888sport appsের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেটের সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলাতে গারো বা মান্দিদের বাস বেশি। এছাড়া ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে অধিকসংখ্যক গারোদের বাস। নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে, এ-আদিবাসীরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির টিবেটো-বার্মান দলের টিবেটো-চায়নিজ পরিবারের সদস্য।
এরা নিজেদের ‘আচ্ছিক মান্দি’ বা ‘পাহাড়ি মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক পছন্দ করে। তবে সমতলের গারোরা নিজেদের শুধুই ‘মান্দি’ বা ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দেয়। গারো পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে একসময়ে এদের অন্যতম শাখা
‘গারা-গানচিং’দের বসতি ছিল। তাদের ধারণা, গারো নামটি অন্য কোনো জাতির দেওয়া। আদিকালে তারা যখন বিচরণভূমিতে মুণ্ডু শিকার করে বেড়াত, তখন অন্য জাতির লোকেরা তাদের জেদি, একগুঁয়ে বা গাড়োয়া বলে ডাকত। কালক্রমে সে-গাড়োয়া শব্দ থেকেই গারো নামটি এসেছে বলে কথিত রয়েছে। আবার নৃ888sport apkীরা মনে করেন, গারোদের আদি বাসস্থানের নাম ‘গারু আ সং’ বা গারোদের দেশ। মূলত এ থেকেই গারো নামকরণের উদ্ভব।
গারোদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। এ-উৎসবকে তারা বলে – ওয়ান্না, ওয়ানাগালা, ওয়ানমা রংচুয়া ও দ্রুয়া ওয়ানবলা। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ-উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে গারোদের নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকে। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। এটি গারোদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। উৎসর্গপর্বটি ধর্মীয় দিক আর ভোজ, নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও সম্মিলনের দিকটি সামাজিক দিক। তবে গারোদের কাছে ওয়ানগালার মূল বিষয়টি ধর্মীয়। পূজা-অর্চনার মাধ্যমে দেব-দেবীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও নানা আবেদন-নিবেদন করা হয় এ-উৎসবে। এ-কারণে অনেকেই এটিকে নবান্ন ও ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকে।
গারোরা ওয়ানগালা উৎসবের প্রথমদিনকে ‘রুগালা’, দ্বিতীয়দিনকে ‘সাসাত স’আ’ ও তৃতীয়দিনটিকে বলে ‘ক্রাম গগাতা’।
ওয়ানগালা উৎসবের নিয়ম অনুসারে জুম ক্ষেতের মাঝখানের কিছু অংশের ধান কাটা হয় সবশেষে। ওই স্থানটিকে গারোরা বলে আ’সিরকার স্থান। ধান কাটা হয় দেবতার উদ্দেশে ধূপ উৎসর্গ করে। অতঃপর গোড়া থেকে কেটে আঁটি বেঁধে এরা ধান নিয়ে আসে বাড়িতে। এ-সময় সবাই মিলে আনন্দধ্বনি করে। এদের বিশ্বাস, শেষ ফসলের সঙ্গে তারা ক্ষেতের দেবতাদেরও এভাবে বাড়িতে নিয়ে আসে। তারা মনে করে, দেব-দেবীগণ পৃথিবীতে সবসময় থাকে না। ওয়ানগালার সময় তাঁরা ভক্তদের আশীর্বাদ করে চলে যায় নিজ আবাসে।
