কাজী গোলাম নাসির
এক
তখন কতই বা বয়স, ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুল ছুটির কোনো একদিনে দুপুরের দিকে আমি যখন সাইকেলের টিউব কাটা এক জোড়া নতুন রাবারের ফিতা জোগাড় করে গুলতিবাসটি নতুন করে বাঁধছি তখন একজন আমাদের বাসায় এলেন। খুব শুকনো একজন, ভালো বাংলায় যাকে বলে শালপ্রাংশু দেহ, মুখে একটু দাড়ি, আমাদের বারান্দায় উঠে হাতের ছাতা বন্ধ করে নিজের নাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বাবা আছেন কি না।
ভরদুপুর, বাবা তখন হয়ত একটু বিশ্রামে বা দিবানিদ্রায়, তাঁকে ওঠাব চিন্তায় হয়ত একটু বিরক্ত হলাম কিন্তু মুখে প্রকাশ না করে বললাম, ‘আসুন, আপনি বসুন, আমি দেখছি।’ বাবার ঘুম ভাঙানোর একটি পদ্ধতি ছিল, মুখে তাঁকে ডাকতে হতো না, কপালে আলতো হাত দিলেই জেগে উঠতেন। আমি জানালাম – একজন দেখা করতে এসেছেন, আরজ আলী মাতুববর তাঁর নাম। বাবা বললেন, ‘ওপরে আসতে বলো।’
আমরা তখন বরিশালে কলেজপাড়া নামক মহল্লায় বেশ সুন্দর একটি ডুপেস্নক্স বাড়িতে থাকি। চারদিকে গাছগাছালি, তার মাঝে একটি দোতলা বাড়ি। একতলার ছাদে লোহার পাতের ওপর ইট বসিয়ে ফ্লোর, দোতলার ওপর টিনের ছাউনি। আমরা নিচতলা থেকে একটি সিঁড়ি দিয়ে প্রথমে দোতলার একটি বারান্দায় আসি তারপর আবার ফুট-তিনেক সিঁড়িতে উঠে দুটি বেডরুম। এখনকার স্পিস্নট লেভেলের মতো, ওপরের দুই বেডরুমের মাঝে আবার অন্তর্বর্তী সংযোগ-দরজাও ছিল।
আমি ভাবলাম, এই লোকটি কে, যাঁর অবাধ প্রবেশ অনুমতি মিলল দোতলায় ওঠার, আমার বাবার ঘরে, যাঁকে আমি যমের মতো ভয় করি আর এই অচেনা লোকটির আগমনে বাবা ঘুম বাদ দিয়ে দেন। আমি তখন অনুভবও করতে পারিনি এদেশের নতুন একটি অধ্যায়ের নায়ককে আমার ছেলেবেলায় আমি সেদিন প্রথম চোখে দেখলাম এবং পরবর্তীকালে প্রায়শই দেখে যাব।
দুই
মাতুববর সাহেব ওইদিন বের হলেন সন্ধ্যায়। বিকেলে বাবা ওপরে বসেই চা খেতেন, ওইদিন কয়েকবার কয়েক কাপ চা গেল ওপরে। ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চাইলে মা বললেন, তিনি তোমার নানা এবং দাদা উভয়েরই বন্ধু তোমার বাবার কাছে এসেছেন একটি বই লিখেছেন তাই নিয়ে কথা বলতে। মায়ের বাবা অর্থাৎ আমার নানা, মায়ের বিয়ের সময়কালে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, আমার দাদা নিজ গ্রামের স্কুলশিক্ষক, হরিহর-আত্মা দুই বন্ধু, ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে তাঁদের বন্ধুত্ব অটুট করেছিলেন।
মাতুববর সাহেব সম্পর্কে পরে আরো শুনলাম মায়ের কাছে, তিনি নাকি খুব ভালো বাবুর্চি এবং বিয়েবাড়ির মঞ্চ সাজাতে পারেন, নিজে নিজে অনেক যন্ত্র বানান, পড়াশোনা যা করেন নিজে নিজেই, স্কুলের গণ্ডিও পার হতে পারেননি তিনি। মাতুববর সাহেব আরো কিছু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। নিজে বাঁশি বানিয়ে তাতে সুর তুলতেন, বানাতেন ঢোল, খোল, তবলা। নিজে গান রচনা করে সঙ্গী-সাথি নিয়ে গাইতেন। একটি সময়কালে তিনি আরজ বয়াতি নামেও পরিচিতি পেয়েছিলেন।
জমিজমা মাপার কাজ খুব ভালো জানতেন মাতুববর সাহেব। প্রাচীন আমলের সেই চেইন সার্ভেয়ার, যা আজকের ডিজিটাল সার্ভের যুগে হারানোর পথে। আমার দাদাও জমি মাপতে পারতেন, দাদার সঙ্গে পিতলের তৈরি চেইন ধরে আমিও জমি মাপতে সহায়তা করেছি বেশ কয়েকবার, খুব কষ্টের কাজ, হিসাবের অঙ্কও খুব জটিল। যদিও তখনো জানতাম না, আমার জীবনের সঙ্গে জমির মাপের অঙ্ক ওতপ্রোতভাবে একসময় জড়িয়ে যাবে। জমিজমা নিয়ে বরিশালে প্রায়ই খুনোখুনি হতো, মাতুববর সাহেবের বিষয়ে গ্রামবাসীর এতটা আস্থা ছিল যে তাঁরা বলতেন, তিনি হাত না দিলে একশ খুন বাঁচে না।
পরবর্তীকালে তিনি ঘনঘন আসতেন, বাবার কাছ থেকে নেওয়া দর্শনের বইগুলো ফেরত দিতেন। বাবা কলেজ লাইব্রেরি থেকে তাঁর জন্য নতুন বই এনে রাখতেন, মাতুববর সাহেব ওই বই নিয়ে বাড়ি যেতেন, পড়াশোনাশেষে আবার ফেরত দিয়ে যেতেন। আমরা অবাকবিস্ময়ে দেখতাম আমার বাবাকে, তাঁর বাবার বন্ধুর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে আর আমার দাদার বন্ধু লোকটি তাঁর বন্ধুপুত্রের কথাগুলো গোগ্রাসে গিলছেন এবং মাঝে মাঝে সম্পূরক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। কী অদ্ভুত একটি সম্পর্ক, কী অভাবনীয় একটি সময়কাল।
তিন
বরিশাল শহর থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন। সেখানকার ছোট্ট একটি গ্রাম লামচরী, সেখানেই বাংলা ১৩০৭ সনের ৩ পৌষ আরজ আলী মাতুববরের জন্ম। মাত্র চার বছর বয়সে ১৩১১ সনে বাবার মৃত্যু, অভাবী সংসারের দেনার দায়ে তাঁদের বসতবাড়িটিও নিলাম হয়ে যায় একসময়, তারপর ভেসে চলে মা এবং ছোট বোনকে নিয়ে তাঁর অভাবের সংসার।
তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন অনেক পরে, তেরো বছর বয়সে, অবৈতনিকভাবে ভর্তি হয়েছিলেন একটি মক্তবে, সেটিও এক বছর পর ছাত্র-বেতন অনাদায়ে বন্ধ হয়ে যায়। আরজ আলী মাতুববরের ফরমাল পড়াশোনার এখানেই সমাপ্তি। এই এক বছরে তিনি বাল্যশিক্ষা পড়েন, তালপাতায় লেখা শেখেন এবং পড়াশোনা করার ইচ্ছার বীজটি এখানেই বপন করেন। অভাবের সংসারে একসময় কৃষিকাজ শুরু করেন, সঙ্গে তিনি শিখে নেন জমি মাপার কাজকর্ম। কিন্তু জ্ঞানের আহরণে তাঁর নিজ চেষ্টায় পড়াশোনা চলতে থাকে, উৎস হয় তখন বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে অন্যের নামে ইস্যু করিয়ে নেওয়া বই। তাঁর ভাষায় জ্ঞানের ‘চুরিবিদ্যা’।
১৩৩৯ সনে মাতুববর সাহেবের বয়স যখন ৩২ বছর, তখন তাঁর মা মারা যান। একজন মায়ের প্রতি আবেগ আর ভালোবাসা থেকেই মৃত মায়ের ছবি তোলান তিনি। মৃত মায়ের ছবি তোলার অপরাধে যাঁরা জানাজা পড়তে এসেছিলেন, তাঁরা জানাজা না পড়ে দাফনে আপত্তি জানিয়ে চলে যান। মায়ের মৃত্যুর সেই আঘাতের ফলে তিনি নিজের মতো করে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, কোনটি সত্য জানার জন্য – ধর্মের নামে কিছু মানুষের অধার্মিক কুসংস্কার, নাকি 888sport apkলব্ধ অর্জিত জ্ঞান? এই নিয়েই আরো গভীরভাবে তাঁর পড়াশোনা শুরু এবং এই বন্ধুপুত্রের সঙ্গে অর্থাৎ আমার বাবার সঙ্গে সখ্য বেশ গভীর হওয়ার সূচনাকাল। পরবর্তীকালে মাতুববর সাহেবের সখ্য এদেশের অনেক জ্ঞানী ও গুণীজনের সঙ্গে হয়েছিল, প্রসঙ্গক্রমে তাঁদের নাম এখানে আসবে।
