শুক্কুরবারের কা-টা ঘটানোর আগে কাশেম আমাদের গ্রামে পাত্তা পাওয়া কেউ ছিল না। অথবা এটা বললে ভালো হয়, কাশেমকে নিয়ে বহুকাল আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। কিন্তু শুক্কুরবার আসর ওয়াক্তের পর থেকে কাশেমকে পাত্তা দিতে শুরু করতে হয় আমাদের। শুক্কুরবার দুপুরের একটু পরপর কাশেম গলায় ফাঁস নেয়। তার জিহবা বের হয়ে যায় আধহাত এবং সে মাটি হতে সাত-আট হাত ওপরে শূন্যে ঝুলে থেকে বাতাসে নড়তে থাকে ডানে-বাঁয়ে।
কাশেমের শরীরটা পাওয়া যায় রাঢ়ি খালের মাঝ বরাবর, হাটে যাওয়ার রাস্তায়। জায়গাটিতে একটা বাঁক আছে, বাঁকের খাপ বরাবর একটা বিশাল চালতাগাছ রাস্তাটিকে প্রায় অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটিতে রাজ্যের চালতা ধরে, এবার এখনো চালতা ধরেনি, সবে ফুল এসেছে। কাশেম এই চালতাগাছের একটা অপেক্ষাকৃত হালকা ডাল বেছে নিয়েছিল নারিকেলি কাছিটি বাঁধার, যে-কাছির ঝোলানো মাথাটি সে ফাঁসের আকৃতি করে তার মধ্যে তার হনু ঠেলে ওঠা মুখসমেত মাথাটি ঢুকিয়ে দিয়ে ‘হু আল্লা হু’ বলে ঝুলে পড়ে। ‘হু আল্লা হু’ সে বলেছে, এটা আমরা সহজেই ধরে নিতে পারি; কাশেম যে-কোনো কাজের আগেই বাক্যটি বলতো। চালতাতলাটি আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, এখানেই সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় আমরা হাতের তালুতে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মৌলানা সাহেবের কন্যা জাহেদার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম একসময়, সেসব দীর্ঘশ্বাসের কার্বন
ডাই-অক্সাইডের পুষ্টি এখনো চালতার পুরনো ডালপালায় খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু নিছক গলায় ফাঁস নেওয়াতেই কাশেমকে নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করতে হয় না আমাদের। নারিকেলি কাছি আর তা বাঁধার মতো আম, চালতা, গাব গাছের কমতি না থাকায় গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়ার কা- আমাদের গ্রামের ইতিহাসে নেহায়েত কম নয়। কাশিমকে পাত্তা দিতে শুরু করতে হয় তার ঝুলে থাকা শরীরের গায়ে জাপটে থাকা লাল ফুলের ছাপা শার্টের পকেটে পাওয়া একটা চিরকুটের কারণে, মানে চিরকুটের লেখাটার কারণে। ঘামের শুকিয়ে ওঠা দাগের ব্যাকগ্রাউন্ডে, ডাক্তারখানার প্যাডের চকচকা কাগজে সবুজ কালিতে লেখা ইংরেজি অক্ষর জেড, তার নিচে গোটা গোটা হাতে লেখা : ‘ইহা সইত্য’ এবং কোনায় একটা ঝাপসা ‘লাভ চিহ্ন’ আঁকা। ‘ইহা সইত্য’ বাক্যটি পরপর দশবার লেখা, এক লাইনের নিচে আরেক লাইন। চিরকুটটি আমরা হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ পাই না, পুলিশ এসে তার শার্টের পকেট হাতড়ে চিরকুটটি বের করে, তারপর বাতাসে ঝুলিয়ে জোরে জোরে পড়ে। আমরা তা ভিড়ের ভেতরে খানিকটা দূর থেকে দেখার সুযোগ পাই এবং একঝলক দেখেই বুঝতে পারি লেখাটি কাশেমের নিজ হাতের। তার হাতের লেখার সঙ্গে আমরা পরিচিত।
মুরুবিবরা জেড অক্ষরের মানে বুঝতে পারে না; কিন্তু এক ঝলক দেখেই আমাদের মনে একটা পুরনো 888sport sign up bonus ঝিলিক মেরে ওঠে এবং আমরা এই সংকেতের মানে বুঝে ফেলি। চালতাগাছের শক্ত বাকলে নানাবিধ যেসব আঁকিবুঁকি প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়, তার মধ্যে একবার ‘জেড’ অক্ষরের মতো একটা চিহ্ন তৈরি হলে তা সর্বপ্রথম চোখে পড়ে কাশেমের এবং সে রাজ্যজয়ের আনন্দ নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, দেখছস, দেখছস, চালতাগাছের মইধ্যে কোন হারামজাদায় জাহেদার নাম লিখ্যা রাখছে। তার সে-আবিষ্কারে আমরা প্রথমে হকচকিত হয়ে গেলেও সে-সময় বিষয়টা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন হাসাহাসির খোরাক পেয়ে যাই এবং রঙ্গ করে বলি, চালতাগাছের মনে হয় জাহেদারে মনে ধরছে। সুতরাং সবুজ কালিতে আঁকা জেড মানে যে জাহেদা, তা আমরা পরস্পরের মধ্যে পরামর্শ না করেই স্থির করে ফেলতে পারি। প্রশ্ন হলো, ‘ইহা সইত্যে’র কাহিনিটা কী? এ-প্রশ্নের কাছে মুরুবিবদের মতো আমরাও থমকে যাই এবং চিন্তাভাবনা প্যাঁচ খেয়ে গেলে কাশেমকে অন্য চোখে আমাদের দেখতে শুরু করতে হয় কেননা, প্যাডের কোনায় ঝাপসা ‘লাভ চিহ্ন’ আমাদের মনে ‘কুড়কুড়ি’র জন্ম দেয় এক নিমেষে।
হঠাৎ করে আমরা বুঝতে পারি, কাশেমকে আমরা এতকাল মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। তার ঠেলে ওঠা দুই গালের হনু, মাথায় ফোঁড়ার কারণে চেঁছে ফেলা থোকা থোকা কদমছাঁট চুল এবং মুখে ব্রণের বিচ্ছিরি দাগের কথা আমাদের মনে আছে। কিন্তু আরেকটু ডিটেইলস মানে তার চোখের রং কিংবা থুঁতনির আকার কিংবা কপালের দৈর্ঘ্য, এমনসব জিনিস বারবার চেষ্টা করেও আমরা মনে করতে পারি না। তার চেয়েও বড় কথা, জেড দিয়ে জাহেদাকে ইঙ্গিত করার কারণের বিন্দুবিসর্গও আমাদের মাথায় ধরে না। তবে কি? এ্যাঁ? এ নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রথমে তর্কাতর্কি হয়, তারপর কথাকাটাকাটি হয় এবং একপর্যায়ে ঝগড়া লেগে যাওয়ার উপক্রম হলে আমরা পরস্পরকে থামাই। আমরা বলি : আইচ্ছা, দুই মিনিট খেমা দে, একটা সুখটান দিয়া লই, মাতা-মুতা ঘুরতাছে।
জেড অক্ষরের মাহাত্ম্য আমরা পুলিশ এবং মুরুবিবদের কাছে পেশ করি না, নিজেরা এর সমাধান বের করবো বলে ঠিক করি। চিরকুটটি হাতে পাওয়া গেলে ভালো হতো, তা সম্ভব হয় না। পুলিশ কাশেমের লাশের সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটটিও নিয়ে যায় থানায়। দুদিন পর লাশটি ফেরত আসে, চিরকুটটি ফেরত আসে না।
