আমি অর্জুন… আমি মরবো না

ভীষ্মদেব চৌধুরী
অর্জুনের প্রথম মৃত্যু তারই পুত্রের হাতে; বভ্রুবাহন সেই পিতৃ-হন্তারক, যে বিমাতা উলুপীর পরামর্শে যুদ্ধে আহ্বান করেছিল পিতাকে। মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার গর্ভজাত ওই পুত্রের হাতে নিহত হলেও অর্জুন তার অপর স্ত্রী নাগকন্যা উলুপীরই দেওয়া সঞ্জীবন মণির শুশ্রƒষায় লাভ করেছিলেন পুনর্জীবন। মিথিক ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস এই যে, লক্ষ্যভেদী সব্যসাচী ও যুগনায়ক যিনি, আত্মজ কিংবা আপনজনই তার হত্যাকারীর ভূমিকায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু অব্যর্থ লক্ষ্যভেদও কখনো-কখনো ব্যর্থ হয়ে যায়। কেননা, অর্জুন ‘জিষ্ণু’ পরিচয়ে বেঁচে থাকেন, বেঁচে থাকবেন। স্বর্গারোহণ হয় না বটে তাঁর, তবু মিথ-পুরাণের অর্জুন মৃত্যুহীন ও লক্ষ্যভেদী বিজয়ী রূপেই মানুষের মনোলোকে অক্ষয় চিহ্ন এঁকে রেখে যান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্জুনও উপর্যুপরি আক্রান্ত হয় তারই বন্ধুর ইন্ধনে, যে-বন্ধুরা ছিল আপৎকালের সহযাত্রী, অনিশ্চিত দেশান্তর-অভিযাত্রার এক-একজন অডিসিয়ুস! সুনীলের আত্মজীবনেরই অনেকটা প্রতিরূপ-চরিত্র অর্জুন, অর্জুন-বৃক্ষের মতোই যে অভ্রভেদী হয়ে ওঠে এবং মিথ-পুরাণের সারাৎসার নিজের চৈতন্যে ধারণ করে বলে : ‘…বেঁচে থাকাটা এত আনন্দের! তবু মানুষ কেন মরতে চায়, কেন অন্যকে মারতে চায়! …আমার বুকে আর ব্যথা নেই – আমার মাথা পরিষ্কার – আমি ঠিক বেঁচে থাকবো! বেঁচে থাকবো! বাঁচতে আমার ভালো লাগে। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, আমি মরবো না।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্জুন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধকালে। 888sport alternative linkটি লিখেছিলেন তিনি ১৯৭০-এর জুলাই মাসে। একাত্তরের অক্টোবরে যখন এর প্রথম সংস্করণ বের হয়, পূর্ববাংলায় তখন ঘনীভূত হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ। নতুন করে দেশান্তরী কোটি বাঙালির ভিড়ে পূর্ণ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো। শরণার্থীদের নির্বাধ ঢেউ সবচেয়ে বেশি আছড়ে পড়েছিল মহানগর কলকাতাসহ সমগ্র পশ্চিম বাংলার শহরে-প্রান্তরে। সময়ের এক আশ্চর্য সংযোগ ঘটেছিল সুনীলের ওই 888sport alternative linkে। নিজের এবং স্বজনদের উদ্বাস্তু-জীবনের কথকতায় মুখর হয়ে উঠেছিল ওই 888sport alternative link – অর্জুন। দেশভাগের নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়ায় সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে সম্ভ্রমহারা অগণ্য মানুষ প্রাণের দায়ে বাধ্য হয়েছিল দেশ ছাড়তে। নতুন দেশ ভারত প্রজাতন্ত্রের সীমানারেখা অতিক্রম করে আসা মানুষগুলোর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল বটে, কিন্তু ‘রিফিউজি’ পরিচয়ের এক অমোচনীয় কলঙ্কতিলক বর্তেছিল তাদের কপালে। ঠাঁই হয়েছিল রাস্তার দুধারে, ঘিঞ্জি বস্তিতে,  আন্দামানে কিংবা দণ্ডকারণ্য…। ১৯৭১ সালে ওই ইতিহাসেরই এক ভিন্নমাত্রিক পুনরাবৃত্তি ঘটল বাঙালি জীবনে। বন্দুকের নলের মুখে সর্বস্বহারা মানুষ দেশান্তরী হলো আবার। উদ্বাস্তু-শরণার্থীর পরিচয়-তিলক পুনরায় ধারণ করতে হলো দেশের এক-সপ্তমাংশ মানুষকে। বাঙালির এক আপৎকালে আরেক আপৎকালের কথকতা শোনাতে এসে সময়ের এক অত্যাশ্চর্য আবর্তনকে বাক্সময় করে তুলেছেন সুনীল। ‘বাংলা দেশের মুক্তিসৈনিকদের উদ্দেশ্যে’ উৎসর্গ করে ফেলেন তিনি অর্জুন। 888sport appsের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা যখন অভ্রভেদী ও লক্ষ্যভেদী ‘অর্জুন’ হয়ে উঠেছে, তখন সুনীলের প্রতিরূপক 888sport alternative link অর্জুনের আত্মপ্রকাশ একধরনের সমার্থকতাকেই প্রতিষ্ঠা করে; এক সুনিশ্চিত প্রত্যয়ের ব্যঞ্জনা ছড়ায়। মিথিক্যাল অর্জুনের দৃষ্টিনন্দন কৃতিত্ব ও অনন্য স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্রৌপদী-জয়ের স্বয়ংবর সভায়। চক্রের ভেতরে স্থাপিত ‘মীনচক্ষু’ শরবিদ্ধ করে অর্জুন লাভ করেছিলেন দ্রৌপদীকে। তার আগে লক্ষ্যভেদ পরীক্ষায় কর্ণকে পরাজিত করে একাগ্র লক্ষ্যভেদীর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন তিনি। সুনীলের অর্জুনও একাগ্র লক্ষ্যভেদী। কলকাতায় স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিল দীপঙ্কর। ধনীর ছেলে দীপঙ্কর, কেয়াতলা রোডে বিরাট বাড়ি; বাড়ির চাকর-বাকরদের অবস্থাও ছিল অর্জুনের তুলনায় সচ্ছল। তার প্রতি ঈর্ষাভাব জেগেছিল অর্জুনের। মেধাবী দীপঙ্কর এগারো নম্বর বেশি পেয়ে ফার্স্ট হয়েছিল। দুজন অধ্যাপক পড়াতেন ওকে। ওই এগারো নম্বর কি পেতে পারত না অর্জুন? পারত নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই সুযোগ ছিল না তার। উন্মাদ বড় ভাই, মায়ের অজানিত আশঙ্কা আর বস্তির অনিশ্চিত জীবন রুদ্ধ করে রেখেছিল সব পথ। তবু হাল ছাড়েনি অর্জুন। শানিত প্রত্যয়ে স্থির থেকেছে সে। নিজের জবানিতে 888sport sign up bonus হাতড়ে বলেছে সে ওই প্রতিজ্ঞার কথা : ‘…দীপঙ্কর, দেখিস, আমি তোকে ঠিক বিট দিয়ে দেবো! বি-এসসি পরীক্ষায় আমি তোকে যদি ডাউন না দিই তো আমার নাম বদলে ফেলবো। এই সব আমার অস্ত্র, এই নিয়ে আমাকে ধনুর্ধর হতে হবে। আমি হারবো না, জিততেই হবে আমাকে।…’ ওই লক্ষ্যভেদী ধনুর্ধর হওয়ার প্রত্যয়ই মাদারীপুরের অর্জুন রায়চৌধুরীকে মিথিক্যাল অর্জুনের প্রতিরূপক করে তুলেছে।  কলকাতার এলিট পরিবারের মেয়ে শুক্লা, যে নিজের ঘরে টানিয়ে রাখে ‘অ্যারো বোর্ড’ বা ‘ডার্ট বোর্ড’। আর ওই বোর্ডের মাঝখানে থাকা অনেক রঙিন বৃত্তের ঠিক মাঝখানের বিন্দুতে তীর বিদ্ধ করার প্রতিযোগিতায় শুক্লা মাতিয়ে রাখে বন্ধুদের। বন্ধুদের কারো নিক্ষেপই অব্যর্থ হয় না। ‘রেকর্ড প্লেয়ারে ইংরেজি বাজনা শুনতে শুনতে শুক্লা তীর ছুঁড়ে মারে। অর্থাৎ জেভলিন দিয়ে বুল্স আই বিদ্ধ করা। শুক্লা এই ধরনের কায়দার খেলা খেলতে ভালোবাসে।’ অর্জুনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক অবনীশদার ছোটবোন শুক্লা একদিন নতুন বন্ধু করে নেওয়া অর্জুনকে বলেছিল, ‘অর্জুন, তুমি তীর ছোঁড়ো তো, দেখি পারো কিনা! বাঙালরা তো অনেক কিছুই পারে শুনেছি।’ কথাটা মনে ধরেছিল অর্জুনের। কিন্তু রাজি হয়নি সে। যে-খেলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সে-খেলায় পূর্ণ পূর্বপ্রস্তুতি না-নিয়ে অবতীর্ণ হয় না অর্জুন। মনে মনে ঠিক করে নেয় যেদিন শুক্লার সঙ্গে একা দেখা হবে সেদিন চেষ্টা করে দেখবে লক্ষ্যভেদ করতে পারে কিনা। ওই সুযোগ আসে একদিন। তবে তার আগেই ঘটে যায় নিমজ্জমনা 888sport promo code উদ্ধারের কাহিনি। অবনীশদার উৎসাহে পারিবারিক বনভোজনের সহযাত্রী হয়েছিল অর্জুন। নৈহাটির বাগানবাড়িতে হই-হুল্লোড়ের মধ্যে তিন-চারজন মেয়ের সঙ্গে পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল শুক্লা। সাঁতার জানা ছিল না এদের কারো। শুক্লা চলে এসেছিল গভীর জলে। তারস্বরে চিৎকার কানে এসেছিল অর্জুনের। একটা পালিয়ে যাওয়া ‘লেগ হর্ন মুরগি’ অনেকের সঙ্গে তাড়া করতে-করতে পুকুরের কাছে চলে এসেছিল অর্জুন। তখন আর দেরি করেনি সে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জলে। জলের দেশ মাদারিপুরের ছেলে অর্জুন; জল যার শৈশবের সঙ্গী, সাঁতার নিত্যদিনের অভ্যাস। তবে কারো কাছে ঋণী থাকতে চায় না বলে, এই জীবন ফিরে পাওয়াটা শুক্লার খুব একটা পছন্দ হয়নি। স্মার্টলি বলেছে সে, ‘তুমি কেন আমাকে তুললে? আমি বেশ দেখতাম, জলে ডুবে যেতে কি রকম লাগে!’  