আমার বাবা কাজী গোলাম কাদির, পরবর্তীকালে বরিশাল শহরে যিনি কে.জি.কে স্যার নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তাঁর শৈশবের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায়। উচ্চমাধ্যমিকে এসে পড়াশোনা করেন বিএম কলেজে। এখানেই স্নাতক সম্মানে পড়াশোনাশেষে দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স করার জন্য কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ছাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে এমএ পাশ করে ফিরে এসে বরিশালের চাখার কলেজে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বরিশালের অখ্যাত একটি গ্রাম সাপানিয়া থেকে কলকাতা যাচ্ছে একজন দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করতে, যাঁর শুরু মাদ্রাসা থেকে, ভাবতেই অবাক লাগে আমার। তাই বাবা যেদিন এমএ পাশ করে গ্রামে ফিরে আসেন, গ্রামের প্রথম এমএ পাশ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে দেখতে সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিল। মাতুববর সাহেবের কথা বলতে হলে আমার প্রয়াত বাবাসহ বেশকিছু মানুষের নাম ও কথা প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে যায়।
১৯৪৮ সালের দিকে বিএম কলেজে দর্শনের শিক্ষকের একটি পদ খালি হয়। ওই সময় বিএম কলেজের অধ্যক্ষ নীলরতন মুখার্জি বাবার প্রতি ভালোবাসায় তাঁকে ওই কলেজে চাকরিতে নিয়োগ করেন। তখন তাঁর কন্যা এবং জামাতাও একই পদে প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা কলকাতার নানান জায়গায় চাকরির দরখাসত্ম করায় নীলরতন মুখার্জি তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। ওইদিন অধ্যক্ষ নীলরতন মুখার্জি সম্ভবত বিএম কলেজের ভবিষ্যতের জন্য নিজের অজামেত্মই একটি বীজ বপন করেছিলেন, যা পরে মহীরুহ হয়ে এসে ধরা দিয়েছিল সকলের কাছে।
চার
বাসায় মাতুববর সাহেবের আসা বেড়ে চলল। বিশেষত ছুটির দিন হলেই জানতাম তিনি আসবেন, বাবার সঙ্গে বসবেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলবেন, কিছু প্রশ্ন করবেন, বাবার উত্তরে তুষ্ট না হলে তার সম্পূরক প্রশ্নের মাত্রা ক্রমে বাড়বে। আমরা তখন মানসিকভাবে অভ্যসত্ম হয়ে গিয়েছি, নানা এবং দাদার বন্ধুকে, মাতুববর সাহেবকে বাবার বন্ধু হিসেবে, ঘরের লোক হিসেবে মেনে নিয়েছি। বাবার সঙ্গে কথার সঙ্গে কিছু লেখার আনাগোনা শুরু হলো।
মাতুববর সাহেব নিয়মিত আসেন, তাঁর নিজের পড়াশোনার ফসল হিসেবে নিজের লেখাগুলো নিয়ে আসেন, বাবার কাছে রেখে যান, বাবা মনোযোগ দিয়ে পড়েন এবং পরবর্তী ছুটির দিনের জন্য একটি কথাযুদ্ধের প্রস্ত্ততি শুরু হয়। কথাযুদ্ধ বিষয়ে বাবার বন্ধু বিএম কলেজের বাংলার শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল হকের কথা ছিল এরকম, ‘… এ যেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কামারশালায় তৈরি সূক্ষ্ম এবং ধারালো তলোয়ার বনাম গ্রামের আনাড়ি কামারশালায় তৈরি ভারী লোহার তলোয়ারে দর্শন, 888sport apk, ধর্ম ও সংস্কার নিয়ে তলোয়ারে তলোয়ারে অনবদ্য ঘর্ষণ।’ শামসুল হক বাংলার শিক্ষক, তিনি ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে রাজশাহী থেকে বিএম কলেজে বদলি হয়ে এসেছিলেন। কলেজ ক্লাবে আনাগোনার জন্য তাঁর সঙ্গে বাবার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বিধাতার অমোঘ নির্দেশে আরজ আলী মাতুববরের সঙ্গে সময়ের তালে ক্রমান্বয়ে তিনি জড়িয়ে যান।
বিএম কলেজের দুটি অংশ, নতুন অংশ আর পুরনো অংশ। পুরনো অংশে অতি সুন্দর একটি দ্বিতল ভবন, যার দক্ষিণ দিকে বিশাল একটি ফুটবল খেলার মাঠ, তারপরে ছাত্রদের হোস্টেল আর দক্ষিণ দিকে দুটি টেনিস কোর্ট, একটি হার্ড অন্যটি সফট, আর একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। ওই বাগানে প্রখ্যাত নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার লাগানো একটি নাগলিঙ্গম গাছ ছিল। দ্বিজেন শর্মা আমার বাবার সহকর্মী ছিলেন এবং কলেজের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি তাঁর উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল।
দ্বিতল ভবনটি অনিন্দ্যসুন্দর, সামনের বারান্দায় প্রবেশ করে দুদিকে দুটি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা, সেখানেই শিক্ষকদের ক্লাব। সেই কক্ষে একটি ইজি চেয়ার, যেখানে জীবনানন্দ দাশ একসময় বসতেন। শামসুল হক এক বিকেলে টেনিস খেলে এসে ওই চেয়ারে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন; সেই সময়কালে আমার বাবা আরজ আলী মাতুববরের লেখার পাণ্ডুলিপি শামসুল হকের হাতে তুলে দেন, বলেন, ‘লেখাটি পড়ুন এবং মতামত জানাবেন; কিন্তু অন্য কাউকে লেখাটি দেখাবেন না।’
শামসুল
হক কাগজের পোঁটলা হাতে নিলেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘কুসংস্কার ও তার স্বরূপ’। তিনি
ওখানে বসেই লেখাটি পড়তে শুরু
করেন। শামসুল হকের ভাষ্যমতে, তিনি একটু অভক্তি নিয়ে পড়া শুরু করলেও মাত্র বত্রিশ পৃষ্ঠার একটি পাণ্ডুলিপির প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা তাঁর সমগ্র সত্তার ভিত্তিমূল
নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি উত্তেজনায় অভিভূত হয়ে লেখাটি বাসায় নিয়ে চলে যেতে চান।
বাবাকে তিনি বলেন, ‘আপনার ছদ্মনামে লেখাটির শুরু পড়েই ভেতরে ওলটপালট হয়েছে স্যার, রাতে পুরোটা পড়ে
আপনাকে কাল মতামত দেব।’ বাবা একটু হাসলেন, ‘বললেন আমার লেখা নয়, লিখেছেন আরজ আলী
মাতুববর নামে একজন। লেখক পেশায়
কৃষক, বয়স প্রায় পঁয়ষট্টির ওপর, স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা করেননি কিন্তু নিজ
চেষ্টায় প্রায় বিদ্যাসাগর।’
