আলো-আঁধারির গান        

লামা কোয়ান্টামে দিন শুরু হয়েছে সেই কাকভোরে। হিরণ্ময় মৌনতায় লীন হওয়ার এই প্রচেষ্টার প্রটোকল হচ্ছে – প্রশিক্ষণার্থীদের জবান থাকবে সম্পূর্ণ বন্ধ। এই ধ্যান-সাফারিতে এসে খানিকটা মুশকিলেই পড়েছি বোধ হয়। কী করে যে একদম মৌন থাকি?

শিথিলায়ন শুরু হলেই আবার তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবও হয়। বিরতির সময় চুমুক চুমুক চা পান করেও ঘুম ভাব তাড়াতে পারি না। প্রশিক্ষক মহোদয় একটু-আধটু আলোচনা করেন মৌনতা, ধ্যান, কৃতজ্ঞতা এসব নিয়ে। বিজনের এই নির্জনে গাইডেড মেডিটেশন চলেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুরুতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে না পারলেও বেশ প্রশান্ত লাগছে এখন। সান্ধ্য সেশন সাড়ে সাতটায়। বিকেলে শুরু হয়েছে দীর্ঘ বিরতি – বিশ্রাম ও ডিনারের জন্য।

ফুরফুরে মেজাজে বের হয়ে বন্ধুর পথে হাঁটি নিঃশব্দে। একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে অপরূপ পুলের নিচে। পাথুরে ঘাট সাজিয়ে রাখা হয়েছে এদিকটায়। উঁচু পাহাড়ের ছায়া পড়েছে কাঠের সেতুর পিঠে। জমে থাকা জলের রং ঘোলাটে। জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে মন প্রশান্ত হয় বলে মুনি-ঋষিগণ কোমর জলে নেমে ধ্যান করতেন। অস্থির আমি জলের ধারা এড়িয়ে আসমানের দিকে তাকাই। অপরাহ্ণের অনন্ত অম্বরে কত যে রঙের খেলা। দিনমণির সোনালি ঐশ^র্য ছড়িয়ে পড়েছে চারধারে। অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে আছড়ে পড়ছে আলোর তীর। কত কিসিমের বৃক্ষলতা এদিকটায়। উদাল গাছের দীর্ঘ কাণ্ড কুচকুচে কালো। সবচেয়ে মনোহর পান্থপাদব গাছ – এর মাথায়  কলাপাতার বিস্তৃত তোরণ। তালগাছের মতো কিছু গম্ভীর বনস্পতি সটান দাঁড়িয়ে। ঘন জঙ্গলের ফাঁকে চিলতে চিলতে সমতল ভূমি। বাঁশঝাড় পেরিয়ে অবতল মাঠ। আকাশচুম্বী সেগুন, শাল, চন্দন বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে। শাখাবিস্তারী পাকুড় গাছ থেকে ক্ষুদে ক্ষুদে ফল ঝরে পড়ল ঘাসের বুকে। ঘাসের গন্ধও নাকে লাগল। মৃদু হাওয়ায় শিরিষ পাতারা দুলছে মৃদুলয়ে।

উঁচু ঢিবির বুকে নখর এঁটে চুপটি করে বসে আছে একটা ভুতুমপাখি। এটি কী দিব্যান্ধ? সাধারণভাবে বলতে গেলে পাখি মানেই সদাচঞ্চল, সারাক্ষণ কিচিরমিচির। কিন্তু এই বিদ্ঘুটে পাখি স্থির রয়েছে ভাস্কর্যের মতো – আত্মমগ্ন, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। এর ভাবভঙ্গিতে রাজ্যের বিরক্তি। জবুথবু খেচরের গোলগাল অবয়বে খয়েরি পালক। এর বয়স কত হলো? পাখিটির  ঘুম ঘুম চোখে  যেন জগতের তাবৎ বৈরাগ্য জটলা বেঁধেছে। এর ঠোঁটের আগা বেশ শানিত। আমার জবান বন্ধ থাকলেও করোটিতে এসে উঁকি দেন নিসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশ।  তিনি এই ধ্যানী পাখির কাব্যিক নাম দিয়েছেন লক্ষ্মীপেঁচা :

উচ্ছল কলার ঝাড়ে উড়ে  

চুপে সন্ধ্যার বাতাসে

লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে

                                               নেমে আসে।

আমার উড়ুক্কু মন উড়াল দিলো সুদূর গ্রিসে। এথেন্সে গিয়ে দেখেছি পেঁচার মুখোশ। এই বিহঙ্গ নাকি প্রজ্ঞা ও সমৃদ্ধির প্রতীক। অস্থির মনকে আবার এই লামার বনানীতে ফিরিয়ে আনি।

