আমাদের শিউলিমালার

জাকির তালুকদার

তখনো, আসব-আসব করলেও, আমাদের ঘরে-ঘরে ডিশ অ্যান্টেনা আসেনি। মুম্বাই-নায়িকাদের ঊরু-ভুরু-শরীর দেখিয়ে প্রতিরাতে তখনো 888sport apps থেকে হাজার হাজার ডলার কামিয়ে নিতে শুরু করেনি ভারতের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। আবার এসব নায়িকাকে দেখে-দেখে সেসব ডিজাইনের জামা-কাপড় বানাতে শেখেনি আমাদের শহরের মেয়েরা। তখনো আমাদের মেয়েদের কামিজগুলোর বুকে-পিঠে এতটা উদোম জায়গা থাকত না, বুকের কাছে এতটা টাইট থাকত না তাদের জামা, নিতম্বের ঠিক ফুলে-ওঠা জায়গাতে এসে শেষ হয়ে যেত না জামার ঝুল, কামিজের দুই পাশের ফাঁড়া এতটা উঁচু হয়ে কোমরের পুরো ভাঁজ প্রদর্শন করতে পারত না। এমনকি এত বোরখাও মেয়েরা তখনো পরতে শুরু করেনি। বোরখার মডেল যে এত কামোত্তেজক হতে পারে, যুবতী-শরীরের বাঁকগুলোকে ঢেকে রাখার বদলে এতটা প্রকট করে তুলতে পারে, এমন চিন্তা মাথাতেই আসেনি 888sport appsি কোনো ডিজাইনারের।

সেই সময়, মানে মাত্র বছর কয়েক আগে, শিউলিমালা ছিল আমাদের শহরের হিট। শহরজুড়ে দিকে দিকে সাড়া তুলে দিয়েছিল শিউলিমালা। আগুনের প্রদীপে পতঙ্গ হতে-চাওয়া যুবকদের কাছে শিউলিমালা ছিল একেবারে জ্বলন্ত মশাল। আসলেই সবসময় জ্বলন্ত মশাল হয়েই থাকত শিউলিমালা। মশাল পুরো শিখা নিয়ে জ্বলতে থাকলে যেমন তার আলোর আগুন এবং আঁচ পেরিয়ে কারো চোখই মশালের গা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, যেমন বোঝা যায় না মশালটা কোন ধরনের বাঁশ কেটে বানানো, সেই বাঁশের গা এবড়ো-খেবড়ো না চকচকে, বোঝা যায় না মশালের গায়ে ধোঁয়ার প্রলেপ পড়ে সেটি কালচে হয়ে উঠছে কিনা সেইরকম