পাঁচ
শামসুল হক বাবার কাছে আরজ আলী মাতুববরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে শামসুল হক বরিশালে আসার প্রায় মাস দেড়েক পর একদিন দুপুরে বিএম কলেজ প্রাঙ্গণে মাতুববর সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। মাতুববর সাহেব সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা এরকম, ‘… আমি ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে সত্মব্ধ হয়ে গেলাম, হৃদয়ভেদী চাহনি, গায়ের রং কাজী সাহেবের বিপরীত, শালপ্রাংশু দেহ, কোথাও কোনো রকম মেদবাহুল্য নেই, চেহারার মধ্যে একটি প্রকৃতিদত্ত মসৃণতা, ঠিক তাঁর লেখার মতোই বাহুল্যবর্জিত।’ পরিচয়পর্ব শেষে বাবা শামসুল হককে বলেছিলেন, ‘মাতুববর সাহেবের শত্রম্নর অভাব নেই, হাজতখাটা একজন মানুষ, পরিচয় গোপন রাখবেন। তাঁর লেখা পড়বেন, বলার যা কিছু আমাকে আর তাঁকে বলবেন, বাইরের কারো সঙ্গে অনুগ্রহ করে কোনো আলাপ করবেন না।’ তবে শামসুল হক বাবার কথা মানেননি, অনেকের কাছেই মাতুববর সাহেবকে পরিচয় করিয়েছেন, তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পূর্বানুমতি নিয়ে।
তারপর থেকে কথাযুদ্ধে তিনজনের অংশগ্রহণ শুরু হলো, কখনো আবার একজন ঠিক রেখে অন্য আরেকজন পরিবর্তন হতে থাকল, অর্থাৎ কখনো বাবা ও মাতুববর সাহেব, কখনো শামসুল হক এবং মাতুববর সাহেব। এ-যুদ্ধের মাধ্যমে তিনজনের বন্ধুত্ব ক্রমে গভীর থেকে সুগভীর হতে থাকল। পরবর্তীকালে বাবার অনুমতিক্রমে আরো দুজন এখানে যোগ দিলেন, যাঁদের একজন পরে মাতুববর সাহেবের বই প্রকাশনায় খুব বেশি উপকারে এসেছিলেন। এই দুজন হলেন অধ্যাপক মুসা আনসারী এবং অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই। হাই সাহেব খুব ভালো দাবা খেলতেন এবং মৎস্যশিকারের খুব নেশা ছিল। অবশ্য মৎস্যশিকারের নেশা আমার বাবা, চাচা শামসুল হুদা এবং অধ্যাপক শামসুল হকেরও ছিল। আমি নিজেও একই নেশায় আক্রান্ত ছিলাম। 888sport apps প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে পড়াশোনার চাপে ক্রমে বড়শি দিয়ে মৎস্যশিকারের নেশা কেটে গিয়েছিল।
স্বাধীনতাপূর্ব 888sport apps। বরিশাল শহরের আমানতগঞ্জ এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী আজিজ সাহেবের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মেহেদী মৃত্তিকা 888sport apk নিয়ে পড়াশোনা করলেও ওই সময়কালে তাঁর বাবার ব্যবসা দেখার জন্য প্যারিস থেকে উড টেকনোলজিতে ডিপেস্নামা করে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে শামসুল হকের বন্ধুত্ব হলো। আবারো বাবার অনুমতিক্রমে তিনি মাতুববর সাহেবের পরিচিতি আরেকটু বাড়াতে চাইলেন, শর্তসাপেক্ষে বাবাও মত দিলেন। শর্তটি হলো, তাঁর বাবার বন্ধুর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
ততদিনে
মাতুববর সাহেবের দুটি পাণ্ডুলিপি ঘষামাজা করে প্রস্ত্তত কিন্তু প্রকাশের কথা চিন্তায় আনা যাচ্ছে না। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিল সত্যের
সন্ধান বইটি প্রকাশ করা যাবে না এবং মাতুববর সাহেবের মতামত কোনো
সভা-সমিতিতে প্রকাশ করা যাবে না। যদি এ-আদেশ অমান্য করা হয় তাহলে পুনরায়
মাতুববর সাহেবকে ফৌজদারিতে সোপর্দ করা হবে। সে-কারণে এদেশের স্বাধীনতার পূর্বে
তাঁর বইগুলো আলোর মুখ আর দেখতে পারেনি। আপাতত পাঠকদের কাছে মনে হতে পারে আরজ আলী
মাতুববরের লেখক হিসেবে এদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি স্বাধীনতার অনন্য ফসল। কথাটি
ঠিক হলেও সে-পথচলা খুব মসৃণ ছিল না, কারণ দুষ্টজন মারা গেলেও নাকি তার প্রেতাত্মা
কুকর্মের জন্য ঘুরে বেড়ায়। সে-বিষয়ের কথাগুলো পরবর্তীকালে এখানে আসবে এবং সেখানে
আমার চাচা কাজী শামসুল হুদা জড়িয়ে আছেন।
ছয়
শামসুল হক ঊনসত্তরের প্রথম দিকের এক বৈশাখী-দুপুরে মেহেদী সাহেবের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পড়ার জন্য সত্যের সন্ধানের পাণ্ডুলিপি তুলে দিলেন। পরদিন দুপুরে মেহেদী সাহেব তাঁর বাসায় এলেন, বললেন, তিনি লামচরী যেতে চান মাতুববর সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হতে, তাঁর সঙ্গে লেখার বিষয়ে আলাপ করতে। শামসুল হক মেহেদী সাহেবকে নিয়ে গেলেন, আলাপ হলো। লামচরী থেকে কলেজপাড়া, এর মাঝে মাতুববর সাহেবের বিশ্রাম নেওয়ার একটি জায়গা হলো মেহেদী সাহেবের বাসায়। সেখানেই আবার আরেক ধরনের কথাযুদ্ধের শুরু, তবে এবার শ্রোতার শোনার আগ্রহ বেশি। মাতুববর সাহেবের লেখার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিতর্কের সূচনা হতো, তারপর মাতুববর সাহেব বলতেন বাকি দুজনই শ্রোতা।
মাতুববর সাহেব সম্পর্কে মেহেদী সাহেবের ভালোবাসা খুব গভীর ছিল। মেহেদী সাহেবের ভাষ্য ছিল, … মাটির মানুষ এই মাতুববর সাহেব, তিনি এতটাই মাটিকে চিনতেন যে মৃত্তিকা 888sport apkের ছাত্র হয়েও মেহেদী সাহেব তাঁর জ্ঞানের কাছে শিশুসম, তিনি কাঠের ব্যবসায়ী হলেও উদ্ভিদবিদ্যার বহু কিছু আরজ আলী মাতুববরের নখদর্পণে। ওই সময়কালে একদিন মেহেদী সাহেবের গাড়ির সমস্যা নিয়ে মাতুববর সাহেব কিছু মন্তব্য করেছিলেন। কোন জ্ঞানে এই বক্তব্য তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রকাশিত হয় যে, মাতুববর সাহেব একসময়ে জীবিকানির্বাহের জন্য গাড়ি চালনা শিখে ড্রাইভার হতে চেয়েছিলেন এবং এই কারণে মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ বিষয়েও বেশ পড়াশোনা করেছিলেন। 888sport app শহরের শাহবাগ এলাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালের সামনের ‘টিভোলি’ নামক দোকানটির প্রথম মালিক ছিলেন মেহেদী সাহেব এবং একাত্তরের শেষের দিকে পাকবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন।
