সুনন্দা সিকদার
’৬১-র জানুয়ারিতে যখন দশ পূর্ণ হয়ে এগারোয় পা তখনই দাদার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটে আমার। কাঁটাতারের ওপারে পড়ে রইল দাদা, যে ছিল আমার দশ বছরের শৈশবে আমার সব থেকে বড়ো সত্য। আমাকে এপারে আসতে হলো, আর নিরন্তর এই বিচ্ছেদ-বেদনা গোপন রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হলো।
যে-বেদনা থেকে রেহাই নেই, প্রকাশ করার কোনো জায়গা নেই, সেই বেদনাকে ভোলার একমাত্র পথ মনে হয়েছিল শৈশবকে অস্বীকার করা। শৈশবের সঙ্গে দাদা, যে কি না আমার সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে, সেই দাদাকে, গ্রাম ও দেশকে অস্বীকার করা, অর্থাৎ জীবন থেকে ছেঁটে ফেলা দশটি বছর।
বড়ো সহজ ছিল না। যতই বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বাঙাল পরিচিতি মুছে ফেলে ময়ূরপুচ্ছধারী কাকের মতো শহুরে চালে চলতে চাই, কাঁটাতারের ওপার থেকে দমকা হাওয়ায় হঠাৎ কোনো টুকরো খবর ভেসে এলে তছনছ হয়ে যায় আমার সমস্ত প্রতিরোধ।
’৭১-এর ৭ই মার্চের পর থেকে ঝড়ো হাওয়ায় এত খবর ভেসে আসতে লাগল যে, আমার ভেতরটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে খান-খান হয়ে যেতে লাগল। কী করে অস্বীকার করি পূর্ব পাকিস্তান দেশটাকে, দিঘপাইত গাঁকে আর আমার দাদা মাজম শেখকে? সব যেন স্বপ্ন থেকে কঠিন বাস্তব হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী করে বাঁচাই নিজেকে? কী করে ঢেকে রাখি আমার পীড়িত মনটাকে?
’৭১-এর ৭ই মার্চ 888sport appর রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ – বলিষ্ঠ অথচ আবেগমথিত সেই কণ্ঠস্বর বারবার বেতারে ধ্বনিত হতে লাগল। পথেঘাটে মানুষের মধ্যে সাংঘাতিক উন্মাদনা, আমার যেসব বন্ধু সাত পুরুষের ঘটি, তারাও আবেগে উদ্বেলিত। এসব থেকে কত দূরে পালাবো আমি? এদের সঙ্গে থেকেও এসব প্রসঙ্গ এলে নীরব থাকি। ওরা ভাবে, ফেলে আসা দেশকে নিয়ে আমার কোনো আবেগ নেই। যে যাই ভাবুক, আমাকে নানা প্রশ্ন করুক, আমি শান্ত আর সংযত থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করি। সবার সামনে ভেঙে পড়তে চাই না আমি।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পর, ২৬শে মার্চ ভোর থেকেই শুনছি চারদিকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। সারারাত ঘুম হয়নি, ভেতরে ঝড় চলছে। বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়ে দেখি পাড়ার রকে মোড়ে একই আলোচনা, অস্ত্রবল, যুদ্ধ করার শিক্ষা কিছুই নেই যাদের, তারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে – এই সাহসকেই যেন কুর্নিশ জানাচ্ছে সকলে। 888sport apk download apk latest versionমিশ্রিত বিস্ময় পশ্চিমবঙ্গীয় মানুষের কথায় – ‘একেই বলে বাঙালে গোঁ, – ওরা সব পারে, এটাও পারবে।’
মনে মনে বলি তাই যেন হয়। আমাদের এপারে কিন্তু নকশাল আন্দোলনের আগুন একেবারে নিভে যায়নি। তবে পাড়ার নকশাল-সিপিএমের ঝগড়া এখন একটু স্তিমিত। দু-দলই 888sport appsের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সশ্রদ্ধ।
