ও নাইটিঙ্গেল

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

বত্রিশ ইঞ্চি স্ক্রিনে সিনেমার শেষটা চলছিল। জায়গাটা লেবানন, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, মিসর বা পূর্ব ইউরোপের যে-কোনো শহর হতে পারে। গুলি চলছে চারধারে আর তার ভেতর দিয়ে একটা লোক ছুটে চলেছে; লোকটার কোলে নিজের মৃত স্ত্রী। লোকটার সারাশরীরে রক্ত আর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, মনে একটা উথালপাতাল চলছে। রাস্তার কেউ কিছু বলে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে সাবটাইটেলে ভেসে উঠল, ‘দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে অথচ দুজন দুজনের থেকে চিরবিচ্ছেদে চলে গেছে।’ লোকটা মাঝে মাঝে মুখ নামিয়ে এনে চুমু খাচ্ছিল মেয়েটার গলায়, মেয়েটার কপালে। আর ওদের পিছু পিছু একটা রক্তের ধারা ফোঁটায় ফোঁটায় সাপের লেজের মতো কোনো রাস্তা তৈরি করতে করতে যাচ্ছিল।
তোর্সা বলল, বন্ধ করো তো; ভালো লাগছে না।
প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল, শেষটুকু দেখতে দিবি না? দারুণ সিনেমাটা।
তোর্সা ঝাঁজিয়ে উঠল, সিনেমা কোথায়, 888sport sign up bonusর হারিকেন জ্বলছে মনে হচ্ছে। মারা গেছে একজন মহিলা আর তাকে আদর করছে, কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছে।
– মারা গেছে তাও ছাড়ছে না, আশ্চর্য না? দলমা বলল।
– কিন্তু যা মরে যায়, তাকে তো ছাড়তেই হয়। হিয়া বলে উঠল।
প্রেমাঞ্জনা বলল, প্রত্যেকটা মুহূর্ত কেমন জানিস তো? যেন একটা ক্যানভাস, যতক্ষণ না 888sport sign up bonusটাকে এনে ফেলছিস ততক্ষণ কিচ্ছু আঁকা নেই। আর 888sport sign up bonus এলেই ক্যানভাসে একের পর এক ছবি।
– বাবা! তুই তো লেকচার দিতে শুরু করেছিস অভীক স্যারের মতো। হিয়া বলল।
– অভীক এর মধ্যে এলো কোত্থেকে? দলমা বলল।
– আমাদের আলোচনায় অভীক আসবে না? তোর্সা বলল।
– আমি কিন্তু সত্যিই জানতাম না যে হিয়ার সঙ্গেও কিছু ঘটেছিল লোকটার। প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল।
– আমরা আজ এখানে এসেছি কেন? স্যারের পি-ি চটকাতে? হিয়া জিজ্ঞেস করল।
– পি-ি চটকানোর সময় আমাদের নেই। কিন্তু অভীক মিত্র হঠাৎ বিয়ে করেছে, সেটা নিউজ। অ্যান্ড আমরা একজন আর একজনের সূত্রে জানতে পেরেছি, আমাদের সবার সঙ্গেই ওর কোথাও একটা ইনভলভমেন্ট ছিল। আমার মনে প্রশ্ন জাগছে যে, আমাদের সঙ্গে ওর ব্রেকআপের পর ও কী এমন পেয়েছে এই নতুন মেয়েটার মধ্যে যে তাকে একেবারে বিয়ে করে নিল। ওরকম কিছু করার ধক ওর আছে বলে আমার মনে হয়নি। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– আমার কিন্তু মনে হতো ওর হাজব্যান্ড মেটিরিয়াল। তোর্সা বলল।
– আমাদের প্রত্যেকের এক্সপেরিয়েন্সগুলো আলাদা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। হিয়া বলল।