আমাদের আড্ডার জায়গা পরিবর্তন হয়েছে কয়দিন ধরে। চালতার ডালে কাছির একটা অংশ এখনো ঝুলছে, অসাবধানে চোখ পড়লে তাকে লকলকে জিহবার মতো মনে হয়। তাছাড়া জায়গাটিতে উলটাপালটা দেখার ঘটনা বেশ কবার ঘটে যাওয়ার পর থেকে নিজের অজান্তেই কেমন একটা গা-ছমছমে ভাব হয়। তাই আমরা এখন হরিশংকরবাবুর চাউলকলের পাশে, আকাশের দিকে পেট ঠেলে উঁচু করা পুলের সরু বাহুতে বসে খালের দিকে পা ঝুলিয়ে দিয়ে থাকি। একটাই সমস্যা আড়াল কম, আগুন ধরানোর আগে চোখ-কান একটু বেশি খোলা রাখতে হয়। একটা ফাইভ স্টারের ঝিম-ধরানো ধোঁয়া ভাগাভাগি করে নিতে নিতে, আমরা কাশেমকে খুঁটিয়ে মনে করার চেষ্টায় লিপ্ত হই।
বয়সের হিসাবে কাশেম আমাদের চেয়ে এক কিংবা দুই বছরের বড় হতে পারে। তবে সিক্স পর্যন্ত সে আমাদের সঙ্গেই পড়েছে। তারপর সেভেনে ওঠার দিন কাশেম আমাদের জানায়, আববায় কইছে, ক্ষেতের কামে লাগি যাইতে। সেই অবধি কাশেম ক্ষেতের কাজে লেগে যায় তার বাবার সঙ্গে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার শরীর এক প্রকার পোড়াটে শক্ত হয়ে যায়। হাডুডু খেলতে এলেই তা আমরা টের পেয়ে যাই। হাডুডু মাঠে কাশেমকে নিয়ে কাড়াকাড়িও লেগে যেতে থাকে, আড়ালে-আবডালে আমরা তাকে ডাকতে শুরু করি : কাশু ভইষ। মহিষের মতোই তার জোর আমাদের ঈর্ষান্বিত করে দিতে থাকে।
ক্ষেতের কাজের মাহাত্ম্য কাশেম বর্ণনা করতো উদাস গলায়। এ-সময় তার স্বরে যে-অভিজ্ঞতা ফুটে উঠতো, তা শুনে আমরা রীতিমতো চুপসে যেতাম। সে লুঙ্গির খোঁট থেকে আকিজ বিড়ির একটা দলা-পাকানো টুকরো বের করে তাতে ফস করে আগুন ধরাতো, তারপর কালচে ধোঁয়া নাকের দুই ফুটো দিয়ে বের করে দিতে দিতে বলতো : ব্যাডা, মাটির ভিতরতন গাছ বাহির করণ সোজা ভাইবছত নি? হোগা হাডি যায় কাম কইরতে কইরতে। কিন্তুক একবার গাছ ভুডভুডাইয়া বাইর হইলে দেইখতে কী যে সুখ লাগে রে – । রে বলে সে দীর্ঘ টান দিত, সঙ্গে সঙ্গে বিড়ির ধোঁয়ার একটা লম্বা রেখাও তৈরি হতো তার রোদপোড়া মুখটা ঘিরে। মাটি ভেদ করে গাছ বের করাতে কী সুখ লাগে তা জানার জন্য আমাদের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ তৈরি হয় না, ততদিনে আমরা স্কুলের 888sport apk বই থেকে চিত্রসহ বীজের অঙ্কুরোদ্গমের বৃত্তান্ত শিখে গেছি। কিন্তু নাক দিয়ে আকিজ বিড়ির ধোঁয়া বের করার কায়দা আমাদের রীতিমতো বিমুগ্ধ করে, আমরা সে-বিদ্যা তার কাছ থেকে শিখতে চাই। কাশেম তার হলুদ দাঁত দেখিয়ে হাসে : হ, হরে ধরা খাইলে কবি কাইশ্যায় শিখাইছে, ক্যান? আমরা এ-অভিযোগের উত্তরে কিরা কাটতে শুরু করি। নানান জিনিসের দোহাই দিয়ে আমরা কিরা কাটি, কিন্তু একমাত্র বিদ্যার কিরা কাটাকে কাশেম বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং আমাদের আকিজ বিড়ির ধোঁয়া মুখে খেয়ে নাকে বের করার তালিম দিয়ে দেয়। ধূমপানের তালিম নেওয়া হয়ে গেলে সে বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞেস করে : মুখে গন্ধ হইছে নি? আমরা হাহ্ হাহ্ করে হাতের ওপর নিশ্বাস ফেলি এবং আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করি, বিড়ির উৎকট ধোঁয়া ভুরভুর করে বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। কাশেম খিলখিল করে হাসতে হাসতে তার অব্যর্থ বিদ্যা বাতলায় : লেবু গাছতন দুইটা কচি পাতা ছিঁড়ি ভালোমতন চাবাই ঘরে যাবি। বিড়ির গন্ধমন্ধ দেখবি সব দূর হই যাইব। আমরা এখন আর আকিজ বিড়ি খাই না, ফাইভ ফাইভ কিংবা ক্যাপস্টান অথবা নিদেনপক্ষে থ্রি স্টার ছাড়া আমরা ছুঁই না, কিন্তু মুখের গন্ধ দূর করার কাশিমি বুদ্ধিতে আমরা এখনো নির্ভর করে আছি। বস্ত্তত সিগারেটের প্যাকেটের মধ্যেই আমরা লেবুপাতা জমা করে রেখে দিই। কখন হাতের কাছে পাওয়া না যায়, বলা যায় না। লেবু পাতার একটা নামও আমরা দিয়েছিলাম তখন : কাশেমি বিড়ি।
কাশেমের কাছে আমাদের এমন আরো কিছু গোপন বিষয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে আসলে উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো কাশেমের উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে জাহেদাকে আবিষ্কার। ততদিনে আমরা ক্লাস টেনে উঠেছি। কাশেমের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা এখন শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে। বড়জোর যেদিন ফুটবল খেলায় কোনো একজন খেলোয়াড় কম পড়ে, সেদিন তাকে আমাদের বিশেষ দরকার হয়, অথবা গরমের দিনে ডাব ও শীতকালে খেজুরের রস চুরির প্রয়োজনে তাকে আমরা তোয়াজ করি। তার প্রয়োজন যথাযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে যে-কারণে আমরা মিশতে সংকোচ বোধ করতে শুরু করি, তার কারণ নিতান্তই বাহ্যিক। ক্লাস টেনে উঠতে না উঠতেই আমরা শাহরুখ খানের স্টাইলে চুল কাটতে শুরু করেছি, মুখে তিববত স্নো এবং ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলি মেখে ‘আই অ্যাম সরি’, ‘থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ’ বলতে শিখে গেছি। অন্যদিকে কাশেমের ত্বক ততদিনে রোদে পুড়ে চাকা চাকা দাগ পড়ে গেছে, মুখের ব্রণ খুঁটে-খুঁটে সে বীভৎস সব ক্ষত তৈরি করে ফেলেছে এবং তার বিড়ি টানা কুচকুচে কালো মাড়ির সঙ্গে ফাটা ঠোঁট প্রসারিত করে সে যখন ‘কী রে ব্যাডা, স্কুলে নি যাস’ বলতো, তার হলুদ দাঁত আমাদের মনে ঘৃণার উদ্রেক করতে শুরু করতো। কাশেম যখন রোদে পিঠ ঠেকিয়ে ক্ষেতে মাটি মেখে অশস্নীল সুর করে ‘বুকটা ফাইট্যা যায়’ গায়, আমরা তখন জ্যামিতি ভূগোল ও ইংরেজি রচনার মাঝে মাঝে উদাস হয়ে ‘হে মেরে হাম সফর’ গাই। দিনে দিনে এ-পার্থক্য ক্রমশ বাড়তেই থাকে এবং একসময় আমরা বেমালুম ভুলে যাই, কোনো এক কালে আমরা একই সঙ্গে পড়তাম। কাশেমকে এখন আমাদের তুলনায় অনেক বয়স্ক দেখায়, তার ছোট ছোট ছাঁটা চুলে অনেক ফ্যাকাশে পাকা চুলের আবির্ভাব আঙুল তুলে নিত্য তাই মনে করিয়ে দেয়। এহেন এক সময়েই আমাদের স্কুলে মৌলভি সাহেব মাস্টারি নিয়ে আসেন, স্কুল বদলে সঙ্গে আসে ক্লাস এইটে ওঠা জাহেদা, মৌলভি সাহেবের মেয়ে।