এমন একটা সময় ছিল যখন পাড়ার সকলে বাঙাল বলে আমার পেছনে খুব লাগত। এখন আবার তারাই ডেকে বলছে, ‘ওরে, তোদের একসময় খুব নিন্দে করতুম, এখন বাঙালদের আত্মমর্যাদাবোধ আর সাহস দেখে ভালো না বেসে পারছি না। যদি পারতুম ওপারের বাঙালিদের সাহায্য করতুম।’
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সাহায্যের দরকার হলো। আমাদের পাড়ার বাঙাল পরিবারগুলোতে 888sport apps থেকে অনেক আত্মীয়-স্বজন চলে এলেন। বেশিরভাগই মহিলা, তাঁদের মেয়েদের সঙ্গে করে চলে এসেছেন পাকিস্তানি সেনার হাতে অসম্মানিত হবার ভয়ে। বাড়ির পুরুষ মানুষরা দেশেই থেকে যাচ্ছিলেন। কিছুটা বাড়িকে আগলানোর জন্য, কেউ কেউ আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য। যুবকদের সম্বন্ধে শুনছিলাম তারা নাকি যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে।
কয়েক মাসের মধ্যেই দেখলাম ছেলেরা অনেকেই পালিয়ে আসছে। শুধু হাতে কি যুদ্ধ করা যায় নাকি? ট্রেনিং নেবার সুযোগ খুবই কম। মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী তৈরি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু আধুনিক সমরাস্ত্রের সঙ্গে পেরে ওঠা কোনোমতেই সম্ভব নয়। ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। না দিয়ে উপায় নেই। বিধ্বস্ত পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থীর ঢল আছড়ে পড়ছে। এপারের বাঙালিদের পূর্ণ সহানুভূতি ওপারের আক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য। এই প্রথম লক্ষ করলাম, পূর্ব বাংলা থেকে আগত মানুষদের মুসলমান পরিচয়ের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তাদের বাঙালি পরিচয়।
সব দেখছি, শুনছি। রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভাবি, জল-জঙ্গল পেরিয়ে আমার দিঘপাইত গাঁয়েও কি ঢুকে পড়বে পাকসেনা? আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। দাদার মুখ ও গাঁয়ের অন্য প্রিয়জনদের মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
আষাঢ়ের শুরু, প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তায় জল জমে গেছে। এরই মধ্যে একদম কাকভেজা হয়ে দিদির সঙ্গে ১৮-১৯ বছরের পাঁচটি ছেলে এলো আমাদের বাড়ি। দিদির বাড়ি দমদম, ওদিকে এত বৃষ্টি ছিল না, পথে বেরিয়ে এমন অবস্থা হবে বুঝতে পারেনি। ওদের দু-খানা গামছা দিলাম হাত-পা মোছার জন্য। তারপর শুনলাম ওরা মুক্তিযোদ্ধা। ওদের ট্রেনিং হয়েছিল। জোরে দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, গাছে ওঠা, বন্দুক চালানো ইত্যাদি। কিন্তু অস্ত্রের অভাবে যুদ্ধ চালানো সম্ভব হয়নি। বেঘোরে প্রাণ দিয়ে লাভ নেই। ওপরের নির্দেশেই ওরা এদিকে পালিয়ে এসেছে। দুটি হিন্দু ছেলে দিদির শ্বশুরবাড়ির দূরসম্পর্কের আত্মীয়। মুসলমান ছেলে তিনটে ওদের বন্ধু। দিদিদের অনেক বড়ো বাড়ি। সেখানে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছে। ওপরতলার নির্দেশ কিছু আসছে না, ওদের গলায় হতাশার সুর। তবে এখনো স্বপ্ন দেখছে, স্বাধীনতার স্বপ্ন।
