আমার বাবার মুখ

মইনুল ইসলাম জাবের

‘অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি’

প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরুতে হতো আমার আর আমার বাবার। স্কুলে পৌঁছুতে হবে পৌনে ৮টার মধ্যে – কারণ তখন পিটি করে ক্লাস ধরতে হতো সকাল ৮টায়। বাবা ঘুম থেকে উঠতেন সকাল সাড়ে ৬টায় আর তার পরপরই মা আর আমি ৭টায়। বাবার প্রথম কাজ স্যান্ডউইচ তৈরি করা, তারপর আমার দাঁত মাজানো। এ দুটো করিয়ে মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া হতো আমাকে। স্নান সেরে সোয়া ৭টার মধ্যে খাবার টেবিলে বসে বাবার জেলি মাখানো রুটি খেতে খেতে বাবারই করা টেবিল-ছড়ানো প্রচ্ছদে চোখ বুলিয়ে তারপর নিচে নামতাম আমি। ততক্ষণে আমাদের ডাইহাটসু গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছেন বাবা। গাড়িতে পাঁচ মিনিট বসে তারপর স্কুলের পথে চলা – বাবা আর ছেলের।

অনেকদিনই নানা কাজের চাপে বাবা বাড়ি ফিরতেন দেরিতে – অনেক রাতে। তবু ভোরে উঠে আমার দাঁত মেজে দেওয়ার কাজটি না করলে ভাবতেন তাঁর হয়তো দিনটাই মাটি হয়ে গেল। ওঁর নিজের দাঁতগুলো নিয়ে ছিল সমস্যা। সেই ছোট্টটি কাল থেকে প্রতি মাসেই তাঁকে দেখেছি দাঁতের ব্যথায় কাতরাতে। প্রায় মাসের চার-পাঁচটি সন্ধ্যা বরাদ্দ ছিল দাঁতের ডাক্তারের জন্যে। দাঁতের ডাক্তার সেরে বাড়ি ফিরে অবধারিতভাবে বাবা খাটের এক কোনায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকতেন। বাবার ন্যাওটা ছিলেম বলে এসব আমার একদম পছন্দ হতো না। সন্ধ্যাটা আমাদের একসঙ্গে কাটানোর কথা। রাগ হতো, বাবা কেন সব দাঁত ফেলে দেন না। তবে দিন পাঁচেক পর সুস্থ হয়ে বাবা যখন স্কুল থেকে আনার পথে নিউমার্কেটের জিনাত বুক শপে নিয়ে এই বই-সেই বই কিনে দিতেন আমাকে, তখন রাগটা কমে যেত। তবে দাঁতের ব্যথা কমে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হতো বাবার তদারকি। আমি ঠিকমতো দাঁত মাজলাম কিনা। ঘুমুতে যাবার আগে আর সকালে উঠেই তাঁর প্রথম কথা, ‘আমি আর বড়ভাই দাঁতের যত্ন নিইনি, তাই আজ আমার এই অবস্থা, আববু দাঁত মেজেছ তো?’ আরো ছোট্টটি যখন ছিলাম, আমার এলোমেলো দাঁতগুলো প্রতিদিন নিয়ম করে টিপে দিতেন তিনি। এত বছর পরও ডাক্তার যখন আমার দাঁত দেখেন; বলেন, ‘আপনার বাবার মতো বাবা তো বিরল, আপনার দাঁতের এমনি তদারকি করতেন!’

সেই আশির দশকের শুরুর দিকে 888sport appয় এমন জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ত না। আমাদের আজিমপুরের বাসা থেকে গাড়িতে করে তাই মিনিট দশেক লাগত স্কুল পৌঁছাতে। এই দশটি মিনিট ছিল আমার আর বাবার গলা সাধবার সময়। বাবা আমাকে নিয়ে গাইতেন ‘অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি বিচার দিনের স্বামী/ যত গুণগান হে চিরমহান তুমি অন্তর্যামী।’ কিংবা, ‘অল্প লইয়া থাকি তাই/ মোর যাহা যায় তাহা যায়।’ কিংবা, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে/ যত দূরে আমি ধাই।’ আবার তার পরপরই কোরানের কোনো সুরা পড়িয়ে নিতেন। আবার কখনো-সখনো ফ্রাঞ্জ সিনাত্রার গলার ‘থ্রি কয়েনস ইন দ্য ফাউন্টেইন।’ কখনো-সখনো গান গাইবার পর সময় থাকলে বাবা বলতেন সুকুমার রায়ের 888sport app download apk – ‘আয়রে ভোলা খেয়াল খোলা স্বপন দোলা নাচিয়ে আয়/ আয়রে পাগল আবোল তাবোল মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।’ 888sport app download apk পড়া আর শেষ হতো না, গাড়ি পৌঁছুত স্কুলের গেট – আর আমাকে দৌড়ে ঢুকে যেতে হতো স্কুলের ভেতর। প্রায়শই আমরা হতাম ‘লেইট’।

বাবা অবশ্য আমার স্কুলের পড়া নিয়ে তেমন ভাবতেন না। প্রায়ই স্কুলের ডায়েরিতে ‘বাড়ির কাজ না করার’ দোষের কথা লিখে দিতেন শ্রেণিশিক্ষক। মা দেখলে রেগে যেতেন, বাবা একটু কঠিন মুখ করে বলতেন, ‘আর এমন করো না’ – তারপর সই করে দিতেন ডায়েরির পাতায়। তবে আমার জন্য বাড়িতে ছিল অনেক পড়ার কাজ। সহজ পাঠ দিয়ে শুরু। তারপর রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি শিক্ষা আর বিদেশ থেকে বের হওয়া ইংরেজিতে লেখা 888sport apkের বই। প্রতিদিন আমার কাজ ছিল এসব পড়া। বাবা বসে বসে সময় নিয়ে পড়াতেন আমায়। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ঠাকুরমার  ঝুলি, গ্রিম ভাইদের রূপকথা কিংবা রুশ দেশের রূপকথা – এসব পড়া এবং তারপর প্রতিদিন একটা বা দুটো ঘটনা পছন্দ করে ইলাস্ট্রেশন করা – এ ছিল আমার নৈমিত্তিক কাজ। সন্ধ্যায় বাবা এসে বলতেন, ‘বাহ্ দারুণ এঁকেছো!’