সে-সময় আমরা সবে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে নিচু স্বরে শিস বাজাতে শিখেছি। সমস্যা হলো, বোম্বের নায়িকাদের পোস্টার (যেগুলো নান্টু নাপিত স্বয়ং ইন্ডিয়া থেকে কিনে নিয়ে এসে তার দোকানের বেড়ায় সেঁটে রেখেছে) দেখে দেখে আমাদের নাক উঁচু হয়ে গেছে। যার ফলে, আয়নায় নিজেদের দেখা চেহারার কাঠামো বেমালুম ভুলে গিয়ে আমরা গ্রামের মেয়েদের দেখে নাক সিঁটকাতে শুরু করেছি। কাউকেই আমাদের মনে ধরার মতো মনে হয় না এবং নান্টু নাপিতের দোকানে বসে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আমরা দীর্ঘ উদাস উদাস দিন পার করতে থাকি। জাহেদাকে দেখেও আমাদের ভাবান্তর হয়নি প্রথমে। হওয়ার উপায়ও ছিল না। জাহেদা কালো একটা বোরখা পরে আসত, কোনোদিন রিকশায়, কোনোদিন মাইল তিনেক হেঁটে। আর সব সময়ই তার সঙ্গে সঙ্গে মৌলভি সাহেব। বোরখা দেখে প্রথমেই আমরা নাক সিঁটকাই, মৌলভি সাহেব সঙ্গে থাকাতে আমরা তাকে সোজাসুজি খরচের খাতায় ফেলে দিই। কিন্তু আমাদের ধারণায় প্রবল ঝাঁকি দেয় কাশেম।
চালতাতলায় সেদিন আমরা বরাবরের মতো গুলতানি মারছি, বিষয়বস্ত্ত ‘সজন’। এইসব বিষয়ে হানিফ সবার থেকে একটু এগিয়ে, সে আমাদের উচ্চারণ ঠিক করে দেয় : সজন না ব্যাটা, উচ্চারণটা হলো সাজন। তারপর সে-সিনেমার কাহিনিটিও বর্ণনা করে সবিস্তারে। আমাদের বাজারে তখন একমাত্র মশিউরভাইর কাঠমিলে ভিসিআর ছিল। সেখানে সাজনের ক্যাসেটটি আনেনি এখনো। হানিফ 888sport app গিয়েছিল তার খালার বাসায়, সেখানে দেখে এসেছে। হানিফ দু-লাইন গানও গায় : তু আশিক হে, মে তেরে আশিকি …। ঠিক এমন সময় কাশেম আড্ডায় ঢুকে পড়ে। এসেই তার হলুদ দাঁত মুখের খাপ থেকে বের করে আমাদের কথার মধ্যে বাঁ-হাত ঢুকিয়ে দেয় : কী রে, তোগো স্কুলে বলে মধুরী আইছে একটা। মধুরী মানে যে মাধুরী দীক্ষিত তা বুঝতে আমাদের কয়েক মুহূর্ত লাগে এবং বোঝার পর আমরা হা-হা করে উঠি। এসব হাসি কাশেমের গায়ে লাগে না, সে বলা বাক্যটি আবার বলে। এবার আমরা কিঞ্চিৎ মনোযোগী হই তার কথায়। আমাদের স্কুলে মাধুরী আর আমরা এখনো জানি না, এ-কথা রীতিমতো অপমানকর। কাশেম বেশি মজাকের ধার দিয়ে যায় না, সোজাসুজি বলে : মৌলুভির মাইয়াটার চেহারা-ছবি দেখছত? বোরখা যে পরে, সেইটা কি এমনে এমনে মনে করছস!
মৌলভির মেয়ে মানে জাহেদা, আমরা চমকে উঠি। তাই নাকি? তার পরের কয়েকদিনে আমরা আড়ে আড়ে জাহেদাকে খেয়াল করি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমরা একমত হয়ে যাই, মাধুরী দীক্ষেতের মতো না হলেও জাহেদা এ-গ্রামে নায়িকাতুল্য, অন্তত কালো বোরখায় ঘিরে আসা সুডৌল এবং ফর্সা মুখটা ভালো করে দেখলে দীর্ঘশ্বাস উঠতে বাধ্য। এ-মুখ এতদিন আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে আর ধরা পড়েছে কাশিম্যার চোখে – ভেবে আমাদের দৃষ্টির ব্যাপারে কনফিডেন্স খানিকটা টাল খেয়ে যায়। ভাঙা কনফিডেন্স জোড়া লাগাতে আমরা জাহেদাকে আরো মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতে থাকি। অচিরেই চলতে-ফিরতে বাতাসে বোরখা টলটল করে উঠলে মুখটার নিচে জাহেদার ধবধবা ফর্সা লম্বাটে গলাও (অনেক পরে আমরা জেনেছি এ-ধরনের গলাকে গ্রীবা বলে) দেখা যায় এবং আমরা একযোগে ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে প্রাইভেট পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
জাহেদার ব্যাপারে কাশেমের অবদানের কথা পর্যন্ত 888sport sign up bonusচারণ হয়ে গেলে আমাদের উচিত জাহেদার সঙ্গে কাশেমের যোগসূত্র ঘটার মতো কোনো ঘটনা খোঁজার দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠা। কিন্তু জাহেদার ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘশ্বাসের সূত্রপাতের পুরনো কথাগুলোর 888sport sign up bonus ঝালাই করে নিতে, আমরা বুঝতে পারি, একটা জ্বালা-ধরানো ভালো লাগা মনের মধ্যে ভুসভুস করে ওঠে। অতএব, এ-ব্যাপারে আরেকটু 888sport sign up bonusচারণ করা যেতে পারে বলে আমরা একমত হই।
অংক এবং বুককিপিং ছাড়া আমাদের স্কুলে আর কোনো বিষয়ে প্রাইভেট পড়ার ইতিহাস নেই। অংক ও বুককিপিংয়ের টিচাররা যখন প্রাইভেট পড়িয়ে কূল পান না, সেখানে অন্য টিচাররা বড় বড় শ্বাস ফেলে বাড়তি রোজগারের ধান্ধায় কেউ ভাগের পুকুরে মাছ চাষে টাকা লাগান, কেউবা সকাল ও বিকেলের অবসর সময়টায় বাজারে একটা দোকান খোলার কথা ভাবেন। জাহেদার বাবা মৌলভি স্যার গনিপুর জামে মসজিদে ইমামতি করেন। আববাস বুদ্ধি দেয় : চল একখান কাম করি। প্রাইভেট পড়নের কতাটা স্কুলে না কইয়া গনিপুর চইল্যা যাই। গনিপুর গিয়া স্যারের বাড়িত গিয়া কই। তাইলে বেশি গুরুত্ব দিবো।
মৌলভি স্যারকে এতদিন আমরা খুব যত্নে এড়িয়ে চলতাম। কেননা যেখানে অন্য স্যারদের কোনোরকমে মুখের ভেতরে রেখে ‘সস্নামুলাইকুম’ বললেই চলে, সেখানে তাকে শুদ্ধ উচ্চারণে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলতে হতো। তাও বেশিরভাগ সময়ই তিনি ভুল ধরতেন। মেয়েদের সামনেই বলে বসতেন : তোমার জিববাটা বেশি ভারি। সুপারি কি বেশি খাও? সুপারি বেশি খাইলে এমন জিববা ভারি হয়। অথচ তার বাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট পড়ার কথা বলার বুদ্ধিতে আমরা একটুও চমকাই না। আমরা দ্রুত একমত হই, আইডিয়াটা এক নম্বর। মেŠলভি সাহেবের বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আববাস আরো দু-এক কথা বলতে শুরু করেছিল; কিন্তু সে দ্রুত বুঝতে পারে, তার দরকার নেই। তার থেকে আমাদের কারো গরজ নেহায়েত কম নয়। অতএব এক ছুটির দিন, আমাদের গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে গনিপুর গিয়ে মৌলভি সাহেবের বাড়ির চারদিকে ঘুরঘুর করতে শুরু করি। আমাদের মুখ গম্ভীর হয়ে থাকে, চুলের ভাঁজ যাতে নষ্ট না হয় সে-চেষ্টায় যেদিক থেকে বাতাস আসে, সেদিক থেকে যথাসম্ভব মুখ সরিয়ে রাখি এবং কিছু একটা শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখি। খানিক বাদে জলিল চোখ বড় বড় করে ফিসফিসিয়ে ওঠে : শুনছস? শুনছস?
