ইহজাগতিকতার অনন্য অভিযাত্রী আনিসুজ্জামান

জনক-জননীর প্রতি অসীম 888sport apk download apk latest versionবোধ শিক্ষা-সংস্কৃতির অকৃত্রিম সচেতনতা, ইহজাগতিকতার অনমনীয় অভিযাত্রী হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নতুন করে পরিচয় দানের অপেক্ষা রাখে না। কেবল সম্মোহিত চিত্তে ফিরে দেখার তাগিদেই এই অকিঞ্চিৎ আয়োজন। বাইরে করোনা-আক্রান্ত দুর্যোগের পৃথিবী আর ভেতরে আমাদের মতো স্ববিরোধীদের মাঝে সাংস্কৃতিক ভুবনে অভিভাবকহীনভাবে দেশবাসীকে রেখে চলে গেলেন তিনি। আমরা বিমূঢ়চিত্তে দূর থেকে চেয়ে দেখলাম।
সুধাকর (১৮৮৯) 888sport live football পত্রিকার প্রবর্তক শেখ আবদুর রহিমের পৌত্র আনিসুজ্জামান। ২৪ পরগনার বসিরহাটের শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১) এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়ে কলকাতায় অবস্থানকালে ছোট-বড়ো ১১ খানা গ্রন্থ রচনা করেন। উদ্দেশ্য, দিগ্‌ভ্রান্ত মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলা। পিতামহের শোণিত ধারা আনিসুজ্জামানের ধমনীতে যে-সঞ্চরণশীল ছিল, তা লেখা বাহুল্য। শেখ আবদুর রহিম বাংলা ভাষার মাধ্যমে সামাজিক জাগৃতির পথে হেঁটেছেন, আনিসুজ্জামানও অনুরূপ। তবে পার্থক্য কালের আর সমাজভাবনার ধরনের। একজন স্বাতন্ত্র্যধর্মী, অন্যজন সমন্বয়বাদী।
সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ আনিসুজ্জামান ভাষা-আন্দোলনের কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে প্রচারপুস্তিকা রচনা করেছিলেন পিতামহের রক্তসূত্রে। আর বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়েছিলেন জননীর ভাষাশহিদের জন্য অকল্পনীয় 888sport apk download apk latest versionবোধ প্রত্যক্ষ করে। তাঁর জননী মৃত কন্যার সোনার মালা অঞ্জলি দিয়েছিলেন প্রথম শহিদবেদিতে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলতেন, চিকিৎসক পিতার নিয়মানুবর্তিতা এবং জননীর অকুণ্ঠ সততা তাঁর চলার পথের দিশারী।
বাইশ বছর বয়সে শিক্ষকতায় আসেন আনিসুজ্জামান। ছিলেন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনকার বিভাগীয় বিরূপ পরিবেশ এড়িয়ে চলার জন্য তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত, পাহাড়-অরণ্যবেষ্টিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। না, বানপ্রস্থে নয়, সে-বয়সও তাঁর হয়নি।
ষাটের দশকে তাঁর অক্ষয়কীর্তি বাংলা নববর্ষ ও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে সক্রিয় অংশগ্রহণ। সেই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ শিরোনামের একখানা অসাধারণ গ্রন্থের সম্পাদনাসহ 888sport app গ্রন্থের ফিরিস্তি দেব না। তবে বলে রাখা ভালো, কাল নিরবধি এবং জেগে উঠিলাম আমার এ-লেখার তথ্যের অন্যতম আকর।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মনীষার পরিচায়ক মুসলিম-মানস ও বাংলা 888sport live football গ্রন্থখানির সুবাদে ১৯৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আগমন ঘটে। ওই সময়ে ‘জুবেরি হাউসে’ একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে তিনি ছিলেন একক বক্তা। প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে আধুনিক বাংলা 888sport live footballে মুসলিম সাধনার লেখক ড. কাজী আবদুল মান্নান তাঁকে অনেক প্রশ্ন করেন। তিনি সব প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিয়ে সবার কৌতূহল প্রশমিত করেন। তখন থেকেই তাঁর বাচনশৈলী আর বক্তব্যের ঋজুতায় মুগ্ধ ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সে-আয়োজনের প্রায় সাতচল্লিশ বছর পর ২০১২ সালে রাজশাহী সাংস্কৃতিক উৎসবে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে তিনি আগমন করলে তাঁর সঙ্গে একান্ত পরিচয়ের সুযোগ হয় আমার। এ-যোগাযোগের আয়োজন করেছিলেন তখনকার রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান, যিনি কবি আসাদ মান্নান নামে খ্যাত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের জন্য আগরতলা হয়ে কলকাতায় চলে যান। সে-সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং মোশতাক আহমেদ তাঁকে যথাযথ সম্মান দেয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে আমন্ত্রণ জানালে তিনি এ.আর. মল্লিকের নেতৃত্বে প্রথমে 888sport apps শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারপর প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যুক্ত থাকার সুযোগ পান। এর নেতৃত্বে ছিলেন মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষার দিকটি দেখতেন। স্বাধীনতা-উত্তর 888sport appsে ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে তার অন্যতম সদস্য নিয়োজিত হন তিনি। কমিশনে থাকাকালে শিক্ষাক্ষেত্রে ইহজাগতিকতার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন আনিসুজ্জামান।
