ভোর ৫টা
মসজিদে আজান হচ্ছে, প্রফেসর হেলাল মিয়া ঘুমাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জাগবে, আর আমাকে বলবে, ‘আজান পড়তাছে। উঠ।’
আজানটা বেশ সময় নিয়ে পড়ে, এক মসজিদ শেষ হলে অন্য মসজিদে, প্রায় ভোরেই। মিনিট পনেরো তাই সময় পাই, কিন্তু তারপর হেলালের সেই অমোঘ আদেশ, ‘উঠ।’ উঠতে হয়।
কাকসকল কোলাহল করে। এক প্রতিবেশীর ছাদ থেকে মোরগ ডাকে। প্রতিবেশীও ডাকে, কাজের লোকগুলোকে। আমার বাড়িতে কাজের লোক নেই, আছে শুধু এক ছুটা-কাজের বুয়া। সে আসবে ন’টায়। ততক্ষণে প্রফেসর হেলাল মিয়া নাস্তা সেরে বাজারে গিয়ে মাছ-তরকারি কিনে বাসায় ফিরবে। তারপর গোসল শেষে ইউনিভার্সিটিতে দৌড়াবে। সকালের আলো জাগে আর পর্দার ফাঁক দিয়ে গলে পড়ে চার কামরার এই ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোনায়। আমি কাজ এবং অকাজের মাঝখানে বুদ্ধিরহিত মানুষের মতো ঘোরাঘুরি করি। কাজগুলো কী, তা বুঝি, কিন্তু কাজের মাঝখানে কেন অকাজ হানা দেয়, তা বুঝতে পারি না।
যেমন, এক সকালে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে কুড়ি মিনিট ধরে আমি আকাশ দেখছিলাম এবং সেটি প্রফেসর হেলালের চোখে পড়েছিল। তার বহুমূত্র সমস্যা, ছ’টার সময় উঠে বাথরুমে যায়। বাথরুম সেরে রান্নাঘরে ঢুকে এক গ্লাস পানি খায়। তারপর আবার গিয়ে শোয়। ঘণ্টা দেড়েকের আরাম ঘুম।
জানালা দিয়ে আমাকে তাকাতে দেখে বলছিল, ‘কী দেখতাছ? হলের ছাদে ছাত্রগো বডি বিল্ডিং, নাকি তাগো খোলা বডি? হুঁ?’
তাই তো! চার-পাঁচজন ছাত্র ব্যায়াম করছে। পলকা শরীর, পাকাটির মতো হাত-পা। তাতেই অদৃশ্যপ্রায় বাইসেপ ফ্লেক্স করে করে শরীরের জেল্লা বাড়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা।
হেলালের চোখের হাসিটা অশ্লীল এবং নির্মম। ‘আইজকা পরোটা অমলেট খামু,’ বলে সে ঘুমাতে যায়।
আমি পরোটা বানাতে বসি।
অনেকদিন আগে – কোন জন্মে তা মনে পড়ে না – বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। প্রথম বর্ষের ক্লাসে একটা 888sport app download apk পড়ানো হতো। ‘পাপের মধ্যে বসবাস।’ এক গৃহিণীর গল্প। সকালে সিঁড়িতে দুধওলার পায়ের শব্দে মেয়েটি জাগে, আর শুরু হয় তার ত্রাসের দিন। অচেনা একজন পুরুষের মতো স্বামীর সঙ্গে দিনযাপন। কিন্তু রাতে সেই স্বামীটিকেই সে জৈবিকভাবে চায়, প্রবলভাবে চায়। এবং সেই ক্ষুধার্ত চাওয়ার ভেতর দিয়ে ভুলে যায় তার গ্লানির গল্প।
পাপ নয় তো কী?
পরোটা বানাতে বসে মনে হয়, 888sport app download apkটি কি আমার জন্য লেখা হয়েছিল?