কী শুনেছি সে-প্রশ্ন এবং তার উত্তর শুরু করতে না করতেই বাড়ির দিক থেকে মৌলভি স্যার বেরিয়ে আসেন। আমরা সমস্বরে দীর্ঘ সালাম দিই। তিনি বিন্দুমাত্র ভুল ধরতে পারেন না আমাদের উচ্চারণে, ঝাড়া তিন মাইল ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ মশকো করতে করতে গিয়েছিলাম আমরা।
সালাম মশকো করা ছাড়াও আমরা ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নানাবিধ পয়েন্ট আলোচনা করে গিয়েছিলাম, যাতে মৌলভি সাহেবের মনে অন্য সন্দেহ বিন্দুমাত্র খচ করে না ওঠে। সুখের বিষয়, তার একটা বাক্যও আমাদের খরচ করতে হয় না। সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, প্রাইভেট পড়ানোর জন্য অনুরোধ করা বাক্যটিও আমরা শেষ করতে পারি না, তিনি বলতে শুরু করেন : দেখো দেখি, বুঝাইয়া-সুঝাইয়া আরো দু-একজন জোগাইতে পারো নি, তাইলে ধরো ব্যাচটা পুরা হয়। তারপর অন্যদের কী বলে বোঝাতে হবে সে-বিষয়েও পয়েন্ট ধরিয়ে দেন : ম্যাট্রিকে কয়টা লেটার পাইছো, এইটাই আসল। কোন বিষয়ে পাইছো, এইটা ঘটনা না। পোলাপাইনরে কইবা, ইসলামিয়াতে লেটার পাওয়াইয়া দেওনের দায়িত্ব আমার।
কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম, তিনি আমাদের বাড়িতে নিয়ে পিঠামিঠা খাওয়ার জন্য বলবেন (বাড়ির দিক থেকে চাইয়্যা পিঠার ভুরভুরে ঘ্রাণ ভেসে আসছিল), আমরা আমতা আমতা করবো, তারপর ‘থাক স্যার, কী দরকার’ বলতে বলতে রাজি হয়ে যাব। মৌলভি স্যার আমাদের আমতা আমতা করার ও পরবর্তীকালে রাজি হয়ে যাওয়ার ধার দিয়েও গেলেন না। কথা বলতে বলতে তিনি আমাদের নিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আববাস বলেই বসল : স্যারগো বাড়িত মনে হয় চাইয়্যা পিঠা বানায়। হে-হে-হে-হে। মৌলভি স্যার আববাসের কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে প্রাইভেট পড়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সে-বিষয়ে কয়েকটা আরবি লাইনসহ বোঝাতে লাগলেন। আমরা ওয়াজ শোনার মতো করে সেসব শুনতে শুনতে একটু পরপর সোবহানাল্লাহ, সোবহানাল্লাহ বলতে থাকি। রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে তিনি বাকিতে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে মুড়ির গোল্লা কিনে দিয়ে, বাকি ফয়সালা কাল স্কুলে হবে বলে, বিদায় দিয়ে দেন।
পরদিন ফয়সালা যা হয়, তাতে আমাদের আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায়। পরপর দুইদিন দুইটা ফয়সালা হয় এবং তাতে আমাদের আক্কেল দুইবার গুড়ুম হয়ে যায়।
প্রথম আক্কেলগুড়ুম : আমাদের স্কুলের সব স্যারই প্রাইভেট পড়ান তাদের নিজেদের বাড়িতে। আমরা সকালে কিংবা বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় গিয়ে পড়ে আসি। কেউ কেউ সন্দেশ, পিঠা, মুড়ি মাখানিও খাওয়ান। মৌলভি স্যার এক ঝটকায় সেসব সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বললেন : তাইলে আগামীকাল থেইক্যা স্কুল ছুটির পর শুরু কইরা দিই? এ-কথায় আমরা সমস্বরে জি জি শুরু করে দিই কেননা, স্কুল ছুটির পর মানে হলো তিন মাইল তিনি ও জাহেদার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ। আর বিকেলে নাস্তা না খাইয়ে রাখবে, এমন পাষ- তাকে আমাদের মনে হয়নি তখনো। আমাদের জি জি-র মাঝখানেই তিনি প্রথম ফয়সালাটা করলেন : দশম খ-শাখার রুমটাতে বইসো। ওইটাতে
হাওয়া-বাতাস আসা-যাওয়া করে ভালো। দপ্তরিরে আমি কইয়া রাখছি, খোলা রাখবো তোমগো লাইগা।
দ্বিতীয় আক্কেলগুড়ুম : প্রথম ধাক্কা সামলানোর জন্য আমাদের সামনে একটা প্রবোধ ছিল, নিশ্চয় জাহেদাও স্যারের সঙ্গে সঙ্গে বসে থাকবে আমাদের প্রাইভেট পড়ার সময়টায়। না হলে সে একা বাড়ি যাবে কেমন করে! কিন্তু দ্বিতীয় দিন স্কুল ছুটির পর আমরা অবিশ্বাস্য চোখে দেখতে পাই, মানে চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দেখতে হয় যে, মৌলভি স্যার জাহেদার একা বাড়ি যাওয়ার সমাধান করেছেন তার জন্য একটা বাঁধা রিকশার ব্যবস্থা করে। সপ্তাহে তিনদিন তিনি আমাদের পড়াবেন, সে তিনদিন জাহেদা রিকশা করে বাড়ি যাবে। আর বাজারে বিশ-পঁচিশটা রিকশাওয়ালার মধ্যে তিনি খুঁজে বের করেছেন কাশেমকে! জি, আমাদের সেই কাশেমের কথাই বলছি।
কাশেম ক্ষেতের কাজই করতো মূলত। কাজকাম কম থাকলে সে মাঝে মাঝে রিকশা চালাতো। মৌলভি স্যারের সঙ্গে এ-বাবদে তার যোগাযোগ নেহায়েত কাকতালীয় কিনা, এ-প্রশ্নের জবাব আমাদের কখনো জানা হয়নি। প্রশ্নটির জবাবে সে সবসময় তার হলুদ দাঁত ও ঘোলা চোখ সহকারে এমন একটা ভঙ্গি করতো, তার একটাই উত্তর ধরে নেওয়া যেত : আল্লার দান, মিয়া বাই।
ঘটনা এমন মোড় নিলে আমরা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকি। আমাদের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায় – ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে প্রাইভেট পড়ার বুদ্ধি প্রথম কার মাথায় এসেছে, এ নিয়ে। সে-তর্কের বিশদ বিবরণে গিয়ে লাভ নেই। কেননা, তর্কাতর্কি-উদ্ভূত কোনো বুদ্ধিই যে আমাদের আগামী তিন মাস মাসিক দেড়শো টাকা করে স্কুল-পরবর্তী সাপ্তাহিক তিনদিন ইসলাম শিক্ষাবিষয়ক প্রাইভেট পড়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না – এ-বাস্তবতায় আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই। তখন ঘাসের ডগা চিবুতে চিবুতে আমাদের একজন বলে – আরে ব্যাটা আল্লা-রসুলের নাম, তারপর ধর পরকাল-আখিরাত, সুন্নাত-ফরজ, হজ-জাকাত এইসব নিয়া ভালো ভালো কথা লিখে দিলেই তো ধর্মে লেটার ওঠে। তার লাগি সপ্তায় তিনদিন প্রাইভেট পড়া লাগে? আর দ্বিতীয়জন বলে – আমরা তাইলে বইসা বইসা আলেফ বে তে পড়ুম, ফাঁকতালে কাশিম্যা জাহেদারে লই রিকশায় হাওয়া খাইবো!