আমি আর বাবা এক টেবিলেই কাজ করতাম, আমাদের খাবার টেবিলে। বাবা করতেন তাঁর প্রচ্ছদ, লোগো, পোস্টার কিংবা পেইন্টিংয়ের লে-আউট আর আমি আমার হাবিজাবি কাজ। কাজের মাঝে মাঝে বাবা বলতেন, ‘তোমার কতদূর হলো? – এটুকু ব্রেক নেবে?’ যেন আমার হাবিজাবি কাজ তাঁর কাজের চাইতেও বেশ জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা দুজন যেখানটিতে বসে ‘কাজ’ করতাম, সেটির অংশীদার আরো অনেকে। ডাইনিং টেবিল বলেই খাবার সময় পুরো বাড়ি এ-জায়গাটি দখল করত। সন্ধ্যাকালে আমাদের বাড়ির নানা কালের নানা শিশু ওই জায়গাটিকেই তাদের পড়া তৈরির যোগ্য স্থান ভাবত। মাঝে মাঝেই ড্রইং কিংবা জলরঙে মগ্ন বাবা কাজ ছেড়ে পাশের শিক্ষার্থীকে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। কিংবা শিক্ষার্থী যদি শিশুটি হয়, তবে তার আবদার রাখতে স্থান ছেড়ে উঠে পাশের ঘরের বিছানায়। শিশু ভোলানাথ কিংবা ঠাকুরমার ঝুলি থেকে পড়ে সেরে আবার ওই স্থানে জলে-কালিতে ডুব মারতেন। অনাদিকালেরই গল্প বোধহয় এটা। ভাবি, এখন এ-বাড়িতে এমন কোনো শিশু নেই যে, বাবার 888sport live chatকর্মের এমন সহযোগী হয়নি!

 

‘অল্প লইয়া থাকি তাই…’

আমাদের আজিমপুরের বাড়িটির বয়স অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। আমার বাবা-মা দোতলার এই ফ্ল্যাটে থেকেছেন বহুকাল। শেখসাহেব বাজার এলাকার ছাপড়া মসজিদ-সংলগ্ন দক্ষিণমুখী গলি দিয়ে এগোলে গাছগাছালি-ছাওয়া সাড়ে তিনতলা বাড়িটি চিনতে বেশি বেগ পেতে হয় না। পুরনো বাড়ি। স্থাপত্যশৈলীতে মনোগ্রাহী নয় তেমনটা। তবু বাইরের আঙ্গিকে জলযাত্রার জাহাজ-আকৃতি বেশ লাগে। বড় লোহার গেট পেরিয়ে গাড়িবারান্দা ছাড়িয়ে দোতলার সিঁড়ি মাড়িয়ে শেষে আমাদের ফ্ল্যাট। দরজা খুললেই ড্রইং কাম ডাইনিং কাম চিত্রশালা।

মাত্র ১৬ x ১৪ ফ্ল্যাটের ঘরটিতে কত কিছুর সমাহার। অভ্যর্থনার সোফা, সেন্টার টেবিল, ক্রোকারিজের কাবার্ড, বইয়ের আলমারি আর ছয়জনার ডাইনিং টেবিল – এ তো কেবল আসবাবের ফিরিস্তি। এছাড়া রয়েছে দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো অ্যাক্রিলিক, জলরং আর তেলরঙের 888sport live chatকর্ম। ঘরসংলগ্ন বারান্দার ধারেই রাখা কাঠের ইজেল আর তার পাশেই সারে সারে শোয়ানো ক্যানভাস। এগুলো কাজের অপেক্ষায়। বাবা যেহেতু গ্রাফিক ডিজাইনার, তাই প্রচ্ছদ, পোস্টার, মনোগ্রাম, লোগো – এসব করার কাগজ, কালি-তুলি, অ্যান্টিকাটার, কাটিং-ম্যাটও এই ড্রইংরুমেই রাখা। ডাইনিং টেবিল-সংলগ্ন একটি কাঠের তাকে ওসবের স্থান।

ঘরটিতে আলোর অভাব নেই কোনো। বারান্দা সংলগ্ন দরজাটি ছাড়াও ঢাউস দুটি জানালা থেকে সূর্য ঠিকরোয়। গাছগাছালি-ছাওয়া বাড়ি বলে বাবার কাজের জায়গার ডানের জানালাগুলো দিয়ে বাইরে তাকালেই সবুজের সমারোহ মন উদাস করে তোলে। 888sport app শহরে থেকেও যেন শহরের বাইরে এ-বাড়িটি। আম-কাঁঠাল-নারকেল-মেহেদি কোন গাছটি নেই বাড়িটির উঠোনে? বাবার ছবির সবুজ কি এই জানালা গলে পড়া সবুজেরই প্রভাব?