শিউলিমালার আলগা চটক এতই বেশি ছিল যে তাকে দেখে কখনোই বোঝা যেত না, আসল মালা ফুপু ঠিক কী রকম দেখতে। তখন এরকম পোশাকের ডিজাইন না থাকলেও নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার ডিজাইনের কোনো অভাব ছিল না। আসলে ডিজাইনের অভাব কোনোদিনই হয়নি। এই মফস্বল শহরের তুলনায় পোশাক-আশাকে, গেটাপ-মেকাপে, চলাফেরায় শিউলিমালা এত বেশি অগ্রসর যে, সে একবার কোনো যুবকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলে সে তৎক্ষণাৎ তার ক্রীতদাসখতে মুচলেকা দিয়ে দিতে রাজি ছিল। যুবকদের স্ত্রীরা স্বামীদের বাইরে যাওয়ার সময় তাদের নিজ-নিজ স্বামীর বুকে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিত। 888sport app বিপদের মতো তারা যেন শিউলিমালার সামনা-সামনি না পড়ে। তাদের কাছে শিউলিমালা হয়ে উঠছিল কামরূপ-কামাখ্যা থেকে ডাকিনিবিদ্যা শিখে আসা মহিলাদের মতো বিপজ্জনক। যুবকমাত্রকেই ভেড়া করে রাখার ক্ষমতা ছিল তার। আমরা ষোলো বন্ধুর মধ্যে তেরোজন তখন কেউ আইএ, কেউ আইএসসি, কেউ আইকম পাশ করে চলে গেছি শহর ছেড়ে অন্য শহরে উচ্চশিক্ষা নিতে। মফস্বল শহরের এই এক অসুবিধা। সে তার মোটামুটি মেধাবী ছেলেমেয়েদের ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরে আর নিজের কাছে ধরে রাখতে পারে না। আমরা কেউ পড়তে গেছি রাজধানীতে, কেউ বিভাগীয় শিক্ষানগরীতে, কেউ ব্রহ্মপুত্রপারের কৃষিবিদ্যার শহরে। বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার একটা জাঁক আছে। সেখানে আমাদের সহপাঠিনী অনেক। তাদের মধ্যে অনেকেই ভয়াবহ রূপসী। অনেকে প্রচন্ড মেধাবিনী। অনেকে অবাক করা ব্যক্তিত্বময়ী। আমরা সেই প্রথম শিখেছি যে, ছেলেতে-মেয়েতে প্রেম ছাড়াও অন্য নানারকম সম্পর্ক হতে পারে। অর্থাৎ আমরা আমাদের ভাষায় অনেক উচ্চমার্গে উঠে গেছি। কিন্তু তারপরও শিউলিমালার কথা আমাদের প্রত্যেকেরই মনে থেকেছে। ঈদ-পরবের ছুটিতে, কিংবা শীত-গ্রীষ্মের ছুটিতে, কিংবা রাজনৈতিক হানাহানিজনিত ছুটিতে বাড়িতে এসে একত্রিত হলে আমাদের আড্ডায় কথাচ্ছলে কোনো-না-কোনোভাবে শিউলিমালা ঢুকেই পড়ে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যে তিনজন এই শহরে থেকেই ডিগ্রি কলেজে পড়ছে, তাদের কাছ থেকে শহরের 888sport app খবরের মতো শিউলিমালার সর্বশেষ তৎপরতার খবরও জানতে চাই। মজনু এবং মিলন মহাউৎসাহে আমাদের শিউলিমালার গল্প শোনায়। কিন্তু হাসানকে দেখতাম শিউলিমালার নাম উঠলেই নিদারুণ বিরক্তিতে নাক কোঁচকাতে। কখনো-কখনো বলেই ফেলত, বড় শহরে এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে গিয়েও আমাদের মানসিকতার আদৌ উন্নতি হয়নি। হলে আমরা শিউলিমালার মতো নেহায়েত ফ্যাশনসর্বস্ব এবং শরীরসর্বস্ব একটা মেয়ে, যে কিনা কোনো পরীক্ষায় থার্ড ডিভিশনের ওপরে পায়নি, তাকে নিয়ে সময় নষ্ট করতাম না।

আমাদের মধ্যে রুহুল তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দারুণ ভক্ত। 888sport app ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বিশ্ব888sport live football কেন্দ্রের পাঠচক্রে যায়। সে হাসানের কথার জবাবে সায়ীদ স্যারের জবানীতে স্ট্রেট বলে – একটা সুন্দরী মাইয়ার আর কোনো যোগ্যতা লাগে না। সে সুন্দরী। ব্যস হয়া গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভচকানো চাপার পন্ডিতের লেকচার শোনার চায়া সুন্দরী মাইয়ার এক মিনিটের ফালতু কথা শোনাও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তাই কইলেই যে-কোনো কথা সত্যি হয়া যাবি?

শুধু সায়ীদ স্যার না। আহমদ ছফাও এই রকমই করে। আহমদ ছফারে চিনস?

চিনি না। কিন্তু লেখা পড়ছি।

কী মনে হয় লেখা পইড়া? মনে হয় না যে, অসাধারণ এক মনীষী পাইছি আমরা?

তাই তো মনে হয়।

সেই ছফাভাই আজিজ মার্কেটের দুই তলায় বসে। তার ঘর আছে একখান। উত্থানপর্ব নামে। সেই ঘরে রাজ্যের সব চিন্তাবিদ জড়ো হয়। নানান গভীর চিন্তার কথাবার্তা চলে।

ভালো। তা এইখানে ছফাভাইয়ের কথা ক্যান?

