একটি আকস্মিক উদ্ধারপর্ব

এক বছরের ব্যবধানে ভায়োলেটের জীবনে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা তাকে যারপরনাই বিধ্বস্ত করে দেয়। এপ্রিলে মারা গেল তার স্বামী মাইক। সিটি সেন্টারের রাউন্ড চার্চে গিয়েছিল ঈস্টারের প্রার্থনাসভায় যোগদান করার জন্য। সেখানেই অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেল তার হৃদযন্ত্র। অথচ অল্পক্ষণ আগেও মাইক মনোযোগ দিয়ে শুনছিল প্রিস্টের কথাগুলি। তিনি বলছিলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত কবি জন ডান এই রাউন্ড চার্চেই কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের অনেকগুলি দিন। তাঁর লেখা ‘পবিত্র সনেট’-এর উল্লেখ করে প্রিস্ট মৃত্যু নিয়ে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত 888sport app download apkটির ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। ‘মৃত্যু তুমি করো না অহংকার’ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে প্রিস্টের কণ্ঠে আর সেদিকে অপলক চেয়ে থাকা মাইক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঢলে পড়ে মৃত্যুরই কোলে। ঠিক এর মাসখানেক পরেই ভায়োলেট গেল অক্সফোর্ডের কাছাকাছি ব্যানবারি। সেই বিখ্যাত ‘ব্যানবারি ফেয়ার’-এর কাছেই মাইকের পৈতৃক নিবাস। গিয়েছিল মাইকের ব্যাপ্টিসম হওয়া চার্চে। চার্চ থেকে বেরোতেই একটা পাথরঘেঁষা বড় গর্তে পড়ে গেল পা হড়কে। সত্তর ছুঁইছুঁই ভায়োলেটের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল তার চেস্টারটন রোডের লিংকহাউজের তিনতলার চিলেকোঠাটা। পুরনো দিনের বাড়ি। বেজমেন্টটা রান্নাঘর। একতলায় ছেলে ফিলিপ থাকে তার বউ আর ছেলেটাকে নিয়ে। দোতলায় মাইকের একমাত্র ছোটভাই আর্থার। বিপত্নীক আর্থারের অবসর জীবন কেটে যাচ্ছে সেখানেই। ওর একমাত্র সন্তান সাইমন চাকরি করে কানাডায় একটা পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে। তিনতলার ছোট্ট কক্ষটাতে বসে বাইরের চলমান জীবনটাকে দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই ভায়োলেটের।

ভাগ্যিস তাদের ঘরটা একেবারে রাস্তার লাগোয়া। নইলে দেখবার মতো তেমন কিছু থাকতোও না। গ্রান্টার নির্জন জনবিরল এলাকা হলে টানা ঝোপঝাড় আর ক্যাম নদীর একটা দিক ছাড়া আর কিছুই মিলতো না দৃষ্টিপথে। ওদিকে পাইনহার্স্টের দিকে একটানা প্রান্তর। প্রান্তর যেখানটায় শেষ, সেখান থেকে এক লাফে দিগন্তরেখা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে দেখা যাবে দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যাওয়া উড়ন্ত পাখিদের।