এখন হাঁটি উদ্দেশ্যহীন। চড়াই-উতরাই পথ। টিলার  আগায় আগায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা-দুটো বাংলোঘর। এই হাউসগুলিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পরিপাটি ঢংয়ে, মায়াবী রঙে। ঘরগুলির নামকরণ করা হয়েছেন বিভিন্ন মশহুর মানুষের নামে। প্রতিটি আবাসের পাশেই একটুখানি বাগান। ঢালু পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে নানান কিসিমের বনস্পতি। সবকিছু যেন পটের ছবির মতো সাজানো-গোছানো। কাঁঠালবনে মৌমাছির বাসা বেঁধেছে – গুনগুন গান শুনি ব্যস্ত পোকার। তেঁতুল, আমলকী, বাদাম, নিম, খেজুর গাছ, বাতাবিলেবু, কদবেল, কামরাঙা, জলপাই ও আরো কত সব ফলদ গাছ এদিকটায়। গাব গাছের গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে হলদে বা গোলাপি রঙের কচিপাতা। ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই, শালিক, ঘুঘু, বাবুই ও নাম-না-জানা বিহঙ্গকুল দেখলাম আশেপাশে। স্বাস্থ্যবতী বনটিয়ে এসে ঠোকর দেয় কামরাঙা ফলে। এদের তীক্ষè চঞ্চুতে, সবুজ পালকে, পত্রপুষ্পে লেগেছে বিকেলের অস্তরাগ। এইসব পাখি আনন্দমুখর চুকচুক শব্দ করে ক্ষুধা নিবারণ করে। হঠাৎ করে কেন যেন 888sport app download for android হলো, রেস্তোরাঁয় তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন সেরে ঢেঁকুর তুলে বের হয়ে আসা মানুষের মুখের আনন্দ আর উপাসনালয় থেকে প্রার্থনা শেষে বেরিয়ে আসা মানুষের মুখের আদলের কী পার্থক্য আছে? আমার সাড়া পেয়ে বিশ্রী ডাক দিয়ে টিয়ের ঝাঁক পালিয়ে গেল দূরবনে। খানিকটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করলাম, কোনো প্রাণীর আনন্দময় হল্লা আর শঙ্কামুখর আর্তনাদের মাঝে প্রভেদ কোথায়?

পুকুরপাড়ে তিতির ডাকে। ঘোলা জলে পড়ল মেঘের ছায়া। সরোবরের এক কোণে ফুটে আছে জংলি শাপলা – লোহিত বরন। এর বাহারি নাম রক্তকমল। নিঃসঙ্গ কদম গাছ খানিকটা ঝুঁকে আছে জলের দিকে। টেনিস বলের মতো সবুজাভ বাসি ফল ঝুলে আছে কাঁচাপাকা পাতার ফাঁকে। কদমফুলের কেশর ঝরে গেছে। এখন কদমের মৌসুম নয়। নইলে হয়তো কদমফুলের গন্ধে বিধুর হয়ে উঠতাম। এই বনে আম, জাম, কাঁঠাল, চালতা গাছও দেখলাম অসংখ্য। জলপাই পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে পড়েছে আদুরে দোয়েল। আক্ষেপ হলো, প্রিয় নারকেল গাছ কি একটাও নাই? বুঝেছি, এখানকার পাহাড়ি জল-মাটি নারকেলবীথির জন্য বৃদ্ধির অনুকূল নয়। না, ওই তো শৈলচূড়ায় একটা গাছের নাম লেখা আছে – ‘বুদ্ধ নারকেল’! কাছে গিয়ে খানিকটা অবাক হলাম, এটি তো পুঁচকে লতানো গাছ। এখানে-সেখানে অজস্র কাঠগোলাপ ফুটে আছে অফুরান।
অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে উঠেছে ঝোপঝাড়। একপাশে কনকচূড়া, কৃষ্ণচূড়া,  রুদ্র পলাশ ও বনচম্পার বাগান। বাদাম গাছকে দেখায় অপরূপ ছায়াবীথির মতো। বিশাল বিশাল পাতা ছড়িয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে হারগজা গাছ। গোলমরিচের লতা জড়িয়ে ধরেছে এর অমসৃণ কাণ্ড। স্বর্ণলতা সোনার বরণ। প্রচুর কুচ ফল ধরেছে লতাগাছের বাঁকে বাঁকে। সবুজ খোসা খুলে দেখি, খুদে ফলটির রং টকটকে লাল,  মাঝে একটুখানি কালো ফোঁটা। একটা বড়ির ওজন মানে এক রত্তি স্বর্ণ মাপার একক। কোথায় যেন পড়েছিলাম, কুচ পাতার রস খাওয়ালে কাক্সিক্ষত ব্যক্তি নাকি আজীবন বশ থাকবে! রিরংসু মনে উঁকি দেয় অশ্লীল জোঁক। পাগলাটে মনকে শাসন করি – চুপ, একদম চুপ। 

হঠাৎ দেখা চপলা পাখিটির একটুও বিরাম নেই, সারাক্ষণ তিড়িং-বিরিং উড়ছে, নাচছে আর গান গাইছে। এটি বাসা বেঁধেছে আতা গাছের পাতা মুড়িয়ে। কোমল পালক ঝরে পড়ছে মাটির বুকে। ফুলের বনে মধু খায় লম্বা ঠোঁটের  একরত্তি পাখি – কী সুন্দর রং। কী মিষ্টি এর গানের গলা। বাহারি নাম মৌটুসি পাখি। আমার প্রয়াত দাদিজানের ভাষায় এই ছোট্ট পাখির নাম ফুলচুষি। কারণ এটি ফুলের মধু ছাড়া কিচ্ছু খায় না, এমনকি পোকামাকড় বা ঘাসের দানাতেও নাকি এই শৌখিন পাখির চরম অরুচি। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে এটি ফুড়ুত করে উড়ে গেল সামনের দিকে। সেদিকে উবু হয়ে আছে ঝিরিঝিরি পাতার