ধান ঘরে এনে প্রথমে এরা মোরগ উৎসর্গ করে মিসি সালজং বা সূর্যদেবতার নামে। কারণ সূর্যদেবতার নামেই ওই স্থানে ধান রোপণ করা হয়েছিল। অতঃপর নতুন ধানের চাল দিয়ে এরা ওয়ানগালার জন্য মদ তৈরি করে। এ-অনুষ্ঠানের পর সংনি নকমা (গ্রামপ্রধান) সবাইকে ডেকে সভা করে ওয়ানগালা উৎসবের দিন নির্ধারণ করেন। দিনের 888sport free bet অনুসারে সমতলের গারোরা একটি রশিতে আর পাহাড়ের গারোরা ওমাক বিগিল নামে এক প্রকার গাছের ছাল দিয়ে গিঁট বেঁধে তা ঘরের চালে বেঁধে রাখে। একদিন পার হলেই এরা একটি করে গিঁট খুলে দেয়।
ওয়ানগালার আগে গারোদের কলার পাতা ছিঁড়ে ব্যবহার করা নিষেধ থাকে। উৎসবের দিন ঘনিয়ে আসার আগেই গ্রামগুলোতে মদ তৈরির ধুম পড়ে যায়। সবাই পূজার স্থান, বাড়িঘর ও গোলাঘর মেরামত ও পরিষ্কার করে। উৎসবের জন্য বাজার থেকে কিনে আনা হয় গরু, শূকর, ছাগল, মোরগ। বাড়ির লোকদের জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক ও অলংকারাদি। উৎসবে ব্যবহারের জন্য জোগাড় করা হয় মোরগ ও ডুকুয়া পাখির পালক।
উৎসবের আগের দিনটি গারোদের কাছে অতি পবিত্র। ওই দিনে কেউ গ্রামের বাইরে যায় না। কোনো কাজকর্মও করে না। সন্ধ্যারাতে পাহাড়ি গারোরা নকপান্থে
888sport promo code-পুরুষ একত্রিত হয়ে মদ ভাত দিয়ে ভোজ সারে। অতঃপর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এরা নাচ, গান করে ওয়ানগালার মহড়া দেয়। কিন্তু সমতলের গারোরা এটি করে না।
ওয়ানগালার প্রথমদিনের নাম রুগালা। এ দিনটিতে মূলত উৎসর্গের উৎসব হয়। শস্যের জননী ও ভাণ্ডারদেবী রক্ষিমে, গৃহদেবতা, সূর্যদেবতা প্রমুখের উদ্দেশে মদসহ উৎসর্গ করা হয় নতুন ধানের ভাত, নতুন ফসলের ফলমূল, শাক-সবজি ও
পশু-পাখি। এদিনে ওয়ানগালা উৎসবের জন্য গরু, শূকর প্রভৃতি মেরে গারোরা সবার মাঝে মাংস বিলি করে।
নকমা (গ্রামপ্রধান) নিকটস্থ ঝরনা বা খাল বা নদী থেকে দুটি কাঁকড়া ধরে এনে একটি পাত্রে রাখেন। ওইদিন দুপুরের আগে তিনি একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে জুম ক্ষেতে যান। সেখানে আ’সিরকা স্থানে সেটি মিসি সালজং বা সূর্যদেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করে পূজা-অর্চনা করেন। অতঃপর বাড়ি ফিরে তিনি ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের দ্রব্যসামগ্রী সাজান।
ঘরের মাঝখানে কয়েকটা কলার পাতা ইংরেজি (ট) অক্ষরের মতো অথবা বর্গাকারে পেতে তাতে নতুন ধানের ভাত, আদা, নানা জাতের কচু, কুমড়া, সলংগা, তে, চিনারা প্রভৃতি শাক-সবজি, ফলমূল দু-ভাগ করে কেটে সাজিয়ে রাখেন। পাশেই জুম ক্ষেতে ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতি – দা, কুড়াল, কোদাল, নিড়ানি প্রভৃতি রেখে কলাপাতায় ঢেকে তার ওপর রাখা হয় কয়েক মুষ্টি চাল।
ঘরের মাঝখানে একদিকে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র – দামা, দাদিক, ক্রাম, রাং, নাগরা, আদিল, কাক্ওয়া, খা’আর প্রভৃতি। চালের মটকা বা পাত্রে মালার মতো সাদা সুতা দিয়ে বেঁধে, সুতায় বেঁধে দেওয়া হয় তিনটি তুলার পিণ্ড। অতঃপর তাতে চাল পুরোপুরি পূর্ণ করে তার মধ্যে একটি মুরগির ডিম ও মোরগের পালকগুচ্ছ বসিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের লোকেরা নকমার বাড়িতে জড়ো হলে দুপুরের পরেই শুরু হয় ওয়ানগালার অনুষ্ঠান।
