আমাদের পরমপ্রিয় কাইয়ুমভাই

সমরজিৎ রায় চৌধুরী

প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৫৯ সালে সরকারি চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে তিনি শিক্ষক হয়ে আসার পর। আমি তখন ওই বিভাগে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বেশ গভীরতা হতে থাকে। সে-সময়ে আমরা বার্ষিক চিত্র-প্রদর্শনীর জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম। তখন গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে আমরা দুজন শিক্ষক পেলাম। অন্যজন প্রখ্যাত চিত্র888sport live chatী কামরুল হাসান। তিনি আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। কাইয়ুমভাই এ-বিভাগে যোগদানের পর সাত-আট মাসের মাথায় তাঁকে নিয়ে BISCIC-র under-এ নতুন বিভাগ Design Center-এ যোগদান করেন। সেখানে কামরুল হাসান স্যার Chief Designer হিসেবে এবং কাইয়ুমভাইসহ আরো প্রায় ছয়-সাতজন 888sport live chatী Designer হিসেবে যোগদান করেন। এর প্রায় তিন বছর পর ওই নতুন বিভাগে ভালো না লাগায় পুনরায় ১৯৬৩ সালে পূর্বের জায়গায় অর্থাৎ সরকারি চারু ও কারুকলায় Graphic Design বিভাগে যোগদান করেন। আমিও তখন সেখানে একই বিভাগে ১৯৬০ সাল থেকে কর্মরত ছিলাম। তিনি তখন সেখানে একই বিভাগে আমাকে সেদিন শিক্ষক হিসেবে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমিও পুনরায় তাঁকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। কামরুল হাসান স্যারের জায়গায় বিভাগীয় প্রধান হয়ে আসেন খাজা শফিক আহমেদ স্যার। এ-বিভাগে আসার আগে তিনি ছিলেন Painting বিভাগের শিক্ষক এবং Painting বিভাগের নাম ছিল তখন Fine Art Dept.। তখন Graphic Design বিভাগের নাম ছিল – Commercial Art Dept.। কাইয়ুমভাই এই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে ক্লাস নিতে শুরু করলেন। গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতিটি বিষয়েই তাঁর দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। এভাবে একদিন final  yr.-এ পোস্টার করাবেন বলে স্থির করলেন। প্রথম পোস্টার করাবেন তিনি, তাই তাদের বলে দিলেন প্রস্ত্ততি নিতে। ২০র্ x ৩০র্ মাপের যথারীতি board তৈরি করতে হবে; গ্রামবাংলার poster করতে হবে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো বিষয়বস্ত্ত পোস্টারের জন্য নির্বাচনও করতে হবে। কিছু বিষয়বস্ত্তর নাম বলে দিলেন, যেমন – ‘মাছধরা’, ‘গুণটানার দৃশ্য’, ‘নৌকাবাইচ’, ‘নদীতীরে সারি সারি নৌকা’, ‘সবুজে ঘেরা গ্রামের দৃশ্য’; সঙ্গে আছে কলাগাছ, তালগাছ, বেদে নৌকা, বাবুই পাখির বাসা, গ্রামের মেয়েরা কলসিকাঁখে সাঁঝের বেলায় পানি নিয়ে ঘরে ফিরছে ইত্যাদি।

ছাত্রছাত্রীদের প্রথমে ছোট করে পোস্টারের layout তৈরি করতে বললেন। ছাত্রছাত্রীরা layout করেছে ঠিকই কিন্তু কাইয়ুমভাইয়ের সেগুলো মোটেই পছন্দ হয়নি। পরে প্রত্যেককে কাইয়ুম স্যার নিজে প্রতিটি বিষয়ের ওপর আলাদা আলাদা করে layout তৈরি করে দিলেন। পোস্টার আঁকার ঢং বা style একটু আলাদা। কাইয়ুমভাই সেই style বা ঢং বজায় রেখে ছোট করে সবার জন্য layout প্রস্ত্তত করে দিলেন এবং বললেন poster-এর size enlarge করতে। কাইয়ুমভাই তাঁর দক্ষতার গুণে সবগুলো layout একদিনেই ছাত্রদের করে দিলেন। গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতি তাঁর দক্ষতা ও অনুরাগের কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। কাজগুলো ছিল রং, স্টাইল ও বিষয়বস্ত্তর দিক দিয়ে অবিশ্বাস্য চমৎকার ও নান্দনিক। আমার দৃষ্টিতে সে-ডিজাইনগুলো এখনো জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। কাইয়ুমভাই বলতেন – ‘পোস্টার যাতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে, এমনভাবে করতে হবে। উজ্জ্বল রং ব্যবহার করতে হবে। কাইয়ুমভাইয়ের নির্দেশে করা পোস্টারগুলো পরে ক্লাসের দেয়ালে টানিয়ে রাখা হয়েছিল। 888sport app ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো প্রতিদিনই দেখতে আসত। শিক্ষকরাও সেগুলো দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। আবেদিন স্যারও সেগুলো দেখে বেশ খুশি হয়েছিলেন। কাইয়ুমভাই ছিলেন Fine Art অর্থাৎ Drawing and Painting বিভাগের ছাত্র। কিন্তু তিনি উভয় বিষয়েই সমান দক্ষ ছিলেন। তিনি প্রতিটি বিষয়ই এভাবে দেখিয়ে দিতেন। এটাই ছিল তাঁর শিক্ষকতার ধারা। ছাত্রছাত্রীরা এ-শিক্ষায় খুব লাভবান হতো। তিনি ছাত্রছাত্রীদের বলতেন – ‘ভালো কাজ করতে হলে সব সময়ই দেশ-বিদেশের ভালো ভালো কাজ দেখতে হবে। নিখুঁতভাবে কাজ করতে ড্রইং শিখতে হবে। তবেই কিছু শিখতে পারবে।’ কাইয়ুমভাই গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতিটি বিষয়েই সমান দক্ষতার গুণে একজন আন্তর্জাতিক মানের Graphic Designer হতে পেরেছিলেন। 888sport appsের বড় প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের logo design তিনি করেছেন। বিয়ের কার্ড, নানান অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র, কয়েক হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ, কয়েকশো নাটক ইত্যাদির রঙিন পোস্টার, পত্র-পত্রিকার নামপত্র ইত্যাদির নান্দনিক গুণে আমাদের মতো সাধারণেরও রুচির বিকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছি।