অথবা সার বেঁধে ছুটে চলা সাদা মেঘ। হয়তো ম্যাডিংলে রোডের ওপর দিয়ে চলে যায় এসেক্সের দিকে। আর এসেক্স পেরোলেই তো লন্ডন। সকালে উঠেই জানালা ঘেঁষে একটা চেয়ারে বসে পড়তে হয়। আবহাওয়া অবশ্য কখনো কখনো সকাল থেকে সন্ধে বলতে গেলে একই রকম থাকে। একইরকম ঘোলাটে, একইরকম বিষণ্ন। প্রবাদটা তো আর এমনি-এমনি তৈরি হয়নি। মনে মনে আওড়ায় ভায়োলেট – ‘ডোন্ট ইউ লাইক ইংলিশ ওয়েদার! ওয়েট জাস্ট ফাইভ মিনিটস্!’ আর ভায়োলেটের তো সারাদিনেরই অপেক্ষা। জানালাটা ডাবল গ্লেজ হওয়ায় রাস্তায় ছুটে যাওয়া যানবাহনের শব্দ তত অসহনীয় হয় না। রাস্তার ওপারে একটা প্রশস্ত লম্বাটে মাঠ। মাঠটা ঘাস আর বড় বড় গাছে ভরা। এলম্ আর পাইনের গাছগুলি দাঁড়িয়ে থাকে মাঠের পাহারাদারের মতন। পাইনের নিচে ঘাসের ওপরে মাঝে মাঝে জমে ওঠে পাইনের মোচা। সিটি কাউন্সিলের লোকেদের নিয়মিত পরিচর্যায় জায়গাটা বাগানের রূপ নেয়। অল্পক্ষণের জন্য জানালা খুলে দিলে যত না গাড়িঘোড়ার শব্দ তারও অধিক আসে পাখিদের কলকাকলির শব্দ। পাইন আর এলম্ গাছগুলিতে ঝোলে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের কুঠুরি, যেখানে রাখা থাকে বার্ডস্-ফুড।

ডিসেম্বর এবং ক্রিসমাসের উৎসব যেন সমার্থক। ক্রিসমাসের যত দিনই বাকি থাকুক ডিসেম্বর মানেই হলো কাউন্টডাউন। শহরের সবখানে আলোকসজ্জা। দোকানগুলিতে উপচেপড়া ভিড়। আকর্ষণীয় ‘সেল’-এর বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট লোকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের আউটলেটগুলিতে। দেখা যাবে ভোররাত থেকেই উৎসাহী ক্রেতারা কিউতে দাঁড়িয়ে যাতে দোকানের ঝাঁপ তোলা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে পূর্বদিন উইন্ডোশপিংয়ে স্থিরীকৃত আইটেমের ওপর গিয়ে হামলে পড়তে পারে। মাইকের ছোটভাই আর্থার চলে গেছে হ্যালিফ্যাক্সে ওর শ্যালিকার বাড়ি। জায়গাটা যেহেতু কানাডার হ্যালিফ্যাক্স নিশ্চিতভাবেই বলা সম্ভব, আর্থার একটি সাদা, ক্রিসমাসেরই মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সেদিক থেকে ক্যামব্রিজের ক্রিসমাসের সফেদত্ব নিয়ে স্থির-নিশ্চিত কিছু বলা মুশকিল। এমনও দেখা গেছে, ক্রিসমাসের আগের ও পরের দিন তুষারপাতে সব সাদা কিন্তু ঠিক ক্রিসমাসের দিনটাই ঝকঝকে রোদে ভরে গেল চতুর্দিক। যারা বাজি ধরেছিল প্রায় নিশ্চিতরূপেই, ক্রিসমাস সাদাই হবে তারা সব আচমকা বাজির টাকা হেরে ফতুর। ভায়োলেটের নাতি একবার অনুরোধও করেছিল, ‘গ্র্যান্ডমা, ধরবে নাকি এক পাউন্ডের একটা বাজি!’ ভায়োলেট অনিচ্ছুক, বাজি আমার ‘কাপ অব টি’ নয় বলে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে ক্যাম নদীর দিকে। এই জানালাটাই কত 888sport sign up bonusবিদ্ধ হয়ে রয়েছে ওর এবং মাইকের সুখদুঃখের বার্তাখচিত হয়ে। দুজনে বসে টিভিতে দেখছে আগাথা ক্রিস্টির ‘মিস মার্পল’ সিরিজের ক্রাইম স্টোরিগুলি আর বাজি ধরছে কে হত্যাকারী সেটা নিয়ে। কখনো কখনো মিলে যেত, কখনো আবার মিলতো না। মাইক বলতো, যাকে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হবে, মনে রাখবে সে মার্ডারার না!

