রেনেসাঁসপ্রাণিত ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ সমাজে শিক্ষা, সমাজচিন্তা ও বাঙালির জীবনসাধনা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে বিলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, পশ্চাতে ফিরে তাকালে এই স্পন্দনকে কত না তাৎপর্যময় বলে মনে হয়।
রামমোহনের আবির্ভাব, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান, সতীদাহ প্রথা বিলোপ ও ডিরোজিওর সঙ্গে যুক্তিনিষ্ঠতা তাঁর প্রমাণবহ। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং বহুবিবাহ রোধ ও স্ত্রীশিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে। কুলীন প্রথার ফলে ভারতীয় 888sport promo codeর বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে তিনি সর্বদা খুবই বিচলিত ও চিন্তিত ছিলেন। তাঁর অবলোকন ও অনুধাবন শুধু মানবিক হওয়ার সাধনাকে দীপিত করেনি, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রকেও করেছিল আলোড়িত। এই আলোড়ন মানবিকতার স্বরূপ সন্ধানের কাজেও তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল উত্তরকালে। যুক্তিকে মর্যাদার সঙ্গে অবলোকন করতে শিক্ষা দিয়েছিল। রেনেসাঁর মর্মমূল ও চেতনা নিয়ে যে বিতর্ক আছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে, তা সত্ত্বেও এই জাগরণ বাঙালির জীবন আবহে দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাসে ও যুক্তিবাদিতায় এক তরঙ্গ তুলেছিল। ধর্মবোধেও এনেছিল নবীন জিজ্ঞাসা। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে তাঁর আস্থা ছিল না।
ইয়ং বেঙ্গল যুবকদের অদম্য ও অনমনীয় কর্মপ্রবাহ সমাজদেহে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ঠিকই; কিন্তু পরবর্তীকালে ডিরোজিওর মৃত্যু ও শূন্যতা, ডিরোজিওর সহযোদ্ধাদের একাংশের সমাজের রীতিনীতির কাছে আত্মসমর্পণ কোনো বৃহৎ সুফল বয়ে আনেনি ঠিকই; কিন্তু যে আলোড়ন তুলেছিল তা দীর্ঘদিন ব্যাপ্ত ছিল সমাজদেহে। ডিরোজিওর মৃত্যুর পর সমাজ অগ্রগতির জন্য বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ কাজ সমাজ সংস্কার হলেও আলোড়ন বা তরঙ্গ যৎসামান্য ম্লান হলেও ইয়ং বেঙ্গলরা আলোকায়নের জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তা স্তিমিত হয়ে যায়নি। যদিও আমরা জানি, বাংলা গদ্যের ভিত নির্মাণও তাঁর অনন্য কাজ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য গ্রন্থ রচনা তাঁকে দেড়শো বছর ধরে প্রাতঃ888sport app download for androidীয় করে রেখেছে। তিনি এক্ষেত্রে খোলাখুলি কোনো বক্তব্য দেননি, তবে অনেকের লেখা পাঠ করে আমরা জানি যে, বিগত একশ সত্তর বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থগুলো পঠিত হয়ে আসছে।
ডিরোজিওর মৃত্যু ও শূন্যতা সৃষ্টি হলেও তাঁরা যে জিজ্ঞাসা-সঞ্চারিত করেছিল প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তা একটি অনড় সমাজকে শিক্ষিত করার জন্য খুবই তাৎপর্য বহন করে।
বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারের জন্য অব্যাহত ধারায় যে কর্মপ্রবাহে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিলেন তার নানা দিক নিয়ে যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিকরা বিশ্লেষণ করেছেন। বাঙালির জীবনধারায় অল্প বয়সেই একনিষ্ঠ এই ব্রাহ্মণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজে প্রচলিত বিধি নিয়ে জিজ্ঞাসামুখর হয়ে উঠেছিলেন তা আজো বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাঁর ব্যক্তিস্বরূপে ছিল একাগ্র হওয়ার সাধনা ও দৃঢ়তা। শৈশব কেটেছিল নিদারুণ অর্থকষ্টে। তবুও সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।
বিদ্যাসাগরের কৈশোরকালের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এসবের সত্যতা যে নেই তা নয়, তাঁর মৃত্যুর পর রচিত গ্রন্থ ও বিবরণ থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি তাঁর মনুষ্যত্বের স্বরূপ ও মানবিক গুণাবলি কত প্রখর ছিল। তবে অতিরঞ্জনকে পরিহার করে যে অনন্য ব্যক্তিত্ব আমাদের চোখে ঝলমল করে ওঠে তাঁর মূল্য ও তাৎপর্য দ্বিশততমজন্মবার্ষিকী উদ্যাপনকালেও খুবই গভীর বলেই মনে হয়।
