একটি ঐতিহাসিক দাফন ও কাউলি পাড়ার 888sport promo codeরা

আমার নাম কাজী সিরাজুল ইসলাম। হাজার বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ বৃহত্তর যশোরের ইতনা গ্রামে আমার জন্ম। ইতি-নাই থেকে কালে কালে মানুষের মুখে এখন ইতনা। (বর্তমানে ইতনা অবশ্য নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার অধীনে)। স্বাধীনতার মহান গৌরবময় যুদ্ধে আমাদের এই গ্রাম ইতনার রয়েছে মহান অবদান। স্বাধীনতার প্রাক্কালেই এখানে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। এবং এর জন্যে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ইতনার গ্রামবাসীকে তার মাশুল দিতে হয়েছিল নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে, তাদের বাড়িঘর লুট হতে দিয়ে, তাদের মেয়েদের ধর্ষিত হতে দিয়ে, এবং তাদের শিশুদের বেয়নেটের মুখে নিহত হতে দিয়ে ।

কিন্তু সেসব এখন অতীত ইতিহাস। স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে এই আত্মত্যাগ চোখের অশ্রম্ন দিয়ে আমাদের ইতনাবাসী বরণ করে নিয়েছে। আমাদের ইতনাবাসী তাদের গ্রামের বীর সন্তান নয়া মিয়াকেও ভোলে নাই। কারণ স্বাধীনতার সেই সংকটময় মুহূর্তে এই নয়া মিয়া আমাদের গ্রামবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। আমাদের মনে সাহস জুগিয়েছিলেন, স্বাধীনতার জন্যে গ্রামের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

আমি, কাজি সিরাজুল ইসলাম, গরিব কৃষক-ঘরের সন্তান। তবুও আমার ছেলেবেলা ছিল সুখের। আমি আমার গ্রামের
পথে-ঘাটে, নদীতে, প্রান্তরে ইচ্ছেমতো ছেলেবেলা কাটিয়ে বড় হয়েছি। আমার ছোট্ট বোনটির জন্যে জঙ্গল থেকে ভাঁটফুল কুড়িয়ে এনেছি, বরই, পেয়ারা, কামরাঙা খুঁজে খুঁজে এনে তার হাতে তুলে দিয়েছি। লেখাপড়া বেশি শেখার কোনো সুযোগ আমার ছিল না। বাবা অসুস্থ। মা সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত, কোনো বেলা আহার জুটেছে, কোনো বেলা জোটেনি, তাতেও আমাদের সংসারে কোনো কষ্ট ছিল না, আমার বাবা-মায়ের ভেতরে কোনোদিন এজন্যে ঝগড়াঝাটি হতে দেখিনি।

ছেলেবেলা থেকে লক্ষ করে দেখেছি আমাদের গ্রামের মানুষেরা গরিব, কিন্তু তা হলেও তারা ছিল সৎ, অধ্যবসায়ী, সাহসী। আমাদের গ্রামে রাজাকার বলতে প্রায় কেউই ছিল না, যে দু-চারজন ছিল তারা পেটের দায়ে বা জান বাঁচানোর দায়ে এ-ধরনের আত্মঘাতী কাজে নিজেদের নিযুক্ত করেছিল। পরে তারা এজন্যে লজ্জিত হয়েছে।

আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।

যা হোক আমি বড় হওয়ার পরে বুঝলাম যে আমার মাকে সাহায্য করতে হলে আমাকে কাজ করতে হবে। নইলে আমার বোনকে বিয়ে দিতে পারবো না, মাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারবো না, আমাদের খড়ের চালে কোনোদিন টিন বসবে না, আমি তাই সদরে গিয়ে একদিন পুলিশে নাম লেখালাম।

তারপর ধীরে ধীরে আমি নিজেকে চাকরির ভেতরে গুছিয়ে তুললাম। আমার সাহস এবং সততা দেখে চাকরিক্ষেত্রে সকলেই আমাকে পছন্দ করতে লাগল।

একসময় আমার পোস্টিং হলো গোপালগঞ্জ সাবডিভিশনে। সেই সাবডিভিশনের পুলিশ অফিসার আবদুল মান্নান সাহেবের দেহরক্ষী হয়ে। আমার পদবি হলো কনস্টেবল।

স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর দেহরক্ষী হিসেবে ডিউটি পেয়ে আমিও খুব খুশি ছিলাম।

ইতোমধ্যে আমার নতুন পোশাকের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। পোশাক কিছুদিন আগে তৈরিও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাজ থেকে অবসর নিয়ে ফরিদপুরে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারছিলাম না। ফরিদপুরে যে দর্জির দোকানে আমাদের পুলিশদের পোশাক তৈরি হতো সেখানে গিয়ে নতুন পোশাক তুলতে হবে আমাকে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কোনো একটা সুযোগের।

এর ভেতরে একদিন সুযোগ পেয়ে গেলাম। সেদিনটি ছিল ১৪ই আগস্ট, ১৯৭৫ সাল।

সেদিন আমার কোনো ডিউটি ছিল না। আমি বাড়িতে আমার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে বলে আমার পুলিশ-ডিউটির নতুন পোশাক বা ইউনিফর্ম আনতে ফরিদপুরের দিকে সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম। ইচ্ছে ছিল রাতেই আবার বাসায় ফিরে আসবো।

তখনকার দিনে আমাদের পুলিশের ইউনিফর্ম, রেশন, বেতন, ভাতা সবই ফরিদপুর সদর থেকে দেওয়া হতো। সদরে আগে থেকেই আমার পরিচিত মানুষজন অনেকে ছিল। তাই সেখানে গিয়ে পোশাক জোগাড় করার পর ভাবলাম, যাই, ফিরে যাবার আগে গোপাল সরকারের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে যাই।

গোপাল আবার আমাদের ইতনা গ্রামের ছেলে। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। বড় হবার পর ফরিদপুরে এসে সে চায়ের দোকান দিয়েছে। দোকান মোটামুটি চলে। গোপাল এখনো বিয়ে-থাও করেনি, তবে বিয়ের জন্যে মেয়ে খুঁজছে।