সকাল ৮:৪৫
প্রফেসর হেলাল মিয়া আজ খাকি প্যান্ট আর নীল শার্ট পরেছে। শার্টটা সে কিনেছে হংকং থেকে। হংকং সে গিয়েছিল এশিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে। সেখানে সে একটা দারুণ 888sport live পড়েছিল। 888sport liveের বিষয়বস্তু : পোঁয়াকারে কনজেকচার। ত্রিমাত্রিক গোলকের বিশেষত্ব নিয়ে মূল্যবান কিছু চিন্তা উপহার দিয়েছিল প্রফেসর হেলাল। ফিরে এসে আমাকে সে বলেছে, চীনা অংকবিদ শিং-তুন ইয়াওয়ের সে চোখে পড়েছে। প্রফেসর ইয়াও পোঁয়াকারে কনজেকচারের সমাধান করেছেন। অংকবিদদের শ্রেষ্ঠ 888sport app download bd ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন। তিনি যখন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন হেলালের কাজে, তার ভবিষ্যৎ তো উজ্জ্বল।
খুশি খুশি চেহারা নিয়ে দরজার পাশে জুতা পরছে হেলাল। আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। একটা ফোন এলো। ফোনটা কি প্রফেসর ইয়াওয়ের? হতে পারে। এশিয়ান জার্নাল অফ ম্যাথমেটিকসে হেলালের একটা 888sport live ছাপা হয়েছে। তারপর থেকে বিদেশ থেকে বেশ ফোন আসছে। হেলাল বলেছে, আগামী বছর বসন্তে হার্ভার্ডে প্রফেসর ইয়াওয়ের সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ প্রায় নিশ্চিত। ‘ফোনটা ধরবা না? দাঁড়াইয়া আছ ক্যান?’ সে বলল। বলাটা রাগের, তাই আমি প্রায় দৌড় দিয়ে ফোন ধরলাম।
‘তোমার ছাত্র, পাপড়ি।’
‘পাপড়ি আবার কেডা? পাপিয়া। নামটাও মনে রাখতে পার না?’ হেলাল আরেকটু রাগ দেখাল। তারপর ফোনটা নিয়ে গলায় অনেক মধু ঢেলে বলল, ‘হ্যালো পাপিয়া, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আইতাছি। চইল্লা যাইও না কিন্তু। ওয়েট।’
আমি অবাক হলাম। হেলাল বলেছিল তার জেনারেল ক্লাস। মাস্টার্সের ছাত্রদের সঙ্গে।
‘তোমার না জেনারেল ক্লাস?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হেলাল রেগে গেল। ‘জেনারেল ক্লাস তো দশটায়। অহন পাপিয়ার লগে সিটিং।’
রাগটা একটু কমতে দেওয়ার জন্য একটা জুতার ফিতা খুলে আবার লাগাল হেলাল। ‘পিএইচ.ডির পুলা-মাইয়াদের লগে ক্লাসটাও ক্লাস, বুঝলা? একজন আইলেও ক্লাস, পাঁচজন আইলেও।’
কিন্তু পাপিয়া যে একাই একশ!
হেলাল চলে গেলে আমি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছবির অ্যালবাম বের করলাম। তাতে হেলালের গণিত বিভাগের গত বছরের পিকনিকের অনেকগুলো ছবি লাগানো। পাপিয়ার মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে, তারপরও সে পিকনিকে গেছে, আর প্রায় প্রতিটি ছবিতে হেলালকে পেঁচিয়ে রেখেছে। মেয়েটি সুন্দরী, তাতে সন্দেহ নেই, অনেকটা ক্যাটওয়াকের মডেলদের মতো। এরকম মেয়ের অংকে ভালো হওয়ার কথা নয়, কিন্তু পাপিয়া ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। হেলালের প্রিয় ছাত্রী। বাসায় ফোন করলে আমি যদি ফোন ধরি, মেয়েটি একটি বাক্যই প্রতিবার বলে : ‘হ্যালো আমি পাপিয়া, স্যারকে দিন।’
হেলাল না থাকলে বলি, ‘স্যরি, ও তো বাসায় নেই।’
‘কোথায় গেছে?’
গেছেন না, গেছে। হ্যাঁ!