– আবার আমরা যদি শেয়ার করি আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো, দেখব কোথাও হয়তো সিমিলারিটিও আছে। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করে হবেটা কী? ও রণবীর কাপুর না সালমান খান যে ওর জন্য মারা যাচ্ছি আমরা? ও যেখানে যার সঙ্গে আছে, থাকুক গে। আই কেয়ার আ ফিগ। দলমা বলে উঠল।
– এই যে আমরা মিট করছি এর পেছনে কি একটা কনফেশনের প্ল্যান আছে নাকি, প্রেমাঞ্জনা? হিয়া হাসতে হাসতে বলল।
– একদমই না। কিন্তু সত্যিটা হলো, কোথাও একটা অভীকের ছাপ আছে আমাদের সবার ওপর। আমরা যারা একই কলেজে ইংলিশ অনার্সের স্টুডেন্ট ছিলাম, সে যে ইয়ারেরই হই, আমাদের প্রত্যেকের অভীকের জন্য একটা হ্যাল ছিল। যেভাবে লোকটা ক্লাসটাকে একটা 888sport app download apkর জায়গায় নিয়ে যেত সেটা আমাদের সবাইকে টানত। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– হ্যাঁ, সেটা অ্যাডমিট করছি; কিন্তু তাই বলে ও কাকে কোথায় বিয়ে করেছে…
তোর্সা হিয়াকে থামিয়ে বলে উঠল, তাই নিয়ে আমাদের কোনো লেনাদেনা নেই এটা যেমন ঠিক, তেমনি অভীক বিয়ে করে খুব হ্যাপি, আমার কথা আর মনেও নেই, এটা জানলেও আমি খুব খুশি হব না। আমি জানি না, তোদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম হতেই পারে বাট…
প্রেমাঞ্জনা একটু উঁচু গলায় বলল, আলাদা কিচ্ছু নয়। খবরটা শুনে আমার খারাপ লেগেছে, আর আমি শিওর আমাদের কারোরই খুব ভালো লাগেনি। তাই আমার মনে হয়েছিল ইফ উই ক্যান শেয়ার সামথিং বিটুইন আস। কিন্তু কনফেশন নয়। নেভার।
তোর্সা বলল, আই নো। ইনফ্যাক্ট আমিই বলছিলাম প্রেমাঞ্জনাকে, যদি একটু হ্যাং আউটও হয় আবার অভীক মিত্র বলতে আমরা কী বুঝি, কেন লোকটাকে ভালো লেগেছিল বা মিস করি এখনো, সেসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু কথাও হয় তো…
– সেটার কি দরকার আছে কিছু? স্পেশালি যখন আই অ্যাম ইনভলভড টু সাম আদার গাই অ্যাট প্রেজেন্ট! দলমা বলল।
– দ্যাখ, আমরা কেউই অভীকের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকব না। কিন্তু ওর সঙ্গে কোথায় কতটুকু জড়িয়ে ছিলাম আমরা সেই গল্প নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলে ক্ষতি কী? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– আমরা একটা লেডিস ভার্সেস অভীক মিত্র করতে যাচ্ছি না কি? হেসে উঠল দলমা।
– তা নয়। অভীক মিত্র তো আমাদের কোথাও ঠকায়নি। হিয়া বলে উঠল।
– ঠকানোর কথা উঠছে কেন? আমরাও কেউ নিশ্চয়ই ওকে ঠকাইনি। দলমা বলল।
– থাক এসব কথা। আমরা আজ এখানে কোনো তর্ক করতে বা কারো ওপরে শোধ তুলতে আসিনি। আমাদের এই রাজারহাটের ফ্ল্যাটটা গৃহপ্রবেশের পর থেকে ফাঁকা পড়ে আছে, তাই একদিন এখানে একটু এনজয় করতে এসেছি। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– উই উইল বুজ, উই উইল হ্যাভ ফান। দলমা বলল।
প্রেমাঞ্জনা বলল, আমরা নিজেদের কথাই বলব। তার মধ্যে অভীক যতটা আসার আসবে। একটাই শুধু শর্ত, উই শুড বি হনেস্ট টু আওয়ারসেলভস। দু-একটা সত্যি গোপন করতেই পারি ইচ্ছা হলে, কিন্তু মিথ্যা বলব না। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– অ্যাকসেপ্টেড। বাট, কাকে দিয়ে শুরু হবে গল্পটা? হিয়া জিজ্ঞেস করল।