মাতুববর সাহেবের সৃজনধর্মী মেধার কিছু পরিচয় পাওয়া যায় মাতুববর সাহেবকে নিয়ে লেখক আইয়ুব হোসেনের রচনায়। দেশে যখন স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার, তখন মাতুববর সাহেব তাঁত888sport live chat গড়ার জন্য তাঁত বানিয়ে তাতে কাপড় বোনাও শুরু করেছিলেন। আরো একটি বিষয় উঠে আসে আইয়ুব হোসেনের লেখনীতে। এটা মাতুববর সাহেবের মায়ের মৃত্যুর পূর্বেকার ঘটনা। স্থানীয় জমিদারের বন্ধু, পূর্বাঞ্চলীয় রেলের বড়কর্তার আমন্ত্রণ ছিল জমিদারবাড়িতে। সাহেবের আগমন উপলক্ষে ঘর সাজানোর দায়িত্ব পড়ল মাতুববর সাহেবের ওপর। তিনি ঘর সাজানোর সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের জন্য কেরোসিনচালিত একটি পাখা তৈরি করেন, সুইচ টিপলে পাখা ঘোরে, বাতাস হয়। তা দেখে সাহেব বিস্মিত, তিনি ওইদিন আরজ আলীর খবর জানতে পারেন এবং তাঁকে কলকাতায় নিয়ে প্রযুক্তিবিদ্যা শেখানোর প্রতিশ্রম্নতি দেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে আরজ আলীর কলকাতা গমনের স্বপ্ন ভেঙে যায়। এই ঘটনাও আমার কাছে মনে হয় পূর্বনির্ধারিত, মনে হয় প্রকৃতি মাতুববর সাহেবকে অন্যরূপে দেখতে চেয়েছিল।
স্বাধীনতার উত্তাল বছর একাত্তর। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু এবং দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে মাতুববর সাহেবের চলাচল একটু নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। আমাদের বরিশালের বাসায় তখন 888sport app থেকে পালিয়ে আসা বেশকিছু জনের আশ্রয়। কেউ যেন বুঝতে না পারে, সেজন্য তাঁরা বাইরে বের হন না, গোসল সেরেও ঘরের ভেতর কাপড় শুকানো হয়, একটা চাপা ও গুমোট ভাবের মধ্যে আমাদের বসবাস। একাত্তরের সে-সময়কালে 888sport appর সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার ফরিদউদ্দিন সিদ্দিকী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার বড় ভগ্নিপতি। আপা বরিশালে, ভাইজান (আমাদের বড় ভগ্নিপতিকে আমরা ভাইজান ডাকতাম) একা থাকেন এতিমখানার ভেতরে তাঁর বাসায় এবং ওই এতিমখানার প্রাক্তন কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে 888sport app শহরে অপারেশন করে রাতে ভাইজানের বাসায় আশ্রয় নেন। কোনো একদিন ভাইজানের এক স্কুল সহকর্মীর মাধ্যমে খবরটি পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে চলে যায় এবং ভাইজানকে তারা এক রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। সে অন্য এক অধ্যায়; কিন্তু এখানে এ-আলোচনার কারণ হলো, একাত্তরের ওই সময়কালে ভাইজানের ঘটনা এবং বাসার আশ্রিতজনদের জন্য বাবা মাতুববর সাহেবকে নিয়ন্ত্রিত চলাচলের অনুরোধ করেছিলেন।
সাত
মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই তখন শেষ পর্যায়ে। বরিশাল শহর থেকে কোণঠাসা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আগেই পালাল। ডিসেম্বর এলো মুক্তির বার্তা নিয়ে। অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। নতুন একটি দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিল। স্বাধীন দেশে তিন বন্ধু মিলিত হলেন আবার – বাবা, মাতুববর সাহেব এবং শামসুল হক। শামসুল হক মাতুববর সাহেবকে মেহেদী সাহেবের কথা জানালেন, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে চোখের জলে তার আত্মার শামিত্ম প্রার্থনা করলেন তিনি।
বাহাত্তরের দিকে শামসুল হক স্যার একদিন বাবাকে বললেন, ‘এখন তো স্বাধীন দেশ, দেশের চার নীতি … গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ, এখন তো মাতুববর সাহেবের লেখার ওপর কোনো পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা নেই, চলুন এবার বইটি প্রকাশিত হোক।’ স্বাধীন দেশের জনগণের সঙ্গে মাতুববর সাহেবকে লেখনীর মাধ্যমে পরিচয় করানো হোক। মাতুববর সাহেবের ইচ্ছেও তাই। তাঁর বক্তব্য ছিল, শিশু বৃক্ষটি এতদিনের যত্নে বেশ বড় হয়েছে; কিন্তু তার ফলের রস এখনো কেউই আস্বাদন করতে পারেনি, তাই উদ্যোগ গ্রহণ হতেই পারে।
বাবার বড় ভায়রা, আমার বড় খালু, জববার সাহেব প্রকাশনা ব্যবসায়ী। বরিশালে কালীবাড়ি সড়কে তাঁর আল আমিন প্রেস। খালুর সঙ্গে বাবা ও শামসুল হকের কথা হলো, তিনি মাতুববর সাহেবের বই ছাপাতে রাজি হলেন। এখানে আরো একজন এ-বই প্রকাশনার কথাবার্তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বিএম কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বাকের আলী। মাতুববর সাহেব-প্রদত্ত একশ টাকা অগ্রিম প্রদানের মাধ্যমে সত্যের সন্ধানের পাণ্ডুলিপি গেল খালুর কাছে। বরিশালে তখনো অফসেট প্রেস যায়নি, খালুর তখন ছিল লেটার প্রেস। সেই দাবাড়ু অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই নিজের পকেট থেকে বই ছাপানোয় বেশ আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন।
প্রকাশনার জগৎ তখন ভিন্ন। সিসা দিয়ে তৈরি অক্ষরগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে বাক্য গঠন করে বইয়ের একেকটি পৃষ্ঠা কম্পোজ করতে হতো। বেশ খাটুনির কাজ ছিল এটি। ছোটবেলায় স্কুলে পড়াকালে আমি বরিশালের বিখ্যাত ‘সোনালী সিনেমা’র পাশের রাস্তায় অনিন্দ্যসুন্দর একটি বাড়ি, যার সমুখে ঘাট-বাঁধানো বিশাল একটি পুকুর আর এর চারদিকে রাস্তা, সেই ‘কবির বাগে’ খালার বাসায় বেড়াতে যেতাম দুটি আকর্ষণে। একটি হলো, আমার সমবয়সী খালাতো ভাই মুনিরের একটি খেলনা জিপ ছিল, তাতে বসে পা দিয়ে প্যাডেল করে সারাবাড়ি আমি গাড়ি চালাতে পারতাম; আরেকটি হলো, বাসায় গিয়েই খালুর প্রেসে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। প্রেসে গিয়ে সিসার অক্ষর কম্পোজ করে নিজের মতো কালি মাখিয়ে নিজ নাম ছাপাতে পারতাম। আমার আগ্রহ দেখে মাঝে মাঝে খালু কিংবা খালুর প্রেস ম্যানেজার সিকান্দার দাদা কিছু সিসার অক্ষর আমাকে দিয়ে দিতেন।
