স্বাতী গুহ
‘মহানদী ভারতের অন্যতম দীর্ঘ ও বৃহৎ একটি নদী।’ 888sport alternative linkের পূর্ববৃত্ত শুরু হয় এই অনতিদীর্ঘ বাক্যটি দিয়ে। যেন শুরুতেই ইশারা মিলে যায় দীর্ঘ একটি জীবনের কথা বয়ন করতে চলেছেন লেখক। ঠিক তাই, পরের অনুচ্ছেদেই হাতে-হাতে প্রমাণ মেলে – ‘যেহেতু নদীর ভৌগোলিক পট বদলায় আর মানুষ স্থির থাকে…’। এ-888sport alternative link সেই চলনশীল জঙ্গম সত্তার আখ্যান। পাঠক হয়তো তার পূর্বাভিজ্ঞতাকে কিছুটা উসকে নেওয়ার কথা ভাবেন। তিস্তা, গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী বাংলা ভাষা888sport live footballের পাঠকের কাছে বড় পরিচিত নাম। জীবনের নানা স্তর, জটিলতা আর সেখান থেকে এক বৃহত্তর জীবনানুভূতির দিকে যাত্রা করেছেন সচেতন পাঠক ইতোমধ্যেই। তবে এ-888sport alternative link কী দেবে তাঁকে! যে-নদীর যাত্রাপথে কোথাও পর্বতম–ত মালভূমি, কোথাও নিবিড় অরণ্য, কোথাও জনপদ আর কোথাও জনমানবহীন শূন্যতা। ছত্তিশগড়ের ধমত্রি জেলার সিহাওয়া পর্বতের পাদদেশ এ-নদীর উৎসস্থল। তারপর সে ঢুকে পড়েছে ওড়িশায়। সম্বলপুর, টিকরপাড়া, নয়াগড়, কটক হয়ে জগৎসিংহপুরের কাছে বঙ্গোপসাগর। শুধু নদীর গতিপ্রকৃতি নয়, মুখ্য হয়ে উঠেছে মানুষ। যে-মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই নদীর সঙ্গে জুড়ে আছে। তীক্ষনধী সমাজ888sport apkীর মতো লেখক লক্ষ করেছেন সেই জীবনপ্রবাহকে। তাই এ-888sport alternative linkের মাত্রা অনেকটাই আলাদা হয়ে গেছে অন্য নদী-আখ্যান থেকে। পাঠক ক্রমশ টের পাবেন, নদীর চলনের মতোই এক গূঢ়জীবন থেকে উন্মুক্ত বিসত্মৃত জীবনের ছবির উন্মোচন। শুধু ছবি নয়, তার প্রাণও যেন পুরনো পৃথিবী থেকে একটু-একটু করে গড়িয়ে পড়তে থাকে আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীর দিকে।
বারোটি পর্ব আর উপসংহার নিয়ে যে-আখ্যান গড়ে ওঠে তার প্রথম পর্বের নাম – ‘বৈদরাজ’। নিওলিথিক মানুষের জীবনযাপনের ক্ষয়ে-আসা চিহ্ন ধারণ করেও মাথা উঁচু করে উপস্থিত তুলারাম ধুরু কিংবা তার স্ত্রী পুনরি। গোঁড় জাতির জনাচলিস্নশ মানুষ এখনো আছেন, যাঁরা জঙ্গলের ঔষধির গুণাগুণ জানেন। এঁরা বৈদ্য। এই আদি পৃথিবীর খবর পৌঁছয় একালেও। তাই অবধূত সিংহ বৈদরাজ তুলারামকে রাজিমে নিয়ে যেতে আসে। ছত্তিশগড় নতুন রাজ্য হয়েছে। অঙ্গনবাড়ি, তিন টাকা কিলো চাল, সর্বশিক্ষা মিশন – এসব সত্যি আজাদির ছবি স্পষ্ট। গোঁড়রা এখন দূরগ্রামে কাজে যায় না। মানে মাইগ্রেশন কমেছে; কিন্তু মদ নিয়ে অশান্তি বেড়েছে। তবু তুলারাম গোঁড় একটি সোনার খনি। ‘যে মানুষের মধ্যে শত শত বছরের জ্ঞান, আনন্দ, ইতিহাস পাললিক শিলার মতো চুপ করে বসে আছে।’ লক্ষ করার বিষয় হলো, সুজনকুমারের বর্তমানে এই পুরনো পৃথিবীর আস্বাদ এসে পৌঁছানো। কারণ ব্যথাহীন নিরাময় যেন সম্ভব নয় অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসার হাসপাতালে। তার জন্য বন আর বানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকা জরুরি। সেই পরিচয়কেই ঝালিয়ে নিতে কুঠেরপালি গ্রাম থেকে হিমিরানির ছেলে কুবের এসে পৌঁছেছিল জুজুমারা পঞ্চায়েতের নুয়াবলন্ডা গ্রামে, যেখানে পুনর্বাসিত হয়েছিল তার মায়ের মহুল সই মালতী। দ্বিতীয় পর্বটি ঐতিহাসিক হীরাকুঁদ জলাধার গড়ে ওঠার অন্তর্গত জীবনকথা যেন। কিন্তু তেমন শোরগোল, হইচই নেই। আছে খুব পুরনো একটা সাদা-কালো ডকুমেন্টারির মতো ছবিগুলোর সামনে এসে পড়া। মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার দলিল যেন কুঠেরপালিতে এসে হাতে-হাতে কিংবা চোখের নাগালে এসে পড়ে কুবেরের। কীভাবে অথই জলের ধু-ধু অন্তরাল এসে পড়ে হিমিরানি আর মালতীর জোড়ের মধ্যিখানে – মানুষের বুক ভেঙে যাওয়ার সে-গল্প, উদ্বাস্তু হয়ে আতান্তরে পড়ার কাহিনি পাঠককে ভাবাবেই ভাবাবে। এ তো দেশভাগ নয়। রাজনৈতিক কাটাছেঁড়াও নয়। তবু স্বাধীন দেশের প্রকল্প, পরিকল্পনা কীভাবে মানুষের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তা যেন আজকের পৃথিবীতে বসে জেনে নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়ে। উন্নয়ন আসলে কার? কীভাবে? এ-ধরনের প্রশ্নগুলো তীক্ষন-ধারাল হয়ে চারিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ পাঠকের মধ্যেও। কুবেরের ছাত্র অবনীর মত মানবনীতি নিয়ে উসখুস করে উঠবে পাঠকের মাথার ভেতরের কোষ। এ-888sport alternative link তাই ভিন্ন এক মাত্রা সংযোজন করে চলে আমাদের অতিপরিচিত জীবনবয়ানে।
বহুদিন পার হওয়ার পরও কুবের মায়ের মহুল সইয়ের ঘ্রাণ, আদরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাখে তার করতলে। কিন্তু অধ্যাপক সত্যেন্দ্র প্রধানের ছাত্র সুবল কিছুতেই আর গ্রামে ফিরে যেতে পারে না। ভাষার ইতিহাস পড়তে-পড়তে ভূগোল, নৃতত্ত্ব, সমাজের ইতিহাস, অর্থনীতির যে-পাঠ সে পেয়েছিল, বুদ্ধিজীবী সত্য প্রধানের সংসর্গে তাতে সুবল শিখেছিল মনের খোরাকের কথা। নিরন্ন জীবনকে তাই শ্রেয়তর মনে হয়েছিল তার। গণ্ডারাম মাঝি, ঝাড়খন্ডের মেয়ে স্মিতা কুজুর আর সত্য স্যারের সঙ্গে মহানদীর এক অন্যরূপকে আবিষ্কার করতে পারবেন পাঠক সুবলেরই মতো। সুবর্ণপুরের মহানদী যেমন পূর্ণযৌবনা, তেমনি যেন স্মিতা। তাঁর সঙ্গে নিজের স্ত্রী গৌরীর যেন কোনো মিল নেই। অথচ দুজনই