নকমা নিজেই বা পুরোহিত লাল বা সাদা রঙের পাগড়ি ও মোরগের পালকগুচ্ছ মাথায় পরে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি চাল রাখার মটকা বা পাত্রে ভাণ্ডারদেবী ও খাদ্যশস্যের জননী রক্ষিমের পূজা-অর্চনা করেন মন্ত্র পড়ে। অতঃপর একটি মুরগি জবাই করে তার রক্ত সুতার মালায় বাঁধা তিনটি পিণ্ডে মাখিয়ে মটকা বা পাত্রের গায়ে রক্ত ছিটান এবং ভেজা রক্তে মুরগির লোমগুলো লাগিয়ে দেন। এ সময় নতুন মদ ভাণ্ডারদেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়। গারোরা একে বলে ‘রংদিক’ বা ‘মিত্দে’।
ভাণ্ডারদেবীর পর গৃহদেবতার উদ্দেশে মন্ত্র পড়ে মদ ও পানীয় উৎসর্গ করা হয়। ঘরের ভেতর এসে নকমা বা পুরোহিত গৃহদেবতার উদ্দেশে মোরগ উৎসর্গ করে মন্ত্র পড়ে ঘরের সামনের বেড়ায় মোরগের রক্ত ও লোম লাগিয়ে দেন। একইভাবে ঘরের মাঝখানের খুঁটির জন্যও একটি মোরগ উৎসর্গ করে তার রক্ত ও লোম মাখিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে রক্ত ও লোম লাগিয়ে দেওয়া হয় বাদ্যযন্ত্রগুলোতেও। কলার পাতায় ঢেকে রাখা কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর মন্ত্র পড়ে মদ ঢেলে উৎসর্গ করা হয়। এরপরই শুরু হয় ওয়ানগালার প্রধান পূজা-অর্চনা।
নকমা বা পুরোহিত পেতে রাখা ভাত-তরকারি, ফল-মূল, শাক-সবজি প্রভৃতি সামনে রেখে মন্ত্র পড়ে সারাঘরে ছিটিয়ে দেন নতুন ধানের চাল বা রান্না করা ভাত। অতঃপর সকালে ধরে আনা কাঁকড়া দুটির ওপর মন্ত্র পড়ে মদ ঢেলে একটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যটিকে একটি বাঁশের কাঠিতে বিদ্ধ করে কাঁকড়াটিকে ওপরে রেখে ঘরের মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হয়। এই বিদ্ধ কাঁকড়াটিকেই সূর্যদেবের বিদায়কালের সহযাত্রী হিসেবে মনে করা হয়।
অতঃপর নকমা বা পুরোহিত মিসি সালজং বা সূর্যদেবতাকে উদ্দেশ করে মন্ত্র পড়েন। তিনি পং-এর মদ সাজানো দ্রব্যসামগ্রী-ভাত-তরকারি, কৃষিজাত ফল-মূল, শাক-সবজি প্রভৃতির ওপর এক এক করে ঢালতে ঢালতে দ্রুত আসন থেকে উঠে সম্মুখ দরজা পার হয়ে পুনরায় নিজ আসনে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ডান ও বাম পাশে রাখা মিল্লাম (গারো দ্বিধার তরবারি) ও স্পি (ঢাল) হাতে নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে নাচতে আরম্ভ করেন। এসময় সবাই সাজিয়ে রাখা বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাতে শুরু করে। নকমা বা পুরোহিত নিজ আসনে ফিরে এলে শুরু হয় মদপান। মদের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় মাংসের তরকারি। এভাবে গারো গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রুগালা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বড় বড় গ্রামে প্রয়োজনে রাতে বা পরদিনও রুগালা অনুষ্ঠান করতে হয়।
