এসো অঘ্রান নবান্নর ঐতিহ্যধারায়

‘নবান্ন’ প্রাচীনবঙ্গের কৃষিভিত্তিক, উৎপাদনভিত্তিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অঘ্রানে তথা গ্রামবাংলার প্রাচীন বর্ষ বিচারে প্রথম মাস অগ্রহায়ণে কৃষকের ঘরে ঘরে নতুন ধান তোলার সময়ক্ষণ হিসেবে উৎপাদন-সংস্কৃতির উৎসব নবান্ন কিছু সময়ের জন্য হলেও কৃষকের মনেপ্রাণে আনন্দের প্রকাশ ঘটায়। আদিম সভ্যতার রীতিমাফিক এতে নৃত্যগীতবাদ্যের আয়োজন না থাকলেও ছিল নতুন চালের গুঁড়োয় পায়েস, পিঠা খাওয়ার উৎসব-অনুষ্ঠানের আনন্দ। এমনকি নতুন চালের ধোঁয়াওঠা ভাতের সুঘ্রাণেই পূর্ণ হতো স্বাদ ও তৃপ্তির ‘অর্ধভোজন’।

অনুমান করা হয়, কৃষিভিত্তিক এ-সংস্কৃতির উৎস সম্ভবত বাঙালি জনগোষ্ঠীর আদি নৃতাত্ত্বিক উপাদান ‘আদি অস্ট্রেলীয়’ প্রোটোঅস্ট্রেলয়েড) নৃগোষ্ঠীর কৃষিজীবী জীবনযাত্রার ধারা, তাদের সাংস্কৃতিক চরিত্র। আর সে-চরিত্রই সম্ভবত গ্রামীণ পূর্ববাংলা কৃষিসংস্কৃতির মূলধারাটিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। অঘ্রাণে যা শুরু পৌষে তার পূর্ণতা।

ইতোমধ্যে দেশে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে সমাজ ও সংস্কৃতির অঙ্গনে। তাতে আদি বঙ্গীয়বর্ষেরও পরিবর্তন, বর্ষ শুরুর মাস হয়ে ওঠে দাবদাহের গ্রীষ্মকালীন মাস বৈশাখ। তবু প্রধান খাদ্য উৎপাদনের মাস অঘ্রান-পৌষের সামান্যই পরিবর্তন ঘটেছে। বিদেশাগত আধুনিকতার প্রভাবের কারণে প্রচলিত আদি-উৎসবগুলো হারিয়ে যেতে থাকে, সে-শূন্যতা পূরণ করে নয়া আনুষ্ঠানিকতা।

এছাড়া সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণও ঐতিহ্য হারানোর পেছনে কাজ করেছে। বিদেশিরাজের হাতে ভূমিব্যবস্থায় সৃষ্ট-জমিদার-মহাজনি শোষণ গ্রামের 888sport free betগরিষ্ঠ জনশ্রেণিকে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে দেয় তার পরিণাম পূর্বোক্ত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। জন্ম দেয় কঠোর জীবনসংগ্রামের এক নিরানন্দ পরিবেশ। এর মধ্যেও অবশ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর (আদিবাসী বলতে মানা) মানুষগুলোকে 888sport promo code-পুরুষ নির্বিশেষে নিজ নিজ গোষ্ঠী-প্রথামাফিক নবান্ন উৎসব পালন করতে দেখা গেছে।

 

দুই

হেমন্ত ও অঘ্রানের ভরা মাঠে সোনালি ফসলের বর্ণ-গন্ধময় প্রাকৃত রূপ নিয়ে বাঙালি কবি-888sport live footballিকদের সৃষ্টিশীল নান্দনিক আবেগও কম উদ্দীপ্ত হয়নি। জন্ম নিয়েছে আকর্ষণীয় চিত্ররূপ পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তিতে। ‘হলুদ ধানের ছড়া’র গোবিন্দ দাস থেকে রবীন্দ্রনাথের অঘ্রানী ফসল পার হয়ে জীবনানন্দের হেমমেত্মর রূপসী মাঠ এবং সুভাষ-সুকামেত্মর ‘নতুন ফসলে সুবর্ণ যুগ’। আর সেখানে ‘মাঠের সম্রাট দ্যাখে মুগ্ধ নেত্রে ধান আর ধান’। বাদ যান না প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর ‘শস্য প্রশসিত্ম’তে ভরেওঠা ফসলের রূপময়তার বয়ানে।