‘আমাকে বলে যায়নি।’
মেয়েটি খুক করে হাসে। বলে, ‘বলবেন, পাপিয়া ফোন করেছিল।’
অবাক কাণ্ড, হেলাল ঘরে ফিরলে যখন পাপিয়ার ফোনের কথা বলি, পড়ি তো মরি দৌড় দেয় ফোনের দিকে। অথবা মোবাইলে নাম্বার খুঁজে টিপতে টিপতে চলে যায় বারান্দায়।
পোঁয়াকারে কনজেকচার! কনজেকচার মানে অনুমান। হয়তো অনুমানটা ঠিকঠাক করতে পাপিয়ার সঙ্গে এত দীর্ঘক্ষণ তার ফোনালাপ।
সকাল ১০:৩০
কেউ আমাকে একটুখানি বোঝাতে চেষ্টা করুক, তিন্নি কেন এই ব্রুটটার সঙ্গে এখনো সংসার করে যাচ্ছে। একটা গেঁয়ো ভূত, সারা গায়ে এখনো বিক্রমপুরের কোনো এঁদোগ্রামের কাদা লেগে আছে। তিন্নির বাবা ছিলেন অংকবিদ। ড. কাজী মোতাহার হোসেনের ভাবশিষ্য। একসঙ্গে দাবাও খেলতেন। একটা আদর্শ যুগের আদর্শবান মানুষ ছিলেন দুজন। পড়াশোনাটাকে অসম্ভব মূল্য দিতেন। ভালো ফল করা ছাত্রদের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। হেলালুজ্জামান মিয়া যখন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকের অনার্স-মাস্টার্স পরীক্ষায় রেকর্ড-ভাঙা ফল করল, তিন্নির বাবার দৃষ্টি পড়ল তার ওপর; সন্তান-স্নেহের সঙ্গে এবার যোগ হলো সম্ভাব্য জামাই-স্নেহ। শিগগিরই সে জামাই-ও হলো। তিন্নি বিনাবাক্যে বাবার পছন্দ মেনে নিল। রহস্যটা সেইখানেই। প্রফেসর এমেরিটাস আ. কা. মজুমদার হেলালুজ্জামানকে পছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু তিন্নি? ইংরেজিতে এমএ করা মেয়ে। স্মার্ট এবং অপরূপা তিন্নি?
আট বছর হয়ে গেল, সংসার করছে তিন্নি। আট বছর হয়ে গেল, আমিও হাল ছাড়িনি। আমার দুই ক্লাস নিচে ছিল তিন্নি, একটা প্রীতিময় সম্পর্কও হয়েছিল তার সঙ্গে, প্রেমময় না হলেও। কিন্তু তিন্নির বিয়ে একটা ভয়ানক ঝড়ের মতো লণ্ডভণ্ড করে দিলো সবকিছু। একটা চাকরি করতাম। সেটি ছেড়ে দিলাম। আইন পড়লাম – কিছুটা বাবার ইচ্ছায়, অনেকটাই তিন্নিকে ভুলে থাকতে। তারপর বিলেত গেলাম। ব্যারিস্টার হলাম। 888sport appয় ফিরে রমরমা আইন পেশাও শুরু করলাম। কিন্তু তিন্নিকে ভুলতে পারলাম না। অথচ এখনো তিন্নি ওই ব্রুটটাকে ছাড়বে না। কী আছে তার জীবনে? ছেলেপুলে হলো না, এবং তা ওই ব্রুটটার ‘দোষে’ নয়, নিজের ‘দোষে’ই – সেরকম আমাকে জানাল। কিন্তু আমি তিন্নির ওই ‘দোষ’ মেনে নিয়েই তো জীবন কাটাতে চাই তার সঙ্গে। ছেলেপুলে চাই না আমার। পৃথিবীতে বংশধর রেখে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই। আমি চাই তিন্নির সঙ্গে একটা জীবন ভাগ করে নিতে। রাতে খোলাবারান্দায় বসে চাঁদ দেখতে, ভোরে পার্কে শিউলি ছড়ানো ঘাসে পা ফেলে ফেলে তার হাত ধরে হাঁটতে, আর এ দুই সময়ের মাঝখানে …
ফোনটা বাজছেই। তানিয়া জানে কার ফোন। ব্যারিস্টার ইমরানের। প্রতিদিন একবার সে ফোন করবেই। তানিয়া কোনোদিন ধরে, কোনোদিন ধরে না।
আজ ধরল।
ইমরানের একই কথা। ‘ডিভোর্সের সকল গ্রাউন্ড তোমার পক্ষে আছে, তিন্নি। প্লিজ, আমাকে অনুমতি দাও। লেট মি সি দিস ইনসিডেন্ট থ্রু।’
