খুব মজার ব্যাপার হলো, আমার গ্রাম সবলসিংহপুরে থাকা হয়েছে কম। কারণ বহুবিধ। একে বাড়ি মাটির চালার। দুই, আশপাশে খালি জায়গা নেই। তিনদিকে ঘর। সামনে নতুন পুকুর। এই দক্ষিণটা খালি ছিল বলে বাঁচোয়া। না-হয় দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। উঠোন বলতে তেমন আলাদা কিছু নেই। আমার বড়দাদা শেখ ইরশাদ আলী তাঁর মাটির দোতলা বাড়িটা আমার বাবা ভাইপো শেখ আজিজুর রহমানকে দান করেন। কারণ তাঁর একমাত্র পুত্র ছিল বাবার সমবয়সী এবং জোয়ানকালে যক্ষ্মায় মারা যান। দাদা মনোবেদনায় বাবাকে নিজের সন্তানতুল্য মনে করে ভিটেটি দান করেন। যৌবনে বাবা খুব সুদর্শন ছিলেন এবং এই একহারা চেহারা আমৃত্যু বহন করে গেছেন। তাঁকে সব সময় অল্পবয়সী মনে হতো। কবিসুলভ নয়, আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন কবি। আর প্রখ্যাত মনীষী হবীবুল্লাহ বাহারের বুলবুল নামক মাসিক পত্রিকায় একসঙ্গে তিনটে 888sport app download apk ছাপা হওয়ায় প্রায় রাতারাতি সারা বঙ্গে বা পশ্চিমবঙ্গে কবিদের দলভুক্ত হন।
যদিও পরবর্তী সময়ে কলকাতায় অবস্থিত দৈনিক আজাদ-সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের উৎসাহে গদ্য ধরেন এবং তিনি কথা888sport live chatী হয়ে ওঠেন। তবে লিমেরিক আকারে কাব্যচর্চা আজীবন চালিয়ে গেছেন।
বাবানামা বাদ দিয়ে নিজ পাড়ার কথায় আসি। আমাদের পাড়ার নাম মেহেদিমহল্লা। বোঝাই যাচ্ছে, মেহেদি নামে কোনো এক পূর্বপুরুষ এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। আর সেই নাম আজ ইতিহাসের পাতায়। জয় বাবা মেহেদি। সময়কাল বলতে পারব না। কারণ বাবা শওকত ওসমান তাঁর আত্মজীবনী রাহনামাতে এই কথাই বলে গেছেন। আর এখন কোনো আদিকালের মানুষ নেই যে, জানা যাবে পুরোনো দিনের কথা। দেশভাগ না হলে হয়তো দাদাদের মুখ থেকে কিছু জানতে পারতাম। কিন্তু বাল্যকালে আমি শুধু মেহেদিমহল্লা নয়, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাংলার সর্বদক্ষিণে স্থাপিত হই – চট্টগ্রামে।
একেবারে কালাপানি পার। বলতে গেলে দ্বীপান্তর। চট্টগ্রামের পাশে সন্দ্বীপে হলে আক্ষরিক অর্থেই দ্বীপান্তর হতো। আগে নিজের গ্রামের কথা তো বলে নিই, তারপর হবে চিটাগাংয়ে দ্বীপান্তরের কথা।
আমাদের মাটির দোতলাঘর থেকে নামলেই সামনে সামান্য খালি জায়গা। উঠোনে কোনো সবুজের বালাই নেই। তবে বাঁ-দিকে একটা মাঝারি সাইজের করমচা গাছ থাকায় সামান্য সবুজের উপস্থিতি। ছায়াও দান করত অল্পপরিসরে। গাছে করমচা ধরত। ফুল বেগুনি। অনেকটা শিমফুলের মতো। ফল চ্যাপ্টা। সবুজাভ। এর ভেতর একটা করে বীজ হতো। এই বীজ পাকা হলে শুকিয়ে চিপে তেল বের করে প্রদীপ জ্বালানো হতো। মাটির প্রদীপ। তাছাড়া পাতা ঝাঁট দিয়ে হতো ভালো জ্বালানি। তখন মাটির চুলোয় রান্না। করমচা পাতা খুব ভালো জ্বালানি। আমাদের গ্রামের ভাষায় জানুন। প্রতিটি গ্রামীণ অঞ্চলে এ-রকম সুন্দর সুন্দর প্রতিশব্দ আছে। আমাদের তেমন কোনো সংগ্রহকারী নেই। নচেৎ এটি ভাষাবিদদের