অর্জুন হাসতে-হাসতে জবাব দিয়েছিল, ‘দেখতে পেতে না তাও! মরে গেলে আর কিছু দেখা যায় না।’ বুঝিয়ে বলেছিল অর্জুন আকস্মিক উদ্ধারের ব্যাপারটি মানুষের ইন্সটিংকট্! জলের মধ্যে শুক্লাকে যে সে খুব মেরেছিল সেটাও ছিল ইন্সটিংকট্! তার বদলে কোনো জেলে বা কাঠুরে যদি থাকত আশেপাশে, সেও ঝাঁপিয়ে পড়ত শুক্লাকে বাঁচাতে। ওই অযাচিত ঋণ এক গভীর মমতা ও দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত করেছিল শুক্লাকে। উদ্বাস্তুজীবনের পাষাণপুরী কলকাতায় ওই সূত্রেই শুক্লা অর্জুনের কাছে মুক্তির জানালা হয়ে দেখা দিয়েছিল। ফলে, পরে যেদিন শুক্লাকে একা পাওয়ার সুযোগ ঘটল, সেদিন শুক্লার অগোচরেই দেয়ালে টাঙানো ‘অ্যারো বোর্ডে’র সামনে দাঁড়িয়ে তিনটি তীর হাতে তুলে নিয়েছিল অর্জুন। প্রথমবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বোর্ডের ভেতরকার চতুর্থ বৃত্তে বিদ্ধ হলো তীরটি। পালক-লাগানো জেভলিন হাতে ভারসাম্য রক্ষা করা যে কঠিন বুঝতে অসুবিধা হলো না তার। একসময় অর্জুনের জুতসই হাত ছিল। এক ঢিলে গাছের মগডালের আম পেড়ে ফেলতে পারত। গুলতি দিয়ে একটি বককে হত্যা করার জন্য দাদা দুঃখ পেয়েছিল বলে গুলতি হাতে তোলেনি আর। আজ কি লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না সে? একটু পিছিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে মনের আর সব দিকের আলো নিভিয়ে দিয়ে বোর্ডের মধ্যবিন্দুটার দিকে মনঃসংযোগ করে অর্জুন। ‘এবার তাকে বুল্স আই বিদ্ধ করতে হবে।’ নিষ্কম্প্র শরীরে তীরটা ছুড়ে মারে অর্জুন। এক চুল এদিক-ওদিক নয়, বোর্ডের ঠিক মধ্যবিন্দুতে গেঁথে গেছে তীরটা। এতটা আশা করেনি; একটুকু গর্ব অনুভব করেই লজ্জিত হয় সে। শুক্লা টেলিফোন রিসিভ করে ঘরে ফিরে মধ্যবিন্দুতে বিদ্ধ তীরটা দেখে বিস্মিত হয়, কিন্তু বিশ্বাস করে না। তীরটি আবার ছুড়তে যখন বলে অর্জুনকে তখন সে শুক্লাকে জানিয়ে দেয় লক্ষ্যভেদে নিজের দক্ষতার কথা। বলে, ‘শুধু ঐটা কেন, তোমার ক্যালেন্ডারে ঐ যে পাখির ছবিটা রয়েছে, আমি এখান থেকে ঠিক পাখির চোখে মারতে পারি! এক সময় গুলতি দিয়ে কত পাখি মেরেছি!’ কোনো এক বিমান কোম্পানির ক্যালেন্ডারে অ্যারোপ্লেনের বদলে উড্ডীন বাজপাখির ছবি। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় শুক্লা, ‘মেরে দেখাও তো! গুলতি ছোঁড়া আর জেভলিন ছোঁড়া এক জিনিস নয়।’ অর্জুন চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করে ফেলে। মাথাটা পেছনে ঝুঁকিয়ে মনেপ্রাণে লক্ষ্যভেদে মনোনিবেশ করে সে। শুক্লা যখন জিজ্ঞেস করে কী দেখতে পাচ্ছে সে, অর্জুন জানায়, ‘আর কিছু না, শুধু পাখিটার চোখ।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তীর নিক্ষেপ করে না অর্জুন। বলে, ‘না লাগাতে পারলে কিছুই নয়। কিন্তু যদি লাগিয়ে ফেলি, তাহলে আমার একটু গর্ব হয়ে যেতে পারে! সেটা ভালো নয়!’ শুক্লা আবারও অবিশ্বাস করে অর্জুনকে। নিজেই তীর হাতে তুলে নিয়ে নিক্ষেপ করে। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ হয় না তার, পাখিটার চোখের কাছাকাছি লেগে তীরটি ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। শুক্লার স্নানঘরে যাওয়ার অবকাশে লক্ষ্যভেদ করার নিভৃত সুযোগ আবার পেয়ে যায় অর্জুন। আর একটি পালকের তীর তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে ক্যালেন্ডারের পাখিটার চোখ লক্ষ করে। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। ঠিক পাখিটার চোখে গিয়ে লাগে তীরটি। অর্জুন ভাবে : ‘আশ্চর্য, আজ কি অর্জুনের হাতে জাদু ভর করেছে? কিন্তু অর্জুন শুক্লার সামনে এ খেলা দেখাবে না। সামান্য ব্যাপার, এ নিয়ে গর্ব ভালো না।’
এই নিরহংকারই অর্জুনের শক্তি কিংবা পারানি। নিজের শরণার্থী জীবনের সকল গ্লানি আর কাঁটাকে সে লক্ষ্যভেদী মনঃসংযোগ আর মেধা দিয়ে দূর করতে চেয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে বারবার, সতীর্থ-স্বজনদের ঈর্ষা আর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে ঘুরেফিরে। কিন্তু শীর্ষে পৌঁছার লক্ষ্যবিন্দু থেকে শত ভীতি-প্রলোভন সত্ত্বেও বিচ্যুত হয়নি মুহূর্তের জন্য। সুনীল আশ্চর্য দক্ষতায় একজন বাস্তুহীন মানুষের শিরদাঁড়া উঁচু করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর, লক্ষ্যভেদী আত্মপ্রতিষ্ঠার কথকতা শুনিয়েছেন অর্জুন 888sport alternative linkে। মিথের অর্জুন যেমন ব্যক্তি হয়েও যুগন্ধর মধ্যমণি, সুনীলের অর্জুনও তেমনি শতভাগ ব্যক্তি হয়েও অনিকেত মানুষের সহস্রভাগ প্রতিনিধি। মাটিহারা ইকারুস-মানুষের নীড় রচনার, প্রার্থিত স্বপ্নবুননের এবং ভবিষ্যৎকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যভেদী সৈনিক সে। ব্যক্তিনামের অর্জুন নিশ্চয়ই বেঁচে থাকে না, কিন্তু ‘অর্জুন’ কনসেপ্ট লক্ষ্যভেদীর প্রতœপ্রতিমা হয়ে বেঁচে থাকে চিরকাল। এ-888sport alternative linkে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালি জীবনের এক কালো অধ্যায়ের গভীরে আলো ফেলে ওই হীরক-প্রেরণাকেই দ্যুতিময় করে তুলেছেন।

দুই
অর্জুন-কাহিনিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক যে-কৌশল অবলম্বন করেছেন সেটি যেমন উপভোগ্য, তেমনি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সূচনায় সর্বদর্শী ঔপন্যাসিক যেভাবে 888sport alternative link শুরু করেছেন, মনে হয় আখ্যান বুঝি ওইভাবেই এগোবে। কিন্তু অল্প কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই ঔপন্যাসিক বদল করে ফেলেন দৃষ্টিকোণ। 888sport alternative linkের পটে তখন আবির্ভাব ঘটে যায় অর্জুনের, অর্জুন রায়চৌধুরীর। নিজের জবানিতে ক্রমে-ক্রমে সে উন্মোচন ঘটায় 888sport sign up bonusময় শৈশবের কথা, জন্মভূমির সঙ্গে তার নাড়ির টান আর ওই নাড়িছেঁড়া বাস্তুত্যাগের কথকতা। বাদ যায় না নতুন এক দেশের মাটিতে পা ফেলা কঠিন সংগ্রামের খুঁটিনাটি, আত্মপ্রতিষ্ঠার চড়াই-উতরাই। তবে দৃষ্টিকোণ বদল করে ঔপন্যাসিক সাময়িকভাবে জনান্তিকে যান মাত্র, কেননা দর্শক ও ভাষ্যকাররূপে তিনি 888sport alternative linkের ভুবনে ফিরে আসেন অচিরেই। অর্থাৎ, সর্বদর্শীর দৃষ্টিকোণ আর চরিত্রের জবানির মিশেলে এক অভিনব ঔপন্যাসিক প্রকরণ-সৃজনে উৎসাহী হয়ে ওঠেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অর্জুনের স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্বের এ এক উল্লেখযোগ্য প্রান্ত। দুই বিপরীতমুখী প্রেক্ষণবিন্দুর মেশামেশিতে 888sport alternative linkের আখ্যান এক ভিন্নমাত্রিক সমগ্রতা পেয়ে যায়। ওই সমগ্রতা অর্জনেরও রয়েছে এক