তানিয়া হ্যাঁ-না বলে না। মৃদু হাসে। তারপর ফোন রেখে দেয়। নেহায়েত একটা ব্যস্ত জীবন ইমরানের, সেজন্যে আর ফোন করার সময় পায় না। আজকাল মিডিয়াতেও মুখর সে। নির্বাচন কমিশনের গঠনকে চ্যালেঞ্জ করে এক বামদলীয় নেতা হাইকোর্টে রিট করেছেন। ব্যারিস্টার ইমরান লড়ছে সেই মামলা। জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা তার, তাতে সরকার সন্ত্রস্ত। আইনমন্ত্রীর আক্কেলগুড়ুম। আর মিডিয়া সরগরম।
তানিয়ার কি ইচ্ছা হয় না এই প্রাণবন্ত, সফল মানুষটির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উৎসাহ দেয়, তার নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে তাকে সাহায্য করে?
দুপুর ১২:৩০
রান্নার দুই-তৃতীয়াংশ শেষ। এবার একটু ডাল-চচ্চড়ি রাঁধব। হেলালের আবার ডাল-চচ্চড়ি ছাড়া খাওয়া হয় না। হেলাল ফিরবে দেড়টায়। তারপর খাবে। তারপর খাবার টেবিলে বসেই তার নানা কনজেকচার আর থিয়োরেমের মুণ্ডু উদ্ধার করবে ঘণ্টা দেড়েক। তারপর ঘুমুবে।
ঘুম থেকে উঠে সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ হাঁটবে, তারপর ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দেবে, তাস খেলবে। ফিরবে রাত নটায়। তারপর ঘণ্টাখানেক আবার পড়াশোনা, খাতা দেখা। তারপর কিছুক্ষণ টিভি দেখা। খবর শোনা। খবর দেখার অভ্যাসটাও তার অদ্ভুত। পুরুষ পাঠক থাকলে সে মোটেও দেখবে না। সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি যে-চ্যানেলে খবর পড়বে, সে-চ্যানেল থেকে বিজ্ঞাপন বিরতিতেও সে বেরোবে না। ‘মাইয়াটা কী সুন্দর শাড়ি পরছে, দেখছ? আর ফিগারটা কী টাইট।’ বলে হো হো করে হাসবে। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলবে। ‘অফ কোর্স তোমার মতো না। কী কও?’
প্রায় রাতেই চ্যানেলের সংবাদ-পাঠিকাদের সামনেই সে আমাকে টেনে ধরে ব্লাউজের বোতাম খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। আর আমি কেমন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে লজ্জা পেতে, অথবা রাগ করতেও ভুলে যাই।
হেলালের হাত দুটি এমনিতে রুক্ষ। কিন্তু রাতে মনে হয় কী নরম, যেন শক্ত একটা হাড়ও নেই কোথাও।
ভাগ্য ভালো, খবরটা শেষ হওয়া মাত্র হেলালকে খেতে হয়। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না কোনো রাতেও।
রান্না শেষ হলে আমি গোসলে যাব। ইমরানের কথা মনে পড়বে। মনটা খুব উদাস হয়ে যাবে।
গোসল করতে করতে আমি শুধু ইমরানকে ভাবব। কোনো কোনোদিন নাফিসকে, নাফিস আমার দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই, যদিও বিয়ের আগে সবচেয়ে নিকট সম্পর্ক হয়েছিল তার সঙ্গেই।
আমাকে দুবার জোর করে চুমু খেয়েছে নাফিস, বাধা দিইনি। তবে এর বেশি তাকে এগোতে দিইনি।
এখন এই বাধার কথা ভেবে হাসি পায়। বাবার শেখানো নৈতিকতা। 888sport apk download apk latest version করতেই হয়।
নাফিস বিয়ে করে সুখেই আছে। দুটি ছেলে। আমাকে অবশ্য সে ভুলে যায়নি। মাঝে মধ্যেই ফোন করে। বাসাতেও আসে। বাসায় এলে নিকট সম্পর্কের দাবিটা আদায় করতেও চায়, যেদিন হেলাল বাসায় থাকে না। কিন্তু আমি বাবার মেয়ে, নৈতিকতার প্রতি 888sport apk download apk latest versionবান।
দুপুর ১টা
আমার ফোন পেয়ে অবাক হলো নাফিস, একটু ঘাবড়েও গেল মনে হয়। ‘সব ঠিক আছে তো, তিন্নি, অ্যানি প্রোবল্লেম?’