সেদিনের মতো ওরা চলে গেল। কিছুদিন পরে শুনলাম হিন্দু ছেলে দুটো কোনো নিকট আত্মীয়ের খোঁজ পেয়ে চলে গেছে। মুসলমান দুটো ছেলে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছে। একলা হিলু রয়ে গেছে দিদিদের কাছে। একা হয়ে যেতে ওর মনটা আরো ভেঙে গেছে। দিদিদের বাড়িতে ওর কাছাকাছি বয়সের কেউ নেই, দিদি ভাবলো, আমাদের বাড়িতে ওর হয়তো একটু ভালো লাগবে। আমি ওর থেকে বছর দুয়েকের বড়ো, কাছাকাছি বয়স, হয়তো খোলামনে দুটো কথা বলতে ভালো লাগবে।
আমাদের বাড়িতে অল্প জায়গার মধ্যে আমরা কিছুটা কাছাকাছি চলে এলাম। ঠিক পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো। রাখিপূর্ণিমায় রাখি পরালাম, কালীপুজোর পরে ভাইফোঁটা দিলাম। ওর উৎসাহেই আমি আল মাহমুদের 888sport app download apk পড়লাম। খুব ভালো লাগল। এতদিন পড়িনি বলে আফসোস হলো। আমার ছোড়দা জলপাইগুড়ি পলিটেকনিকে পড়ায়, ও ছুটিতে এসেছিল। ছোড়দা ওকে নিয়ে যেতে চাইল, ওখানে ও অনেক ভালো থাকবে, ওর বয়সী ছাত্রদের সঙ্গে।
হিলু চলে গেল। এদিকে যুদ্ধের খবর যতই শুনছি, সবারই হতাশা বাড়ছে। ওখানে সাধারণ মানুষ নাকি সমানে মার খাচ্ছে। যুদ্ধ করতে গিয়ে মৃত্যু তবু মানা যায়; কিন্তু সাধারণ নাগরিকের এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া এপারের বাঙালিদের পক্ষেও খুব কষ্টকর হলো। দুই পারের বাঙালি একই ভাষায় কথা বলে, গান করে, সমস্ত রকম আবেগ প্রকাশ করে, স্বপ্ন দেখে। সেজন্য শরণার্থীর ভিড় দেখেও কেউ বিরক্ত হচ্ছে না। শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণটি প্রায়ই বেতারে আমরা শুনতে পাই। সকলের মনেই উৎকণ্ঠা – দেশটি কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে?
তবে পূর্ব বাংলার যুবগোষ্ঠী তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণ হাতে নিয়ে। এই অসম যুদ্ধেও তারা হাল ছাড়ছে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার নিন্দা হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব-জনমতকে স্বাধীন 888sport appsের পক্ষে প্রভাবিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কাগজে প্রায়ই ইন্দিরা গান্ধীর ছবি থাকছে – শরণার্থী শিবিরে তিনি নিজে হাতে খিচুড়ি বিতরণ করছেন, শরণার্থী শিবিরের মেয়েদের কাছে গিয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনছেন সহানুভূতির সঙ্গে, আশ্বাস দিচ্ছেন। ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি সে-সময় সকল বাঙালির 888sport apk download apk latest version বেড়ে গিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অনুভব করেন দুই বাংলার আত্মিক যোগ, ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে বাঙালির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিলেন।
