

দুই

888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ এবং 888sport appsের অভ্যুদয়, দুটো অঙ্গাঙ্গী ঘটনা এ-উপমহাদেশের সাতচল্লিশোত্তর ইতিহাসে সবিশেষ গুরুত্ববহ। এই যুদ্ধে যাঁরা প্রত্যক্ষ যোদ্ধার ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমাদের উত্তরপুরুষ

চিরকৃতজ্ঞ। সে-সময়ে অনেকেই সাধ্যমতো অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন; কেউ রাইফেল কাঁধে তুলে নিয়ে, কেউ রাজনৈতিক সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে, কেউ বা ‘কলমের তলোয়ার’ হাতে তুলে নিয়ে। আবুবকর সিদ্দিক মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। ১৯৬৯-৭০-এর গণআন্দোলনের দিনগুলিতে রাজপথের মিছিল ও মেহনতি মানুষের সভা-সম্মেলনগুলিতে তাঁর লেখা গণসংগীতের উচ্চকিত আওয়াজ শোনা গেছে। আমরা আজো ভুলিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর ‘ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল’ বা ‘বিপ্লবের রক্তরাঙা ঝাণ্ডা ওড়ে আকাশে’ অথবা ‘পায়রার পাখনা বারুদের বহ্নিতে জ্বলছে’ গণসংগীতের সেই আগুন ধরানো কথাগুলি। এসব লেখার অপরাধে তাঁকে সে-সময় গণবিরোধী শক্তির হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে হয়।

এই ভূমিকাটুকু থেকে স্পষ্টই বোঝা যাবে, 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্পসমূহের মধ্যে আবুবকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭) সংকলনের গল্পগুলি কোথায় ও কেন একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা পায়। প্রতিটি গল্প এই সত্যই জানিয়ে দেয়, তাঁর চেতনার সম্পূর্ণ অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত সংগ্রাম ও পরিণামের সঙ্গে একাকার। তীব্র দায়বদ্ধতা একজন লেখকের 888sport live chatচিন্তাকে শুধু নিয়ন্ত্রণই করেনি, লক্ষ্যবিন্দুটি পর্যন্ত সুস্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত করে দিয়েছে। তাই সাতটি গল্পের একটি গুচ্ছে আমরা পাই আবুবকর সিদ্দিকের বাস্তব অভিজ্ঞতার 888sport live chatদলিল। কোথাও কৃত্রিমতা নেই, নেই কোনো অতিরঞ্জন। আছে একটি উদ্বেল আশা ঘিরে যোদ্ধা হৃদয়ের উচ্চারণ, আর আশাভঙ্গের ক্ষত থেকে ঝরে পড়া ব্যক্তিগত যন্ত্রণা। এজন্য মরে বাঁচার স্বাধীনতা আগামী প্রজন্মের জন্যে একটি মূল্যবান সম্পদ।

‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’ নামটি অনেকটা অভাবিতপূর্ব ও প্রশ্নোদ্দীপক। লাখ লাখ মানুষের রক্তে পিচ্ছিল পথ বেয়ে  স্বাধীনতা আসে ঠিকই কিন্তু আসার পরেও বহু মানুষকে অপমৃত্যু থেকে বাঁচানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাধারণ মানুষ তখন সঠিক অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজে পায়নি। দুর্ভিক্ষ, হাইজ্যাকিং, ধর্ষণ, ঘুষ, চোরাকারবার, মুদ্রাস্ফীতি একাত্তরোত্তর 888sport appsে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বিষয়টি দেশবাসীকে ও বিশেষ করে, পর্যবেক্ষকদের ধরিয়ে দেওয়া বিবেকবান 888sport live footballিকের কর্তব্য। মরে বাঁচার স্বাধীনতা বইয়ের গল্পগুলিতে আবুবকর সিদ্দিক এই সাহসী দায়িত্বটি পালন করেন।