আমাকে তার দোকানে হাতে ইউনিফর্ম নিয়ে উপস্থিত হতে দেখে গোপাল তো মহাখুশি। বলল, আরে সিরাজ, কেমন আছো। তুমার বউ, আমাগের বউদি ক্যামুন আছে? কেমন লাগতিছে চাকরি? বাঃ, এই বুঝি তোমার নতুন ইউনিফরম? বেশ, বেশ। বসো, চা খাও।

তো গোপালের দোকানে বসে চা-শিঙাড়া খাচ্ছি, আর গল্প করছি, এমন সময় আমার আরেক ছেলেবেলার বন্ধু, একই গ্রামের, তার নাম লুলু সিকদার, সেখানে উপস্থিত। আমাকে দেখে সে তো হইহই করে উঠল।

লুলু বলল, আরে দোস্ত, তুমি এইখানে? কী ব্যাপার?

আমি তাকে সদরে আসার কারণ বললাম। এটাও জানালাম যে নাস্তা করেই আমি আবার গোপালগঞ্জে ফিরে যাবো। কিন্তু লুলু কিছুতে ছাড়ল না। সে বলল, আজ তো তুমার কোনো ডিউটি নেই, তা’লি কেন ফিরে যাতি চাও? কাল ভোর বিহানে উঠেই চলে যেয়েনে, দোস্ত। আজ রাতির বেলা মালেক ভাইয়ের বাড়িতি আমাগের দাওয়াত। ভাবি বাপের বাড়ি গেছে বেড়াতি। বাসা একেবারে ফাঁকা, বুঝলে? আজ সারারাত আমরা তাস খেলবো। আমাগের মনিও এখুন এইখেনে আছে।

মনি আমাদের একই গ্রামের বন্ধু। আমরা সব একসাথে বড় হয়ে উঠেছি।

আমি তখন দোমনা হয়ে বললাম, দেখো দোস্ত, আমার মনডা ভালো বলতিছে না, এখেনে আসার আগে আমার স্যাররে আমি বইলে আসি নি, যদি স্যার রাতির বেলা আমার খোঁজ করে, তখুন?

উত্তরে লুলু বলল, আরে, না। তোমার আজ ছুটি। কেউ খোঁজ করবে নানে।

তো তাদের জোরাজুরিতে আমিও কীভাবে যেন রাজি হয়ে গেলাম।

এরপর বন্ধুরা মিলে হইচই হাসি-ঠাট্টা করতে করতে রাতের বেলা ফরিদপুরের নামকরা এক ভাতের হোটেলে পেট ভরে ভাত আর গরুর গোসত খেলাম। গোসত খুব ঝাল ছিল। কিন্তু রান্নাটা ছিল খুব ভালো। আর আমরা বৃহত্তর যশোরের মানুষ। ঝাল একটু বেশিই খাই।

এরপর আমরা পানের দোকান থেকে পান কিনে খেয়ে মালেক ভাইয়ের বাসায় গেলাম। সে বাসায় মাত্র একটাই ঘর। সেদিন তাসের আসর বসল জমজমাট। কেন যেন আমিই সেদিন জিতে যাচ্ছিলাম বারবার। বিনা পয়সার খেলা, তবু তাতেও আনন্দ হচ্ছিল প্রচুর। এক ঘরের ভেতরে মেঝেয় শতরঞ্চি পেতে খেলা হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে মালেক ভাবির ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রেডিও বাজছিল। রেডিওর গান শুনতে শুনতে, কথা শুনতে শুনতে আমরা তাস খেলছিলাম, মাঝে মাঝে হাসিঠাট্টা করছিলাম, মাঝে মাঝে হো হো করে বেসুরো গলায় গান ধরছিলাম, সংসারের বিপদ-আপদ সম্পর্কে তখনো আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা হয়নি, আমাদের জীবন সবে শুরু, জীবন আমাদের কাছে তখন শুধুই সামনের দিকে তাকাবার, কোনোরকমের বিপদ বা ঝড়ঝঞ্ঝা তখনো আমাদের জীবনে ছায়াপাত করেনি, এইভাবে কখন যে সময় চলে গেছে, রাত গভীর থেকে গভীর হয়েছে, রেডিও আপনমনে বেজে চলেছে, আমরা সেই ঘরেরই মাঝারি সাইজের খাটের ওপরে একসময় ক্লান্ত হয়ে যে যেদিকে পারি পা লম্বা করে বা গুটিয়ে শুয়ে পড়েছি, রেডিও যে সেই রাত থেকে চলছে, রেডিও যে বন্ধ করতে হবে, তা কারো খেয়ালই নেই; একসময় ঘুমিয়েও পড়েছি, রেডিও আপনমনেই বেজে চলেছে, আর আমরা চার বন্ধু খাওয়া-দাওয়া করে, আনন্দ করে, তাস পিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমিয়েই পড়েছি।

ক্রমে রাত গভীর হয়েছে। রাত যখন আড়াইটে বা পৌনে তিনটে হবে, আমি শুয়ে থাকলেও কেন যেন আমার চোখে ঘুম আসছে না, অথচ তাকিয়ে দেখছি আমার সঙ্গীরা সব ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার ঘুম আসছে না, হয়তো মনের ভেতরে আমার স্যারকে না বলে ফরিদপুরে চলে এসেছি, এই চিন্তা মনের গভীরে কাজ করতে পারে, হঠাৎ শুনি রেডিওতে বুলেটিন দিচ্ছে,

‘স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে!’

প্রথমে আমি খেয়াল করিনি। পরে খেয়াল হলেও বুঝতে পারিনি, তৃতীয়বার আবার যখন শুনলাম আমার গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে উঠল। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম শুরু হয়ে গেল। এসব কি পাগলের প্রলাপ? আমি ভাবলাম। আমি রেডিওর দিকে হতভম্ব হয়ে একবার তাকাচ্ছি, তারপর ঘুমন্ত সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। ভাবছি, ওদের কি ঘুম থেকে ডাকবো? আমার কথা শুনে কি ওরা হাসবে? মাথা খারাপ ভাববে?