আরে সেইডাই তো কইতাছি। ধর যে-কোনো বিষয় নিয়া গভীর আলোচনা চলতিছে, তর্ক-বিতর্ক অনেকদূর গড়ায়া একেবারে গভীর থেকে গভীর স্তরে চইলা গেছে; কিন্তু ঠিক সে-সময় যদি একজন যুবতী মাইয়া ঘরে ঢুকছে তো সব আলোচনা শ্যাষ।

মানে?

মানে তখন দেশ-জাতির আলোচনা, 888sport live football-সংস্কৃতির আলোচনা ফালায়া ছফাভাইয়ের পুরা মনোযোগ সেই যুবতীর দিকে। তখন আর সায়ীদ স্যারের কথাই ছফাভাইয়ের ক্ষেত্রেও খাইটা যায়।

মেডিক্যাল-পড়ুয়া যুবায়ের বলে – এইটা হচ্ছে মাঝবয়স পার হওয়া পুরুষদের প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের ব্যাপার।

মানে?

পেচ্ছাপের থলির মধ্যে যে-জায়গা থেকে পেচ্ছাপের নালা বের হয়, তার দুইপাশ জুড়ে থাকে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড। তো বয়স বাড়লে কারো কারো সেই গ্ল্যান্ড বাইড়া যায়। সেইখান থেকে একটা হরমোন আসে। সেই হরমোনের কারণে বুড়া পুরুষদের 888sport promo code দেখলেই ছোঁক-ছোঁক করার অভ্যেস তৈরি হয়।

আমি একটু আপত্তির সুরে বলি যে, মানি লোকদের সম্পর্কে এরকম রসিকতা করা উচিত না।

যুবায়ের বলে, এইডা মানি লোক আর ফালতু লোকের ব্যাপার না। এইটা হচ্ছে সায়েন্স।

আচ্ছা সায়েন্সের জায়গাত সায়েন্স থাকুক। আমরা কথা বলতাছি শিউলিমালারে নিয়া। তার প্রতি হাসানের এতোটা অ্যালার্জি ক্যান?

ধুর! ঠোঁট ওলটায় হাসান – ওইডা একটা মাকাল ফল।

হইল না-হয় মাকাল ফলই। কিন্তু তার কথা কইতে তোর এতো আপত্তি কিসের?

হাসান একটুও না ভেবে বলে, তোরা থাকিস বড় টাউনে। সেই জাগাত সুন্দরী মিয়্যার আকাল তো নাই রে ভাই। আমরা যারা পইরা আছি এই মফস্বলের চিপির মইধ্যে, তারা শুনবার চাই বিদগ্ধ সুন্দরীদের গপ্পো। সেই রকম সুন্দরীদের গপ্পো বাদ দিয়া ম্যাড়ম্যাড়া শিউলিমালারে নিয়া এতো মাথাবেদনা কী জন্যে?

ঈশ্বর গুপ্তের 888sport app download apk পড়স নাই শালা! স্বদেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। 888sport app-রাজশাই-চাঁটগা-মৈমনসিংয়ে অনেক সুন্দরী মাইয়া আছে। থাকুক। কিন্তু শিউলিমালা হইল আমাগোর মাইয়া। আমাগোর টাউনের মাইয়া। তারে নিয়া আলোচনায় যেমন আমাগো হক আছে, তেমনি তারও হক আছে আমাগো আলোচনার বিষয় হওনের। হাজার হইলেও সে আমাগো নিজেগের মানুষ।

শুনা দেখি, এই কয়মাসে শিউলিমালা আর কয়জনারে পাগল করছে? হ্যায় এখন কারে ছাইড়া কার লগে প্রেম করতাছে?