কাছে সুন্দর একটা গবেষণার বিষয়। পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ নিয়ে একটা চমৎকার অভিধান হতে পারে। বাংলায় চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ একটি আলাদা আঞ্চলিক ভাষা। ১৯৪৭-এর আগে সিলেট বাংলায় ছিল না। ছিল আসামের অঙ্গ। দেশভাগের সময় গণভোটে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা পূর্ব বাংলায় যোগ দেয়। শ্রীহট্ট ছিল এর পূর্ব নাম। এর আঞ্চলিক ভাষাও বাংলার আঞ্চলিক ভাষা থেকে পৃথক। 888sport appsে তাই দুটি পৃথক আঞ্চলিক ভাষা পাওয়া যায়। এক, চট্টগ্রাম – দুই, সিলেট। 888sport appর ভাষায় আমরা দেখি 888sport app শহর আর বিক্রমপুরের কথ্যভাষায় বেশ পার্থক্য। কলকাতার টিভি সিরিয়ালে 888sport appর যে-ভাষা ব্যবহার হয় তা বিক্রমপুর অঞ্চলের কথ্যভাষা হালায়, ওটা সম্পূর্ণ 888sport app শহরের মুদ্রাদোষ বা গুণ। যেমন কলকাতায় বিহারিরা বলে : আ বে …
করমচাগাছটা ছাড়িয়ে অল্প দূরে একটা বিশাল তেঁতুলগাছ। এর শেকড় নতুন পুকুরের পাড় ঘেঁষে মাটি কামড়ে রেখেছে। শেকড় মোটা কাছির মতো। এখানে অনেক কাঁকড়া দেখতাম। ওরা মজা করেই বাসা বেঁধেছে। আমরা তালপাতার শিরা দিয়ে ফাঁস তৈরি করে ধরতাম। তবে সহজ ছিল না।
আমার ছোট চাচা ফনু – ভালো নাম শেখ গোলাম জিলানী – খুব পাকা ছিলেন এই কাঁকড়া ধরায়। তালপাতার শিরায় একটা ফাঁস বানিয়ে দাড়ায় লাগিয়ে টান। ফাঁস লেগে যেত। তারপর ডাঙ্গায় তুলে দে মার। দু-একটা পালিয়ে গেলেও বেশিরভাগ হতভাগা কাঁকড়া মারা পড়ত। এটা ছিল আমাদের খেলা আর আনন্দ। পরে ঈশপের গল্পে ব্যাঙের গল্প পড়েছি। ব্যাঙ ছেলেদের বলছে : যা কারো জন্যে খেলা, তা কারো জন্যে মৃত্যু। তাই এরকম ভয়ানক খেলা অনুচিত। এটা পড়া থাকলে আমরা এমন খেলায় মত্ত হতাম না। বেশ কিছুদিন পর ঈশপের গল্প আমার হাতে আসে। বাবা কলকাতা থেকে এনেছিলেন। এটা পড়ার পর কাঁকড়া নিধন বন্ধ হয়। আমরা নিজেরাই গল্পের নীতিকথা মেনে নিই।
দোতলা চালাবাড়ির পর ডানপাশে একতলা একটা চালা। নাম নতুন ঘর। প্রতিটি ঘরের এরকম নাম থাকে। যেমন পুজোর ঘর, পড়ার ঘর, শোবার ঘর, বসার ঘর বা বৈঠকখানা। ঘরের ভেতর প্রতিটি কামরারও নাম থাকে। এটা বাবা-মা’র ঘর, ওটা দাদা-দাদি বা ঠাকুরমা-ঠাকুরদার ঘর। পয়সাঅলা বড়লোকের এরকম অনেক ঘর বা কামরা থাকে। সবার বাড়িতে একটা ঘর থাকবেই … সেটা রান্নাঘর। আগে মানুষ প্রাত্যঃকৃত্যটা করত মাঠেঘাটে। তাই আজকের মতো ল্যাট্রিন ছিল না। ধনীরা ল্যাট্রিন বানাত। খোলামাঠের ব্যাপারটা রীতিমতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আন্দোলন করে ঋণদান করে ভারতবর্ষে বন্ধ সম্ভব হয়েছে। এখন সব ঘরে দূরে হলেও টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়।
আমাদের ভিটের পেছনে বাঁশঝাড়ের পর একটা ডোবামতো জায়গা ছিল। সেখানে বড়দের জন্যে শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল। ভিটে থেকে নিচে এবং বেশ কিছুটা দূরে। বর্ষাকাল ও বানের সময় খুব অসুবিধে হতো। ওটা ডুবে যেত।