আদিবাসী রমণী। কিন্তু দিলিস্নতে অধ্যাপনা করা স্মিতা কুজুরের সঙ্গে কীভাবে এঁটে উঠতে পারে বেকার, দরিদ্র, ভূমিহীন অথচ শিক্ষিত কথাকার বা কবি সুবলের দুই সমত্মানের জননী গৌরী! পাঠক যেন প্রতিটি পদে ফলিত হতে দেখতে পাবেন সমাজ888sport apkের সূত্রগুলোকে। কিন্তু লেখক যেন কোথায় এ-ব্যাপারে তেমন উচ্চরব নন। বরং স্মিতার হাসির সমান্তরাল জলতিতির ডাক তিনিও শোনেন কান পেতে। সত্য প্রধান বা সুবল নন, তিনিও যেন মুগ্ধ স্মিতা কুজুরে। চিন্তিত সাবিত্রী দেশমুখের রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনায়। তন্ত্রসাধনা ও বৌদ্ধধর্মের চর্চা এ-অঞ্চলে অনেক পুরনো। তাই জেলার নাম বৌধ। অথচ পুরনো গান্ধীবাদী সাবিত্রী আততায়ীর লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়া কনস্টেবলটির ছবি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। তাঁর মনে হয় – ‘উদারনীতির যুগের পুঁজি রাষ্ট্রকেই তার বেতনভুক কর্মীতে পরিণত করেছে – ওই ঠায় চুপ দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলটিও জানে – কিছু না করে কেবল দেখাটাই ওর কাজ!’ প্রশাসনের একেবারে ভেতরে তিরিশ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে থেকেও লেখক অনিতা অগ্নিহোত্রী যেন দুঃসাহসিক হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এত তীব্র এবং তীক্ষন সমালোচনায় বিদ্ধ করতে। আসলে ব্যবস্থা তো মানুষের জন্য। সেই মানুষের অবমাননা কোনোভাবেই বরদাশত করতে পারেন না তিনি। তাই সমাজ888sport apkীর বিশেস্নষণী শক্তিতে সমস্ত গল্প, কথা, কাহিনি কিংবা ঘটনাকে দেখতে চান। দেখাতেও চান। মহানদী সেই জীবন পরিক্রমণের আখ্যান, যা শুধু দেখায় না, কারণ বিশেস্নষণের অবকাশ তৈরি করে। হয়তো পাঠকের ওপরও কিছুটা দায়িত্ব বর্তায় – তিনি তাঁর সংশিস্নষ্ট জীবনকে কীভাবে গ্রহণ করবেন কিংবা সংশোধন করবেন। এখানেও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে এ-888sport alternative link। সময়ের জীবন্ত দলিল হয়ে ওঠে তাই এই আখ্যান।
হীরাকুঁদ বাঁধ বাঁধার পর থেকে নদীতে মাছ কমেছে। জলও কমেছে। তাই নৌকো চালানো কিংবা মাছধরা যাদের জীবিকা, তাদের দিন চলে না এখন। নদীর জলে বস্নাস্টিং করে বড় মাছ সহজে ধরে নেওয়ার লোভী চক্র আসলে ছোট মাছদের আকালের কারণে। নীলকণ্ঠরা প্রতিবাদী হয় কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারে না। প্রাকৃতিক সম্পদে মানুষের এখতিয়ার বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ রাষ্ট্র। তাই গণ্ডারামের লগি ঠেকে যায় বালির চড়ায়। তেমনি হঠাৎ-আসা-বন্যায় এ-নদীর জলে এসে