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শিউলিমালার কোনো প্রেমের কাহিনি আমরা কেউ কোনোদিন শুনতে পাইনি। এই রকম মক্ষীরানী মেয়েরা যা করে, একের পর এক ছেলের সঙ্গে প্রেম করে তাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়, শিউলিমালা তেমনটা করেনি। সে-মানুষের মুগ্ধদৃষ্টি দেখে আনন্দিত হতো নিশ্চিত, আহ্লাদিতও, পুরুষের মাথা ঘোরানোর নিজের শক্তিতে হয়তো আপ্লুতও হতো, কিন্তু আগ বাড়িয়ে কাউকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেনি কখনো। শিউলিমালা এযাবৎ একজনের সঙ্গেও প্রেম করেনি। তার বাপ-ভাইয়েরা তাই তাকে নিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় পড়েনি কখনো। শিউলিমালাকে নিয়ে তাদের ঝামেলায় পড়তে হয়েছে অবশ্যই। টাউনের ভালো ছেলে থেকে বখাটে মাস্তান পর্যন্ত অনেকেই শিউলিমালার দিকে হাত বাড়িয়েছে, রাস্তাঘাটে পথ আগলেছে, ফোনে জ্বালাতন করেছে, প্রস্তাবের পর প্রস্তাব পাঠিয়েছে প্রেমের, কিন্তু শিউলিমালা কারো সঙ্গেই প্রেম করেনি কখনো। এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে একটা রহস্যই থেকে গেছে। কেউ-কেউ বলেছে – ডাঁট। রূপের দেমাগে যে-কোনো ছেলেকেই তাচ্ছিল্য করে শিউলিমালা। কাউকেই তার পছন্দ হয়নি। টাইমপাস করার জন্য ছেলেদের সঙ্গে মাখামাখি করেনি শিউলিমালা।

আমরা জানতে চাই – শিউলিমালারে কোথায় দেখা যায়? আমরা তারে একবার দেখতে চাই। আগের থাইকা আরো সুন্দরী হইছে নাকি?

শিউলিমালারে অবশ্য অনেক জায়গাতেই দেখা যায়। শহরের যে-কোনো রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে, বা সমবায় দিবসের অনুষ্ঠানে, বা সরকারের যে-কোনো অনুষ্ঠানে সে উপস্থাপিকা। উপস্থাপিকা না হলেও সে উপস্থিত থাকে। কিন্তু তাকে দেখার সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে কলেজ ক্যাম্পাসই। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কাল তাকে ডিগ্রি কলেজেই দেখতে যাব। আগে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়নি। এখন তো হাসান তার ক্লাসমেট। সে আমাদের শিউলিমালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে।

কিন্তু হাসান সোজা না করে দেয় – আমি তার সঙ্গে কোনোদিন কথা কই নাই। সে-ও আমারে চিনে না। আমি কীভাবে পরিচয় করাব তোদের সঙ্গে?

সে কি কথা! এতোদিন একসঙ্গে ক্লাস করতাছিস, অথচ তোগো মইদ্যে পরিচয়ই হয়া সারেনি!

না হইছে না হোক। এতোদিন হয় নাই। কাইল হবে। কাইল আমাগো সঙ্গেও শিউলিমালার পরিচয় হবে, হাসানের লগেও হবে।

আমার আগ্রহ নাই।

ক্যান? আগ্রহ নাই ক্যান?

যার দিকে বেশি মানুষ ফাটা কাঁঠালের ওপর বইসা থাকা মাছির লাহান ভনভন করে, আমি তার ধারেকাছে ভিড়তে চাই না।

আরে সেজন্যেই তো যাওয়া লাগবে। দেখতে হবে বুঝতে হবে, কেন মানুষ একটা মেয়ের জন্যে এভাবে হন্যে হয়ে ওঠে।

হাসান সাফ বলে দেয় – তোদের যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে যা। পরিচয় করা, স্টাডি কর, গবেষণা কর, যা খুশি কর। আমি ওইসবের মধ্যে নাই।

হাসান কিছুতেই শিউলিমালার সামনে যেতে রাজি হয় না।

কিন্তু বছরখানেক পরে সেই শিউলিমালার কাছেই যেতে হয় আমাদের। হাসানের জন্যই।

 

দুই

শিউলিমালার বিয়ে ঠিক হয়েছে শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে-রাতেই হাসান নিজের হাতের শিরা কেটে ফেলেছে।