সব বাড়িতে এ-অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই আবার নকমার বাড়িতে চলে আসে। রুগালার রাতে গারোরা নাচ-গান, আমোদ-প্রমোদ করে কাটায়। প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয় পিঠা। যুবক-যুবতীরা খুশিমনে নেচে-গেয়ে পরম্পরকে মদ পান করায়। এসময় এরা পরম্পরকে আজেয়া, দরোয়া খাবি ইত্যাদি গান দ্বারা প্রশ্ন করে ও উত্তর দেয়। প্রশ্নের উত্তর সাধারণত প্রৌঢ় নর-888sport promo codeরা দিয়ে থাকেন। এ-উৎসবের মাধ্যমে এভাবেই নবীন বয়সের গারোরা জেনে যায় – সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, দর্শন, পৌরাণিক কাহিনি ও গারোদের অতীত গৌরবময় ঐতিহ্য। ফলে বংশপরম্পরায় টিকে থাকে গারোদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।
সাসাত স’আ মানে ধূপসামগ্রী উৎসর্গ। ওয়ানগালার দ্বিতীয়দিনে হয় এ-অনুষ্ঠান। ওইদিন খুব সকালে গ্রামের সবাই এসে জড়ো হয় নকমার (গ্রামপ্রধান) বাড়িতে। নকমা প্রথমে তাঁর সারাঘরে নতুন চালের ভাত ছিটিয়ে দেন। গারোদের কাছে
এ-ছিটানো ভাতগুলো শিলাবৃষ্টির প্রতীক। কৃষি মৌসুমে যেন সুবৃষ্টি হয় এবং ক্ষেতে ফসলের ভালো ফলন ফলে, এটি সেই কামনারই বহিঃপ্রকাশ। নকমা নিজে বা পুরোহিত নকমার ঘরের চারকোণে
পং-এর মদ নিয়ে দেবতার উদ্দেশে মদ উৎসর্গ করেন ভাণ্ডারে ও মালজুরিতে। অতঃপর তিনি ধূপ পোড়া দিয়ে সূর্যদেবতা বা মিসি সালজংয়ের নামে মন্ত্র পড়ে ধূপ উৎসর্গ করে সারাঘর ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেন। ধূপের কালো ধোঁয়া ঘরের বাইরে চলে গেলে আগামী বছর মেঘ এভাবেই ভেসে এসে বৃষ্টি বর্ষণ করবে বলে গারোরা বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, সূর্যদেবতা ধূপের সুগন্ধে খুশি হন। এসময় বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজানো হয় এবং গারোরা খামাল মিল্লাম ও স্ফি নিয়ে ‘গ্রিকা’ নাচ শুরু করে। নাচের ফাঁকে চলে মদ ও খাজি পরিবেশন। এসময় এরা উঠোনে বৃহৎ বৃত্তাকারে নানা অঙ্গভঙ্গি করে নাচে ও গান গায়। একে সা’আডাল বা মারা রোয়া বলে। এটি মূলত মুক্ত নাচ ও গান। এভাবে নাচ-গান ও ভোজন-পান প্রতিটি বাড়িতে সম্পন্ন হয়। ওয়ানগালার এদিনের অনুষ্ঠানগুলোই বেশি আকর্ষণীয়।
ওয়ানগালার তৃতীয়দিনের অনুষ্ঠান ক্রাম গগাতা বা জল ওয়াতা। ‘ক্রাম গগাতা’ মানে নকমার ক্রাম নকমার ঘরে তুলে দেওয়া। আর ‘জল ওয়াতা’র অর্থ শেষ বিদায়। ওইদিন সকালে নাস্তা সেরে সবাই নকমার বাড়িতে সমবেত হয়। নকমার বাড়িতে দেব-দেবীদের উদ্দেশে পুনরায় সংক্ষিপ্ত আকারে রুগালা ও সাসাত স’ওয়ার আচারগুলো করা হয়। সারাদিন গ্রামের সব বাড়িতেই এ-অনুষ্ঠান হয়। আগের দিনের মতোই চলে নাচ-গান, ভোজন-পান। তবে তাতে আগের মতো জৌলুস থাকে না। যুবক-যুবতীদের মাঝে এদিন বিচ্ছেদের ভাব জেগে ওঠে।
সন্ধ্যার ঠিক আগে সবাই বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে হাজির হয় নকমার বাড়িতে। তিনি তখন শেষবারের মতো সবাইকে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বলেন। বাদ্যযন্ত্রে সুর উঠতেই নকমা তাঁর ঘরের মালজুরিতে সূর্যদেবতা ও রক্ষিমের উদ্দেশে শেষ রুগালা ও সাসাত স’ওয়া করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। অতঃপর তাঁরা যেন আগামী বছর আবার এসে আশীর্বাদ করেন সে-আবেদন জানিয়ে খুশি মনে তাঁদের বিদায় দেন। দামা, ক্রাম, রাং প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র নকমার ঘরেই জমা থাকে। এভাবেই গারোদের ওয়ানগালা উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