পড়ে আমেরিকান রুই। এসব বাস্তব অভাব-অনটনের গল্পের মধ্যেই আশ্চর্য সুতোর বুনটের মতোই ঢুকে পড়ে সীতানাথ ঝরার বউ আরুণি আর নীলকণ্ঠের প্রেমের বিষাক্ত ঝাঁঝ। কাটা জন্তুর মতো ছটফট করতে-করতে লঙ্কেশ্বরীর দহের কুটিল পাকে-পাকে ডুবে যায় নীলকণ্ঠের বিষে জরজর শরীর। গল্প তাই বয়ে চলে টিলাগড় শহরের কাছ দিয়ে বয়ে চলা তেল নদীর ধারাটিকে সঙ্গে নিয়ে। চতুর্থ পর্বটির নাম ‘উপনদী’। ওড়িশার সেরা তাঁত888sport live chatীদের বসত সুবর্ণপুর ও পাশের জেলা বরগড়ে। এরা মেহের সম্প্রদায়ের। আশপাশে অনেক তাঁতি গ্রাম। কিন্তু প্রশিক্ষণের অভাবে দক্ষতা ধরা পড়ে না আর কাজে। সমবায় সমিতিগুলো পরিচালনক্ষমতার অভাবে কিংবা কিছু সম্পন্ন ব্যবসায়ীর লোভে বিপন্ন আজ। এ যেন সমগ্র দেশের স্থানীয় 888sport live chatের গতিপ্রকৃতিকেই এক লহমায় হাজির করা। এরই মধ্যে রমেশের সেকেন্ডহ্যান্ড এস্টিম গাড়ি নিয়ে ছ-মাস পর গ্রামে এসে পৌঁছানোর গল্প চালিয়ে যেতে থাকে। পটচিত্র, দশাবতার তাস, মেয়েদের স্বনির্ভর দল, মল, এক্সক্লুসিভ বাজার, ধর্মঘট, ঠান্ডা পানীয়, বিমা পলিসি - শব্দে সেকাল-একালের ঝাঁকিদর্শন পাঠককে ত্রস্ত করে রাখবে সারাটা সময়। কোথাও স্থির হতে দেবে না। নদীর মতোই তা বহমান। কিন্তু শুধু বাইরে থেকে দেখা জলভার মাত্র নয় তা। জলের প্রতিটি বিন্দুর পরতে মিশে থাকা জীবনের ঘূর্ণি পাঠককেও আঁকড়ে ধরবে নিশ্চিত। যেভাবে শিতুলিয়াদের বসত থেকে উড়ন্ত আগুনের ফুলকি এসে ধাওয়া করে রমেশের ছুটন্ত গাড়ির গতিকে। শিতুলিয়ারা ভ্রাম্যমাণ আদিবাসী। ধাতু888sport live chatী। বলঙ্গির, শোনপুর, কালাহান্ডি, নুয়াপাড়ার এসব 888sport live chatী আর কারিগরের সংগঠন ‘পৃথিবী’। ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিএ করা কলকাতার ছেলে দেবব্রত শিতুলিয়াদের নিয়ে মেতে ওঠে বাঁধাধরা ছকের জীবনের বাইরে এসে। মানুষের অবর্ণনীয় দারিদ্র্য, ব্যর্থতা আর অসহায়তা তাকে যেন প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে চায়। অথচ এরই মধ্যে বেঁচে থাকে ওদের নানা পরবের গান আর ঢোলকের বাদ্য। দেবব্রত লক্ষ করেন, নিজেদের 888sport live chatকে বাঁচানোর আশ্চর্য তাগিদ। ঝড়জলে নিজেরা ভিজেও তাই তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের হাতের কাজটুকুকে ভিজতে না দিতে। তাই বারবার সমস্ত ব্যর্থতাকে অস্বীকার করে ফিরে যায় সে শিতুলিয়াদেরই কাছে। পাঠকের শরীরে, মজ্জায়ও যেন একটা অনুভূতি চালিয়ে যেতে থাকে দেশ আর হাজার কিসিমের মানুষের অসিত্মত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার বা সম্মান প্রদর্শন করার। ভালোবাসতে শেখার এক পাঠও যেন এই 888sport alternative link।