আর একদিন পরেই ক্রিসমাস ইভ। ক্যারল গাইতে গাইতে ছেলেমেয়েরা দোরে-দোরে ঘুরবে। সমস্ত সন্ধে ভরে উঠবে অস্ট্রীয় সেই তাঁতি ফ্রাঞ্জ হাভের গ্রুবেরের লেখা বিখ্যাত ক্যারলের কোরাসের সুরে – স্টিলা নাখ্ট্, হাইলেগে নাখ্ট্। কিংবা কিশোর-কিশোরীরা গাইবে ‘হার্ক, দ্য হেরাল্ড অ্যাঞ্জেলস্ সিঙ্’। তাদের সেই সুর ক্যাম নদীর পাড় ঘেঁষে হাওয়ায় ভেসে ভেসে পৌঁছে যাবে বহুদূর। হয়তো সেই সুরের দোলায় কোথাও কোনো অসাড় স্ক্রুজের বুকেও লাগবে দোলা এবং হাড়কিপ্টে সে কোনোদিন যা করেনি তা-ই করবে। দরজা মেলে ধরে এক থালা চকোলেট বাড়িয়ে দেবে ক্যারল-গাওয়া ছেলেমেয়েদের দিকে। একদিন ভায়োলেটও গেয়েছিল ক্রিসমাস ইভে কত ক্যারল! এইসব ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে হেলেপড়া অপরাহ্ণের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে সে। রোদহীন বিকেল অনেকটা আসন্ন সন্ধের মতোই লাগে। দিনকয়েকের তুষারপাতে ক্যাম নদীর ওপরকার জলের স্তরটা জমাটবদ্ধ হয়ে আসে। পাতলা একটা স্তর স্বচ্ছ স্লেটের মতো বিছানো রয়েছে, দূর থেকে দেখলে তেমনটাই মনে হয়। তাহলে কি ক্যাম নদী এবারকার সাদা ক্রিসমাসে সত্যি জমে যাবে! বছর দশেক আগে একবার লন্ডনে জমে যাওয়া টেমসের ওপরকার শক্ত তুষারের আস্তরের ওপর দিয়ে হেঁটেছিল মাইক আর ভায়োলেট। অনেকেই এসেছিল দূরদূরান্ত থেকে। কী যে উত্তেজনা লোকেদের মধ্যে। তুষারপাত নিয়ে উত্তেজনার ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরনো। তুষারপাতে জমাট বাঁধতে থাকা ক্যাম নদীর দিকে তাকিয়ে 888sport sign up bonusচারী ভায়োলেটের মনে পড়ে মাইকের কথা। একটা মজার বই কিনে এনেছিল তার জন্য। সেই বইয়ে ১৬০৮ সালে বরফে জমাট টেমস নদীর ওপরকার মেলা উপলক্ষে ছাপানো টিকেটের ছবি প্রকাশিত হয় – ‘দ্য গ্রেট ফ্রস্ট : কোল্ড ডুয়িংস্ ইন লন্ডন, অ্যাক্সেপ্ট ইট বি অ্যাট দ্য লটারি’। মানুষের সৃজনশীলতার এইসব দৃষ্টান্তের কথা ভেবে মনে মনে পুলক অনুভব করে ভায়োলেট।

অনেকটা সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সে প্রায় জমে আসা ক্যামের দিকে। বক কি সারসের মতো দেখতে কয়েকটা পাখি যখন জমে থাকা ক্যামের ওপর ছোটাছুটি করে উড়ে চলে যায় তখন ভায়োলেটের ধারণা হলো, আর একটা দিন যদি তুষারপাত চলে তাহলে নিশ্চিত ক্যাম নদী জমাট হয়ে যাবে পুরু বরফের আস্তরে নিজেকে ঢেকে নিয়ে। অল্পক্ষণ আগেও লোকেরা ক্যামেরায় ছবি তুলেছে নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে। কেউবা পাইন-এলমের তলে দাঁড়িয়ে বন্দি করে নিয়েছে নিজস্ব মুহূর্তগুলিকে। নদীর অন্য পাড়েও ঘাসের লম্বাটে চত্বর এবং কিনারা ঘেঁষে নানা রকমের