– প্রেমাঞ্জনা শুরু করুক। ও আমাদের হোস্ট। দলমা বলে উঠল।
– হোস্ট তো সবার শেষে বলে। প্রেমাঞ্জনা হাসল।
– এক্ষেত্রে হোস্টই পথ দেখিয়ে শুরু করবে। পরে আমরা সবাই। তোর্সা বলল।
– ঠিক আছে। কিন্তু একটু গলা না ভিজিয়ে নয়। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– গলা ভেজানোর চক্কর শুরু হলে কিন্তু সামলাতে পারব না শেষে। হিয়া বলল।
– না, বেশি খাচ্ছি না। জাস্ট ওয়ান ফর দ্য রোড। তোরা হয়তো ভাবছিস আমরা তো ঘরের ভেতর তাহলে পরে… আসলে যে কোনো প্রেম বল বা রিলেশন, শেষমেশ তো একটা রাস্তাই তাই না? প্রেমাঞ্জনা ফ্রিজের ভেতর থেকে বিয়ারের ক্যানগুলো বের করে বাকি তিনজনের হাতে ধরিয়ে দিলো একটা করে। আর নিজেরটা দাঁত দিয়ে ওপেন করে, সময় নিয়ে চুমুক দিলো একটা। তারপর বলল, লেটস স্টার্ট।

প্রেমাঞ্জনা
আমি এই কলেজে পড়তেই আসতে চাইনি, ফার্স্ট অব অল। প্রেসিডেন্সিতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আর যাদবপুরেও। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং দুটোর একটাতেও পাইনি। আমার বাবা ব্যারিস্টার, অনেক আটঘাট জানা আছে ভদ্রলোকের, একটু কাঠখড় পোড়ালে আমার জন্য মনের মতো কলেজ বেছে নিতে পারত। কিন্তু আমার মনে হলো, পেছনের দরজা দিয়ে নয়, যেখানে সরাসরি পাচ্ছি সেখানে অ্যাডমিশন নেব। এবার আর একটু ভালো একটা কলেজে আমার হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু দেখলাম দীপ্র সেখানে অ্যাডমিশন নিচ্ছে। দীপ্র, তোরা জানিস না, ওয়াজ মাই এক্স। একদম হাড়ে হারামজাদা ছেলে। কী জ্বালান যে জ্বালিয়েছে আমাকে, বলে শেষ করতে পারব না। ইলেভেনে প্রেমটা হয়েছিল। টুয়েলভে গিয়েই শেষ হয়ে যায়। তার মধ্যে ও কমসে কম আমার হাজার কুড়ি টাকা মেরেছে, তাছাড়া ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছে। ও যে টিপিক্যালি খুব খারাপ ছিল তা নয়, কিন্তু ভয়ংকর সব ব্যাপার করত। যেমন ধর, সাপের বিষের নেশা ছিল ওর। এটা প্রথম শুনে আঁতকে উঠেছিলাম আমি। তখনো টানটা ছিল বলে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। ভেবেছিলাম মিথ্যা বলছে কিন্তু আমায় নিয়ে গিয়ে যখন একদিন দেখিয়ে নিয়ে এলো তখন আর অবিশ্বাস করব কীভাবে? পুরো গা-ছমছমে জায়গা। এন্টালিতে নেমে গলি তস্য গলি পেরিয়ে একটা তিনতলা বাড়ির প্রায় অন্ধকার একতলায়। সাপের ছোবল যে খায় তার নাকি ছ-মাস একটা হালকা ঘোর মতো থাকে। ফেরার পথে ভাবছিলাম দীপ্রর ছোবল খাওয়ার আগে আমি ওর থেকে পালাব কী করে? ব্যাপারটা সহজ ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত না দীপ্র নিজে ছাড়ছে। যাই হোক আলটিমেটলি ব্রেকআপ হওয়ায় আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। তারপর আবার ওর সঙ্গে একই কলেজে? রক্ষা করো বাবা!