কিছুটা বাধ্য হয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে এসেছেন। সে-দেশের বুদ্ধিজীবীরাও ভারতে, প্রধানত কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ প্রচারিত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং সে-দেশের কিছু মানুষ, যারা পাকিস্তানপন্থী, তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথাও প্রচারিত হচ্ছে। তারা চিহ্নিত হচ্ছে রাজাকার নামে।
অনেক পরে পরিণত বয়সে 888sport appsে নিজের গ্রামে যাবার যখন সুযোগ হলো, তখন এদের নৃশংসতার বর্ণনা আরো বেশি করে জানতে পারি। এই মুহূর্তে ’৭১-এর 888sport sign up bonusই রোমন্থন করে যাচ্ছি।
আনন্দ-দুঃখের এই মিশ্র অনুভূতি মানুষের জীবনে এ-রকম তীব্রভাবে আসে কি না আমার জানা নেই। তবে আমার ওই ২০-২১ বছরের জীবনে সুখ-দুঃখের সাংঘাতিক ওঠা-পড়ায় মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, ভেতরের যন্ত্রণাকে চাপা দেওয়ার জন্য জীবনে আর এত অভিনয় আমাকে করতে হয়নি।
এই সুখ-দুঃখের একজন ভাগীদার ছিল আমার পালিকা মা। সে আমাকে মানুষ করে আমারই টানে সত্তর বছর বয়সে গাঁ ছাড়তে বাধ্য হয়। দেশ ছাড়ার পর থেকে তার আর আমার মধ্যে গাঁয়ের উল্লেখ সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। আমার মায়ের মতো আমিও মানতাম, গাঁয়ের প্রসঙ্গ আমাদের কষ্ট আরো বাড়াবে। কিন্তু এতসব ঘটনা বহির্জগতে ঘটে চলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের নাম 888sport apps হতে চলেছে, সীমান্ত খোলা, এত লোকের যাতায়াত, রেডিওতে 888sport appsের গৌরবকাহিনি, ইন্দিরা গান্ধীর এত বড়ো সাফল্য – এসব নিয়ে নানাদিকে আলোচনা চলছে। সম্ভবত মা আর সইতে পারছিল না তার ভেতরের এই উথাল-পাথাল। রাতে শুয়ে দুজনেই অন্যদিনের মতো ঘুমের অভিনয় করি। দুজনেই জানি, এসব রাতে আমাদের পক্ষে ঘুমোনো কত কঠিন। এগারোটা নাগাদ বিছানায় শুয়েছি আমরা, রাত একটা নাগাদ মা বললো – ‘দয়া, দ্যাশটার কি ভালো হইব?’ ‘মনে হচ্ছে ভালো হবে। ওরা স্বাধীন হতে চাইছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকবে না বলে বিদ্রোহ করছে।’ ‘ওরা কি পাইরা উঠব রে দয়া?’ ‘ভারত সাহায্য করলে নিশ্চয়ই পারবে।’ মা আর কথা বাড়ালো না। মায়ের গলাটা ধরা ধরা মনে হলো।
ভারতীয় যুদ্ধবিমান 888sport appর আকাশে দেখা গেছে – এরকম একটা খবর কার মুখে প্রথম শুনলাম মনে নেই। তবে সকলেই মনে করছে ইন্দিরা গান্ধী বিপন্ন পূর্ব পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যা সকল বাঙালিরই কাম্য ছিল। কয়েক দিন কাটল খুব উত্তেজনার মধ্যে। ১৬ই ডিসেম্বর শেষ পর্যন্ত ভারতের লে. জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন পাকিস্তানের লে. জেনারেল নিয়াজী। 888sport apps অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেল। পশ্চিমবঙ্গবাসী আনন্দে ভাসলেন, গৌরববোধ করলেন বাঙালিয়ানার এই জয়ে।
আমিই খুব আনন্দ করতে পারছি না। জানি না মায়ের মনের মধ্যে কী চলছে। আমার সব সময় নানা আশঙ্কা। গ্রামে কি পাকিস্তানি সেনা ঢুকেছিল? যদি ঢুকে থাকে তবে কেউ কি বেঁচে আছে সেখানে? কত কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে তাদের? যদি কেউ বেঁচেও থাকে সে তো না খেয়েই মরে যাবে। বরাবর শুনে আসছি যুদ্ধের পরেই দুর্ভিক্ষ আসে। মাথায় সবসময় এরকম ঘুরছে। হিলুটা আবার জোর করেই দেশে ফিরে গেল। ওরই বা কী খবর কে জানে।