ডিরোজিওর মৃত্যুর পর সমাজের প্রতিকূলতার মধ্যেও নবগঠিত প্রজন্ম তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। ডিরোজিও মানবিক যুক্তিবাদের যে বীজ বপন করেছিলেন তাতে তারা জলসিঞ্চনে প্রয়াসী ছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এই শিক্ষাবিদ এক সত্যনিষ্ঠ, চরিত্রবান, স্বদেশপ্রেমী এক নির্ভীক যুবদল গড়ে দিয়েছিলেন। ইয়ং বেঙ্গল নামে এই দলটির আদর্শ ও নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিল। একদল পাশ্চাত্য শিক্ষা ও দর্শনশাস্ত্রে ডিরোজিওর কাছে শিক্ষালাভ করায় যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছিল। সমাজজীবনের নানা অসংগতি ও প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের তারা বিরোধী ছিলেন। কৌলীন্য প্রথার কঠোর সমালোচক ছিল। এই গোষ্ঠীর মুখপত্র এনক্রোয়ার ও জ্ঞানান্বেষণে এ-প্রথার নিন্দা করে লেখা প্রকাশিত হয়। এই সময় থেকেই কৌলীন্য প্রথা সম্পর্কে বাঙালি চিন্তানায়করা সচেতন হয়ে উঠতে থাকেন। রামমোহন-অনুরাগী প্রসন্নকুমার ঠাকুর রিফর্মারে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধনে লেখেন, কৌলীন্য প্রথা সমাজের পক্ষে হানিকর, এর ফলে কুলীন পত্নীদের ও বিবাহবঞ্চিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্যভিচার বৃদ্ধি পায়, সমাজে নৈতিকতার হানি হয়, জন888sport free bet বৃদ্ধির গতিও হ্রাস পায়। যে-কোনো সভ্য সরকারের কাছে এ ধরনের প্রতিটি ক্ষতিই মারাত্মক এবং যেহেতু এই প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়, তাই সরকারের অবশ্যই তা নিবারণ করা উচিত। এ-বিষয়ক আইন প্রণীত হলে অসংখ্য নিরীহ 888sport promo code দাসত্ব বন্ধন, হাজার পাপ ও অবমাননার হাত থেকে রেহাই পাবেন। ইংলন্ডে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, তাই ব্রিটিশ প্রজা হিসাবে ভারতীয়রাও এই আইন সম্প্রসারণের প্রার্থনা জানাতে পারে। এ প্রথা যে একই সঙ্গে ব্রিটিশ ও হিন্দু শাস্ত্রবিরোধী তার উল্লেখ করতেও সম্পাদক ভোলেননি। উনিশ শতকের তিরিশের দশকেই বিষয়টি নিয়ে সমাচার দর্পণের সঙ্গে সমাচার চন্দ্রিকার বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। এ-বিষয়ক বিতর্কের রেশ 888sport app পত্রিকাতেও লাগে। ইন্ডিয়া গেজেট, ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া, ক্যালকাটা খ্রিষ্টান অবজারভার প্রভৃতির মতো সাহেবি পত্রিকাও।
মাত্র তেইশ বছর বয়সে ডিরোজিওর মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু নবজিজ্ঞাসা-আলোড়িত যে-যুবকদের রেখে গেলেন তাঁদের মধ্যে রসিককুমার মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ সিকদার, পিয়ারীচন্দ্র মিত্র, মাধবচন্দ্র মল্লিক, মহেশচন্দ্র ঘোষ, গোবিন্দ্রচন্দ্র বসাক উল্লেখযোগ্য।
এই পটভূমিতে তাঁর আবির্ভাব বিদ্যাসাগরের কর্মপ্রবাহ যুক্তিনিষ্ঠ ও সত্যনিষ্ঠ আবহ সৃষ্টি করেছিল। তিনি যুবা বয়সেই অনুধাবন করেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। সেজন্য তিনি যখন শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন তখন থেকেই ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে যে চারটি লেখা লিখেছিলেন তা বোধকরি সেকালে বিদ্যাসাগর চর্চায় নবমাত্রা সঞ্চার করেছিল। সমাজ সংস্কার, শিক্ষাক্ষেত্রে তো বটেই, তাঁর অবদানকে তিনি সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাংলাভাষা নির্মাণের কুশলী ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক দিক থেকে বিদ্যাসাগর চর্চার ওপর রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর নানা দিক থেকে বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক স্বরূপ বিশ্লেষণ হয়েছে, তাঁর জীবনের নানা দিক তাতে উন্মোচিত হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পূর্বে তাঁর ট্র্যাজিক নিঃসঙ্গতা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এইসব অনুসন্ধানী রচনায়। কর্ণাটকে সাঁওতালদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ও সারল্য এবং ওই অঞ্চলের মানুষদের বিশেষত বৃহত্তর অর্থে সাঁওতালদের ওপর আমৃত্যু তাঁর নির্ভরতা বিদ্যাসাগরকে ও তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যকে এক অনন্য মানুষ করে তুলেছিল। তাঁর সমাজ সংস্কার, উদারতা ও মানবিক কল্যাণ আকাঙ্ক্ষা ও সামগ্রিক কর্মপ্রবাহ এবং কর্মকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য তাঁর অনমনীয় পর্যবেক্ষণে মনে হয় তিনি বাঙালি ছিলেন না। ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের সকল মর্মকে ধারণ করে অনন্য এক সমাজ সংস্কারক হয়ে উঠেছিলেন। তালতলার চটি, ধুতি ও চাদর তাঁর বেশভূষা ছিল। এই সাধারণত্ব নিয়েই এক অসাধারণ বাঙালি রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। ইংরেজ সিভিলিয়ান ও লাট ভবনে যেতেন তিনি এই পোশাকে। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর ১২৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে ও আসন্ন দ্বিশততমজন্মবার্ষিকী উপলক্ষ করে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রণীত হচ্ছে। এ সকল গ্রন্থ ও তাঁকে গভীরভাবে গবেষণা ও অধ্যয়ন-প্রয়াস দেখে প্রতীয়মান হয় তিনি আজো প্রাসঙ্গিক ও সজীব।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.