জগৎজোড়া লোকের কাছে ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো’ বিদ্রোহী কবি তিনি, আবার সেই প্রবল দ্রোহের কবিই বাঙালির ‘দুখু মিয়া’। ‘চির-বিদ্রোহী বীর’ এই কবি নিজেই বলেছেন ‘চির-উন্নত শির’ তাঁর। এমন প্রবলতর জানান যখন দিয়ে যাচ্ছেন 888sport app download apkর ছত্রে ছত্রে, সেই কবিই আবার সেই একই 888sport app download apkয় বলছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’। আর এই নিরন্তর গভীর বৈপরীত্যময়তাই নজরুলকে বাঙালির প্রাণের কবি করে তুলেছে। যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাই আপামর জনসাধারণ থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ জ্ঞানী গবেষক পর্যন্ত সকলের কাছে নজরুল তাই একই সঙ্গে দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি। আমার কাছে নজরুল বড্ড বিশেষ, অতি আপনার। ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে’ যিনি আমার সমগ্র সত্তা ছুঁয়ে আছেন, জুড়ে আছেন; যাঁর গানে গানে আমি নিরন্তর খুঁজে বেড়াই ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’-কে। সেই কোন সে শৈশবে গানকে নিয়ে আমার যে পথচলার শুরু কিংবা গানকে ঘিরে আমার যে একান্ত আপনার জগতের পত্তন, অবচেতনেই সেখানে নজরুল চির মূর্তমান।
আশৈশব গান, গানের সুর, সুরের বোধ আমার অন্তঃপুরে এক সুবিশাল জায়গা জুড়ে আছে। পরিণত বয়সে এসে আজ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করি কীভাবে এই অনুষঙ্গ আমার মনোজাগতিক ভুবনকেই শুধু সংগঠিত করেনি, সংগঠন করেছে আমার সমগ্র আত্মপরিচয়, আমার বাঙালিয়ানার বোধ। আর অবচেতনেই নজরুলের গান আমার জীবনপথের বাঁকে বাঁকে, এর প্রতিটি সন্ধিক্ষণে আমায় সঙ্গ দিয়েছে, দিয়েছে বৌদ্ধিক ভাবনার জন্ম, দিয়েছে সৃজনশীলতার প্রেরণা। যে-কোনো কঠিন মুহূর্তে আমি নিরন্তর অনুপ্রেরণা পাই ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শীর্ষক অভিভাষণে গানকে নিয়ে নজরুলের নিজের বলা কথাতেই – ‘জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।’১
জীবন এক চলমান প্রক্রিয়া। প্রত্যেকটি মানুষের জাগতিক বোধ-অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে তার জীবনাচরণের মনস্তাত্ত্বিক দর্শন থেকে তার সৃষ্টিশীলতা কিংবা সৃজনশীলতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে এই চলমান প্রক্রিয়া ভিন্ন থেকে ভিন্নতর স্বতন্ত্র মাত্রা পায়। তাই আজ অবচেতনে নয়, বরং সচেতনেই জানি আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনের পথ পরিক্রমায় আমার চিরসখা গান আর গানের বোধকে যদি ‘পার্থ’ হিসেবে ভাবি, তবে নজরুলের গান ‘পার্থসারথী’ হয়ে আমাকে নিরন্তর চিনিয়ে যাচ্ছে চিরসখা ‘পার্থ’কে, আর ‘পার্থ’র চোখ দিয়ে জগৎসংসারকে। সুতরাং জীবনের কঠিনতম সময়ে বারংবার আমার ‘পার্থসারথী’সম নজরুলের কাছেই ফিরে যাই, তাঁর গানের কথাতেই পরম পুরুষের কাছে সানুনয় নিবেদন করি ‘পাঞ্চজন্য শঙ্খ’ বাজিয়ে – ‘চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর,/ ভয়-ভীতজনে কর হে নিঃশঙ্ক।’