বাস্তবিকই কাশেম যখন থেকে জাহেদাকে রিকশাতে ওঠাতে শুরু করে, আমরা তার মধ্যে একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন খেয়াল করি। তার কদমছাঁট চুল লম্বা হয়ে উঠতে থাকে, একটা পকেট চিরুনি (কালো রঙের, এক টাকা দাম) দিয়ে যখন-তখন সে চুল আঁচড়ায়। তার মুখের ব্রণে পাউডার পড়ে বলেও আমাদের মনে হয়, কেননা তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিববত ট্যালকম পাউডারের কড়া গন্ধ পাওয়া যায়।
শেষ পর্যন্ত ঘটনা দাঁড়ায় এরকম : সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস শেষ করে আমরা দশম শ্রেণির খ-শাখায় ঢুকতে ঢুকতে দেখি, কাশেম তার কমলা-হলুদের চক্রাবক্রা মাফলারটা কায়দা করে গলায় পেঁচিয়ে রিকশা নিয়ে স্কুলগেটে দাঁড়ায়, জাহেদা তার রাঙা পা ফেলে (জাহেদার রাঙা পা আমাদের কল্পনা করতে হয় কেননা তা দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, সে কালো রঙের মোজা পরে থাকে পর্দার অংশ হিসেবে, তবে সুন্দরী মেয়েদের পা রাঙাই হয়, আমরা সিনেমায় দেখেছি) রিকশায় উঠতে যায়। সে যত রিকশার দিকে এগোয়, কাশেমের হলুদ হলুদ দাঁত (ইদানীং সেগুলোকে প্রায় সাদাই দেখায়, মনে হয় নিয়মিত ছাই ঘসে) ততো মুখগহবর হতে বেরোতে থাকে। জাহেদা ঠিক যে-মুহূর্তে রিকশায় ওঠে, সেই মুহূর্তে কাশেম আমাদের দিকে ফিরে চোখ টিপ মারে, তারপর জাহেদার দিকে ফিরে বলে : টাইট হইয়া বও দেখি, দেখো কেমনে উড়াইয়া লইয়া যাই। হু আল্লা হু। তারপর জাহেদা টাইট হয়ে বসে, কাশেম হোন্ডায় ওঠার মতো লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে প্যাডেল চালাতে থাকে, তার মাথা দুলতে থাকে এদিক-ওদিক রিকশার তালে তালে, আমরা পরিষ্কার শুনতে পাই (কল্পনায়) কাশেম গাইছে : আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে, ধুত্তুর ধুত্তুর ধুত্তুর ধু, সানাই বাজিয়ে …
তারপরের কিছুদিন আমরা কাশেমের সঙ্গে আগের তুলনায় একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হই। কিংবা কাশেমই আগ বাড়িয়ে আমাদের সঙ্গে বেশি বেশি মিশতে থাকে। তার মুখে আমরা জাহেদা-সম্পর্কিত প্রায় আলৌকিক সব খবরাখবর শুনতে থাকি। যেমন কাশেম আমাদের জানায় : মাইয়াটা বড় ভালো রে। মোটেও দেমাগ নাই। আমারে নিজ মুখে কইছে, রিকশাওয়ালারাও মানুষ। কাশেম আমাদের আরো জানায় : আরে ব্যাটা, যেই ভদ্র বুঝছত নি। প্রত্যেকটা দিন আমারে হয় পিঠা নাইলে মুড়ি নাইলে শরবত, একটা না একটা কিছু খাওয়াইবই। জাহেদার মাও বড় ভালো। আমারে কইছে, রাস্তাঘাটে যেন জাহেদারে দেইখ্যা রাখি। আমিও কইছি, খালাম্মা, কোনো চিন্তা কইরেন না, হু আল্লা হু, কোন পোলাপাইনে জাহেদার দিকে চোখও তো তুলি তাকাইতো পাইরতো ন।
এইসব বলতে বলতে কাশেম যেই দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাতো, তা সহ্য করা আমাদের পক্ষে শিগগির মুশকিল হয়ে পড়ে। কাশেমের এইসব গালগল্প আমরা প্রথম প্রথম হেসে উড়িয়ে দিই। তাকে নিয়ে ঠাট্টাও করি : হ, তোমারে বডিগার্ড রাখছে। কিন্তু অচিরেই আমরা খেয়াল করি, রিকশায় ওঠার সময় জাহেদা হেসে হেসে কাশেমের সঙ্গে গল্প করছে। কী নিয়ে গল্প করে, তা আমরা দূর থেকে বুঝতে পারি না; কিন্তু কাশেমকে শত্রুজ্ঞান করার জন্য জাহেদার হাসিই যথেষ্ট হয়ে দেখা দেয়। মৌলভি স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়লেই আমাদের মনে পড়ে যেতো : কাইশ্যা হারামজাদায় জাহেদাগো বাড়িত বইস্যা নারকেল-মুড়ি খাইতেছে রে। শেষ পর্যন্ত ‘কাশিম্যার মতো পোলা’র কাছে হেরে যাওয়ার একটা বিচিত্র অনুভূতি আমাদের কুরে কুরে খেতে থাকলে আমরা এ-মর্মেও গোপনে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি : রিকশাওয়ালা হওনটাও খারাপ না। প্রেম কি আর ধনী-গরিব মানে?
এটা স্বীকার করাই ভালো যে, প্রেম কি আর ধনী-গরিব মানে-সংক্রান্ত তত্ত্বটি আমাদের মৌলিক আবিষ্কার নয়, সিনেমা দেখে শেখা। উদাহরণ হিসেবে আমরা বেদের মেয়ে জোছনার নায়িকা জোছনার যুগপৎ গলা এবং হৃদয়-কাঁপানো অনেকগুলো সংলাপের হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারি। কিন্তু প্রেম এবং শ্রেণিসংগ্রাম গোলানো এ-তত্ত্বটি যত হৃদয়গ্রাহী হোক না কেন, ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে কাশেমকে মিলাতে আমাদের রীতিমতো কসরত করতে হয়। সে-কসরতে আমরা সফল হই না এবং বর্তমান পরিপ্রেক্ষেতে নায়ক হিসেবে কাশেমকে মানতে আমাদের ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। আমরা অচিরেই দেখতে পাই, জাহেদার ব্যাপারে কাশেমের কথাবার্তায় একটা সম্ভ্রম-মেশানো সতর্কতা ফুটে উঠছে, কোনো রকম খারাপ ইঙ্গিত সেখানে থাকে না এবং কাশেম মাঝে মাঝে – আল্লায় যদি তোগো মতন পড়ালেখা করণের সুযোগ দিতো জাতীয় বাক্য বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ হঠাৎ উদাস হয়ে যায়।
এ পর্যন্ত আমাদের 888sport sign up bonusচারণ হয়ে গেলে দেখা যায়, আমাদের প্রত্যেকেরই বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। আমরা তখন পরস্পরের চোখের দিকে তাকানো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দূরের বোরো ক্ষেতের দিকে এবং তার পরে মাথা তুলে থাকা গোয়ালবাড়ির সহোদর তালগাছ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকি। তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমরা বুঝতে পারি, কাশেম ও জাহেদা সংক্রান্ত 888sport sign up bonusচারণের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য আর বিশেষ কোনো ঘটনা আমরা মনে করতে পারছি না, যাকে বর্তমানকালে পাওয়া চিরকুটটির সরাসরি যোগসূত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়।
আমাদের মনে পড়ে, কাশেমের মুখে জাহেদা-সংক্রান্ত কথাবার্তা ক্রমশ কমে যেতে থাকলে আমরা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম : কী রে কাশিম্যা, খাওন-দাওন এখনো চলেনি মৌলভির বাড়িত? তার উত্তরে কাশেম মুখ গম্ভীর করে উত্তর দেয় : তোগো হিংসা লাগে, ক্যান?
মূলত কাশেমের এই গা-জ্বালানো উত্তরই প্রথমবারের মতো আমাদের নায়ক নায়ক ভাবের মধ্যে কষে ঝাঁকুনি দেয়। আমরা বলাবলি শুরু করি – ধুর অ। যেই মাইয়ার রিকশাওলার লগে খাতির, হের নজর কেমন তা তো বুঝাই যায়। তখন আমরা নতুন করে ভাবতে শুরু করি : আসলেই কি জাহেদার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলা যায় কিনা?