এরই মধ্যে ’৭২-এর প্রথম সপ্তাহে গ্রাম থেকে চিঠি এলো। ইয়েদালি কাকার হাতের লেখায় দাদার চিঠি। চিঠির কথাটুকু হলো, ‘আমরা বাঁচিয়া আছি। পথের খরচ জুটাইতে পারিলে একবার তোমার মুখখানি দেখিয়া আসিব।’ এর সঙ্গে ছিল কাকার আশীর্বাদ। এরকম দিন আমার জীবনে খুব বেশি আসেনি। এত আনন্দ পাওয়া, এমনভাবে চাপমুক্ত হবার কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। 888sport appsের স্বাধীনতা এতক্ষণে আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারলাম।
দাদার পথের খরচ মেটাতে লেগেছিল আড়াই বছর। ততদিনে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। দাদাকে দেখলাম, ১৪ বছর আগে সে ছিল সুঠাম যুবক, সে এখন যেন অশীতিপর এক বৃদ্ধ মানুষ। মনে মনে হিসাব করলাম, তার বয়স ’৭৪ সালে ৪৫- ৪৬-এর বেশি নয় কোনোমতেই। অনাহারে সন্তানদের খেতে দিতে না পারার কষ্টে তার এই অকালবার্ধক্য।
দাদা আমাকে যাবার সময় অনেক করে বলেছিল, ‘এখন দ্যাশটা স্বাধীন, নাম বাংলাদ্যাশ, তুমি নিশ্চিন্তে আসবা, শাক-ভাত জুটামু তোমার জন্য। আইস দয়াসোনা আমার।’
দাদার জীবদ্দশায় যেতে পারিনি, গেলাম ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রৌঢ় বয়সে; ভাবি দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সেই আইলা, সে বাঁইচ্যা থাকতে আইলা না ক্যান?’
যাই হোক, দাদার পরিবারের সকলে আমাকে পরমাত্মীয়ের স্বীকৃতি দিলো। গ্রামের অন্য সকলের কাছেও ভালোবাসা পেলাম। ২০০৯-এর পর থেকে চারবার ঘুরে এসেছি গ্রামে। জানতে পেরেছি ’৭১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমার গ্রামের ওপর দিয়ে কী গেছে, কীভাবে আত্মরক্ষা করেছে আমার গ্রামের মানুষ। ভিখারি আকালু বাউসীর পথে যেতে দেখতে পায় পাকসেনার ছাউনি। সেখানে গাঁয়ের এক হাজি সাহেবকেও দেখতে পায় সে। বাতাসে ছড়িয়ে ছিল মাংসের সুগন্ধ। সেই দারুণ সুগন্ধ পেছনে ফেলে দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামে ফেরে সে প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে। এসেই সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যায় কাত্যায়নী পিসি ঠাকরানের কাছে। ওরকম বুদ্ধিমতী মানুষ গাঁয়ে আর ছিল না। সারা গাঁয়ের মানুষকে সতর্ক করেন তিনি। চাল-ডাল চিঁড়ে-মুড়ি কাঁথা-কাপড় বেঁধে নিয়ে বংশ নদীর ওপারে জঙ্গলে ঢুকে যাবার নির্দেশ দেন সকলকে। নিজেও ভাই-ভ্রাতৃবধূ ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে জঙ্গলের পথ ধরেন। গৃহপালিত পশুগুলোর গলার দড়ি খুলে দেওয়া হয়, তারা অনুসরণ করে বাড়ির মানুষকে। কুকুরগুলোও গ্রামের মানুষের পেছন পেছন চলে।