নিগূঢ় কার্যকারণ। সর্বদর্শীর দৃষ্টিসীমায় একাকার হয়ে যায় দেশকাল-রাজনীতি আর অর্জুনের উত্তমপুরষের ভাষ্যে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তির সংকট, সংগ্রাম, আকাক্সক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার টানাপড়েন। ব্যক্তিক ও সামষ্টিক এই দুই ভিন্নমুখী প্রেক্ষণবিন্দুর মেলবন্ধে অপূর্ব এক সাম্য প্রতিষ্ঠা করে আরোপিত রাজনীতির ক্ষতকে, দেশভাগের ছুরিকায় আহত মানবাত্মাকে সুনীল জীবন্ময় করে তোলেন। ব্যক্তি ও সমষ্টির সমন্বিত দৃষ্টিপাতে সমগ্র দেশের আহত-হৃদপিণ্ড তার রক্তক্ষরণ-সমেত দূরবর্তী নিরাময়ের সংকেতে পাঠকমনকে সচকিত করে রাখে। পরস্পরবিপরীত এই প্রেক্ষণবিন্দু ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনীল সাফল্য পেয়েছেন দুটি কারণে। প্রথমত, 888sport alternative linkটিতে জড়িয়ে আছে তাঁর আত্মজীবনের 888sport sign up bonus; দ্বিতীয়ত, নির্মোহ ঔপন্যাসিকের দেশকাল ও সমাজ-রাজনীতি বিষয়ে আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। অংশত-আত্মজৈবনিক এ-888sport alternative linkে তিনি ব্যক্তির আততি ও রক্তক্ষরণের কথকতায় 888sport sign up bonusময় শৈশবকে যেমন জীবন্ত করে তোলেন, তেমনি ওই ব্যক্তিকেই তিনি সমষ্টির পরিপ্রেক্ষণীতে স্থাপন করে নিরাসক্ত সর্বদর্শীর দৃষ্টিপাতে দান করে ফেলেন সম্পূর্ণতা। উত্তমপুরুষের জবানিতে হয়তো থাকে পক্ষপাত, কিন্তু সর্বদর্শীর উপস্থাপনায় আসক্তি নয়, সংযুক্ত হয়ে যায় নিখাদ তন্ময়তা। কৃশ এই 888sport alternative linkের পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদে অনবরত প্রেক্ষণবিন্দুর এই অদলবদল অনন্যসুন্দর এক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। আর এভাবেই ব্যক্তির রক্তক্ষরণ ও দূরাশ্রয়ী অভীপ্সা শেষ অবধি সামষ্টিক মানুষের প্রত্যয়ের প্রতিরূপক তাৎপর্য পেয়ে যায়।

তিন
সর্বদর্শী ঔপন্যাসিক 888sport alternative linkের পট-উন্মোচন করেছেন ১৯৭০ সালের কলকাতা নগরের ‘দেশপ্রাণ কলোনি’ নামক একটি রিফিউজি পাড়াকে উপলক্ষ করে। দেশভাগের বেশ কয়েক বছর পর ফরিদপুরের মাদারিপুর অঞ্চল থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা সর্বসহায়হারা কয়েকটি ভাঙা-পরিবারের মানুষ আশ্রয়ের জন্য দখল করে নিয়েছে যে-পরিত্যক্ত বাগানবাড়িটি তারই নতুন নাম দেশপ্রাণ কলোনি। উত্তর কলকাতার দমদম অঞ্চলে গড়ে ওঠা ওই কলোনিটির কিছু মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে, কেউবা নিরুদ্দেশ হয়েছে। তবু মানুষের মোট 888sport free bet কমেনি, বেড়েছে। দেশত্যাগের বন্ধুর অভিযাত্রায় এদের মধ্যে যে সহমর্মিতা ও সংহতি গড়ে উঠেছিল, তার অনেকটাই এখন নড়বড়ে, শিথিল। দারিদ্র্য বিস্তৃত হয়েছে আরো, সম্ভ্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসছে ক্রমশ। ধসে পড়েছে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও শুভচিন্তা। জীবনের ওইসব ফাটলকে উপলক্ষ করেই এই কলোনিতে ঢুকে পড়েছে বাইরের ক্লেদ ও বিকৃতি, অপরাধ। ঔপন্যাসিক শুরুতে ধসে পড়ার জন্য উন্মুখ ওই কলোনির কিছু মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকার, আত্মপ্রতিষ্ঠার, আর সংহতি রক্ষার কথকতা নানাভাবে গ্রথিত করেছেন। কিন্তু ধস যখন নামে, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে সব। ওই ভাঙনের এবং ভাঙন ঠেকিয়ে বেঁচে থাকার আখ্যানই নানা চরিত্রের, ঘটনার ও প্রত্যাশার আশ্রয়ে অর্জুন 888sport alternative linkে স্থান পেয়েছে। সর্বদর্শী ঔপন্যাসিক সূচনায় সরাসরি চোখ ফেলেন কলোনির ভেতর বাড়িগুলোর গভীরে। তুলে আনেন টুকরো-টুকরো ঘটনা, সংলাপ। সুস্থতার, মমতার, লেখাপড়ার প্রতি একাগ্রতার, বিশেষ করে মানুষ পরিচয়টি রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টার অর্থাৎ কঠিন জীবনযুদ্ধের স্মারকগুলোকে তিনি প্রতিভাসিত করে তোলেন। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে তিনি আঁকাড়া করে তোলেন সংলাপের ভাষিক উপস্থাপনায়। পশ্চিম বাংলার আলো-হাওয়ায় দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও পূর্ববাংলার ভাষিক সংস্কৃতি থেকে এই কলোনিবাসী বিচ্যুত হয়নি। পূর্ববাংলার বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের উপভাষা এরা অবলীলায় ব্যবহার করে। রাস্তার মারামারিতে এক পাঞ্জাবির সাহায্যে কেওয়ল সিং এগিয়ে এলে কলোনিবাসীদের ‘ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন, পাঞ্জাবী গো মইধ্যে দারুণ ইউনিটি! এক পাগড়ির বিপদ দ্যাখলেই আর-এক পাগড়ি দৌড়াইয়া আসে।’ অতীত সুন্দর ও মধুময় ছিল বলেই, কলোনির অপেক্ষাকৃত প্রবীণরা 888sport sign up bonusকাতর হয়; কোনো কাজে লাগবে না জেনেও হারানো গৌরব ও সম্ভ্রম-সম্মানকে দূরদর্শন করতে ভালোবাসে। কিন্তু বর্তমানটি নির্মম বলেই অতীত ঝাপসা হয়ে গেছে যাদের চোখে, ভবিষ্যতের দিকেই তাদের চোখ। এরা তরুণ, দেশকালের ঝাপটা এদের দৃষ্টিকে কখনো শানিত করে, কখনো-বা ঝাপসা করে দেয়। এদেরও দুটি ভাগ, সুস্থতার ধারা আর বিকৃতির পরম্পরা। একদল মানুষ পরিচয় খুঁজে নিতে তৎপর, এরা বিদ্যা অর্জনকেই আত্মপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। অপরপক্ষ সার করেছে ঔপভৌগিক অস্তিত্বকে। এরা দুঃসময়শাসিত, পেশি ও বিকৃতির সহায়তায় ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করতে চায়। যে ৩৪টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে এ-কলোনি তার ভেতরেই নিভৃতে তৈরি হয়েছে ওই ফাটল।
সর্বদর্শী ঔপন্যাসিক প্রথমেই কলোনির যে-বাড়িতে তাঁর দৃষ্টির আলো ফেলেছেন, লাবণ্য তাদেরই একজন, – যারা শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে চায় বিদ্যার্জনের পথ ধরে। এই ধারার স্বল্পসংখ্যক তরুণদের মধ্যমণি অর্জুন। লাবণ্য – লাবি সম্বোধনে যে কলোনিজীবনে পরিচিত তার আদর্শ-উৎসও অর্জুনই। রিফিউজি কলোনির ছেলে অবজ্ঞাত অর্জুন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রের তকমা পেয়েছে। কেমেস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ায় দেশের রাষ্ট্রপতি তার গলায় পরিয়ে দিয়েছেন মালা, দু-হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়েছেন। বিএসসি পরীক্ষায় একবার ফেল করেছে লাবি, তবু সে হতোদ্যম হয় না। অর্জুনদার মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় সে। অন্যপক্ষে আছে দিব্য আর সুখেনরা। দিব্য একবার জুনিয়র গ্র“পে অল বেঙ্গল কুস্তি প্রতিযোগিতায় সেকেন্ড হয়েছিল। কোমল মুখশ্রীর জন্য ছোটবেলায় ‘দেবশিশু’ মনে হতো তাকে। কিন্তু এখন সে পেশিশক্তিকেই পুঁজি করে চলে। যে অনায়াসে বিপন্ন এই কলোনিবাসীর প্রতিরক্ষায় প্রধান ভরসা হয়ে উঠতে পারত, সে-ই এখন হয়ে উঠেছে ধস্নামা পরিস্থিতির উৎস। কলোনির পাশঘেঁষে রয়েছে যে প্লাইউড ফ্যাক্টরি, তার পাঞ্জাবি মালিক কেওয়ল সিংয়ের সে বেতনভোগী লাঠিয়াল! ফ্যাক্টরির সীমানাঘেঁষে রয়েছে কলোনির যে-কয়টি ঘর, সে-জায়গাটুকুর ওপর পড়েছে  কেওয়ল সিংয়ের চোখ। ওই জমিটুকু সে জবরদখল করে নিতে চায়। নানা কৌশলে সে জাল ফেলে জব্দ করে ফেলে ওই কলোনিজীবন। তার বড় ভরসা দিব্য আর তার সহযোগীরা। দিব্যর সূত্র ধরেই বাইরের ক্লেদ আর বিকৃতি অবলীলায় ঢুকে পড়ে কলোনির নিস্তরঙ্গ জীবনে। সুখেনের বয়স ৩২, কিন্তু দাড়ি-গোঁফ নেই বলে ২২-২৩-এর বেশি মনে হয় না। ভালো গান গায় আর কাজ করে সে পাউরুটির কারখানায়। অন্যদের কাছে গর্ব করে বলে, ‘আমি তোদের মতন বেকার না, বেকারিতে কাজ করি!’ এককালের গোবেচারা সুখেন এখন দিব্যর প্রধান সহযোগী। দীর্ঘদিন ধরে তার চোখ পড়ে আছে লাবির ওপর। লাবিকে বিয়ে করতে চায় সে। তার সহায়শক্তি দিব্য গায়ের জোর খাটিয়ে লাবিকে নির্দেশ দেয় সুখেনের সঙ্গে বিয়ের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো নিভৃতচারী অর্জুনকে কলোনিজীবনের এই টানাপড়েনে জড়িয়ে ফেলে দিব্যরা। অর্জুন আইডল বলেই, লাবির প্রিয় মানুষ। আর ওই একই কারণে আপৎকালের বন্ধু ও সহযাত্রী হওয়া সত্ত্বেও অর্জুন দিব্যদের পথের কাঁটা হয়ে যায়। অর্জুন ইতোমধ্যে নিজের যোগ্যতার সুবাদেই প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছে কলকাতার নাগরিক পরিমণ্ডলে। অনেক বড় বড় মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ। ফলে কেওয়ল সিংও ঠিকই টার্গেট করে নেয় অর্জুনকেই। ফলে উপর্যুপরি আক্রান্ত হয় অর্জুন। দিব্য আর সুখেনরা একজোট হয়ে যায় কেওয়ল সিংকে ঘিরে। অত্যাসন্ন হয়ে ওঠে দেশপ্রাণ কলোনির ভাঙন। কলোনিতে জ্বলে ওঠে আগুন, দিব্যর পেশিশক্তির কাছে সম্ভ্রম হারায় লাবি। ঘরপোড়া জমি রাতারাতি দখল করে নেয় পাঞ্জাবি কেওয়ল সিং। লাঠি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে যায় কেওয়ল সিংয়ের দেহরক্ষী দিব্যরা। ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু। ওই আপৎকালে, অজ্ঞাত আততায়ীর যে শাবলের আঘাতে প্রথমবার বিপন্ন হয়েছিল অর্জুনের জীবন, সেই শাবল হাতে নিয়েই লক্ষ্যভেদী অর্জুন দলবল নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়ে। আবারও আক্রান্ত হয় অর্জুন। কিন্তু অর্জুন মরে না। বেঁচে থাকে অর্জুন। ওই বেঁচে থাকার লড়াকু জীবনের কাহিনি সুনীল আশ্চর্য দক্ষতায় জুড়ে দিয়েছেন অর্জুনের জবানিতে। সর্বদর্শী ঔপন্যাসিক 888sport alternative linkের পটে ফিরে এসেছেন বারবার, কিন্তু অর্জুনের আত্মকথার অবকাশে  জনান্তিকে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। আবার অন্যভাবে বললে, এ-কথাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নাট্যমঞ্চে দ্বৈত ভূমিকায় নামে যে কুশীলব, অনেকটা সেরকমই যেন ঔপন্যাসিক সুনীল তাঁরই আত্মরূপ চরিত্র অর্জুনের বেশ ধারণ করে ফিরে-ফিরে আসেন 888sport alternative linkের রঙ্গমঞ্চে। আত্মজীবনের 888sport sign up bonusকাতরতায় দেশভাগজনিত যন্ত্রণার উপলব্ধিকে তিনি বাক্সময় করে তোলেন, মাতৃভূমি ছেড়ে আসার বেদনাকে প্রতিকারহীন বিক্ষোভ আর অভিমানের চিত্রধ্বনিময় তারে গুঞ্জরিত করে তোলেন। উদ্বাস্তু-জীবনের গঞ্জনা-বঞ্চনার ইতিবৃত্তকে, শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর আস্তিত্বিক সংকটকে লক্ষ্যভেদ-সংগ্রামের সমার্থকতা দান করেন তিনি। আর, এভাবেই অর্জুন যুগপৎ হয়ে ওঠে এক বিশেষ আপৎকালের ব্যষ্টি ও সমষ্টি বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার 888sport live chatশোভন কথামালা।

চার
888sport alternative linkটির দ্বি-স্রোত আখ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ অর্জুনের আত্মজবানিতে উপস্থাপিত কথামালা। উত্তমপুরুষের আত্মভাষ্যে চরিত্রের স্বৈর-স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ। সব কথা, ঘটনা ও বিশ্লেষণ যেহেতু ওই চরিত্রের প্রেক্ষণবিন্দু থেকে উপস্থাপিত হয়, সেহেতু ওইসব ঘটনা ও বর্ণনার সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ থাকে না পাঠকের। তবে সংশয় তৈরি হতে পারে নিশ্চয়ই। কিন্তু সংশয় সত্ত্বেও ওই বয়ান মেনে না নেওয়ারও কোনো বিকল্প থাকে না। অর্জুনের ভাষ্যও স্বৈরস্বাধীন, কিন্তু এতে সংশয় যে জাগে না তার কারণ নিজের জীবন নিঙ্ড়ে পাওয়া অভিজ্ঞতার কাহিনি শোনায় সে। যে-দুর্ভোগের শিকার সে, জাতিগত ইতিহাসের গভীর থেকে তার উৎসারণ। ব্যষ্টির সাফারিং শোনায় বটে সে, কিন্তু প্রকারান্তরে অর্জুন হয়ে ওঠে সমষ্টিরই প্রতিনিধি। তার ভাষ্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে দেশ-কাল-সমাজ; বিশেষ কালের বিপন্ন দেশত্যাগী উন্মূলিত ভাগ্যহত মানুষের বিদীর্ণ এক দর্পণ হয়ে ওঠে অর্জুন।
কলকাতার দেশপ্রাণ কলোনিতে জমি নিয়ে বিরোধ যখন তুঙ্গে উঠেছে, অর্জুন তখন লক্ষ্যবস্তু হয়েছে প্রতিপক্ষের উপর্যুপরি আক্রমণের। প্রথম আক্রমণেই জীবনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তার। অজ্ঞাত আততায়ী ঘরের জানালার বাইরে থেকে শাবল দিয়ে আঘাত করেছিল তাকে। জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি পৌঁছেছিল অর্জুন। তবু সে বেঁচে উঠেছিল, মরেনি। হাসপাতালের বিছানায় হারানো 888sport sign up bonus খুঁজে-খুঁজে সে ক্রমভঙ্গুর এক 888sport sign up bonusর ভাণ্ডার পুনর্গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল। ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওই 888sport sign up bonusর ভাণ্ডারকেই নানা কোণ থেকে অর্জুনের আত্মভাষ্যে গ্রথিত করেছেন। বর্তমান থেকে অতীত এবং অতীত থেকে আবার বর্তমানে ফিরে ভবিষ্যতের প্রত্যাশা-জাগানো ইশারায় অর্জুনের দুই মেয়াদে হাসপাতাল বাসকালীন 888sport sign up bonus-অন্বেষা শব্দরূপ পেয়েছে 888sport alternative linkে। নিজের জবানিতে অর্জুন প্রথমেই একটি আত্মপ্রতিকৃতি সৃজন করে ফেলে নিজের স্বভাব, বোধ আর লক্ষ্যভেদী মানসতার মিশেলে। 888sport alternative linkের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হাসপাতালের বিছানায় শায়িত অর্জুন প্রথম আত্মোন্মোচন করে ক্রমভঙ্গুর 888sport sign up bonusর টুকরোগুলোর কোলাজ রচনা করে। বলে সে : ‘আমার নাম অর্জুন রায়চৌধুরী। আমার বাবার নাম ঈশ্বর ক্ষিতিমোহন রায়চৌধুরী।… আমার ডান হাতের তালুতে একটা জড়–লের দাগ আছে। আমার বইয়ের টেবিলে একদিন একটা শুঁয়োপোকা এসছিল কোথা থেকে। আমি সেটাকে একটা বোতলে ভরে রেখেছি – প্রজাপতি হয় কিনা দেখার জন্য।… আমি সর্ষের তেলের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। একবার আমি জলে ডুবে গিয়েছিলাম, তখন আমার বয়স তেরো… আর একবার আমি জলে-ডোবা থেকে একটি মেয়েকে বাঁচিয়েছিলাম, সব মনে আছে।… আমার বয়স পঁচিশ, কিংবা ছাব্বিশও হতে পারে। আড়াই বছর আগে আমি এম-এসসি পাস করেছি। দমদমের দেশপ্রাণ কলোনিতে আমি থাকি – আমাদের বাড়ির নাম নাচঘর।… আমি বেঁচে উঠব ঠিকই। আমি এত সহজে মরার জন্য জন্মাইনি। এটা হাসপাতালের খাট, খাটের পাশেই দেয়াল – আমি হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি – কিন্তু আমার হাত দুটো চামড়ার স্ট্র্যাপে বাঁধা। হাত বেঁধে রেখেছে কেন?… আমি বেঁচে উঠব ঠিকই। আমার মাথায় চোট লেগেছে, ও কিছু না, সবারই একবার আধবার মাথা ফাটে। আমার ভয় ছিল, আমার 888sport sign up bonus না নষ্ট হয়ে যায়।