কিন্তু না, আমি আর সময় ক্ষেপণ করলাম না। এবার মালেক ভাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললাম, ও মালেক ভাই, ওঠেন তো, দেখেন তো কে কারে হত্যা করতিছে? আমি কি কানে ঠিক শুনতিছি? ওঠেন তো ভাই, দেখেন তো কীসব আবোল-তাবোল বলতিছে!

মালেক ভাই আমার ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, তোমার মিয়া মাথা খারাপ নাকি? নিজেও ঘুমাও না, আমাগেরও ঘুমোতি দাও না।

কিন্তু তারপর মালেক ভাইও অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে।

বুঝতে পেরে সে খালি ওঠবস করছে। যেন এরপর কী করবে বুঝতে পারছে না। মুখে শুধু বলছে, এখন কী হবে? ও সিরাজ, এখন কী হবে?

আমার অন্য দুই বন্ধু তখন বিছানায় উঠে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। জোরে জোরে দোয়া-দরুদ পড়ছে, চোখ মুখ বুক সব পানিতে ভেসে যাচ্ছে তাদের।

হায় আল্লা, এখন আমাগের কী হবে? লুলু সিকদার বলে উঠল।

মনি মিয়া বলল, হায়, আমরা যে এতিম হইয়ে গ্যালাম।

মালেক ভাই বলল, মাথা ঠান্ডা রাখো, ভাইরা। দেশে শত্র‍ু ঢুকে পড়িছে। আমাগের দেশটা কোনো শত্র‍ু হাইজ্যাক করার চিষ্টা করতিছে, ভাইরা, সাবধান!

এদিকে এক-দেড় মিনিট পরপরই রেডিওর বুলেটিন বেজে চলেছে।

এইসময় হঠাৎই আমার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে গেল। প্রথমেই মনে হলো, আমি তো এখন ফরিদপুরে। যদি আমার স্যার আমাকে কল করেন, তখন তো আমি যেতে পারবো না। আর বঙ্গবন্ধু যদি মারা যান, তাহলে তো আমার স্যারের কল আসবেই, স্যার তখন আমাকে কল দেবেন, কিন্তু আমি তো চাকরিস্থলে নেই, যেতে তো পারবো না।

লাফ মেরে এবার আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাই, আমার আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবার উপায় নেই। এখনই আমাকে গোপালগঞ্জের দিকে রওনা হতে হবে।

কিন্তু আমি এখন যাবো কীভাবে। রাত তো এখন গভীর। এই সময় যানবাহন কোথায় পাবো? কীভাবে গোপালগঞ্জ ফিরে যাবো?

জীবনে সেই প্রথম বন্ধুদের প্ররোচনায় হঠকারী কাজ করার জন্যে নিজেকে মনে মনে অভিশাপ দিলাম।

এভাবে নিজের ডিউটির জায়গা ছেড়ে চলে আসাটা কি আমার ঠিক হয়েছে। এখন যদি মুহূর্তের ভেতরে আমার স্যার চাকরিটা নট করে দেন?

আমার জন্যে আমার বন্ধুরাও পড়ে গেল মহাচিন্তায়।

রাত তখন তিনটে।

আমি পুলিশের নতুন ইউনিফর্ম পরে রওনা দিলাম।

তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। রাস্তাঘাট ছিল ভাঙাচোরা। বেশি রাতে যানবাহন পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই তখন গড়ে ওঠেনি। এখনকার মতো অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু হয় নি।

গভীর রাতে আমি রাস্তায় একাকী লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলাম। আর মনে মনে দোয়াদরুদ পড়তে লাগলাম। বারবার আমার চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর সেই বাঘের মতো চেহারা ভেসে উঠতে লাগল। ভায়েরা আমার –

রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু যেদিন বক্তৃতা দেন তখন আমি তরুণ। তখন আমি ইতনা গ্রামে থাকি। পরে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে আমরা তরুণেরা সাংঘাতিকভাবে অনুপ্রাণিত হই। আমাদের কাছে এই বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছিল এটাই স্বাধীনতার ডাক। মুক্তিযোদ্ধারা যখন মুক্তিযুদ্ধের জন্যে নয়া মিয়া ভাইয়ের কাছে ট্রেনিং নিচ্ছিল, তখন আমি সেখানে ছিলাম। কিন্তু মায়ের অসুখের জন্যে ঠিকমতো ট্রেনিং নিতে পারিনি।

তারপর তো দেশ স্বাধীনের চার বছরের মাথায় আমার এই চাকরিটা হয়। তারপর মা আমাকে বিয়ে দেন। সব একটার পর একটা ঘটনা আমার মনের ওপর দিয়ে যেন ভেসে যেতে লাগল।

নির্জন রাস্তায় একটা কুকুরও সেদিন নেই। আমি শুধু আপনমনে হাঁটছি আর ভাবছি, যিনি আমাদের জাতির পিতা, যিনি আমাদের আলাদা একটি জাতিসত্তা উপহার দিলেন আর তাঁকেই আমরা হত্যা করলাম? কিন্তু কেন হত্যা করলাম? কীসের জন্যে হত্যা করলাম? এ কীরকম হলো? এখন আমাদের উপায় কি? আমরা কীভাবে তাঁর দিক নির্দেশনা ছাড়া বেঁচে থাকবো।

 

এইসব ভাবছি আর হাঁটছি। ভাবতে ভাবতে আমার চোখ বেয়ে একভাবে পানি বের হতে লাগলো। আমার নতুন ইউনিফর্মের বুক ভেসে যেতে লাগল আমার চোখের অশ্রম্ন দিয়ে।