তারপর একদিন কাশেমের তিনমাসের রিকশা বাওয়ার বান্ধা চাকরি ও আমাদের তিন গুণন দেড়শো, মানে সাড়ে চারশো টাকার ইসলাম শিক্ষার প্রাইভেট পড়া শেষ হয়। মৌলভি সাহেবের হাতের লেখা আরবি কোটেশন সহযোগের লম্বা লম্বা সব নোট বাদ দিয়ে আমরা পপি গাইড পড়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্ত্ততি নিতে থাকি। আমাদের স্কুল তিনমাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং জাহেদার মুখ মনে পড়ার জন্য (যদিও জাহেদাকে আমরা প্রায় বাদ দিয়ে দিয়েছি মন থেকে) জাহেদার আববার দিকে মাঝে মাঝে তাকানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ কিনা জাহেদা-সংক্রান্ত গোলযোগ প্রায় থেমে যায় ও আমরা পড়ায় মনোনিবেশ করি। যদিও আমাদের কানে আসে প্রায়ই যে, মৌলভি স্যারের বউ কিংবা জাহেদার কোথাও যাওয়ার দরকার পড়লে কাশেমের রিকশার ডাক পড়ে এবং কাশেম এ-সংক্রান্ত কোনো কথা উঠলেই দ্রুত অন্য কথায় চলে যেতে চায়।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরবর্তী অখ- অবসরে আমরা কাশেমকে তীক্ষন পর্যবেক্ষণ করি এবং একপর্যায়ে নিঃসন্দেহ হই যে, জাহেদার সঙ্গে কাশেমের নেহায়েত রিকশাওয়ালা ও পেসেঞ্জারের সম্পর্ক। আমরা ভীষণভাবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি এবং পরীক্ষার রেজাল্ট এলে যে মিষ্টি নিয়ে গনিপুরে মৌলভি স্যারের বাড়িতে যেতে হবে, এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এর মধ্যেই একদিন কাশেম হুট করে আদমজী জুট মিলে কাজ করতে 888sport appয় চলে যায়।
যেহেতু আমাদের তখন আর স্কুলে যেতে হয় না, তাতে আমাদের মধ্যে একটা বড় বড় হয়ে যাওয়ার ভাব চলে আসে এবং আমরা বাজারের মোড়ে সকালে ও বিকেলে এবং বিশেষত চালতাতলায় আড্ডা দিতে শুরু করি। মৌলভি সাহেবকে দেখে দীর্ঘ সালাম দিয়ে আলাপ জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি এবং তার পেছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা জাহেদাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি : ভালো করি পড়ো তো? এ-সময় জাহেদা মিষ্টি করে হাসে এবং আমাদের বুক খাঁ খাঁ করে ওঠে। উলেস্নখ্য, কাশেম আদমজী চলে যাওয়ার পর থেকে জাহেদার প্রতি আমাদের মনোযোগ আবার নিবিষ্ট হতে শুরু করেছে। আর যাই হোক, এ-কথা তো সত্য যে, জাহেদার নজর কাশেমের মতো একটা বিদ্ঘুটে দেখতে রিকশাওয়ালার দিকে যেতেই পারে না।
এ পর্যায়ে আমাদের পুলের বাহু হতে নেমে নিচে দাঁড়াতে হয়। কেননা, আমরা বুঝতে পারছি, এরকম 888sport sign up bonusচারণ আসলে নেহায়েত বুকের জ্বালাই বাড়িয়ে দিচ্ছে কিন্তু কাশেমের ‘ইহা সইত্যে’র কোনো কূল-কিনারার দিকে যাচ্ছে না। ঠিক তখুনি বোমা ফাটায় মোবাশ্বের। সে ফোঁত করে নাক ঝাড়ে এবং সিকনি জমা হাত পুলের গায়ে মুছতে মুছতে বলে : তাইলে ভিতরের খবর হুন, 888sport app থেইক্যা কাশিম্যা বাড়ি এলে প্রায়ই জাহেদাগো বাড়িত যাইতো। আমরা সমস্বরে এ্যাঁ করে উঠি। মোবাশ্বের দ্বিতীয়বার নাক ঝেড়ে বলে : হ, সইত্য। আমি জানি।
দেখা যাচ্ছে, এতক্ষণ পর ঘটনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আমাদের ঝাঁ করে মনে পড়ে, গতবার যখন কাশেম বাড়ি আসে, তার বাবা তাকে বিয়ের কথা বললে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। তার বাবা নুরুল কাকা চায়ের দোকানে আমাদের কাছে তার দুঃখ ঝেড়েছিলেন : পোলাটার মতিগতি বুঝলাম না। চাকরি-বাকরি যখন করছ, কইলাম বিয়া কর। ঘোঁত ঘোঁত করে। হা-ও কয় না, না-ও কয় না। ইয়া মুছিবত।
যে-পর্যায়ের কথা এখন হচ্ছে, ততদিনে আমাদের সঙ্গে কাশেমের দূরত্ব যোজন হয়ে গেছে। আমরা এখন দশমাইল উত্তরে নিবারণ সরকার ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে পড়ি। কাশেম এখন আর আলোচ্য কোনো বিষয়ই না আমাদের কাছে। বছরে বড়জোর দুবার সে গ্রামে আসে, দুই ঈদে দুইবার। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে – কী রে, কুনদিন আসছত? – এর বেশি কোনো কথা হয় না। জাহেদা ম্যাট্রিক পাশ করে ঘরে বসে আছে, যে-কোনোদিন তার বিয়ে হয়ে যাবে। তাই এ-সংক্রান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলার মাত্রা ও পরিমাণও আমাদের মধ্যে কমে আসছে। জীবনের এ-সত্য আমরা বুঝে ফেলেছি, চুলে শাহরুখ খান কাট দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাভ হয় না। তবু চালতাতলায় হাবিজাবি কথার সঙ্গে এ-প্রসঙ্গ ওঠে এবং আমরা না চাইলেও মাঝেমধ্যে জাহেদা-সংক্রান্ত দীর্ঘশ্বাস উঠতে থাকে।
মোবাশ্বেরের এই উক্তির পর আমরা একযোগে তাকে বকাঝকা শুরু করি। যার মূল বিষয়বস্ত্ত হলো, এই কথাটা সে এতক্ষণ ধরে কেন বলেনি। তাহলে অন্তত এতসব খুচরো 888sport sign up bonusচারণার আমাদের দরকার পড়তো না। একইসঙ্গে মোবাশ্বের আমাদের তদন্তের একটা কিনারাও দেখিয়ে দেয়, সেজন্য আমরা তার দেওয়া তথ্যের ওপর জোর দিতে শুরু করি। মোবাশ্বের তখন আমাদের আরো জানায় : যতবার কাশিম্যায় বাড়িত আসতো, ততবার মৌলভি স্যারগো বাড়িত যাইতো। যাওয়ার সময় চানাচুর, চকলেট এসবও সঙ্গে নিত।
আমাদের প্রত্যেকের গলা দিয়ে যে বিস্ময়ের ও স্বস্তির শব্দটি বের হয়, তার মিলিত রূপ দাঁড়ায় : ওহ্ হো, এই ঘটনা, তাইলে বোঝ, এহ হে রে, তলে তলে এই-ই, ইসস, পুরাই চালু রে, হুম-ম ইত্যাদি। এবং আমরা এবার আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্টটি তৈরি করে ফেলি। ঘটনা দাঁড়ায় এরকম :