একপাশে রেকর্ড প্লেয়ার। বাবা যখন অাঁকতেন, তখন অবধারিতভাবে বাজত ওই যন্ত্রটি। আমার এবং আমাদের অন্য শিশুদের জন্য প্রায়শই তিনি লালকমল-নীলকমলের রেকর্ড কিংবা ম্যারি পপিন্সের রেকর্ড বাজিয়ে দিতেন। তারপর কাজের ফাঁকে গুনগুন গেয়েও নিতেন। সেই ছেলেবেলাতেই জানি, আমাকে ছবি অাঁকতে হবে, গান শুনতে হবে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে হবে, আর মুভি দেখতে হবে। সবগুলোই আনন্দের। আর তার সঙ্গী বাবা।

ছেলেবেলার প্রায় প্রতি হপ্তাতেই আমরা একসঙ্গে ছবি দেখতে বসতাম। সত্যজিৎ রায়ের গুপি-বাঘা যেমন দেখতাম, তেমনি দেখতাম ডিক্ ভ্যান ডাইক-অভিনীত চিটি চিটি ব্যাং ব্যাং কিংবা জুলি অ্যান্ড্রুসের ম্যারি পপিন্স। কোনো এক কার্টুন দেখার পর বাবা ওই কার্টুনে কী কী রং সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে, তার সেই রং যদি প্রাথমিক রং না হয়, তবে তা কীভাবে বানানো যাবে তা দেখাতেন। ওঁর প্যালেটে সবসময়             একটু-আধটু রং থেকেই যেত, বাবা শুধু শুধুই এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি মিশিয়ে দেখতেন নতুন কী হচ্ছে! মাঝে মাঝে আমারও কাজ ছিল নানা রঙের মিশেল ঘটিয়ে নতুন রং বানানো – আর তারপর বাবার রঙের বই দেখে তার নাম শেখা। ছোটবেলাতে কত রঙের নাম জানলাম আমি; স্কুলে একবার ড্রইং স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই রংটা তুমি পাইলা কই?’ আমি বেশ বিজ্ঞের মতো বলে দিলাম, ‘এটা ‘ইয়েলো অকার’ – বার্ন্ট সিয়েনার সঙ্গে এমনি হলুদ মেশালেই পাওয়া যায়।’ ওই বয়েসেই আমি রং-বিশেষজ্ঞ!

বাবার নৌকার খুব সুনাম শুনতাম আমি। তাই একবার ড্রইং পরীক্ষায় বাবার গলুই চোখ আর জলের আভাস দিয়ে একটা কম্পোজিশন করে এঁকে পঞ্চাশে পঞ্চাশ পেলাম। এমনিতে আমি বরাবর ড্রইংয়ে ফুল মার্কস পেতাম না। অাঁকতে জানতাম তবে বাবা বলতেন, ‘যা তুমি দেখোনি তা অাঁকবে না’। তাই গ্রামের দৃশ্য (তেমন গ্রামে আমি ছোট্টবেলায় যাইনি) অাঁকতে দিলে না-এঁকে খাতা ফেরত দিতাম। তো এবার নৌকা এঁকে এতো ভালো নম্বর পেয়ে বাবাকে দেখাতেই তিনি বেশ রেগেই গেলেন। বললেন, ‘তুমি এটা কী অাঁকলে? তুমি তোমার মতো করে অাঁকবে, আমার মতো নয়।’ ‘আমার মতো করে নৌকা আমি কীভাবে অাঁকব? তবে তো আমাকে নৌকা দেখতে হবে, নৌকায় চড়তে হবে।’ বাবা সেই আমায় বোঝালেন, নিজস্বতা তৈরি করে নিতে হয়, তবে এই বোঝানোটায় কোনো প্রত্যক্ষ চাপ ছিল না। বাবার এই গুণটি ছিল  – শেখাতেন পরোক্ষভাবে –  কোনো চাপ সৃষ্টি না করে।

মাঝে মাঝে এমন হতো, বাবা যতক্ষণ কাজ করছেন, আমিও ততক্ষণ পড়ছি-লিখছি-অাঁকছি। বাবা কখনোই আমায় বলেননি, এটা করো-সেটা করো, বরং তাঁর কাজের সঙ্গী করে আমার নিজের কাজে আগ্রহী করেছেন। আমার বড় হওয়ার পরিবেশটা 888sport live chatকলা, সিনেমা, গানে যতটা ভরপুর ছিল, ঠিক ততটা ভরাট ছিল 888sport apk-গণিতে। বাবা নানা 888sport apkের বই এনে দিতেন। মাঝে মাঝেই আবদুল্লাহ-আল-মুতির সঙ্গে গল্প করাতে নিয়ে যেতেন। রাতের অন্ধকারে তারা পরিচিতি হাতে ছাদে পাঠাতেন আকাশ দেখায় আগ্রহী করে তুলতে। একবার রাশিয়া থেকে ফেরার সময় বাবা ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার জন্য কী আনব?’ আমি বললাম, ‘টেলিস্কোপ।’ বাবা আনলেন মাইক্রোস্কোপ। আমার তো প্রচন্ড রাগ। শেষে তিনি বললেন, ‘তুমি তো রাতে তারা দেখতেই পাও, এবার এই যন্ত্র দিয়ে দেখো পানির মধ্যে কত জীব-জীবাণু আছে।’ আমার স্কুলে আমি কোনো দিন এই যন্ত্রের ব্যবহার করেছি কি না জানি না, তবে বাড়িতে আমার 888sport live chatী-বাবার কল্যাণে এ-যন্ত্রটি আমার খেলার সাথি হয়েছিল। বাবার এই পরোক্ষভাবে শেখার প্রতি আগ্রহী করার প্রক্রিয়া।

