কাজীবাড়ির বৈঠকঘরের সামনে থেকে একটা সরুপথ দক্ষিণের বায়ু ঠেলে লাউয়ের মাচান ও পানাজলাটা ছুঁয়ে নদী আইলে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়েছে। নদী আইলের উত্তরেই মূলত বসতবাড়ি। দক্ষিণে চরাভূমি। তবে বংশবিস্তারের হারানো তালে দক্ষিণের চরাভূমিতেও বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা বসতবাড়ি উঁকি মারছে। এদের কতকটা পুরনো, কতকটা নতুন।
জাহিদ কাজীবাড়ির সরুপথটা মাড়িয়ে নদী আইলে উঠে পুবে দৃষ্টি ফেলল। পৌষের উত্তুরে হাওয়া বৈদ্যনাথ বিলের গা বেয়ে এসে তার মুখ, চোখ ও সমস্ত শরীরে আছড়ে পড়ল। ওয়াপদার নদী আইলটা নতুন করা হয়েছে। গোমতী নদীর সমান্তরালে আইলটা কোম্পানীগঞ্জ থেকে মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের পাশ কেটে হীরাকান্দা, সিমলাই, দিলালপুরের বুক চিরে অনেকদূর চলে গেছে।
কুমারবাড়ির পোড়ামাটির ঝাঁজ সয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুবের দীর্ঘ তালগাছটা দিয়ে দিলালপুর গ্রামের শুরু। সূর্যটা যেন সেই তালগাছটার গা বেয়েই ধীরে ধীরে উঠছে। জাহিদ লাল রং থেকে সোনালি-হলুদ রং হয়ে ওঠা সূর্যটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরক্ষণ দৃষ্টি ঘুরিয়ে কী ভেবে পশ্চিমমুখো হাঁটতে শুরু করল। বৈদ্যনাথ বিলের এ-মাথাটা চিকন। বিলটা হঠাৎ করেই যেন নদী আইলে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। বিলের চিকন মাথার ওপাশে গোরস্তান।
জাহিদ গোরস্তানের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দুজন মানুষ দেখতে পেল। পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল বলে দূর থেকে মানুষ দুটোর চেহারা ঠিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে না।
জাহিদ গোরস্তানের দিকে এগিয়ে গেল। গোরস্তানের কাছাকাছি হতেই সে মানুষ দুটোকে চিনতে পারল। কিন্তু ওদেরকে চিনতে পেরেই তার চোখদুটো যেন কপালে উঠল। তার দৃষ্টির সামনে কী এক ভ্রমদুয়ার খুলে গেল। সে ভাবল, এ কি ভ্রমদুয়ারের উন্মুখ মুখ, নাকি অন্যকিছু?
রজব আলী মাস্টার লম্বা আলখেল্লা পরে আছেন। আলখেল্লার রং ধবধবে সাদা। মাথার টুপিটাও ধবধবে সাদা। মুখে চাপদাড়ি। মেহেদি রং করা চাপদাড়িতে সকালের সোনা রং রোদ পড়ে কেমন চকচক করছে।
জাহিদ নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, কেমন আছেন?’
হঠাৎ নতুন বেশে জাহিদের সামনে পড়ে রজব আলী মাস্টার খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণই তিনি সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হ ভালা, ভালা আছি। তুমি কেমন আছ?’
‘জি স্যার, আমি ভালো।’
‘আমি শুনেছি তুমি কাইল বিকালে আইছ। তয় বউবাচ্চাদেরকে কি লগে নিয়া আইছ?’
‘না স্যার। আমি একাই এসেছি।’
‘কয়দিন থাকবা?’
‘তিন সপ্তাহ’।
‘তা হঠাৎ একলা আইলা?’
