এই মাটিতেই শেকড় খুঁজি

বড় হলরুমটার পাশের ছোট ঘরে আমি, ইউনুস, নীলু, রনি কাজ করছিলাম। সে-ঘরে তখনো আলো জ্বলছিল। একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল নীলুকে। বাইশ/তেইশ হাত লম্বা একটি অজগর সাপের চামড়া বিছিয়ে তার পাশে বসে গভীর মগ্ন হয়ে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের ওপর চোখ লাগিয়ে কী যেন দেখছে। ওকে বিরক্ত না করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দায় টেবিলগুলোতে ছড়ানো রং, তুলি, কাটার, প্লেট, ছেঁড়া বোর্ড ইত্যাদি অনেককিছু। বারান্দা থেকে ইটের পথ বেয়ে বংশীর ঘাটে এলাম। বংশীর শরীরে জোয়ার লেগেছে। প্রবল তোড়ে পানি চলেছে ইচ্ছামাফিক। ঘাটে নৌকাটা দুলছে। ঘাটের ওপরে লাল ব্যানারে লেখা – ‘কোলাজ-কল্প’।

সকালে বেঙ্গল জুট ফ্যাক্টরির আকাশ-রঙা নৌকায় চড়ে আমরা সতেরো জন 888sport live chatী এপাড়ের রেস্ট হাউজে এসেছি। আজ ১৫ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কোলাজ-কর্মশালা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই আয়োজন করছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে কর্মশালায় যোগদানের আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম। তাতে লেখা, কর্মশালা হবে চারদিনব্যাপী। সাভারের বেঙ্গল জুট ফ্যাক্টরির রেস্ট হাউজে, স্পেন-প্রবাসী 888sport live chatী মনিরুল ইসলাম এটি পরিচালনা করবেন। কর্মশালার 888sport live chatীরা পুরো সময়টি কর্মশালাস্থলে অবস্থান করবেন।

প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে বেঙ্গল রেস্ট হাউজ। রেস্ট হাউজের খোলা টেরাসে দাঁড়ালে দেখি রুপালি ফিতার মতো বংশী নদী মনের গাঙে ঢেউ তুলে বয়ে চলেছে, 888sport live chatীকেও যে সঙ্গে নিয়ে যায় তার প্রমাণ মিলেছে রফি, বেবুল, সিদ্ধার্থের ছবিতে। আমাদের ঘরের বারান্দার ওপাশের মেহগনি বনে পাখিরা রব তুলত সকাল-সন্ধ্যা। কদম ফুটিয়েছিল ফুল, নীলু ক্যানভাস সাজিয়েছিল তা দিয়ে। বনলতা, ফার্ণের ঝোপ, বংশীর আকাশ রং ছড়িয়ে দিয়েছিল সবদিকে। সবমিলিয়ে কী মনোহর 888sport live chatিত পরিবেশ!

কর্মশালা শুরুর আগের দিন অর্থাৎ ১৪ জুন বেঙ্গল 888sport live chatালয়ে অনুষ্ঠিত হলো 888sport live chatী ও সাংবাদিক-সম্মেলন। মনিরুল ইসলাম কর্মশালা কেমন হবে তা নিয়ে বললেন, ‘আমাদের অনেক ম্যাটেরিয়াল ও পিগমেন্ট আছে। যেমন – গ্রে বোর্ড, করোগেটেড বোর্ড এবং পিগমেন্ট বলতে চালের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, সিঁদুর, এলামাটি। এসব লোকাল ম্যাটেরিয়ালের উপযুক্ত ব্যবহার আমরা করিনি। এগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নতুন 888sport live chatভাষা তৈরি হতে পারে, ম্যাটেরিয়ালের গুণাগুণ বোঝা যাবে। তাছাড়া এগুলো সহজলভ্য এবং দামে কম। এসব ব্যবহার করে কর্মশালায় আমরা চেষ্টা করব এমন কিছু করতে, যা সাধারণত করা হয় না। একবার আমি কয়েকটি গ্রে বোর্ড স্পেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা এগুলো পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিল। তবে এসব বোর্ডে কিছু অসুবিধাও আছে। এসবে পোকার আক্রমণ হয় দ্রুত এবং রং ফেইড হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। ওয়ার্কশপে এগুলোকে টেকসই করার পদ্ধতিও খুঁজব।’

 ১৫ জুলাই সকাল দশটার মধ্যে আমরা হাজির হয়ে গেলাম বেঙ্গল 888sport live chatালয়ে। এখান থেকে গাড়ি রওয়ানা দিল বংশী ঘাটের উদ্দেশে। ওপারে সাভারের শিশু888sport live chatীরা অপেক্ষা করছিল আমাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য।