নবান্নে শুধু যে নতুন চালের সুগন্ধভরা পায়েসসহ রকমারি মিষ্টান্ন, তাই নয়। ব্যস্ত গৃহবধূ ও তরুণীদের সুদক্ষ কারুকার্যখচিত রকমারি পিঠা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সূচনা ঘটায়। আজ থেকে ছ-সাত দশক আগেও গ্রামবাংলার বাড়িতে বাড়িতে নতুন ধান ঘরে ওঠা উপলক্ষে দেখা গেছে উৎসব-আনন্দের পরিবেশ। এবং তা সম্প্রদায় ও শ্রেণি নির্বিশেষে।

যেমন সম্পন্ন কৃষক, তেমনি নিম্নবর্গীয় দরিদ্র কৃষকেরও এ-উপলক্ষে ঘরবাড়ি উঠোন-আঙিনায় দেখা গেছে নয়া সাজ। লেপেপুছে ঝকমকে-তকতকে উঠোন-আঙিনা এমনকি ঘরের দাওয়ার কী ভিন্ন রূপ! কৃষিসরঞ্জাম থেকে শুরু করে নতুন ডালাকুলা চালুনি চাটাইয়ের বাহার যার যার সাধ্যমতো। কোথাওবা হাঁড়ি-সরা-কলসিতে রঙিন আঁকিবুঁকি। নবান্ন উপলক্ষে উদ্দীপনা ও কর্মতৎপরতার প্রকাশ।

ধানকাটা, ধানমাড়াই, ঝাড়াবাছা থেকে ধানভাঙা শুধু কর্মে ও শ্রমেই ধন্য হয়ে ওঠে না, তৈরি করে লোকসংগীত বা দেশজ ছড়া, গানের আবহ। তাতে সাড়া দেন আধুনিককালের কবিকুলও, বিশেষ করে সমাজসচেতন গণসংগীতকারগণ, যা কখনো ঐতিহ্যধারায় স্নাত, কখনো প্রতিবাদী সংস্কৃতির চরিত্র নিয়ে উৎসারিত। সবকিছুর মিলে তৈরি হয় উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে মিল রেখে আনন্দঘন সাংস্কৃতিক পরিবেশ। উৎসবে-উৎপাদনে-আনন্দিত আয়োজনে ধরা পড়ে শ্রম ও বিনোদনের অন্য এক বন্ধনের রূপ।

সংস্কৃতির এ-ধারায় কখনো দেখা গেছে গ্রামীণমেলার অনুষ্ঠান, যেখানে প্রয়োজন ও বিনোদন সমান গুরুত্বে স্থান পায়। তাই মেলার পণ্যসামগ্রীতে থাকে খেলনা, পুতুল, হাঁড়ি-কলসি থেকে পিঠা-পায়েস ও রকমারি মিঠাইমণ্ডা এবং সেইসঙ্গে শাড়ি-গামছা-লুঙ্গিসহ বাঁশ ও বেতের তৈরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বাঁশির সুরে মেলা হয়ে ওঠে নান্দনিক চরিত্রের। গাছগাছালির প্রাকৃত সুষমা এর আকর্ষণীয় প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

এ-মেলার প্রসারিত রূপ দেখা যায় আধুনিক কালের বর্ষশুরুর বৈশাখিমেলায়। এ-ধরনের মেলায় কখনো দেখা যায় লোকজধারার গানবাজনার অনুষ্ঠান। একটি তথ্য মনে রাখার মতো যে, ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন উৎসব-অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রায়শ জড়িত থাকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ, তবে তা রক্ষণশীলতার পরিবর্তে উদার মানবিক চেতনায় সিক্ত। অবশ্য কাল ও আধুনিকতার প্রভাবে সেসব উপসর্গ কখন যে ধুয়ে-মুছে গেছে কেউ তা মনে রাখেনি।

 

 

তিন

ওই যে বলেছি আধুনিক কালের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নবান্নের উৎসব-অনুষ্ঠান হারিয়ে গেছে বেশ কিছুকাল থেকে। গ্রামে কোথাও কোথাও এর নামকাওয়াসেত্ম উপস্থিতি, উলেস্নখযোগ্য নয় মোটেই। তবে একালে আমাদের নাগরিক শিক্ষিত সমাজে সংস্কৃতি-চেতনায় একধরনের জাগরণ দেখা দিয়েছে মূলত বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন ও ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বোধের পথ ধরে।

