১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের ভয়ে জীবন নিয়ে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। খোলা হয় শরণার্থী শিবির।
প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ওপর। ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়। শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে তারা সরকারকে চাপ দিতে থাকে।
ঠিক ওই সময়েই পরিকল্পনা হয় 888sport apps থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ আয়োজনের। এতে অংশ নেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত 888sport appsের ৩৮ জন শিক্ষিত যুবক। ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
পদযাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জনসভা করতেন। গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহ্বান জানাতেন 888sport appsের পক্ষে দাঁড়াতে। তাঁদের সকলের হাতে হাতে শোভা পেত – ‘আমাদের এক কথা – 888sport appsের স্বাধীনতা’, ‘মুজিবের মুক্তি চাই’ সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা। ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি চলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর। সে-খবর ব্যাপক আলোড়নও তোলে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় তথা বিশ্ব জনমত গড়তে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
পদযাত্রী দলের ডেপুটি লিডার-২ ছিলেন কামরুল আমান। তাঁর বাবা চাকরি করতেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। সেই সুবাদে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন তোলারাম কলেজের ছাত্র। নিজ আগ্রহেই যুক্ত ছিলেন ওইসময়কার আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা আর বর্বরতা কামরুল আমান দেখেছেন খুব কাছ থেকে। আলাপচারিতার শুরুটা তাই গণহত্যা দিয়েই।
তাঁর ভাষায়, ‘২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতের মধ্যেই 888sport appর গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কারফিউ চলছিল। তা শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়ে রওনা হই 888sport appর দিকে। ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ। ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে 888sport app থেকে। সবার মুখে লোক মরার খবর। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে সাত-আটজনের গলাকাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানে না। দেহ তখনো কই মাছের মতো নড়ছিল। এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কব্জি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। কার লাশ এটা? কেউ জানে না। খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারিপট্টিতে। আহারে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পোড়াইছে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারিপট্টির প্রবেশমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনো আগুন জ্বলছিল। একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে। মানুষ পুড়ে তার চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে পড়েছে আমার পা। এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!’
পাকিস্তানি আর্মিরা নারায়ণগঞ্জ দখলে নিলে কামরুল ট্রেনিংয়ের জন্য কুমিল্লার রামকৃষ্ণপুর হয়ে চলে আসেন আগরতলায়, গোকূলনগর রিক্রুটিং ক্যাম্পে। ট্রেনিং শুরুর দেরি দেখে পরে চলে যান কলকাতায়। ওখানে সিপিএম অফিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় দেবেন সিকদারের। তাঁর পরামর্শেই তিনি কাজ শুরু করেন যশোরের বেনাপোলে, 888sport apps ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরে। সীমান্ত এলাকার শরণার্থীদের সেবা ও সাহায্য করাই ছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ। পরে তাঁদের মাধ্যমেই তিনি রিক্রুট হন ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলে।
সে-ইতিহাস শুনি কামরুল আমানের মুখে। তাঁর ভাষায়, ‘888sport appsের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডল’ নামের একটি সংগঠন। এটি গঠিত হয় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আটটি সংগঠনের সম্মিলনে। এদের সহযোগিতা করে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন। পদযাত্রার মূল উদ্যোক্তা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং আহ্বায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জি।
আমাদের ৩৪ জন বাছাইয়ে কাজ করেন যশোরের শাহ হাদিউজ্জামান, মরহুম এম রওশন আলী, বিমল রায় চৌধুরী ও শেখ মোখলেসুর রহমান খোকন। বনগ্রাম থেকে ১৪ অক্টোবর ১৯৭১-এ আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে পৌঁছি। সেখানে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরের মাটি ছুঁয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য শপথ নিই। বাকি চারজন পরে এসে যোগ দেন মুর্শিদাবাদে।’
পদযাত্রীদের নাম জানালেন কামরুল – ‘লিডার আবদুল খালেক। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের ছাত্র। ডেপুটি লিডার-১ খুলনার একরামুল ইসলাম। আমি ছিলাম ডেপুটি লিডার-২। বাকিরা হলেন – রফিকুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, মুরারী মোহন সরকার, বিনয় কুমার বিশ্বাস, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ আবু বকর, পরিতোষ কুমার মণ্ডল, আবদুল লতিফ (১), আবদুল লতিফ (২), সৈয়দ রবিউল হক, দুলাল মণ্ডল, ওহিদুজ্জামান চাকলাদার, তুষার কান্তি সুর, শেখ আনোয়ার কামাল, সুভাষ চন্দ্র বসু, অমিত দেব, ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডল, আনন্দ মোহন রায়, প্রদীপ কুমার শীল, আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল কাদির, পরিতোষ কান্তি কবিরাজ, দেলোয়ার হোসেন, অনিল কুমার বিশ্বাস, মইন উদ্দিন, সহিদুল ইসলাম, বিশ্বনাথ সাহা, সমীর কুমার বসু, ওমেদ আলী, আবু বকর সিদ্দিকী, শামসুল হক, মতিলাল দাস, অহিভূষণ চক্রবর্তী, সনৎ কুমার বিশ্বাস, আশরাফ হোসেন ও দিলীপ কুমার নাগ।’
শুরুর আনুষ্ঠানিকতা কেমন ছিল?