কৃষ্ণচূড়া গাছ; দিঘল তলোয়ারের মতো সবুজ ফল এসেছে এই বৃক্ষে। শিশুকালে আমরা এই তলোয়ার দিয়ে মিছিমিছি যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতাম। পাশর্^বর্তী কিংশুক গাছ এই সময়টায় রিক্ত। দিনের শেষের জাফরানি রঙের আলো ছড়িয়ে পড়েছে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে। ঝির ঝির করে কড়ই পাপড়ি ঝরে পড়ছে নাকে-মুখে-মাথায়। কাতুকুতুর মতো লাগে, তবু বেশ লাগে।

এখানকার সমতল ভূমিতে রয়েছে কয়েকটা ফুলের বাগান। রক্তকাঞ্চন, পলিপেরাস, গোল্ড শাওয়ার, রোজ ক্যাকটাস, ফণীমনসা, লজ্জাবতী,  প্যাগোডা, শতপা, স্থলপদ্ম, ক্যামেলিয়া, করবী, টগর, হলুদ কাঞ্চন লতা-গুল্ম। সারি সারি গোলাপের ঝাড়ে ফুল ফুটেছে। গোলাপের পাপড়ি পড়ে ঘাসের গালিচা সয়লাব হয়ে গেছে। হলুদ-গোলাপি-সফেদ রঙের বুনোফুল বেড়ে উঠেছে বেড়ার ধারে-এর নাম ল্যান্টানা। জারুল ফুল ভূপাতিত হয়ে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে ঘাসের গালিচায়।  সবুজ গুল্মের গা বেয়ে হলুদ ও গোলাপি রঙের অচেনা ফুল ফুটে আছে গরবিনীর মতো। ঘাসবনে লুকিয়ে থাকা ঘোড়াপোকা বা বিচিত্রসব কীটপতঙ্গের ডাক শুনি। জ্বলজ্বল করছে রাশি রাশি ঘাসফুল – সফেদ-বেগুনিরঙা। লতানো ঝোপে নীলকণ্ঠ ফুল শুঁকে দেখলাম – একটুও ঘ্রাণ নেই। সুগন্ধি গোলাপ ছাড়া বর্ণিল ফুলগুলি সাধারণত নির্গন্ধ হয়। আর মোহিত হওয়ার মতো সৌরভ ছড়িয়ে বেড়ায় সফেদ রঙের ফুল – বেলি, কামিনী, বকুল, ছাতিম, বেল ফুল। হয়তো এভাবেই প্রকৃতি ভারসাম্য বজায় রাখে। যেমন পতঙ্গের মাঝে দেখা যায়, যার হুল আছে তার বিষ নেই। একই ফুলের পরাগ খেলে মৌমাছির পেটে মধু হয় আর ভ্রমরের উদরে

 পড়ে একই ফুলের রস রূপান্তরিত হয় বিষে। কুরচি গাছে ফুল আসতে ঢের দেরি। সফেদ কামিনী আর বেলির মিশ্র সৌরভ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সবুজের যে কত রকমফের হতে পারে। চেরি, লতাজবা, টি অলিভের কচিপাতা দুলছে
এদিক-সেদিক। একটা বাহারি পাতাযুক্ত গাছের নাম জেনে অবাক হয়েছি – সমুদ্র জবা। সবুজ, সাদা, মেরুন আর সোনালি রঙে চিত্রিত বড় বড় পাতায় সারা ঝাড় ঝলমল করছে। রক্তকাঞ্চন, নীলকণ্ঠী, জয়তী, মালতীলতা, কুন্দগাছ দেখে 888sport app download for android করি আমাদের প্রতিদিনের সূর্য রবি ঠাকুরকে। এক স্বেচ্ছাবন্দি অলস দাস জনৈক মহারানীর আনন্দ সাধনে আত্মনিবেদন করলেন এভাবে :

আছে দেবী, আরো আছে –

নানা কর্ম, নানা পদ নিল তোর কাছে

নানা জনে; এক কর্ম কেহ চাহে নাই,

ভৃত্য – ’পরে দয়া করে দেহো মোরে তাই-

আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার।

মালাকার?

ক্ষুদ্র মালাকার, অবসর

লব সব কাজে।

কিন্তু এই তপোবনে হঠাৎ দেখা ত্যাড়াবেড়া গাছটির ফুলের গুচ্ছ লুকিয়ে রয়েছে ফলের ভেতরে। ডুমুরের ফুল! মেরুন ডুমুর এঁটে আছে খসখসে কাণ্ডে। ঐশীগ্রন্থ অনুসারে, আদিপিতা আদম ও মা হাওয়া নিষিদ্ধ গন্ধম খেয়ে লজ্জাতুর হয়ে ডুমুরপত্র দিয়ে নিজেদের আব্রু ঢেকেছিলেন। গুরু জ্যোতিঃপাল মহাথেরোর কাছে একান্তে শুনেছি, দীর্ঘ তপস্যার সময় গৌতম বুদ্ধ শুধু ঝরনার জল আর ডুমুর খেয়ে ক্ষুণ্নিবৃত্তি করতেন। নিয়মিত ডুমুর ফল খেলে নাকি মন সদা প্রফুল্ল থাকে, চিন্তা শানিত হয় ও বাচালতা কমে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