গল্পগুলি পরপর এমনভাবে সাজানো যে, সাতটি গল্প মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে পরিণতি, একটি অখণ্ড ইতিকথা তুলে ধরে। প্রথম গল্প ‘লাশের নাম নেই’ স্বাধীনতাযুদ্ধে উৎসর্গিত একজন প্রগতিশীল লেখকের শহিদ হওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনি। তরুণ লেখকটিকে আর্মি ক্যাম্প থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়ার পর পিছু ধাওয়া করে নদীর তীরে এনে বৃষ্টিভেজা কালোরাতে রাজাকাররা তাঁর লেখা গণসংগীতের পাণ্ডুলিপি ভারতে পাচার করা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সেই গান প্রচারিত হওয়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর পরের ঘটনাটুকু লেখক যে চমকে দেওয়ার মতো ভাষায় বর্ণনা করেন তা পাঠককে অসহ্য যন্ত্রণায় দীর্ণ করে। এই তরুণ যোদ্ধা বেয়নেটের ডগায় পিঠের চামড়া চিরে চিরে যাওয়ার মুহূর্তেও ঠোঁট থেকে আদর্শের গান হারিয়ে যেতে দেন না। সেই গানে ‘নদীর জোয়ার ফুঁসে উঠে। আকাশের ভারী মেঘ প্রচণ্ড নাড়া খায়। কালো বাতাস ছিঁড়ে ফেঁড়ে যায়।’ (পৃ ২১) তরুণের কণ্ঠে গণসংগীতের যে কলি ফুটে ওঠে তা আমাদের পূর্বপরিচিত। সত্তরের গণআন্দোলনে খুলনার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ২১শে মার্চ সন্ধ্যায় খুলনার হাদীস পার্কে যে প্রতিবাদ-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, সেখানে আবুবকর সিদ্দিকের ‘বাংলার ঘরে ঘরে সংগ্রাম জ্বলন্ত/ জানো কি/ বাংলার গাছে গাছে বিদ্রোহ ফলন্ত/ তুমি জান কি!!’ গণসংগীতটি সাধন সরকারের সুরে ও কণ্ঠে গাওয়া হয়। গল্পটিতে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

এর পরের গল্প ‘খতম’। এ-গল্পে আমরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায়ে চলে আসি বটে, তবে প্রচলিত পটে নয়। এখানেও আবুবকর সিদ্দিক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ও রাজনৈতিক তত্ত্বচেতনার নিরিখে মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যতিক্রমী মূল্যায়ন করেছেন। আমরা জানি, একাত্তরের যুদ্ধে দেশের সমস্ত প্রগতিশীল ও আধা-প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন অংশগ্রহণ করে। আমরা এও জানি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারপন্থী নকশালবাদী আন্দোলনের প্রেরণায় একটি অতিবাম-মার্কসবাদী সংগঠন জোতদার-মহাজন খতমের অভিযানে লিপ্ত হয়। সূক্ষ্ম দ্বান্দ্বিক সমস্যার প্রতিফলন ঘটে ‘খতম’ গল্পটিতে। হ্যাঁ, তখন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির করণীয় আগে জোতদারের গলা কাটা, না দখলদার বাহিনীর ধ্বংসসাধন? ‘খতম’ গল্পে এই একটি কূট প্রশ্নে পার্টি-কমরেড তারাপদের বুলেটে খতম হয়েছে তাঁরই পার্টিকর্মী দীনেশ। খুনোখুনির পালা এখানে শেষ নয়, শুরু। দীনেশ হত্যার পরপরই কমরেড তারাপদ খুন হয়ে যায় একই পার্টিকর্মী দীনেশের সুহৃদ আমানের বুলেটে। তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহও সাক্ষ্য দেয়, ওই রণকৌশলগত দ্বন্দ্বে নকশালবাদী মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও কোথাও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরিণামে তখন পারস্পরিক অন্তর্ঘাতী তৎপরতায় অনেক মূল্যবান প্রাণ খোয়া যায়। সেদিক দিয়ে বলতে হয়, 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের একটি জ্বলন্ত প্রশ্নকে ‘খতম’ গল্পে মুখ্য রূপ দিয়ে লেখক তাঁর কমিটমেন্টের শর্ত পূরণ করেন এবং বলেন, ‘আমরা এখন পিপ্ল থেকে কমপ্লিট বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যৎকে মাশুল চুকিয়ে দেয়া লাগবে সবার। মোকাবিলা দাও কমরেড! নইলে আরও দীনেশ খুন হয়ে যাবে এই শুক্লাতিথিতে।’ (পৃ ৩০)