গবেষক নারায়ণ চৌধুরী তাঁর ‘কাজী নজরুলের গান’ শীর্ষক গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন, ‘নজরুল সত্তায় যেন এক অফুরন্ত সৃষ্টির সঞ্চয় লুকানো ছিল, রূপকথার কল্পবৃক্ষে নাড়া দিলেই যেমন তার থেকে সোনা রূপা ঝরে পড়ত, তেমনি তাঁর গানের গাছে নাড়া দিলেই চাইতে না চাইতে রকমারী গানের ফল টুপ করে খসে পড়ত। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুল এক অতি অদ্ভুত সৃষ্টিশীল প্রতিভা। নব-নবোন্মেষশালিনী সুর সৃজনের প্রতিভায় তিনিই তাঁর তুলনা, তাঁর আর কোন দোসর নেই।’২ আমার নজরুল সত্যিকার অর্থেই সেই রূপকথার কল্পবৃক্ষ। অথবা আমার নিজের মতো করে বললে নজরুলের গানের মাঝে আমি অনিঃশেষ এক গুপ্তধন ভাণ্ডারে মণি-মাণিক্য সন্ধান করে বেড়ানোর আনন্দ খুঁজে পাই। যত পাই তত আরো খুঁজি, আরো কিছু পাবার আশায়। সেই খোঁজার আনন্দে নেই ক্লান্তি, নেই নিরাশা, নেই হারানোর ভয়। এ এক পরম আনন্দ। আর সেই খোঁজে নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দ যেমন আছে, তেমনি অবাক বিস্ময়ে দেখি আগে পাওয়া মণি-মাণিক্যও জীবনের এক এক বয়সে, এক এক স্তরে ভিন্ন ভিন্ন আলো ছড়ায় – বোধের ভিন্নতায়, ভাবনার পার্থক্যে নজরুলকে নতুন করে চেনায়। তাই বয়সে, বোধে, মননে, সৃজনে আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরুলও আমার কাছে প্রকাশমান হন, বিকশিত হন, উন্মীলিত হন।
খুব ছোটবেলাতে স্কুলে যাওয়ারও আগে গান শেখা শুরু আমার। আর সে একেবারে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয়সংগীত। সে-বয়সে রাগসংগীতের রস, ভাব বা প্রকৃতি বোঝার মতো বোধ বা বুদ্ধি কোনোটাই ছিল না আর তা থাকার কথাও হয়তো নয়। অনেক পরে যখন জেনেছি চূড়ান্ত বৈপরীত্যময় প্রেম আর ক্রোধ যেই শব্দে একাকার হয়ে গেছে, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয়সংগীতে সেই রাগ শব্দটি এসেছে রঞ্জক থেকে; তখন বুঝেছি স্বরের বিন্যাসে গাঁথা সুরের লহরী মনকে রঞ্জিত করে বলেই না ‘রঞ্জয়দি ইতি রাগ’। প্রেম আর ক্রোধ দুই-ই মনকে উদ্দীপিত করে, মনকে রাঙায়। ঠিক তেমনি সুরের খেলায় আর স্বরের মেলায় এই রঞ্জনা করার যে প্রয়াস সেটাই রাগের আসল কথা। এখানে ব্যাকরণ নয়, বরং স্বরের বৌদ্ধিক আর সৃজনশীল মেলবন্ধনে সৃষ্ট সুরেলা অনুরণনের যে ভাবপূর্ণ ব্যাপ্তি সেটাই মনকে রাঙায়, চিত্তে দোলা দেয়। আর সত্যি বলতে আমার জীবনে রাগসংগীতে স্বরসংগতির জ্ঞানের সঙ্গে এর রস আর ভাবের বোধের যে মিলন ঘটেছে তার উৎসমুখেও দাঁড়িয়ে আছেন