তিনি বলেন, ‘আগের দিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে র্যালিসহ একটি জনসভায় আমাদের অভিনন্দন জানানো হয়। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গান্ধীপন্থী লেখক মৌলভি রেজাউল। বক্তব্য দেন মোহাম্মদ একরামুল, শ্রী দেশাই, আবদুল খালেক প্রমুখ। পরদিনই 888sport appsের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ আমরা বহরমপুর থেকে গোকর্ণর দিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি। বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা। প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হতো। বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হতো জনসভার। উঠোন-বৈঠকও হয় অগণিত। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলে মতবিনিময়। এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তিনিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লখনৌ, আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে।
৩০ জানুয়ারি ছিল গান্ধীপ্রয়াণ দিবস। ওইদিন দিল্লির রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হবে – এমনটিই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগেই বিজয় লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তরপ্রদেশে এসে পদযাত্রাটি শেষ হয়। 888sport appsের স্বাধীনতায় যদি আরো সময় লাগতো তাহলে এই দলটিকেই প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে পাঠানোর চিন্তা ছিল।’
এ নিয়ে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
কামরুল আমান বলেন, ‘পদযাত্রায় স্থানীয় জনগণই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত। পাটনাতে যখন গেলাম ওখানকার চিফ আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পল্টনের মতো বিশাল একটি মাঠে মিটিং হয়। বক্তৃতায় বললাম নিজের অভিজ্ঞতার কথা, গলাকাটা লাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশের মাটিচাপা, পুরান 888sport appর মানুষ পোড়ানো, মানুষের চর্বি গলানো মেঝেতে নিজের পায়ের ছাপ। লিডার খালেক বললেন রাজশাহীতে গণহত্যার বর্বরতার কথা। বর্ণনাগুলো যখন হিন্দিতে 888sport app download apk latest version করে বলা হচ্ছিল তখনই দেখলাম ওখানকার মানুষ হুহু করে কাঁদছে।
লখনৌ ইউনিভার্সিটিতে আমাদের বক্তব্য শুনে 888sport appsের স্বাধীনতার পক্ষে কণ্ঠ মেলায় ছাত্রছাত্রীরা। মুজিবের মুক্তিতে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারও করে তারা। এভাবে 888sport appsের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় জনগণ একাট্টা ছিল। তাদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমর্থনটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় শক্তি।
আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদটা মানুষের মনের ভেতরই গাঁথা থাকে। কে কোন দেশের, সেটা বড় কথা নয়। মানুষের মুক্তির, মানুষের স্বাধীনতার জন্য মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। একাত্তরে এটাই প্রমাণ করেছিল ভারতীয় জনসাধারণ।’
ভিন্ন অভিজ্ঞতাও ছিল কামরুলদের। তাঁর ভাষায়, ‘মুর্শিদাবাদে এক উঠোন-বৈঠকে ভারতীয় একদল মুসলমান আমাদের ওপর বেশ রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান ছিল একটা মুসলমানের দেশ। তোমরা সেটা ভেঙে দিতেছ। এক কোটি লোক আইসা আমগো ওপর খাইতাছ। আমগো ভারতও ধ্বংস করবা তোমরা। যুদ্ধ তোমাদের, কিন্তু সৈন্য মরে আমগো। এই যুদ্ধ আমাদের দরকার নাই। বিদায় হও তোমরা।’
আমরা ধৈর্য হারাই না। পাকিস্তানে মুসলমান যে মুসলমানকে তেইশ বছর ধরে কীভাবে নির্যাতন করেছে, মুসলমান মুসলমানের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কীভাবে পদদলিত করেছে – এটা আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি। বলি, মুসলমান ব্যাপার না, আসল বিষয় শোষণ আর নির্যাতনের। শুধু কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই ছাড়া ভারতের মুসলমান গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওই সময় বেশ কনফিউজড ছিল। এক্ষেত্রে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলটি একটি বড় অ্যাম্বাসাডরের কাজ করেছিল।’