আমরা খবরটা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

কিন্তু খবরটা জেনুইন। তারচেয়েও বড় কথা, হাসান হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে কাল রাত থেকে। ওর বাবা খুব নরম মনের মানুষ। ছেলেকে দূরে পাঠাতে হবে বলে তাকে কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিপরীক্ষা পর্যন্ত দিতে দেননি। সেই মানুষ টেলিফোন করে করে আমাদের খুঁজে বের করেছেন। বারবার অনুনয় করেছেন চলে আসতে। আমরা না এলে নাকি হাসানকে বাঁচানো যাবে না। সে শিরা কাটার আগে চিঠিতে লিখেছে, শিউলিমালাকে না পেলে সে কিছুতেই এ-জীবন রাখবে না। এখন হাসানের আববার ভয়, এ-যাত্রায় যদি সে বেঁচেও যায়, আবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে। তাকে বাঁচানোর জন্যে তার বন্ধুদের পায়ে পড়া ছাড়া তার আর গতি নেই।

আমরা চারজন সেই আকুল অনুরোধে সাড়া দিয়ে শহরে এলাম। তবে হাসানের ওপর রাগ উঠেছিল আমাদের চারজনেরই। ইচ্ছা ছিল হাসপাতালে ঢুকে শালাকে রামধোলাই দেওয়া হবে।

কিন্তু হাসানকে দেখামাত্র আমাদের সব রাগ উবে গিয়েছিল। এমন চেহারা হয়েছে আমাদের বন্ধুর! আমরা কেউই তখনো প্রেমে পড়িনি। কিন্তু সত্যিকারের প্রেমিককে দেখলে হৃদয় ঠিকই জানিয়ে দেয়, প্রেম তাকে কতখানি ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। এবং হাসানকে দেখামাত্র আমরা বুঝে ফেলি, সে সত্যি-সত্যিই জীবন রাখবে না শিউলিমালাকে না পেলে।  সেই ছিন্নভিন্ন হাসানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের করোটির মধ্যে কে যেন গুনগুনিয়ে উচ্চারণ করে, উর্দুকবি শেখ আলায়ির অমোঘ প্রেমপঙ্ক্তিমালা –

যার ইচ্ছা করে – নয়ন ভরে দেখে নিক

হাসিমুখে আমার জীবন দেওয়া।

দৃষ্টান্ত হয়ে থাক সেইসব অবোধের জন্য,

যাদের ধারণা এই যে

প্রেম – সে কেবল মুখের কথা।

যুবায়ের আর আমার চোখে-চোখে কথা হয়। আমরা বেরিয়ে পড়ি কেবিন থেকে।

কিন্তু শিউলিমালা শোনামাত্র বলে – অসম্ভব! আপনারা কি পাগল হয়েছেন? আমার বিয়ের আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। কেনাকাটা শেষ, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করা শেষ, এই সময় আমি বিয়ে ভাঙব কীভাবে?

আমরা নাছোড় – যত অসম্ভবই হোক, এটা করতে হবে।

শিউলিমালা নিজের কথার সঙ্গে সঙ্গে এবার বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ তোলে – আমার আববা আর মায়ের কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? আমার ভাইবোনদের কী হবে? ওরা কি সমাজে মুখ দেখাতে পারবে?

অবশ্যই পারবে। যুবায়ের জোর দিয়ে বলে, কত বড়-বড় ঘটনা ঘটে রোজ-রোজ। কে মনে রাখে সেসব বেশিদিন?

কিন্তু এটা তো ঘটনা না। এটা অঘটনা। বিরাট বড় অঘটনা।

না-না অঘটনা হতে যাবে কেন? এটা সত্যিকারের একটা ভালো ঘটনা হবে।

আর সেই মানুষটার কথা একবার ভাবেন তো! যে-মানুষটার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার কী অবস্থা হবে?