অতএব এই কলেজেই। ভর্তি হওয়ার পর ফার্স্ট উইকটা আমি যাইনি। পরের সপ্তাহে গেলাম প্রথম। পরপর দুটো ক্লাস করে অসম্ভব বোর লাগছে, ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাব, ও মা লোকটা ক্লাসে ঢুকেই দরজাগুলো বন্ধ করে দিলো। বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন বাইরে। আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, বাধ্য হয়ে বসে গেলাম আবার। মাথার মধ্যে অন্য পঞ্চাশটা চিন্তা ঘুরছিল। কারণ ততদিনে রাকেশ বনসালের সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়ে গেছি আমি। মাড়োয়ারি বাড়ির ছেলে, দু-জেনারেশনের ট্রান্সপোর্টের বিজনেস, প্রচুর পয়সার মালিক রাকেশরা। সঙ্গে ওর হেব্বি হ্যান্ডসাম চেহারা। রাকেশ কথায় ইম্প্রেস করতে পারত এমনটা নয়; কিন্তু ওর সঙ্গে বেরোলে ও পুরো কন্ট্রোলে নিয়ে নিত গোটা দুনিয়া। আমার কিছু নিয়েই চিন্তা করার দরকার পড়ত না। যখন আদর করতে শুরু করত রাকেশ, জায়গা-ফায়গা, কোথায় আছি না আছি, কিচ্ছু মানত না। ও বলত, ইউ আর মাইন। সো, হু বদারস।
এই হু বদারস ব্যাপারটায় একটু লজ্জা লাগত, আবার অসম্ভব অ্যাট্রাক্টও করত এটা আমায়। রাকেশ আমায় কয়েকদিন ভোরবেলায় পার্কে হাঁটতে নিয়ে গিয়েছিল। আর সে সময় আমাকে শিখিয়েছিল হাঁটা দেখে লোক চেনা যায় কীভাবে। পার্কে যারা কাউকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটছে তারা হলো গিয়ে বড় আমলা বা বিজনেসম্যান। যারা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, এগিয়ে এসে আলাপ করতে চাইছে তারা শিওর-শট দালাল কিংবা কোনো ধান্দায় এসেছে। যারা একেবারে সাধারণ তারা হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ছে আর সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখছে। সিরিয়াল যারা করে তারাও আড়চোখে দেখে নিচ্ছে, কতজন তাদের দেখছে বা দেখছে না। আর যারা আড়াল খুঁজছে তারা হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা। আমি, রাকেশের ওই পার্কে লোক চেনার ফরমুলা মেনে, পার্কের বাইরেও লোক চিনতে শুরু করেছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম যারা কাউকে পাত্তা দেয় না লোকে তাদেরই পাত্তা দেয়। ওই অ্যাটিটিউডটা নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম বলে অভীক মিত্র কী পড়াচ্ছে, শুনছিলামই না ভালো করে।
কিন্তু লোকটা কোথায় একটা টানতে শুরু করল জানিস। সাধারণ চেহারা, শ্যামলা গায়ের রং, মাঝারি হাইট কিন্তু কথাগুলো কিরকম মন্ত্রমুগ্ধ করে দিচ্ছিল। বৃষ্টি যেমন মাটির ভেতর ঢোকে, সেভাবে কথাগুলো আমার ভেতরে ঢুকছিল। কথার পৃথিবী থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, রাকেশ বনসালের সঙ্গে। আমার বাবা পছন্দই করছিল সেটা। লাইফ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সকালে ব্রেকফাস্ট, জিম, সুইমিং, কলেজ, তারপরে একটা ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্স, বিকেলে অ্যাপো। কিছুর মধ্যেই মনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু অভীক যখন, ‘টাইগার টাইগার বার্নিং ব্রাইট/ ইন দা ফরেস্টস অব দা নাইট’ পড়াতে গিয়ে বলে উঠল, বাঘ ভেড়াকে খাওয়ার জন্য আসেনি, বাঘ আসলে আমাদের অন্তরের ওই তুলতুলে ভেড়াটাকে, মানে ইনোসেন্সকে রক্ষা করার জন্যই আসে, আমার চোখের সামনে