… 888sport sign up bonus নষ্ট হলে আমার চলবে না। আমার থিসিসটা এখনো পুরো শেষ হয়নি, তাছাড়া, ধুৎ, জড়ভরত হয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে আছে নাকি? না, না, আমার সব মনে আছে।’ 888sport sign up bonus হাতড়ে-হাতড়ে অর্জুন পৌঁছে যায় বর্তমান থেকে অতীতে, মধুময় শৈশবে। তবে রূঢ় বর্তমানটা মনের ভেতরকে মোচড় দিয়ে যায় বলেই অতীতের সঙ্গে একটা নড়বড়ে সেতুবন্ধ তৈরি হয়ে যায়। আত্মপরিচয়ে মায়ের নামটা উচ্চারণ করে না অর্জুন। প্রথাশাসিত সমাজ শৈশবেই শিখিয়ে দিয়েছে মায়ের নাম যত্রতত্র উচ্চারণ করতে নেই। মা শান্তিলতার কথা পরে নানাভাবে বলেছে অর্জুন, কিন্তু পাগল বড় ভাইটির প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে তার কথায়। – ‘মা কাঁদতো দাদার জন্য।… দাদা যখন সত্যিই পাগল হয়ে গেল – তখন কিছুই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারিনি।… শেষ দিকে দাদা খুব বলতো, চল, আমরা দেশে ফিরে যাই! হিন্দুস্থান, পাকিস্তান আবার এক হয়ে গেছে, তুই জানিস না? গান্ধীজী সব মিটমাট করে দিয়েছে, আবার সব এক! গান্ধী খুন হয়ে গেছেন তার চোদ্দ বছর আগে, দাদার খেয়াল নেই।’ দাদা তার চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘অর্জুন, তুই দ্যাখোস নাই? এই দ্যাখ, কাগজে বড় বড় কইরা ছাপাইয়া দিছে – জিন্নার লগে কোলাকুলি করছে জওহরলাল। চল্, আমরা বাড়ি ফিরা যাই। এই পচা দ্যাশে আর থাকুম না। – আশ্চর্য, যে কাগজখানা দাদা দেখাচ্ছিল, তাতে বড় বড় করে ছাপা ছিল দাঙ্গার খবর।’ তার ওই দাদাকে একদিন মেরেছিল দিব্য। ওরাই জোর করে তার অসুস্থ দাদাকে ঘুঘুডাঙ্গার এক ফ্যাক্টরিতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খোলা মাঠ আর নদীর দেশ ছেড়ে এসে তার দাদা এই ইট-পাথরে গড়া শহুরে জীবনে খাপ খাওয়াতে পারেনি। দাদার কথা ভাবতে-ভাবতেই অর্জুন তার হারানো শৈশবের টুকরো-টুকরো 888sport sign up bonusকে গেঁথে ফেলে ক্রমভঙ্গুর প্রক্রিয়ায়। আর ওই প্রক্রিয়াতেই দেশভাগ-উত্তর পূর্ববাংলার 888sport free betলঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের আঁকাড়া বাস্তবতা জীবন্ত হয়ে ওঠে। অর্জুন বলে : ‘আমি দেশ ছেড়েছিলাম এগার বছর বয়সে। হ্যাঁ, দেশই তো। দেশ-বিভাগের সময়ের কথা আমার মনে নেই। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে জানতাম, আমরা পাকিস্তানের মানুষ।… আমাদের সব সময় ভয় দেখানো  হতো, একা একা যেন দূরে কোথাও না যাই, ইস্কুলে কোনো মুসলমান ছেলের সঙ্গে যেন ভুলেও কখনো ঝগড়া না করি।… বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে ইস্কুল, রোজ হেঁটে যেতাম। বর্ষাকালে সব জলে ডুবে যেত, তখন নৌকো ছাড়া উপায় নেই।… যেদিন কোনো নৌকো পেতাম না – সেদিন বট গাছটার আড়ালে জামাপ্যান্ট খুলে তাতে বইখাতা মুড়ে নিয়ে, মাথার ওপরে এক হাতে উঁচু করে তুলে সাঁতরে পার হয়ে যেতাম।’ অবনীশদাকে ওই গল্প শুনিয়েছিল অর্জুন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ১১ বছর বয়সে এরকম ন্যাংটো হতে লজ্জা করত না তার? অর্জুন অবলীলায় বলেছে, না, লজ্জা কিসের? শুক্লা জিজ্ঞেস করেছে, ‘অত কম বয়সে তুমি সাঁতার কাটতে পারতে? কে সাঁতার শিখিয়েছিল?’ ‘কি অদ্ভুত কথা, পুব বাংলার কোনো ছেলেকে কেউ সাঁতার শেখায় নাকি? জলের দেশ, জলের পোকার মতন সবাই জন্মাবার পর থেকেই সাঁতার শিখে যায়।’ – প্রশ্নটি তাই অদ্ভুত ঠেকেছিল অর্জুনের। স্কুলের হেডমাস্টার আমজাদ আলির কথা ভুলতে পারে না অর্জুন। অসাধারণ মানুষ ওই আমজাদ আলি; দুটি দেশের নির্বোধ উন্মত্ততায় তিনি দুঃখ পেতেন। যে ‘রাজনৈতিক মূর্খতা আর গোঁয়ারতুমির’ জন্য দেশ দুভাগ হয়েছে তার সমর্থক ছিলেন না তিনি। 888sport free betগরিষ্ঠতার জোরে 888sport free betলঘুদের দমিয়ে রাখার চেষ্টাকে তার মনে হতো অভদ্রতা। অর্জুন এখন বুঝতে পারে পাগলামির যুগে এ-ধরনের মানুষ জনপ্রিয়তা পান না। ওই আমজাদ আলিরই ছেলে অর্জুনের সহপাঠী ইয়াকুব ঘৃণা করত অর্জুনকে। ছিনিয়ে নিয়েছিল সে অর্জুনের যক্ষের ধন লাল-নীল পেনসিল। স্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিল বলে পাড়াতুতো এক কাকা, যিনি চাকরি করতেন নেভিতে, অর্জুনকে উপহার দিয়েছিলেন লাল-নীল পেনসিল আর রুপোলি মাউথ অর্গান। পেনসিলটি হারিয়ে বিমূঢ় হয়েছিল অর্জুন। পাড়া-প্রতিবেশী, পরিবার-পরিজন সবাই পরামর্শ দিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করতে। অর্জুনের এখন মনে হয়, পেন্সিল কেড়ে নেওয়াটাকে হয়তো অনেক বড় কিছু কেড়ে নেওয়ার আগাম সংকেত হিসেবেই বিবেচনা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু শ্রেণিকক্ষেই আমজাদ স্যারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল অর্জুন। যোগ্য বিচারই পেয়েছিল সে। হেডস্যার আমজাদ আলি বলেছিলেন, ছেলেটি শুধু চোর নয়, মিথ্যাবাদীও। রায় দিয়েছিলেন তিনি শ্রেণিকক্ষে প্রকাশ্যে ইয়াকুবের কান মলে দিতে। অর্জুন কোনোমতে ইয়াকুবের শুধু কান ছুঁয়েছিল। কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। হইচই পড়ে গিয়েছিল গ্রামে। ‘উনিশ শো পঞ্চান্ন সালে পাকিস্তানে একটি হিন্দুর ছেলের পক্ষে মুসলমান ছেলের কান মলে দেওয়া ছিল সাংঘাতিক ঘটনা। বাড়ির সবাই বেশ কিছুদিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছিল, বেশ মনে রয়েছে অর্জুনের। সবাই জানত, আমজাদ আলি ভালো লোক হলেও, তাঁরই ভাই মুসলিম লিগের পান্ডা। ফল পাওয়া গিয়েছিল কয়েক দিনের মাথাতেই। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে চার-পাঁচজন ছেলেসহ ইয়াকুব আবার কেড়ে নেয় ওই পেন্সিল, মাউথ অর্গান, এমনকি বইখাতা পর্যন্ত। জানিয়ে যায়, আমজাদ স্যারকে আবার বিষয়টি জানালে, পাটক্ষেতের মধ্যে লাশ দেখবে ওর বাবা-মা।’  888sport sign up bonusকাতর অর্জুন বলে, ‘…ঐ দুটিই ছিল আমার সম্পদ। আমি হারিয়েছি, আমার ছেলেবেলার লাল-নীলস্বপ্ন। পুকুর ধারে, বাঁশ বাগানে, বেতের ঝোঁপের পাশে Ñ যেখানে আমি একলা আমার মাউথ অর্গান বাজাতাম, সেসব জায়গার গাছপালা পরে দেখেছে আমার থেকে ফুঁপিয়ে-ওঠা বুক-চাপা কান্না।’ পরে ঠিকই লাশ পড়েছিল পাটক্ষেতে। তবে অর্জুনের নয়, অমলাদির।