আমি নিজের অজান্তেই তেল মারতে শুরু করে দিয়েছি, তার কিছুই হবে না। কিচ্ছু ক্ষতি হবে না। যে-মানুষ আপনার মতো মেয়ের স্বামী হতে যাচ্ছিলেন, যোগ্যতার দিক থেকে তিনি নিশ্চয়ই অনেক বড়। এরকম বড়মাপের মানুষের কোনো কিছু ঠেকে থাকে নাকি! দেখা যাবে দুই-চারদিনের মধ্যেই তিনি অন্য কোনো যোগ্য পাত্রী দেখে বিয়ে করে ফেলবেন।

না! শিউলিমালা নিজের জায়গা থেকে নড়ে না। আবার জোর দিয়ে বলে, না। এ হতে পারে না। আপনারা এই অসম্ভব অনুরোধ আমাকে করবেন না।

আমরা তো অসম্ভবকে জয় করার জন্যই এসেছি। কীভাবে করব, জানি না। শুধু জানি করতে হবে। করতেই হবে।

কাতর স্বরে দুইজনেই বলি, আপনি দয়া করেন শিউলিমালা। নাহলে হাসান বাঁচবে না।

এই হাসানটাই বা কে? যাকে আমি চিনি না, কোনোদিন একটা কথাও হয়নি যার সঙ্গে, আজ হঠাৎ আপনারা এসে বলছেন তার জন্য আমার বিয়ে ভেঙে দিতে হবে। বুঝতে পারছি না, আপনারা কি পাগল, নাকি আমাকেই পাগল ভেবে এসেছেন?

পাগল আমরা কেউ নই। পাগল হচ্ছে প্রেম।

এবার ফিক করে হেসে ফেলে শিউলিমালা। সেই হাসি দেখেই আমরা প্রথম যেন অনুভব করি কোথায় মেয়েটির অসাধারণতা। এই অবস্থাতেও সে হাসতে পারে এমনভাবে! মনে মনে বলি, হাসান ঠিক মেয়েকেই ভালোবেসেছে।

শিউলিমালার ঠোঁটে তখনো লেগে আছে হাসিটা। বলে – আমি তো প্রেম করিনি।

তখন আমার কী যে হয়, খুব সিরিয়াস হয়ে যাই। মুখের রেখাগুলো শক্ত হয়ে যায় আমার। বলি – কী হতভাগিনী আপনি? বাইরের ঠাঁট-ঠকম নিয়েই দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। অথচ আপনার সঙ্গে একই রুমে ক্লাস করতে-করতে একটা ছেলে যে সর্বস্ব দিয়ে আপনাকে ভালোবেসে যাচ্ছে, সেটি এক মুহূর্তের জন্যেও টের পাননি আপনি। অর্থাৎ আপনার অনুভূতি ছিল পুরোপুরি ভোঁতা। যদি সংবেদনশীলতা বলে জিনিসটা আপনার মধ্যে থাকত, তাহলে সেই প্রেমের অলৌকিক সুঘ্রাণ আপনি ঠিকই টের পেতেন। এমন ভালো এই যুগে কেউ কাউকে বাসতে পারে, তা কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। আমাদের বন্ধু হাসান সেই ভালোবাসার অস্তিত্বের প্রমাণ দেখিয়েছে পৃথিবীর মানুষকে। আর আপনি এতোদিন টের পাননি। তার ওপর আজ সেই ভালোবাসার কথা জানতে পেরেও গ্রহণ করতে দ্বিধা করছেন। আপনার জন্যে আমার সত্যিই করুণা হচ্ছে।

একটানা জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে উঠি আমি। ঘরের মধ্যে নীরবতা নেমে এসেছে। মুখ নিচু করে বসে আছে শিউলিমালা। আমি যুবায়েরের চোখের দিকে তাকাই। তার চোখে আশার ঝিলিক। তার এবং আমার – দুজনেরই মনে হচ্ছে শিউলিমালা অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। এই সময় ঝট করে মাথা সোজা করে চোখ তুলে শিউলিমালা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, সব বুঝলাম। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপনাদের আবদার পূরণ করা। আপনাদের বন্ধু অনেক দেরি করে ফেলেছে। তাছাড়া নিজের ভালোবাসার কথাটাও যে জানাতে সাহস পায় না, সেরকম প্রায় কাপুরুষ একটা লোককে আমি কেন, কোনো মেয়েই 888sport apk download apk latest version করতে পারবে না।

আমরা দুইজন মাথা নিচু করে বসে থাকি। মেনে নিয়েছি আমাদের মিশনের ব্যর্থতা। যুবায়ের হার স্বীকারের কণ্ঠে বলে, ঠিক আছে। আপনাকে আর জোরাজুরি করব না আমরা। শুধু একটা অনুরোধ। একবার চলেন হাসপাতালে। একবার অন্তত গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে আসবেন হাসানকে।

এই প্রস্তাবেও দ্বিধান্বিত দেখায় শিউলিমালাকে, সেটা কি ঠিক হবে? বাড়তি ঝামেলা তৈরি হবে না তো?