পঞ্চম পর্বের নাম ‘প্রত্নবিষাদ’। কনস্টেবল শম্ভু মহাকুঁদ, ঠিকাদার বিশু নায়েক – এরা একালের মানুষ। জাগতি স্কুলের হেডমাস্টার হারাধন ছুটির দিনে পুরনো জিনিসের খোঁজে বেরোয় আর তা নিয়ে লেখালেখি করে বলে পাগলামাস্টার নামে পরিচিত। লতা নায়েকের সম্বলপুরী শাড়ির তিনটি পাড়। লেখকের বর্ণনায় সেই পাড়ের কারুকাজের ফুল, মিনের নকশা, হাতি, ঘোড়া, কচ্ছপ, টিয়েপাখি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জানা যায়, ঝন্টানুয়া বা নুয়াখাইতে পরবের কথা। শম্ভু মহাকুঁদের ধনুযাত্রার দল নতুন পৃথিবীর মধ্যেও টানটান ধরে রাখে কংসবধের পালা। প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত তুচ্ছতাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে চলে আজো মানুষ তার অভিনয়ের ক্ষমতায়। এ যেন কোনো শম্ভুমাত্র নয়। পৃথিবীর যে-কোনো দেশে, যে-কোনো কালে এ-ঘটনা ঘটে চলে কিংবা চলেছে আজো। বাস্তব আর অবাস্তব মিলেমিশে এভাবেই তৈরি হয় প্রতিদিনের ম্যাজিক রিয়েলিটি বা জাদুবাস্তবতা। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় বুদ্ধমূর্তি কিংবা সংস্কৃতির যে বিসত্মৃত পরিচয় উন্মোচিত হয়েছিল কিংবা হারাধন মাস্টারের সন্ধানে যে-জীবনের গালগল্প উঠে আসে তাকে আরো কিছুটা দ্রম্নততর পৃথিবীর সামনে এনে ফেলে রঙ্গ আর পুতুলের কাহিনি। সাতকোশিয়া অভয়ারণ্যের পথ ধরে তারা ন্যাশনাল হাইওয়ে ছাড়িয়ে, রঙ্গর স্করপিও গাড়ি রেঞ্জারের অফিস পেরিয়ে বনবাংলোয় এসে পৌঁছায়, যেন সভ্যতার যাতায়াত দ্বিমুখীও হলো। শহর, নগর এসে পৌঁছাল জঙ্গলে, নদীর বাঁকে। দেবব্রতর মতো না হলেও সম্পর্কের টানাপড়েনটাকে পরখ করার জন্য যেন এমন দূরে, আদি পৃথিবীর কোলে এসে পৌঁছানো প্রয়োজন ছিল। পুতুলের পোশাকি নাম সুমনা। কিংবা সে যে পুতুলমাত্র নয়, তাও কি লেখক ইশারায় বলতে চেয়েছেন। যতক্ষণ পুতুল সে, ততক্ষণ সে রঙ্গর সঙ্গী। যখন সে সুমনা অর্থাৎ বিশেস্নষণ ক্ষমতার অধিকারিণী, স্বাভিমানী তখন সে আর পুতুল নয়। তাই তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে রঙ্গ সেই জঙ্গলে একা-একা। হরমু জানি কন্ধ আদিবাসী। যে রঙ্গনাথন আর সুমনাকে জঙ্গলের মানুষের জীবন দেখায়। ওদের সঙ্গে পাঠকও জানতে পারেন জঙ্গলের জমি যারা চাষ করে তাদের পাট্টা নেই। বনের প্রাণীর রক্ষার জন্য আইন আছে কিন্তু মানুষের পেটের খিদে মেটানোর জন্য কোনো আইন নেই। তবু এরা গ্রাম ছাড়তে নারাজ। কেমন যেন নাছোড় মনে হয় এই মানুষগুলোকে। আবার ক্লান্ত সম্পর্ক নিয়ে রঙ্গর বিলাপ কিংবা সুমনাকে নিয়ে