তোমার গাঢ় কোমল মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বরে
আরেকবার উচ্চারণ করো সেই মন্ত্র
অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দাও সেই সব পবিত্রস্থান
যেখানে মনুষ্যজীবন জন্ম নিয়েছে বুনো আগাছার মতো
কর্মিষ্ঠ কৃষক শস্যক্ষেত্রে
সোনালী ধান্যের মঞ্জরীতে ফলবান করেছে জীবন স্বপ্ন
এবং কানে কানে বলো
এইখানে তোমার জন্ম, এইখানে তোমার বিলয়
এই তোমার পৃথিবী, এই তোমার স্বর্গ।
– ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’, আহমেদ ছফা
সুলতান ১৯৪১-এ কলকাতা আর্ট কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন। ১৯৪৩-এ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর আর্ট কলেজে পড়বেন না। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ নয়, সুলতানের ভালো লাগত না রুটিনমাফিক 888sport live chatচর্চা। ১৯৪৬-এ সিমলায় প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। তারপর ১৯৫০-এ আমেরিকায়, লন্ডনে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৯৫৩ সালে সোজা নড়াইলে। দেশে ফিরে তিনি কোনো প্রদর্শনী করেননি। ১৯৭৬-এ এসে তিনি 888sport apps 888sport live chatকলা একাডেমিতে প্রদর্শনী করেন। সে-সময়ের প্রদর্শনীর কাজ নিয়ে নিজের বয়ানে বলেন – ‘আমি সবসময় কৃষকদের এঁকেছি, মানুষকে বড় করে দেখেছি, কৃষকরা যুগ যুগ ধরে অমানবিক পরিশ্রম করে চলেছে। ওদের উপজীব্য করেই সমাজটা গড়ে উঠেছে।’ অদম্য কৃষকের গায়ের পেশি সবসময়ই উদ্ধত দেখায়। পেশিবহুল
888sport promo code-পুরুষ সুলতানের ছবিতে বারবার ফিরে আসে। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন সুলতানের বোহেমিয়ান জীবনের সঙ্গী হয়েছিলেন দীর্ঘ এক দশক। এসএম সুলতানের সঙ্গে নাসির আলী মামুনের প্রথম পরিচয় 888sport appয় ১৯৭৬ সালে। প্রথম নড়াইলে যান ১৯৭৮ সালে। আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নাসির আলী মামুন সুলতানের সঙ্গে থাকা সময় প্রসঙ্গে বলেন – ‘আমি ’৭৮-এ নড়াইলে যাইয়া দেখলাম, এক অন্যরকম দুনিয়া। এই যে এতদিন আমি ছবি তুলতে ছিলাম 888sport appয়, রাজধানীতে বিখ্যাত মানুষদের উপরে, তারা তো সবাই হইলো নাগরিক মানুষ, আধুনিক মানুষ। সুলতানকে দেখলাম যে, তার ঘরের মধ্যে ঢুকলে মনে হবে, দুইশ বছর আগে কোথাও চইলা আসছি। কারণ বাড়ির মধ্যে কোন বিদ্যুৎ নাই আর এই দুইশ-আড়াইশ বছরের পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি নড়াইলে। কোন সাপস্নাইয়ের পানি নাই, ইলেকট্রিসিটি নাই। দরজা জানালাও নাই। এইগুলো সব একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় – সব লুট-পাট হইয়া গেছে। বাড়ি শ্যাওলা পরা এবং সব আস্তর খসানো এবং ছাদগুলো ঢেউ ঢেউ, ফ্লোরও ঢেউ ঢেউ কোথাও ভাইঙ্গা গেছে – ই হইয়া পড়ে চুন খইসা পড়ে।’ সুলতানের এই অদ্ভুদ দুনিয়ার সঙ্গে নাসির আলী মামুন খাপ খাওয়াতে পারেননি। তবু ছবি তোলার লোভে তিনি সুলতানের পিছু ছাড়েননি। সুলতানকে যে-ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটি খুব সহজে তিনি পোজ দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। খুব কষ্ট সহ্য করে দিনের পর দিন সুলতানের সেই ভাঙা-জরাজীর্ণ ভবনে বাস করে তার জীবনের নানা মুহূর্তকে ক্যামেরায় ধারণ করেছেন মামুন। এবারের প্রদর্শনীর সাতাশটি আলোকচিত্রকে তিনি বেছে নিয়েছেন সুলতানের হাজারো ছবির মাঝ থেকে। মুনেম ওয়াসিফের সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে নাসির আলী মামুন আরো বলেন – ‘আলোছায়ার প্রতি আমার এক ধরনের নেশা ছিল … সূর্যের আলো ছিনতাই কইরা আইনা সেটারে কুল কইর্যা, লো কইরা, ছায়া বানাইয়া ঐ আলো মুখে ফালাইয়া, সুন্দর সুন্দর বাক্য রচনা করা, সেইটাই এসএম সুলতানের সময় আমি করতে পারছি। কারণ দেখলাম যে, ফাটা ওয়াল, ভাঙ্গাচুড়া এবং আধুনিক মানুষের ঘরে যেসব জিনিসপত্র থাকে র্যাক, টেবিল, চেয়ার, আলনা, খাট কিচ্ছু নাই ঐখানে, ঐগুলা নাই, অন্যরকম জিনিস এবং সুলতান যে পোজ দিছে তাও না, ঐরকমই ছিল, বিড়ালগুলিও ঐরকমই কোলে উঠছিল। সুলতানের মাছিমদিয়া গ্রামে গেলে রেমব্রান্টের দুনিয়ায় উপস্থিত হইতাম আমি।’
সুলতানের ছবি তুলতে গিয়ে মামুন শত শত নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। বিড়াল নিয়ে এসএম সুলতানের তোলা অনেক ছবি একই রকম হয়েছিল। কারণ সুলতানের চেহারা আর পোশাক একই রকম ছিল। সুলতান পোশাক পরিবর্তন করতেন না, একেক ছবিতে একেক রকম পোশাক দেখা যায় না। চুল একই রকম, পোশাকও একই রকম। সুলতানের ছবির রিপিটেশন থেকে মামুন কখনো বের হতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে রাতদিন ক্যামেরা নিয়ে থাকার কারণে দুর্লভ মুহূর্তগুলো নিয়ে সঠিক চেহারার সুলতানের ধ্রম্নপদী ইতিহাস রচনা করতে সমর্থ হয়েছেন নাসির আলী মামুন।
সুলতানের ছবি তোলার সময় তিনি দীর্ঘদিন একাধারে নড়াইলে ছিলেন তা নয়। আট-নয় দিন, দশদিন তিনি এভাবে থাকতেন। মুনেম ওয়াসিফের সঙ্গে আলাপে মামুন বলেন – ‘সুলতানের ঐ বাড়ির মধ্যেই আমি থাকতাম। ফ্লোরে ঘুমাইতাম মাদুরের মধ্যে। বিছানা-বালিশ কিচ্ছু ছিল না। এবং প্যান্ট-শার্ট, জুতা-মোজা পইরা শুইতাম। শীতের দিনে যাইতাম বেশির ভাগ সময়ে। ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে। ঐ শীতের মধ্যে জুতা-টুতা পইরা ঘুমাইয়া থাকতাম। এবং যেইখানে আমারে ঘুমাইতে দিত ঐ ঘরটার মধ্যে র্যাক ছিল কতগুলা। র্যাকের মধ্যে তো বই থাকে মানুষের বাড়িতে, সুন্দর সুন্দর শোপিস থাকে। সুলতানের র্যাকের মধ্যে বেজী, বনবিড়াল, বনমোরগ, তারপরে সাপ, এই নানা ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত জন্তু ভিতরে আটকানো থাকত। সারারাত ওরা ডাকত, আওয়াজ করত, একেকজনের একেক বিচিত্র আওয়াজ।’
এরকম এক ভীতিকর পরিস্থিতিতে মামুন কাজ করে গেছেন। তাঁর মাঝেমধ্যে মনে হতো – কখন যে সুলতান নাসির আলী মামুনকে খুন করে ফেলেন, যার জন্যে মামুন রাতে ঘুমাতেন না। অদ্ভুত জীবনযাপনের সঙ্গে মামুন যুক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে মনে করতেন একটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক মানুষ রাতের অন্ধকারে কক্ষি ঢুকছেন। আগাথা ক্রিস্টির সেই রহস্যময় live chat 888sportের মতো।
এবারের প্রদর্শনীর সাতাশটি ছবির সবকটি ছবি ওই সময়ের, অর্থাৎ ১৯৭৮ থেকে তোলা।
পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির মধ্যে বলা যায় মুখচ্ছবিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষটির কর্ম সেখানে গৌণ হয়ে যায়। মামুনের তোলা সুলতানের ছবিগুলো আমাদের অন্য কথা বলে দেয়। যেমন : ‘দ্য ম্যাজিক্যাল হ্যান্ড’ – ১৯৭৭ সালে সুলতানের হাতে বেশ কয়েকটি ছবি আঁকার তুলি। হাতের পেশি বলে দিচ্ছে এটি সুলতানের হাত। এখানে সুলতানের মুখচ্ছবি নেই। পুরোদস্ত্তর আর্ট অব ফটোগ্রাফি বললে এ-ছবিগুলোকে যথার্থই বলা হয়।
ছবিতে আলোছায়া, সাদাকালোর অপূর্ব বিন্যাস এক ধ্যানী সুলতানকে আমাদের সামনে হাজির করে। ১৯৮০ সালে তোলা ‘ন্যাচার অ্যান্ড ক্যানভাস’ ছবিতে সুলতান দীর্ঘ ক্যানভাসের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। পুরো উঠোনে গাছের ফাঁকে আলো ছিটকে পড়ছে।
নাসির আলী মামুনের ছবিতে সুলতানের জীবনঘনিষ্ঠ পরিবেশ, দৈনন্দিন জীবনের মুহূর্তগুলোও দেখা যায় আলোছায়ার বৈপরীত্যে। সুবিন্যস্ত আলোর ছায়া দেখেই তিনি আলোকচিত্রগুলো তুলেছেন।
নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামের যে-বাড়িতে সুলতান থাকতেন, তার বাইরে চর দখল ছবিটির আলোকচিত্রে দেখা যায় – গাছগাছালিঘেরা দোতলা আধানির্মিত বাড়ির সামনে ইজেলে ছবিটি রাখা। ক্যানভাসের কোনো কোনো জায়গা পোকা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
‘দ্য বোহেমিয়ানস শেল্টার’ ছবিতে বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে সুলতান কালো আলখাল্লা পরা অবস্থায় দাঁড়ানো। ছবিটি দেখে মনে হয় – ছবির পেছনে ঘরবাড়ি, গাছপালা, স্থাপনার সঙ্গে সুলতান একাকার হয়ে আছেন। এ-বাড়ি দেখে এও মনে হতে পারে, এটি তৈরি করা হয়েছে শুধু সুলতানেরই জন্যে। ১৯৭৯ সালে তোলা ‘এমব্রেসিং ব্যাটল অ্যান্ড সোনা’ ছবিতে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকা সুলতানের কোলে দুটি বিড়ালছানা। সুলতানের মুখে হাসি, ক্যামেরার আলো বিড়াল আর সুলতানের মুখে ঠিকরে পড়েছে।
১৯৮০ সালে তোলা মামুনের ছবি ‘দ্য ডিপার্চার’ – এতে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছেন প্রিয় সুলতান। গাছগাছালিতে ভরা ছায়া888sport app নড়াইলের বাড়িতে সকালের উজ্জ্বল রোদ এসে উঠোনে পড়েছে।
নাসির আলী মামুনের প্রিয় 888sport live chatী সুলতান। বোহেমিয়ান ও অগোছালো এই 888sport live chatীর জীবনঘনিষ্ঠ মুহূর্ত, প্রতিকৃতি, ঘরে-বাইরে ব্যস্ত সুলতানকে ক্যামেরাবন্দি করতে সময় লেগেছে প্রায় দশ বছর। এ-প্রদর্শনীতে রাখা বাছাই করা কাজগুলো সেটি সাক্ষ্য দেয়। তাই তো এতসব কাজের ভিড়ে সুলতান মামুন সম্পর্কে বলেন – Nobody, none will be able to capture me at the moment of my going away except Nasir Ali Mamum.
It is he and he alone who will hold me still in his camera.
মাটির সঙ্গে যুদ্ধ করা কৃষকের শরীরে যে-শক্তি সুলতান নির্মাণ করেন আমাদের জন্যে, তেমনি মৃত্তিকালগ্ন888sport live chatী সুলতানকে ক্যামেরায় তুলে আনেন নাসির আলী মামুন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্যে। এ-প্রদর্শনীর ছবিগুলো আমাদের এমন বার্তাই দিয়ে যায়।
রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গত ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ৫ অক্টোবর।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.