আমাদের নতুন পুকুরটা বেশ বড় ছিল। গোটা চারেক ঘাট ছিল নানা দিকে। দক্ষিণ দিকটায় ঘরদোর না থাকায় ওদিকটা তেঁতুলগাছ আর বাঁশঝাড়ে ভরা ছিল। পশ্চিম-উত্তর কোণে ছিল একটা বড় কদমগাছ। রাতে বাদুড়ের চেঁচামেচি শুনতে পেতাম। পাকা কদম খেতে আসত। গাছতলা বিচ্ছিরি হয়ে থাকত বাদুড়ের বিষ্ঠায়। কিন্তু প্রথম কদমফুল যখন ফুটত, তখন গাছের বাহার দেখে কে। নিচ দিয়ে গেলেই ফুলের সুগন্ধ মাতাল করে তুলত। এই কোনায় ছিল সেজদাদাদের ঘাট।
ছোটদাদার ঘর আমাদের পাশে। মাঝে একটা গলি। তিন ফুটের বেশি নয়। পুরো মহল্লাটা এরকম গালি দিয়ে সাজানো। শীত-গ্রীষ্ম ছাড়া বর্ষায় চলাফেরায় খুব অসুবিধে হতো। ছাদের জল, বৃষ্টির জল একসঙ্গে ঝরায় ছিল খুব অসুবিধে। কজনের আর ছাতা ছিল। বেশিরভাগ লোক মোটা কাপড়ে মাথা ঢেকে চলাফেরা করত। মহল্লায় কোনো ধনী পরিবার ছিল না। সবই নিম্নমধ্যবিত্ত। আসলে দরিদ্রই বলা চলে। কোনোমতে পরিবারের একজন কলকাতায় কিছু একটা করে। সংসার চলে একজনের রোজগারে। শিক্ষাগত যোগ্যতা হাই স্কুলে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত। আমার মামাবাড়ি ঝামটিয়ায় যেমন সব ছিল উচ্চশিক্ষিত, সে-তুলনায় এরা খুবই নগণ্য। পুরো পাড়ার চেহারা দারিদ্র্যপীড়িত। মাটির ঘরবাড়ি। একমাত্র একতলা পাকা বাড়ি ছিল হাফেজ চাচাদের বাড়ি। পরে তিনি আমার সেজদাদার মেয়ে আনসুরা ফুপিকে বিয়ে করায় ফুপা বা পিসেমশাই হয়ে যান। তাঁর ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। ফর্সা দোহারা মাঝারি উচ্চতার। খুব পান খেতেন – ফর্সা চেহারায় ঠোঁট লাল হয়ে থাকত। এই হাফেজ চাচার মা খুব কর্মী মানুষ ছিলেন। বাঁশতলা ঝাড়ু দিয়ে পাতা জড়ো করে জ¦ালানি জোগাড় করতেন। বিধবা বলে সাদা শাড়ি পরতেন। খুব হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত মানুষ। হাফেজ চাচার কোনো সন্তান না হওয়ায় দাদি আমাদের খুব স্নেহ করতেন। আর আমি বড় বলে আমাকেই কাছে পেতেন আর খুব আদর করতেন। পাড়ায় আমাকে সবাই খুব ভালোবাসতেন। বাবা একজন বড়মাপের মানুষ, তাছাড়া বড়লোকের নাতি … দেখতেও খারাপ নই, তাই আদর আর স্নেহটা বেশি করে বর্ষাতো।
সবলসিংহপুর প্রায় চার বর্গমাইল জায়গা জুড়ে। উত্তরের গ্রাম সমকপুর, পশ্চিমে নন্দনপুর, দক্ষিণে মাড়োখানা Ñ আর পুবে মুণ্ডেশ^রী নদী। নদীর ওপারে পড়ে হরিশচক গ্রাম। আর লতিফপুর।
হরিশচকে আমার এক ফুপুর বিয়ে হয়। তাঁরা বেশ ধনীঘর। পাকা বাড়ি। চৌহদ্দি দেয়ালঘেরা। আমার এই ফুপু বিয়ের কিছুদিন পর মারা যান। কোনো সন্তান ছিল না। ফুপা বা পিসান আবার বিয়ে করেন। এই পিসি পাতলা-ফর্সা, খুব সুন্দরী ছিলেন। আমার দাদি মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে পড়ন্ত বেলায় এই পিসির বাড়ি যেতেন। তখন মুণ্ডেশ্বরী বর্ষাকালে ছাড়া বাকি সময় ছিল শীর্ণ এক নদী। একেবারে রবীন্দ্রনাথের আমাদের ছোট নদী … দু’পাড়ে বালির স্তর … পা দেবে যেত … জোরে চলা ছিল মুশকিল … নদী পার হওয়ার সময় আমাদের গ্রামের বাঁ-দিকে পড়ত আজগুবিতলা। কেন এমন ধরনের নাম জানা হয়নি। এই আজগুবিতলায় একটা ছোটখাটো 888sport sign up bonus-মন্দির ছিল। কার 888sport sign up bonus তাও জানি না।