 

‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি যাই’

আমি যে-বছর প্রাইমারির গন্ডি পার করলাম, সে-বছর 888sport apps শেষবারের মতো দেখল সামরিক শাসকের প্রতাপ। ১৯৯০। বাবা তখন সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের সঙ্গে যুক্ত। নানা সময় নানা 888sport free bet সরকারের রোষে পড়ে বাজেয়াপ্ত হয়। এমন এক সময়ে আমাদের বলা হলো, বাবাকে আন্ডারগ্রাউন্ড হতে হবে। আমার মুক্তিযোদ্ধা মামার কারণে আমাদের বাড়িতে সবসময়েই রাজনীতির নেতাকর্মীরা আনাগোনা করতেন। তাঁদের কেউ কেউ বেশ কিছুদিন না এলে মায়ের কাছে শুনতাম ওরা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ হয়েছে। এবার বাবার পালা। তবে বাবাকে তো আমি একা ছাড়ব না! বাবা আর আমি তাই গেলাম আমার মায়ের মামাবাড়ি। একরাত-দুরাত থাকি, বাড়ি থেকে খবর আসে পুলিশ ঘুরে গেছে। সে-সময়ে দিনে হয় হরতাল, নয় তো কারফিউ।

সেই সুযোগে বাবা আর আমি অন্য জাগতিক কাজ ছেড়ে বসে বসে গল্পের বই পড়ছি। এমনি একদিন হঠাৎ বাবা আমার হাতে দুটো বই দিলেন, ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি আর ফর হুম দ্য বেল টল্স। বললেন, ‘হেমিংওয়ে আমার খুবই প্রিয় লেখক। পড়ো।’ আমি বইদুটোর মলাট দেখে খুব আনন্দে পড়তে শুরু করলাম। বাবা বলেছিলেন, ‘পাঁচ পৃষ্ঠা পড়বে আর তারপর নিজের মতো ইলাস্ট্রেশন করবে।’ এখন বুঝি, ওই বইদুটো খুব ভালো করে পড়াবার জন্যই বাবার এই পরোক্ষ প্রয়াস ছিল। কারফিউ উঠলে আমাদের স্কুলের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় আমি ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় লিখলাম, আমি বড় হয়ে ইতিহাসবিদ হতে চাই। ইংরেজি শিক্ষক ভালো মার্কস দিয়ে বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে ইতিহাসবিদ কেন?’ আমি বললাম, ‘ফর হুম দ্য বেল টল্স পড়ে আমার স্পেনে গৃহযুদ্ধ সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা করছে, তাই ইতিহাসবিদ হব।’ বাড়িতে এসে বাবাকে বলতে বললেন, ‘তোমাকে আগে ১৯৭১-কে জানতে হবে।’ আমার মা-খালা-মামা এবং বাবার কল্যাণে ১৯৭১-এর নানা ঘটনা আমরা ছোটরা প্রায় প্রতিদিনই শুনতাম। আমার এক খালাতো ভাইকে রাজাকাররা নভেম্বরেই ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। আর আমার মামা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এমন পরিস্থিতিতে আমার মায়ের পরিবারকে নিয়ে বাবা কীভাবে এ-বাড়ি সে-বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, যুদ্ধের সময়েই কীভাবে আমার ভাইয়ের খোঁজ করেছেন, যুদ্ধ শেষে কীভাবে হাজার লাশের মাঝে খুঁজেছেন প্রিয়জনের মরদেহ  – এসব আমি কতবার যে শুনেছি। আর ভেবেছি, এসব নিয়ে বাংলায় কেন বই লেখা হয় না! মুক্তিযুদ্ধ যে কৃষক-শ্রমিকের আত্মদানের ফসল, বাংলার আপামর জনতার জীবনের বদলে যে এই 888sport apps, সেটি বাবা বারবার বলতেন। তাই বাবার মুক্তিযোদ্ধা মাথায় গামছাবাঁধা কৃষক তারই পাশে দাঁড়ান গ্রামবাংলার নকশিকাঁথা বোনা 888sport promo code  – অতি সাধারণ এই মানুষেরাই তো ‘সময়ের প্রয়োজনে’ অসাধারণ হয়ে উঠেছিল।