ফরিদপুরের পুরানবাড়ি গ্রামে কখনো দাঙ্গা হতে দেখেনি অর্জুন। অর্জুন জানে গ্রামে দাঙ্গা হয় না, দাঙ্গা হয় শহরে। গ্রামের ক্ষুদ্র পরিসরে চেনা মানুষের বুকে কেউ ছুরি বসায় না। তবে বাইরের দাঙ্গার খবর ঠিকই পৌঁছে যেত নিভৃত নিস্তরঙ্গ গ্রামে। মাঝেমাঝেই 888sport app কিংবা নারায়ণগঞ্জের দাঙ্গার খবর যখন পৌঁছাত গ্রামে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত তখন। অর্জুন 888sport app download for android করতে পারে, ‘সেই সব দিনে ছেলেরা খেলা করতো না, মেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করতো না, বুড়োরা পরচর্চা বন্ধ রাখতো – সবারই মুখ থমথমে।’ মাঝেমাঝেই দেখা যেত এক-আধটা বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে দেশান্তরী হতো মানুষ। আয়োজন চলত গোপনে, নিকট প্রতিবেশীও টের পেত না দেশান্তরী হওয়ার পরিকল্পনার কথা। এরা গোপনে জলের দরে বেচে দিত জমিজমা, কিন্তু পৈতৃক ভিটেটা বেচত না মায়ার বশে। গ্রামের সম্ভ্রান্ত বনেদি বাঁড়–জ্যেদের বাড়ি এমনি একদিন খালি হয়ে গিয়েছিল অকস্মাৎ। দত্তরাও চলে গেল একদিন। দত্তদের মর্মান্তিকভাবে চলে যাওয়াটা অর্জুনের এক অবি888sport app download for androidীয় 888sport sign up bonus। ওই বাড়ির সঙ্গে একটা হার্দ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিশোর অর্জুন আর তার দাদার।  দত্তকাকার চার মেয়ের একজন অমলাদির সঙ্গে েস্নহবাৎসল্যের এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাদের। বিয়ের দুবছরের মাথায় অমলাদি বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। অর্জুন তার আত্মভাষ্যে বলেছে, ‘বড় ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ে ছিলেন অমলাদি, দুপুরবেলা শান্ত দিঘির টলটলে জলের মতন মুখ, কেউ কোনোদিন ওঁকে একটা জোরে কথা বলতে শোনেনি।… এক একজন মেয়ে থাকে, ছেলেবেলা থেকেই যাদের মধ্যে একটা মাতৃভাব দেখা যায়। তারা মা হয়েই জন্মায়, মা হয়েই সুখে থাকে। আমরা যখন দেখেছিলাম, তখন কতই বা বয়েস অমলাদির, বাইশ কিংবা তেইশ। তবু, অমলাদি আমাদের সঙ্গে ঠিক দিদির মতনও ব্যবহার করতেন না, অনেকটা ছিলেন মায়ের মতন। কুড়ি বছর বয়েসে বিধবা হয়েছেন, সন্তানের সাধ জীবনে কখনো মিটবে না – তাই অমলাদি গ্রামের ছোট-ছোট ছেলেদের যখনই দেখতেন, যে-ভাবে পারেন কিছু না কিছু খেতে দিতেনই। আমরা যখন খেতাম, কি গভীর মমতাময় চোখে তাকিয়ে থাকতেন অমলাদি। জেলেপাড়ার মা-মরা ছেলে সাত বছরের আব্বাস তো দিনরাত অমলাদির কাছেই পড়ে থাকতো।’ যাকে দেখলেই অর্জুনের স্কুলের বইয়ে পড়া ‘তাপসী রাবেয়া’র গল্পটা মনে পড়ত, সেই অমলাদির বাড়িতে ওঁর সঙ্গে বন্ধু আলতাফসহ কত দুপুর গল্প করে কাটিয়েছে অর্জুন। ‘কি সুন্দর কর্পূরের গন্ধমাখা ক্ষীর আর নারকেল দিয়ে বানানো এখনো মুখে স্বাদ লেগে থাকা ‘তক্তি’ খেয়েছে তারা। সেই অমলাদির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল ‘দেড়-মানুষ উঁচ’ু পাটক্ষেতের ভেতরে। গ্রামের একদল ছেলে খেলা করতে গিয়ে লাশটি দেখতে পায়। অর্জুন ছিল না ওই ছেলের দলে, কিন্তু দাদা ছিল তার। অর্জুনের ভাষায় : ‘অমলাদির গলাটা অর্ধেক কাটা, শরীরে অসংখ্য কোপের দাগ, পোশাকের চিহ্নমাত্র নেই। ভোগ করার পর শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, অমলাদির শরীরটাকে টুকরো-টুকরো করতে চেয়েছিল।’ এই বীভৎস ঘটনা কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল কিশোর অর্জুনের কোমল মনটিতে, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শৈশবের গভীর থেকে তুলে আনা সেই অবি888sport app download for androidীয় 888sport sign up bonus মূল্যায়ন করে অর্জুন বলে : ‘আমি পাটক্ষেতের সেই দৃশ্য দেখিনি, সেইজন্যই, হয়তো কল্পনায় সেই দৃশ্য আরও ভয়ঙ্কর। আজও ভুলতে পারি না। অমলাদির জন্য সেদিন গ্রামের সবার চোখ সিক্ত হয়েছিল। পাটক্ষেত থেকে ছুটতে ছুটতে এসে দাদা বাড়ির  উঠোনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মাঝেমাঝে অজ্ঞান হয়ে যাবার অসুখটা তখন থেকেই শুরু হয়। অমলাদি, আমি আজ অনেক পড়াশনো শিখেছি, কিন্তু তোমাকে কোনো গল্প শোনাতে পারলাম না।’ এর দিন পনেরো পরেই দত্তদের বাড়ি একদিন প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। বাড়িতে রয়ে গেলেন কেবল ঠাকুমা আর ঠাকুর্দা। তাঁরা সাতপুরুষের ভিটেতেই দেহ রাখতে চান বলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। অর্জুন জল খেতেও যায়নি ওই বাড়িতে আর। তবে এরপর খুব বেশিদিন গ্রামেই থাকা হয়নি অর্জুনদের। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ক্রমেই ফাঁকা হয়ে পড়ছিল। অর্জুনের বাবা ক্ষিতিমোহন দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ভারত আর পাকিস্তান আবার এক হয়ে যাবে। গ্রামছাড়া মানুষ ফিরে আসবে আবার, আগের মতোই জমজমাট হয়ে উঠবে গ্রাম। অর্জুনের স্পষ্ট মনে আছে বাবা তার সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, ‘ঋষি অরবিন্দ বলেছেন, আর বেশী দিন নয়, উইদ্ইন নাইন্টিন ফিফটি সেভেন এক হয়ে যাবে সব, হিন্দু মুসলমান কোলাকুলি করে বলবে, পাস্ট ইজ পাস্ট! ইন ফিউচার আমরা সবাই ভাই-ভাই!’ অর্জুনের এতসব বোঝার বয়স তখনো হয়নি। পরে পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে নিজের মতো করে একটি ধারণা তৈরি করে নিয়েছে সে। বুঝেছে সে, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার মুসলমানরাও প্রতিশ্র“ত সুখ সমৃদ্ধি পায়নি।… পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হয়েছে, চাকরি-বাকরির রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে, ধীরে ধীরে মুসলমানদের মধ্যে গড়ে  উঠেছে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তখনো নিষ্পেষিত রইলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে। বাঙালী মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা রইলো না কিছুই, তাদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিদেশী শাসকদের মতনই রয়ে গেল। খাঁটি অর্থে পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলা কখনো স্বাধীনতা পায়নি। হাজার মাইল দূরত্বের দুটি অংশের মধ্যে মিলনের সূত্র শুধু ইসলাম।’
কিছুদিনের মধ্যেই অর্জুনের বাবা মারা গেলেন সন্ন্যাস রোগে। দারিদ্র্য, উৎকণ্ঠা, ভয় সম্ভবত সহ্য করতে পারেননি তিন। রাত্রে ঘুমিয়েছিলেন, সকালে আর জাগেননি। বাবার শ্রাদ্ধ করার সুযোগ পায়নি অর্জুনেরা, মাথাও ন্যাড়া করতে হয়নি দুই ভাইয়ের। শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুর ১১ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই ঘরে আগুন লাগল। আগুন লাগার পরদিনও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন করে সংসার সাজানোর চেষ্টা চলছিল। কিন্তু কালাশৌচের রাতে গ্রামের আরো ছয়টি বাড়িতে আগুন লাগল একসঙ্গে। আর দেরি নয়, অর্জুন দ্রুততার সঙ্গেই বলেছে, ‘ভোর হতে না হতেই আমরা দলকে দল বেরিয়ে পড়লাম।’ স্বপ্নের, ভালোবাসার মধুর গ্রামখানি হারিয়ে গেল অর্জুনের জীবন থেকে। হৃদয়চেরা বেদনা নিয়ে বলেছে অর্জুন : ‘পিতৃদাহের পর, হাঁড়ি ভেঙে শ্মশানের দিকে আর পেছন না ফিরে চলে যেতে হয়। আমরাও চলে যাচ্ছি এক শ্মশান ছেড়ে, আর পেছনে তাকাবো না।’ প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে প্রাতঃ888sport slot gameের অভ্যাস ছিল আমজাদ আলি স্যারের। পথে দেখা হয়েছিল তাঁর সাথে। বলেছিলেন তিনি, ‘…যাইও না! আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাছে লেইখ্যা তোমাগো ঘর বানাবার টাকা আদায় কইরা দিমু!’ ভীতিবিহ্বল মায়ের অবিশ্বাস ছিল, তাড়াও ছিল। দাদা বলেছিল, ‘যাই স্যার।’ ভুলতে পারে না অর্জুন, স্যার অমঙ্গুলে ওই কথাটি সংশোধন করে বলেছিলেন, ‘যাওন নাই, আসো গিয়া!’ কিন্তু ফেরা হয়নি অর্জুনের, জীবন থেকে দেশ হারিয়ে গেলে সে দেশে ফেরা হয় না। গভীর বিষণœতা বুকে নিয়ে সেই 888sport sign up bonus আগলে রেখেছিল অর্জুন, প্রায় অর্ধচেতন অবস্থায় হৃদয় খুঁড়ে তুলে এনেছে সেই অবি888sport app download for androidীয় 888sport sign up bonusগুচ্ছ। বলেছে সে, ‘…আমরা আর কোনোদিন ফিরে আসবো না। সেই ধানক্ষেতে কই মাছ ধরা দুপুরে, ভাতে লেবু পাতার গন্ধ, বটগাছে তক্ষকের ডাক, সাঁতার কেটে ইস্কুলে যাওয়া, ভূতের ভয়ে গা ছমছমানি, খেজুর গাছে উঠে রস চুরি করা, অমলাদির হাত থেকে মিষ্টি খাওয়া, হরীতকী গাছের নিচে গোসাপের দেখা পাওয়া – এইসব মিলিয়ে আমার যে জন্মভূমি, তাকে ছেড়ে এলাম।’