‘না, কোনো প্রোবল্লেম নেই। তোমাকে মনে পড়ল, তাই ফোন করলাম।’ নাফিস কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিলাম।
বারান্দায় দুপুরের তীব্র রোদ পড়েছে। একটু আগে কুরিয়ারে চিঠি এসেছে। গ্লোবোলিংক টেলিকম 888sport appsে কাজ শুরু করবে। পত্রিকায় এক্সিকিউটিভ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। আমিও আবেদন করেছিলাম। কোনো কারণ ছিল না – চাকরির জন্যে যে-চেষ্টা করছিলাম, তাও নয়। হেলালকেও বলিনি। একটা হুজুগের বসেই অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। হয়তো মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনের প্রস্তাবটা লোভনীয় মনে হয়েছিল।
১২ তারিখ ইন্টারভিউতে ডেকেছে।
বারান্দায় রোদের আঁচ বাঁচিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়লাম। পাঁচতলা দালানের চারতলায় আমাদের ফ্ল্যাট। নিচে একটা ছোটখাটো বাগান। সেই বাগান থেকে একটা প্রজাপতি উঠে এসেছে।
অবাক কাণ্ড, হাতে ধরা চিঠিতে এসে বসেছে প্রজাপতিটা! ফেলতে গিয়েও চিঠিটা তাই ফেলতে পারলাম না।
দুপুর ২:৩০
আজ দুপুরে আমার ঘুম পেয়েছে, কিন্তু হেলাল বিছানায় থাকলে আমার শোয়া হবে না। প্রথম কারণ, দিনে ওর ভীষণ নাক ডাকে। নাক ডাকা তো নয় যেন নাসিকা-গর্জন। দ্বিতীয় কারণ, ও যখন শোয়, লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে তুলে এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় পা দুটি আড়াআড়ি বিছানায় ফেলে রাখে, যেন এক ভয়ানক রোমশ কাঁচি, পাশের
যে-কোনো বস্তু কেটে ফেলার জন্য প্রস্তুত। রাতেও নিশ্চয় এরকম শোয় সে, এবং আমার প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও, লুঙ্গি পরেই, কিন্তু রাতে আলো নেভালে কিছুই চোখে পড়ে না। বিপত্তিটা দিনের বেলাতেই।
হেলাল খাবার টেবিলে বসে লিখছে, অথচ আমি চাইছি হেলাল ঘুমাতে যাক। ও ঘুমিয়ে পড়লে আমি গেস্টরুমের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ব। চারটার মধ্যে আমাকে উঠতে হবে। আজ নাফিস আসবে, আমি নিশ্চিত। ওর জন্য একটু নাস্তা তৈরি করতে হবে। চাকরির ব্যাপারটা নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। নাফিস এলায়েন্স ফোনের বিরাট অফিসার। মাসে বেতন আড়াই লাখ – এরকমই শুনেছি ওর স্ত্রী হাফসার কাছ থেকে।
হেলালকে বললাম, ‘তোমার পোঁয়াকারে মহাশয় ত্রিমাত্রিক ম্যানিফোল্ডের ধারণাটা যেভাবে পাকাপোক্ত করেছিলেন, এবং বলেছিলেন প্রতিটি বদ্ধ, সহজভাবে সংযুক্ত, ত্রিমাত্রিক ম্যানিফোল্ড হচ্ছে এক একটা গোলক, তার থেকে তুমি খুব বাইরে আসতে পারোনি।’
হেলালের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। ‘তুমি এইসব কী কইতাছ?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘তোমার ধারণাগুলো এখনো কাঁচা। বরং প্রফেসর ইয়াওয়ের দুই ছাত্র জি-পিং জু এবং হুয়াই-দং কাও যে-তত্ত্ব দিয়েছে, বিশেষ করে এশিয়ান জার্নাল অফ ম্যাথমেটিকসের জুন ২০০৬ 888sport free betয়, তাতে তোমার আর বিশেষ কিছু করার নেই।’
‘মানে?’