888sport appsের সংবিধান রচনায় তাঁর ভূমিকা কম নয়। সংবিধান বাংলাভাষায় রূপান্তরের তিনি অন্যতম কুশীলব। ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ – সবকিছুতেই অসামান্য অবদান রাখলেও ব্যক্তিগত ত্যাগের দাবি তুলে পদ-পদবির জন্য উদ্বাহু হননি, অথবা রাজনীতির ছত্রছায়ায় বিশেষ সুবিধাভোগের জন্য নির্লজ্জ উমেদারি থেকে সযত্নে দূরে থেকেছেন। সমাজ-সংস্কৃতি উন্নয়নে মানবিক ইহজাগতিকতার প্রতি তিনি প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন। এসব ব্যাপারে ছিল তাঁর স্বতঃপ্রবৃত্ত অংশগ্রহণ।
দৈববাদী পশ্চাৎপদরা ছাড়া সকল প্রগতিশীল মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সম্মানের পাত্র। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর মানববাদী ইহজাগতিক কল্যাণ চিন্তার পরিবর্তন হয়নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, 888sport appsকে যখন ‘উদ্ভট উটের পিঠে’ আসীন করে পাকিস্তানি ঘরানায় নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল কিছু ব্যক্তি এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়ে মসনদে বসানোর ছক এঁকেছিল, তখন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নীরব দর্শক থাকেননি। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুদ্ধাপরাধীদের জন্য গঠিত বিচারমঞ্চে অন্যতম কুশীলব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ’৯৬-এর পূর্ব পর্যন্ত তাই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহে খড়্‌গ মাথায় নিয়ে চলতে হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, সেই অপবাদে তাঁকে কানাডায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ভিসা দেওয়া হয়নি। এতে তিনি ভীতবিহ্বল হননি; বরং যা বিশ্বাস করতেন, তা কথায় ও কাজে প্রয়োগ করে দেখিয়ে গেছেন।
একজন আদর্শ শিক্ষকের অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্য তিনি ধারণ করতেন। এ-ব্যাপারে তিনি সমর্পিত সমঝোতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। যা ভালো বুঝেছেন করেছেন, কর্মসাধনায় সীমালংঘন করেননি।
আনিসুজ্জামান স্যার ঘরে-বাইরে অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁকে সম্মাননা প্রদানকারীরা নিজেরাই গর্বিত হয়েছেন। নিকট অতীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ওপর উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। রচনাটি নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে বসে লেখায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হয়ে দেশকে গর্বিত করেছিলেন আনিসুজ্জামান। এ ছিল তাঁর প্রখর শ্রুতধরতার পরিচায়ক। অথচ সমাজে দেখা যায় কিছু স্বঘোষিত শিক্ষাদিকপাল উলঙ্গ স্তাবকতার মাধ্যমে নিজের বা পরিজনের জন্য পদকপ্রাপ্তির পথ খোঁজেন। তিনি সে-জাতের মানুষ ছিলেন না। তাঁকে দেওয়া সম্মানের মর্যাদা রক্ষায় তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। শোনা যায়, অনেক রাজনীতিক তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন পাওয়ার আশা থাকতেন। তবে সে তুলনায় তাঁর পরামর্শ গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। এই দুঃখ বোধ তাঁর ছিল।
শিক্ষা কমিশনে যুক্ত থেকে তিনি মানবমুখী ইহজাগতিক শিক্ষায় প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন, সংবিধানে সন্নিবিষ্ট জাতীয় চার মূলনীতির প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে ইহবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠার কামনা ছিল তাঁর। হয়ে ওঠেনি। তবে বিশ্বাস হারাননি। মনে করতেন, মানবকল্যাণকামী সৎ রাজনীতিকগণই সমাজজীবনকে মানবমহিমায় অধিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবে। উল্লেখ্য, তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করেননি। যদিও শিক্ষার্থীজীবনে প্রগতিশীল ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল। কিন্তু শিক্ষকতায় এসে সেই প্রত্যক্ষ সংযোগ রাখেননি। লেখা বাহুল্য, একজন আদর্শ শিক্ষাব্রতীর নিজ কর্মকাণ্ডে মতবাদী হওয়া বেমানান। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জীবনাদর্শের সকল ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছিলেন। বিশ্বজোড়া করোনার নিদারুণ অকরুণ দিনে এই ইহজাগতিকতাবাদী অনমনীয় নিষ্ঠকর্মী চলে গেলেন। আমরা কজন তাঁর গুণগ্রাহী হতে পারবো, তার জন্য হয়তো দীর্ঘসময় প্রতীক্ষা করতে হবে।