888sport appsের প্রতি আমার বাবার পক্ষপাতিত্ব ছিল অপরিসীম। তিনি খুব বিশ্বাস করতেন, 888sport appsের আপামর জনতার ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি প্রবল। যুদ্ধটা তো তারাই করেছে। বাবার ১৯৭২-এ করা ‘প্রতিবাদ’ ছবিটার কথাই বলি। ৭ মার্চে দলে দলে আসা বৈঠা হাতে প্রতিবাদী মানুষগুলোকে বাবা ওই ছবিতে অাঁকলেন। যে-নৌকার গলুইয়ের চোখ বাবার আঁকার চোখকে লোকমুখী করেছিল, বাংলার নান্দনিকতার প্রথম অর্থবহ পাঠ দিয়েছিল, সেই নৌকার মাঝির বৈঠাকেই এবার তিনি প্রতিবাদের ভাষা করলেন। সেই চোখ, নদীর ঢেউয়ের মোটিফ এতেও বিদ্যমান  –  তবে এবার তা সৌন্দর্য নয়, বরং সাহসিকতাকেই প্রকাশ করছে। বাবা যে কেবল ছবি এঁকেই তাঁর প্রতিবাদকে প্রকাশিত করেছিলেন তা নয়। সামরিক শাসনে ক্লিষ্ট স্বদেশ যখন তাঁকে ‘888sport cricket BPL rateে পদকে’ ভূষিত করল, বাবা তখন সেটি দেশের সামরিক পোশাকপরা রাষ্ট্রপতির হাত থেকে গ্রহণ করেননি। তাঁর পক্ষে কেউ গিয়ে তা নিয়েও আসেনি।  পরবর্তীকালে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাবাকে এই পদকটি প্রদান করে। বাবার এই সিদ্ধান্তের পেছনে আমার মায়ের প্রচ্ছন্ন অবদান ছিল। আর 888sport cricket BPL rateে পদকের ইতিহাসে এই অনন্য ঘটনা কতবার ঘটেছে তা বিচারের প্রয়োজন রয়েছে। আমার মনে পড়ে, বাড়িতে বসে আমরা পদক প্রদান অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় দেখছিলাম। একমাত্র বাবার পদকের সময় কেউ উঠল না! 888sport apps হয়তো ভুলে গেছে সে-ঘটনা – বা খেয়ালই করেনি। তবে, যাঁর কথা ছিল পদক প্রদানের, সেই রাষ্ট্রনায়ক এই বছর বাবার স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে ঠিকই ব্যাপারটি 888sport app download for android করে বাবাকে বলেছিলেন।

১৯৯০ সালের যেদিন ‘গণতন্ত্র মুক্তি’ পেল – সেদিনটিতে বাবার চোখে-মুখে যে-আনন্দ আমি দেখেছি তা এখনো ভুলিনি। আগেই বলেছি, নানা রাজনীতিবিদের আনাগোনা ছিল আমাদের বাড়িতে। তাই পতনের শব্দ আমরা বেশ কিছুদিন থেকেই পাচ্ছিলাম। তখন আমি রাজনীতির তেমন কী-ই বা বুঝি। তাই সেদিন, যেদিন আল্লাওয়ালা ভবনে আগুন লাগাল জনতা, বাবা আমায় বললেন, ‘বাদ দাও পরীক্ষার পড়া, চলো আমার সাথে।’ বাবা আর আমি গেলাম পুরানা পল্টনে গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদের অফিসে। সেখানে তখন অনেকে। বাবা সেখান থেকে আরো দু-একজনকে সাথি করে আমায় নিয়ে গেলেন ‘আল্লাওয়ালা’র ওপর জনতার রোষ দেখাতে। ওই একটি রাজনৈতিক ঘটনা আমার জীবনে রাজনৈতিক দর্শনের এক অমোঘ শিক্ষা যেন দিলো – জানলাম, জনতার শক্তিই রাজনীতির শেষ কথা।

 

‘চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি, তুমি হে…’

বাবার কাজ ছিল আমাকে নতুন নতুন বই, সিনেমা আর গানের সামনে হাজির করা। স্কুলে একটু বড় ক্লাসে উঠতেই বাবা বললেন, ‘বঙ্কিম, তারাশঙ্কর, মানিক, শেক্সপিয়র, মার্ক টোয়েন, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি পড়তে হবে তোমাকে।’ ততদিনে বড় লেখকদের বই কেবল পড়া শুরু করেছি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল একটু-আধটু তো পড়া এমনিতেই হয়, তবে বাবার চাপ না থাকলে ওই লেখকদের জানাই হয়তো হতো না আমার। সেই ছেলেবেলায় এই পড়াগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার কালেও আবার ঝালাই করে নিতে বলেছিলেন বাবা। এই লেখক, একই গল্প কিংবা 888sport alternative link কিন্তু বোধের কী বিশাল পার্থক্য। বাড়িতে বড় বড় লেখক-কবি-888sport apkীর অনেকেরই আনাগোনা ছিল বলে, আর আমিও বিজ্ঞের মতো ছোট্টটি কাল থেকেই বড়দের মাঝে বসে থাকতাম বলে, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমানের নানা লেখা – সে 888sport app download apk কিংবা গল্প কিংবা নাটক যা-ই হোক – পড়ে ফেলা হতো আমার। আর অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, বাবা যে এগুলোর অনেক কটিরই প্রচ্ছদ এঁকেছেন, সেটি দেখলেই তো দর্শন প্রায় ধরেই ফেলা যায়। মনে পড়ছে, শামসুর রাহমানের আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি – টাইপোগ্রাফির কী অনন্য ব্যবহার সেখানে। টাইপ ফেসকে ক্রমাগত ছোট থেকে বড় করে এনে যেন পদধ্বনির চেহারা কেমন হবে তা দেখিয়ে দিলেন বাবা। বাবার করা 888sport liveের বই, 888sport app download apkর বই, গল্পের বই, 888sport apkের বইয়ের প্রচ্ছদ যেন বিষয়ের সারবস্ত্তটুকু খুব সহজে ধরে নিতে পারত। পেইন্টিংয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে বাবা যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা ইতিহাসে অনন্য। বাবা যখন পেইন্টিং করতেন তখন তিনি পেইন্টার, যখন প্রচ্ছদ-পোস্টার করতেন তখন তিনি গ্রাফিক ডিজাইনার – এই দুই সত্তায় কোনো বিবাদ কখনো দেখিনি।