888sport live chatকলার জগতে তাঁর অবদান অসীম। পোশাক-পরিচ্ছদেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত রুচিবান মানুষ। একজন সুবক্তা হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। উচিত বক্তা, মার্জিত ব্যবহার, শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদি সব গুণই ছিল তাঁর মধ্যে সমানভাবে। আমার সঙ্গে এক ছাত্রের পরীক্ষার  result-এর ব্যাপারে বেশ রূঢ় ব্যবহার করতে দেখে তিনি তার ওপর রুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ তাকে কক্ষ থেকে বের করে দিলেন এবং বললেন, – ‘ভালো ব্যবহার শিখে তারপর চারুকলা ইনস্টিটিউটে আসবে, অন্যথা নয়।’ তৎক্ষণাৎ ছাত্রটি আমার কাছে মাফ চেয়ে রক্ষা পেল। কাইয়ুম স্যার শেষে তাকে বলেছিলেন – ‘শিষ্টাচার শিখে চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসবে। এর আগে এখানে ঢুকতে পারবে না।’ পরে অবশ্য সেই ছাত্রটির আচার-ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল।

কাইয়ুমভাই বেশ রসিক মানুষও ছিলেন। আলাপচারিতার মাঝে বেশ রসিকতাও করতেন। রসিকতার মাপকাঠি ছিল মার্জিত। তিনি ছবি আঁকার মতো গান শুনতেও বেশ ভালোবাসতেন। তার 888sport app download for androidশক্তিও ছিল বেশ প্রখর। তিনি দেশ-বিদেশের অজস্র সংগীত, সিনেমা, কবিদের 888sport app download apk, ভালো ভালো বিষয়ের 888sport live ইত্যাদি পাঠ করেছেন। অনেক বিষয়ের ওপর বিতর্ক করতে পারতেন। বহু আগে পড়া ও শোনা বহু বিষয়ের বিস্তারিত নিখুঁতভাবে মনে রেখে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এমন 888sport app download for androidশক্তি বিরল দেখা যায়। এই বিরল প্রতিভার গুণে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। খুব ভালো ছড়াকারও ছিলেন তিনি। বেশকটি ছড়ার বইও আছে তাঁর। পুরনো দিনের বহু গানের রেকর্ড তাঁর সংগ্রহে এখনো সযত্নে আছে। সব জিনিসের প্রতি তিনি যত্নবান ছিলেন। তিনি নিয়মিত গান শুনতেন। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদ, আববাসউদ্দীন, লালনগীতি, ডিএল রায় প্রমুখ খ্যাতনামা ও বরেণ্য ব্যক্তির গান তিনি নিয়মিত শুনতেন। এটি তাঁর প্রতিদিনের একটি নিয়মিত অভ্যাস ছিল। তিনি এসব পুরনো দিনের গানের recordগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখতেন। ছবির মতো গানকেও তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। গানের প্রতি তাঁর এত দুর্বলতার জন্য এই মহান 888sport live chatী তাঁর আমূল্য জীবনের শেষ দিনেও রাতভর একটি Musical Conference-এ (Bengal Foundation-আয়োজিত) গান শুনতে শুনতে আকস্মিক heart attack-এ সবার মায়া-মমতা কাটিয়ে চিরবিদায় নিলেন। এই মহান আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।