বেরি ফলের ঝোপ। গ্রীষ্ম এলেই সেখানে দলবেঁধে হানা দেবে মৌমাছিরা আর গোটা এলাকা বেরিফলের মিষ্টি সুবাসে ভরে উঠবে। তবে এই শীতে এবং একটানা তুষারে বেরিঝোপের শাখা-প্রশাখাগুলিকে দূর থেকে দেখায় শ্বেতশলাকার মতো। যেন কোনো নিপুণ 888sport live chatী তার নিপুণ হস্ত888sport live chatের স্বাক্ষররূপে সাদা রঙের শলাকাগুলিকে গেঁথে দিয়েছে মাটির বুকে। ভায়োলেট মুগ্ধ চোখে উপভোগ করছিল রৌদ্রহীন দিবসের ভিন্ন এক সৌন্দর্য। তখনো খানিকটা আলো গোধূলিমুখী ঘড়ির কাঁটায় প্রতিফলিত হতে থাকলে ভায়োলেট বাতি না জে¦লে বসে ছিল আলো-অন্ধকারে। একটু দূরে ট্রিনিটি কলেজের চূড়াটা ওপরের বিশাল আকাশের প্রেক্ষাপটে শূন্যতামুখী এক বিমূর্ত ভাস্কর্যের মতো দেখায়।

ক্যামের তীর আর বেরিফলের ঝোপ ছুঁয়ে ভায়োলেটের দৃষ্টি যখন ট্রিনিটির চূড়ামুখী হচ্ছিল তখনই আচমকা একঝলক সাদা রশ্মি কোত্থেকে এসে বিদ্ধ হয় তার চোখে। ফাঁকা রাস্তায় একটা-দুটো গাড়ি ছুটে যায়। ক্যামের জমে আসা জলের স্তর থেকে তুষারজনিত একটা স্বচ্ছ আলোক এবং নদীমুখী আচমকা সাদাটে রেখা বরাবর দৃষ্টির খননকার্য চালালে ভায়োলেট দেখলো, একটা গতিমান জিনিস ঠিক ক্যাম নদীর মাঝ বরাবর গিয়ে সেখানটায় স্থির হয়ে রয়েছে। স্থির হলেও তা জড় নয়, বরং খানিকটা আন্দোলন সেটির সারা অবয়বে স্পষ্ট। একটুক্ষণের মধ্যে বোঝা গেল সেটা একটা রাজহাঁস। উড়ে এসে বসে পড়েছে তুষারজমাট ক্যাম নদীর জলস্তরের ওপর। তবে ভায়োলেটের ধারণা হলো, রাজহাঁসটি নিশ্চয়ই এমন ঠান্ডায় সেখানে বসে থাকবে না, কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়ে চলে যাবে তার নিজস্ব গন্তব্যের দিকে। হতে পারে সে দলছুট হয়ে চলে এসেছিল এদিকটায়। কেননা সে একা, সঙ্গে কোনো সঙ্গীসাথি ছিল না। ভায়োলেট খানিকটা কৌতূহলের বশেই রাজহাঁসটার গতিবিধি লক্ষ করতে থাকে। হাঁসটা ততক্ষণে তার বড় ডানাদুটি নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। কিন্তু সে উড়ে এসে যে-জায়গাটাতে বসেছিল সেখানটাতেই স্থিত থাকে, উঠে যায় না। অন্ধকার ধীরে গাঢ় হয়ে চলে। রাজহাঁসটা তার সরু গলাটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে যেন কিছু একটা বলতে চায় বা করতে চায়, কিন্তু ভায়োলেটের মনে হলো হাঁসটা যা করতে চায় তা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না বিশেষ কোনো কারণে। কেননা রাজহাঁসটার অবস্থিতি চারদিককার নির্জনতা, শৈত্য-পরিস্থিতি এবং নদীর ভেতরকার প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যথেষ্ট বেমানান। জানালার ডাবল গ্লেজ আয়না খানিকটা সরিয়ে দৃষ্টিকে সরু তীরের মতো রাজহাঁসটার দিকে পাঠায় ভায়োলেট। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া হালকা কামড় বসিয়ে দেয় তার সারা মুখে। ডিসেম্বরের ঠান্ডা নিশ্চয়ই রাজহাঁসটাকে এরই মধ্যে কামড়াতে শুরু করে দিয়েছে। হ্যাঁ, রাজহাঁসেরা তো সারাক্ষণ জলের মধ্যেই থাকে। ক্যাম নদীতে দিনের প্রায় সবটা সময় দেখা যাবে রাজহাঁসেদের। ইচ্ছেমতো তারা বিস্তার করে চলেছে নিজেদের সাম্রাজ্য। আর তারা যে রানিমায়ের বিশেষ সম্পত্তি সে-তথ্য জেনে হয়তো মাঝে মাঝে যথেষ্ট বেপরোয়াও হয়ে ওঠে তারা। প্রায়ই ক্যামে নৌবিহারীদের সঙ্গে ঝামেলা লেগে যায় রাজহাঁসেদের। হয়তো কোনো বৈঠাধারীর একটা ঘা সন্তরণরত কোনো এক রাজহাঁসের গায়ে লেগেছিল তার অজ্ঞাতসারেই। কিন্তু হাঁসেরা তাকে সহজেই ছেড়ে দেয় না। দলবেঁধে আক্রমণ শানায় বৈঠাধারীর দিকে। কাজেই নৌচালকদের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া থাকে তারা যেন বৈঠাচালনায় থাকে সতর্ক ও সচেতন।

নির্জন রাজহাঁসটিকে তখন এক অসহায় প্রাণীর মতোই ঠেকে ভায়োলেটের। এমনকি চেস্টারটন রোডের তিনতলার চিলেকোঠায় বসে থাকা ভায়োলেটের অকস্মাৎ নিজেকেই মনে হয় এক নিঃসঙ্গ কিংবা পরিত্যক্ত রাজহাঁস। অনেককাল আগে পড়া বোদলেয়ারের 888sport app download apkর কথা তার মনে পড়ে। সিন নদী থেকে উঠে আসা এক রাজহাঁসকে নিয়ে 888sport app download apk লিখেছিলেন শার্ল বোদলেয়ার। সারা প্যারিসে তখন চলছিল দুর্দম ভাঙাভাঙি। ধুলোবালিকাদামাখা রাজহাঁসটি নিশ্বাস নিতে পারছিল না। মহানগরের রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া বোদলেয়ারের সেই রাজহাঁসটিকে দেখে ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, শার্ল, আমরা যা পারিনি তুমি তা পেরেছো। যৌবনে পড়া সেই রাজহাঁসটির মুমূর্ষু – এক প্রতীকী রূপান্তর যেন ক্যাম নদীর বরফজমাট জলের ওপর নিঃসঙ্গ বসে থাকা রাজহাঁসটাই। দৃষ্টিতে আরো খানিকটা গভীরতা যোগ করলে ভায়োলেটের মনে হলো, রাজহাঁসটা ইচ্ছের বশে নয়, হয়তো সামর্থ্যরে অভাবেই পারছিল না উড়ে যেতে। হতে পারে সেটি অসুস্থ। মানুষের অসুস্থতার সংবাদ মানুষ স্বয়ং জানাতে পারে কিন্তু হাঁসের মতো এসব প্রাণীর পক্ষে তো আর তাদের নিজেদের অসুস্থতার সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। হতে পারে এই ভয়ংকর ঠান্ডাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরির সঞ্চয় নেই তার। উড়ে যেতে হলে তো তার শরীরে মজুদকৃত খাদ্যের শক্তি থাকা চাই। এসব ভাবতে ভাবতে ভায়োলেট দেখলো রাস্তা শীতসন্ধ্যায় জনবিরল হয়ে পড়েছে।
যে-হাঁসটিকে সে তার বাড়ির তিনতলা থেকে এতটা মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে-হাঁসের জন্য দুনিয়ার কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই।