নজরুল। রসকষহীন ব্যাকরণে রাগের সত্যিকার পরিচয় মেলে না, একে ছাপিয়ে প্রতিটি রাগের যে একটি চরিত্র আছে, রস-রূপ-ভাব আছে, নজরুলের গানই যেন তা আমাকে প্রথমে জানান দিয়েছিল। তাঁর গানে অভূতপূর্ব বাণীর সঙ্গে সুরের যে মিশেল আর তার যে চিত্রিত রূপকল্প – আমার মনে খুব সহজেই সে বিভিন্ন রাগের রূপখানি এঁকে দিয়েছিল। সত্যিকার অর্থে তাঁর গানেই আমার বোধ জাগলো প্রথম – ‘রঞ্জকো জনচিত্তানাং স রাগঃ কথিতো বধৈঃ’ – রাগের সরগম দিয়ে ছবি আঁকা যায়, আর তাতে চিত্ত হরণ করাও সম্ভব।
সেই স্কুলপড়ুয়া আমার মনে আহির ভৈরব রাগে বাঁধা ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানটি শেখার সময় একদিকে যেমন ‘আহির’ শব্দের ভেতর দিয়ে গোপবালকের রূপকল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, ঠিক তেমনিভাবে বাংলা গানে সুরের সঙ্গে বাণীর প্রগাঢ় সম্পৃক্ততার বিষয়টি মনে গেঁথে গিয়েছিল গভীরভাবে। সেই গানের বাণী পড়তে পড়তে কোন ফাঁকে যেন আমার শিশুমনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল ভোরবেলাকার এক অপূর্ব দৃশ্য যেখানে কোনো এক সবুজ-শ্যামল গ্রামে ঊষালগ্নে এক রাখাল বালক তার পোষ্যদের নিয়ে যাচ্ছে মাঠের দিকে। প্রত্যুষকালের রাগ আহির ভৈরবের প্রকৃতি শান্ত, এর সুরের আমেজে আছে ভক্তিরস। ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানের বাণীর মাঝে প্রকাশমান রূপকল্প আর আহির ভৈরব রাগে বাঁধা এর সুর যে কারো মনেই এক শান্ত ধ্যানী যোগীর এক চিত্রকল্প এঁকে দেয়, যেখানে কি না জ্যোতির্ময় সেই যোগী নীরবে এসে দুয়ারে দাঁড়িয়েছেন – এ যেন আহির ভৈরব নিজেই ‘বাঘছাল পরিহর, ধর নটবর বেশ, পর নীপমালা’য় সেজে ঋষিমূর্তি ধরে এসেছেন। এ-গানের মধ্য দিয়েই আহির ভৈরব রাগের চিত্রকল্প চিরতরে আমার মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। সেই ছোটবেলায় মনে গেঁথে যাওয়া ভাবনা থেকেই ঋষিরূপী আহির ভৈরবকে বড় আপনার লাগে। যতবার আহির ভৈরব রাগটি গাইতে বসি, ততবার এই ঋষিকে মনে মনে কল্পনা করে নিজেই এক ‘আহিরিণী’ হয়ে সানুনয় আকুতি জানাই ‘ত্রিভুবন-পতি’কে যেন তিনি প্রিয় হয়ে দেখা দেন ‘নবমেঘে চন্দনে ঢাকি অঙ্গজ্যোতি’।
অথবা সেই সে কোন ছোটবেলায় যখন বৃন্দাবনী সারং রাগে বাঁধা ‘তৃষিত আকাশ কাঁপে রে’ শুনেছিলাম তখন তৎক্ষণাৎ ‘প্রখর রবির তাপে’ তাপিত গ্রীষ্মদিনের কী দারুণ এক রূপকল্প সেই শিশুমনেই আঁকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর জানলাম, ফার্সি ভাষায় ‘সারং’ শব্দের অর্থ মেঘ হলেও সারং ঘরের রাগগুলোর ঋতু গ্রীষ্ম। কিন্তু গ্রীষ্মশেষের সেই গ্রীষ্মকালে খানিক মেঘের আভাস আছে, ধীরে ধীরে তার সঞ্চার আছে অল্প বিস্তর। ক্রমশ যখন জানা হলো, বৃন্দাবনের প্রখর দাবদাহে মেঘের তৃষার মতোই বৃন্দাবন শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণের অনুষঙ্গ পাওয়ার আকাক্সক্ষা, তখন বৃন্দাবনী সারং রাগ হয়ে উঠল আমার কাছে গনগনে তপ্ত দিনে মেঘের দেখা পাওয়ার পরম আকুতি প্রকাশের সুর। আর তাতে বাঁধা গান ‘তৃষিত আকাশ কাঁপেরে’ তৈরি করে দিলো গ্রীষ্মদিনের রূপকল্প, যা আমার একান্ত নিজস্ব।