ক্লাস-কলেজ-ব্লেক সব ঝাপসা হয়ে গেল, শুধু মাথার মধ্যে বাজতে থাকল, আমার যেটুকু নরম তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাকেই তো কঠিন হতে হবে। লোকটা বলে যাচ্ছিল, বাঘ ভেড়ার প্রতিস্পর্ধী নয়, সব হিংসাই পেলবতার বিরুদ্ধে নয়, বরং এই পৃথিবীতে পেলবতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই হিংসা দরকার একেক সময়। আমি ওই ‘প্রতিস্পর্ধী’ আর ‘পেলবতা’ শব্দ দুটো জীবনে প্রথম শুনলাম, হয়তো বাংলা মিডিয়াম থেকে যারা এসেছিল তাদের জন্য বলছিল অভীক, তবু কোথাও অনেক ইংলিশ ওয়ার্ডসের সঙ্গে মনে থেকে গেল ওরাও। যেমন মনে থাকল এএম-এর ক্লাস।
পরের একটা ক্লাসে ও পড়াচ্ছিল শেলির ‘স্কাইলার্ক’ আর আমার মনে হচ্ছিল, ওই ছোট্ট পাখিটা, পাখির গানটা যত উঁচুতে উঠছে আমার সমস্ত স্বপ্ন, সব ইচ্ছা আর অনুভূতিগুলো তত ওপরে উঠছে। আমি তো আজকের একটা মেয়ে। আমার অত ইমোশনাল হওয়ার দরকার ছিল না; কিন্তু লোকটার কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল যেন বাতাসের গায়েও সুর লাগিয়ে দিতে পারত। তাই হয়তো কথাগুলো বাজত আমার কানে। অভীক বলছিল, স্কাইলার্ক একা আর সে একার রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে। কারণ একার রাস্তার ওপরে কোনো ছাদ থাকে না, আকাশ থাকে। আমার গায়ে যেন কাঁটা দিলো কথাটা শুনে। মনে হলো, বাবা একটা ছাদ, রাকেশ বনসাল একটা ছাদ, আমার মাথার ওপরে কোনো আকাশ নেই। কিন্তু আকাশ তো আমার চাই। ওই পাখিটার মতোই। আমি তো শুধু একটা অবজেক্ট নই, আমি তো দুটো ডানাও। সিক্স প্যাক একটা শরীরের মাথাটা যদি থান ইট হয়, তাই নিয়ে কী করব আমি? ভাবতে ভাবতে ফোনটা সুইচ অফ করে দিয়ে একটা মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে গেলাম। ভুলভাল একটা সিনেমা দেখে, হালকা নেশা করে যখন বাড়ি ফিরেছি তখন রাত্রি সাড়ে দশটা।
ফিরে দেখলাম বাড়িতে সবার মুখ গম্ভীর। রাকেশের সঙ্গে আমার ডেট ছিল সেদিন। ও ফোনে না পেয়েও অনেকক্ষণ আমার জন্য ওয়েট করেছিল। তারপর আমার বাড়িতে এসে জানিয়েছে। বাবা তো আমাকে এই মারে কি সেই মারে। বলল যে, আর একটু দেখে থানায় যেত খবর নিতে। আমি জানি যে বাবা থানায় যেত না, বাবার যা নেটওয়ার্ক তাতে থানায় যাওয়ার দরকার পড়ত না। আরো জানি যে, বাবা বুঝতে পেরেছিল, আমার রাকেশের সঙ্গে ঘুরতে ইচ্ছা করছিল না বলেই আমি কোথাও সটকে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবাকে আমার সামনে নিজের ওয়েট রাখতে হবে বলে বাবা আমায় কথাগুলো শোনাল। কী করবে? বাবা তো স্কাইলার্ক নয়। আমিও নই তাই বললাম যে, মোবাইল খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে খবর দিতে পারিনি।
বাবা আমার উত্তর শুনে আর কোনো প্রশ্ন না করলেও রাকেশ পরদিন সকালে এসে জানতে চাইল, তোমার আর একটা মোবাইল কী হলো?