রাজহাঁসটা তখন তার সরু লম্বা গলাটাকে বাড়িয়ে হয়তো নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। ডানা দুটো সক্রিয় করার তার প্রবল অধ্যবসায় কোনো কারণে সফল হয়ে উঠতে পারে না। আর তখনই আচমকা ভায়োলেটের মনে হলো – আসলে রাজহাঁসটির নিম্নাঙ্গ ক্যাম নদীর জমাট জলস্তরের ওপর আটকা পড়েছে। হতে পারে উড়ে এসে বসার মুহূর্তেই হাঁসটি ছিল উড়ে যাওয়ার ক্ষমতাশূন্য। আর শক্তিহীন বসে থাকতে থাকতে তার নিম্নাঙ্গ বরফ হয়ে যাওয়া জলের মধ্যে বসে গেছে খাঁজ কেটে। আর সত্যিই যদি তা হয় তাহলে হাঁসটির পক্ষে উড়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং সেটি বরফের ফাঁদে আটকা পড়ে জনান্তিক মৃত্যুর শিকারে পরিণত হবে। কষ্টেসৃষ্টে চেয়ার ছেড়ে উঠে যাওয়া যায়। নিচতলার বাসিন্দাদের ডেকে আনা যায় কিন্তু সেটা করতে গেলে, ভায়োলেট হিসাব করে, রাজহাঁসটাকে হয়তোবা বাঁচানো সম্ভব হবে না। ততক্ষণে সেটির ডানাও যেনবা নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। পাশে রাখা টেবিলের ওপরকার ব্রিটিশ টেলিকমের টেলিফোন সেট থেকে দ্রুত রিসিভারটা হাতে নিয়েই ভায়োলেট চাপ দেয় তিনটে ৯-এ পরপর। ওপাশ থেকে কেউ একজন সাড়া দিতেই ভায়োলেট বলতে থাকে – চেস্টারটন রোডের ১৪ নম্বর বাড়ি থেকে ভায়োলেট বলছি, রাস্তার উল্টোদিকে জমে যাওয়া ক্যামে একটা রাজহাঁস আটকা পড়েছে। উড়ে যেতে পারছে না। ওকে সাহায্য না করলে সে আর অল্পক্ষণের মধ্যে মারা যাবে।

‘ধন্যবাদ, আসছি।’ – এটুকুই কেবল শোনা গেল এবং সম্ভবত দুই মিনিটের মধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স ইমার্জেন্সি ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এসে হাজির। এসেই ঠিক ১৪ নম্বর বাড়ির সামনে থেমে পড়লো। ড্রাইভার ছাড়া আরো তিনজন ফায়ার-ফাইটারকে দেখা গেল। বিশেষ ধরনের জ্যাকেট পরা দুজন সুঠামদেহী যুবক ত্রস্তে রাস্তার লাগোয়া লোহার বেড়া এবং টার্নসটাইল পেরিয়ে পৌঁছে গেল ক্যাম নদীর পাড়ে যেখানটায় জমাট বরফস্তরে আটকে রয়েছে রাজহাঁসটা। ওদের একজন নিকটের ব্রিজ পেরিয়ে চলে যায় অপর পাড়ে। একজন থাকে রাস্তার লাগোয়া পাড়টাতে। তৃতীয় জন অ্যাম্বুলেন্স থেকে ভারি ও গোটানো কিছু একটা দ্রুত বয়ে নিয়ে ছুটতে থাকে পূর্ববর্তী দুজনের দিকে। বিস্মিত ভায়োলেট সবটা তৎপরতা দেখতে থাকে অপলক চোখে। ততক্ষণে দুয়েকজন পথচারীও ঠান্ডা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে পড়েছে প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে। সবাই বুঝতে পারে কোনো এক রেসকিউ-পর্বের