আমরা রেস্ট হাউজের টেরাসে উঠে এলে বেজে উঠল মন্দিরা ও ঢোল। লাল ফ্রক পরা শিশুরা নাচল, পরে গাইল, ‘এসো নীপবনে…’। বৃষ্টি এলো এই সময়েই। আমরা চায়ের টেবিলে গিয়ে বসলাম। আলাপ জমল, কীভাবে কাজ হবে, কী দিয়ে হবে – এসব নিয়ে। মনিরুল ইসলাম গেলেন কিচেনে, আমরাও গেলাম। সেখানে দ্ুিট চুলার একটিতে গাদের আঠা, অন্যটিতে চালের গুঁড়া পুড়ছে। দুটি মিশিয়ে তৈরি হলো ধূসর কালচে রং। মনিরুল ইসলাম আমাদের জানালেন, এটিকে কীভাবে এলামাটি, চকপাউডার বা অ্যাক্রামিনের সঙ্গে মিশিয়ে বোর্ডের ওপর ব্যবহার করতে হয়। আমরা কাজে বসলাম। সন্ধ্যা হলো। রাতের খাবারের পরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আগের কর্মশালার ওপর নির্মিত ছবি দেখলাম। ঘুমাতে গেলাম। নীলু তখনো কাজ করছিল।

মনিরুল ইসলাম আমাদের দলটিকে সারাক্ষণ উদ্দীপিত করছেন। তিনি বলছেন, ‘নিজের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করো। কারু দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কী দিয়ে কেমন করে কাজ করবে এ-ব্যাপারে আমি সাহায্য করব।’

পরের দিন ভোরে উঠেই দেখি রং, প্যালেট সংগ্রহ করে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। দোতলায়, নিচতলায়, বারান্দায়, টেরাসে, ফুল-ছাওয়া সবুজ মাঠে, মেহগনির বনে ছড়িয়ে পড়ে 888sport live chatীরা মগ্ন            হয়েছেন 888sport live chatরচনায়। অনেকে ডালপালা, পোড়াকাঠ খুঁজছেন, রনজিৎ দাস বেঙ্গল জুট থেকে পাটের রঙিন সুতা, ছোবড়া সংগ্রহ করে এনেছেন।

কে কেমন কাজ করলেন কর্মশালায়

হামিদুজ্জামান খান : নতুন উপকরণ পেয়ে তিনি বেশ উত্তেজনায় আছেন। আমাকে বললেন, ‘বুঝলে তরুণ, সাদার মধ্যে সাদার কাজ শুরু করলাম। সাভারের রাস্তায় ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এই জংধরা টিনের টুকরোটি পেয়েছি, এটি ব্যবহার করব।’ যে-কাজটি করেছেন সেটি এমন- সুতা দিয়ে শুকনা ডাল করোগেটেড বোর্ডের ওপর ঝুলিয়ে দিয়েছেন, বোর্ডের মসৃণ আস্তরণ কেটে ভেতরের করোগেটেড দাগগুলো প্রকাশিত করেছেন, ফলে খুব সহজ একটি শৈল্পিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।

রনজিৎ দাস : তিনি করোগেটেড বোর্ডের ওপর দুই পিস কাঠের টুকরো এবং র‌্যাদা করা কাঠের দৃশ্যমান ছিলকা পেস্ট করে কালো রং ঢেলে দিয়েছেন। বললেন, ‘যোগসূত্রের উপস্থাপনা করেছি, আমি রিয়েলিটির পুনরাবৃত্তি করি না, রিয়েলিটির অন্য কোনো রূপ খুঁজি।’

অলকেশ ঘোষ : বললেন, ‘এখনো কাজ শুরু করিনি। মনির স্যার আমাকে পাশ দিব না, বুঝলা?’ তাকে পরের দিন দেখলাম দু-তিনটি কাজ শেষ করতে। কীভাবে শেষ হলো ঠাহর করতে পারিনি। বললেন, ‘এবার নতুন কিছু করার চেষ্টা করলাম, পুরনো পদ্ধতিতে করলাম না।’

মোহাম্মদ ইউনুস : তিনি ছয় পিস কাগজ লম্বালম্বিভাবে জোড়া দিয়েছেন। মাঝে তৈরি করেছেন একটি বৃত্ত। তার মাঝে তৈরি করলেন আরেকটি বৃত্ত। সব মিলিয়ে একটি ত্রিকোণ তৈরি হলো। ওপরের দিকে ছয়টি বক্স বোর্ড পেস্ট করলেন। জমিনে ধূসর রঙের আবরণ। আমার মনে হলো, সারিবদ্ধ কংক্রিটের কাগজের বাক্সের মতো দালানগুলো নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরো দুটি কাজ শুরু করেছেন সিডি পেস্ট করে।

গোলাম ফারুক বেবুল: তাঁর বোর্ডের কাটা-ছেঁড়া অংশগুলো প্রায়ই মনে করিয়ে দেয় নৈসর্গিক আবহের কথা। কালচে নীল রঙের মধ্যে ছোট ছোট দাগগুলো কখনো আকার বা ফর্মের পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে বেবুল গড়ে তুলেছেন কিছু অস্তিত্ব।

সিদ্ধার্থ তালুকদার : বাস্তব ও কল্পনার মিশেল তাঁর ছবিতে। মনে হয়, অবচেতনে গড়ে তুলেছেন এক সচেতন স্তর। রঙের জটিল যোগ-বিয়োগে তৈরি করেছেন এক মানবিক সরলতা। বলছিলেন, ‘কর্মশালায় যোগ দিয়ে কাজের আগ্রহই বেড়ে গেছে।’