আমি জানতাম যে উত্তরে যদি বলি, ওটা নিয়ে বেরোইনি তাহলে পরের প্রশ্নটা হবে, তোমার বন্ধুর মোবাইল ছিল না? আমি তাই জবাবের বদলে নিজেকে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম; কিন্তু ও আমার হাতটা ধরামাত্র মনে হলো একটা কাঠের পুতুল আমাকে ধরেছে। ওর আধা হিন্দি, আধা ইংরেজি গোদা কথাগুলো শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, কখন আবার ওই কাঠের বেঞ্চিটায় গিয়ে বসব। কখন অভীক মিত্র আবার ক্লাস নিতে আসবে। আর সেদিন অভীকের অফ ডে ছিল না কামাই করল আমি জানি না শুধু জানি জীবনে প্রথমবার আমি কোনো একটা ক্লাস হলো না বলে দুঃখ পেলাম। ভাবছিলাম, কোথায় সেই লোকটা যে মুখের কথায়, পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আমার পৃথিবী বদলে দিতে পারে। ইউএসএতে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম রোদ উঠেছে হালকা করে আর তার মধ্য দিয়ে বরফ পড়ছে গুঁড়ো গুঁড়ো, সে যে কি অদ্ভুত দৃশ্য, হিরে গলে পড়ছে যেন চারদিকে। পরদিন যখন অভীকের ক্লাস করছি মনে হচ্ছিল ওর কথাগুলো যেন রোদের মধ্যে বরফের মতো মিশে যাচ্ছে। সেদিন ক্লাসের শেষে অন্বয় বলে একটা ছেলে আমায় বলল, এএম-এর কাছে প্রাইভেটে পড়বি?
টিউশন নিয়ে তখনই কিছু ভাবিনি কিন্তু অন্বয়ের কথা শুনে বুঝলাম যে, প্রাইভেটে ভর্তি হলে সপ্তাহে দুদিন এএম-এর কাছে যেতে পারব, ওর কথা শুনতে পারব। মনের মধ্যে একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেল। বললাম, হ্যাঁ, ডেফিনিটলি। কবে থেকে?
অন্বয় বলল, মুর্শিদকে নিজের ফোন নাম্বার দিয়েছে স্যার, বলেছে একটা গ্রুপ করতে। ব্যাপারটা বেশি কাউকে বলিস না এখন।
আমি হেসে ফেললাম, অন্বয়ের কথা শুনে। আর প্রথম দিন ওর বাড়ি গেলে, অভীক যখন বলছিল যে, অন্তত বারোজন না হলে একটা গ্রুপ শুরু করা যায় না তখন ভাবছিলাম একবার জিজ্ঞেস করি, বারোজন মিলে যত টাকা দেবে সেই টাকাটাই যদি আমি একা দিয়ে দিই তাহলে পারব সপ্তাহে দুদিন একা ক্লাস করতে?
কে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ফর্মালিটিস কী’ আর উত্তরে অভীক বলল, ‘ছশো’। আমার একটু কমই লাগল। আমি ভেবেছিলাম, হাজার-দু-হাজার বলবে। এত ভালো পড়ায় যে-লোকটা তার মাত্র ছশো টাকা রেট?