‘মাকে নিয়ে যেতে এসেছি’।
‘অ, চাচিরে নিউজিল্যান্ড লইয়া যাইবা? ভালা ভালা।’
‘জি স্যার। মার এখানে থেকে আর কী লাভ? একা মানুষ। ভিসার অ্যাপ্লাই করলাম। হয়ে গেল। তাই নিতে এসেছি।’
‘হ, ওইটা ঠিকই কইছ। তয় আমাদের বাড়িতে একদিন আইস।’
‘জি, স্যার। আসব।’
‘আইচ্ছা, আমি অখন যাই। আমার তাড়া আছে। তুমি অবশ্যই আইস কিন্তু।’
জাহিদ বলল, ‘অবশ্যই, স্যার।’
ওরা গোরস্তান থেকে উঠে একটা সরু আইল ধরে দক্ষিণমুখো হেঁটে চলে গেলে জাহিদ ওদের গমন পথের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর নিজে নিজেই মাথা ঝাঁকাল। কী ভেবে দৃষ্টির ওঠানামাও করল। এদিকে সকালের রোদটা আরো স্পষ্ট সোনারং ধারণ করেছে। কুয়াশা আরো কেটে যাচ্ছে। সকালের রোদটা নরম হলেও কেমন চোখে লাগছে।
জাহিদ নদী আইল ধরে আরো খানিকক্ষণ পশ্চিমমুখো হাঁটতেই দেখল, মতিন মিয়া তার দিকে হনহন করে এগিয়ে আসছে। মতিন মিয়া তার ছেলেবেলার বন্ধু।
মতিন মিয়া কাছাকাছি আসতেই জাহিদ একটা দিঘল হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে মতিন যে, কী খবর?’
মতিন মিয়া কৃত্রিম বিরক্তির গলায় বলল, ‘আরে রাখ তোমার খবর। আমি তোমারে এক ঘণ্টা ধইরা খুঁইজ্যা মরতাছি। তোমার বাড়িত গেলাম। চাচি কইল, তুমি বাইর হইয়া গেছ। পাতবমনে বের হইছ।’
‘কী 888sport slot gameে?’
‘আরে হইছে। বুইঝ্যা লও।’
দুই
গোমতী নদীঘেঁষা পুরনো আইলটা দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধের বলি ওঠা ত্বকের মতো। সর্বত্র উঁচুনিচু ও ধার কুঁচকানো। একসময় পুরনো আইলটাই ছিল প্রধান গ্রামপথ। কিন্তু ওয়াপদা বোর্ডের নতুন আইলটা হওয়ার পর পুরনো আইলটার অবস্থা হয়েছে যেন দিলালপুরের সুন্দর চেয়ারম্যানের নতুন বিয়ে করা অষ্টাদশী বউয়ের পাশে তার গালভাঙা প্রথম বউয়ের ছবি। যেন তার শরীরের ওপর জল ভাঙে, পলল পড়ে, কিন্তু বানের জলকে ঠেকিয়ে রাখার সামর্থ্য নেই।
জাহিদ নদীর নতুন আইলটা ধরে রজব আলী মাস্টারের বাড়ির দিকে হাঁটছে। গোরস্তানের পশ্চিমপাশের একটা ইশা, তারপরেই তার বাড়ি। আজ সকালে হাঁটতে বের হওয়ার সময়ই সে রজব আলী মাস্টারের বাড়ির কথা মাথায় রেখে বের হয়েছে। এমনিতেই দেশে আসার পর পাঁচদিন চলে গেছে। সে মাঝখানে দুই দিন 888sport appয় থেকে এসেছে।
রজব আলী মাস্টার জাহিদের হাতেখড়ির শিক্ষক। তিনি শুধু তার হাতেখড়ির শিক্ষকই নন, তরুণ বয়সে তার রাজনীতির শিক্ষাগুরুও। কলেজে পড়াকালীন তার সংস্পর্শে গিয়ে সোভিয়েতপন্থী সোশালিজম-কমিউনিজম, কত কী শিখেছে! সেই নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে না গেলে সে হয়তো এতদিন নিউজিল্যান্ডে না গিয়ে মস্কো কিংবা ক্রেমলিনে থাকত।
জাহিদ জানে, রজব আলী মাস্টার বরাবরই ভাঙা কপালের এক উনপাঁজুরে মানুষ। তার কোথাও কোনো ভিত গড়ে ওঠেনি। সংসারের গ্যাঁড়াকলে পূর্ণ হতে হতে বরাবরই অনাকাক্সিক্ষত হোঁচট খেয়েছেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি বেশ ভালোভাবেই পাশ করেছিলেন। কিন্তু খুব গরিব ঘরের ছেলে বলে টাকা-পয়সার অভাবে তিনি আর কলেজে পড়তে পারেননি। লোকবল বা টাকা-পয়সার অভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে না পেরে শেষে একটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত-আট বছর মাস্টারি করেন। কিন্তু একটা সময় বিনা কারণেই স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়। বছরকয়েক কর্মহীন থেকে এদিক-ওদিক থেকে ধারদেনা করে মুরাদনগর বাজারে একটা বই ও কাগজ-কলমের দোকান দেন। দোকানটা ভালোই চলেছিল। এরই মধ্যে তিনি বিয়ে করেন। পরপর তিনটা ছেলে হয়। কিন্তু বইয়ের দোকানটা প্রায় এক যুগ চালিয়ে শেষে কী কারণে যেন বন্ধ করে দেন…!