আহমেদ শামসুদ্দোহা : বোর্ডের কিছু অংশ কেটে ভেতরের ঢেউ ঢেউ টেক্সচার প্রকাশিত করে এক স্বপ্নময় প্রকৃতি-জগৎ প্রকাশিত করেছেন শামসুদ্দোহা। আগে তাঁর এমন কাজ ক্যানভাসে দেখেছি, বোর্ডে করাতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে।

শিশির ভট্টাচার্য : মাটি আর পরিবেশ মিলিয়ে 888sport live chatকর্মের কাঠামো গড়েছেন। তিনি কাঠ দিয়ে ভাগ করে বোর্ডের ওপর খোপ তৈরি করেছেন। খোপগুলোর মাঝে তিন রঙের মাটি। গাছ থেকে ঝরে-পড়া পাতা জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর কাজ মনে পড়িয়ে দেয়, কোথায় কবে যেন প্রকৃতি আধো আধো গন্ধ ছড়িয়েছিল।

দিলারা বেগম জলি : ক্যানভাসে নীলের আবহ তৈরি করে তার ওপর খুব আবছা করে কাগজের নৌকা বসিয়েছেন। পেস্ট হয় না কিছু আভাস

দেয় মাত্র।

রফি হক : বোর্ডের ওপর নানা রঙের কাগজ পেস্ট করে তার ওপর রঙের প্রলেপ – কখনো কখনো অমসৃণ। বাস্তব জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথা, অনুভূতি – রফিও ছবিতে পরিস্ফুট। রহস্য আছে, নীরবতা আছে এখানে।

উত্তম কুমার রায় : বয়সে সবার ছোট সে। সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা নিয়ে কাজ করে চলেছে। একসঙ্গে এতজন 888sport live chatীর সঙ্গে এই প্রথম কাজ   করছে উত্তম। কোনো জড়তা নেই। প্রকাশভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত। টেকনিকের ওপর জোর দিয়েছে।

আরো অনেকের কথা বলা হলো না। রনি আহম্মেদ, সুলেখা চৌধুরী, নীলুফার চামান, শাজাহান আহম্মেদ বিকাশ, তৈয়বা বেগম লিপি প্রমুখ সকলেই ছিলাম একসঙ্গে। একটি কথা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সবাই অনাবিল আনন্দে কাজ করেছে, উৎসাহ ছিল প্রবল।

হাতের কাছে যা পাওয়া যায় সে-সকল নানা উপাদান ব্যবহার করে যে ছবি আঁকা যায় তার উৎসাহ যুগিয়েছে কর্মশালা। এ-কর্মশালায় যে-অভিজ্ঞতা হলো তা একদিন হয়তো 888sport live chatকলার নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে। যেভাবেই হোক নিজস্ব 888sport live chatভাষার সন্ধান 888sport live chatীকে করতেই হবে, নয়তো 888sport live chatী অনুকরণপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। আর অনুকরণের 888sport live chatে আকার থাকে, অনুভব থাকে না। মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘সৃষ্টি আর নতুন কী করবা, সবই তো হয়ে গেছে বা হয়ে আছে। আমরা শুধু পারি আমাদের নিজেদের মতো করে, নিজেদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশ করতে। সেটাই নতুনত্ব, তা-ই আধুনিকতা।’

আধুনিকতা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে, প্রশ্ন আছে। তবে তার সঠিক উত্তর আছে নিজের কাছেই। আত্ম-অনুসন্ধানই সবচেয়ে ভালো উত্তর খুঁজে দিতে পারে, কী করতে হবে এবং কেন? আমার মধ্যে কোনো-না-কোনো অভাব আছে তাই অনুসন্ধানে বসি, শিকড় খুঁজি এই জমিতেই, এটিই আমাদের প্রত্যয়। এই কর্মশালা প্রশ্নগুলোকে বিস্তৃত করেছে, সেইসঙ্গে উত্তরগুলো নিকটবর্তী করেছে। 

কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী 888sport live chatীরা প্রত্যেকেই পাঁচ-ছয়টি করে কাজ করেছেন। প্রত্যেকটি ছবিই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে 888sport live chatীর নিজ-চিত্রশৈলীর মধ্য দিয়ে। আমরা যে-কদিন এই কর্মশালায় ছিলাম সৃষ্টির উন্মাদনা আমাদের পেয়ে বসেছিল। আমরা যে-যার মতো জায়গা বেছে নিয়ে কাজ শুরু করেছি। প্রত্যেক 888sport live chatীর চিত্রভাষা আলাদা। এই চিত্রভাষার নির্মাণ যখন সৃষ্টির উন্মুখতা নিয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপ ও অবয়ব পেয়েছে, সবাই অবাক হয়েছে। 888sport live chatী মনিরুল ইসলাম কাজ করবার জন্য, কম্পোজিশনে নতুন মাত্রা সৃষ্টির জন্য সকলকে      উৎসাহ দিয়েছেন। নিজেও কাজ করেছেন।