বাবার 888sport live chat তৈরির প্রক্রিয়াটি ছিল কয়েক ধাপে বাঁধা। তিনি মূল কাগজে কিংবা ক্যানভাসে কিছু করার আগে ‘লে-আউট’ কিংবা ড্রইং একটা কিছু করতেনই। কোনো কোনো প্রচ্ছদের দশ-বারোটা লে-আউট আমার দেখা। তারপর সেখান থেকে বেছে নিয়ে কাগজে তুলতেন তিনি – বড় আর্ট পেপারে এঁটে দিতেন বাইকালার-মাল্টি কালার কাজ ও তার কালার স্কিম। অাঁকার আগে অনেক পড়ার ও ভাবার অবসর লাগত বাবার। আর ছোট-বড় যেমন লেখকেরই হোক – যে-বইটির প্রচ্ছদ তিনি করতেন সেটিকে নান্দনিকভাবেই উপস্থাপন করতে চাইতেন। তিনিই তো তাঁর প্রতিপক্ষ।

বাবা আমাকে শেখাতেন কীভাবে স্প্যাচুলা দিয়ে রয়ে যাওয়া রং ক্যানভাসে লেপ্টে দিতে হয়। কিংবা কীভাবে অ্যান্টিকাটার দিয়ে প্রচ্ছদের ওপর ঘষে নানান ইফেক্ট তৈরি করা যায়। তবে আমি মুগ্ধ হতাম তাঁর নোট করার প্রবণতা দেখে। হয়তো বাইরে কোথাও বেরিয়েছি, বাবাকে করতে হবে কোনো পোস্টার, বাবা সেখানে কিছু একটা দেখে একটা আইডিয়া পেয়ে মগ্ন হয়ে বসে গেলেন নোট নিতে। এ কেবল ড্রইং বা স্কেচ নয়, এটি একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের ডিজাইন তৈরির উপাদান সংগ্রহের প্রক্রিয়া। কোনো কোনো কাজ নিয়ে বাবা যে কত দিন-রাত একাকার করে ফেলতেন, তা বলে শেষ করা যাবে না।

আমরা মাঝে মাঝেই বসতাম পুরনো ছবি দেখতে। দিলীপ কুমার-সায়েরা বানু কিংবা গ্রেগরি পেক-অড্রে হেপবার্ন – শুধু এঁদের সিনেমা দেখা নয়, মুভির টাইটেল সিকোয়েন্স দেখাটা ছিল বাবার প্রধানতম কাজ। সল বাসের করা অ্যানাটমি অব অ্যা মার্ডারের টাইটেল সিকোয়েন্স, তারপরে তাঁর পোস্টার নিয়ে বাবার উচ্ছ্বাসের অন্ত ছিল না। হিচ্ককের ছবি দেখা, তার সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে নানা কথা বলা – বাবার ছিল নেশার মতো। বাবা যখন বলতেন আমি ভাবতাম, আববু এত উচ্ছ্বসিত হন এগুলো দেখে? প্রায়ই আমায় বলতেন, ‘ভালো একটা সিনেমা তৈরি করতে চেয়েছিলাম জীবনে। এমন অসাধারণ টাইটেল সিকোয়েন্সসহ।’ 888sport appsের 888sport live chatী বলে এ-স্বপ্ন যেন তাঁর কখনোই পুরোবে না – তা যেমন তিনিও জানতেন, তেমনি জানতাম আমিও।

টাইপোগ্রাফির 888sport apk আর ক্যালিগ্রাফির 888sport live chat – কাইয়ুম চৌধুরীর মতো কজন বুঝেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। বাবার যে এ দুটো বিষয় নিয়ে রীতিমতো অবসেশন ছিল, সে আমি বলতে পারি। কতদিন তাঁকে দেখেছি নানা গ্রাফিক ডিজাইনের বই ওলটাতে, টাইপোগ্রাফির ওপর পড়তে আর ল্যাটাসেট নিয়ে উবু হয়ে বসে নিমগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। অনেক সময়েই অনেক প্রচ্ছদ দেখে বাবা বলতেন, ‘এভাবে টাইপটা না দিলে হতো না?’ টাইপ বোল্ড হবে, না নরমাল হবে এবং কোন কারণে সেটা হবে – এ সাধারণ বিষয়টিও       যে-দেশের লোকেরা নান্দনিকভাবে বুঝতে পারে না, সে-দেশের 888sport live chatীর টাইপ ফেস নিয়ে চিন্তা না করলেই চলে। তবে বাবা তো আসলে সম্পূর্ণ 888sport live chatী, তাই তিনি পারতেন না অক্ষরের ওপর অনাচার সহ্য করতে।