সত্যি-সত্যি টানাপড়েন খুব যত্নের সঙ্গে বর্ণনা করেন লেখক। সীতা আর তার প্রেমিকের কুমির হয়ে যাওয়ার গল্প শুনতে-শুনতে সুমনা ভাবতে থাকে, এই প্রাচীন ভালবাসাবাসির গল্পের সঙ্গে তার জীবনের কোনো যোগ আছে কিনা। নিজেকেও যেন একবার সম্পূর্ণ দেখার জন্য এই বনভূমিতে এসে পড়া একান্তই জরুরি ছিল। সেখানেই সে শুনেছিল পাতাঝরার অস্ফুট শব্দ। টের পেয়েছিল মানুষ মাত্রেই সম্পূর্ণ একা। তাই মানুষ একটা অভ্যাসে বেঁচে থাকে। যেমন - ‘হরমুর গ্রামের লোকজন খেতে না পেয়ে হাড় হয়ে মাটিতে মিশে যাবে, তবু গ্রাম ছাড়বে না…’; কিন্তু লেখক তো কিছুতেই এই শূন্যতার বোধে আটকে থাকতে পারেন না। তাই হরমু জানির কল্পনার পৃথিবীটাকেই তাঁর আসল সত্য আরো রঙিন বলে মনে হয়। সুমনার মতো তিনিও হয়তো বিশ্বাস ধরে রাখতে চান, তেমন একটা পৃথিবীতে মানুষের জলধ্বনি শুনে আকাশের মেঘের সাড়া দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই পৃথিবীটার সঙ্গে যোগসূত্রটা নতুন করে গড়ে দিতেই কি এই নদীকথা রচনায় হাত দেন তিনি?
গ্রামের নাম কন্টিলো। কাঁসারিদের গ্রাম। মহানদীর জলে সূর্যাস্ত দেখতে ব্রহ্মাদ্রি পাহাড়ে মানুষ আসত দেশ-বিদেশ থেকে; কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এই কঠিন কাজ করতে নারাজ। আশপাশের জেলার ছেলেরাও ভর্তি হয়েছিল পুলিশ আর হোমগার্ডের কাছে। কাঁসারি আশুর ছেলেও গিয়েছিল পুলিশের কাজে। এছাড়া আরেক ধরনের সমান্তরাল রিক্রুটমেন্ট চলছিল এসব গ্রামে-গ্রামান্তরে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা টাকা, খাবার, উর্দির জন্য হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। গ্রামের লোকেরা কীভাবে ‘কো-ল্যাটেরাল ড্যামেজ’ হয়ে ওঠে সে-তথ্য ঢুকিয়ে দিতে চান লেখক একজন সৎ এবং দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে। কোনো ধরনের পক্ষপাতের ধার ধারেন না তিনি। মানুষের সর্বনাশে মানুষই কীভাবে দায়ী তা সরাসরি বলতে চান তিনি। আজকের পৃথিবীর পলিসি মেকিং আর তার ইমপিস্নমেন্টেশনের ফাঁক-ফোকরকে স্পষ্ট করে তুলতে চান যেন শুশ্রূষার রোডম্যাপটাকে নতুন করে গড়ে তুলতেই। আশাবরীর ‘আরণ্যকে’ কাজ করা, ঝঞ্ঝাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার তুমুল চেষ্টা। নাড়ির টান নয়, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাই যে আসল সে-কথা অনিতা অগ্নিহোত্রী নিজেও বিশ্বাস করেন বলেই তাঁর চরিত্ররাও এমন একরোখা অথচ বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। পাঠক বারবার পরিচিত আর অপরিচিতের দ্বন্দ্বে দোলাচল হয়; কিন্তু তাকে অবাস্তব বলে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন না কিছুতেই। এখানেই 888sport alternative link হিসেবে মহানদী খাঁটি হয়ে ওঠে।