‘এই সেই জয়বাংলা’ গল্পে লেখক পাঠককে একেবারে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ী আদর্শ এবং তার নগ্ন বাস্তব পরিণামের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। মোহভঙ্গের পালাটি সম্পূর্ণ উন্মোচিত করার জন্যে তিনি সঠিকভাবে একটি আকাঁড়া দেহাতি চরিত্রকে বেছে নিয়েছেন। চিরহাভাতে জাতচোর বেচারা লেহাজ একদিন দুর্ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্লায় পড়ে ‘স্বাধীনতা’, ‘দেশপ্রেম’, ‘জয়বাংলা’ ইত্যাদি কতক আদর্শবোধক শব্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আদর্শ দেশপ্রেমিক হওয়ার স্বার্থে সে তার চুরিবিদ্যা ত্যাগ করে সৎজীবন যাপনের সংকল্প নেয়। আকস্মিকভাবেই সে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভবিষ্যতে আদর্শ জীবনযাপনের স্বপ্ন নিয়ে মশগুল থাকে। যুদ্ধ একদিন শেষ হয়। স্বাধীন 888sport appsের মাটিতে পা রেখে পুলকিত হয় লেহাজ। স্বাধীন দেশের আদর্শ নাগরিক হয়ে বাঁচার আকাক্সক্ষায় চোর লেহাজ ভালোমানুষ লেহাজে পরিণত হয়। কিন্তু অচিরেই ধরা পড়ে, এ-পথের পথিক হয়ে ঠকে গেছে সে। অন্ধকারের সুঁড়িপথ ধরে যে যার আখের গুছিয়ে নেয়, শুধু চোর থেকে ভালোমানুষ হওয়া লেহাজের না খেয়ে মরার দশা হয়। কোনো নেতা, কোনো দেশপ্রেমিক লেহাজের দিকে ফিরেও তাকায় না। এমনকি চরম দুর্দিনে তার বউটিও একুব রেশন ডিলারের করতলগত হয়। এইভাবে লেহাজের মানবিক মূল্যবোধটুকু পর্যন্ত হরণ হয়ে যায়। এরপর যে চোরা লেহাজ যুদ্ধের আগে ছিল ‘মেক্কুড়’ অর্থাৎ বিড়ালেরও অধম কাপুরুষ এক ছ্যাঁচড়া জীব, দুর্নীতিবাজ ভণ্ডদের হাতে ঘা খেয়ে সে হয়ে উঠল কালান্তক রাক্ষস। ক্ষুধার তাড়নায় সে পরিণত হয় ফেরারি ডাকাতে। গল্পটির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আয়রনিঘটিত প্রথম আঘাত এই লক্ষ্যবিন্দুটিতে। শেষ আঘাত আরো অমোঘ ও নির্মম। একজন সত্যদর্শী কথা888sport live chatীর কলম এরকম ক্ষমাহীন হয়ে উঠতে পারে। চিত্রটি এরকম : ‘বিকারগ্রস্ত রাক্ষসটি ক্ষুধার তাড়নায় দিবালোকে শহরের রাজপথে নেমে এসেছে। ওদিকে নিউজহকার প্রভাতী খবরের কাগজ বিলি করে যাচ্ছে নতুন খবর হেঁকে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরী!’ আর রাস্তার নর্দমায় তখন কশাইখানা থেকে ভেসে আসা পশুজবাই করা টাটকা দইরক্ত আঁজলায় তুলে পান করছে অনাহারী রাক্ষস Ñ মুক্তিযোদ্ধা লেহাজ। হায়! যাদের উদ্দেশ্যে এ-চাকরি তথা পুনর্বাসনের সুসংবাদ, তারা তখন সেই সংবাদের মর্মগ্রহণযোগ্য বোধবুদ্ধির একেবারে বাইরে। যখন এ-শুভ উদ্যোগ নিলে তাদের স্বাভাবিক মানবধর্মটুকু বাঁচিয়ে রাখা যেত, সেই লগ্নটি অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।’