‘মানে হলো, রিচি-ফ্লো নিয়ে হ্যামিলটন-পেরেলম্যানের যে-তত্ত্ব রয়েছে, তার নির্ভুল ব্যাখ্যা তারা দিয়েছে। তাদের 888sport liveের শিরোনামটা খেয়াল করো : এ কমপ্লিট প্রুফ অফ দ্য পোঁয়াকারে অ্যান্ড জিওমেট্রিসাইজেশন কনজেকচারস।’
‘এইসব তুমি কই থাইক্যা পাইলা? কই থাইক্যা জানলা?’
‘কোত্থেকে জানলাম, এ নিয়ে ভেব না। আজ সকালে বাবা তোমার জন্য জার্নালটা পাঠিয়েছিলেন। তোমাকে দেওয়ার আগে আমি পড়ে নিলাম। প্রফেসর মজুমদারের মেয়ে আমি, অংকটা আছে জিনের মধ্যে, আর জার্নালটা তোমার টেবিলে। জু আর কাও তোমার কাজ শেষ করে দিয়েছে। অন্য লাইনে চেষ্টা করো। তবে এখন ওঠো, এখন ঘুমাতে যাও।’
সন্ধ্যা ৬:১৫
তিন্নির বাসায় নক করতেই দরজা খুলে দিলো। দরজা ভেতর থেকে খোলাই ছিল, শুধু পাল্লাটা ভেজানো। পরিপাটি ড্রইং রুমে একটা সোফায় ব্যারিস্টার ইমরান বসে। মনে হলো মাত্রই এসেছে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। আগে থেকেই তাকে চিনি। তিন্নির পাণিপ্রার্থী ছিল একসময়। মন্দ হতো না, তিন্নি রাজি হলে। স্মার্ট ছেলে, সুদর্শন। ছ’ফুটের মতো লম্বা। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। আজকাল টিভি চ্যানেলের খবরে প্রায়ই দেখা যায়। বেশ গুছিয়ে কথা বলে।
পরিচয় যেহেতু আগে থেকেই ছিল, হাই হ্যালো করলাম, ইমরানও করল। আমাদের বসতে বলে রান্নাঘরের দিকে গেল তিন্নি। বললাম ‘লুচি আর ভাজি। আর কফি।’ তিন্নি বলল, ‘তৈরি আছে, জনাব, শুধু ভেজে আনা।’ তারপর বলল, ‘একটা ডিভোর্স প্রসিডিংস শুরু করা যায় কি না, আলাপ করার জন্য ব্যারিস্টার ইমরানকে ডেকেছি।’
তিন্নির কথা শুনে ভালো লাগল। ডিভোর্স প্রসিডিংস! ওর অংকের মাস্টার স্বামীটাকে কোনোদিন পছন্দ হয়নি আমার। তিন্নি আর মাস্টারটাকে পাশাপাশি দেখলে ওই তুলনাটা মনে পড়ে : বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট।
ইমরানের যুক্তি স্পষ্ট। বনিবনা হচ্ছে না, মানসিক অত্যাচার করছে। আর লোকটা যে কী বিচ্ছিরি রকম ব্যবহার করে তিন্নির সঙ্গে, সে তো আমিও দেখেছি।
‘আর ইদানীং এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করছে ব্রুটটা’, ইমরান বলল, প্রেমের কথা শুনে নড়েচড়ে বসলাম। ‘হ্যাঁ প্রেম করছে। তাদের একসঙ্গে বসুন্ধরা সিটিতে দেখা গেছে। ভূত-এ একসঙ্গে লাঞ্চ করেছে দু’দিন।’
ইমরান একজন টিকটিকি লাগিয়েছে অংকের মাস্টার আর মেয়েটার পেছনে। তাকে খুব উৎসাহী মনে হচ্ছে। বেচারা। হয়তো এটাই তার শেষ সুযোগ।