তবে কার্তিকের শেষে জঙ্গলে অসহনীয় ঠান্ডা। খাবার ফুরিয়ে গেলে খিদের কষ্ট। বুড়ো-বাচ্চা কয়েকজন তো মারাই গেল। সব থেকে বেশি মারা গেল গ্রামের অল্পবয়সী ছেলেরা। তাদের জঙ্গলে আটকে রাখা যায়নি। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিচ্ছে – আর তারা থাকবে জঙ্গলে লুকিয়ে! বাবা-মায়ের কথা ভাইবোনের কথা তারা ভাবলো না, বেরিয়ে পড়ল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে, রাজাকারদের ওপর নজর রাখতে। কেউ কেউ আবার আগে থেকেই চলে গিয়েছিল বাঘা সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিতে। শেষ পর্যন্ত গ্রামে ফিরে এসেছিল মাত্র চারজন যুবক।
যখন জানা গেল, ভারত সাহায্য করছে, খান সেনারা পিছু হটছে, তখন ভয়ানক শীতের কামড়। জঙ্গলে আগুন জ্বালাতেও ভয়। খাবার একেবারে শেষ। বুনো ফল, মাটির তলা থেকে খুঁড়ে বার করা হচ্ছে কন্দ জাতীয় উদ্ভিদ, কিছু জলজ উদ্ভিদ, কিশোর ছেলেরা কখনো চুনো-চানা মাছ-কচ্ছপ বা পাখি শিকার করে আনছে। এই খাদ্যাভাবের মধ্যে মায়েরা কিন্তু নীরবে নিঃশব্দে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন। কোনো হিন্দু মা খাবেন না মুসলমান শিশুদের ফেলে, কোনো মুসলমান মাও খাবেন না হিন্দুঘরের শিশুদের না খাইয়ে। এভাবে সংকটকালে জাত-পাতের কঠিন আগল খুলে গেল।
ছেলেরা ১৬ই ডিসেম্বর রাতের বেলা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে খবর নিয়ে এলো পাকিস্তানি লে. জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতের লে. জেনারেল অরোরার কাছে। শিশু জাকিরের কাছে লুকোনো ছিল 888sport appsের জাতীয় পতাকা। তার দাদা যুদ্ধে যাবার সময় বলে গিয়েছিল, স্বাধীনতার খবর এলে হাটখোলায় পতাকা তুলতে। এ-খবর জানার পর সবারই চোখে জল, তবু জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সবার আগে হাটখোলায় পতাকা তোলা হলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে।
গ্রামে আগুন ধরিয়ে ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকসেনারা। গ্রামের কিশোরদের সাহায্য নিয়ে পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও হাত লাগালেন মায়েরাই। মোটামুটি কয়েকটি বাসযোগ্য ঘর হবার পর ধান কাটার চিন্তা। ধান বোনা যখন হয়েছিল, তখন তারা ভাবেনি পাক সেনারা রাস্তা চিনে গ্রামে আসতে পারবে। যাই হোক, ধানক্ষেত নষ্ট করার কথা তাদের বোধহয় খেয়াল হয়নি। ধান কাটাতেও অবশেষে তাঁরা হাত লাগালেন। বলদ অনেকগুলো ছিল একসময়। দুটি বলদ জোগাড় করাই যুদ্ধের পর কঠিন হয়ে গেছে। বলদগুলো সবই মারা পড়েছে। কিশোরদের চেষ্টায় দুটি বলদ কোনোরকমে জোগাড় হলো। ধান যেদিন মাড়াই হচ্ছে, ঘরে-না-ফেরা ছেলেদের জন্য সারা গ্রামই কাঁদছে তখন। বুনো ফল, কচু কিংবা শাকপাতা খাওয়া মানুষগুলোর কাছে তখন ভাত রাঁধার কল্পনাও বড়ো যন্ত্রণাদায়ক ঠেকছে। কিন্তু ধান ভানতেও হবে, ভাত রাঁধতেও হবে মায়েদের। শিশুগুলো যে কতদিন ভাত খায় না। কিশোর ছেলেগুলোই বা কতদিন আর অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকবে, তাই শোক ভুলে মায়েদের আবার হাঁড়ি-হাতা-খুন্তি নিয়ে বসতে হয়, ভাত রেঁধে শিশুদের মুখে তুলে দিতে হয় নুন-ভাত। নুনও তখন দুষ্প্রাপ্য। তবে অনেকেই বুদ্ধি করে গোয়ালঘরে নুনের বস্তাটি সরিয়ে রেখেছিল।