এই হরিশচকে একবার একটা ঘটনা ঘটে। সেটা এখনি বলতে ইচ্ছা করছে। আমার ফুপার হয়েছে মারণব্যাধি অর্থাৎ যক্ষ্মা। তখন যক্ষ্মা নিরাময় হওয়ার মতো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তাই একে বলা হতো রাজব্যাধি। অর্থাৎ যক্ষ্মা হলে আর রক্ষা নেই। আমাদের বাড়িতেও যক্ষ্মা হানা দিয়েছিল। বড়দাদার একমাত্র ছেলে বাবার বয়সী ছিলেন। যক্ষ্মায় মারা যান। আমি অবশ্য তাঁকে দেখিনি। সেটা অনেক আগের কথা।
একবার হরিশচকে আমরা মা ও ছোট দু-ভাইকে নিয়ে গেছি। দাদি আমাদের টিম লিডার।
জানি না ক’দিন থাকব। আমাদের সঙ্গে আমার একমাত্র চাচা জিলানীও ছিলেন। তিনি আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়।
হরিশচক বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। প্রায় সবার পাকাবাড়ি। এই পাড়ায় আমার সেজদাদার মেজো ছেলে লালু চাচার বিয়ে হয়। লালু চাচা দেখতে একেবারে লালচে ফর্সা ছিলেন। তাঁর শ্বশুর ছিলেন হরিশচকের একমাত্র দোকানদার। ভালো বেচাকেনা। পাকাবাড়ি। আমাদের সঙ্গে খুব রসিকতা করতেন। বলতেন, এই যে ছেলের মামাশ্বশুর, এদিকে এসো।
আমি খুব ভেবে বের করি ছেলের মামাশ্বশুর বলা মানে শালা বানিয়ে ছেড়েছেন।
আমি মনে মনে বলি, ছেলের মামাশ^শুর নয়, পিসেশ্বশুর। কিন্তু বলা আর হয়নি। পালিয়ে যেতাম। পেছনে হাসির আওয়াজ পেতাম।
তো ফুপুর বাড়ির কথা।
সন্ধ্যায় ফনুচাচা বললেন, গ্রামে একটা যাত্রা হবে। রাত দশটা থেকে। তুমি আমার সঙ্গে যাবে নাকি?
তাহলে মাকে বলতে হয়। অনুমতি লাগবে।
আমার খুব ইচ্ছা। কোনোদিন যাত্রা দেখিনি। সুযোগ এসে গেছে। আর সঙ্গে চাচা তো থাকছেই।
মার কাছে আর্জি পেশ করতে খুব সহজেই তিনি অনুমতি দিলেন। যেহেতু চাচা আছেন সঙ্গে।
রাতে খেয়েদেয়ে বের হলাম।
প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে প্রবেশের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
এই যাত্রার স্থানে যেতে মাঝে পড়ে গ্রামের কবরস্থান। সকালে এদিকে বেড়াতে এসে দেখেছিলাম একটা কবরের ওপর জামা টানিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকটা কাকতাড়ুয়া ঢংয়ে। দেখে ভয় লাগে। কবরটা খুব সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে। এটা মূলত শেয়ালকে ভয় দেখানোর কায়দা। কারণ শেয়াল শবদেহ খেয়ে ফেলে।
যাত্রাস্থানে যেতে অন্ধকারে কবরের পাশ দিয়ে যেতে জামাটাকে দুলতে দেখলাম। গা একটু কাঁটা দিয়ে উঠল। যদিও ছোটবেলা থেকে আমার ভূতের ভয় ছিল না। আসলে মানব জাতি নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে, সুতরাং