ওয়ানগালা উৎসবের পেছনের গদ্যগুলো অনন্য। এ-উৎসব নিয়ে মান্দি বা গারো সমাজে প্রচলিত আছে কয়েকটি মিথ বা লোকগাথা। বহুল প্রচলিত মিথটির ভাবার্থ এমন :
আদিকালের কথা। মানুষ তখন বনের আলু, কচু, গাছের ফলমূল, লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করত। ধান, জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। তখন পৃথিবীতে ধন-সম্পদ,
মণি-মানিক্য, খাদ্যশস্য প্রভৃতির একটি বৃক্ষ ছিল। বৃক্ষের একটি ডালে ছিল ধান ও 888sport app খাদ্যশস্যের প্রচুর ফল। কিন্তু মানুষ তো নয়ই, দেবতারাও তা আহরণ করতে পারত না।
একবার বায়ুদেবতা ‘জারু মে আ জাবাল পান্থে অক্কুয়াংসি জাপাৎ চং সি’ পরিকল্পনা আঁটেন। ওই বৃক্ষ থেকে খাদ্যশস্যের বীজ পেতে তিনি বন্ধুত্ব গড়েন ঝড় ও শিলাবৃষ্টির দেবতা ‘মিক্কা টেম্মা স্টিল রংমা’র সঙ্গে। তিনি তাঁর সাহায্যে ওই বৃক্ষে জোরে নাড়া দেন। এতে ধান ও 888sport app খাদ্যশস্যের বীজ পড়ে যায় মাটিতে।
বায়ুদেবতা ওই ধানের বীজ না কুড়িয়েই বাড়ি চলে গেলে ‘আ’ নিং নসিকসক চিনিং নমিনদিল আ নিং দিপেরি চিনিং দিপেরা’ ধানের বীজগুলো কুড়িয়ে ক্ষেতে বপন করেন। পরবর্তীকালে সূর্যদেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তাঁর কাছ থেকে ধানের বীজ নিয়ে নিজের ক্ষেতে লাগান এবং সর্বপ্রকার খাদ্যশস্যের একচেটিয়া অধিকারী হন।
সূর্যদেবতা একদিন বাজারে যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এ-জগতের এক লোক। তার শরীর ছিল ময়লামাখা। পরনে নোংরা পোশাক। থলেতে খাবারের আলু। পেছনে সূর্যদেবতার মতো সুপুরুষকে পরিচ্ছন্ন পোশাকে দেখে সে লজ্জায় বড় এক পাথরের আড়ালে লুকাল। সূর্যদেবতা তা খেয়াল করলেন। কাছে গিয়ে তিনি তাকে বেরিয়ে আসতে বললেন। নাম জানতে চাইলে লজ্জায় ও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে লোকটি নাম জানাল, ‘আনি আপিলপা চিনি গালাপাও।’
নামে নামে মিল দেখে সূর্যদেবতা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। গাছের ছায়ায় একসঙ্গে খাবার খেতে বসে তিনি দেখলেন, তাঁর বন্ধু খাচ্ছেন বনের আলু। তাঁর খুব মায়া হলো। তাকে নিজের ভাত ও সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি খেতে দিলেন। অতঃপর ধান ও 888sport app খাদ্যশস্যের বীজ বপন করেন কি না জানতে চাইলে বন্ধুটি উত্তরে বলে, ধান কী, তা তিনি জানেন না।
শুনেই সূর্যদেবতার দয়া হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে ধানের বীজ পাঠাব। তুমি জুম চাষ করে জুম ক্ষেতে ধান বুনবে। যখন ধান পাকবে, ঘরে তুলবে। সে-সময় আমাকে 888sport app download for android করবে। আমার আশীর্বাদে, আমার দানে আনন্দ করবে, আমার কাছে প্রার্থনা জানাবে। তাহলে প্রতিবছর তোমাকে ও তোমার পরিবার-পরিজনকে আমি আশীর্বাদ করব। এ আমার প্রতিশ্রুতি।’
বাড়ি ফিরে সূর্যদেবতা প্রতিশ্রুতিমতো তাঁর দাস ‘নক্কল জসিকসক ররি জবংবং’কে দিয়ে বন্ধুর জন্য ভালো ধানের বীজ পাঠালেন।
ওই দাস ছিল খুব ঈর্ষাপরায়ণ। বীজগুলোকে সে ভিজিয়ে নষ্ট করে পৌঁছে দিলো।
সরল বিশ্বাসে বন্ধুটি জুম ক্ষেতে তা বুনল। দখিনা বাতাস এলো। বৃষ্টিও হলো। কিন্তু বীজ থেকে কোনো চারা গজাল না। তা দেখে সে হতাশ হলো। সূর্যদেবতা তাকে ঠকিয়েছেন ভেবে কষ্ট পেল। একদিন সূর্যদেবতার অন্য দাসদের পেয়ে সে ক্রোধে তাদের বেঁধে রাখল।