888sport sign up bonus পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় অর্ধচেতন অর্জুনরে ক্রম রক্ষা করার সুযোগ ছিল না তো বটেই, 888sport sign up bonusরও স্বধর্ম উল্লম্ফনধর্মিতা। ফলে আদি-মধ্য-অন্ত্য-ঘেরা স্থান বা ঘটনার ঐক্য ওই 888sport sign up bonusচারণায় রক্ষিত হওয়া অবান্তর। অসুস্থ দেহমনে যখন যে ঘটনাটি উদ্ভিন্ন হয়ে উঠেছে, তাকেই মনোজগতে আকার দিতে চেয়েছে অর্জুন। তার ওই 888sport sign up bonusচারণার শ্রোতা নেই কোনো, নিজে সে কথকও নয়, – ভাবুক মাত্র। ওই ভাবনার নৌকো পাড়ি দিতে দিতেই পশ্চিম বাংলার 888sport free betলঘু তার সতীর্থ মীজানুরের কথা মনে পড়েছে অর্জুনের। মীজানুরের মুখে একটি নির্ভুল চিহ্ন লক্ষ করেছিল পূর্ব বাংলার 888sport free betলঘু অর্জুন। একটা ‘তেলতেলে’ ভয়মাখা ভাব। মুখের ওই চিহ্নই শৈশবে অর্জুন আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের চোখে নিত্য দেখেছে। তার নিজের মুখেও ছিল ওই ‘888sport free betলঘু হওয়ার গ্লানিবোধে’র চিহ্ন। অর্জুন লক্ষ করেছে, রাস্তায় ভিড় জমলে, হট্টগোল হলে, মীজানুর উঁকি মারে না, ভয়ে-ভয়ে দূরে সরে যায়। হঠাৎ কোথাও ছোটাছুটি দেখলে কলেজপাড়ায় থাকে না মীজানুর, পার্কসার্কাস কিংবা রাজাবাজারে চলে যায়। এমনটি অর্জুনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে কতবার। সেও তো তার পেনসিল আর মাউথ অর্গান হারানোর কথা কাউকে বলতে পারেনি। মীজানুর ভারতবর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নয়, তবু তার মুখ থেকে অস্বস্তির চিহ্ন মোছে না। অর্জুন ভাবে – ‘সংবিধানের সুযোগ নিয়ে এক-আধজন মুসলমান ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে পারে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ চাষী-মজুর আর গরীবরা এখনো নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। আমি যদি রাজনীতি-টিতি করতাম, আমি জমি দখল বা শ্রমিক আন্দোলন না করে, ভারতের মানুষের মধ্যে ধর্ম-বিভেদ দূর করার চেষ্টা করতাম আগে। এ দেশের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়। এই সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে সেই দিন, যেদিন পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার মানুষ শুধু হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে পরিচয় না দিয়ে বাঙালী হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে। ধর্ম নয়, সংস্কৃতির ঐক্যেই আমরা বাঙালী।’ এভাবেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে লক্ষ্যভেদী অর্জুন স্বরচিত এক তত্ত্বলোকে পৌঁছে যায়। উৎস খুঁজে নিয়ে উৎসে ফিরে যায়।

পাঁচ
অর্জুনের আত্মভাষ্যের শেষ স্তরে রয়েছে তার দ্বিতীয় মেয়াদে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে 888sport sign up bonus গঠনের ক্রমভঙ্গুর কথামালা। তার আগে সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিক আখ্যানের পটে ফিরে এসেছেন বেশ কয়েকবার। সর্বদর্শীর প্রেক্ষণবিন্দু থেকে তিনি সমকালের কলকাতা, রিফিউজি বস্তির নির্মম বাস্তবতা, নানা টানাপড়েন ও অন্তর্বিরোধের কথকতা সংলাপে-মূল্যায়নে-বর্ণনায় গ্রথিত করেছেন। দেশপ্রাণ কলোনির জমি নিয়ে বাইরের আমদানি করা সংকট যখন রিফিউজি জীবনে অন্তর্বিরোধ ঘনীভূত করে তুলেছে, তখন দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে অর্জুন। এবারও সংকট দেখা দিয়েছে তার জীবনের। তবে তারও আগে মা শান্তিলতার উৎকণ্ঠায় ঋজু কণ্ঠে ভরসা দিয়েছে মাকে। একটি শানিত বিশ্বাস অবলম্বন করে স্থিত হয়েছে Ñ ‘সে কারুর ক্ষতি করেনি, তবু কেউ একজন ভেবেছিল, তাকে সরিয়ে দিলে তার কাজের সুবিধে হবে। কিন্তু অর্জুন তো মরবে না।’
অবশেষে দিব্যকে প্লাইউড ফ্যাক্টরিতে কেয়ারটেকারের চাকরি দিয়ে কেওয়ল সিং গুছিয়ে নেয় তার পরিকল্পনা। প্রথমে জমি ছেড়ে দেওয়ার আপস প্রস্তাব নিয়ে এগোয় ওই পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী। কলোনিবাসীর পরামর্শ সভায় এক ছটাকও জমি ছেড়ে না-দেওয়ার প্রস্তাব রাখে অর্জুন। উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে ঘুণেধরা মানুষগুলোকে। কলোনিবাসীর পারস্পরিক সম্পর্ক যখন সংঘর্ষে রূপ নিতে প্রস্তুত তখনই একরাতে কারখানার সীমানাঘেঁষে দাঁড়ানো ঠিক ওই পাঁচটি বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুনের ইন্ধন যে জুগিয়েছে কেওয়ল সিং ও তার অনুগত রক্ষীদের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারো। থানা-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে কব্জা করে কেওয়ল সিং ফ্যাক্টরির সীমানা প্রসারিত করে দেয়াল তুলে দেয় রাতারাতি। পোড়ো জমিটি ঢুকে পড়ে ফ্যাক্টরির সীমানার ভেতরে। এবার সুনিশ্চিত টার্গেট হয়ে যায় অর্জুন। যে নিজে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী, সে-ই হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবিন্দু। দিব্য স্পষ্টতই খুড়িমা শান্তিলতাকে জানিয়ে দেয় যে, এই কলোনিতে তার ও অর্জুনের একত্রবাস অসম্ভব। দিব্য অনেকটা নির্দেশের ভঙ্গিতেই এই কলোনি থেকে চলে যেতে বলে শান্তিলতাকে। জলজ্যান্ত এই অন্যায় মেনে নিতে পারে না অর্জুন। প্রতিবাদ করে, কিন্তু প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় দিব্য-সুখেনরা। লক্ষ্যভেদী ধনুর্ধর  অর্জুন এবার মুখোমুখি হয় অগ্নিপরীক্ষার।