অষ্টম পর্ব - ‘অববাহিকা’। কটক জেলায় এসে মহানদীর সমতল যাত্রা আরম্ভ। নদী এখানে এসে বিভাজিত। কাঠজোরী মহানদী তারপর আরো নানা শাখা নদীতে। কাহিনিও তেমন। ইন্দ্রনাথ-বনশ্রী, ইন্দ্রনাথ-তাপসী, ইন্দ্রনাথ-তন্ময় হয়ে জীবনের পরত তুলে ধরেছে। একের সঙ্গে অন্যের যোগ আছে বা নেইও। এরই মধ্যে জাগ্রত ইতিহাস যেন র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল। নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের জীবনের প্রথম সতেরো বছর। কোনার্ক মন্দির চত্বরে আয়োজিত শাস্ত্রীয় নৃত্যের আয়োজন, পুরীর সমুদ্র দর্শনের অভিজ্ঞতা এসব এসেছে স্বাভাবিকভাবে। যেমন এসেছে বন্যা। যার কারণ - বর্ষাচক্রের পরিবর্তন কিংবা পরিবেশ বদলের দাপট। এমনই বৃহত্তর পৃথিবীর গল্প ক্রমশ সেঁধিয়ে গেছে আরো গভীর জড়ে। যেখানে প্রেমিকা তাপসীর অসিত্মত্বের সংকটের দিনে কাছে চলে আসেন ইন্দ্রনাথ। আর সেই তাপসীর ছেলে গ্রিনকার্ড হোল্ডার তন্ময় এসে পৌঁছায় বন্ধ সুতাকল শ্রমিকদের অবস্থার সার্ভের কাজে। এসবই এক-একটা প্রজেক্ট। তাই একটা সময় চলে যেতে হয় তন্ময়কে। অর্থনীতিকে বুঝতে চেয়ে মানবনীতি অনেক বেশি আয়ত্ত করে ফেরে সে। বিদেশ থেকেও তাই এখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে জুড়ে থাকার স্বপ্ন দেখে সে। তখন কার্তিক-পূর্ণিমার বর্তুল চাঁদ যেন আকাশে ভেসে থাকা একটি নিরাবলম্ব ফানুস। কিন্তু খেলার মাঠ থেকে যে-ঘোষণার আওয়াজ কানে এসে ঢোকে তাতে বাড়ি ফেরার কথা। বাড়িতে কোথাও কারো অপেক্ষা করার কথা। তাই ইন্দ্রনাথও যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন তাপসীর অপেক্ষায়। মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষকেই চায়। মহানদীও হয়ে ওঠে চিরন্তন মানুষের আখ্যান।
‘টানি ও ভরণি’র উপমন্যু পাত্র গীতগোবিন্দ ফুটিয়ে তুলেছিলেন সুতোর গ্রন্থিতে দক্ষিণের রেশমে। তাঁর কাছে বয়ন একটি সাধনা। স্ত্রী, সমত্মান, সংসার সবকিছু থেকে দূরে থেকে লালন করতে হয় তার 888sport live chat-চেতনাকে। তাই তার হাতে তৈরি সেই বস্ত্র কোথায় যায়, কত মূল্যে বিকোয় সেসব যেন তোয়াক্কা করেন না উপমন্যু। শুধু একটি কাজ সমাপনের পর যে-স্ত্রীসঙ্গ তা যেন তার পূর্ণতার অনুভবকে সম্মাননা। স্ত্রী মোহনীতে এসে উপমন্যুর যাবতীয় দহনের সমাপ্তি। কিন্তু জীবন যে কত নির্মম, কত নির্লজ্জ তার প্রমাণ কর্ণকুমার ঘোষ। রঙ্গনী বান্ধকার কর্ণের তলানিতে এসে ঠেকা জীবন পৃথিবী জুড়ে হেরে যাওয়া মানুষের গস্নানির প্রতিবিম্ব। আমাদের দেশে বর্তমানকালের হাড়হিম করা সংবাদ যেন। আরো কঠিন অরূপের মতো মানুষের জীবন-জীবিকা। কাজহীন অর্থনীতির নিজস্ব কর্মনাশা রাজনীতিতে কেমনভাবে ডুবতে থাকে মানুষ তার ডকুমেন্ট যেন পেশ করেন লেখক। খুব কাছের ঘোলাটে সময়ের ময়নাতদন্ত যেন এই অংশটি।