দাসদের কান্নায় আকাশ থেকে নেমে এলেন সূর্যদেবতা। বন্ধুর মুখে সব শুনে তিনি অনুনয় করে বললেন, ‘আমার এ-দাসদের কোনো দোষ নেই। অন্যায় করেছে আমার দাস ‘নক্কল জসিকসক ররি জবংবং’। আমি তাকে শাস্তি দিচ্ছি। তুমি এদের ছেড়ে দাও। আমি পুনরায় তোমাকে সতেজ ধানের বীজ পাঠাব।’
সূর্যদেবতার অনুরোধে দাসগণ মুক্ত হলেন। তিনি তাঁর কথামতো বন্ধু ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’র কাছে নতুন বীজ পাঠালেন।
নব উদ্যমে পরিশ্রম করে বন্ধুটি জুম ক্ষেতে ধানের সে-বীজ বুনল। বীজ থেকে এবার ধানগাছ গজিয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল। তা দেখে বন্ধুর মনে আনন্দের দোলা লাগে।
ধান পাকছে। কয়েক দিন পরেই কাটতে হবে। এমন সময় ঘটল আরেক ঘটনা! দেবতার কয়েকজন দাস গোপনে ক্ষেতের কিছু ধান চুরি করল। অতঃপর সূর্যদেবতার কাছে তারা অভিযোগ করে বলল, ‘দেখো, আগে তোমাকে না দিয়েই পাকা ধানগুলো তোমার বন্ধু কেটে খেয়েছে। তোমাকে সে উপেক্ষা করেছে, অসম্মান করেছে।’
দাসদের কথায় সূর্যদেবতা রাগান্বিত হলেন। অতঃপর বন্ধুর পুত্র ও দাসদের ধরে এনে তিনি বন্দি করে রাখলেন।
এ-সংবাদ শুনে আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা সূর্যদেবতার কাছে ছুটে আসে। অভিযোগ শুনে সে অনুনয় করে বলে, ‘এখনো আমি জুম ক্ষেতের ধান কাটিনি। তোমাকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করে নিজে আগে খাইনি। কারা যেন কিছু পাকা ধান চুরি করে কেটে নিয়েছে। আমি তোমাকে সম্মান করি ও করব।’
বন্ধুর কথায় সূর্যদেবতার মন গলে। ভুল শুধরে নতুন করে তারা বন্ধুত্ব গড়ে।
এরপর ফসল ওঠে। আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা প্রথম মংরে পর্বতের (মন্দর পর্বত) চেন্দেন শিখরে দেবতার উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন মদিরা, ধূপ প্রভৃতি উৎসর্গ করে। আকাশ, সূর্য ও উর্বরতার দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তখন খুশি হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘এ ব্যক্তি ও তার বংশধরগণের ভবিষ্যতেও ভালো ফসল হোক। তারা চিরকালের জন্য আশীর্বাদযুক্ত হোক। প্রতিবছর ফসল কাটার ঋতুতে আমি পৃথিবীতে ফিরব আশীর্বাদ করতে।’
ফলে দিন দিন সে আরো ধনী ও সম্পদশালী হয়ে উঠল। তার পুত্র-কন্যাদেরও জুম চাষে উৎসাহ দিলো। এভাবেই যুগ-যুগান্তে বংশপরম্পরায় গারো বা মান্দিদের ওয়ানগালা উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
কিছু কিছু এলাকার গারো আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে ওয়ানগালা নিয়ে আরেকটি পৌরাণিক কাহিনি। কাহিনিটি এমন :
দেবতা মিসি সালজংয়ের একবার ছোটভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ফলে তিনি ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। তাঁর সংসারে তখন অভাব চলছিল। স্ত্রীর মুখে বড়ভাই আসার খবর শুনেও তিনি ঘরের বাইরে এলেন না, বরং বিরক্ত হলেন। স্ত্রী বলেন, ‘অতিথিকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করব?’