১৬ ডিসেম্বর। দেশ তখন স্বাধীন। ১৮ ডিসেম্বর লখনৌতে বিশাল আয়োজনে উদযাপিত হয় বিজয় দিবস। ভারতীয় বিমান, সেনা ও নৌবাহিনী, ক্যাডেট, স্কাউট, গার্ল গাইডস ও জনসাধারণের সঙ্গে 888sport appsের ডেলিগেট হিসেবে জাতীয় পতাকাসহ অংশ নেয় পদযাত্রার দলটি। ওই অনুষ্ঠানের সংবাদ ওই সময় ভারত ও বিদেশি রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রেও ফলাও করে প্রচার করা হয়। ১৯ ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসেন ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ দলটির যুবকরা।
বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার দলটি স্বাধীনতার জন্য ভারতে হেঁটেছিল চৌদ্দোশো মাইল। মুক্তিযুদ্ধটা কেন ন্যায় যুদ্ধ – সেটি ভারতীয়সহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল তাঁদের কাজ। পদযাত্রীদের কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। যেসব ভারতীয় নেতা ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছিলেন, বর্তমান সরকার তাঁদের এনে সম্মাননা দিয়েছে। এটাও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও পদযাত্রায় অংশ নেওয়া ৩৮ জনকে কণ্ঠযোদ্ধা বা ফুটবলযোদ্ধাদের মতো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি, যা প্রত্যাশিত নয়।
একাত্তরের আরেক যোদ্ধা ঈশ্বরদীর বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লা। কেমন ছিল তাঁর যুদ্ধ?
১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছে পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই রূপপুর গ্রাম। সেই গ্রামের রাস্তার পাশের এক কড়ইতলায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান বসান তিনি। সবার কাছে সেটি মোল্লার দোকান। গ্রামের মানুষ কাশেম মোল্লাকেই ভালোবেসে ডাকত ‘মোল্লা’ বলে।
রূপপুরসহ আশপাশের গ্রামের সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। অনেক পরিবারেরই যুবক ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। পাকিস্তানিরা নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সবাই উৎকণ্ঠা আর আতংকে দিন কাটাচ্ছে। দেশের কোনো খবর জানে না কেউ। রেডিও পাকিস্তানে সঠিক কোনো খবর নেই। যা খবর পাওয়া যায় তা শুধুই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, কলকাতা বেতার আর স্বাধীন বাংলা বেতারে।
দশ গ্রামের মধ্যে শুধু কাশেম মোল্লারই ছিল একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসিতে দেশের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনতে চায়ের দোকানে ভিড় লেগে যেত। ক্রমে ভিড় বাড়তে থাকল। চায়ের দোকানের পাশে গড়ে উঠল আরো বেশ কয়েকটি দোকান। এভাবে তৈরি হয় একটি গ্রাম্যবাজার।
সন্ধে হলেই রূপপুর গ্রামে হাঁকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলত, ‘চলো, বিবিসি শুনতে যাই।’ এভাবে মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয় ‘বিবিসি বাজার’।
বিবিসি বাজারে বসে কথা হয় চর রূপপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা মো. ওমর আলী ও আশরাফ মালিতার সঙ্গে। ১৯৭১-এ কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বসে বিবিসির খবর শোনার 888sport sign up bonus আজো তাঁদের কাছে জীবন্ত। পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়ির শব্দ পেলেই সবাই চায়ের দোকান থেকে সরে পড়ত গ্রামের ঝোপঝাড়ে। তাঁরা জানালেন, জীবন বাজি রেখেই কাশেম মোল্লা সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। সে-সময় মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে গেছে শত শত যুবক। এভাবে বিবিসি বাজার, সেই কড়ইগাছ আর কাশেম মোল্লা জায়গা করে নেন ইতিহাসের পাতায়।
কিন্তু কাশেম মোল্লাকে কোথায় পাব? একজন জানালেন, পাকশী রেলবাজারে তাঁর একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান আছে। বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লাকে চেনে সবাই। তাই দোকান খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।