ভূত-বিশ্বাস এমন কিছু অমূলক নয়। মানুষ মরে গেলে তার আত্মা কোথায় যায় – এটা চিরকালের প্রশ্ন। এ থেকে জন্ম হয়েছে পরলোক, পাপ-পুণ্য, শুভ-অশুভ সব ভাবনা। স্বর্গ-নরক এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে। মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গল চিন্তা ও কর্মের বিচার … কোনো এক অদৃশ্য শক্তি একদিন করবে। আর পাঠাবে স্বর্গ আর নরকে বা বেহেশত ও দোজখে। সৃষ্টির রহস্য নিয়ে হাজার জল্পনা-কল্পনা। ভূত-প্রেত এসব চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে। 888sport apkের কাছেও এর কোনো সুরাহা মেলে না। তাই ঈশ^রচিন্তা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি অজানা জিনিস নিয়ে বেশি আলোচনায় অনেকে সময় নষ্ট করতে চায় না। তাই তাদের বলে নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী। নাস্তিক না বলে অজ্ঞেয়বাদী বলা যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ এ-বিষয়ে সঠিক বলা মুশকিল।
তো রাত দশটা বাজে। খেয়েদেয়ে আমি আর ফনুচাচা বের হলাম – যাত্রার উদ্দেশে যাত্রা। মা আর ফুপু বারবার করে চাচাকে বলে দিলেন, কখনো হাত ছাড়বে না। ছোট ছেলে – বিপদ-আপদে পড়তে পারে। তখন দেশে ছেলেধরা বলে একটা কথার খুব চল ছিল। বাচ্চা ছেলেদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিত। বা কোনো খারাপ কাজে লাগিয়ে দিত।
মনে পড়ছে দুপুরবেলা আমরা যখন মামাদের বাগানে যেতে চাইতাম মা ভয় দেখাতেন। ছেলেধরার গল্প বলে। বাধ্য হয়ে মা’র কথা শুনতে হতো। দুপুরটা মাটি। ঘুম না এলেও শুয়ে থাকতে হতো।
রাত দশটা। গ্রামগঞ্জের রাত দশটা বলতে গেলে গভীর রাত। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আন্দাজ করে চলেছি। চাচার হাত ধরা, কখনো হাত ছাড়িনি। কারণ পৃথক হয়ে গেলে কিছু ঠাওর করতে পারব না। ঘরে যে ফিরে যাব সে-ধারণাও করতে পারব না। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মাঝে দু-একটা জোনাকি জ্বলতে দেখে মন আনন্দে নেচে ওঠে। সঙ্গে ভয়ও চেপে আছে – খুব বেশি খুশি হতে পারছি না।
পথের মাঝে পড়ল কবরস্থানটা। এবার গা ছমছম করার সময় এসে গেল। সকালে এদিকে বেড়াতে এসে একটা কবরের ওপর একটা জামা ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্য দেখেছি। হাওয়ায় দুলছে। অনেকটা কাকতাড়ুয়ার মতো। শুধু মাথায় কালো হাঁড়িটা চাপান নেই।
বুক ধুকপুক শুরু করে। মনে মনে আল্লাহ-খোদা, ভগবান-ঈশ্বর জপ করতে করতে কবরস্থান অতিক্রম করে চলেছি। থাক, ভালোয় ভালোয় ফাঁড়া কাটল।
অদূরে সামনে খালি মাঠের মধ্যে হ্যাজাকবাতির আলো নজরে আসে। বাঁশি আর খোল-করতালের ধ্বনিও শুনতে পাই। সঙ্গে হারমোনিয়ামের সুর। লোকজনের কোলাহলও কানে বাজে। মনে হয় যেন হাট বসেছে।
যাক ভালোয় ভালোয় ফনুচাচার হাত ধরে গন্তব্যে পৌঁছলাম। চারদিকে লোক। যাত্রা বেশ মজার জিনিস। মঞ্চ থাকে মাঝখানে। প্রায় তিনদিক ঘেরা। মানুষ মঞ্চের পাশে সামান্য জায়গা রেখে ঘিরে বসেছে। একদিকে মেয়েদের বসার জায়গাও করা হয়েছে।
হ্যাজাকবাতি শোঁ-শোঁ আওয়াজ করে ঝুলছে। চারদিক নীলচে আলোয় ভরে গেছে। আর বাতির কাচে হাজার হাজার পোকা-মাকড় উড়ে এসে পড়ছে। মরে পড়ছে হ্যাজাকতলায়। আলো আর পতঙ্গের খুব একটা মরণব্যবস্থা।