দৃঢ়কণ্ঠে তাকে আশ্বস্ত করে যুবায়ের, কোনো অসুবিধা হবে না। কোনো ঝামেলা হবে না। আপনি একবার শুধু চোখের দেখা দেখে আসবেন হাসানকে।

 

 

তিন

শিউলিমালা হাসপাতালে আসে।

তার পরের দিনও আসে।

তার পরের দিন দুইবার আসে।

তার পরের দিন সারাটা দিনই তাকে হাসপাতালে হাসানের কেবিনে বসে থাকতে দেখা যায়।

তার পরের দিন যুবায়ের আর রুহুলকে সঙ্গে নিয়ে আমি হাসানের কেবিনে ঢুকেই থ হয়ে যাই। বালিশে হেলান দিয়ে উঁচু হয়ে বসে আছে হাসান। তার একেবারে পাশে বিছানার ওপরেই বসে আছে শিউলিমালা। তার বাঁহাতে খাবারের থালা। ডান হাতে লোকমা তুলে ধরা হাসানের মুখের কাছে। মুখে অনুরোধ – আরেকটু খাও সোনা! এত অল্প খেলে তোমার শরীর সারবে কেমন করে? আরেকটু খাও লক্ষ্মীসোনা! এই যে আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।

যুবায়ের ফিসফিস করে বলে, হাসান শালা পাক্কা হারামি! মানুষ ডান হাতে ব্লেড ধরে শিরা কাটে বাঁহাতের। আর এই শালা বাঁহাতে ব্লেড নিয়ে শিরা কেটেছে ডান হাতের। এখন ওকে মুখে তুলে খাওয়ানো ছাড়া গতি আছে শিউলিমালার! শালা জানত। আগে থেকেই জানত যে এরকমই ঘটবে।

 

চার

তারপর বিয়ের নতুন কার্ড ছাপা হলো।

সারা শহরে এখন শুধু শিউলিমালা আর হাসানের গল্প।  সিনেমা-নাটকের বাইরে এমন ঘটনা বাস্তবে ঘটতে পারে, এমন কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সবাই অবাক।

অবাক হইনি কেবল আমরা কয়েকজন। কেননা, আমরা অন্তর থেকেই বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসার শক্তি রয়েছে সবরকম অসম্ভবকে সম্ভব করার।

আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, শিউলিমালা-হাসানের এমন অনুষ্ঠান করব যে, সারা শহর মনে রাখবে এই বিয়ের কথা। রুহুল 888sport app থেকে আর্ট কলেজের শিক্ষক জাহাঙ্গীর ভাইকে দিয়ে অসাধারণ ডিজাইন করে এনেছে কার্ডের। এমন একটা কার্ড কেউ অনুষ্ঠানের পরে ফেলে দিতে পারবে না। সংরক্ষণ করতে হবে 888sport live chatকর্ম হিসেবে।

আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছি বিয়ের আয়োজনে। রিজভির পরীক্ষা সামনে। তবু সে চলে এসেছে। এমন ঐতিহাসিক একটা ঘটনা ছেড়ে দূরে থাকতে রাজি নয় সে।

যুবায়ের একটা সার্কাস কোম্পানি থেকে হাতি ভাড়া করেছে। হাসান বিয়ে করতে যাবে হাতির পিঠে নওশা সেজে। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে বিবি রাসেলের খুব ভালো সম্পর্ক। তার কাছে এমন একটি অসাধারণ ঘটনার কথা শুনে বিবি রাসেলের মতো ডিজাইনার রাজি হয়েছেন শিউলিমালার জন্য বিনা পয়সায় একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিয়ের পোশাকের ডিজাইন করে দিতে।