আবার মেঘ রাগে বাঁধা ‘শ্যামা তন্বী আমি মেঘ বরণা’ কিংবা মিয়া মল্লার রাগে বাঁধা ‘স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা’ সমস্ত ব্যাকরণের কাঠিন্য ছাড়িয়ে বর্ষাকে আমার কাছে এক শ্যামবর্ণা বাঙালি মেয়ের রূপে উপস্থাপন করে। আর এভাবেই হিন্দুস্তানি রাগের সুরে আর স্বরের সঙ্গে আমার বাঙালিয়ানার সমাপতন ঘটে। পুরাণমতে পণ্ডিতেরা বলেন, গোবর্ধনলীলার সময় শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর কনিষ্ঠাতে পুরো গোবর্ধন পর্বত ধারণ করেছিলেন, তখন মহাদেব ডমরু বাজিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে রক্ষা করতে, সেই ডমরুর শব্দেই মেঘ রাগের সৃষ্টি। এর রস গম্ভীর। নজরুলের গানে আমার অন্তর্লোকে মেঘ রাগের চিত্রকল্প আঁকা হয় যেখানে ‘অম্বরে জলদ মৃদঙ্গ’ বাজায় আর মৃদঙ্গের গভীর গম্ভীর শব্দ আমাকে মেঘ রাগের গাম্ভীর্যের দিশা দেয়। আর রাগের স্বরবিন্যাস ছাপিয়ে মেঘ রাগ আমার কাছে বরষারূপী এক শ্যামাতন্বী জীবন্ত মানবী হয়ে ওঠে, যে কি না ‘মুখে হাসি, চোখে জল’ নিয়ে ‘কদম কেয়ার ডালা’ সাজায়। পুবালি হাওয়াতে ভেসে আসা বরষা আনে বিজলি, আনে মেঘ। চোখ বুজে যখনই মেঘ রাগের সুর ধরি, নজরুলের গানে আঁকা চিত্রকল্প আমার কণ্ঠে স্বর আর সুরের বিন্যাসে রাগের ছবি এঁকে যায়।
সম্রাট আকবরের সভায় সংগীতসম্রাট তানসেন জলদগম্ভীর মেঘ আর ভারী উত্তাল বৃষ্টির সুরেলা ধ্বনিকে একসঙ্গে ভেবে নিয়ে মিয়া মল্লার রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। এ-রাগের রসে একই সঙ্গে আছে গাম্ভীর্য আর স্নিগ্ধতা। কৈশোরে যখন এ-রাগের চলন, ব্যাকরণ শিখছিলাম তখন এর সুরের রেশ মনে এনে দিলো নজরুলের গান – ‘স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা’। সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে এঁকে নিয়েছিলাম ‘ঘন নীল বাসে অঙ্গ ঘিরে’ থাকা ‘ক্ষীণা তন্বী’ যে কি না ‘জল ভারে নমিতা’ আর ‘ডাকে বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে’ আর তার হাতে ‘কুন্দ মালতী-যুঁই ভরি’ থালিকা’। আর ঠিক এভাবেই মিলেমিশে যায় মিয়া তানসেনের রাগভাবনা আর নজরুলের শব্দবন্ধে আঁকা রাগের চিত্রপট। সেই যে আমার কিশোরী বাঙালি মনে চিরকালের মতো মিয়া তানসেন আর নজরুল মিয়া মল্লার রাগে একাকার হয়ে গেলেন, তার রেশ আজো কাটেনি।
ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে নবরসের কথা বলা আছে – শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রুদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত। এই নবরস মনের বিশেষ বিশেষ অবস্থা, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ করে। আমাদের জীবনের চড়াই-উতরাই, উত্থান-পতন, সুখ-শোক-কান্না-হাসির গল্পগুলো এই স্বতন্ত্র অনন্যমাত্রিক নয়টি রসের দোলাচলেই গাঁথা হয়, উন্মীলিত হয় আমাদের জীবনের চিরচলমান প্রতিরূপ। আমাদের সংগীতে শৃঙ্গার, শান্ত আর করুণ রসের প্রাধান্য দেখা যায়। আর কিছু কিছু সময় বীর রসের উপস্থিতিও উজ্জ্বলভাবে প্রকাশমান হয়। শৃঙ্গার রসে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, অভিমান, বিরহ, মিলন যেমন আছে, তেমনি আছে ভক্তিভাব। আর এখানেই মানবপ্রেম আর ঈশ্বরপ্রেম একাকার হয়ে গেছে শৃঙ্গার রসে। নজরুলের গানে শৃঙ্গার রস এসেছে নানা ভাবে, নানা ঢঙে, নানা মাত্রায় আর নানা উপচারে। শৃঙ্গার রসের যে গভীরতা, ভিন্নমাত্রিকতা আর অনন্যতা আছে নজরুলের গান আমায় সে-বোধ দিয়েছে। আর সে কারণেই আভিধানিকভাবে শৃঙ্গার শব্দের বর্ণনা (আদিরস তথা কামনা বা সম্ভোগের বাসনা) ছাপিয়ে এর গভীর দ্যোতনা আমাকে শিখিয়েছে, জানিয়েছে যে, বৌদ্ধিক ভাবনা আর মননের প্রয়োগে ভাষার শব্দেরা ভিন্নতর ব্যঞ্জনা খুঁজে পায়, পায় অনন্য মাত্রা।
নজরুলের ঠুমরি আমাকে সেই ভিন্নতর শৃঙ্গার রসভাবনার জোগান আর প্রমাণ দুই-ই দিয়েছে, নিরন্তর দিয়ে চলেছে। উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের উপাদান ঠুমরি শৃঙ্গার রসের অভিব্যক্তিতে আর্দ্র। আপাদমস্তক প্রণয় রসে সিক্ত ঠুমরির বিষয়বস্তু মূলত প্রেম, মানবপ্রেম। এর বাণীতে আছে মান-অভিমান, পূর্বরাগ-অনুরাগ, বিরহ-বিচ্ছেদযন্ত্রণা, চঞ্চলতা-প্রগলভতা, অভিসার-মিলনের পরম আকুতি। রাগের বিশুদ্ধতায় নয়, বরং শৃঙ্গার রসের নানান উপচারে বাণীর সঙ্গে সুরের অভিব্যক্তি মিলিয়ে ঠুমরির চিত্রকল্প আঁকা হয়, এর ব্যঞ্জনা প্রকাশমান হয়। নজরুল এক অনায়াস দক্ষতায় হিন্দুস্তানি ঠুমরিকে একান্ত বাঙালির করে তুলেছেন। শৃঙ্গার রসকে ঘিরে বাঙালির ভাবনায় এনেছেন এক অভাবনীয় পরিবর্তন। তাঁর ঠুমরির মাধ্যমে তিনি যেমন বাংলা গানকে নতুন দিশা দিয়েছেন, তেমনি বাঙালির কল্পনাপ্রবণ প্রেমিক কাব্যিক সংগীতভাবনায় জাগিয়েছেন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। তাঁর ঠুমরির আদলে উত্তর ভারতীয় ছাপ আছে হয়তো কিন্তু রসে, বশে সে একান্ত বাঙালির। আর ঠিক এখানেই, এভাবেই আমার নজরুল আমার ভাবজাগতিক অন্তর্লোকে আমার বাঙালিয়ানার সঙ্গে আমার হিন্দুস্তানি সংগীতের জ্ঞান আর বোধের অনন্য সমাপতন ঘটিয়েছেন।