আমি একটু চিন্তায় ছিলাম তিন্নির ফোন পেয়ে। কতদিন হয় তিন্নি ফোন করে না। তাকে দেখলে মনে হয়, যেন একটা গুটিপোকা। চিরতরে নিজের ভিতরে গুটিয়ে আছে।
ইমরানকে বসতে বলে আমি রান্নাঘরে গেলাম। কড়াইতে লুচি ফেলে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে তিন্নি। জানালার বাইরে গাছগাছালি। একটু দূরে ছেলেদের হল। কী দেখছে তিন্নি?
রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরলাম আমি, কিন্তু আমার হাত ছাড়িয়ে সরে গিয়ে সে বাতিটা জ্বালাল। তারপর কড়াই থেকে লুচি তুলে প্লেটে নিয়ে বলল, ‘চল, খাবে।’
তার চোখে জল।
রাত ৯:৩০
পাপিয়ার ফোন এলো, ‘হ্যালো আমি পাপিয়া। স্যারকে দিন।’
আমি বললাম, ‘তোমার স্যার এখন পোঁয়াকারেতে আছে। এখন ফোন ধরবে না, আমাকে বলেছে।’ তারপর ফোন রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর হেলালের মোবাইল ফোন বাজল। ফোনটা খাওয়ার টেবিলে। কয়েকবার বাজার পরও সে ধরল না।
আজ তিন্নির মন খারাপের দিন।
হেলাল রাতের খবর দেখতে ভুলে গেল। এমনকি খবর শেষে খেতে বসতেও ভুলে গেল। আমি ডেকে আনলাম।
বেচারা। পোঁয়াকারে তাকে বিপর্যস্ত করেছে। না, পোঁয়াকারে নয়, করেছে জু এবং কাও। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে দিয়েছে। ঠিক ওদের লাইনেই এগোচ্ছিল সে। আমাকে বলেছিল, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ফিল্ডস মেডেলটা একদিন সে-ই পাবে। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত এটি পাওয়া যায়। এখন তার বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ। গ্রেগরি পেরেলম্যান পেয়েও নিতে চাননি, কিন্তু সে পেলে অবশ্যই নেবে। নিয়ে এক বছর গলায় ঝুলিয়ে রাখবে।
আজ অল্পই খেল হেলাল। জু এবং কাও তাকে আজ প্রায় উপোস রাখবে।
হেলালের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এতদিনে তার আস্থা আর অহমিকার দুর্গে একটা বড় ফাটল ধরেছে।
খাওয়া শেষ করে হেলাল পড়ার টেবিলে বসল। আমি বসলাম টনি মরিসনের বিলাভেড নিয়ে। কঠিন 888sport alternative link, কিন্তু পড়তে আজ ভারী আনন্দ হচ্ছে।
রাত ১২:৩০
আমি শুয়ে পড়েছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। ইমরানের কথা মনে হচ্ছে, তার উদ্বেগ আর উচ্ছ্বাসের কথা মনে পড়ছে। নাফিসের এক মুহূর্ত বাতি নেভানো অন্ধকারের কথা মনে পড়ছে।
একটু খসখস শব্দ, বিছানার পাশে। প্রফেসর হেলাল মিয়া শুতে এসেছে। অন্যদিন বেশ সাড়াশব্দ হয়। বাথরুমে দাঁত মাজে, সশব্দ কুলি করে। এজন্য ও শুয়ে পড়লে আমি বিছানায় আসি। ওর বিছানায় যাওয়ার সময় বারোটা। আজ দেরি হচ্ছে দেখে আমিই শুয়ে পড়েছি।