কী সে ভয়াবহ রাত।

জাতির জীবনে তো বটেই, প্রতিটি বাঙালির জীবনেও।

সেদিন সেই গভীর রাত্রের কান্নার মতো আমি আমার জীবনেও আর এরকমভাবে কোনোদিন কাঁদিনি।

এরপর থেকে যেন আমার মন শক্ত হয়ে যেতে লাগল।

ভাবতে ভাবতে দেখি রাস্তা দিয়ে একটা ট্রাক চলে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে সেটা থামালাম। তারপর ড্রাইভারকে নিজের পরিচয় দিয়ে তাতে চড়ে বসলাম।

কিছুক্ষণ বাদে নদীর ঘাটে এসে থামল সেটা, সেখান থেকে নেমে লঞ্চে উঠলাম, কিছুদূর গিয়ে লঞ্চ নদীর ঘাটে ভিড়লে আবার সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করলাম, এভাবে প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার পথ পার হয়ে আমি প্রথমেই বাড়ির দিকে ছুটলাম, স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে প্রথমেই জানতে চাইলাম কেউ আমার খোঁজে বাড়ি এসেছিল কী না, যখন শুনলাম কেউ আসেনি, তখন কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগলাম এবার আমি কী করবো।

ভাবতে ভাবতে ঘড়িতে দেখি সকাল সাতটা বেজে গেছে।

আর তার ঠিক পরপরই বাসায় পুলিশ এসে হাজির। তারা আমাকে ডেকে গোপনে ফিসফিস করে বলল, সিরাজ ভাই, তাড়াতাড়ি চলেন, স্যার আপনাকে ডেকেছেন।

বাড়ি ফিরে আমি পোশাক খুলে ফেলেছিলাম। এখন একথা শুনে আবার ইউনিফর্ম পরে নিলাম। তারপর স্যারের কাছে গেলাম। তারপর আমার সাবডিভিশন পুলিশ অফিসার আবদুল মান্নান সাহেব অর্থাৎ আমার স্যার, তারপর সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদের সাহেব এবং আমি একটা স্পিডবোটে চড়ে চলে এলাম টুঙ্গিপাড়ায়।

টুঙ্গীপাড়ায় এর আগে আমার কখনো ডিউটি পড়েনি, আমি আগে কখনো আসিনি। শুধু ছেলেবেলা থেকে শুনেছি এই গ্রাম নাকি বঙ্গবন্ধুর জন্মগ্রাম। এখন আমি এখানে এসে একেবারে যেন হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম, এই গহিন জঙ্গল ঘেরা গ্রামটিতেই কি আমাদের বঙ্গবন্ধু জন্ম নিয়েছিলেন? কী আশ্চর্য! এ যে একেবারে বাংলা মায়ের গর্ভ থেকে উঠে আসা এক গ্রাম! সজনে গাছের সবুজে, দিঘির কলমিলতায়, হিজলের পাতায় পাতায় সেকি এক অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ, তা বলে বোঝানো আমার মতো সাধারণ এক কনস্টেবলের পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীর এতবড় একজন রাষ্ট্রনায়কের জন্ম আমাদের এই টুঙ্গীপাড়া গ্রামে? আরে, আশ্চর্য! মনে মনে ভাবলাম।

কিন্তু আমার এইসব ভাবনা বাইরে থেকে কাউকে বুঝতে দিলাম না।

ছেলেবেলায় আমি স্কুলের খাতায় পদ্য লিখতাম বলে ক্লাসের বন্ধুরা আমাকে সিরাজ সাঁই বলে ঠাট্টা করতো। সেই কুষ্টিয়ার সিরাজ সাঁই। লালন ফকিরের গুরু।

আমার মনে হলো আমার এইসব ভাবনা বাইরে থেকে কেউ টের পেলে আমার বিপদ হবে।

আমরা ফিরে টুঙ্গিপাড়ার থানায় এসে বসলাম। বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কীসের অপেক্ষা?

বঙ্গবন্ধুর জন্যে অপেক্ষা। কারণ বঙ্গবন্ধুর মরদেহ তখনো এসে পৌঁছায়নি।

আমি মনে মনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু মুখের ভাব করে রাখলাম নির্বিকার, যেন কেউ বাইরে থেকে আমার মনের ভাব বুঝতে না পারে।

এমন সময় একজন এসে আমার কানে কানে বলল, বঙ্গবন্ধুর জন্যে কবর খোঁড়া হচ্ছে!

কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখনো এসে পৌঁছাননি।

আমি মনে মনে ব্যাকুল হয়ে আমার স্যারের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। কিন্তু আমার স্যারের মুখের ভাবও নির্বিকার। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, তার মনেও অনেক ধরনের চিন্তা খেলে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় চিন্তা হয়তো এই জায়গা ছেড়ে নিরাপদে নিজের থানায় ফিরতে পারবেন কী না।

তখন বেলা প্রায় দশটা বা এগারোটার দিকে আকাশে একটা হেলিকপ্টার ঘুরতে দেখলাম। হেলিকপ্টারটা মাটিতে নামার আগে টুঙ্গিপাড়ার মাথার ওপর অনেকক্ষণ ধরে যেন ঘুরতে লাগল। যেন নামার আগে একশ ভাগ নিশ্চিন্ত হয়ে তবে সেটা মাটিতে নামবে!

