এই ভোর, গোধূলি বিকেল

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল স্কুলের লেখার খাতায় পেনসিলে কাটাকুটি দিয়ে, তাও বেশ আগে, ১৯৪৬ সালে। তখনো দেশভাগ হয়নি। পাঠশালায় যেতেন, ক্লাসের ফাঁকে আঁকিবুঁকি করতেন। মামা ছিলেন ছবি আঁকার মানুষ। তাঁর ছোটবেলার ঈশ্বর পাঠশালা আর মামার অনুপ্রেরণা নিয়েই ছবির পথে যাত্রা করেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী। ছবি আঁকার স্বপ্ন তখন থেকেই একটু একটু করে এগোতে থাকে। সমরজিৎ রায় বাংলার প্রকৃতি আর মানুষ ভালোবাসেন। ইউরোপীয় ধাঁচের বিমূর্ত রীতির আশ্রয়ে বাংলাকে বর্ণনা করেছেন ক্যানভাসে। প্রকৃতিতে দেখা বৃহৎ রং-রেখা আর ফর্মের ভান্ডার থেকে চুম্বক অংশ নিয়ে আসেন ছবির বিষয়ে। কোনো অঙ্গীকার বা দায়বদ্ধতা থেকে তাঁর এই 888sport live chat সৃষ্টি নয়, মনের অনুভূতিকে মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যেই তাঁর সৃষ্টি।

দ্বিমাত্রিক তলে রেখা, বুনট আর রঙের সমাবেশে সমরজিৎ শুধু দৃশ্যকল্প তৈরি করেন না, তিনি প্রকৃতির ভেতরে চলতে থাকা জ্যামিতি আর উষ্ণ-শীতল রঙের চলাচলকে অনুভব করিয়ে দেন দর্শকদের। ক্যানভাসের গায়ে সৃষ্টিকর্মের প্রস্ত্ততিপর্বে বুনট আর রঙের প্রাথমিক প্রলেপ দিয়ে শুরু হয় কাজ। মূল কাজে যাওয়ার এ-প্রস্ত্ততিতে সমরজিতের ক্যানভাসে কিছু ফর্মের দেখা মেলে। শেষ পর্যন্ত সমরজিৎ জ্যামিতিকে হাজির করেন – বিষয়ের সঙ্গে। বিষয়, রং আর আকার-আকৃতি যূথবদ্ধ হয়ে তৈরি করে বর্ণিল ছবি। তাঁর ছবিতে একধরনের ধ্বনি শোনা যায়, যে-ধ্বনি প্রকৃতির ঋতুভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিশেল, নগরের সঙ্গে গ্রামের, নতুন শহরের সঙ্গে পুরনো শহরের একটা মৌলিক তফাৎ দেখাতে চান সমরজিৎ। কালের চাকায় ঘুরে পুরনো ঐতিহ্যলগ্ন ঘরবাড়ি লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেন না একবারও।

মনে হতে পারে, সমরজিৎ শুধু মৌলিক রঙে আকার-আকৃতি নিয়ে নিরীক্ষায় ব্যস্ত। মনে হয়, সুনির্দিষ্ট কমিটমেন্ট নিয়েই তিনি এগিয়ে যান। পিকাসোর কিউবিস্ট আন্দোলনের ফলে প্রতিষ্ঠিত ঘনকবাদের আশ্রয় নেওয়া সৃষ্টিকর্মের মূলসূত্রে ছিল জ্যামিতি। এর ভেতর দিয়েই সমরজিৎ ছবি আঁকার বিষয়কে দেখেন। বিষয়বস্ত্তকে দেখার জন্যে বেছে নেন – কাছে, দূরে পাখির দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতকে। এখানে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, জ্যামিতিক বিন্যাসের কারণে কোনো কোনো ছবিকে কখনো শুধু নকশা বা আলঙ্কারিক সৃষ্টি মনে হয়। সমরজিৎ গ্রাফিক ডিজাইনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণকালে একেবারে বাস্তবধর্মী ফর্মের 888sport live chat-নির্মাণের সঙ্গে নকশা যুক্ত করেছিলেন। বিমূর্ত চিত্রকলার বিশুদ্ধ রীতি অনুসরণের পথে সমরজিৎ না এগিয়ে আড়াআড়ি, উল্লম্ব রেখার আড়ালে বাস্তবানুগ নির্মাণরীতিকে বেছে নেন। তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে সমরজিতের চিত্রকলার পাঠ নেওয়া যায়।