উত্তরে ছোটভাই বলেন, ‘একটি পাত্রে কিছু ঘুঁটে নিয়ে পুড়িয়ে দাও। সে তার ঘ্রাণ নিক।’
ভাইয়ের ব্যবহারে মিসি সালজং অপমানিত ও রাগান্বিত হন। অতঃপর তিনি চলে আসেন পৃথিবীতে। যে-স্থানে তিনি আবির্ভূত হন, সেখানে থাকতেন এক বিধবা। নাম ‘আইসেগ্রির মিসালি সিংসালি টোটমারি কিংমারি’। বিধবা খুবই গরিব ছিলেন। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে থাকতেন শুকনো লতাপাতার ছাউনি দেওয়া ছোট্ট কুঁঁড়েঘরে। ঘরের চারপাশ ছিল জংলি পাতার ঘের দেওয়া। তাদের খাবার জুটত না ঠিকমতো। গরিব হলেও তারা ছিল খুবই সহজ-সরল। মনটা ছিল উদার।
মা-মেয়ে মিলে তখন পাহাড়ি শাক রান্না করে খাচ্ছিল। এমন সময় দেবতা মিসি সালজং সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে তারা চিনতে পারল না। রাগ ও বিরক্তও হলো না। তিনি তাদের বললেন, ‘আমি আজ তোমাদের বাড়িতে থাকব।’
আইসেগ্রি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বলল, ‘আমি এক দুঃখী বিধবা 888sport promo code। শুকনা কলাপাতার ছাউনি ও বুনো লতাপাতার বেড়া দেওয়া ঘরে কোনোরকমে থাকছি। এ-ঘর আপনার মতো সম্মানীয় অতিথির থাকার যোগ্য নয়।’
মিসি সালজং তার সরলতায় মুগ্ধ হলেন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু গনগাজা ডিল ও রিসিম গাছের কষ সংগ্রহ করে গাছের গুঁড়া দিয়ে পুড়িয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ধূপের সুগন্ধি আমার জন্য দিও।’
তারা মিসি সালজংকে ঘরে থাকতে দিলো এবং পরামর্শমতো ধূপ-সুগন্ধি উৎসর্গ করল। এতে তিনি খুশি হলেন। পরদিন পাহাড়ে হয় এমন ধানের বীজ বিধবার হাতে তুলে দিয়ে মিসি সালজং বললেন, ‘প্রতিবছর এ-সময়ে এভাবেই আমি আসব। তখন তোমরা আমার জন্য ধূপ-ধুনা পুড়িয়ে সুগন্ধি উৎসর্গ করবে। আনন্দ-ফুর্তি করবে, খাওয়া-দাওয়া করবে।’
গারোদের বিশ্বাস, সেই দিন থেকেই প্রতিবছর ফসল তোলার পর ধূপ জ্বালিয়ে পানাহার করে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে তারা ‘ওয়ানগালা’ উৎসব পালন করে আসছে।
সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে আদিবাসীদের উৎসবগুলো। এখনকার ওয়ানগালা উৎসব কেবল নাচ-গান আর কিছু আচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ধর্মান্তরের ফলে গারো বা মান্দিরাও আজ হারিয়ে ফেলছে এ-উৎসবের আদি রূপটিকে। কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি ও 888sport live footballে তাদের বিশ্বাসের মিথগুলো আজো জীবন্ত হয়ে আছে। ৎ
ছবি : সালগিরা চিসিম


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.