দিনের শেষ আলোয় চারপাশ একটু ঘুরেফিরে দেখি। চলতি পথে দেখি কামার, পপলার, পাইন, শাল ও ফার বৃক্ষ। দ্রুতপদে চলেছি রহমগিরিতে – পাহাড়ের চূড়ায়। অশোক বনের ঘনছায়া পার হতে গিয়ে মনে হলো, এই বুঝি ঝেঁপে আসবে ঘোর অন্ধকার। ওপারের ঘন বনে সবুজ আঁধার জমে আছে। চড়াই পথে লাল ইটের প্যাঁচানো সিঁড়ি। মোড়ে মোড়ে বেঞ্চি পাতা। এত সিঁড়ি ভাঙতে আমার পা ধরে আসে। বাঁপাশে  একটা ঝুলন্ত সেতু – আলফা ব্রিজ। মেঘভাঙা আবীর নেতিয়ে পড়ছে পাহাড়ি অরণ্যে।

পাকদণ্ডির দিকে বড় বড় পাপড়িভরা চোখের এক রূপসী মেয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে। মৃদু বাতাসের ছোঁয়া এসে লাগে তার চোখে-মুখে। হঠাৎ 888sport app download for androidে এলো খুশবন্ত সিং সরদারজির উদ্দীপক শের – ‘বুরা কামকা ওয়াস্তে বুরা নেহি!’  ছি, কী ভাবছি আমি? আজকের দিনেই তো ধ্যানমগ্ন ছিলাম তিন-চার ঘণ্টা?  বলে রাখি,  আমাদের প্রতি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল, একদম মৌন থাকতে হবে। কেউ কাউকে পারতপক্ষে শব্দ করে সালামও দেবে না। সালামের জবাবও উচ্চস্বরে না দিয়ে ইঙ্গিতে দিতে হবে। প্রশিক্ষণের এই তিনদিনে বিপরীত লিঙ্গের বা পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এমনকি চোখাচোখি হলেও সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। কোনো কথা নয়, চিন্তা নয়, তাকানো নয়, কামনা নয়, ঘৃণা নয়, পাপ নয়, অভিযোগ নয়, শুধু নিজের প্রতি মগ্ন হতে হবে – একদম নীরবে।

আমি আয়োজকদের নিষেধাজ্ঞা  বেমালুম ভুলে যাই। ঝোপের আড়াল থেকে চোরা চাহনিতে বারবার তাকাই মেয়েটির দিকে। যুবতী হাঁটে  মল বাজিয়ে, নিতম্ব দুলিয়ে। নিঝুম বলয়ে ছম ছম শব্দ হয়। ফুলের পাপড়ির গুঁড়ো লেগেছে তার ঠোঁটের কোনায়?  রূপবতী তরুণীটি চুল এলো করে আকাশ দেখছে? তাকে কি আগে কোথাও দেখেছি? মনকে শাসাই, পা চালাই, আসি উলটোদিকে। এদিকে জবাকুসুমের বন।  শুনেছি, কাপালিকগণ নরবলি ও তন্ত্রমন্ত্রে এই ফুল ব্যবহার করতেন। রক্তজবার পাপড়ি মানুষের মন বশীকরণ ও নরবলিতে ব্যবহৃত হয়। এর শিকড়ও নাকি যৌন উত্তেজক। চলে মনে মনে আবোলতাবোল

খেলা, যার কোনো মাথামুণ্ড নেই। আদমের সন্তানের বিক্ষিপ্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করা বেশ কঠিন বইকি। লম্বা দম নিয়ে দৃষ্টি ঊর্ধ্বমুখী  করি – দূরবর্তী টিলাগুলি মুক্ত ও দূরছন্দা। আবার কল্পনার ফানুস ওড়াই, দিঘলকেশী মেয়েটি কি কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে? মনের এই বিশ্রী রোগ, যা করতে বারণ করা হয়, তাতেই বাঁদর-মনের যাবতীয় কল্পনা।

আলো-আঁধারের বুঝি যুদ্ধ লেগেছে? খানিকটা  লুকোচুরি চলল রোদ-ছায়ার।  দূর-দূরান্তের নীলাভ শৈলমালা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।  ধূসর পাখি আজকের মতো কলরব শেষ করছে সফেদার ডালে। সুনিবিড় ঝোপঝাড়ের ফাঁকে কুচকুচে বাকলের গাব গাছ দেখি অজস্র। একটানা শুনি ঝিঁঝির ডাক, পাখির কাকলী বা পাতার মর্মর। সমস্ত বিশ্ব আগেভাগেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। কী অপরূপ দূর পাহাড়ের শোভা! ছায়া নামছে গাঢ় হয়ে।