এরপর ‘মোহা না’, যেখানে জঙ্গিরার পার্বতী ঘাম ও নুন মেখে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। শুকনো মাছের গন্ধ তার শরীরে, বসনে। তবু ছেলেকে না দেখে কিছুতেই সে ফিরে যাবে না। আর ছেলেও কিছুতেই ফিরে যাবে না। এসবের মধ্যেই সীমান্ত তৈরি করে নতুন ঠিকানা ‘মৃত্তিকা’। পোড়ামাটির কাজের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। ‘বাতিঘর’ – পারাদ্বীপ বন্দর অঞ্চলকে চিহ্নিত করে যেন। সেই সঙ্গে জুড়ে যায় পস্কো আন্দোলন এবং তার বিরোধীগোষ্ঠীর মতান্তর ও মনান্তর। পানচাষিদের জোট হয়ে তৈরি করা অর্থনৈতিক অবরোধের গল্প চারিয়ে যেতে থাকে পাঠকের শিরায়-উপশিরায়। সমস্ত বিপস্নব আর হানাহানির শেষে মানুষের শরীরঘেঁষে যে-ওম তা ভাগ করে নিতে চায় সীমান্ত-পার্বতী। মহানদীও যেন তখন বঙ্গোপসাগরে এসে মেশে। নদীর সবুজ জল সমুদ্রনীলে মিশে যেতে থাকে সীমান্ত ও পার্বতীর শরীরী মিলনের মতোই। তাই নদী কোনো বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক চরিত্রমাত্র নয় এ-888sport alternative linkে। মানুষের ঘাম, নুন, রক্ত, মেধা, প্রেম, তৃষ্ণা, ঈর্ষা, দ্বেষ, প্রতিশোধের কাহিনির প্রেক্ষাপট। কিংবা চালিকাশক্তি জীবন আর জীবিকার।
888sport alternative linkের শুরু মালভূমিতে বসন্ত আসার সংবাদে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বৈশাখের দাহ সবে আরম্ভ হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায় সুবর্ণপুরে মহানদী পূর্ণ-যৌবনা – হেমন্তের শেষে বর্ষার উদ্দাম জলভার আর নেই। এর পরের দুটি অধ্যায়েই হেমন্তকালের কথা। ষষ্ঠ পর্বে মাঘ মাসের কথা। শীত তখনো বিদায় নেয়নি অরণ্য থেকে। সপ্তম অধ্যায়ে আবার গ্রীষ্মকালের কথা। অববাহিকা পর্বে আবার কার্তিক মাস অর্থাৎ হেমন্তকাল। তারপর আবার চৈত্রের কথা। আবার বর্ষার উথালপাতাল জল আর সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার গল্প। এভাবেই ঋতুচক্রের যাওয়া-আসা আর জীবনচক্রের চলন ধারণ করেছে এই 888sport alternative link। সমস্ত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করেও জীবন এখানে কোনো বিশেষ অঞ্চলে আবদ্ধ নয়। আর এখানেই লেখকের সিদ্ধি আর পাঠকের প্রাপ্তি। r


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.