তারা সাক্ষী হতে যাচ্ছে কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স যে মানুষের পরিবর্তে একটি রাজহাঁসকেই উদ্ধার করতে এসেছে সেটা বুঝতে খানিকটা সময় নেয় যখন তারা দেখলো একজন ফায়ার-ফাইটার ভারিমতো গোটানো লোহার মাদুরটা ছুড়ে দিলো অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। রাজহাঁসটা যেখানটায় আটকা পড়েছে ঠিক তার পাশেই নদীর
এপারে-ওপারে মাটি গেঁথে বসে গেছে লোহার সেই মাদুর। পঁচিশ-ত্রিশ ফুট দীর্ঘ মাদুরটার দুটো দিকই চারটে মোটা লোহার পায়ে মাটি কামড়ে বসে গেলে অপর পারের ফায়ার-ফাইটারটা তখন সরীসৃপের মতন বুকে হেঁটে রাজহাঁসটার নিকটে এসে পৌঁছায়। তৃতীয় জন তখন এপারে একটা স্ট্রেচার নিয়ে দাঁড়িয়ে। একই সঙ্গে স্বস্তি ও শংকা ভায়োলেটের মধ্যে ছোটে দুটি সমান্তরাল রেখায়। স্বস্তি এই ভেবে, শেষ পর্যন্ত উদ্ধার পাচ্ছে রাজহাঁসটা এবং শংকা, রাজহাঁসটা আসলেই বেঁচে উঠবে কি না। প্রথমজন তার সরীসৃপ গতি থামিয়ে মুমূর্ষু রাজহাঁসটাকে কোলে নেওয়ার আগে পকেট থেকে একটা ছেনি বের করে নেয়। যে-শক্ত বরফের আস্তরে হাঁসটা আটকা পড়েছে সেটাকে কৌশলে ছেনির আঘাতে ভাঙতে থাকে লোকটা। হাঁসের গায়ে যাতে ছেনির আঘাত না লাগে লক্ষ রাখতে হয় সেদিকেও। একপর্যায়ে আটকমুক্ত হয় রাজহাঁস। ভাঁজ করে রাখা একটা কম্বলে জড়িয়ে নিয়ে হাঁসকে নিয়ে পুনরায় সে-লোক বুকে হেঁটে সন্তর্পণে এগোয় তীরের দিকে। রাজহাঁসটার শুধু গলার খানিকটা এবং ঠোঁট দেখা যায়। চোখে পড়ে ভায়োলেটের, যদিও তা থেকে বোঝা মুশকিল হাঁস জীবিত কি মৃত।

প্রথমজন তীরে পৌঁছালে দ্বিতীয় ফায়ার-ফাইটার দ্রুত লোহার মাদুর গুটিয়ে নিলে তৃতীয় জন স্ট্রেচারটা বাড়িয়ে দেয় রাজহাঁসবাহী লোকটার দিকে। এবং দ্রুত তৎপরতায় তিনজনই অ্যাম্বুলেন্সে পৌঁছালে ড্রাইভার স্টার্ট দেয় গাড়িতে। মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় বিপন্ন রাজহাঁস এবং উদ্ধারকারী দল। ভায়োলেটের মনে তখন স্বস্তির আমেজ বইছে। ক্রিসমাস ইভ এবং ক্রিসমাসের পূর্বে এরকম একটা উদ্ধার তৎপরতার অংশ হতে পেরে দারুণ একটা ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে তার। কিন্তু হাঁসটার জন্য একটা আশঙ্কা তার মনে জেগেই থাকে। একতলায় তখন কোলাহল চলছিল ক্রিসমাস ইভ এবং ক্রিসমাস উদ্যাপনের নানা অনুষঙ্গে। হয়তো দিনকয়েক আগে কিনে আনা টার্কিটাকে কীভাবে স্টাফড্ আর রোস্ট করা হবে সেসবের পরিকল্পনা চলছে। রাজহাঁসের উদ্ধারপর্বে উৎসাহী পথচারীদের আর চোখে পড়ে না। রাউন্ড চার্চের চূড়ায় বজ্রনিরোধক শলাকার পাশে একটি বাতি জ্বলে।