সমরজিতের ক্যানভাস প্রস্ত্ততি নেওয়ার সময় সাদা জমিনে লেপ্টে দেন প্রাথমিক রঙের ওয়াশ। প্রাথমিক অবস্থা থেকে তুলে এনে তাতে আলোছায়া ভাগ করে নিয়ে বিষয়ের অবয়ব গড়ে তোলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে রেখার ব্যবহারে একটি পূর্ণ ক্যানভাস তৈরি করেন। গ্রাম, শহর, সভ্যতা, অগ্রগতি, এসবের পাশাপাশি মানুষের মুখাবয়ব হাজির হয়ে যায় বিষয়ের সঙ্গে। চেনা-অচেনা দিগন্তের রং কখনো ক্যানভাসে হাজির করান। আকাশের রংগুলো বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেখান। পূর্বাচল থেকে উত্থিত হয়ে রং স্পষ্ট হয় প্রভাত-তারার মতো। জ্যামিতির উল্লম্ফন,  আলোর নাচন, কেন্দ্রহীন দূরত্বে আচ্ছন্ন সমরজিতের শৈশবের দুরন্তপনা, ষোলো ঘুঁটি খেলার ছক-কাটা ঘরের 888sport sign up bonus, বাড়ির বাইরে পুকুরের জলে প্রতিচ্ছায়ায় ভেসে-ওঠা গাছগাছালির সবুজ 888sport sign up bonus ক্যানভাসে এসে দাঁড়ায়। মাঠ, আকাশ, পায়ের নিচে মাড়ানো ঘাস, মাথার ওপর ছাউনি দেওয়া আকাশ। রাতের তারার সঙ্গে কথা হয় 888sport live chatীর। মৃদু বাতাস চোখ ছুঁয়ে দেয়। শব্দ-অনুভবে রোমান্টিকতার ছাপ। রঙের স্ফুরণ ক্যানভাসকে দ্যুতি দেয়। লাল, বেগুনি, বান্টসিয়েনা, ক্যাডমিয়াম ইয়েলো, নীলচে সবুজ, সবশেষে কালো রঙের আকৃতিতে মিশে যায় জ্যামিতি। দু-একটি ছবি নিয়ে আলোচনা করলে সমরজিতের বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ছবির ক্যানভাস ১০৫ x ১০৫ সেন্টিমিটার শিরোনাম – ‘ওল্ড 888sport app সিটি’। পুরনো শহরের বাড়ির অবয়বে থাকা জানালা, দরজায় আড়াআড়ি খিড়কি আঁটা, উপরিভাগে নকশা করা। এ-বাড়ির প্রসঙ্গে 888sport live chatী বলেন, এমন করে ‘খুব ভোরে যখন দরজা জানালা খুলে দেই তখন আলোর সাথে দরজার ছায়া এসে পড়ে আমার ঘরে।’ আলট্রামেরিন নীলের ব্যবহারে মাঝে মাঝে বাড়ির আকৃতির ফাঁকে আকাশ দেখা যায়। এই শহরের ঢেকে যাওয়া আকাশের রং এমনভাবেই দেখা যায়। বিস্তীর্ণ মাঠের একাকী পড়ে থাকা ছোপ ছোপ রঙের আকৃতিকে 888sport live chatী নাম দিয়েছেন ‘সং অব লাইনস’। ‘অ্যা মোমেন্ট অব লাভ’ শিরোনামের ছবিতে বেগুনি, লাল ত্রিকোনা নিশানের আড়ালে নর-888sport promo codeর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তকে উৎকীর্ণ করেছেন বেগুনি রঙে। শৈশবে দেখা বিয়েবাড়ির সাজানো দেখে 888sport sign up bonusতে গেঁথে রেখেছেন ঘুড়ির কাগজে বানানো নিশান। মোহাম্মদ কিবরিয়ার সুন্দর রঙে সাজানো ফর্মের আভাস পাওয়া যায় সমরজিতের ছবিতে। ছবির মাঝে চলতে থাকা আড়াআড়ি উল্লম্ব রেখার উপস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি মনে করি, ছবির লাইনটাই হলো এর প্রাণ, লাইন দিয়েই ফর্ম হয়। লাইন টেনে টেনে বৃত্ত করতে পারি, চতুর্ভুজ বানাতে পারি, ত্রিভুজ বানাতে পারি, এই তিনটা জিনিস দিয়েই আমি ছবি আঁকি। আর সর্বত্রই লাইনের ছড়াছড়ি। রাস্তায় গিয়ে চোখ খুললেই দেখা যায় লাইন। ওই লাইনটাই আসলে প্রাণ। লাইন গান গাইতে পারে। লাইন ছোটাছুটি করে। লাইন খেলে।’

মোট ৭১টি কাজের মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ রয়েছে। অ্যাক্রিলিক, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, উডকাট মাধ্যমের ছাপচিত্রের মধ্যে সহজেই সমরজিতের রেখাপ্রধান কাজের অভ্যাস খুঁজে পাওয়া যায়। রঙের সাবলীল বিন্যাস, রেখা আর ফর্মের শক্তিশালী বন্ধন আমাদের কাছে অতিচেনা সমরজিৎ রায় চৌধুরীর কাজকে নতুন করে চেনায়। রঙের দ্যুতি আর গতিময় রেখার এই যাত্রা অব্যাহত থাকুক। বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে গত ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ২২ সেপ্টেম্বর।