বই ছাপার প্রস্ত্ততি শুরু হয়, কম্পোজিটররা কাজ করেন, খালু মাঝে মাঝে নিজেও প্রম্নফ দেখেন, ছাপার কাজ চলে। কিন্তু ছাপার গতি খুব শস্নথ। তাই আরজ আলী মাতুববরের মন উতলা, তাঁর আর দেরি সহ্য হয় না। সময় যায়, ওইদিকে কাগজপত্রের দামও একটু বাড়তির দিকে, প্রেস থেকে তাই মাতুববর সাহেবকে নতুন খরচের একটি হিসাবে ধরিয়ে দেওয়া হলো। মাতুববর সাহেব একটু কষ্ট পেলেও জিনিসপত্রের দামের জন্য খালুর কিছু করার ছিল না। এসব মেনেই ছাপার কাজ এগিয়ে চলল। ছাপার কাজের প্রায় শেষের দিকে বরিশালের এক পিরের কাছ থেকে প্রেসে নির্দেশ এলো, এই বই বের করা যাবে না, ছাপা বন্ধ করতে হবে, যা ছাপা হয়েছে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্রেসের ভেতর ওই পিরের মুরিদ ছিল বলে আমার মনে হয়েছে, তবে তাকে চিহ্নিত করা তখন সম্ভব হয়নি।
স্বাধীনতা-উত্তর 888sport appsে সেই পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ওইদিন নতুন করে জেগে উঠল। তারা গোপনে নিজেদের সংগঠিত করল, যার জের ধরে পরবর্তীকালে আমরা বঙ্গবন্ধুকে খুব অসময়ে হারালাম। পিছিয়ে গেল একটি স্বাধীন দেশের অগ্রযাত্রা। খালু একটু বিচলিত হলেন, প্রেসে হামলার ভয়ে আলাপ-আলোচনা করে ওইদিন রাতেই বইয়ের কম্পোজ কপি কিছু শামসুল হকের বাসায়, কিছু মাতুববর সাহেবের ছেলের বাসায় লুকানো হলো। পরদিন সন্ধ্যায় গোপনে ছাপানো অংশসহ কম্পোজের কপি লঞ্চে করে 888sport appয় পাঠানো হলো।
888sport appর একটি প্রেস, বর্ণমিছিল। প্রেসের মালিক তাজুল ইসলাম সেই দাবাড়ু অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাইয়ের বন্ধু, শামসুল হকের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব। তিনি বইয়ের বাকি অংশ ছেপে বাঁধানোর ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন। রেজা হাই খুব অদ্ভুতভাবে মাতুববর সাহেবকে পছন্দ করেছিলেন। এখানে দুই স্যারের মাতুববর সাহেবের প্রতি 888sport apk download apk latest version আর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটল। মাতুববর সাহেবের লালিত স্বপ্ন এবং পরিশ্রমের ফসল সত্যের সন্ধানের চোদ্দোতম পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী প্রথম সংস্করণ বের হলো বাংলা ১৩৮০ সনের কার্তিক মাসে। অর্থাৎ প্রায় বিশ বছরের মতো সময়কাল ধরে মাতুববর সাহেব তাঁর নিজ পড়াশোনা ও গুণীজনের আলোচনালব্ধ জ্ঞান নিয়ে বহুবার মূল পাণ্ডুলিপি বেশ পরিবর্তন ও পরিমার্জন করেছিলেন।
বই ছাপাশেষে মাতুববর সাহেব বই নিতে 888sport app এলেন, একটি পোটলায় চলিস্নশ কপি বই নিয়ে দুপুরেই লঞ্চে উঠলেন। লঞ্চ ছাড়ার সময়কাল সন্ধ্যা, একটু প্রয়োজনে ঘাটে নেমে পুনরায় লঞ্চে উঠে দেখেন বইয়ের পোটলা চুরি হয়েছে। ওইদিন আর তাঁর ফেরা হলো না, প্রেসে গিয়ে পনেরো কপি বই আবার বাঁধিয়ে সঙ্গে নিয়েই বরিশালে ফিরলেন তিনি। প্রথম গেলেন শামসুল হকের বাসায়। তাঁকে এক কপি বই উপহার দিয়ে দুই বন্ধু এলেন আমাদের বাসায়, বাবার হাতে বইটি তুলে দেওয়ার জন্য। বহু স্বপ্নের সেই দিনটি, অনিন্দ্যসুন্দর একটি দিন, বহু ঘটনার 888sport sign up bonusর সেই দিন, ১৯৭৩ সালের ২ ডিসেম্বর। আবেগে কি বাবার চোখের কোণ একটু ভিজে গিয়েছিল, হৃদয়ের গহিনে কি পস্নাবন এসেছিল তাঁর, এতদিনকার স্বপ্ন তাঁর বাবা কাজী হাতেম আলীর বন্ধু আরজ আলী মাতুববরের প্রচেষ্টা সার্থকতায় রূপ নিতে দেখে। আমার বাবার কাছে এ-প্রশ্নটি করতে সেদিন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যের সন্ধান ছাপা হলেও বইটি বরিশালে প্রকাশ্যে আনা গেল না। কাকে কাকে বইটি দেওয়া হবে পড়ার জন্য – তিন বন্ধুর আবার গোপন আলোচনা শুরু হলো।
আট
চুয়াত্তরের শুরুর দিক মাতুববর সাহেব নিয়মিত বাসায় আসেন, নতুন লেখা
নিয়ে সেই পুরনো দিনের মতোই কথাযুদ্ধ শুরু
হয়। আমি এবং আমার মেজো বোন হাসি (যাকে দিদি ডাকি আমি) বাবার কাছে রেখে যাওয়া
মাতুববর সাহেবের লেখা সেই পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ পাই, বাবাই সে-সুযোগ করে দেন আমাদের
দুই ভাইবোনকে।
সে-সময়ে বরিশালের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয় মাতুববর সাহেবের বই ছাপানো নিয়ে। আল আমিন প্রেসে
খোঁজ চলে, খালু সরাসরি অস্বীকার করেন, বলেন –
নিষেধের পরে তিনি আর ছাপার কাজ শেষ করেননি। আপাতত ওই সময়ে আর কিছু না ঘটলেও হঠাৎ
করে একদল লোক মাতুববর সাহেবকে অনুসরণ শুরু
করে। ওই সময়কালের এক বিকেলে বাবার ছোট ভাই শামসুল হুদা, আমার কাকা, গজগজ করতে করতে
বাসায় ঢুকছেন আর বলছেন, ‘হারামজাদা, তোরা একাত্তরে আমাদের অনেক জ্বালিয়েছিস, আবার
স্বাধীন দেশে নতুন করে মাথা তুলছিস, তোদের আর বাড়তে দেওয়া যাবে না।’ মা, কাকার
মেজাজ দেখে, কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘মাতুববর সাহেবকে পথে একদল জোববাধারী
ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছি তাদের।’
এই ঘটনার পর আরজ আলী মাতুববরের চলাচলে নিরাপত্তার জন্য একজন সঙ্গী ঠিক করা হলো। সে কিছুদিন পরে তার বাবার নির্দেশে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করল। তখন সামগ্রিক বিবেচনায় কমিয়ে দেওয়া হলো মাতুববর সাহেবের শহরে আসা ও অবাধ বিচরণের সময়কাল। ওইদিকে বইয়ের কাজ করার জন্য খালুর প্রেস, আল আমিন প্রেস, বই ছাপানোর বিল পায়, শামসুল হক একদিন গেলেন খালুর সঙ্গে বিল নিয়ে কথা বলতে। খালু বলেছিলেন, ‘এখন বিলের চিন্তা বাদ দিন, একটু সাবধানে থাকার চেষ্টা করুন।’
বরিশাল শহরে শামসুল হকের পূর্বপরিচিত একজন আয়কর আইনজীবী ছিলেন : এমএ নূর। তিনি নূর সাহেবকে অক্লান্ত পাঠক, সংস্কৃতিসেবী, হৃদয়বান ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিনতেন। তখন নূর সাহেবের সহধর্মিণী সাহেদা নূর বিএম কলেজে বাংলা বিভাগে এমএ প্রথম পর্বে শামসুল হকের ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হলেন। শামসুল হক সাহেদা নূরের কাছে একদিন শুনলেন নূর সাহেব বসন্ত আক্রান্ত, সারা দিনরাত মশারির মধ্যে বন্দিজীবন তাঁর। তিনি নূর সাহেবকে দেখতে গেলেন একদিন, অনেক চিন্তাভাবনা করে সঙ্গে নিলেন সদ্য প্রকাশিত সত্যের সন্ধান। নিজের অজামেত্মই শামসুল হক সেদিন মাতুববর সাহেবের দ্বিতীয় বইটির প্রকাশক জোগাড় করে ফেলেছিলেন। সে-কথা পরে আসবে। বইটি দিয়ে শামসুল হকের অনুরোধ ছিল, পড়া শেষ হলে বইটি ফেরত দিতে হবে আর এই মুহূর্তে এ-বইয়ের কথা কাউকে জানানো যাবে না। নূর সাহেব রাজি হলেন এবং অসুস্থ শরীরে সারারাত জেগে বইটি পড়া শেষ করলেন।