দোকানটিতে কাশেম মোল্লা নেই, বসে আছেন তাঁর মেজ ছেলে আব্দুস সামাদ। ভাঙাচোরা দোকানের এক কোণে ঝুলছে বড় একটি ছবি। ছবিতে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাংবাদিক আতাউস সামাদসহ বেশ কয়েকজন। সামাদ জানালেন, বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে বিবিসির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশনে’র প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিসের উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও প্রেজেন্টার দীপঙ্কর ঘোষ এবং সংবাদদাতা আতাউস সামাদ। বিবিসি শোনার সেই রেডিওটি কোথায়? এমন প্রশ্নে সামাদ নিশ্চুপ থাকেন। পরে জানালেন, স্বাধীনের পর অভাবের কারণে তাঁর বাবা কাশেম মোল্লা বাধ্য হয়েছিলেন ’৭১-এর 888sport sign up bonusবিজড়িত সেই রেডিওটি বিক্রি করে দিতে।
ঘণ্টাখানেক পরে দোকানে আসেন কাশেম মোল্লা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। হানাদার বাহিনীর আঘাতে জখম হওয়া পা নিয়ে চলছেন লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চা খেতে খেতে তিনি বলেন মুক্তিযুদ্ধের সে-সময়কার কথাগুলো।
অভাবের কারণে ক্লাস সেভেনের বেশি পড়া হয়নি কাশেম মোল্লার। ফলে জীবন চালাতে নেমে পড়েন টুকিটাকি ব্যবসায়। একসময় পাকশী রেলবাজারে দেন একটি মুদিদোকান। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানি আর্মি বাজার পুড়িয়ে দিলে তিনি চলে যান নিজ গ্রাম রূপপুরে। নিজের হাতে লাগানো কড়ইতলীতে বসান ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।
বিয়ের পরে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম একটি রেডিও কেনার আবদার করেছিলেন। রেডিও শোনার প্রতি কাশেমেরও এক ধরনের ঝোঁক ছিল। তাই টাকা জমিয়ে তিনি কিনলেন একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। কাশেম মোল্লার সেই রেডিওই হয়ে যায় ইতিহাস।
তাঁর ভাষায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চায়ের দোকানে তিনি রেডিওতে বাংলা খবর শোনাতেন। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ দু-বেলাতেই নিয়মিত ভিড় জমাত তাঁর চায়ের দোকানে। গোপনে মাঝেমধ্যেই দলবেঁধে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নানা খবর জেনে যেতেন কাশেম মোল্লার কাছ থেকে। চা খেতে আসা নানা লোকের নানা তথ্য থাকত কাশেমের কাছে। তিনি সেসব খবর দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
হাসতে হাসতে কাশেম জানালেন, সে-সময় বিবিসির খবর শুনে শুনে এমন অবস্থা হলো যে, কেউ অধিবেশন শুরুর পরে এলেও ঠিক ঠিক বলতে পারত কার কণ্ঠ শুনছে – সিরাজুর রহমান, নুরুল ইসলাম, শ্যামল, নাকি কমল বোস। এমনকি কেউ কেউ তাঁদের কণ্ঠ এবং ভঙ্গি পর্যন্ত অনুকরণ করতে পারত। বিবিসি শুনতে আসা গ্রামের মানুষেরা শুধু খবর শুনতই না, পর্যালোচনা করত, বিশ্লেষণ করত।
স্বাধীনের ঠিক কয়েক দিন আগে রাজাকারদের তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি আর্মি হানা দেয় তাঁর চায়ের দোকানে। সেদিনের কথা মনে হলে আজো তিনি আঁতকে ওঠেন। বললেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি এসে হুংকার আর গালি দিয়ে বলে, ‘মাদারচোদ, তোম ইধার আঁও, তোমহারা দোকান মে রেডিও বাজতা হ্যায়, শালে, তুমকো খতম কারদেগা, তুম রেডিও নিকালো।’ সেনাদের কথায় আমার জানে তো পানি নাই। ভেবেছিলাম মাইরে ফেলবি। আমি কলেম, ‘ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে শুনালকে লেকে চলে যাতা হে।’ কথা শুনে পাকিস্তানি সেনারা আমাকে মাটিতে ফেলেই মারতে শুরু করে। সেনাদের এই নির্যাতনে আমার ডান পা বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এরপর থেকেই ওই পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারি না।’
কাশেম মোল্লার চায়ের দোকান ছিল খুবই ঝুঁকির জায়গা। পাশেই ছিল আর্মি ক্যাম্প আর চারপাশে রাজাকারদের পদচারণা। এরই মধ্যে তিনি রেডিওতে বিবিসির খবর শুনাতেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা খবর দিতেন গোপনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। কাশেম মোল্লা সম্পর্কে এভাবেই বললেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার মো. আব্দুর রাজ্জাক। তাঁর মতে, কাশেম মোল্লা একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা। যাঁর হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল রেডিও আর নানান সংবাদ। কাশেম মোল্লাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত করা এবং তাঁর সুচিকিৎসার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তাঁর পাশে থাকবে বলেও তিনি অঙ্গীকার করেন; কিন্তু পরবর্তীকালে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।
