মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস সহজ নয়। মৃত্যু একটা অপার্থিব অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা প্রত্যহ ঘটে না। এই অভিজ্ঞতার বাস্তবতা যত বেশি এড়িয়ে থাকা যায়, তত জীবনযাপন স্বাভাবিক থাকে।
বিকেলে ঘুরে বেড়ানো আমার নেশা। ভালোই লাগে গাছপালার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। একদিন আমি বেড়িয়ে ফিরেছি। আকাশ কালো হয়ে উঠেছে। হয়তো তুষার পড়বে। আমার গন্তব্যে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে শুনি, আমার ফ্ল্যাটের পাশের বাসিন্দা, রৌপ্যকেশ বৃদ্ধা, আমাকে ডাকছেন। বৃদ্ধা, তার স্বামী, আর কেউ সঙ্গে থাকে না। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা, দুজনই হাসিখুশি, ভালোমানুষ।
আমি সংকুচিত পায়ে তাদের ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়ালাম।
আমি বললাম, কী হয়েছে?
বৃদ্ধা বললেন, ও মারা গেছে।
আমার জিবে একটা কথা এসেছে। কথাটা গিলে ফেলে বললাম, আমার করার কিছু নেই। আমি কন্ডোর পরিচালকদের খবর দিই।
বৃদ্ধা আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। খুব সম্ভব অবাক হলেন। খুব সম্ভব ভাবনাটা তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
বৃদ্ধা ফের বলতে থাকলেন, তুমি হয়তো জানো না, এই গ্রামটার আদি বাসিন্দা আমরা। এখন তো এটি আর গ্রাম নয়। এটা এখন শহর, টরন্টোর একটা অংশ। ওর শরীর আমার সামনে থেকে সরিয়ে ফেলবে। আমার গ্রাম আমি যেমন খুঁজে পাই না, তেমনি ওর শরীর আমি আর খুঁজে পাব না। ওর শরীর যদি সরিয়ে নাও, তাহলে সামনের পাহাড়টিও সরাতে হবে। গাছপালাগুলো সরাতে হবে। এক একটা গাছ আমার ছেলেমেয়ের নামে লাগিয়েছিলাম। ছেলেমেয়েগুলো মরে গেছে। শুধু গাছপালা টিকে আছে। ওদের সঙ্গে আর আমার বৃদ্ধ মানুষটির সঙ্গে কথা বলে আমার দিন কাটত। তুমি শরীর সরাবে বলেছ। তার মানে তুমি বোঝ? বোঝ না। দুজনের মধ্যে একজন চলে গেলে কী হয়। সেই হওয়াটার মধ্যে বসবাস করা যায় না। কুড়ি বছর যার সঙ্গে থেকেছি সে চলে গেলে কী থাকে। তুমি কথা দিতে পারো? এই কথাটাই পবিত্র। একত্রে বসবাস করার এই হচ্ছে নিঃসঙ্গতার বোধ : তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি এদেশের নও। এদেশের কিংবা যে-দেশের হও, সবাইকে চলে যেতে হয়। শরীর সরালে কি 888sport sign up bonus সরানো যায়। যায় না। যায় না।
হঠাৎ মনে হয় বৃদ্ধার মুখে অজস্র অজস্র ভাঁজ পড়েছে। ভাঁজপড়া মুখ পানিতে ভিজে যাচ্ছে।