‘পরাণপ্রিয় কেন এলে অবেলায়’ কিংবা ‘কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী’ গানগুলি যখন গাই তখন এ গানগুলির বাণীর গভীর অভিব্যক্তি যেমন আমার মনকে স্পর্শ করে যায়, এদের মাঝে লুকিয়ে থাকা অভিমান আর আকুতি পূর্ণতা পায় পিলু রাগের সুরে। কাফি ঠাটে বাঁধা মিষ্টি রাগ পিলু প্রেমের রাগ, বিরহের রাগ – এই রাগের শৃঙ্গাররসে একদিকে আছে গভীর বিষণ্নতা-অভিমান-বিরহ-মিলনের সানুনয় আকুতি আবার আছে ভক্তিরসও। তাই পিলু রাগের সুর যেমন আমায় একদিকে গানের বাণীর চিত্রকল্প আঁকতে সহায়তা করে, ঠিক তেমনি নজরুলের শব্দবন্ধ বারবার চিনিয়ে দেয় পিলু রাগের পথ পরিক্রমা। আমায় ভাসিয়ে নেয় তার সুরের ভেলায়।
আবার নাতিচঞ্চল শান্ত প্রকৃতির রাগ ভৈরবীতে ভক্তি ও শৃঙ্গার রসের ভিন্নতর প্রকাশ ঘটে। এ রাগে বাঁধা ঠুমরি ‘না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়’ তাই শুধু আমার কাছে প্রিয়সঙ্গ যাপনের পর ভোরবেলাকার বিচ্ছেদের কষ্ট মনে করায় না, ভাবায় জীবনের সব প্রিয় মুহূর্ত বড্ড ক্ষণস্থায়ী অথবা প্রিয়সঙ্গলাভে মনের যে গভীর অনন্ত অভিলাষ তা কখনোই হয়তো পূর্ণতা পায় না। কিংবা যখন গাই ‘ফুল ফাগুনের এল মরশুম’ তখন ভৈরবীর বারোটি স্বরের অনন্য ব্যবহারে শৃঙ্গার রস আমার কাছে ঠিক যেন জীবনের সব রং, সকল উপচার ছুঁয়ে যাওয়ার প্রয়াস মনে হয়। এ-রাগে বাঁধা নজরুলের ঠুমরি তথা 888sport app গানে বিচ্ছেদ-বিরহ-অভিমান মিলেমিশে একাকার, সঙ্গে আছে শাশ্বত প্রেমের সানুনয় আকুতি – সে প্রেম কখনো নশ্বর, কখনোবা অবিনশ্বর। তাই এ-রাগ আমাকে চেনায় এক অনন্য নজরুলকে যাঁর জীবনটা ঠিক ভৈরবী রাগের শুদ্ধ-কোমল-কড়ি বারোটি স্বরের সমন্বয়ে আঁকা অনিঃশেষ দুর্দান্ত সৃষ্টিশীল এক মানুষের অভিযাত্রার এক প্রতিরূপ।
এই যে এতো নানা অনুভূতি, ভাব বা রসের কথা এলো, এ প্রসঙ্গে আমার একান্ত নিজের একটি ভাবনাও ভাগ করে নেওয়া খুব প্রাসঙ্গিক হবে হয়তো। আমাদের মনোজগতে এই সমস্ত নানান অনুভব বা অনুভূতির উপলব্ধির ব্যাপারটা নানান স্তরে সাজানো। ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে, ভিন্নতর অভিজ্ঞতায়, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই অনুভব আর অনুভূতিগুলি ভিন্ন মাত্রা পায়, অনন্যতা পায়, স্বতন্ত্রতা পায়। আবার জীবনের পথ পরিক্রমার অভিজ্ঞতাকে আমি তুলনা করে দেখি অনেকটা পেঁয়াজের মতো। এর খোলস ছাড়িয়ে যত গভীরে ঢুকি, এর উপলব্ধি তত তীব্রতা পায়। এর রং বদলায়, সঙ্গে এর উগ্রতা, উচ্ছলতা কমে; কিন্তু বাড়ে এর গভীরতা। নজরুল নিজেই তাঁর ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শীর্ষক অভিভাষণে বলেছেন – ‘আমার বেশ মনে পড়ছে। একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্র শোকে যখন ভেঙে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য, আমার গান আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।’৩ নজরুলের গানের বাণীতে, এর সুরের বৈচিত্র্যে আমি যেমন তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে তাঁর অনুভব, অনুভূতি, উপলব্ধির পরিবর্তন দেখি; ঠিক তেমনি আমার জীবনেও বয়স, অভিজ্ঞতার পরিণতিপ্রাপ্তি আমার নজরুলকে আমার মতো করে বোঝাতে, জানাতে, চেনাতে আমার অনুভবে, বোধে, মননে ভিন্নতর মাত্রা উপলব্ধি করি।