অন্যরকম মুক্তিযোদ্ধা কাশেম মোল্লা। একাত্তরে জখম হওয়া পা নিয়েই চলেছে তাঁর জীবন। উপজেলায় বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস পালন হয় ঘটা করে। কখনো কখনো স্বাধীনতাবিরোধীরাও দাওয়াত পায় সসম্মানে। কিন্তু একজন কাশেম মোল্লার খোঁজ রাখে না কেউ। তবু একাত্তরের 888sport sign up bonus আর বিবিসি বাজারের কথা উঠলেই গর্বে বুক ভরে যায় তাঁর।
কাশেম মোল্লার সঙ্গে আলাপচারিতার পর কেটে যায় কয়েক বছর। সংবাদপত্রে লেখা প্রকাশের পর তাঁর সুচিকিৎসায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই বীর। কিন্তু কাশেম মোল্লার জীবনেতিহাস মিশে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে।
আরেক মুক্তিযোদ্ধা হামিদ রায়হান। তিনি গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। য্দ্ধু করেছেন ঠিকই, তবে অস্ত্র নয়, ক্যামেরা হাতে। একাত্তরের কুষ্টিয়ার সেই তরুণ হামিদ রায়হানের বয়স এখন আটাশি।
চয়েন উদ্দিন ও জোবেদা খাতুনের বড় সন্তান হামিদ রায়হান। বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের ৫২ মসজিদ বাড়ি লেনে (বর্তমানে সেটি ১১ নম্বর খলিলুর রহমান সড়ক)।
তাঁর কাছে শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় ফটোগ্রাফিতে নেশা হওয়ার কারণ এবং মুক্তিসংগ্রামে জড়ানোর ঘটনা। হামিদ রায়হান বলেন, ‘তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হন। বড় ছেলে আমি। তাই লেখাপড়া বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরি। তামাক পাতার ব্যবসা শুরু করি প্রথম। পরে ম্যানেজার পদে চাকরি নিই কুতুবউদ্দিন অ্যান্ড সন্স টোব্যাকোতে। ওখানেই কাজ করেছি মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত।
ফটো তোলার ঝোঁক ছিল আগে থেকেই। একটা কম দামি ক্যামেরা ছিল, লুবিডর ক্যামেরা। ওটা দিয়েই ফটো তুলতাম। ইয়াসিকা ক্যামেরা পোস্টালে অর্ডার করা যেতো তখন। টাকা জমিয়ে একবার ৫০০ টাকায় ইয়াসিকা সিক্স-থার্টিফাইভ ক্যামেরা করাচি থেকে আনাই পোস্টালের মাধ্যমে। ওই ক্যামেরাটাই ইউজ করেছি একাত্তরে।
ফটোগ্রাফি শিখেছি নিজে নিজে। স্টুডিওতে গিয়ে দেখতাম কীভাবে ওরা এনলার্জ করে। তখন কৌতূহলও বেড়ে যায়। খুব বেশি টাকা তখন ছিল না। তাই লেদমেশিনে নিজের মতো যন্ত্রাংশ তৈরি করি। করাচি থেকে দেড়শো টাকায় আনাই একটা লেন্সও। রেলগেটের লাইটে যে-কাচ লাগানো থাকে, ওরকম দুটো কাচও জোগাড় করি। এগুলো দিয়েই বানাই এনলার্জ। ওটা বানানোর কথা তখন চিন্তাও করা যেতো না। পরে অফিসের ভেতর একটা রুমকে স্টুডিও বানিয়ে ফেললাম। এভাবেই ফটোগ্রাফির আগ্রহটা জীবন্ত রাখি।’
তারপর এলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা এবং রাজনীতিতে জড়ানোর প্রসঙ্গ। ক্যামেরা হাতে বলতে গেলে সারাজীবনই কাটিয়ে দেওয়া রায়হান বলেন, ‘বাল্যবন্ধু ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। ১৯৭০ সালের মার্চের ঘটনা। তখন আমি কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনী জনসভা হবে, শেখ মুজিব আসবেন কুষ্টিয়াতে। ব্যারিস্টারকে তিনি বললেন, ‘তুই যশোরে আয়, আমি রাতে নামবো ওখানে।’ ব্যারিস্টারসহ একটা গাড়ি নিয়ে আমরা যাই যশোরে। কিন্তু ওইদিন ফ্লাইট লেট হয়। বেশি রাত হওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে ঝিনাইদহেই রাখলাম। সকালে নিয়ে আসি কুষ্টিয়াতে, উনি ওঠেন ডাকবাংলোতে।
‘বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বাড়ির গরুর দুধ পর্যন্ত তাঁকে খাইয়েছি। মায়ের বয়স তখন অনেক। বঙ্গবন্ধুকে উনি খুব পছন্দ করতেন। তাই অসুস্থ শরীর নিয়েই ভাষণ শুনতে হাজির হয়েছিলেন কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুল মাঠে। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর যে ভূমিকা দেখেছি, তখনই বুঝেছি, নেতা একটাও যদি হয় তিনিই হবেন। বাঙালিকে ভালোবাসেন – এমন জোরদার নেতা তখন ছিল না। ফলে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রাণের নেতা। কুষ্টিয়াতে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি পোর্ট্রেট ও জনসভার ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছিলাম। ওই ছবিগুলোই আজ কথা বলছে। একাত্তরের আন্দোলন, প্রতিবাদ, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ইতিহাসটাও ছবির মাধ্যমেই জীবন্ত হয়ে আছে।’
বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে যাওয়া ও ছবি তোলার আগ্রহের কথাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ রায়হান।
তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই কুষ্টিয়া উত্তপ্ত হতে থাকে। ২৩ মার্চ ইসলামিয়া কলেজ মাঠে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে শোডাউন করে ছাত্র-মজুর-জনতা। ২৫ মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে ছাত্র নেতারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গোলাম কিবরিয়া, আব্দুর রউফ চৌধুরী, নূরে আলম জিকো প্রমুখ। ওইদিন সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, দা ও ডামি রাইফেল নিয়ে সমাবেশও করে। ওই আন্দোলনে হামিদ রায়হান নিজে শুধু যুক্তই থাকেননি, বরং ক্যামেরায় ছবিও তুলে রেখেছেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতেই সারাদেশে শুরু হয় গণহত্যা।
তখন কী করলেন হামিদ রায়হান?
তাঁর ভাষায়, ‘আমার খেয়াল হলো ছবিগুলোর প্রতিটির নেগেটিভ রাখবো। ওগুলো অফিসেই ছিল। কারফিউ শেষ হলে নেগেটিভগুলো নিয়ে পরিবারসহ চলে যাই ভায়রার বাড়িতে, দৌলতপুরের কামালপুরে। পরে সেখান থেকে যাই ভারতের করিমপুরে। থাকি জামশেদপুরের এক ভাড়াবাড়িতে। কুমারখালীর এমপিএ গোলাম কিবরিয়া সাহেবসহ নেতারা একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প খোলার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন সেখানে। কিবরিয়া সাহেব পূর্বপরিচিত। ফলে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করি। করিমপুর রিক্রুটিং ক্যাম্পটি চালু হলে ধীরে ধীরে যুবকরা আসতে থাকে। সেখান থেকেই তাদের বাছাই করে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হতো।’
তখন কী ধরনের ছবি তুলতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, ওই সময়টায় ছবি তোলায় ভাটা পড়ে যায়। মনে তখন দেশকে মুক্ত করার চিন্তা। ২৪ ঘণ্টাই ক্যাম্পে থাকতাম। যুবকদের সংগঠিত করা, তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করাসহ মাস্টাররোল তৈরি করতে হতো প্রতিদিনই। প্রায় দুই হাজারের মতো যুবক ছিল ক্যাম্পে। ফলে এতো লোকের খাবার আয়োজন করা খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ক্যাম্প থেকে যখন হায়ার ট্রেনিংয়ে যুবকদের পাঠানো হতো তখন খুব আনন্দ লাগতো।’
যুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে রায়হান বলেন, ‘ট্রেনিং থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শুরু করেছে। যুদ্ধ চলছিল পুরোদমে। ওই সময় ক্যাম্প থেকে হায়ার ট্রেনিংয়ে লোক নেওয়াও কমে যাচ্ছিল। তখনই মনে হলো, তাহলে ফটোগ্রাফিটাকে কাজে লাগাই।
তখন 888sport apps ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর কাজ করছিল বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে। ওরা ভলান্টিয়ার নিয়োগ দিত। শরণার্থী ক্যাম্পের যুবক-যুবতীদের সংগঠিত করে লেফট-রাইট করানোসহ নানা কাজে যুক্ত রাখত ভলান্টিয়াররা, যাতে তারা বিপথগামী হয়ে না যায়। ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। লন্ডনের ওয়ার অন ওয়ান্ট তাদের ফান্ড দিত। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ ছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান।
একদিন ব্যারিস্টারকে (আমীর-উল ইসলাম) বললাম, ‘তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমি ফটোগ্রাফিটা করি।’ তাদেরও প্রয়োজন ছিল ডকুমেন্টেশনের জন্য একজন লোক। ফলে তার মাধ্যমেই ১৫ সেপ্টেম্বর 888sport apps ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ পাই। বেতন ছিল চারশো টাকা। এর পরই ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করি যুদ্ধদিনের নানা অধ্যায় ও ঘটনাপ্রবাহ।’