বই কিংবা পোস্টারে যেমন টাইপোগ্রাফি আর ক্যালিগ্রাফি, তেমনি পেইন্টিং আর জলরঙে ‘রং’-এর ব্যবহার ছিল বাবার 888sport live chatসাধনার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি এগুলোকেই তাঁর 888sport live chatের সামগ্রী করেছিলেন। কোথায় রং ভরাতে হবে, কোথায় স্পেস ছাড়তে হবে – এ ছিল বাবার 888sport live chatরচনায় ব্যাকরণিক প্রশ্ন। বাবা ভাবতেন, প্রচ্ছদ-পোস্টার যেমন টাইপের ওপর ভর করবে, তেমনি পেইন্টিং কিংবা প্রিন্ট দাঁড়াবে ‘রং থাকা’ কিংবা ‘না থাকা’র ওপর। আর বিন্যাস-বিস্তারে বাবার চিন্তায় ছিল মাধ্যমের পূর্ণ ব্যবহারের প্রয়াস। যে-মাধ্যম যা দাবি করে, ঠিক তা-ই দিতে চাইতেন তিনি। তাই স্কেচ যেমন করতেন, ড্রইং তেমন হতো না, 888sport app download apkর ইলাস্ট্রেশন যেমন করতেন, গদ্যে তেমন করতেন না – আর পেইন্টিংয়ে তো তিনি একদম ভিন্ন মানুষ। যদিও লোকজ রং-গড়ন-নকশা তাঁর মূল 888sport live chatদর্শন ছিল – তবু মাধ্যমের প্রয়োজনে তিনি তাঁর স্টাইলকে সাজানোর কাজটি করেছেন খুব প্রচ্ছন্নভাবে। মাতিসের 888sport app download apkর ইলাস্ট্রেশন, পিকাসোর প্রচ্ছদ, জয়নুলের প্রচ্ছদ, টুলুস লুত্রেকের লিথো যেমন বাবাকে আলোড়িত করেছে, তেমনি সল বাসের কিংবা মিল্টন স্লেসারের পোস্টার আর পল ব্যান্ডের লোগো ডিজাইন বাবাকে উদ্বেলিত করেছে। কতশত বই-ম্যাগাজিন-কাগজ তিনি জোগাড় করতেন। বাবা প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘যেখানেই যাও ভালো দৈনিক খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন নিয়ে আসবে।’ বাবা বসে বসে সেগুলো দেখতেন, রীতিমতো স্টাডি করতেন। প্রথম আলোর যে পেজ-মেকআপ, মাধ্যমের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সচিত্র সন্ধানীর যে অনন্য নান্দনিক রূপ – এ তো বাবার এমন অধ্যবসায়েরই ফল। বাবা তাঁর কাজ নিয়ে কোনো আপসে রাজি ছিলেন না। এ কারণেই অনেক সময়ে বাবা ছেড়ে এসেছেন অনেক নকশা ঘর কিংবা পত্রিকা। তাঁর কাছে 888sport live chatই ছিল মুখ্য। তবে তাঁর 888sport live chatের শেকড় ছিল বাংলার মাটিতে গ্রথিত আর ডালপালা ছড়িয়ে ছিল বিশ্ব888sport live chatের আধুনিকতম রূপকে প্রতিমুহূর্তে গ্রহণ করার প্রয়াসে।

বাবার কাজের বিস্তার নানা মাধ্যমে ছিল বলে এবং এসব কাজের প্রায় প্রত্যেকটির জন্যই প্রচুর পড়ার, শোনার এবং উপলব্ধি করার প্রয়োজন হতো বলে সমগ্র দিন, সপ্তাহ-মাস বাবা ব্যস্ত থাকতেন। আর কাজ করতে পেরে তাঁর যে কী আনন্দ হতো, তা তাঁর কর্মপূর্ব অস্থিরতা আর সম্পাদন-পরবর্তী স্বস্তি দেখে বেশ বুঝতাম। একটি লোগো করার জন্য তিনি কত যে লে-আউট করতেন, কতবার যে আমাদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কেমন হয়েছে? কি, বুঝতে পারছ কিছু?’ আর এ করতে করতে সময় যেত গড়িয়ে। বাবা তাই দেরিতেই কাজ দিতে পারতেন। তবে এত কাজ, চিন্তা – এসবের মাঝেও পরিবারকে সময় দেওয়াতে বাবার কখনোই বেগ পেতে হয়নি। আর আমার জীবনে তো এমন কোনো 888sport sign up bonus নেই যেখানে বাবাকে শুনেছি ‘না’ বলতে। যতবার বাইরে গেছি, যাবার কিংবা আসার সময় বিমানবনদরে তিনি যাবেনই। যাবার বেলা কপালে শেষ চুমুটি কিংবা আসারকালে প্রথম আদরটি তিনি করবেন – এ-ব্যাপারটিতে বাবা ছিলেন একদম শিশুসুলভ। কতবার বলেছি, ‘আববু এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার জন্য তুমি বসে না থেকে একটু বিশ্রাম করলেই তো পারো!’ তিনি এর কোনো উত্তর দেননি।

বাবা আমাকে বলতেন, ‘তুমি আমার চোখ।’ তাই যেখানেই যাই, নতুন গ্যালারি, মিউজিয়াম এবং ইন্টারেস্টিং কিছু দেখা, বোঝা এবং সংগ্রহ করার কাজটি আমাকে করতেই হবে। বাবা প্রতিনিয়তই জানতে চাইতেন, নতুন 888sport live chatীরা কে-কোথায়-কী করছেন, কোথায় কেমন প্রদর্শনী হচ্ছে, নতুন প্রকাশনাগুলো কেমন হচ্ছে। প্রতিদিনকার পিতা-পুত্রের ভিডিও কিংবা অডিও আলাপচারিতার একটি বিরাট অংশ থাকত এসব নিয়ে। মাঝে মাঝেই ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে বের করতেন নতুন প্রদর্শনী, নাটক কিংবা live chat 888sportের খবর – বলতেন, ‘দেখে এসো, রাতে জানিও কেমন হলো।’ আমার গবেষণার কাজের শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবার এই আর্জিগুলো রাখতেই যেন জীবন ধন্য মনে হতো।