আমি ইংরেজি 888sport live footballের ছাত্রী ছিলাম, সঙ্গে তুলনামূলক 888sport live football পড়েছি। এই পরিণত বয়সে এসে বুঝি, জীবনের পথ পরিক্রমায় ভিন্ন ভিন্ন বয়সে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যেমন একই 888sport app download apk, গল্প, 888sport alternative link কিংবা নিবন্ধ ভিন্নতর ভাবজাগতিক বোধ আর বৌদ্ধিক উপলব্ধির জন্ম দেয়, ঠিক তেমনি গানের বাণী, সাংগীতিক মনন-চিন্তাও সময়ের সঙ্গে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে, অন্তর্লোকে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা তৈরি করে, সৃষ্টি করে অভূতপূর্ব নিত্যনতুন দ্যোতনা। মানসচক্ষে এর রূপ-রস-ভাব যায় বদলে। আর এই বদলের বোধের মাঝে লুকিয়ে আছে অন্যরকম আবিষ্কারের এক আনন্দ।
বড়জোর বছর ছয়েক বয়স হবে বোধকরি তখন, যখন জৌনপুরী রাগে বাঁধা ‘মম মধুর মিনতি শোন ঘনশ্যাম’ গানটি শিখেছিলাম। তখন সেই বয়সে ‘মধুর মিনতি’ শব্দগুচ্ছের মানেই বা কী আর ঘনশ্যামের ‘চরণ জড়ায়ে ধরে কাঁদিতে’ পারার জন্য অতো সানুনয় আকুতিই বা কেন সে বোঝার আমার বয়স বা মন কোনোটাই কী আর ছিল! আর সেই গান বেছে বেছে কবি জৌনপুরী রাগেই বাঁধলেন কেন – অমনতরো ভাবার মতো মন আর মনন কোনোটাই ছিল না আমার তখন, থাকার কথাও নয়। সে-বয়সে গুরুর কাছ থেকে কণ্ঠে তুলে নেওয়া আলাপ, খানদুয়েক বিস্তার সহযোগে তাল, লয়, সুর সঠিক রেখে গানটা গাইবার প্রয়াসটাই মুখ্য ছিল। সকলের বাহবাটুকু মনে বেশ তৃপ্তিই হয়তো দিত। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছে যখন নতুন করে জানলাম, জৌনপুরী রাগে নিবেদনের, আত্মসমর্পণের আকুতি আছে, আছে সনির্বন্ধ মিনতি, তখন ছোটবেলাতে শেখা ‘মম মধুর মিনতি শোন ঘনশ্যাম’ গানটি অন্য মাত্রা নিয়ে এলো আমার সামনে!! আরো পরে যখন শৃঙ্গার রসের ভিন্নমাত্রিকতার উন্মেষ হতে থাকল ধীরে ধীরে আমার মনে, মননে আর বোধে, তখন জানলাম, শৃঙ্গার রসের গভীরে থাকা বিরহের এক দুর্মর বিষণ্নতা আছে। জৌনপুরীর কোমল গান্ধার সেই বিষণ্নতাকেই ধারণ করে। শৃঙ্গার রসের সেই গভীর বিষণ্নতা কোথাও গিয়ে ভক্তিরসে মেশে। যত এ-রাগের রূপ-রস আমার মনে ধরা দিতে থাকল, তত বুঝলাম কেন নজরুল এই গান জৌনপুরী রাগে বেঁধেছেন, কেন বারবার ‘ঘনশ্যাম’ শব্দটি কোমল গান্ধার ছুঁয়ে যায়, কেনই বা ‘চরণ জড়ায়ে ধরে’ শব্দবন্ধ কোমল গান্ধারকেই স্পর্শ করে আসে। বয়স আর বোধ যত পরিণত হয়েছে, তত বুঝেছি ‘মধুর মিনতি’ শব্দযুগলে ভাব আর ভক্তির কী মধুর মিশেলই না হয়েছে অথবা ‘চরণ জড়ায়ে ধরে কাঁদিতে পারি’ শব্দবন্ধে কত গভীর আকুতি, সানুনয় নিবেদন