চামসে গন্ধ এসে নাকে লাগল? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, লিচু গাছে পা উল্টো ঝুলিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে কালো বাদুরের ঝাঁক। বাতাসের দোলায় এরা আধোঘুমে দুলতে থাকে এদিক-সেদিক। শেওড়া ঝাড়ে ফুটে আছে অজস্র স্বর্ণাভ ফল। আমার সেকেলে পিতামহী জর্দার সুবাস ছাড়িয়ে পান-খাওয়া-ঠোঁটে বলতেন, এই ঝাঁকড়া গাছে পেত্নির আবাস। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত মা এগিয়ে এসে ভয়ার্ত আমায় জড়িয়ে ধরলে মায়ের গায়ের বেহেশতি গন্ধে আমি নিঃশঙ্ক হয়ে যেতাম। সবুজ শাড়িপরা মা হেঁসেলে চলে গেলেই আবার জড়ো হতো রাজ্যের ভয় – ভূত-প্রেত-শাকচুন্নি-রাক্ষস-খোক্ষস! সন্ধ্যাবেলায় দিকে বাঁশবনের আগা থেকে বকের ছানারা কেঁদে উঠত বিশ্রীস্বরে। দাদিজান একবার কালো মোরগের বিনিময়ে এক স্বাস্থ্যবতী মগিনীর কাছ থেকে একটা কবজ কিনে আমার গলায় ঝুলিয়েও দিয়েছিলেন। এইসব তুকতাকের বিশ্বাস উবে গেছে সেই কবে।

দূর পাহাড়ের ধোঁয়াশা উড়ে উড়ে যায়।  বেলা যে শেষ হয়ে এলো। সন্ধ্যা পুরো মিলাবার আগে ধূলিবালি ঝেড়ে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম। এরূপ স্নিগ্ধ গোধূলি যেন সুদূরের অতীত থেকে হাজির হয়েছে জীবন্ত সুষমা নিয়ে। আমাদের পুকুরপাড়ের বটের ঝুরিতে এমনি করেই লাগত মøান আবিরের ছোপ। এরূপ মাহেন্দ্রক্ষণে স্বল্পবাক পণ্ডিত মশায় বাচাল আমাদের বলতেন, প্রজ্ঞার সূত্রপাত হয় মৌনতা থেকে। তিনি প্রতি মাসে একবার মৌনব্রত পালন করতেন। তাঁর কাছে শুনেছিলাম প্রজ্ঞার সুরভি : 

এক পুঁথিগ্রস্ত পণ্ডিত এসে তথাগত বুদ্ধদেবের কাছে নিবেদন করলেন, আমার মনে অজস্র প্রশ্ন – হাজারো দ্বিধা। আমি সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। বুদ্ধ বললেন, তুমি কী আসলেই এসব প্রশ্নের জবাব জানতে চাও, তাহলে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এমনিতে একটা উত্তর থেকে আরো অনেক প্রশ্ন জন্মায়। উৎসুক পণ্ডিত বললেন, আমি আমার উত্তর পাওয়ার জন্য যে-কোনো মূল্য পরিশোধে উন্মুখ। বুদ্ধদেব খানিকটা উদাসীনতার প্রলেপে নিজেকে মুড়িয়ে আবার চক্ষু মুদিত করে ধ্যানমগ্ন হলেন। কৌতূহলী পণ্ডিতের যেন আর তর সইছে না, ভাবছেন চলে যাবেন কি না। মহামতি বুদ্ধ আচমকাই গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, পণ্ডিত, পুরো দু-বছর মৌন থাকো। আগ্রহী পণ্ডিত বললেন, ঠিক আছে, হে মহাত্মন, তখন কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন। বুদ্ধ সৌজন্যস্নিগ্ধ মুচকি হাসি হেসে বললেন, যদি তখনো তোমার মনে কোনো প্রশ্ন থাকে।

ঠিক মনে পড়ে, সাঁঝের মায়ায় আমাদের পণ্ডিত মশাই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পাঁচালিও পাঠ করতেন :  

কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ

কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ।

সংসারোহয় মতিবর বিচিত্রঃ

কস্য ত্বং বা কুত আয়তঃ

তত্ত্বং চিন্তায় তদিদং ভ্রাতঃ।

[ভাষান্তর : কে তোমার স্ত্রী, কে তোমার পুত্র

           এই সংসারের ব্যাপার অতি বিচিত্র।

           তুমি কার বা কোথা থেকে এসেছ,

           হে ভ্রাতঃ, এই নিগূঢ় তত্ত্ব চিন্তা কর।] 