এই গল্পে এক জায়গায় যুদ্ধ থেকে ফেরা লেহাজকে তার অনাহারক্লিষ্ট বউ বেলোকা যখন তীক্ষè ভাষায় তিরস্কার করে Ñ ‘ইঃ হি রে! কামাইতে গ্যাছলেন! খাউজানি আর হাগনডা কামাইয়া আনছেন। অহনে প্যাডে খোরাক নাই। পিনধনে কাপুড় নাই। ডোল মুড়ি দিয়া গরে বইয়া থাহুম দোনোজনে।

মুই না তোর বিয়ার সোয়ামী? কতার দিগদারিডা কম করস। খোদায় ব্যাজার হইব।’ (পৃ ৩৯)

তখন আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিত্তবান বিলাসী পরিবারের মূল্য জোগাতেই যেন সর্বহারা মানুষ ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’ অর্জন করেছে। গল্পের নামটিতেও বড় শ্লেষ, ‘এই সেই জয়বাংলা’।

সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা আরেকটি গল্পের নাম ‘ফজরালি হেঁটে যায়’। এই গল্পটিতে আবুবকর সিদ্দিক স্বাধীনতাযুদ্ধের ভালোমন্দের দিকগুলিকে একটি তুলাদণ্ডে মেপে উত্তরকালের সমীক্ষার জন্য নিয়ে আসেন এবং তিনি তা করেন প্রতীকের গভীরতায়, সাংকেতিক বর্ণনায় আর কালের সীমা-অতিক্রমী এক চিরন্তন তাৎপর্যে। মুক্তিযোদ্ধা ফজরালি যেন যুগ যুগ ধরে যাবতীয় শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এক অপরাজেয় যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে খানসেনার আক্রমণে একটি পা খোয়া গেছে তার। স্বাধীনতা-পরবর্তী 888sport appsের পথে চলতে হয় ক্রাচে ভর দিয়ে। খোঁড়া, তবু বিশ্রাম বা স্বস্তি তার জন্যে নয়। মানুষের প্রকৃত মুক্তি এখনো অনায়ত্ত। তাই একজন ফজরালি বা তার প্রেতাত্মা রাইফেলের নল বাগিয়ে এখনো স্বাধীনতার নতুন শত্রুকে আঘাত হানার জন্যে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। এই তথ্যটুকু এক কাব্যিক আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন লেখক – হাজার হাজার বছর না লাখ লাখ বছর ধরে বেয়নেট অন্ধকার ফুঁড়ে ফুঁড়ে খুঁজে ফিরছে মলংগির হৃৎপিণ্ড। সেই কবে কোন শতাব্দীতে এক আদিফজরালি মাটির ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে একটা পা তোপের মুখে নজরানা ধরে দিয়েছিল, বদলে তার মা-জননীর পর্দা দীর্ণ হয়েছিল মলংগি মাস্টারের ধর্ষণে। তারপর ভেসে চলে গ্যাছে যুগযুগান্তর। এমনি সময়। কোটিবর্ষ গড়িয়ে যায়। মানুষের দুশমনকে তবু শান্ত করা যায় না। প্রতিবার সে ভোল পাল্টে নেয়। … তাই মলংগিকে ধরা হয় না তার। শুধু খেলা চলে। ধরাছাড়া চোর পুলিশ খেলা যুগ যুগ। একটি দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়কে মধ্যিখানে আড়ালখাড়া রেখে দুজনের কোটীবর্ষব্যাপী এ কালমৃগয়া। সাম্প্রতিকের ফজরালি  এখনো অন্ধ প্রতিহিংসায় বেয়নেট  বাগিয়ে  পাহাড়  পাক দিয়ে ফেরে সাম্প্রতিকের মলংগির সন্ধানে। (পৃ ৫২-৫৩)