গোরস্তানটা পার হতেই নদীর নতুন আইল থেকে দক্ষিণে একটা সরুপথ নেমে গেছে। সরুপথটার দু-ধারে পরপর দুটো বাড়ি। হাতের বাঁপাশের শেষবাড়িটাই রজব আলী মাস্টারের।
সরুপথটার মাথায় কয়েকটা রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাহিদ বেশ কৌতূহল বোধ করল। রিকশাওয়ালা ও অটোরিকশা ড্রাইভাররা এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরপাড়ার হারেস মিয়া ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আরোহীদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে।
জাহিদ হারেস মিয়াকে ডাকল, ‘এই যে হারেস, শোনো।’
হারেস মিয়া কয়েক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘জি, কাজী সাব?’
জাহিদ জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে এত রিকশা ও অটোরিকশার ভিড় কেন?’
হারেস মিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘অ কাজীসাব, আপনে রজব আলী মাস্টরের খোয়াবের কথা জানেন না?’
‘না তো, কীসের খোয়াব?’
‘ওমা, তিনি না গেল বছর খোয়াবে পিচা পাইছেন?’
‘কী পাইছেন?’
‘পিচা, একটা ভাঙা পিচা।’
‘কী যা-তা বলছ?’
‘হ, আমি ঠিকই কইতাছি। তিনি খোয়াবে পিচা পাইছেন। হেই পিচা দিয়া যে কোনো বেরাইম্যা রোগীরে তিনবার ঝাড়া মারলে রোগী ভালা হইয়া যায়।’
‘কী বলো এসব?’
‘জি, ঠিকই কইছি। তিনি তো পিচা-হুজুর।’
‘পিচা-হুজুর?’
‘হ, কাজীসাব। শুক্কুরবারে তিনি সবাইরে আইতে কন। মাঝবেলা পর্যন্ত লম্বা লাইন থাকে। মাঝবেলার পর তিনি আর রোগী দেখেন না। কত দূর দূর থাইক্যা রোগী আসে, জানেন!’
জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে হারেস মিয়ার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে অবিশ^াস ও দ্বন্দ্ব নিয়ে রজব আলী মাস্টারের ইশার দিকে পা বাড়াল।
রজব আলী মাস্টারের বাড়িতে ঢুকতেই জাহিদের ভেতর একটা অবিন্যস্ত স্তব্ধতা জমা হলো। কয়েকটা বাঁশপাতা শরীর বুলিয়ে উড়ে এসে তার পায়ের কাছে পড়ল। একটা পাতিকাক রান্নাঘরের ছনের চালে বসে অনবরত ডাকছে – কা কা, কা কা, কা কা। একটা বেড়াল দোচালা বৈঠকঘরের সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। উঠোনে বেশ আলোছায়ার খেলা।
বাড়ির প্রবেশপথ থেকে ঘরের দাওয়া পর্যন্ত মানুষের দীর্ঘ লাইন।
রজব আলী মাস্টার ঘরের দাওয়ায় একটা চেয়ার পেতে বসে আছেন। তার হাতে অতি পুরনো একটা ঝাড়ু। তার চোখ বোজা। তার সামনে আধহারা শরীরের 888sport promo code-পুরুষরা একে একে ঝুঁকছে। ওদের কারো কারো হাতে আবার মোবাইল ফোনও।
তাজুল মিয়া 888sport promo code-পুরুষদের সারি সামলাতে ব্যস্ত।
তিন
একদলা অন্ধকার যেন উঠতি রাতটায় হাঁটতে হাঁটতে হারিকেনের চিমনির কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। ঘরে ও বাইরে শীতের স্তব্ধতা। জাহিদ উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইলে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। 888sport appsে উঠতি রাত হলেও নিউজিল্যান্ডে তখন অনেক রাত। 888sport appsের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের সময়ের পার্থক্য সাত ঘণ্টার।
জাহিদের কথা শেষ হয়ে এসেছে, ঠিক তখনই বাইরে থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে মিহিসুরে ডেকে উঠল, ‘জাহিদ, ও জাহিদ।’
জাহিদ জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’
বাইরে থেকে মানুষটা বলল, ‘আমি মতিন।’
‘আরে মতিন, কী খবর? তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
‘আমার খুব বিপদ।’
‘কী হয়েছে?’