এখন সাঁঝ নামছে টগবগিয়ে। ঝিঁঝি ও নিশাচর পাখির ডাক শোনা যায়। নিস্তব্ধ অন্ধকারে কার যেন পদধ্বনি শুনি। দূরপাহাড়ের গায়ে দেখা যায় অগ্নিশিখা। জুমচাষিরা বোধহয় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। নাকি অশরীরী কিছু? কী জানি? নিউরনে ছুটে আসছে 888sport sign up bonusর মিছিল। এক রাতে মায়ের অঘুমের পালা শুরু হলো। ঘরে ঘুমের ওষুধ না পেয়ে বড়পা আমাদের ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পাঠায়। বড় টর্চ নিয়ে অগ্রজ লুলু সেনাপতির মতো হাঁটে। আমি স্যাঁতসেঁতে হালট ধরে সন্তর্পণে তাকে অনুসরণ করি। আলের দুপাশে বুনো লতার ঝাড়। মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসে। পানাপুকুরের পাড় দিয়ে শিমুলতলা পার হয়ে শশ্মানঘাট দিয়ে যেতে গা ছমছম করে উঠল। কয়দিন আগেই এখানে লাশ দাহ করা হয়েছে। পথ চলতে চলতে টর্চের আলো একদম ফিকে হয়ে এসেছে বলে তারার আলোয় দাঁড়িয়ে বিরক্ত লুলু কচুগাছের মাথায় হিসি ছাড়ে। আমি বলি, দাঁড়িয়ে হিসি করতে মা বারণ করেছেন না? অগ্রজ লুলু ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয় এভাবে, বলে লাভ নাই, মা অসুস্থ। লুলু গম্ভীর মুখে টর্চের ব্যাটারি নেড়েচেড়ে দেখে। কিন্তু টর্চ আর জ্বলে না। কৃষ্ণপক্ষের ম্রিয়মাণ আলোয় লক্ষ করি, গাঙের বুকে কয়েকটা লণ্ঠনজ্বলা ছোট নৌকো আর জালের মাচান। দূরের জলাভূমি থেকে জলজ বাতাস এসে বুকে লাগে। গায়ে শিরশির অনুভূতি হয়। আমিই প্রথম জলাভূমির দিকে আলোর কোমল ঝলকানির মতন কিছু দেখি। অকুতোভয় লুলুর কণ্ঠেও আতঙ্কের রেশ দেখি। ভয় কাটাতে কিশোর লুলু বুকে থুতু ছিটালেও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। তবু নতুন কিছু আবিষ্কারের গৌরবে বেশ উত্তেজিত বোধ করি। এমনি এমনি আগুন জ্বলে? কি সে কেরামতি? ভূত বা অজানার জগৎ এত কাছে! সব বিস্মৃত হয়ে আলেয়ার দিকে চেয়ে থাকি। ভয় ভয় লাগলেও আমরা কিন্তু সব ভুলে এই মায়াপুরীর আগুনের খেলা দেখি। প্রলম্বিত অনুনাদের ট্রেনের হুইসেল এসে মগ্নচৈতন্যে আঘাত হানে। উলটোদিক থেকে আসা এক বিড়িখোর হাটুরে ফিসফিস করে বললেন, ‘ভয় পাইস না, এইসব ইনাদের খেলা, তবে ইনারা কারো ক্ষতি করেন না!’ 

অনেক আগেই কালো-সাঁঝ কালো-ভূতের মতো এসে আজকের সবটুকু আবির ছিনতাই করে নিয়েছে। দস্যুর মতো অন্ধকার নেমে আসছে পাহাড়ি বনে। ঝোপের দিকে বের হয়েছে শত-সহস্র জোনাকি পোকা, যেন চলমান আলোর ফুল! এরা জ্বলছে আর নিভছে। এরা ঝাঁকবেঁধে সামনে এগোয় ধীরলয়ে। লেবুতলায় এসে জোনাকিরা থামল। এই স্বপ্নপুরী ছেড়ে ক্লাসে ফিরতে আমার মন চায় না। তবু ফিরতে হয়। প্রদীপ জ্বলছে  তুলসীতলায়। আলোচক মমতার স্বরে জানিয়ে দেন – লোভ, কাম ও ক্রোধের দাস মানুষের কি পাপতাপের শেষ আছে। তাই তো, আমার আপন আঁধারের খবর আমিই কেবল জানি। চোখের জলে নিমগ্ন হই অকৃত্রিম অনুশোচনায়।

রাতের ক্লাস শেষে আবাসে ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘরের সব লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। একদল মানুষ প্রশান্ত মনে ভূমিশয্যায় এলিয়ে পড়েছে লম্বা ঘরে। অস্থায়ী আবাস দেখতে তাঁবুর মতো। মৌনতার ধ্যানে আগতদের মুখে ফিসফাসের সুযোগ নেই। সঙ্গে নেই কোনো ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বা বইপুস্তক। নেই ফোন বা অনলাইন স্ক্রলের সুযোগ। রাতজাগা পাখির ডাক ভেসে আসে। কী করুণ কাকলী। পতঙ্গের আর্তনাদ বাজে অপরূপ সংগীতের মতো। মাঝে শুনি দূরাগত ঘণ্টাধ্বনি। দূরে কোথাও কাঁসর বাজে – সম্ভবত মানসী পূজার। বনবিড়াল কাঁদে – অবিকল মানবশিশুর কান্না!

আগেভাগেই শুয়ে পড়েছি ভূমিশয্যায়। এত তাড়াতাড়ি কি ঘুম আসে? আধশোয়া হয়ে শুনি অন্ধকারের গান। কথা ছিল, জবান থাকবে বন্ধ, তবু মনে বয়ে চলে অস্থির তরঙ্গ হাঙ্গামা হইচই, শঠতা ঐশ্বর্য ধনরত্ন,

কামনা দুঃখ বাসনা টেনশন অবসাদ। অস্থির, অশান্ত, অতৃপ্ত, হাহাকারময় ও কোলাহলময় মন নিয়ে কী করি :

অজ্ঞতা হইতে আসে অহমিকা

অহমিকা হইতে স্বার্থপরতা

স্বার্থপরতা হইতে বিরক্তি

বিরক্তি হইতে রাগ

রাগ হইতে ঘৃণা

ঘৃণা হইতে ধ্বংস।

(বুদ্ধদেব)  