আছে আর এর সুরেলা সাংগীতিক প্রকাশের জন্য জৌনপুরীর চেয়ে আর উত্তম কীই বা হতে পারে! আর ঠিক এমনিভাবে আমার জীবনভর নজরুলের চেনা গান, চেনা সুর নিরন্তর নতুন নতুন অর্থ, অনন্য সব বোধের জন্ম দিয়েছে। আমার জীবন তাই সদাই নতুন কিছু খুঁজে বেড়ানোর আনন্দে মশগুল থাকতে পারে। আমার অন্তরের সুরলোকে নজরুলের গান আমার তেমন বন্ধু যে শতরূপে শতবার ধরা দিয়েও কখনো পুরনো আটপৌরে হয় না – ‘তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয় শতরূপে শতবার/ জনমে জনমে চলে তাই মোর অনন্ত অভিসার।’
আমার কাছে নজরুল এক চিরমুখর গানের বুলবুলি, যাঁকে আমি চিনেছি তাঁর গান দিয়ে আবার আমার গানের বোধ বা মননের উন্মেষেও তাঁর গানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর গানের প্রতি তাঁর নিজেরও বড় পক্ষপাত ছিল। তিনি নিজেই তো বলেছেন, ‘আপনারা আমার 888sport app download apk সম্পর্কে যা ইচ্ছা হয় বলুন কিন্তু গান সম্পর্কে নয়। গান আমার আত্মার উপলব্ধি।’৪ তাঁর গান যেমন তাঁর ‘আত্মার উপলব্ধি’ ছিল, তেমনি তাঁর গান আমাকে আমার আত্মানুসন্ধানের নিরন্তর খোরাক জোগায়। গান ভালোবাসতেন বিধায় বোধকরি নজরুল নিজেকে বসন্তের বার্তাবাহক গানের পাখিদের সহযাত্রী মনে করতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন – ‘কোকিল, পাপিয়া, বৌ কথা কও … এরা ছন্নছাড়া, কেবলই ঘুরে বেড়ায়, শ্রী নাই, সামঞ্জস্য নাই, কোথায় যায়, কোথায় থাকে – ভ্যাগাবন্ড এক নম্বর। তবু আনন্দগান গেয়ে গেল এরাই। এরাই স্বর্গের ইঙ্গিত এনে দিল।’ নজরুলও আমার কাছে ঠিক এই বসন্তের পাখিদের মতোই, আশৈশব জীবনভর প্রতিনিয়ত যিনি আনন্দগান গেয়ে স্বর্গের ইঙ্গিত এনে দেন। আমার নজরুল খ্যাপাটে কিন্তু দীপ্তিময়; ছন্নছাড়া কিন্তু প্রজ্ঞাবান; অগোছালো কিন্তু ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’ – যিনি কি না নিজেই লিখেছেন, ‘তোমার অনুরাগে, ওগো বুলবুল/ মোর গানের লতায় ফোটে কথার ফুল।’ তাই আমার মানসপটে যে নজরুলের নিত্য আনাগোনা তাঁকে নিয়ত বলি – ‘তোমার বিনা তারের গীতি বাজে আমার বীণার তারে/ রইল তোমার ছন্দ গাঁথা আমার কণ্ঠ হারে।’
তথ্যসূত্র
১. ৬ এপ্রিল ১৯৪১-এ ‘বঙ্গীয় মুসলিম 888sport live football সমিতি’র রজতজয়ন্তীতে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শিরোনামে সভাপতির ভাষণ দেন কাজী নজরুল ইসলাম।
২. কাজী নজরুলের গান, নারায়ণ চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১০-১১।
৩. ৬ এপ্রিল ১৯৪১-এ ‘বঙ্গীয় মুসলিম 888sport live football সমিতি’র রজতজয়ন্তীতে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শিরোনামে সভাপতির ভাষণ দেন কাজী নজরুল ইসলাম।
৪. নজরুল গীতি, আবদুল আজীজ আল আমান, পৃ ৩৫।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.