অন্যদিন কথা বলে হেলাল। ‘দুলতাছ ক্যান? এমুন সেন্ট মাখছ ক্যান?’ ইত্যাদি। আজ সে চুপচাপ।
জু আর কাও তার মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে।
কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করল হেলাল। তারপর আমার পিঠে হাত রাখল। ‘তুমি আইজ আমারে আচ্চর্য করলা’ – সে বলল। ‘এমন কঠিন বিষয়টা এত তাড়াতাড়ি বুইজ্যা ফেললা। অবাক।’
সরল স্বীকারোক্তি। একটা কথাও বানানো নয়, অতিরঞ্জিত নয়।
হেলালের হাত আমার পিঠ থেকে যাত্রা শুরু করল। পিঠের ওপর যত মাঠ, যত রাস্তাঘাট, অলিগলি সব তার ঘোরা হলো। তারপর জোরে আমাকে আকর্ষণ করল, আমাকে উলটে দিলো। এখন আমার পিঠ দেয়ালের দিকে, মুখটা তার দিকে।
তার হাত এবার আমার বুকের পাহাড়-পর্বত মাঠঘাট ঘুরতে ব্যস্ত হলো।
আমি টের পেলাম, আজ হেলালের হাতদুটি বেশি তীব্র, অদম্য। আমার ব্লাউজে টান পড়ল, শাড়িতেও। কয়েকটা মিনিট মাত্র। তারপর মার্সেল দুশাম্পের সিঁড়ি বেয়ে নামা নগ্নিকার মতো অদৃশ্য এবং বিমূর্ত একটি শরীর ধরে আমি বিছানায় পড়ে থাকলাম।
এখন প্রফেসর হেলাল মিয়া আমাকে নিয়ে খেলবে। এবং আমিও, অবাক হবার কথাই, যদিও এই একটা সময়ে আমি অবাক হই না, সেই খেলায় ঢুকে পড়ব। শুরুতে সে-ই খেলবে দাপটের সঙ্গে, কিন্তু শিগগিরই আমিও খেলতে শুরু করব। ও এক দান দিলে আমি এক দান। ও লুকিয়ে গেলে আমি খুঁজব, আমি লুকালে সে। ও একটা গোল দিলে আমি একটা গোল দেব।
আমাদের শরীর ঘনিষ্ঠ হতে হতে অভিন্ন একটি জৈবিক সত্তায় রূপ নেবে। ত্রিমাত্রিক ম্যানিফোল্ডে। একটি গোলকে। আমরা সিম্পলি কানেক্টেড একটি জ্যামিতিতে পরিণত হবো।
ডাক্তার আমাকে বলেছে আমি সন্তান ধারণে অপারগ, সোজা বাংলায় বাঁজা। কিন্তু আজ রাতে যে-কোনো রাতেই বস্তুত – আমার শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তীব্রতা ডাক্তার অনুভব করতে পারবে না। এই বিদ্যুৎ আমাকে গোঁড়াসুদ্ধো কাঁপিয়ে দেয়, দুলিয়ে দেয় এবং একটা বিশাল শিহরণের স্রোত অনেকক্ষণ ধরে বইয়ে দেয় শরীরের শিরায় শিরায়।
এটি পরিমাপ করার মতো যন্ত্র ডাক্তারের নেই।
অবাক, ইমরান অথবা নাফিসের পরও, পাপিয়ার টেলিফোনের পরও, এই মুহূর্তটির জন্য কি আমি জেগে থাকি? বসে থাকি? তাকিয়ে থাকি? য়
তৃতীয় বর্ষ, একাদশ 888sport free bet, অগ্রহায়ণ ১৪১৩, ডিসেম্বর ২০০৬


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.