পরদিন নূর সাহেবের স্ত্রী, শামসুল হকের ছাত্রীর অনুরোধে তিনি আবার নূর সাহেবের বাসায় গেলেন। নূর সাহেব বইয়ের প্রসঙ্গ তুলে লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলেন। শামসুল হক বাবার কাছে বিষয়টি জানালে বাবা সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একটু বিরক্ত হয়েছিলেন, কারণ নূর সাহেবের বাসায় তখন অনেক লোকের যাতায়াত এবং মাতুববর সাহেবের আসা-যাওয়ার সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। বাবার চিন্তা ছিল, শিক্ষিত লোকজন যখন যুক্তিহীন আচরণ করে তখন তা খুব বিপজ্জনক। অনেক কষ্টে এবং শর্তে অনুমতি মিলল। সবকিছু চিন্তা করে শামসুল হক অনেক ঘুরপথে মাতুববর সাহেবকে নূর সাহেবের বাসায় নিলেন। পরিচয় হলো দুজনের এবং পরবর্তীকালে দুজন কথা বলার মাধ্যমে সমমনা হয়ে খুব কাছাকাছি চলে এলেন। নূর সাহেব সরাসরি মাতুববর সাহেবের পরবর্তী বই প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন। এভাবেই মাতুববর সাহেবের দ্বিতীয় প্রকাশনা সৃষ্টি রহস্য পাঠকের নজরে এলো। প্রকাশনার জন্য নূর সাহেবের অনুদান ছিল দশ হাজার টাকা, ওই সময়কালে এই টাকাতে মিরপুর এলাকায় পাঁচ কাঠা জমি কেনা যেত।
মাতুববর সাহেব অদ্ভুত এক চরিত্রের মানুষ। জীবনে ক্ষুধা ও দারিদ্রে্য কষ্ট করেছেন অনেক; কিন্তু অন্যায় উপার্জনে নিজেকে নষ্ট হতে দেননি। কথা বলতেন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে, যুক্তিতে নত হতেন। প্রতিকূল-বৈরী শত্রম্নর মতোই অসংখ্য অনুকূল বন্ধুও ছিল তাঁর।
নয়
এত বৈরী সময়ের মাঝেও আনন্দ আসে, অনেকটা এরকম যে, রাত যত গভীর হয় সকাল ততই ঘনিয়ে আসে। মাতুববর সাহেবের জীবনেও সেরকম আনন্দের একটি ঘটনা ঘটে। বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ888sport free betয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি 888sport live প্রকাশিত হয়। 888sport liveের নাম ‘আরজ আলী মাতুববরের জীবন জিজ্ঞাসা’। একটি লেখা একজনের জীবনে কতখানি উচ্ছ্বাস আনতে পারে, কতটুকু উদ্দীপ্ত করতে পারে তা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখাটি সেদিন প্রমাণ করেছিল। মাতুববর সাহেব সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন, শামসুল হককে আসার অনুরোধ করেছিলেন এবং দুই বন্ধুর সামনে নিজেই তাঁর সম্পর্কে লেখাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন।
মাতুববর সাহেবের জীবনে পরবর্তী ঘটনা আরো বেশি উদ্দীপনাময়। ১৯৭৫ সালের দিকে একদিন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলামের উদ্যোগে দর্শন ক্লাসে আত্মা ও প্রাণের ওপর একটি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়! আরজ আলী মাতুববরকে মূল বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সম্মতি দেন এবং ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে কথার মাধ্যমে নিজেকে উজাড় করে দেন। সেদিন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ দর্শনের আঙিনায় নতুন একজন দার্শনিককে খুঁজে পায়। এই ড. নুরুল ইসলামই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে মাতুববর সাহেবের বইটি পড়তে দিয়েছিলেন।
সময় গড়িয়ে চলে, বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে নতুন অধ্যাপক আসেন বদলি হয়ে এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন! অন্যদিকে শামসুল হকের পদোন্নতি হয় না কোনো এক অদ্ভুত নিয়মে। তিনি পদোন্নতির উপযুক্ত বিবেচিত হন না, বিষয়টি খুব কষ্টের হয়ে দেখা দেয় তাঁর জন্য। সে-সময়ে তাঁর দুজন শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মৌখিক পরীক্ষা নিতে বিএম কলেজে আসেন, সকল বিষয় শুনে তাঁরা তাঁকে সরকারি কলেজের চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে বলেন। সেটি ছিল শামসুল হকের জন্য এক দুর্বিষহ সময়। বাবা এবং মাতুববর সাহেব – এই দুজনকে ছেড়ে আসতে হবে, অন্যদিকে তাঁর চার বছরের জুনিয়র পদোন্নতি পেয়ে পদবিতে তাঁর ওপরে তখন। খুব বৈরী এক সময়। অনেক আলোচনা ও চিন্তাশেষে শামসুল হক অবশেষে ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে বিএম কলেজের মায়া কাটিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
শামসুল হক 888sport app চলে এলেও তাঁর স্ত্রী বিএম কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হিসেবে থেকে যান। ফলে তিনি নিয়মিত বরিশালে আসতেন। কিন্তু একটি সময় আসে যখন তিনি সত্যি সত্যি বরিশালের মায়া কাটাতে সমর্থ হন। শেষবারের মতো ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি বরিশালের পাট চুকিয়ে একেবারে 888sport app চলে আসেন। বরিশাল ছেড়ে আসার সময়ে তাঁর মন জুড়ে ছিল বন্ধু আরজ আলী মাতুববরের 888sport sign up bonus। তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘… কালো পাথরে খোদাই করা শালপ্রাংশু দেহ, মিকেল অ্যাঞ্জেলোর মোজেস।’ তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির আর তাঁর হাত ধরে পাওয়া একজন আরজ আলী মাতুববর।
বাবার সঙ্গে ছিল তাঁর গাঢ় বন্ধুত্ব, তাই বন্ধুকে প্রতিনিয়ত কাছে পাওয়ার জন্য তিনি বাবাকেও চলে আসতে বলেছিলেন 888sport appয়। বিএম কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। বাবা তাঁর বাবার জন্য কখনো বরিশাল ছাড়তে চাননি এমনকি খুলনা বিএল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়ার পদোন্নতিও ফিরিয়ে বরিশালে থেকে গিয়েছিলেন। সে-কারণেই শামসুল হকের এই লোভহীন পিতৃভক্ত মানুষটির বিশেস্নষণ ছিল, ‘… পাণ্ডিত্য, মার্জিত রুচি আর ধীরস্থির ভাব নিয়ে কাজী সাহেবদের মতো বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী মফস্বলের অধ্যাপকরা একসময়ে ডাইনোসরদের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেলেন।’