এর নানামাত্রিক প্রকাশ যেমন দেখা গেছে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মোৎসব ঘিরে, তেমনি বিশেষভাবে বাংলা নববর্ষের বৈশাখি মেলার উৎসব-অনুষ্ঠান ঘিরে। আর সেই সূত্রে গ্রামীণ অনুষ্ঠান উঠে এসেছে শহরে; বিশেষভাবে রাজধানী 888sport appর মহানাগরিক পরিবেশে। ছাত্রসমাজ এবং রাজনীতি ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় 888sport appর রাজপথে শিক্ষায়তনে বৈশাখী নববর্ষের বিশাল আয়োজন। যেমন সামাজিক অঙ্গনে হালখাতায়, উৎসবে-অনুষ্ঠানে তেমনি সংস্কৃতির নানা আয়োজনে।

সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্যবাহী প্রসারিত ধারায় অনুষ্ঠিত বৈশাখি উৎসব ও মেলার প্রভাবে কিছুকাল থেকে 888sport appয় শুরু হয়েছে গ্রামীণ নবান্ন উৎসবের পরিশীলিত আধুনিক সংস্কৃতিমনস্ক প্রকাশ। শুরুটা যদিও হাঁটি হাঁটি পা পা করে তবে বছর দুই-তিন ধরে এর আনুষ্ঠানিক  প্রকাশ বেশ সমারোহে।

888sport appর চারুকলা শিক্ষায়তনের গাছগাছালির ছায়াভরা স্বনামখ্যাত বকুলতলায় সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিদের সাংগঠনিক তৎপরতায় নাগরিক নবান্ন উৎসবের ঐতিহ্য রক্ষার উৎসব অনুষ্ঠান চলে প্রতিবছর পয়লা অঘ্রানে। গানবাজনায়, ঢাকঢোলে, বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য-ইতিহাস উচ্চারণে, সর্বোপরি রেখা ও রঙের নকশাসজ্জিত কুলা-হাঁড়ি-সরা বা নকশিকাঁথা বা শীতলপাটির প্রতীকী উপস্থিতিতে ঝলমল নবান্নের অনুষ্ঠান – পিঠা-পায়েস, খই, চিড়া, মুড়ি, মোয়া-মুড়কির সদ্ব্যবহারে।

বাংলা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারে সমাজের জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছে এ জাতীয় উৎসব অনুষ্ঠান। বড় কথা এর অসাম্প্রদায়িক সামাজিক চরিত্রের প্রকাশ। রাজধানীর এ-জাতীয় সংস্কৃতিচর্চার প্রভাবে দেশের শহর-বন্দরে  কোথাও কোথাও উদযাপিত হচ্ছে নবান্নর সংস্কৃতিমনস্ক  উৎসব-অনুষ্ঠান। ক্রমান্বয়ে এর বিস্তার ঘটছে।

নবান্ন যদিও কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থার গ্রামীণ উৎসব হিসেবে পরিচিত এবং ঐতিহ্য প্রেরণায় রাজধানীতে এর সাংস্কৃতিক প্রকাশ, তা সত্ত্বেও গ্রামের মূলধারায় ঐতিহ্যবাহী এ-অনুষ্ঠান নতুন করে বিকাশলাভ করেনি। সামাজিক সচেতনতার অভাব এর মূল কারণ। সেই সঙ্গে কারণ গ্রামে ব্যাপক সুশিক্ষার অভাব। সেই সঙ্গে
লোকসংস্কৃতির যথার্থ চরিত্র বুঝতে না পারা।

শহুরে বা নাগরিক সংস্কৃতিচর্চা বরাবরই তো গ্রামীণ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে অনুৎসাহী। গ্রাম পূর্বকথিত মধ্যযুগে পড়ে না থাকলেও সেখানে সুস্থ, প্রগতিশীল, আধুনিক সংস্কৃতিচর্চার নিতান্ত অভাব। সেক্ষেত্রে অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব, রক্ষণশীলতার প্রভাব  সাংস্কৃতিক পিছুটান হিসেবে কাজ করছে। জাতীয়তাবাদী বা প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব যতদূর সম্ভব এ-সমস্যা আমলে  এনে সংস্কৃতির সুস্থ, মানবিক চর্চায় উদ্যোগী হওয়া। এ-ব্যাপারে গ্রামকে টেনে তোলা দরকার নাগরিক সংস্কৃতির সমান্তরাল স্তরে, লোকসংস্কৃতির চেতনা ধারণ করে।