888sport alternative linkের এই স্তরে পৌঁছে অর্জুন নিজের দৈর্ঘ্যকে অতিক্রম করে অভ্রভেদী হয়ে ওঠে। মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে নিয়ে এগিয়ে যায় সে ওই নতুন তৈরি হওয়া দেয়াল লক্ষ করে। সর্বদর্শী ঔপন্যাসিক যে ভঙ্গিতে শুরু করেছিলেন আখ্যান, ওই ভঙ্গি বজায় রেখেই তিনি এবার ব্যষ্টির সমষ্টি হওয়ার কথকতা শোনান। বলেন তিনি : ‘দেখুন এবার এই ছেলেটাকে। এর নাম অর্জুন। অর্জুন এখন তার শরীরের থেকেও লম্বা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে এখন তার প্রস্থের চেয়েও বেশী চওড়া। তার জীবন এখন তার জীবনের চেয়েও বড়।’ কারণ ইতোমধ্যে সে দরজার কোণে দাঁড় করানো শাবলটা হাতে তুলে নিয়েছে। সেই সে শাবল, অজ্ঞাত আততায়ী যে শাবল দিয়ে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। মা শান্তিলতা পথ আগলে দাঁড়ান তার। স্থিতধী অর্জুন শান্তভাবে বলে, ‘মা, তোমার কোনো ভয় নেই। আমি ঠিক ফিরে আসবো!’ এবার মুষ্টিমেয় কজন ছেলেমেয়ের দলবল নিয়ে এগিয়ে যায় সে। দেয়ালের ওপাশে তখন সারি সারি মুখ। অন্ধকারে চেনামুখগুলো শনাক্ত করে থমকে যায় অর্জুন। চেঁচিয়ে বলে, ‘দিব্য তোরা সরে যা – আমরা এই দেয়ালটা ভাঙতে এসেছি।’ লাঠি হাতে দিব্যরা সগর্বে প্রতিরোধ করে দাঁড়ায়। অর্জুন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সহযোদ্ধা কার্তিক তাড়া দিলে ক্লান্তভাবে বলে, ‘না, থাক্! আজ থাক্! চল্ ফিরে যাই!’ তার বুকের মধ্যে এক অসহায় হাহাকার বাসা বাঁধে। আর একটু এগিয়ে গেলেই মারামারি লাগবে। কার মাথা ফাটবে আর কেই-বা মরবে তার ঠিক নেই। এমন এক শক্তিতে তখন সে উজ্জীবিত, ইচ্ছে করলেই সে যেন সমগ্র পৃথিবী লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। ‘কিন্তু কাদের সঙ্গে মারামারি করতে যাচ্ছে সে! দিব্য, রতন, শম্ভু, নিতাই – ওদের সঙ্গে সে কলোনির মাঠে একসঙ্গে খেলাধুলো করেছে – কতদিন সে ওদের বাড়িতে ওদের মায়ের হাতের রান্না খেয়েছে। দিব্যর মায়ের মৃত্যুর আগে, যখন খুব অসুখ চলছিল তাঁর, তখন শান্তিলতা দিব্যকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন, তখন দিব্য অর্জুনের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাতো!… মানুষের প্রাণের চেয়ে কি জমির দাম বেশী! স্বজন হত্যার বদলে তো পথে পথে ভিক্ষা করাও ভালো! অর্জুন অসহায়ের মতন দ্বিধায় কাঁপতে লাগলো। কি করবে সে? এখন তার কি করা উচিত? এমন কেউ নেই, যার কাছ থেকে অর্জুন কোনো পরামর্শ বা বুদ্ধি নিতে পারে।’
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের সহায় ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ; তাঁর সারথি ও উপদেশক। ভ্রাতৃঘাতী ওই যুদ্ধের সূচনাতেই যুদ্ধবিমুখ হয়ে উঠেছিলেন অর্জুন। কাদের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করবেন? যুদ্ধের মাঠে প্রতিরোধের ব্যুহ রচনা করে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা তো তাঁরই নিকটজন, পরমাত্মীয়! পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ তখন যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে উপদেশনা দিয়ে যুদ্ধমুখী করে তুলেছিলেন। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় সংকলিত হয়েছে ওই উপদেশবাণী। বিশ শতকের কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণতুল্য সারথি নেই অর্জুনের, যুদ্ধের ময়দানে নিঃসঙ্গ লক্ষ্যভেদী ধনুর্ধর সে। ঔপন্যাসিক সুনীল, 888sport alternative linkে বলেন না মহাভারতের কথা, শ্রীকৃষ্ণের কোনো প্রতিমা সৃজনেও তিনি নিরুৎসাহী। তবু ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে অর্জুনকে যেভাবে তিনি উপস্থাপন করেন, সচকিত করে রাখেন যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি, তাতে মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্র অপ্রচ্ছন্ন থাকে না, ইশারায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঔপন্যাসিক সুনীল আধুনিক যুগের ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের স্বরূপটি বুঝিয়ে দেন বিপন্ন দেশকালের পরিপ্রেক্ষণীতে। এ-যুগে নিকটজনের ছদ্মবেশ ধরেই হানা দেয় শত্র“। যুদ্ধের মাঠে যুগনায়ক অর্জুনদের শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে হয়, শত্র“হননের মাহেন্দ্রক্ষণকে ব্যর্থ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। এই বোধের পরিপ্রেক্ষণীতেই বোধকরি ঔপন্যাসিক অর্জুনকে নব-মূল্যমানে পুনর্নির্মাণ করে ফেলেন। দাদার অত্যন্ত আদরের পালিত কুকুর ‘বেচারাম’ যখন প্রতিপক্ষের লক্ষ্যভ্রষ্ট আক্রমণে রক্তাক্ত হয়ে যায়, ঠিক তখনই নিজের অন্তর থেকেই নির্দেশ পেয়ে যায় অর্জুন প্রতি-আক্রমণের : ‘অর্জুন মাটি থেকে শাবলটা তুলে নিল আবার। এখন সে ভয়ঙ্কর শব্দটার চেয়েও ভয়ঙ্কর। তার ছিপছিপে শরীরটা উদ্যত তীরের মতন খরশান! সে হুংকার দিয়ে বললো, সাবধান হবার কি আছে? আয় ভেঙে ফ্যাল! শেষ করে দে Ñ শাবলটা ঘোরাতে ঘোরাতে অর্জুন এক লাফে দেয়ালটার ওপারে গিয়ে বললো, আয় কে আটকাবি, দেখি! সব ভেঙে ফেলবো!’
শেষ কথা
অর্জুন তার আত্মভাষ্যের শেষস্তরে পৌঁছে যায় ওই সম্মুখযুদ্ধের সূত্রেই। প্রচণ্ডভাবে আহত হলে পুনরায় তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়। অস্ত্রলেখা চিহ্নিত হয় তার শরীরেরে সম্মুখভাগে, বুকের গভীরে। ‘বীর প্রসূণ’ ও লক্ষ্যভেদী অর্জুন তার আগেই নিশ্চিত করে ফেলে যুদ্ধের সুফল। এই রক্তারক্তির ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হলে রাজ্য সরকার জমির ভোগদখলকারীদের পক্ষ অবলম্বন করে  অবস্থান নেয়। ঘোষণা দেয় ওই জমির পাকা দলিল হস্তান্তরের। এতে অবনীশদার ভূমিকা থাকে, নেপথ্যে চিরঋণী শুক্লাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। অবশেষে রক্তরঞ্জিত বিজয়ী যোদ্ধার বেশেই অর্জুনের প্রত্যাগমন ঘটে হাসপাতালে। ওইখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার ক্রমভঙ্গুর আত্মভাষ্য পুনরায় 888sport alternative linkের পটে ধারণ করেন ঔপন্যাসিক। দ্বিতীয় মেয়াদে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-শুয়ে এ-যুগের অর্জুন তার 888sport sign up bonusকথাকে পূর্ণতা দেয়। অর্ধচেতন অবস্থাতেও এক উদার বিশ্বমানবিক উচ্চতায় পৌঁছে অর্জুন 888sport sign up bonus পুনর্গঠন করে জানিয়ে দেয় তার প্রত্যাশা ও প্রত্যয়। বলে সে :
…দিব্যর ওপর আমার রাগ নেই, কিন্তু ও কেন দেয়ালের ওপাশে দাঁড়াতে গেল? ও যদি আমাদের সঙ্গে দেয়ালের এপাশে থাকতো তাহলে আমাদের লড়াই-ই হতো না… আমি ক্ষমা চাইছি। দিব্য, কেওয়ল সিং – আমি তোমাদের কাছেও ক্ষমা চাইছি। আমি মানুষকে মারতে চাই না।… হারানদা, আপনার হাত ভাঙলো কি করে?… ট্যাক্সি অ্যাকসিডেন্টে আপনার হাত ভাঙলো – অথচ আপনি যদি আমাদের সঙ্গে আসতেন, আজ আপনার হাত ভাঙলেও আপনি দুঃখ পেতেন না, আনন্দই পেতেন। আপনি কি ভাবছেন আমি অনুতাপ করছি? মোটেই না – আমি আবার যদি কখনো ঐ অবস্থায় পড়ি, আমি আবার ঐভাবে এগিয়ে যাবো। …ছেলেবেলা থেকে মৃত্যু অনেকবার আমার কাছে এসেছিল। দেশ ছাড়ার সময় দুঃসহ যাত্রাপথে যে-কোনো সময়ই তো মরে যেতে পারতাম। খুলনায় দুটো লোক যখন মা-কে ধরেছিল, কিংবা বনগাঁ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আমারই বয়সী ক’টা ছেলে তো কলেরায় পটাপট মরে গেল – কলোনিতে এসেও…। এই দু’বার ওরা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিছুতেই পারবে না। কোনোদিন পারবে না। আমি বেঁচে থাকবো। আমি ঠিক বেঁচে থাকবো।
আর এভাবেই ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহাভারতের মিথিক্যাল অর্জুনের প্রতিরূপক চরিত্র রূপে সৃজন করে ফেলেন আধুনিক জীবনকথার অর্জুনকে। নবযুগের নবার্জুন এক অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্নকে সাংকেতিক করে তোলে। বাঙালিকে ঘিরেই ওই স্বপ্ন।  অর্জুন 888sport alternative linkে ঔপন্যাসিক দেশভাগ ও দেশত্যাগের নির্মম বাস্তবতার পটে ওই স্বপ্নকথাকেই প্রচ্ছন্ন মিথের আশ্রয়ে প্রতিরূপক তাৎপর্য দান করেছেন।