দশ
অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির। জন্ম ২ মার্চ, ১৯২৪ সালে। ছোটবেলার পড়াশোনা বরিশালের এক পাড়াগাঁয়ে। সাপানিয়া গ্রামের কাগাশুরা উচ্চ প্রাইমারি বিদ্যালয়ে। ১৯৩২ সালে সেখান থেকে উচ্চ প্রাইমারি পাশ করে আলেকান্দা নুরিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি। ১৯৪০ সালে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা পাশ করে ঐতিহ্যবাহী বিএম কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁর পদচারণা শুরু। ১৯৪২ সালে আইএ পাশ করে বিএম কলেজেই দর্শন নিয়ে পড়ার জন্য বিএ অনার্সে ভর্তি হন। মাদ্রাসার পড়াশোনা শেষে দর্শন শাস্ত্রে অনার্স, ভাবতে একটু ধাক্কা খাই আমি। এমন একটি চিন্তা কীভাবে এলো, দাদা কীভাবে রাজি হয়েছিলেন চিন্তা করে বিস্মিত হই আমি। সাফল্যের সঙ্গেই তিনি ১৯৪৪ সালে দর্শনে বিএ অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সাপানিয়া গ্রাম থেকে কলকাতার ভৌগোলিক দূরত্ব বেশ দূরে; কিন্তু পড়াশোনার জন্য বাবার সেখানে গমন। সেখান থেকে ১৯৪৬ সালে দর্শনে এমএ করে দেশে প্রত্যাবর্তন।
আমি
যখন 888sport apps প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তখন
পড়াশোনার অঙ্গ হিসেবে ভারতীয় স্থাপত্য দেখার জন্য ক্লাস থেকে দলবেঁধে ভারত 888sport slot game
করেছি। আমাদের 888sport slot game তালিকায় তাজমহল ছিল। 888sport slot game থেকে ফিরে এসে বাবার কাছে যখন
বলেছি, পূর্ণিমার রাতে আমি তাজমহল দেখেছি, তখন বাবা বলেছিলেন, ‘তুমি ভাগ্যবান, আমি
কলকাতাতে পড়াশোনা করেও তাজ দেখার সৌভাগ্য হয়নি।’ আমি সেদিন বাবার কণ্ঠে ও চোখে
একটু কষ্টের ছোঁয়া দেখেছিলাম কিনা তা এখন আর অনুভবে নেই; কিন্তু আমি সেদিন জোর করে
বলতে পারিনি, বাবা আমি তোমায় তাজ দেখাবো, আমার পড়াশোনা শেষ হোক। আজকে যখন
পৃথিবীর নানা প্রামেত্ম কর্ম নিয়ে ঘুরে বেড়াই তখন বাবার কথা খুব মনে হয়।
আজকে বাবাকে তাজ দেখানোর মতো আর্থিক সংগতি বিধাতা দিয়েছেন; কিন্তু সে-সময় হারিয়ে
গেছে। বাবাকে হারিয়েছি আমি। বাবা আছে এবং বাবা নেই – এর মাঝে যে যোজন যোজন পার্থক্য।
আরজ
আলী মাতুববর সাহেব আমার নানা, চরবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খান
সাহেবের বন্ধু। আমার দাদা মুন্সী কাজী হাতেম আলী সাহেবেরও বন্ধু তিনি। মোহাম্মদ
আলী খান সাহেবের প্রথম মেয়ে (আমার বড় খালা, সেই আল আমিন প্রেসের মালিক জববার
সাহেবের স্ত্রী) শিরিন বেগমের বিয়ে। সেখানে বন্ধু হিসেবে মাতুববর সাহেবের নিমন্ত্রণ।
সেখানেই বাবার সঙ্গে তাঁর পিতার বন্ধু মাতুববর সাহেবের প্রথম পরিচয়। বাবা সম্পর্কে
দাদার বক্তব্য ছিল, তাঁর ছেলে স্বল্পভাষী, ভাবগম্ভীর ও নির্জনতাপ্রিয় একজন।
মাতুববর সাহেবের ওপর দায়িত্ব ছিল বিয়ের সাজানো এবং রান্নার বিষয়টি দেখা।
তিন-চারদিন ধরেই তিনি বিয়েবাড়িতে অবস্থান করছেন, সকল কিছু তদারক করছেন। মাতুববর
সাহেব রান্নার প্রকৃত 888sport live chatী ছিলেন, তাঁর হাতে রান্না 888sport live chatরূপে ধরা দিত। বিয়ের
দিন আমার বাবাও ওখানে ছিলেন এবং মাতুববর সাহেবের নজরে এসেছিল তাঁর বন্ধুর
ছেলেটিকে। রাতে বরযাত্রীর
খাওয়া-দাওয়া শেষে বাবার সঙ্গে মাতুববর সাহেবের প্রথম আলাপ শুরু। বাবা তখন দর্শনের ছাত্র এবং মাতুববর সাহেবের প্রশ্নগুলো
ছিল জগৎ ও জীবন সম্পর্কে। মাতুববর সাহেব
প্রশ্ন করেন, কাজী গোলাম কাদির তার উত্তর দেন। পরবর্তীকালে সম্পূরক প্রশ্ন আসে, তা
নিয়ে আলোচনা বাড়ে, রাত্রি বাড়ে, শেষ হয় রাত্রি, ফজরের আজান পড়ে; কিন্তু কথার যুদ্ধ
শেষ হতে চায় না। মাতুববর সাহেবের ভাষ্য ছিল, তাঁর মতো একজন কৃষকের মুখে এমন আলোচনা
শুনে দর্শনের ছাত্র কাজী গোলাম কাদির তাঁর মনোরাজ্যের অলিগলি পর্যবেক্ষণের জন্য
স্বেচ্ছায় আলোচনা বাড়াচ্ছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে এমএ শেষে প্রত্যাবর্তন এবং বিএম কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পেছনের কাহিনি আগেই বলেছি। বরিশাল শহরে আমাদের বাড়িটি কেনার আগে বাবা সাপানিয়া গ্রাম থেকে কলেজে ক্লাস নিতে আসতেন। বাহন একটি সাইকেল, পরবর্তীকালে আমি উচ্চমাধ্যমিকে বিএম কলেজে পড়ার সময় ওই সাইকেল নিয়ে বরিশাল শহরে এতই ঘুরতাম যে, শহরের অনেকেই ওই সাইকেলটি আমার হিসেবেই চিনত। বাবা কখনো সাইকেল নিয়ে বের হলে আমার বহু শিষ্য নাকি সরাসরি বাবাকে বলত, ‘এটা তো নাসিরভাইয়ের সাইকেল, আপনি চালাচ্ছেন কেন?’ বাবা আবার বাসায় ফিরে মাকে তার ছেলের শহরব্যাপী পরিচিতির কথা জানাতেন।
বাবা দর্শনের শিক্ষক, আরজ আলী মাতুববর একজন জ্ঞানের ছাত্র। তাই কলেজ বন্ধের দিন মাতুববর সাহেব লামচরী থেকে ছয় মাইল হেঁটে আমার দাদাবাড়িতে, সাপানিয়াতে চলে আসতেন, তাঁর বন্ধুর টানে নয়, বন্ধুপুত্রের সঙ্গে তাঁর নতুন লেখা নিয়ে আলোচনা করতে। দাদার বক্তব্য ছিল, তাঁর বড় ছেলেটি অর্থাৎ আমার বাবা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দেয় না, লোকজন থেকে দূরে থাকে, বসার ঘরে লোকজন দেখলে কথা বলার ভয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকে, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাতুববরের সঙ্গে কী এত কথা বলে। আরজ আলী মাতুববর আমার দাদা অর্থাৎ তাঁর বন্ধুকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনার ছেলে সবার সঙ্গে কথা বলে না, এটা তাঁর অহংকার নয়, বাজে কথায় সময় অপচয় না করার প্রচেষ্টা মাত্র, কাজী গোলাম কাদির রুচিসম্মত আলোচনায় সর্বদাই উৎসাহী একজন বক্তা ও শ্রোতা।’
এগারো