ভায়োলেট কেবল বাইবেলটা শেলফ থেকে হাতে নিয়েছে পড়ার জন্য। লেভিটিকাস-এ অ্যারন এবং তার সন্তানদের কথা বলা হচ্ছে। মোজেস তাঁবুতে বসে, ঈশ্বর তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন, অ্যারনকে মুকুট পরিয়ে দেওয়ার জন্য। মোজেস ঈশ্বরের নাম নিয়ে যেইমাত্র একটি বিশেষ তেল অ্যারনের মাথায় লাগিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই ভায়োলেটের কামরার দরজাটা মেলে যায়। বাইবেল গুটিয়ে রেখে সে দেখতে পেল দরজায় দাঁড়িয়ে তার ছেলের বউ ফ্রান্সিন এবং একজন অপরিচিত লোক। অচেনা হলেও লোকটার পোশাক থেকে তাকে চেনা যায় – তার গায়ে ফায়ার-ফাইটারদের পোশাক। লোকটা নিশ্চয়ই ফায়ার সার্ভিস বিভাগ থেকে আগত। কথা বলে ফিলিপের স্ত্রী ফ্রান্সিন – ইনি বলছেন, এ-বাড়ি থেকে ভায়োলেট নামে একজন ওদের ৯৯৯-এ ফোন করেছিলেন। ওরা ক্যাম থেকে ঘণ্টাখানেক আগে একটা রাজহাঁস উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। এখন এসেছে আপনাকে ধন্যবাদ দিতে। কারণ, এ-বাড়িতে আপনিই তো একমাত্র ভায়োলেট!

ফ্রান্সিনের কথায় এবং ফায়ার-ফাইটারটাকে দেখে আবেগে অভিভূত বোধ করে ভায়োলেট। হ্যাঁ, মনটাকে প্রশান্ত করার জন্য সে বাইবেলের পৃষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছিল বটে কিন্তু তার মনের মধ্যে তখনো রাজহাঁসটিই বিরাজ করছিল। লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে ভায়োলেট বলে, হ্যাঁ, সে-ই বিপন্ন দেখে আটক রাজহাঁসটাকে মুক্ত করার জন্য ফোন করেছিল। জবাবে
ফায়ার-ফাইটারটা উল্টো ধন্যবাদে ভরিয়ে দেয় ভায়োলেটকে – ‘দেখুন সমস্ত ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা আপনারই জন্য। আপনি ৯৯৯-এ ফোন না করলে রাজহাঁসটাকে বাঁচানো যেতো না, মরে যেতো হাইপোগ্লাসিমিয়ায়। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন, রাজহাঁসটি সংকটাপন্নই ছিল কিন্তু বর্তমানে সেটি বিপদমুক্ত। আমাদের বিভাগ থেকে সকলের পক্ষে আমি আপনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।’

লোকটা চলে গেলে ভায়োলেট চেয়ার টেনে বসে তার ডাবল গ্লেজ জানালা ঘেঁষে। খুলে দেওয়া জানালাটা আটকাতে ভুলে গিয়েছিল। হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকতে থাকে। সে-হাওয়া আসে হয়তো ক্যাম নদীর বুক ছুঁয়ে কিংবা হয়তো অদূরের পাইন-এলম আর বেরিফলের ঝাড় ছুঁয়ে। আসুক ঠান্ডা হাওয়া। জানালার পাল্লা লাগিয়ে দেওয়ার আগে আরো একবার ক্যামের দিকে তাকায় ভায়োলেট। একটু আগেও বরফজমাট ক্যামের আস্তরে বন্দিদশায় অবরুদ্ধ ছিল রাজহাঁসটা। এখন জায়গাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেবল কয়েকটা জোনাকি দেখা যায় যেগুলি পরিণত হয়েছে আলোকের বিন্দুতে।