পাশের বেডের প্রৌঢ় মানুষ অঘোরে ঘুমোন – তিনি ঘুমের ঘোরে হিজিবিজি কী সব বকতে শুরু করেছেন। বুঝলাম, ঘুমন্ত অবস্থায় মৌন থাকার নির্দেশনা ঠিক কার্যকর করা যায় না! আরেক আধবুড়া লোক বিরক্তমুখে উসখুস করেন। ফিকে আলো ঢুকে পড়েছে সন্তর্পণে। অপার্থিব আলোর নকশা দেখি তাঁবুর ফাঁকে – হাত বাড়িয়ে ধরতেও আলস্য লাগে। রাত বাড়ছে একটু একটু করে, কিন্তু আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। বৃষ্টির পাখোয়াজ বাজতে শুরু করেছে মিহিলয়ে। খানিক পরেই ঝুম বৃষ্টি। একসময় আকাশের কান্না থামলে নিকষ আকাশে উদিত হয়েছে জ্বলজ্বলে তারা।

গভীর রাতে তাঁবুর বাইরে এলাম সন্তর্পণে। আচমকাই মনে উদয় হলো বিকেলে চোখাচোখি হওয়া মেয়েটির সলাজ দৃষ্টি। 888sport promo codeরত্নটির দেহবল্লরীতে কি এখন খামোকা অজুহাতের মতো একটুখানি ফিনফিনে পোশাক? আবার নিষিদ্ধ গন্ধমের হাতছানি! সে কী পদ্মগন্ধী? পুরাণমতে, মাছের উদরে জন্ম নেওয়া সত্যবতীর  সারা গায়ে মাছের গন্ধ ছিল। মৎস্যগন্ধা।  তিনি শৈশব থেকেই জেলেদের সঙ্গে নদীতে খেয়া পারাপারের কাজ করতেন। একদিন পরাশর মুনি তীর্থ শেষে ঘুরতে যমুনা তীরে আসেন। অপর পারে যাওয়ার জন্য তিনি যুবতী সত্যবতীর নৌকায় উঠলেন। পাটনির রূপে মুগ্ধ হয়ে পরাশর একান্ত সময় চাইলেন। বিনিময়ে তার গায়ের গন্ধ দূর করে দেবেন। মুনি মন্ত্রবলে নদীতে ঘন কুয়াশার আবরণ সৃষ্টি করলেন। পরাশর সংগম শেষে সত্যবতীর গায়ের মাছের গন্ধকে পদ্মগন্ধে পরিণত করে দেন। সত্যবতীর গায়ের সুবাস যোজন দূর থেকে পাওয়া যেত বলে তার আরেক নাম যোজনগন্ধা।

কিন্তু কোথায় পাব যোজনগন্ধা 888sport promo code? বরং নাকে লাগল ঝাঁঝালো গন্ধ! বৃষ্টির জমে থাকা জলে ছপ ছপ পা ফেলে একটা প্রাণী চলে গেল গহন বনে।  একটু পরেই ঝোপের দিকে শেয়ালের হাঁকডাক শুনতে পাই। মনে পড়ল ব্রিটিশ পোয়েট লরিয়েট টেড হিউজের অমর স্তবক : 

Across clearings, an eye,

A widening deepening greenness,

Brilliantly, and concentratedly,

Coming about its own business

Till, with a sudden sharp hot stink of fox

It enters the dark hole of the head.

The window is starless still, the clock tick,

The page is printed.

এবার স্তবকটির দুর্বল ভাষান্তর দেখুন :

দৃষ্টির ওপারে ছিল শূন্য আকাশ

চারধারে আদিগন্ত সবুজ পাথার

আবেশ ঘনিয়ে আসে

কেঁপে কেঁপে সহজিয়া ঢংয়ে

সময় স্থির হয়, নক্ষত্ররা সুপ্ত রয়

মাথার ভিতর জাগে অসুখী গাঁথা

হঠাৎ উড়ে এলো খেয়ালি বোধ

888sport app download apkর খাতায় রচি এলেবেলে কথা।

১৯৫৭ সালে রচিত ইংরেজি 888sport app download apkটি প্রথম পড়তে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। আরে, এই 888sport app download apkর মূল রচয়িতা যেন আমাদের প্রাণের কবি জীবানানন্দ দাশ। কিন্তু আমার এই 888sport app download apk latest versionে a sudden sharp hot stink of fox গেল কই? এই বুঝি শেয়ালের তীব্র গন্ধ? ভেজা বাতাসের ঝাপটা এলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই বিশ্রী গন্ধ কর্পূরের মতো উবেও গেল। বরং বাতাসে ভাসছে কুসুমগন্ধ। নিশ্চিত হলাম, দূরে কোথাও ছাতিম ফুল ফুটেছে। আমার দাদিজানের ভাষায় সপ্তপর্ণ ফুল। ছাতিম গাছের ইংরেজি নাম ডেভিলস ট্রি – শয়তানের গাছ। এর আয়ুর্বেদী পরিচয় মদগন্ধ। রাতের নির্জনে এই ফুলের গন্ধ বেশি ছড়ায়। এই ফুলের সৌরভ প্রথমে উদাস করে, পরে শরীরে-মনে নেশা ধরে যায়, সবশেষে নাকি কুকামের আগ্রহ হয়! মৌন থাকলে কত যে এলেবেলে ভাবনা আসে মনে। ফ্রয়েড সাহেব মন নিয়ে তো দেখি যথার্থই বলেছেন। অসভ্য মানবমন বুঝি কখনো পরিশীলিত  হবে না? কুৎসিত মনকে বকা দিয়ে সামনে এগোই। 