বিষয়ের ভয়াবহতার দিক দিয়ে সংকলনের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’ গল্পটি মনে হয় 888sport appsের কথা888sport live footballে বিরল সৃষ্টি। ‘স্বাধীনতা’ একটি সুন্দর শব্দ অথচ তা কত করুণ ও নিষ্ঠুর হয়ে একজন সর্বহারা মানুষের জীবনে একেবারে অর্থহীন হয়ে যেতে পারে, তারই এক আলেখ্য ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’। স্বাধীনতা বলতে প্রচলিত অর্থে আনুষঙ্গিক যা কিছু বোঝায়, সেই সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, রাষ্ট্রযন্ত্র Ñ কোনো কিছুরই অভাব হয়নি এই 888sport appsে। অভাব যা হয়েছে তা হলো, একটি অন্ত্যজ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই আর পেটের হাঁ পুরোবার মতো দু-মুঠো অন্ন। শুধু এই জৈবিক দাবিটুকু মেটানোর দায়ে হরমুজকে নেমে আসতে হয়েছে চরম অমানবিক স্তরে। গল্পের মূল চরিত্র হরমুজ স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষের দিনে নিজের হাতে বেওয়ারিশ লাশ ছিলে ছিলে কংকাল বের করে ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতো। ‘মানুষের হাড়-বেচে বেঁচে গ্যালো হরমুজরা। আসলে ওরা ছিলো এর খুচরো জোগানদার। মুনাফার মোটা অংকটা স্তরে স্তরে চলে যেতো দালাল পাইকের গ্যাঙের পকেটে।’ (পৃ ৫৯) তাই শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর ক্ষুধা হরমুজকে ফুটপাতের কংক্রিটে চিৎ করে পেড়ে ফেলেছে। প্রাণ বাঁচানোর তীব্র তাড়না জ্যোৎস্নারাতে তাকে নিয়ে গেছে গোরস্তানে। মধ্যরাতের ভৌতিক পরিবেশে সে যখন কবরের লাশ তুলে হাঁটুর ওপর পেতে ধরে এবং আকাশের পূর্ণচাঁদের দিকে তাকিয়ে খুশিতে বিকৃত স্বরে হেসে ওঠে এবং একটু পরে সেই লাশের বুকের মাংসে গোগ্রাসে কামড় বসায়, তখন সমস্ত ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। যেন এ-মুহূর্তে নস্যাৎ হয়ে যায় গোটা মুক্তিযুদ্ধপবের্র সমস্ত রক্তপাত – যাবতীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা। তবে সুবিধাবাদী চরিত্রের ধনী হয়ে ওঠার যে ইতিহাস, আর্থসামাজিক যে পরিপ্রেক্ষিত, তার পশ্চাদভূমিতে এই চিত্র হয়তো অস্বাভাবিক নয়। এক অদ্ভুত পরাবাস্তব আবহে গল্পটি সাজানো, যা এই গল্পটাকে বিশিষ্ট করেছে। গল্পকারের বর্ণনা থেকে একটু দৃষ্টান্ত – সদ্য মাটি চাপানো একটা কবরের মুখ আলগা করছিলো দুটো শেয়াল। হরমুজকে দেখে একটু থামে। সরে দাঁড়ায়। একপাশে গর্তের মুখে একটা টাটকা মাথা টেনে তুলে রেখেছে। হরমুজের চোখদুটো চাঁদের বিপরীতে ঝক ঝক করে শানিয়ে ওঠে। উবু হয়ে একবার দেখে নেয় মানুষের ছেঁড়া মুড়োটা। একবার নাক নামিয়ে প্রাণপুরে ঘ্রাণ নেয়। তারপর মাথা খাড়া করে প্রকাণ্ড হাঁ মেলে পিশাচের মতো হেসে ওঠে  :

অহঃ – অহ্ঃ! অহ্ঃ – অহঃ! (পৃ ৬৪-৬৫)

এরপরের গল্প ‘রক্তগর্জন’। বিষয়ের দিক দিয়ে অনেকটা ‘ফজরালি হেঁটে যায়’ গল্পের মতো। তবে ঘটনার সূত্রপাত স্বাধীনতা-উত্তরকালের। সুর সেই একই। লাখ লাখ মানুষের বুকের রক্তে স্বাধীনতা আসে, অথচ দেখা যায় স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গণশত্রুরা আবার নতুন কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়ে যায় প্রগতিশীল চরিত্র। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে ঘরে দোর দিয়ে আটকে রাখা হয়। আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের জোরে একদা রাজাকার ও বর্তমানে নয়া মুক্তিযোদ্ধা দাপটের সঙ্গে সমাজের সুযোগ-সুবিধা লুটে নেয়। মূল মুক্তিযোদ্ধা লাহু বিবেকের তাড়নায় মরিয়া হয়ে জানালা ভেঙে বাইরে ছুটে আসে। ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতার দুশমনদের ওপর। গল্পের শেষে দেখা যায়, পুলিশ হাতের কাছে লাহুকে পেয়ে গ্রেফতার করে। গল্পের শেষ বাক্যটি অত্যন্ত তির্যক ও তাৎপর্যপূর্ণ,  ‘লাহু স্পষ্ট দেখতে পায়, কয়েক কোটি লোহার হ্যাণ্ডকাফ ধীরে ধীরে নেমে আসছে 888sport appsের মাটি লক্ষ্য করে।’ (পৃ ৭৫)