দেখে আমার মনে হলো হেলিকপ্টারটা ভয় পেয়েছে। টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টার নামতে ভয় পাচ্ছে! হয়তো ভাবছে লক্ষ লক্ষ টুঙ্গিপাড়াবাসী তারা নামলেই তাদের ঘিরে ফেলবে।

অবশেষে হেলিকপ্টার নামল।

হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাত্র একজন মেজর আর একজন সিপাহিকে দেখলাম।

এইসময় স্থানীয় হাসপাতাল থেকে মানুষ চলে এলো। তারপর থানার কয়েকজন পুলিশ এবং হাসপাতালের লোকজন বঙ্গবন্ধুর কফিন ধরে ধরে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। আমি ওদের সঙ্গে সঙ্গে থাকলাম।

আমি কফিনের দিকে লক্ষ করে দেখলাম কফিনের কাঠ চারপাশ থেকে লম্বা লম্বা পেরেক ঠুকে শক্ত করে আটকানো। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানার ভেতর ঢুকে কফিনটাকে নামানো হলো উঠোনে।

উঠোনে দাঁড়িয়ে অল্প একটু সময়ের জন্য আমি আনমনা হয়ে গেলাম। ভাবলাম, এই সেই উঠোন যেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ছেলেবেলায় ধুলোমাটি খেলেছেন! শহীদ হয়ে আবার এই মাটিতেই তিনি ফিরে এলেন।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ যেন নিস্তব্ধতা নেমে এলো বাড়ির ভেতরে। যেন কিছুক্ষণের জন্যে সকলেই একটু 888sport sign up bonusবিধুর হয়ে গেল। হয়তো ভাবল, শেষ যেবার বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ির উঠোনে হেঁটে গিয়েছিলেন, তখন কি তিনি জানতেন এরপর তাঁর মরদেহ এসে বাড়ির উঠোনে নামবে?

এইসময় মেজরের হুকুমে কে একজন একটা শাবল জোগাড় করে আনলো। সেই শাবল দিয়ে একটা একটা করে পেরেক উঠিয়ে কফিন খোলা হলো।

অনেক কষ্টে চোখের পানি সামলে রেখে আমি ঝুঁকে তাকিয়ে দেখলাম। দেখলাম এই মহীরুহের সবল দেহ চাপাতি আর বরফ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এখন এই পাতি সরিয়ে তাঁকে বের করতে হবে। কথাটা ভেবে আমার হাত কাঁপতে লাগল। কাঁপা কাঁপা হতে আমি চায়ের পাতিগুলো ধীরে ধীরে সরালাম।

সেই পাতি আর বরফ সরিয়ে দেখা গেল তাঁর শরীর সাধারণ একটি কাপড় দিয়ে 888sport app, যেটি কাফনের কাপড় নয়। কাফনের তো তিন খ- কাপড় হবে, সেখানে শুধু এক খ- বস্ত্র দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

না, এটা তো হতে পারে না।

এই লাশের তো কাফন হয়নি! কীভাবে তাহলে কবরে নামবে?

অসম্ভব!

মনে মনে এ-কথা চিন্তা করে আমি মাথা ঘুরিয়ে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। দেখি একটু দূরে কফিনের দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখে সেই মেজর সাহেব মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে ভীষণ এক উদ্বেগ।

পারলে তখুনি তিনি লাশ নামিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেন।

আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার, লাশের তো গোসল হয়নি মনে হচ্ছে!

আমার প্রশ্ন করার সাহস দেখে মেজর সাহেব অবাক হয়ে গেলেন। রাগে তার মুখ লাল হয়ে উঠল। কপালে, নাকে ঘাম জমে গেল বিন্দু বিন্দু।

আমারও বুক কেঁপে উঠল ভয়ে।

কিন্তু না, এখন ভয় পেলে চলবে না। এ এক ভীষণ সংকটের সময়।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে, তারপর কিছুটা যেন নিরুপায় হয়ে তিনি রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলেন, কে কার গোসল করাবে?

তার প্রশ্ন শুনে যেন চারপাশ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। গাছের পাতা নড়া যেন বন্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ বাতাস বইছিল থিরথির করে, সেই বাতাসও যেন মনে হলো হঠাৎ থমকে গেছে।

যেন আকাশ-বাতাস নীরব একটি বাক্যে ভরে গেছে চারদিক, তাই তো, কে এই মহীরুহের শরীরে হাত রেখে গোসল করাবে? কার এত বড় সাহস আছে?

মেজর সাহেবের যে নেই, সেটা তো তার কথার ভাঁজেই আমি বুঝতে পারলাম।

কিন্তু আমি সামান্য একজন কনস্টেবল। আমার কী সাহস আছে যে মুখ খুলি?

কিন্তু না, সাহস আমাকে পেতেই হবে। সাহসী আমাকে এই পরিস্থিতিতে হতেই হবে, নইলে কোনো উপায় নেই। এতে করে যদি আমার প্রাণ যায় তো যাবে। আমার মতো সামান্য একজন কনস্টেবলের প্রাণের মূল্যই বা কী।

আমি তখন বললাম, স্যার, কবর যখন খোঁড়া হয়েছে, মুসলমান হিসেবে তাঁকে আমার গোসল দিতে হবে, কাফন দিতে হবে, তারপর দাফন করতে হবে। এ ছাড়া তো কবর দেওয়া যাবে না!

মেজর সাহেব আমার কথা শুনে প্রথমে একটু যেন হতভম্ব, তারপর রেগে গিয়ে বলে উঠলেন, মিয়া, আপনার বাড়ি কোথায়?

মেজর সাহেব নিশ্চয় ভেবেছিলেন যে আমি বোধহয় বঙ্গবন্ধুর কোনো আত্মীয় হবো। কিন্তু তাকে আমি বললাম, স্যার, আমার বাড়ি যশোর জেলার লোহাগড়া থানার ইতনা গ্রামে।

উনি আমার উত্তর শুনে কিছুক্ষণ যেন থম মেরে বসে থাকলেন।

তারপর তাড়াহুড়ো করে বললেন, দেরি করলে লাশ ছিনতাই হয়ে যেতে পারে!

এবার আমি তার দুশ্চিন্তার কারণ বুঝলাম। তখন বললাম, স্যার, বাইরে একশো চুয়ালিস্নশ ধারা জারি করা হয়েছে। ১৯টি জেলার পুলিশ ফোর্স দিয়ে টুঙ্গিপাড়া ঘেরাও করা হয়েছে। লাশ কীভাবে কে ছিনতাই করবে? লাশ ছিনতাই করার তো কোনো সুযোগ নাই।

মেজর সাহেব আমার কথা শুনে আবার কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকলেন। তারপর সংক্ষিপ্তভাবে বললেন, গোসল কে করাবে আর কতক্ষণ সময় লাগবে?