মনে মনে ভাবি, যদি এসব পোকা-মাকড় ভাজি করে খাওয়া যেত। শুনেছি চীন বা শ্যামদেশে এসব ভেজে খাওয়া হয়। নিশ্চয় খুব মুচমুচে লাগে। মুখের ভেতর লালা কাটতে শুরু করে এসব চিন্তা করায়।
দর্শকের কোলাহল একটা বাজারি শব্দ তৈরি করেছে। আমরা একপাশে দুজন বসে গেলাম। শো শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। সবাই উৎসুক। আমার কাছে আরো আকর্ষণীয়। কেননা, জীবনে কোনো যাত্রাপালা দেখিনি। মামাবাড়ির চারপাশে কোনো যাত্রাপালার দল ছিল না। সবলসিংহপুরেও নেই। তাই আমার ভাগ্য খুলে গেল। বারেক পিসির বাড়িতে বেড়াতে এলাম। এই হরিশচকের উত্তরে লতিফপুর। আশপাশ সব গ্রামেই প্রায় হিন্দু-মুসলিম সমসংখ্যক। এই অঞ্চলে কখনো
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধেনি। দু-সম্প্রদায়ে খুব ভাব। বলতে গেলে গলায় গলায় ভাব।
সবলসিংহপুর ও আশপাশের গ্রামে বাবাকে সবাই চিনত। একমাত্র কারণ তিনি শুধু ম্যাট্রিক নন, এম.এ. পাশ। আবার সরকারি কলেজের অধ্যাপক। তিনি যেন একজন কেউকেটা ব্যক্তি। আমরা দেখেছি, তিনি কলকাতা থেকে গ্রামে এলেই উৎসব লেগে যেত। কখনো ঘুড়ি উড়োচ্ছেন সবার সঙ্গে। কখনো জমাট আড্ডা। গ্রাম প্রায় খালি করে লোকজন লাগাতার আসত।
সারা গ্রামে একমাত্র বাবার ছিল ক্যারম-বোর্ড। খেলাও চলত। বাবা ছিলেন এ-অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়। তিনি মধ্যম অঙ্গুলি দিয়ে স্ট্রাইক করতেন। বুড়ো আঙুল আর দ্বিতীয় আঙুল দিয়ে সাধারণত স্ট্রাইক করে সবাই। বাবা আমাদের শেখাতেন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আর মধ্যমার সুবিধা। এতে অন্য ঘুটির ফাঁক অল্প থাকলেও কাজে অসুবিধা হয় না। আমি বা অন্যরা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতাম। শেষ পর্যন্ত সেই বুড়ো আঙুল আর দ্বিতীয় আঙুলে চিরাচরিত চলে প্রত্যাবর্তন।
ক্যারম-বোর্ডটা ছিল বেশ দামি। আর স্ট্যান্ডার্ড সাইজের। ঘুঁটিগুলো খুব সুন্দর। আর পলিশও ছিল পাকা। বিশেষ করে সাদা ঘুটি। ঘিয়ে রঙের ঘুটিগুলো খুব ছিল সুদর্শন। আর মধ্যমণি রেড আসলে ছিল পাকা গোলাপি। যদিও নাম রেড। সিঙ্গেলে বাবাকে কেউ হারাতে পারত না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপরীতে বসা ব্যক্তি নিল গেম খেত। আমিও বাবার অপজিট পার্টি হয়ে খেলেছি। আর পেয়েছি নিল গেম। নিল গেম খেলেই আমার রাগ হয়ে যেত। সব ঘুটি এলোমেলো করে কান্নাকাটি করতাম। মা ছুটে আসতেন। কী হলো! বাবা হাসতে হাসতে বলতেন, খুব নিচু স্বরে, নিল গেম খেয়েছে। মা আস্তে সরে পড়তেন। আর বাবা বলতেন, কান্না থামাও, আর এক গেম হোক। এবার হয়তো তুমি জিতবে। পরে বাবা হেরে যেতেন। অবশ্য নিল গেম দিতে পারিনি কখনো। এখন বুঝি খেলাতে আমার মনোযোগ রক্ষার খাতিরে ইচ্ছা করে হেরে যেতেন। অবশ্য আমরা দেশভাগের পর যখন চট্টগ্রামে খেলতাম, তখন বাবা সব সময় জিততে পারতেন না। তখন আমরাও বাঘের বাচ্চা।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.