আমার ইচ্ছা করছিল বৃদ্ধার মুখ মুছে দিতে। সাহসে কুলোল না। আমি কোনো কথা না বলে নিজের ফ্ল্যাটে আসি। পরিচালকদের টেলিফোন করে বৃদ্ধ মানুষের মরে যাওয়ার কথা শোনাই। মরে যাওয়ার মতো অসহায়বোধ আর কিছুতে নেই। পাশের কন্ডোতে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে চলে যাই। আমার পক্ষে এই ফ্ল্যাটে থাকা সম্ভব নয়। মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস সহজ না।
দুই
আমি এবং আমার দুজন বন্ধু 888sport apps থেকে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে পৌঁছেছি। আমরা বাঙালিপাড়ায় একটি ঘরভাড়া করে থাকি। আমাদের মতো আরো অসংখ্য বাঙালি এই পাড়ার বাসিন্দা। যে কাজ পাই তাতেই আমরা খুশি। আমরা এখানে এসেছি টাকা রোজগার করতে, দেশে টাকা পাঠাতে, ফেলে আসা মা-বাবা, ভাই-বোনদের স্বস্তিতে জীবনধারণের ব্যবস্থা করতে।
এখানে কাজ পেয়েছি এক জার্মান-লিথুনিয়ান কন্ট্রাকটরের গ্যাংয়ে। রাস্তা বড় করার কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজের মধ্যে ডুবে থাকি। গ্যাংয়ে অন্য দেশের অন্য ভাষাভাষী লোকজন আছে। এভাবে আমাদের ইংরেজি শেখা হয়, কাজ চালানো ইংরেজিতে আমরা দক্ষ হয়ে যাই।
চারপাশে ভবন উঠছে। রাস্তা বড় হচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে বুঝি : স্টরমন্ট, গ্লেনগেরি এবং ডান্ডি কাউন্টিগুলো রাস্তা বড় করার নামে, নতুন নতুন ভবন তৈরির নামে গ্রামগুলো লুট করা হচ্ছে, গ্রামগুলো থেকে ভবন নির্মাণের মালমসলা লুট হয়ে যাচ্ছে : আর এই লুটের একজন আমি, আমার গ্যাং লুট করে চলেছে, বাদবাকিটা বুলডোজারের হাতে। লুটের ভাগ আমি পাই না, আমি কেবল লুট করার ব্যাপারে সাহায্য করছি। একসময় পশ্চিমারা আমাদের দেশটাকে লুট করেছে। এখন দেখছি পশ্চিমারা নিজেদের দেশকেও লুট করছে। লুট লুট, চক্রাকারে লুট হচ্ছে পৃথিবী। আমি ইতিহাসের ছাত্র। ইতিহাস আমাদের কাজ জুটিয়ে দিতে পারেনি। আমি ও আমার দুই বন্ধু এবং একজন বান্ধবী ইতিহাস থেকে হতাশা শিখেছি। সেই হতাশার নিরসনে আমার বান্ধবীটি একদিন কুয়ালালামপুরে চাকরি পেয়ে চলে যায়। আর আমি, আমার বন্ধুটি ভাসতে ভাসতে এখানে চলে আসি।
ইতিহাস কী শেখায়? জানি না।
একদিন বান্ধবীর চিঠি পাই। কুয়ালালামপুরের একজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। আমার এখানকার বন্ধুটি প্রায় আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছোটখাটো একটি ফ্ল্যাট কেনার। আর আমি? কিছুই করছি না। আমি ইতিহাসের কথা ভাবি। ইতিহাসের কথা ভাবি।
তিন
আমি বন্ধুটির কথা ভাবি, ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে যাই। একা থাকতে ভালো লাগছে না। আমি কি এই বাড়িটা ছেড়ে দেব?