তখন আমি সাহস করে বললাম, স্যার, আমি গোসল করাবো।

তুমি গোসল করাবে? মেজর সাহেব যেন একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন।

আমি বিনীত হয়ে বললাম, হ্যাঁ, স্যার।

তুমি কি গোসল করাতে জানো? মেজর সাহেব বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

তার চেহারা দেখে মনে হলো তিনি নিজে হয়তো কোনোদিন কাউকে এভাবে গোসল দেননি।

উত্তরে আমি বললাম, জি, স্যার। ছেলেবেলা থেকে এইসব কাজ আমরা জানি।

কতক্ষণ লাগবে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

এই আধঘণ্টার মধ্যে হয়ে যাবে। উত্তরে আমি বললাম।

মেজর সাহেব আমার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বললেন, আচ্ছা, তাহলে করাও।

অনুমতি তো মিললো। এখন কাফনের কাপড় পাবো কোথায়? মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে হাতেও সময় আর বেশি নেই। একবার ভাবলাম লাশ ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কাফনের কাপড় জোগাড় করে আনি। তখন আমাদের ইতনা গ্রামের একজন পুলিশ অফিসার, তার পোস্টিং তখন ছিল টুঙ্গিপাড়ায়, থানার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে কাজ করতেন, তিনি আমার পেরেশানি লক্ষ করে বললেন, তোমার আর কাপড় আনতে যাওয়ার দরকার নেই, কাপড় আমি নিয়ে আসছি। তুমি গোসল করাও।

তো তার কথা শুনে আমি কৃতজ্ঞ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে তো খুব ভালো হয়, স্যার।

একটু পরে সেকেন্ড অফিসার চলে গেলে আমি ভালো করে বঙ্গবন্ধুর শরীরের দিকে তাকালাম। তাঁকে লাশ ভাবতে আমার মনের ভেতরে খুব কষ্ট হতে লাগল। এ-কষ্ট কাউকে বোঝানো যাবে না।  এ-কষ্ট যার যার, তার তার। আরো মনে হলো আমার মতো একজন নগণ্য ব্যক্তি আজ এই বিরাট মানুষটিকে গোসল করাবে, এতবড় সৌভাগ্য আল্লাহতায়ালা আমার কপালে রেখেছিলেন ভেবে আমার দুচোখ বারবার পানিতে ভরে আসতে লাগল।

কিন্তু না, আমার মন শক্ত করতে হবে।

এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর পরণে শুধু লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি।

আমি যখন তাকিয়ে দেখে ভাবছি, এমন সময় বঙ্গবন্ধুর দূরসম্পর্কের একজন চাচা এসে আমার কাছে দাঁড়ালেন। তিনিও নীরবে বঙ্গবন্ধুর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কী যেন ভাবতে লাগলেন। তার চোখ শুকনো। বুঝলাম অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সামলে রেখেছেন। আমি বললাম, স্যার, আমাকে একটা বালতি আর একটা বদনা দেবেন, গোসল করাতে হবে।

উনি আমার কথা শুনে ঝটিতি বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুটো টিনের পুরনো বালতি, আর পুরনো সিলভারের একটা বদনা নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন।

আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে গোসল করাচ্ছি, এর ভেতরে কাফনের কাপড়ও নিয়ে আসা হলো।

সেই কাপড় দেখে আমার মন বিষাদে ভরে গেল। এইরকম মানুষকে আমি কীভাবে এই কাপড় দিয়ে কাফন পরাবো? লাল পাড়ের শাদা কাপড়। সেই পুরনো দিনের মার্কিন থানের কাপড়। এইগুলো মহিলাদের রিলিফ দেওয়ার সময় বিলি করা হতো। এই কাপড় দিয়ে অনেক সময় হাসপাতালের বেওয়ারিশ লাশদের দাফন দেওয়া হতো। দেখেশুনে মন আরো খারাপ হয়ে গেল। তার ওপর দেখলাম কাপড়ে কম হয়ে যাচ্ছে। মাত্র দুটো কাপড় আনা হয়েছে। তাও আবার আড়ে খাটো। অথচ আমার লাগবে তিনটে কাপড়।

আমি সেকেন্ড অফিসারকে বললাম, স্যার, এই দুটো কাপড়ে তো হবে না, আরো কাপড় লাগবে।

আরো কাপড় কোথায় পাবো? এবার করুণ মুখে বলে উঠলেন সেকেন্ড অফিসার।

পরে বুদ্ধি করে কাপড় জোড়া দিয়ে তিনটে খ- করা হলো। কাফন প্রস্ত্তত করা হলো।

এই ফাঁকে গোসলের জন্য ৫৭০ কাপড় কাচার সাবানও আনা হলো। সাবান চোখে দেখে কান্নায় আমার বুক ভেঙে গেল। স্বাধীন 888sport appsের স্থপতিকে আজ আমি সাধারণ কাপড় কাচা সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দাফন দিচ্ছি, যেখানে গোলাপ ফুলের নির্যাস দিয়ে সুগন্ধি আতর দিয়ে মাখনের মতো পেলব নরম সাবান দিয়ে তাঁকে শেষ গোসল দেওয়া উচিত ছিল এই বাঙালি জাতির।

চোখের পানি আমি আর রোধ করতে পারলাম না। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগল। আমি তা লুকোবার চেষ্টা না করে আপনমনে আমার কাজ করে যেতে লাগলাম।

তাঁকে গোসল করাবার সময় আমি যুগপৎ অবাক ও বিস্মিত হচ্ছিলাম। কারণ তাঁকে গুলি করে মারা হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাঁর শরীরে কোথাও জখমের দাগ নাই!

ভাবলাম, তাহলে তিনি মারা গেলেন কীভাবে?