‘বলতাছি। আগে ভিতরে আসি।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি আগে ভেতরে আসো।’ বলেই জাহিদ আধশোয়া ছেড়ে উঠে বসল। দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘দেখো তো কী, একবেলা কারেন্ট থাকে তো বাকি তিনবেলা আসার নামগন্ধ থাকে না। এভাবে তোমরা চলো কীভাবে?’
মতিন মিয়া অন্যসময় হলে হে হে হেসে সায় দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা বলত। কিন্তু এখন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একদম চুপ হয়ে গেল। তার চেহারা ফ্যাকাসে ও বিধ্বস্ত।
জাহিদ জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে মতিন, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘আমার পোলাটা…’
‘তোমার ছেলে, মানিক? তার কী হয়েছে?’
‘আমার পোলাটা মইরা যাইতাছে। হেয় দুপুর থাইক্যা দশবার রক্তবমি করছে। অখন আর বিছানা থাইক্যা উঠতে পারতাছে না।’
‘বলো কী, ডাক্তার ডেকেছ?’
‘না, ডাকি নাই। রজব আলী মাস্টার কইলেন, কবরস্থানের পাশ দিয়া যাইবার সময় আলগা বাতাস লাগছে। তিনি পিচার ঝাড়া দিয়া গেছেন। বইল্যা গেছেন, বিহান হইলেই ভালা হইয়া যাইব।’
জাহিদ বলল, ‘তুমি যে কী! চলো, তোমাকে নিয়ে ডাক্তার ডাকতে যাব।’
‘ডাক্তার ডাকবা?’
‘কেন, কোনো অসুবিধা?’
‘না, মানে, রজব আলী মাস্টার?’
‘ওনার কথা বাদ দাও। চলো, তোমার বাড়িতে আগে যাই। মানিকের অবস্থা গিয়ে দেখি।’
মতিন মিয়া ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলো।
চার
নতুন নদী আইল ধরে পশ্চিমে হেঁটে বৈদ্যনাথ বিলটা পার হতেই দিলালপুরের পশ্চিমপাড়া শুরু। পশ্চিমপাড়ার প্রথম বাড়িটাই মতিন মিয়ার। গোরস্তানটা আইলের দক্ষিণে, মতিন মিয়ার ইশা উত্তরে।
জাহিদ ও মতিন মিয়া ত্বরিত পা চালিয়ে পশ্চিমপাড়ায় এসে উঠোনে পা রাখতেই দেখল, হাট দরজা খোলা কুপির স্পষ্ট আলো দিঘল হয়ে উঠোনে এসে পড়েছে। পাশেই দিঘল সমান্তরাল ছায়া। ঘরের ভেতর মানুষজন এলোমেলো দাঁড়িয়ে আছে। একটা কালো কুকুর কুপির দিঘল আলোতে বসে ঘরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।
ওরা কুকুরটার পাশ কেটে ঘরে ঢুকল।
কুপির আলোটা স্পষ্ট হলেও বিছানায় শুয়ে থাকা মানিকের চেহারাটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। জাহিদ বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে বলল, ‘মতিন, কুপিটা এখানে এনে ধরো তো।’
মতিন মিয়া উনা থেকে কুপিটা এনে মানিকের চেহারার সামনে ধরল।
জাহিদ দেখল, মানিকের চোখ এরই মধ্যে গর্তে ঢুকে গেছে। চেহারাটা ফ্যাকাসে-নীল। হাত-পা অসাড়। সে মতিন মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মতিন, মানিককে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। জলদি।’