একেবারে শেষের গল্পটি পরিসরে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শানিত বক্তব্যের শক্তিতে তীব্র। যে-মুক্তিযোদ্ধাদের দৌলতে আজ আমরা স্বাধীনতার ফল ভোগ করছি, তাঁদের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে বাধে আমাদের। প্রতিবছর স্বাধীনতার বিশেষ দিনটিতে তাঁদের জন্য রুটিনমাফিক অনুষ্ঠান হয়। আহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের এনে মঞ্চের সামনে সারি দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। জাঁহাবাজ বক্তাদের মাইক-ফাটানো বক্তৃতায় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। এই প্রহসনকে ক্ষমাহীন ভাষায় আঘাত করেছেন আবুবকর সিদ্দিক।

সেদিক দিয়ে ‘খোঁড়া সমাজ’ গল্পটি আমাদের চৈতন্যের চাবুক।

মরে বাঁচার স্বাধীনতা গ্রন্থের গল্পগুলি মিলিয়ে একটি সুরই প্রধান হয়ে ওঠে, গতানুগতিক সেøাগানমুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন। দেশ ও মানুষকে হৃদয়ে নিবিড়ভাবে ধারণ করতে না পারলে এত গভীরভাবে ব্যাপারটিকে তলিয়ে দেখা সম্ভব হতো না। গল্পগুলি পড়ার সময় মনে হয়েছে, হয়তো সরলীকরণের ফাঁদে আটকে যাবে লেখকের কলম, কিন্তু আশ্চর্য সংযম ও কুশলী ভাষা লেখককে নিরাপদে পার করে নিয়ে গেছে। আবুবকর সিদ্দিক একজন কবি, তাই ভাষায় তাঁর চমৎকার দখল।

আবার এটাও স্বস্তির কথা যে, কবিত্বের অনুচিত স্পর্শদোষে শ্লথ হয়নি বর্ণনার গতি। বরং কোথাও প্রতীকের চমৎকার ব্যবহারে, শব্দের প্রয়োগে, চিত্রকল্পের অভিনবত্বে ও সাহসী বক্তব্যে গল্পগুলি গতি পায়। যেমন Ñ ‘টেকনাফের জলসীমা থেকে ক্রোধ ফুঁসে ওঠে, উঠতে উঠতে তেঁতুলিয়ার উত্তরে কালো হিমালয় ছোঁয়। স্বাধীনতা দাও। বদলে দেবো দেহমন বিরাম ঘুম।’ (পৃ ৭০) সব মিলিয়ে বলতে হয়, আবুবকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা গল্পগ্রন্থটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কথা888sport live footballে মূল্যবান সংযোজন।

তিন

আবুবকর সিদ্দিক আলোচিত গ্রন্থ দুটি ছাড়াও ডজনখানেক প্রথাবিরোধী গল্পের বই আর চারটি 888sport alternative link, 888sport app download apk লিখেছেন।  তাঁর বয়স ২০২৩ সালে নব্বই স্পর্শ করবে। তিনি বর্তমানে লিখতে পারেন না, চলাফেরাও বন্ধ; কিন্তু বই-পত্রিকা পড়ার বাসনা বরাবরের মতোই বিদ্যমান। কথা বলতে শুরু করলে ফেলে আসা 888sport sign up bonusর ঝাঁপি আর বন্ধ হতে চায় না। সদাপ্রগতিশীল, বামপন্থী চিন্তাভাবনায় ঋদ্ধ, গুণী অধ্যাপক ও সমাজজীবনের প্রতি দায়বদ্ধ 888sport live footballিক আবুবকর সিদ্দিককে জানাই ভক্তি ও 888sport apk download apk latest versionর্ঘ্য।

Published :


Comments

Leave a Reply