এদিকে নিবিড় অরণ্য-বনতলে কাজল আঁধার। বিজলি চমকালো-বটবৃক্ষের তলায় কী যেন ঝলমল করে উঠল।  অরণ্যের বুক চিরে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ভিজে একদম নেতিয়ে পড়েছে। পাখিরা ঘুমিয়ে পড়েছে – ঝিমিয়ে পড়েছে বৃক্ষলতা-কাজল বন। দূরাগত কাঁসরের শব্দ শুনি? অন্ধকারে উড়ে এলো বাদুরের ঝাঁক। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে মেটে ছুঁচো দৌড়ে গেল চিঁহি চিঁহি করে। দিনমানের সবটুকু সবুজ ঘোর তমসায় একদম হারিয়ে গেছে। পাতলা ধোঁয়ার নেকাবে চারদিক 888sport app। তমসা গাঢ় হয়ে এসেছে। ঘন কালো বনান্তের মাথায় আবার উঁকি দিয়েছে ধূসর কাস্তে-নীল চাঁদ। রাত্রি যেন প্রশান্ত হয়ে এসেছে। কেঁপে উঠল আমার প্রশান্ত মন অপার্থিব আনন্দবিহারে। অতীত-ভবিষ্যৎ সব তুচ্ছ মনে হয় :

অতীতে ডুবিয়া থাকিও না

ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনিও না

বর্তমান মুহূর্তে মন দাও।

(বুদ্ধদেব)

কোথায় যেন পড়েছি, প্রকৃতি নাকি চায় না আমরা তার গতি ও রূপের স্বরূপ পুরোপুরি জেনে যাই। প্রকৃতি নিজেকে লুকিয়ে রাখে আলো-ছায়ার নেকাবে – পরতের পর পরত পর্দা ভেদ করে এর রহস্য খুঁজে নিতে হয়। আক্ষেপ হলো, একটা দুরবিন হলে বেশ হতো। তারাখচিত আকাশ কি রহস্যের শেষ আছে? হঠাৎ করেই উল্কাপাতের মতো কিছু হলে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। পায়ের তলার মাটি একটু কাঁপছে যেন। নক্ষত্ররাজির ক্ষীণ আলোয় দেখা যায়, পাহাড়ি অরণ্য ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে  ভয়ংকর দৈত্যের মতো। তিন প্রহরে শেয়াল ডেকে উঠল। উপবনে ঝংকৃত হলো পাখির ডাকের তরঙ্গ। আগল খুলে গেছে – ফুল ফুটল বাঁশঝাড়ে। এই নিস্তব্ধ চরাচরে চলে আলো-আঁধারের খেলা। বৃক্ষরাজির গায়ে বাতাসের দোলা লাগে – চিরায়ত ইসমের শব্দ শুনি – হু, হু।

অন্ধকার আকাশে ফুটে আছে অজস্র আলোর ফুল। তারার আলোর নিচে সবকিছু নিঝুম – জল, স্থল, অরণ্য। কোমল চাঁদ বুঝি গা-888sport app দিয়েছে। আসমান জুড়ে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। আমি বেকুবের মতো তারার রাজ্য শুমারি করি – এক, দুই, তিন – কোনো কূলকিনারা পাই না। ওই তো দেখা যায় সাতটি তারার তিমির – সপ্তর্ষি মণ্ডল। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো রাতের অরণ্যে। শুনেছি, তারকা-ধ্যান শুরু করতে হয় এরূপ নির্জন রাতে। একজন সাধকের পূর্বনির্দেশিত ধারায় একাকী ইসম জপ করতে করতে ধ্যানস্থ হতে হবে। একটু স্থির হয়ে আকাশভরা তারকাপুঞ্জের দিকে না তাকিয়ে কেবল একটা তারার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। সেই নির্দিষ্ট তারকার দিকেই প্রতিরাতে কিছুটা সময় বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই তারকাটিকে একদিন জীবন্ত মনে হবে, হঠাৎ অনুভূতি হবে – কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে সেই তারাটির আলো ধ্যানীর হৃদয়ে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে! কে এই গ্রহ-নক্ষত্র-সৌরজগতের মহান কারিগর? নিশ্বাস-প্রশ্বাস ধীর হয়ে হয়ে আসে…

আমি আচ্ছন্নের মতো প্রশ্ন করি, অন্ধকার, তোমার জন্ম

কোথায়? মন পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় – আলোর জন্ম

কোথায়? আমি স্বগতোক্তি করি, আলো কী? অন্ধকার কোথায়? মন জবাব দেয়, জ্ঞান হলো আলো, অবিদ্যার অপর নাম অন্ধকার। আচমকাই দূরে কোথাও হাতির ডাক শোনা গেল – কী ভয়ংকর নিনাদ! পুরো বন ও ডোবার জল কেঁপে কেঁপে উঠল। আমি প্রাণপণে ছুট দিলাম চালাঘরের দিকে।