888sport apps ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের দল যখন যে জায়গায় যেত, তাদের সঙ্গেই যেতে হতো হামিদ রায়হানকে। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়েও ছবি তুলতেন তিনি। পাটগ্রামের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। ১৯৭১ সালের পহেলা অক্টোবর তারিখে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থসহ পাটগ্রামের কোট-কাছারি, হাসপাতাল ও বিভিন্ন জায়গায় ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। এছাড়া তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চলগুলোতে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংস করা ব্রিজ, কালভার্ট ও ভবনের ছবিও উঠে এসেছে তাঁর ক্যামেরায়, যা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ছবি, ১১ ডিসেম্বর যশোরের পিকনিক কর্নার এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া তাজা রকেট বোমার পাশে দুই শিশুর ছবি, ঝিকরগাছায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ, ২২ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়া রাজাকারের ছবিও ক্যামেরাবন্দি করেন এ-আলোকচিত্রী।
পাকিস্তান সেনাদের বেয়নেটের টর্চারে আহত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিএসবি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার ছবি, ২ ডিসেম্বর মুক্ত কালিগঞ্জে (সাতক্ষীরা) পরিদর্শনে আসা এএইচএম কামরুজ্জামান, মেজর জলিল, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মেজর হায়দার প্রমুখের ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। ১১ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন 888sport appsে প্রথম জনসভা হয় টাউন হল ময়দানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন 888sport appsের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। রায়হানের তোলা সেদিনের ছবিতে দেখা যায় এম আর আক্তার মুকুল, উপেন তরফদার, জহির রায়হান ও যশোরের রওশনসহ অনেককে।
কুষ্টিয়াতে রাজাকারদের ধরে আনার ছবি, ৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতির দিন কলকাতায় একটি মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবিও উঠে আসে তাঁর ক্যামেরায়। এই ছবিগুলোই ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। একাত্তরে হামিদ রায়হানের তোলা ছবিগুলো বিশ্ব গণমাধ্যমে পাঠানো হতো। ফলে 888sport appsের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আলাপচারিতায় যুদ্ধদিনের 888sport app download for androidীয় কয়েকটি ঘটনার কথাও তুলে ধরেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান। তাঁর ভাষায়, ‘খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অভুক্ত অবস্থায় মানুষ আসছে দেশ থেকে। তিন-চারদিন পর খাবার পেল। আবার কলেরা শুরু হয়ে গেল। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চোখের একটা অসুখ দেখা দেয় তখন। চোখের ওই রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল সব ক্যাম্পে। ফলে পশ্চিম বাংলার লোকেরা ওই রোগের নাম দেয় ‘জয় বাংলা রোগ’। এক শরণার্থী ক্যাম্পে দেখেছি মা মরে গেছে, বাচ্চা গিয়ে তার দুধ খাচ্ছে। এই ছবিটা তুলতে না পারায় খুব আফসোস হয়েছিল। হাজার হাজার লোক মরেছে ক্যাম্পে আসার আগেই, খাবারের অভাবে। খুলনার গল্লামারি বদ্ধভূমিতে মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলির স্তূপ ছিল। অধিকাংশকেই সেখানে বিহারি ও রাজাকাররা হত্যা করেছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘একাত্তরে ভারতীয় জনগণের সহযোগিতার কথা না বললেই নয়। শুধু খাওয়া নয়, থাকার জায়গা দিয়েও সহযোগিতা করেছে। কলকাতার কাছে এক শরণার্থী ক্যাম্পেই ছিল প্রায় লাখের মতো লোক। ভারতীয়রা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে স্কুলগুলো দেয় শরণার্থীদের থাকার জন্য। ভারত যে-সহযোগিতা করেছে তা না হলে প্রায় অসম্ভব ছিল দেশ স্বাধীন করা। সাড়ে সাত কোটির ভেতর এক কোটি লোককেই তারা জায়গা দিয়েছে। ওই সময়ের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না একাত্তরে কী হয়েছিল!
শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়াও ছবি তুলেছি বর্ডার এলাকার অ্যাকশন ক্যাম্পগুলোতে। আমার ক্যামেরায় তুলে আনি একাত্তরের ৫৪০টির মতো ছবি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ২৯২টি, দৃককে ১০০টি ও সামরিক জাদুঘর ‘বিজয় কেতনে’ দিয়েছি আরো বেশ কিছু ছবি।’
ছবি নিয়ে ভালোলাগার অনুভূতিও জানান এই আলোকচিত্রী, ‘একাত্তরে সাতক্ষীরার দেবহাটায় এক মুক্তিযোদ্ধার বন্দুক তাক করা একটা ছবি তুলেছিলাম। কয়েক বছর আগে দৃক গ্যালারিতে সে-ছবিটি প্রদর্শিত হয়। ওরা প্রদর্শনীর প্রচারণা চালায় ওই ছবিটা দিয়েই। তা দেখে এক ব্যক্তি তাঁর নিকটাত্মীয়কে খবর দেন। তারপর নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে একাত্তরে নিজের ছবি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেন ওই মুক্তিযোদ্ধা। তখনই জানি, তাঁর নাম মোসলেহ উদ্দিন।
এভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত মানুষ, তাঁদের বা তাঁদের স্বজনদের খুঁজে পেয়েছেন আমার তোলা ছবি থেকে। ওই ছবি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দিয়ে তাঁরা বা তাঁর পরিবার সম্মানিতও হয়েছেন। এটাই ভালো লাগে। ছবি তুলেছিলাম বলেই তো আজ এতো ছবি আপনারা দেখতে পারছেন। একাত্তরে ক্যামেরাটাই ছিল আমার অস্ত্র।’
১৯৭৩ সালের ১৩ মার্চ কুষ্টিয়া শহরে রূপান্তর নামে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান। সেখান থেকে একাত্তরের ছবিগুলো সামান্য মূল্যে প্রিন্ট করা যায়। এছাড়া প্রজন্মের কাছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে টানানো রয়েছে বেশকিছু ছবি। পরিসর ছোট হলেও রূপান্তর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার এক জীবন্ত মিউজিয়াম।
যুদ্ধ-আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হানের বয়স এখন আটাশি। একাত্তরে রিক্রুটিং ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সম্মান লাভ করেছেন তিনি।
কিন্তু অদ্যাবধি তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে সরকার কোনো স্বীকৃতি বা 888sport app download bd দেয়নি। এ নিয়ে কোনো আফসোসও নেই তাঁর। শুধু বললেন, ‘কর্তব্য ছিল, করেছি। নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে। একাত্তরের ছবিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে রূপান্তর স্টুডিও দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ওই ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক। ভাবুক তারা, কত কষ্টে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি!’
শুধু অস্ত্র হাতেই নয়, একাত্তরে নানাজন নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, ত্বরান্বিত করেছিল স্বাধীনতা অর্জনকে। এ-কারণেই পদযাত্রী দলের কামরুল আমান, বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লা ও যুদ্ধ-আলোকচিত্রী হামিদ রায়হান অন্যরকম মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন দেশে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, একাত্তরকে কর্তব্যকর্ম ভেবেই তৃপ্ত হন তাঁরা। তাই তাঁদের গৌরবের ইতিহাস প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের অর্জনের ইতিহাসটুকু পাঠ করে এ-প্রজন্ম মাতৃভূমিকে ভালোবাসার তীব্র আনন্দটুকু অনুভব করতে শিখবে। তাঁদের কথা ভেবে একদিন তারা বলবে, তোমরা যে 888sport appsের স্বপ্ন দেখেছিলে সেই 888sport appsকে আমরা গড়ে তুলবই।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.