মতিন মিয়া সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল।
মতিন মিয়ার মা খানিকটা এগিয়ে এসে আগ বাড়িয়ে বলল, ‘কাজীর পুত, আমাগো রজব মাস্টার তো কইল, বিহানবেলার মধ্যে আমার নাতি ভালা হইয়া যাইব। সইন্ধ্যাবেলা হেয় দুইবার পিচার ঝাড়া দিয়া গেছে।’
মতিন মিয়া কী বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল।
জাহিদ মৃদু ধমক দিয়ে বলল, ‘মতিন, তোমার ছেলের যা অবস্থা, আর দেরি করলে বাঁচাতে পারবে না। দাঁড়িয়ে থেকো না। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’
মতিন মিয়ার মা আর কিছু বলল না।
মতিন মিয়ার বউ বলল, ‘আমিও হাসপাতালে যামু।’
পাঁচ
ঘুম ভাঙতেই জাহিদ দেখল, রোদটা জানালা গলে তেরছা হয়ে তার পায়ের কাছে এসে পড়েছে। রোদের তেরছা রশ্মিতে অসংখ্য ত্রসরেণু উড়ছে। সাধারণত সে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলেও আজ সে বেশ বেলা করে উঠেছে। গতরাতে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে।
জাহিদ বিছানা ছেড়ে উঠে রুম থেকে বের হতেই তার মা সাহেরা বানু বললেন, ‘জাহিদ, মতিন মিয়ার ওখানে একবার যাওয়া দরকার না? ওইদিকে তার পোলাডার দাফন-কাফনের কী করল।’
জাহিদ বিষণ্ন দৃষ্টি মেলে মাথা ঝাঁকাল। মুখে কিছু বলল না।
সূর্যটা ততক্ষণে পুবের আমগাছগুলোকে চেপে ধরে অনেকটাই মাথায় উঠে গেছে। উঠোনের অর্ধেকটা অবধি হলুদ রোদ। জাহিদ হালকা নাশতা করে মতিন মিয়ার বাড়ির উদ্দেশে বের হলো।
জাহিদ হাঁটছে পশ্চিমমুখো হয়ে, রোদের বিপরীতে। ছায়াটা ছোট হয়ে তার সামনাসামনি হাঁটছে। তার বাড়ি থেকে মতিন মিয়ার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। একটা চক, বৈদ্যনাথ বিলের দক্ষিণ ঘেঁষা ওয়াপদার নতুন আইল, তারপরই পশ্চিমপাড়া। কিন্তু আজ তার কাছে পথটা বেশ দীর্ঘই মনে হচ্ছে। গতকালের রাতটার মতো দীর্ঘ। মতিন মিয়ার এতটুকুু ছেলে মানিক। তার একমাত্র ছেলে। মানিক আর বাঁচেনি।
মতিন মিয়ার বাড়িতে পৌঁছেই জাহিদ দেখল, এরই মধ্যে মানিককে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। ছেঁড়া ও কালো তালি দেওয়া মশারির ভেতর তাকে শেষ গোসল করানো হচ্ছে। রজব আলী মাস্টার উঠোনের পুবপাশে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তাজুল মিয়া তার পাশেই।
মতিন মিয়া পশ্চিম ঘরের দাওয়ায় ঘাড় নুইয়ে বসে আছে। তার মা মাটি চাপড়ে সুর করে ঘরের দরজার মুখে বসে কাঁদছে – ‘হায় হায় হায়, ইঁ ইঁ ইঁ, আমার নাতিডা, অঁ অঁ অঁ …!’