বাবা যখন বাইরে বেরুতেন, তখন তিনি নিজেই আঙুল তুলে দেখাতেন; বলতেন কী দেখতে হবে, কীভাবে দেখতে হবে। খুলনামুখী স্টিমারের ডকে বসে বলতেন, ‘ওই দেখো নদীর পানির রং কীভাবে বদলাচ্ছে। একটু পরে দেখবে আরো ঘোলা হবে, ওয়াটার কালারে এই মজাটা ধরা যায়।’ আবার বড় মিউজিয়ামে টিশিয়ানের পেইন্টিং দেখিয়ে বলতেন, মুভমেন্টগুলো দেখো, চোখ দুটো দেখো, কী ‘পেনেট্রেটিং!’ ফ্রান্সের জিভার্নিতে মর্নের বাড়িতে বাবা বললেন, ‘মনে হচ্ছে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর মর্নে ‘ওয়াটার লিলি’ অাঁকছে।’ ওভার সুর অস এ থিও আর ভ্যানগঘের কবরে ফুল দিতে গিয়ে বাবার চোখে জল দেখে মা আর আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম। লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়ে ফ্রাঙ্ক গেরির ডিজনি কনসার্ট হলের  ভেতরে-বাইরে দাঁড়িয়ে বাবাকে যেমন তন্ময়ভাবে দেখতে দেখেছি, তেমনি পিটসবার্গের কিংবা ওয়াশিংটন ডিসির ছোট-বড় ভাস্কর্যকে অপার আনন্দে পর্যবেক্ষণ করতে দেখেছি। প্রায়শই তিনি বলতেন, ‘888sport apps এমন যদি হতো?’ বাবার খুব ইচ্ছাও ছিল কিছু ত্রিমাত্রিক কাজ করার। নিতুন কাকার (নিতুন কুন্ডু) সঙ্গে কিছু পরামর্শও তিনি করেছিলেন। নিতুন কাকার মৃত্যুর পর বাবা দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘এ আর হবে না!’

শিক্ষক এবং বন্ধুদের প্রতি বাবার 888sport apk download apk latest version-ভালোবাসা-প্রেম তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অটুট ছিল। নানা ঘটনায় তাঁকে অনেকেই আহত করেছেন, বাবা তবু 888sport apk download apk latest versionই করে গেছেন। কীভাবে অবলীলাক্রমে মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন, শয্যাশায়ী শিক্ষক সফিউদ্দীন আহমেদকে কপালে চুমো দিতে পারেন, কি মোহাম্মদ কিবরিয়ার শয্যাপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, আর যখন-তখন নানা 888sport sign up bonusর রোমন্থনে জয়নুল আবেদিনকে 888sport app download for android করতে পারেন – এ আমি দেখেছি। তাঁর অনুজ এবং ছাত্রদের নিয়েও বাবার যে-উচ্ছ্বাস আমি দেখেছি, তা তো অতুলনীয়। সমুদ্রের নীল দেখে যেমন জয়নুলের নীল তিনি খুঁজে পেতেন, তেমনি দেয়ালের টেক্সচার দেখে বলে উঠতেন – দেখো দেখো ইউনুসের কাজ। শিশির ভট্টাচার্যের প্রদর্শনীর দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে তাই আমাকে তাগাদা – ‘দেশে আসো তাড়াতাড়ি, শিশিরের কাজগুলো দেখতে পাবা – কী ড্রইং!’ আবার রফিকুন নবীর প্রদর্শনীর পর বললেন, ‘তুমি নবীর ওপর লেখো – খুব ডিটেইলে।’ এমনতরো নানা 888sport sign up bonusই তো রয়েছে আমার।

 

‘যাও রে অনন্ত ধামে মোহ মায়া পাশরি -’

বাবা তাঁর পরিবারের গন্ডিটা অনেক বড় করে তুলে ছিলেন। তাই নিজ সন্তানের মতোই যেন সবাইকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন। নীতির প্রশ্নে আপস করবেন না তিনি – সে পরিবারের ভালোর জন্যই। আর পরিবারের কাউকে নিরাশও করবেন না তিনি –  সে ভালো একটা কাজ উপহার দেওয়ার আশাতেই। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত কাউকে তিনি বুঝতেও দেননি, বয়স হয়েছে তাঁর। তাই বাবার ওই আকস্মিক থেমে যাওয়া আমাকে যেমন স্তম্ভিত করেছে, পুরো দেশকে তেমনি করেছে হতবাক। বারবার ভেবেছি, আববু একবারটিও যদি তুমি বলতে যে, তুমি এভাবে চলে যাবে, আমি তোমাকে আজ আগলে রাখতাম। তারপর যেন শুনতে পেয়েছি, বাবা বলছেন, ‘এভাবে চলে যাওয়াই ভালো, আমি রঙের মানুষ, চারপাশে রং ছড়িয়েই তাই চলে গেলাম।’ সত্যিই তাই, বাবা নিভৃতে নয়, তাঁর পরিবারের – তার 888sport appsের সবার মাঝ থেকে, শেষ মুহূর্তের কাজটি পূর্ণ সম্পাদন করে চিরকালের মতোই চলে গেলেন। যেন মৃত্যুদূতও থমকে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ, বাবাকে তাঁর বক্তৃতাটি শেষ করতে দিয়েই তাঁকে নিয়ে গেলেন সঙ্গে করে।

চলে যাবার আগের দিন, বাবা তাঁর পৌত্রী রোহিনাকে জড়িয়ে ধরে গাইছিলেন – ‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে…’। চিরশয্যায় বাবাকে শায়িত রেখে ফেরার সময় চারপাশটি তেমনই ‘ফুলে ফুলে’ সেজে থাকতে দেখেছি। আর তার পৌত্রী এখনো নিরন্তর গেয়ে চলছে। ‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে…’ আর একটু থেমে বলছে, ‘দাদা, দাদা… দা… দা…, আসো।’