এই ভেবে আরো ভালো করে তাঁর শরীরের দিকে লক্ষ করলাম। তখন দেখতে পেলাম বুকের ঠিক বাম দিকে তিনটে ছোট ছোট ছিদ্র হয়ে আছে। লাল তিনটে ছিদ্র।

ছিদ্র তিনটি পরম যত্নে পরিষ্কার করে আমি চামড়াগুলো টেনে এনে এক জায়গায় করলাম। তখন একটু একটু করে রক্ত বেরোতে লাগল। আমি বুদ্ধি করে কাফন সেলাইয়ের সুই দিয়ে তাঁর সেই ক্ষতস্থান সুন্দর করে সেলাই করে দিলাম।

মনে মনে বললাম, আপনার জীবনের সব ক্ষত, সব কষ্ট একদিন দেশবাসী এভাবে সেলাই করে দেবে, স্যার! আপনি চিন্তা করবেন না! আপিনি যেখানে আছেন, স্যার, সেখানে নিশ্চিমেত্ম থাকেন।

তাঁর ডান হাতটা বেশ জখম হয়েছিল। ডান হাতটিকেও যত্ন করে পরিষ্কার করলাম। তারপর দাফন শেষ করে কবরের কাছে নিয়ে এলাম। এখন তাঁকে কবরে নামাবে কে?

লাশকে কবরে নামাতে গেলে আগে তো নিজেকে কবরের ভেতরে নামতে হবে।

এখন দেখি কেউ আর অগ্রসর হয় না।

আমার কেন জানি মনে হলো, কেউ কেউ হয়তো ভাবছে কবরে নামলে পরে আর কবর ছেড়ে ওঠা যাবে না! তাকেসুদ্ধ গুলি করে এই মেজর সাহেব এই কবরেই নামিয়ে দেবে! হয়তো কোনো সাক্ষী রাখবে না!

শেষে আমিই তাঁকে কবরে নামালাম।

মনে মনে ভাবলাম, যদি বেঁচে থাকি, কোনোদিন না কোনোদিন আমি গর্ব করে দেশের মানুষকে আমার এই হাত দুখানা উঁচু করে তুলে ধরে বলতে পারবো, এই যে দেশবাসী দেখুন, একদিন এই দুটো হাতে আমি জাতির জনকের মরদেহ নিজ হাতে গোসল করিয়ে, কাফন পরিয়ে, কবরে নামিয়ে দাফন করেছি। আমি ধন্য।

আমার এইসব ভাবনার ভেতরেই কবরে লাশ শোয়ানো হয়েছে, এবার আমি দোয়া পড়ে কবর থেকে উঠে এলাম।

এর আগে অবশ্যই জানাজা পড়ানো হলো। পুলিশ, স্টাফ আর হাসপাতালের মানুষজন মিলে বিশ-পঁচিশজন লোকের সঙ্গে জানাজা পড়া হলো। তাছাড়া লোক কীভাবে আসবে? কাউকে তো লাশের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।

এবার কবরের ওপরে উঠে আমি বাঁশের জালি খাঁচা দিয়ে কবর ঢেকে দেবার জন্যে প্রস্ত্ততি নিচ্ছি, হঠাৎ করে আমার চোখের সামনে কীরকম যেন ঘটে গেল! যেন তেলেসমাতির মতো কিছু। দেখি, দূরের গলিপথ দিয়ে, ঝুলে থাকা অন্ধকার গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে, প্যাচপেচে কাদা, গোবর আর শুকনো ডালপালা পা দিয়ে ইলিবিলি হয়ে মাড়িয়ে, হাউমাউ করতে করতে কোত্থেকে এগিয়ে আসছে কতকগুলো হাড় জিরজিরে কংকালসার মানুষ। গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। তারা সবাই মহিলা। তাদের পরণে মলিন একপেঁচে শাড়ি, মাথায় মলিন ও ছেঁড়া ঘোমটা, নাকে পিতলের নথ, রুক্ষ লাল চুলে তাবিজের মাদুলি, কারো কারো কপালে আর সিঁথিতে লাল টকটকে সিঁদুর : তাদের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, হাঁটুর কিছুটা নিচ থেকে তাদের পা খালি এবং ধূলিধূসরিত, একজনের কোলে ন্যাংটো একটা বাচ্চা, মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, তার ঘুমন্ত মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে তারা সব হেঁটে এসেছে, নিঃশব্দে হেঁটে এসেছে। যেন সকলের চোখের আড়ালে তারা হেঁটে এসেছে। তারা সব হঠাৎ বাকরুদ্ধ। তাদের চোখ লাল। দূর পথ হেঁটে আসার পরিশ্রমে তাদের সকলের মাথা বেয়ে, কপাল বেয়ে, মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছে। তারা সকলে সারাপথ কাঁদতে কাঁদতে এসেছে বোঝা যায়।

আমার চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন অচেনা, ছায়া ছায়া হয়ে এলো। হতবুদ্ধি হয়ে ভাবলাম, এসব কী? চোখে ঠিক দেখছি তো? এই ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে এত সাহস তারা কোত্থেকে পেল? এইসব হতগরিব মানুষ?

আমি যেন মুখ হা করে তাদের তাকিয়ে দেখলাম, আমার সঙ্গে যারা ছিল, সকলে দেখল, তার সব হুড়মুড় করে এগিয়ে এসে সেই মেজর সাহেবের পায়ের কাছে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লেগেছে। প্রাণের মায়া না করে তাদের কেউ কেউ মেজর সাহেবের পায়ের ওপরে পড়ে বিলাপ করে বলছে, আমাগো বঙ্গবন্ধুরে শেষ একবার দেইখবার দ্যান, বাবা!

জেবনে আর কোনোদিন তো তারে আমরা আর দেখতি পাবো নানে! শুধু একবার দেখবার দ্যান, বাবা।

বাবা, আমাগের সব শ্যাষ, একবার শুধু –

আর মেজর সাহেব ভীত চোখে পা ঝাড়া দিয়ে সরে বসে বলছেন, এই, সরো সরো, যাও এখান থেকে। ভাগো।

না বাবা, তা’লি আপনার পা ছাড়বো না নে, একবার দেখাতিই হবে, বাবা!