গেট সাজানোর জন্য মাগুরা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে ডেকোরেটর। শুধু দেশেই নয়, পূজার সময় কলকাতাতেও ওদের নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ মন্ডপ তৈরি করার জন্য।

বিয়ের অনুষ্ঠান চলবে অন্তত তিনদিন। এই তিনদিন যাতে কোনোভাবেই শহরে লোডশেডিং না হয়, তার জন্য রাজি করানো হয়েছে পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলীকে। তিনি কথা দিয়েছেন, কেবল যদি ন্যাশনাল গ্রিডে ফেল না করে, তাহলে এক সেকেন্ডের জন্যেও কারেন্ট অফ হবে না এই শহরে। আমাদের শহরের ঠিক মাঝখানে ছোটখাটো নদীর মতো রানী ভবানীর দিঘির পাশে তৈরি করা হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানের জায়গা। রিজভির ইচ্ছা ছিল দিঘির ঠিক মাঝবরাবর একটা জলটুঙ্গি টাইপের ঘর তৈরি করে সেখানে বাসর রাতের আয়োজন করার। কিন্তু সেটা বড় বেশি পাবলিক প্লেস হয়ে যাবে, আর সেই রাতে শহরবাসী সকলের চোখ আটকে থাকবে সেই জলটুঙ্গির দিকে, এই ভেবে লজ্জায় লাল হয়ে শিউলিমালা রাজি হয়নি সেখানে বাসর যাপন করতে। কাজেই হাসানদের বাড়ির দোতলা থেকে অন্য সবাইকে উচ্ছেদ করে সেখানে পুরো ফ্লোরজুড়ে অজন্তা-ইলোরার ফ্রেসকো অাঁকা হয়েছে দেয়ালজুড়ে। সিঁড়ির মাথার দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কাউকে দেখতে দেওয়া হবে না সেই দেয়ালচিত্র। বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে রাত্রিযাপনের জন্য নবদম্পতি যখন দোতলায় যাবে, তখন হাসানের হাতে তুলে দেওয়া হবে সিঁড়িঘরের চাবি। ওরা দুইজন ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবে না দোতলায়।

এই রকম আরো পরিকল্পনা চলছে। নতুন কী করা যায়! অভিনব কী করা যায়! শিউলিমালা হাসানের প্রেমের টানে সাড়া দিয়ে যে অসাধারণ নজির স্থাপন করেছে, তাকে আর কী কীভাবে সম্মানিত করা যায়!

কিন্তু গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের দিন দেখা গেল হাসান নিজের ঘর থেকে বেরই হচ্ছে না। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উৎসাহীরা গেল হাসানকে খুঁজতে। দেখা গেল হাসানের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সেখানে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি। কিন্তু সাড়া নেই হাসানের। ধাক্কাধাক্কি করেও খোলানো যাচ্ছে না দরজা। দরজা ভাঙার হুমকি দিয়েও কাজ হচ্ছে না। দরজা খুলছে না হাসান। আমরা গিয়ে ক্রুদ্ধ হুংকার ছাড়লাম। সেই হুংকারের উত্তরে ভেতর থেকে ভেসে এলো হাসানের গোঙানি। তখন আর দরজা না ভেঙে উপায় কী!

মেঝেতে পড়ে আছে হাসান। রক্তে ভেসে যাচ্ছে নতুন করে টাইলস-বসানো ঝকঝকে মেঝে। ব্লেড দিয়ে আবার নিজের হাতের শিরা কেটেছে হাসান।

হাসপাতালে আমাদের অবিশ্রান্ত গালাগালির মধ্যেও হাসান ম্লান হেসে কেবল বলতে পারে – শিউলিমালা কি আর আমাকে ভালোবেসেছে রে? সে তো আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে করুণা করে। কিন্তু আমি তো করুণাময়ী চাইনি! করুণার সঙ্গে কি ভালোবাসা নিয়ে ঘর করা যায়? ভালোবাসা আর করুণা কি একসঙ্গে বাস করতে পারে একঘরে? পাশাপাশি?