স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরে গ্রামে গিয়ে আমি যে উন্নতিটুকু দেখলাম তা চোখে পড়ার মতো। আমার শৈশবে চাষি সারাবছর খেতে পেতেন না। ৫৮ বছর বয়সে গিয়ে দেখি চাষি তিনবার ভাত খান দিনে। হোক না সে নুন-ভাত কিংবা শাক-ভাত, তবু পেটভরা খাওয়া তো। খড়ের ঘরগুলো এখন টিনের। গ্রামে স্কুল-কলেজ হয়েছে। চাষিবাড়ির অন্তত দুটি ছেলে কিছুটা লেখাপড়া করে চাকরি করছে। গ্রামের পাশ দিয়ে জাতীয় সড়ক হবার ফলে কিছু ব্যবসাপত্র হয়েছে, তার ফলে হয়েছে কিছু কর্মসংস্থান। মেয়েরাও পড়াশুনো করছে। তবে পরিবার পরিকল্পনা এখনো তত ফলপ্রসূ হয়নি গ্রামে। 888sport promo codeশিক্ষার প্রসার হলে আশা করা যায় এক্ষেত্রে ফল পাওয়া যাবে।
সব থেকে ভালো লাগলো কীর্তনের পর হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসে খিচুড়ি-লাবড়া খেলেন দেখে। যদি ৭৫-৮০ বছর আগে এমনভাবে খাওয়ার উপায় থাকত তাহলে হয়তো দেশভাগের প্রয়োজন নাও হতে পারত। একসঙ্গে খাওয়া মানুষকে কত কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে – সেই উপলব্ধি হলো ৪৮ বছর পর গাঁয়ে গিয়ে।
কীর্তনের আসরেই আলাপ হলো গ্রামের নিরক্ষর গায়ক ও কবি বেলাল হোসেনের সঙ্গে। প্রবীণ কীর্তনীয়া তাঁর পরিচয় দিলেন এমনিভাবে, ‘এই পোলা হইল দশ গাঁয়ের গৌরব। নিজে গান বান্ধে, নিজেই সুর দেয়। অতি মিঠা গলা। শুনেন পরান জুড়াইব।’ বেলাল সেলাম জানিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, তিনি লালনের একজন ভক্ত মাত্র, মুখে মুখে গান বাঁধেন বটে, সুরও দেন। তবে সেসব কতখানি পরিবেশনযোগ্য তিনি জানেন না। তিনি মানুষকে ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করতে চান জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে। মানুষে মানুষে যে-কোনো রকম বিভাজনই তাঁকে খুব কষ্ট দেয়।
তাঁর গানের একটা কলি তুলে দিচ্ছি নিচে।
ধর্মের জন্য মানুষ তো নয়/ ধর্ম তাহাই মানুষের যা সয়
আল্লা হরি বেহেস্তে নাই/ মানুষের ভিতরেই রয়। 888sport appsের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো। আমার শৈশব গড়ে দিয়েছিল আমার গ্রামের মানুষ। আমার দাদা মাজম শেখ ছাড়াও আরো অনেকে মিলে আমার জীবনের ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। সেই জন্য শারীরিকভাবে আমি যেখানেই থাকি না, মনে মনে আমি গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। পঞ্চাশ বছরে 888sport appsের আর্থিক উন্নতি, বাংলাভাষার সম্মান, সমৃদ্ধ 888sport live footballকীর্তিতে আমি খুবই গৌরব অনুভব করি। সেই সঙ্গে প্রার্থনা করি বেলালের মতো অনেক অনেক কবি-গায়কের জন্ম দিক 888sport apps। মানবপ্রেমের যে-গান গাইছেন বেলাল, ধর্ম সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে, তার ঢেউ আছড়ে পড়ুক ভারতে। তাহলে যদি ভারতবাসী তার প্রাচীন ঐতিহ্য খুঁজে পায়।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.