তাদের কথা শুনে আমরা যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কতবড় সাহস! এতবড় সাহস তারা কোথায় পেল?

মেজর তখন গম্ভীর মুখে বললেন, এখন দেখানো যাবে না, কীভাবে দেখাবো? দাফন হয়ে গেছে।

কিন্তু একথা বললে কী হবে? তারাও নাছোড়বান্দা।

এতদূর থেকে এসেছে। একবারের জন্যে বঙ্গবন্ধুর মুখ না দেখে তারা তো যাবে না!

তাদের ভাব দেখে আমার যেন মনে হলো তারা বাঙালি মিলিটারি কাকে বলে জানে না। তাদের চোখে খাকি উর্দির কোনো দাম নেই, উর্দির প্রতি কোনো 888sport apk download apk latest versionবোধও নেই। আছে শুধু ভয়। প্রাণের ভয়।

তারপরও তারা জানে যাঁকে হারিয়েছে চিরদিনের জন্যে তাঁকে কখনোই চোখের আড়াল হতে দেবে না একবার তাঁর গৌরবদীপ্ত মুখম-লটি শেষ চোখে না দেখে।

আমি অবস্থা দেখে একটু এগিয়ে গিয়ে মহিলাদের একজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, মা, আপনাদের বাড়ি কোথায়?

একজন নাকের পানি চোখের পানি ময়লা আঁচলে মুছতে মুছতে বলল, কাউলি পাড়া।

কাউলি পাড়া? সে তো অনেক দূর, মা। এতদূর থেকে আপনারা আসছেন? তাও পায়ে হেঁটে?

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

তাদের ভেতর থেকে বয়স্কা একজন মহিলা, গম্ভীরভাবে বলে উঠল, কেন আসপো না বাবা, বঙ্গবন্ধুরে হারায়ে ফেলিছি, আমাগের আর তো কিছু হারাবার নাই, বাজান!

আমি তখন সাহস করে মেজর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, স্যার, দশ-বারো মাইল রাস্তা হেঁটে এই মেয়েগুলো এখানে এসেছে তাঁরে শেষ একবার চোখের দেখা দেখবে বলে। এরা কি তাহলে না দেখে ফিরে যাবে?

মেজর তখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, ওপরে বাঁশের খাঁচা পড়ে গেছে, কে এখন তাদের মুখ দেখাবে?

তখন আমি বললাম, স্যার, আমি দেখাবো।

আমার কথা শুনে মেজর সাহেব যেন এইবার একেবারে ক্ষেপে গেলেন। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আপনি মিয়া তো আচ্ছা লোক, সেই তখন থেকে, লাশ আসছে পর থেকে আপনি লেগেই আছেন এর পেছনে। ব্যাপারটা কী বলেন তো?

আমি চিৎকার শুনে একটু দূরে সরে গিয়ে মনে মনে বললাম, আমার আর ব্যাপার কি। আমি সামান্য একজন কনস্টেবল। জাতির পিতাকে আমি নিজের হাতে কবরে নামিয়েছি, এইটুকুই শুধু আমার ব্যাপার!

তারপর আমি আবার কবরের কাছে গিয়ে মহিলাদের কাছে ডাকলাম। বাঁশের তৈরি নতুন খাঁচাটি দুহাতে সরিয়ে দিলাম। তারা যেন একেবারে হুড়মুড় করে কবরের কাছে এসে সকলে দাঁড়াল। যে মুহূর্তে আমি বঙ্গবন্ধুর মুখের কাপড় খুলে তাদের দেখালাম, তারা তো হাউমাউ করে সকলে মিলে কান্না জুড়ে দিলো। আমি সামান্য একজন কনস্টেবল, কিন্তু সেদিন তাদের কান্না শুনে আমার মনে হলো যেন শোকগ্রস্ত সমগ্র দেশবাসীর কান্না তারা এই দশজনে মিলেই কাঁদছে!

আমি মনে মনে বললাম, কাঁদো মা সকল, কাঁদো। তোমাদের হারিয়ে ফেলা সোনার মানিকের জন্যে কাঁদো। তোমাদের খোকার জন্যে কাঁদো। তোমাদের বঙ্গবন্ধুর জন্যে কাঁদো। তোমাদের সোনার দুলাল শেখ মুজিবের জন্যে কাঁদো।

সেই নির্জন নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু কান্নার শব্দ। তাদের কান্না শুনে যেন চারদিকে শোকের মাতম পড়ে গেল। অনেকেই চোখ মুছতে লাগল। অনেকে মাটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলল। কারো রক্তচক্ষু যেন আর তাদের চোখের পানি রোধ করতে পারল না। কিন্তু মেজরের চোখে কোনো পানি নেই। তার অবস্থা দেখে আমার মনে হলো যেন তার চোখের সব পানি সেই খাকি উর্দিই শুষে নিয়েছে! হয়তো তার বাপ মরলেও তিনি কোনোদিন কাঁদবেন না। যেন তিনি মানুষ নন!

কিন্তু তখন এতকথা ভাববার সময় নেই। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

আমি মেয়েদের কান্না থামাতে বলে আমার নিজের স্যার আবদুল মান্নান সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালাম।

এতক্ষণ বাদে আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এতিম মনে হচ্ছে।

স্যার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, সিরাজ, তুমি আজ অনেক কাজ করেছো, এখন বিশ্রাম নাও।

একথা শুনে আমার মুখ নিচু হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, কীসের বিশ্রাম? গতকাল রাত থেকে যা কিছু ঘটেছে, এইগুলো তো সব স্বপ্ন, এইগুলো কি বাস্তব?

১৭/৪/২০১৯

* ঐতিহাসিক ঘটনাবলি অবলম্বনে।   – লেখক