এখন যেখানে আমরা রাস্তা বানাবার কাজ করি সেখানে, কাছের হেব্রাইডিস নদী শুকিয়ে গেছে। নদীটা একটা হ্রদ বানিয়ে, চিলটার্ন পাহাড়টার ভেতর লুকিয়েছে।
আমি পাহাড়টার গন্ধ, নদীটির গন্ধ, বিচ গাছগুলোর গন্ধ ফুসফুসে ভরে নিয়ে বাংলাপাড়ায় আসার জন্য বাস ধরি।
বাড়িতে আমার কাজের অন্ত নেই। বড় কাজ রান্না করা। বাংলাপাড়ার অধিকাংশ, যারা আমার মতো, তাদের প্রিয় খাবার আফগানি কাবাব। আমার খুব পছন্দের না; আমার পছন্দের ডাল-ভাত, আর একটা সবজি; আমাকে তরতাজা রাখে। আমি টের পাই আমার অভিজ্ঞতার গরিবি হাল। এই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি কতদূরে পৌঁছব। প্রায় মধ্যরাত হয়ে যায় আমার খাওয়া-দাওয়া সারতে। বাংলাপাড়ায় অফুরান গাছ। মেপলের পাতা বাতাসে উড়ে উড়ে ফেরে।
আমি চাঁদের আলো ও রাস্তার বাতির জন্য জানালা খুলে দিই। আমি কতদূর 888sport appsের কথা ভাবি। আমি কতদূর কুয়ালালামপুরের কথা ভাবি। আমাকে ঘিরে আছে 888sport app এবং টরন্টো। আমি টরন্টোর কথা ভাবি এবং 888sport appর কথা ভাবি। কোনো শহরই আমার না। কিংবা দুটি শহর আমার, এখানেই আমার জীবনযাপন। এই দুই শহরের বাইরে আমার কোনো জগৎ নেই।
ভোর হয়ে আসছে; জোছনা শেষবারের মতো গাছের ডালপালা ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমি 888sport appর রাস্তায় হাঁটতে থাকি টরন্টোর রাস্তা দিয়ে।
চার
আমার আগের কন্ডোর প্রতিবেশী সেই রৌপ্যকেশ বৃদ্ধার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। আমি বিব্রত না হয়ে মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
মহিলাটি হেসে বলেন, কেমন আছ।
ভালোই।
তুমি কন্ডোটা ছেড়ে ভালোই করেছ।
আমি আস্তে আস্তে বলি, আমার অন্য কোনো উপায় ছিল না।
মহিলাটি বলেন, লজ্জার কিছু নেই। আমি হলে তা-ই করতাম।
আমি চুপ করে থাকি।
মহিলাটি ফের বলেন, মৃত্যু কত কিছু মনে পড়ায়। আবার সবকিছু ঢেকে দেয়।
আমি বৃদ্ধার কথা মনে ভরে নিয়ে নিজের কন্ডোতে ফিরে যাই।
পাঁচ
ভোর হওয়ার আগে আমার ঘুম ভাঙে। চারপাশে স্তব্ধতা, স্তব্ধতা বিস্ফোরিত হতে থাকে একটা দুটো গাড়ির শব্দে। আমার মনে হয়, আমার পাশে আর কেউ শুয়ে আছে। আমার মা, কুয়ালালামপুরের বান্ধবী কিংবা আমার কোনো ছেলেপুলে। গাছের পাতাদের বোবায় পেয়েছে, স্তব্ধতা ভারী, পুরু, কবরের মতো, সব শব্দ পৃথিবী থেকে উধাও।
আমি নিজে জানি না আমি কী ভাবছি। শুধু বুঝি আমার ভাবনার গভীরতা, সেই গভীরতা আমার চোখে পানি এনেছে। নিজের কাঁদন আমাকে নাড়া দেয় না, এই কাঁদন আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমি বুঝি, জোর করার কোনো অধিকার আমার নেই।
আমি চুপচাপ বসে থাকি।
আমি সবকিছু দেব নিজের হৃৎপিন্ডের আওয়াজ শোনার জন্য।
ছয়
ইতিহাসের সঙ্গে 888sport free betর কোথাও একটা যোগ আছে। টরন্টো যেভাবে বড় হচ্ছে, 888sport appও একইভাবে বড় হচ্ছে।
টরন্টোর চারপাশ থেকে কিংবা 888sport appর চারপাশ থেকে বিশ হাজার একর জমি থেকে মানুষজনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। দুশো পঁচিশটা ফার্ম উধাও হয়েছে। 888sport appতেও একই প্রক্রিয়া। পাঁচশো একত্রিশটা বাড়ি সরানো হয়েছে। যেসব বাড়িঘর রয়ে গেছে সেসব বিস্ফোরিত হয়েছে কিংবা বুলডোজারের শিকার হয়েছে। 888sport app শহর বড় করতে গিয়ে কতসংখ্যক বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছে।