তলে তলে নিশ্চয় কাশেম জাহেদার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছিল এবং এজন্যই এক কালের বান্ধা রিকশাওয়ালার পরিচয় সুবাদে সে জাহেদাদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে থাকে। তাদের বাড়ির যাবতীয় কাজকর্মে সে সবার আগে এগিয়ে যেতে শুরু করে, কারণে-অকারণে তার আগ্রহ দেখিয়ে জাহেদা, মৌলভি সাহেব ও তার বউয়ের মন কাড়তে চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই সে তার রূপ ও যোগ্যতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল এবং মনে মনে জাহেদাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কাশেম বাড়ি এসেছিল দিন তিনেক আগে। বাড়ি এলে প্রতিবারের মতো তার বাবা ও মা বিয়ে করার জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করে। প্রতিবার কাশেম বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও এবার সে পরিবারের কাছে জাহেদাকে বিয়ের খায়েশটি প্রকাশ করে। প্রেমে পাগল কাশেমের বিষয়-বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেলেও নিশ্চিতই তার বাবা ও মায়ের তা যায়নি। তাই তারা এ-বিষয়ে কাশেমকে তার অযোগ্যতা দেখিয়ে দিয়ে এই অসম্ভব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বলে। এইসব নিয়ে কাশেমের সঙ্গে তাদের ভীষণ ঝগড়াঝাটি হয়, গত দুইদিন সে বাড়িতে রাগ করে ভাত খায়নি এবং একপর্যায়ে গলায় দড়ি দেওয়ার ভয়ও দেখায় বাড়িতে। স্বভাবতই কেউ তার ভয় দেখানোকে আমলে নেয় না। তখন কাশেম তার প্রেমের প্রমাণস্বরূপ কাগজে ‘জেড’ আদ্যক্ষরটি লিখে রাখে ও ‘ইহা সইত্য’ জাতীয় নাটকীয় বাক্যটি লিখে তার প্রেমের স্মারক রাখতে চেষ্টা করে এবং নিশ্চয়ই কোনো সিনেমায় দেখা অভিমানী নায়কের মতো নিজের জীবন আত্মাহুতি দেয়। কাগজের কোনায় আঁকা ‘লাভ চিহ্ন’ বাদ দিয়েই আমরা এতদূর ‘একে একে দুই’ করে ফেলতে পারি, আর তার সঙ্গে ‘লাভ চিহ্ন’টিকে জুড়ে দিলে আমাদের থিওরির পুরো ষোলোকলা পূর্ণ হয়।
থিওরি তৈরি হয়ে গেলে আমরা আনন্দে ফাইভ ফাইভ সিগারেট ধরিয়ে ফেলি পটাপট। ভোঁস ভোঁস করে টানও দিয়ে ফেলি বেশ কয়েকটা। আমাদের মাথাগুলো এরই মধ্যে জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। জ্যাম মাথা এবার হালকা হতে শুরু করে। সিগারেট টানতে টানতে আমরা কাশেমের পরিমিতি বোধ ও ভদ্রতা জ্ঞানের প্রশংসা করতে থাকি। কেননা, সে জাহেদার পুরো নামটি না লিখে আদ্যক্ষরটিই লিখেছে মাত্র এবং প্রেমের কথাটি সরাসরি না প্রকাশ করে কেবল ‘ইহা সইত্য’র মতো দুর্দান্ত বাক্যটি মাথা খেলিয়ে বের করেছে। যদিও আমরা নিশ্চিত কাশেম নিশ্চয় ইদানীংকালে দেখা কোনো প্রেমের সিনেমা বা নাটক থেকে আইডিয়াটা পেয়েছে। আমরা তখন সহানুভূতিশীল হয়ে এক বাক্যে স্বীকার করি : নাহ্, পোলাটায় আসলেই জাহেদারে ভালোবাসছিল। এইসব বলতে বলতে ও সিগারেট টানতে টানতে আমরা মাথার জ্যাম ছোটাতে থাকি।
আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই জহিরের মাথার জ্যাম আগে ছুটে গিয়েছিল। সেই প্রথম আমাদের থিওরির খানাখন্দগুলো আবিষ্কার করতে শুরু করে। সে কথা শুরু করে এভাবে : আমাদের থিওরিটিতে কাকতালীয় অনুপপত্তি ঘটেছে।
জহিরের মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রায়শই আমাদের মেজাজ খারাপ হতে থাকে, কেননা, জহিরের অভ্যাস সাম্প্রতিককালে পড়া বিষয়বস্ত্ত সে দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্যে অবলীলায় ঢুকিয়ে দেওয়া। ‘কাকতালীয় অনুপপত্তি’র মতো শব্দগুচ্ছ নিশ্চিতভাবে কিছুদিন ধরে পড়া যুক্তিবিদ্যার প্রভাব। আমরা তখন তার দিকে কটমট করে চাইলাম। জহির যুক্তিবিদ্যার টার্ম রেখে সহজ করে বললো : থিওরি ঠিক আছে। তবে গুরুতর সমইস্যা আছে একটা। কাশিম্যা হের বাপের লগে যে জাহেদারে লইয়াই ঝগড়া করছে, এইটা আমগো শিউর হওন দরকার না?
জহিরের তোলা সমস্যায় আমাদের থমকে যেতে হয়। হয়-ই। কেননা, কী নিয়ে কাশেমের সঙ্গে তার বাবার ঝগড়া হয়, তা আসলেই আমরা জানি না। কান্নাকাটির ফাঁকে ফাঁকে কাশেমের বাবা শুধু বলেছিল, কাশেমের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে এবং কাশেম গলায় ফাঁস দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের থমকে যাওয়ার কারণ ঝগড়ার কারণটি আমরা জানি না বলে নয়। চাইলেই আমরা ব্যাপারটা জানতে পারি বলে। এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে গুরুতর প্রশ্ন হলো, ব্যাপারটা আমরা জানতে চাইবো কিনা?
তা জানতে চাওয়া যায়। এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। যদিও আমরা স্থির নিশ্চিত ঘটনা আমরা যা সাজিয়েছি, তাই ঘটেছে। কিন্তু একটা মানুষ মারা গেলে তার সম্পর্কে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনাটা কতটুকু ঠিক হবে এবং আমাদের এই কৌতূহলকে কাশেমের বাবা কীভাবে নেবে – এ-ব্যাপারে আমাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে যায়। তাছাড়া কাশেমের বাবা নিশ্চয়ই লোকজনের উলটোপালটা কথার ভয়ে বিষয়টা লুকিয়ে যেতে চাইবে। অবশেষে আমাদের কৌতূহল জয়ী হয় এবং আমরা সিগারেটের গোড়াগুলো খালের পানির দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাশেমদের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যাই।
কাশেমকে কবর দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ির সামনের কবরস্থানে, একেবারে পথের সঙ্গেই। তার কবরের মাটি উঁচু হয়ে আছে, তাতে বরইগাছের একটা ডাল পুঁতে রাখা আর একটা লম্বা খেজুরগাছের ডাল ছড়িয়ে রাখা আছে। জায়গাটি পার হওয়ার সময় আমরা এক ধরনের বিজাতীয় ভয় ও আশংকায় আক্রান্ত হই। আমাদের মনে জেগে ওঠে : আইজ মইরলে কাল দুইদিন রে ভাই। কথাটি আমরা সশব্দে বলাবলিও করি এবং এক বাক্যে এর সত্যতা সম্পর্কে রাজি হয়ে যাই।