শামসুল হক বরিশালে নেই। তিন আসনের একটি শূন্য, মাতুববর সাহেবের মন ভালো নয়! অস্থির বোধ করেন তিনি বন্ধুর জন্য, তাই বরিশাল থেকে ছুটে আসেন 888sport app। বাসে ঝুলে পৌঁছে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে শামসুল হকের সঙ্গে কথা বলে ডাঙার মাছ পানি খুঁজে পায়, ফলে তাঁর ঘনঘন 888sport app আগমন। এর ফলে শামসুল হকের সৌজন্যে তাঁর জ্ঞানী লোকজনের সঙ্গে পরিচিতি বাড়ে, তিনি তাঁর জ্ঞানের পরিধি আলোচনার মাধ্যমে আরেকটু ঋদ্ধ করেন। বাবা 888sport app এলে তিনিও ছুটে যান জাহাঙ্গীরনগর বা খবর পেয়ে শামসুল হক চলে আসেন লালমাটিয়ায় আমার বোনদের বাসায়। দূরত্ব মানসিক বন্ধনের কাছে হার মানে। ওই সময়কালে দুজন জ্ঞানী ও গুণীজনের সঙ্গে মাতুববর সাহেবের পরিচয় হয়। একজন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান, শামসুল হক মাতুববর সাহেবকে সাইদুর রহমানের বাড়ি ‘সংশয়’-এ নিয়ে গিয়েছিলেন। সাইদুর রহমান স্যারের প্রশ্ন ছিল, ‘সংশয়ে আসতে অনেকেই ভয় পায়, কাকে নিয়ে এলেন, তিনি ভয় পাননি তো?’ শামসুল হকের উত্তরটি মজার ছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘আরজ মাতুববর সাহেব একজন ‘সংশয়াতীত’ ব্যক্তি।’ আরেকজন যৌন888sport apk গ্রন্থের লেখক আবুল হাসনাত। এ দুজনের মাধ্যমে মাতুববর সাহেবের পরিচিতির আরেকটি অধ্যায় শুরু হয় তখন।
বরিশাল শহরসহ দেশব্যাপী মাতুববর সাহেবের পরিচিতি বাড়তে থাকে, সকলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে তাঁর কথা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। নানা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় কথা বলার জন্য। লেখক শিবির, উদীচী 888sport live chatীগোষ্ঠী, বরিশাল 888sport live football পরিষদ, 888sport apps দর্শন সমিতিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। 888sport apps টেলিভিশনে ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। মাতুববর সাহেব বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, মন উজাড় করে কথা বলে যান। সেই সময় বাংলা একাডেমি কর্তৃক তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, একাডেমির ‘ফেলো’ পদ প্রদানের জন্য প্রস্তাব করা হয়। মাতুববর সাহেবের জন্য সেটি একটি বিশেষ দিন।
বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি বলেন, তাঁর অর্জিত জ্ঞান চুরি করা এবং এ-জ্ঞানের চুরিতে যাঁরা সহায়তা করেছেন তাঁদের মধ্যে কাজী গোলাম কাদির অন্যতম। উদীচী 888sport live chatীগোষ্ঠীর সংবর্ধনায় তিনি বলেছিলেন, যৌবনে কাদিরের সঙ্গে আলাপে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন, একজন শিক্ষানবিশ তরুণের জ্ঞানের বিস্তৃতি ও গভীরতা দেখে। সে-সময় থেকে আমার বাবা মাতুববর সাহেবের হিতাকাঙ্ক্ষী আর মাতুববর সাহেব কাজী গোলাম কাদিরের কাছে দর্শনে দীক্ষা নেওয়া একজন শিষ্য। তিনি বলেছিলেন, জীবনের দীর্ঘ সময়ে কাজী গোলাম কাদিরের সহায়তায় যে-সকল দানসামগ্রী পেয়েছেন তা যদি কাদির সাহেব ফিরিয়ে নেন তবে মাতুববর সাহেবের কাছে কাসেত্ম-কোদাল আর লাঙল-জোয়াল বাদে আর কিছুই থাকবে না। তাই যে-সংবর্ধনা তিনি এখন পাচ্ছেন তার প্রকৃত দাবিদার অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির। গুরুর প্রতি শিষ্যের কি এক গভীর 888sport apk download apk latest versionঞ্জলি!
তিনি বক্তৃতায় সেদিন বাংলা একাডেমিকেও অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষা যেহেতু জানেন না তাই বাংলা একাডেমি যদি বিদেশি ভাষার ভালো বই বাংলায় 888sport app download apk latest version করে প্রকাশ করত তাহলে আরজ মাতুববরের মতো আরো অনেকে নিজের মতো করেই দুর্লভ বই পড়ার সুযোগ পেত। সময় এগিয়ে চলে প্রকৃতির নিয়মে। শরীর ভাঙে, মন অস্থির হয়। জীবনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে চিন্তা করেন তিনি। জীবন নিয়ে মাতুববর সাহেবের নিজস্ব ভাবনা আছে, তাই তাঁর জীবনকে, জীবনের কর্মকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। মাতুববর সাহেব তাঁর অর্জিত সকল সম্পত্তি হিসাব করেন, লিপিবদ্ধ করেন, এমনকি অমূল্য সম্পত্তি নিজের দেহ সেটা নিয়েও ভাবেন বেশ কয়েকদিন। তারপর একসময়ে জ্ঞান অর্জনে সহায়তার জন্য নিজ দেহ ও চোখ মানবকল্যাণে উৎসর্গের চিন্তা করেন, ছেলেদের জানিয়ে দেন মনের ইচ্ছার কথা। মাতুববর সাহেবের চিন্তা ছিল, দারিদ্রে্যর কারণে কখনো তিনি স্কুল-কলেজে বিদ্যা কিনতে যেতে পারেননি, তাঁর সকল জ্ঞানের উৎস ছিল লাইব্রেরি, তাই সকল কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি লাইব্রেরিকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ভাবেন। একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার চিন্তা শুরু হয়, একসময়ে প্রতিষ্ঠা হয় লাইব্রেরিটি, তাঁর জন্মস্থান লামচরীতে, নামকরণ হয় ‘আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরি’। বরিশাল শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হন এই জ্ঞানের মানমন্দির প্রতিষ্ঠার দিন। ১৩৯২ সনের ১ চৈত্র, মাতুববর সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী দেহটি চলে যায় বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি সেকশনে, মেডিক্যালে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শরীর সম্পর্কীয় জ্ঞানার্জনের জন্য, চোখ চলে যায় দৃষ্টিহীনের দেখার জন্য। একজন জ্ঞানের ক্ষুধার মানুষ বহু প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের চেষ্টায় জীবনের সকলটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানের অন্বেষণে, আর মৃত্যুর পরও তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে নিজেকেই জড়িয়ে রাখেন জ্ঞানের জগৎজুড়ে। এমনি চিন্তার, কর্মের, ত্যাগের একজন মানুষের জন্য আমার পিতা অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির এবং তাঁর বন্ধু অধ্যাপক শামসুল হকের জীবনযুদ্ধের কার্যক্রম জীবনের শেষ প্রামেত্ম এসে আমি স্থপতি কাজী গোলাম নাসির আবার নতুন করে উপলব্ধি করেছি দেখেই সকলের কাছে আরজ আলী মাতুববরকে নতুন করে উপস্থাপনা আর এ-লেখার মাধ্যমে মাতুববর সাহেবের প্রতি আমার 888sport apk download apk latest versionঞ্জলি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.