আমি নিজেকে জিগ্গেস করতে গিয়ে লজ্জা পাই।
বদলে যাওয়ার ইতিহাসের মধ্যে আছে ন’টা স্কুল, চৌদ্দটা চার্চ এবং চারটা শপিং সেন্টার। বদলে যাওয়ার ইতিহাসে আরো আছে আঠারোটা গোরস্তান, পনেরোটা ঐতিহাসিক স্থান, হাইওয়ে ও রেলওয়ে লাইন।
আমি 888sport appর বদলের কথা ভাবি। পুরনো, ভগ্নদশা মসজিদগুলোতে ভাঙন ধরেছে। গোরস্তানগুলির ইতিহাস মানুষ ভুলতে বসেছে। সবটাই কবরের মাটি হয়ে গেছে। প্রতিটি মসজিদে শেষবারের মতো নামাজ পড়া হচ্ছে। ইতিহাস পাল্লা দিতে পারছে না। হেরে যাচ্ছে পুরনো কাল নতুন কালের সঙ্গে।
888sport appর বিভিন্ন এলাকায় আমি ঘুরে বেড়াই। আমি তাদের সঙ্গে ঘুরি যারা বাড়িঘর হারিয়েছে। আর কয়েক বছরের মধ্যে মনে হয় ল্যান্ডস্পেস হারাবে। সবাই চুপচাপ ঘুরে বেড়ায়।
সাত
আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমার বর্তমান জীবিকার সঙ্গে ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু ইতিহাসের বই আমাকে টানে। টরন্টোর পুরনো বইয়ের দোকানে একটা অদ্ভুত বইয়ের খোঁজ পাই। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই দোকানটি। আমি কখনো কখনো ছুটির দিনে, বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে ক্লান্ত হলে, এই লেবানিজ রেস্টুরেন্টে খেতে আসি। প্রায়ই আসি বলে দোকানের, খুব সম্ভব মালিকের মেয়ের সঙ্গে আমার এক ধরনের ভাব হয়।
তোমাকে দেখে কানাডিয়ান মনে হয় না।
আমি তো কানাডিয়ান নই।
তাহলে?
আমি এশিয়ান।
আমিও।
তোমার টরন্টো ভালো লাগে না?
না। আমার স্বপ্নের শহর বৈরুট।
আমার 888sport app।
বইয়ের দোকানে একদিন হঠাৎ এক অদ্ভুত বইয়ের খোঁজ পাই। বইটার নাম মাটি শুদ্ধ করার ইতিহাস। বইটি কিনে আমার প্রিয় লেবানিজ রেস্টুরেন্টে খেতে আসি। সামিনা আমাকে দেখেই এগিয়ে আসে।
খাবে?
হ্যাঁ।
একই জিনিস।
হ্যাঁ।
সবসময় একই জিনিস খেতে ভালো লাগে।
পছন্দ একটা নির্দিষ্ট থাকলে ভালো।
যেমন।
তুমি।
মানে।
তোমাকে দেখে তো আমার ক্লান্তি লাগে না।
তুমি কি আমাকে তোমার শহরে নিয়ে যাবে?
কোথায়? 888sport appয়।
যাব। 888sport appর কথা শুনতে শুনতে আমার বৈরুটের কথা মনে পড়ে যায়। যদি কখনো 888sport appয় ফিরে যাই, তোমাকে নিয়ে যাব।
সামিনা।
মা ডাকছে।
কথাটা ভুলে যেও না।
আমি বইটার পাতা উলটাতে উলটাতে খেতে থাকি। কি অদ্ভুত বইয়ের নাম : মাটি শুদ্ধ করার ইতিহাস। শুধু রক্ত বৈধ করলে চলবে না। মাটিকেও। জার্মানদের দেশে থেকে যারা জার্মান না, তাদের বের করে দিতে হবে।
হঠাৎ আমার 888sport appর কথা মনে হয়। একটা রাজনৈতিক দল, জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন নামে, একটা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেমন যারা মুসলমান না, তাদের খুন করা হচ্ছে। মুসলমানদের দেশে শুধু মুসলমান থাকবে। যারা তা মানবে না, তাদের খুন করা বৈধ। যেমন 888sport appয় শুরু হয়েছে : হিন্দুদের মেরে ফেলার কলাকৌশল। অন্য ধর্মের জায়গা নেই। অন্য জাতির জায়গা নেই। এক ধর্ম এক জাতি এক ঈশ্বর।
এই খুনোখুনির দেশে আমি কী করে সামিনাকে নিয়ে যাব?
চোখভরা পানি নিয়ে আমি দূরের দিকে চেয়ে থাকি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.