কাশেমদের ঘরের দিক থেকে একটা হালকা ফোঁপানো কান্নার আওয়াজ শোনা যায়, কিন্তু কাউকে দেখতে পাই না। আমরা আসেত্ম আসেত্ম উঠানে গিয়ে – ‘কাকু বাড়ি আছেন নি’ বলে গলা খাঁকারি সহযোগে মৃদু আওয়াজ তুলি। তখন কান্নার আওয়াজটি থেমে যায় এবং একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা মাথা বের করে আবার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। খানিকক্ষণের মধ্যে দুই-তিনজন মহিলা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, তাদের পেছনে পেছনে ক্রন্দনরত কাশেমের মা। তিনি আমাদের সবাইকেই গ্রামের সুবাদে খানিকটা চেনেন। তাই একবার আমাদের দেখে নিয়েই কান্নার ফাঁকে ফাঁকে যেসব কথা বলেন, তার মধ্যে – ‘আমরা কাশেমের বন্ধুরা তাকে দেখতে গেছি, এজন্য তার মনটা শান্তি লাগছে, আমাদের দেখে কাশেমকে দেখার মতোই তার মনে হচ্ছে, কাশেম বেঁচে থাকলে এখন আমাদের মতোই ঘুরতো-ফিরতো হাসতো-খেলতো, এমন ডগডগা ছেলেটা মরে গেল’ – এরকম কথাগুলো ঘুরেফিরে আসে। সেসব শুনতে শুনতে আমাদের গায়ে কাঁটা দিতে থাকে এবং চোখে জলও আসতে থাকে। কাশেমের বন্ধু সম্বোধনে আমরা ক্ষণিকের তরে কেমন অপরাধী অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকি এবং ‘চাচি আম্মা, কাঁইদেন না’ বাক্যের বেশি কোনো সান্তবনাবাক্য না বলতে পেরে মুখ ব্যাজার করে থাকি। কিন্তুও কেবল মুখ ব্যাজার করে থাকলে হবে না, আমাদের সত্যি উদ্ঘাটন করতে হবে। আমরা জানতে পারি, কাকু, মানে কাশেমের বাবা বাড়িতে নেই। তখন কাশেমের মা একজন মহিলাকে ডেকে ভাঙা গলায় ফোঁপানো অব্যাহত রেখে বললেন : মইন্যার মা গো, পোলাগুলারে কাগজখান দেখাও গো। হেরা শিক্ষিত পোলা, বিষয়টা বুঝতে পারবো গো …
তখন এক মাঝবয়সী মহিলা ঘরের ভেতরের দিকে হাঁটতে শুরু করলে আমরা বুঝতে পারি তিনিই মইন্যার মা। মইন্যার মা আধা মিনিট বাদে হাতে একটা প্যাড নিয়ে বের হয়ে আসেন এবং কাশেমের মায়ের হাতে তুলে দেন। কাশেমের মা প্যাডটি সাবধানে খোলেন। একটা প্রেসক্রিপশন লেখার ডাক্তারি প্যাড। আমরা বিপুল কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করি তিনি কী দেখাবেন, তা দেখতে। প্যাডের ভেতর থেকে একটা ভাঁজ করা ছোট সাইজের কাগজ বেরিয়ে আসে। কাশেমের মা তা আমাদের হাতে তুলে দিতে দিতে বলেন : পোলায় এইবার বাড়ি আসার পর থেইক্যা দেখি এই খাতাটা খুইলা কীসব লেখে। পইড়্যা দেখো তো বাবারা, কী ঘটনা। 888sport appততন নিয়া আইছে কি জাদু-টোনারে, বাপুরে, কিয়ের লাই আমার পুতের এত রাগ উঠলো রে … বলতে বলতে তিনি আবার কাশেমের জন্য বিলাপ শুরু করেন। আমরা প্যাড এবং কাগজটি হাতে নিই।
কাগজটি একটি ছাপানো লিফলেটের মতো। তাতে প্রচুর বানান ভুল সহযোগে লেখা : ‘মদিনা শরিফের হুজুর স্বপ্নে দেখেছেন, নবীজি যারপরনাই হয়ে কাঁদছেন। নবীজির কান্না দেখে মদিনার হুজুর বেচাইন হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন, ইয়া নবী, আপনি কেন কাঁদছেন? কী বিষয়? উত্তরে দয়াল নবী বলেন : হে আমার প্রিয় উম্মত, তুমি দুনিয়ার মানুষদিগকে বলে দাও যে, তারা আমার শিক্ষা ভুলে গিয়ে নাফরমানিতে লিপ্ত হয়ে রয়েছে। এর জন্য আমি আসমানে আল্লার কাছে শরমিন্দা হয়ে আছি। তাদেরকে বলো, নাফরমানির কাজ ছেড়ে দিয়ে দ্বীনের পথে আসতে।
এই চিঠি যে পাইবে তাকে দশদিনের মধ্যে দশ কপি ফটোকপি করে বা হাতে লিখে দশজনের মধ্যে বিলাইতে হইবে। যদি না বিলায়, তবে দশদিনের মধ্যে তার ওপর নালত নেমে আসবে। আর যদি বিলায়, তবে দশদিনের মধ্যে সে পরম খোশখবর পাইবে। ইহা সইত্য। ইহা সইত্য। ইহা সইত্য।
বি.দ্র. খবরদার, ইহাকে হেলা করিবে না। এক ব্যক্তি দশজনের মধ্যে কাগজটি বিলি করায় সে লটারিতে এক লাখ টাকা জিতিয়াছে। আরেক ব্যক্তি ইহাকে বুজরুকি মনে করায় আচমকা তার বাড়ির ছাদ ধসে বউ-ছেলে মারা গেছে। কোনো কারণে পুরোটা লিখতে বা ফটোকপি করতে অপারগ হইলে ‘ইহা সইত্য’ বাক্যটি দশবার লিখে প্রচার করিলেও খোদার অছিলায় অনুরূপ তরক্বী ঘটিবে, ইনশাল্লাহ।’
লিফলেটটি পড়া হয়ে গেলে আমরা তখন দেখতে পাই প্যাডটির বেশ কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে গোটা গোটা হাতের লেখায় ‘ইহা সইত্য’ বাক্যটি লেখা, কাশেমেরই হাতের লেখা চিনতে আমাদের কষ্ট হয় না। এবং সবশেষে প্যাডের কোনায় সবুজ কালিতে লেখা ইংরেজি ছাপানো অক্ষর জেড দেখতে পাই। জেডের অ্যাব্রিবিয়েশনও সঙ্গে আছে, খুব হালকা কালিতে, চোখে প্রায় পড়ে না-র মতো জলছাপে : জেলট্রাপ। কোনো একটা ওষুধের নাম নিশ্চয়ই। কাশেমের লেখার তলায় জলছাপটি প্রায় পুরোপুরি চাপা পড়ে গেছে। এবং সবশেষে কোনায় ঝাপসা ‘লাভ চিহ্ন’টি, খানিকটা আঁকাবাঁকা করে ডিজাইন করা, দেখলে মনে হয় হাতে আঁকা।
এতক্ষণ কাশেমের মায়ের বিলাপের দিকে আমাদের কান ছিল না, লিফলেট পড়া হয়ে গেলে আমরা আবার বিলাপের প্রতি মনোযোগী হই এবং শুনতে পাই তিনি বলছেন : পোলায় খালি জমি বেইচা ডুবাই যাইব ডুবাই যাইব কইছে গো। পোলার বাপে মা-মাসি গালি দিয়া ভাগাই দিছে গো। পোলায় আমার রাগের জবালায় দুইদিন ধইরা ভাত-পানি খায়নো গো … ইত্যাদি। প্রতি বাক্যে গো শব্দের দ্যোতনা সুরের মতো বাজতে থাকে কাশেমদের বিশাল উঠোন জুড়ে।
একটা আচমকা উদাসীনতা এ-পর্যায়ে আমাদের গ্রাস করে। জন্ম-মৃত্যু যে নেহায়েত আল্লার হাতে, মানুষের এ-ব্যাপারে কিছুই করার নেই – এ-সত্য পরস্পরকে বোঝাতে বোঝাতে আমরা অবশেষে কাসেমদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে থাকি। নানান দৈর্ঘ্যের দীর্ঘশ্বাস আমাদের বুক থেকে সোজা জন্ম নিয়ে নাক দিয়ে সশব্দে বেরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে আমরা বুঝতে পারি, খানিকক্ষণ মৌন থাকা দরকার। সে-বাবদ আমরা কথাবার্তা বন্ধ করে মৌন হয়ে হাঁটা ধরি হাটের রাস্তা বরাবর। শুধু জহির মিনমিন করে বলে : হ রে, শুধু জন্ম মৃত্যু না, বিয়াও আল্লার হাতে রে।
এ-ধরনের অনর্থক বাক্যের উত্তরে মৌনতা ভঙ্গের কোনো কারণ আমরা দেখতে পাই না।
পাদটীকা : লিফলেটটি আমরা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। দেরি না করে আজ রাত থেকেই দশটা লিখে ফেলতে হবে বলে ঠিক করি আমরা। তাছাড়া শুধুমাত্র ‘ইহা সইত্য’ না, পুরো লেখাটাই লিখবো বলেও ঠিক করি কেননা, তাতে বেশি তরিক্বি ঘটবে – এতে আর সন্দেহ কী? কাশেমকে যে ফাঁস নিয়ে মরতে হলো, তার কারণ এখন সহজেই আঁচ করা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সে দশদিনের বেশি লাগিয়ে দিয়েছে লিফলেটটি বিলি করায়।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.