মতিন মিয়ার বউকে দেখা যাচ্ছে না।
জাহিদ মতিন মিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। সে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আস্তে করে মাথায় হাত রাখল।
মতিন মিয়া চমকে ওঠার মতো করে দৃষ্টি তুলল। সে কাঁদছে না, কিন্তু সমস্ত কষ্ট ও যন্ত্রণা যেন তার চেহারা থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে।
জাহিদের ভেতরটাও এতে নড়ে উঠল।
তারপর ঘটনাটা আকস্মিকভাবেই ঘটল।
মতিন মিয়ার পশ্চিমের বসতঘরের ডানে, উঠোনঘেঁষা একটা মাটির দেয়াল। দেয়ালটা কোমর অবধি। দেয়ালের ওপাশে খোলা হেঁশেল।
একটা আর্তচিৎকারের শব্দ শুনে জাহিদের দৃষ্টিটা ওদিকে পড়তেই সে দেখল, এক রণমূর্তির যমদ্বিতীয়া যেন কালিমাখা একটা মাটির পাতিল হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রণমূর্তিটা মতিন মিয়ার বউ।
জাহিদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মতিন মিয়ার বউয়ের হাতের কালো পাতিলটা তার গায়ে এসে আছড়ে পড়ল। একটা শব্দ হলো, পটাস …! পাতিলটা মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
জাহিদ অবশ্য তেমন আঘাত পেল না। জামার আস্তিনের কাছে শুধু একটা কালো দাগ পড়ল। পেছন থেকে কয়েকজন মহিলা এসে মতিন মিয়ার বউকে ধরে ফেলল।
কিন্তু মতিন মিয়ার বউ মহিলাদের হাতের আঁটুনিতে আরো ফুঁসে উঠল। কান ফাটানো চিৎকারে বলতে শুরু করল, ‘হারামি, হারামি, আমার পোলাডারে হাসপাতালে নিয়া মাইরা ফালাইছে। হারামি …!’
রজব আলী মাস্টার কোন ফাঁকে চেয়ার ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, জাহিদ তা খেয়াল করেনি। সে স্তম্ভিত দৃষ্টি নিয়ে রজব আলী মাস্টারের দিকে তাকাল।
রজব আলী মাস্টার একটু টেনে টেনে বললেন, ‘বেটি পোলার শোকে পাগল হইয়া গেছে। পুরা পাগল। তুমি আমার লগে আসো।’
জাহিদ নির্ভরতাহীন, কিন্তু নড়ল না।
ঘরের দরজা থেকে মতিন মিয়ার মায়ের কান্নার নতুন সুর এলো, ‘ওরে কাজীর পুত, আমার নাতিডারে ক্যান মাইরা ফালাইছস রে, ও কাজীর পুত। আমার নাতিডারে …!’
রজব আলী মাস্টার বললেন, ‘জাহিদ, আমি পোলাডারে সইন্ধ্যাবেলায় দুইবার পিচার ঝাড়া দিয়া গেলাম। ওদের কইয়া গেলাম, বিহান হওয়ার আগেই পোলা ভালা হইয়া যাইব। কিন্তু মাঝখান থাইক্যা তুমি ক্যান এই ঝামেলাটা বাঁধাইলা? পোলাডারে হাসপাতালে নিয়া মাইরা ফেলাইলা?’
জাহিদ কিছু বলল না। স্থিরদৃষ্টিতে রজব আলী মাস্টারের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই সে দেখল, রজব আলী মাস্টারের দেহ ভেদ করে আস্ত একটা মানুষ বের হচ্ছে। সেই মানুষটার অবয়ব ঠিক রজব আলী মাস্টারের অবয়ব নয়।
জাহিদ আর রজব আলী মাস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তৎক্ষণাৎ তার দৃষ্টি মতিন মিয়ার পুব ইশার ঘরের দিকে গেল। ঠিক ঘরের দিকে নয়, ঘরের কালি টিনের চালের দিকে। কালি টিনের চাল উজিয়ে একটা পেঁপেগাছ বেড়ে উঠেছে। গাছটায় ছোট-বড় অসংখ্য সবুজ পেঁপে। কিন্তু পেঁপেগুলোর গা-ঘেঁষে ঠিক উপরে একটা ছেঁড়া জুতা ঝুলিয়ে রাখা। ছেঁড়া জুতাটা যেন প্রহরীর মতো পেঁপেগুলোর পাহারায় ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে।
জাহিদের মুখে একদলা থুতু এসে জমা হলো। কিন্তু সে থুতুটা ফেলতে পারছে না। থুতু ফেলতেও তার কেমন জানি ভয় হচ্ছে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.