‘রেট’ শব্দটা কী খারাপ না? কিন্তু সবাই ওই শব্দটাই ব্যবহার করছিল বাইরে বেরিয়ে। একজন বলছিল, পাঁচশো হলে ভালো হতো, আর একজন বলছিল, স্যারের কাছে পড়ছে না এমন কারো সঙ্গে নোটস ভাগ করে নিলে তিনশো করে পড়বে। আমার যে কী বাজে লাগছিল; শুধু ভাবছিলাম, কীভাবে অভীকের কাছে একা ক্লাস করা যায়, সবটাকে ভাগিয়ে?
যেভাবে ভাবি সেভাবে তো আর হয় না কিছু, তাই নয়জনকে নিয়ে শুরু হলো ক্লাস, তারপর বারো না তেরোয় গিয়ে দাঁড়াল। তবু ওই অতজনের মধ্যে বসে থাকলেও আমি অন্য কারো প্রেজেন্স ফিল করতাম না। মনে হতো অভীক আর আমার মধ্যে শুধু একটা শব্দের নদী আর কেউ কোত্থাও নেই, কিচ্ছু নেই। কথা দিয়ে একটা পৃথিবী তৈরি করে দিতে পারত লোকটা। আর আমার বাড়িতে তো কেউ কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলত না, যে যার নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত, তাই ওই যে ওকে একটা প্রশ্ন করলেই এক প্যারাগ্রাফ উত্তর পাওয়া যেত, সেটা খুব মুগ্ধ করত আমাকে। আমি সেই কথাগুলো আলাদা করে এক্সপ্লেন করতে পারব না। তোরাও জানিস, তোরাও নিশ্চয়ই শুনেছিস কিন্তু সেগুলো এমনভাবে কানে বাজত যেন বাঁশির ডাক শুনছি। আচ্ছা, বাঁশির ডাক কী আসলে কথা দিয়েই তৈরি? নইলে কেন মনে হতো যে শব্দের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি আমি, কোথাও কোনো ট্র্যাফিক নেই। শেলি থেকে শেক্সপিয়র, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে। ছোটবেলায় শোনা গানটা নতুন করে ফিল করেছিলাম, অভীকের কাছে পড়ার সময়।
অভীক কথা দিয়ে ওরকম ম্যাজিক করত বলেই হয়তো রাকেশের সঙ্গে থাকতে ক্লান্ত লাগত আমার। কারণ ওর কথা মানেই তো, কোন শেয়ারের দাম বাড়ল, কোনটার কমল, কোন রিসোর্ট থেকে একদিন ঘুরে আসা যায়, এইসব। ওকে চুপ করানোর জন্য আমি আমার শরীরটাকে এগিয়ে দিতাম, অনেক সময়। রাহুল ওয়াজ এ গুড পারফর্মার, ইউ নো। দ্যাখ এখন, ভার্জিনিটি ইজ নট সাচ আ বিগ থিং সো, আমি ভার্জিন এসব বলে, ন্যাকামি করব না। সত্যি বলতে, আই হ্যাড সেক্স উইথ রাহুল, নিউমারাস টাইমস। কিন্তু অভীককে দেখার আগে আমি ওই ইন্টিমেসি থেকে যতটা আনন্দ পেতাম, পরে ঠিক ততটা নয়। কী করব, তখনো মাথার মধ্যে
কথাগুলো বেজে উঠত যে।
একদিন অভীক বলছিল, ইফ ইমোশন ইজ আ মার্কেট, ওয়ার্ডস আর মানি। কী মারাত্মক না কথাটা? অনুভূতি যদি একটা বাজার হয় তবে কথাই তো সেই বাজারের পয়সা! আমি সেই অনুভূতির বাজারটায় চলে গিয়েছিলাম, যেখানে আমাকে কথা দিয়ে কিনে ফেলা যায়; কথা দিয়েই বিক্রি করা যায় আবার। তাই বলে কি ফি দিতাম না? একবার কী করেছিলাম জানিস, ইচ্ছা করে ছয়শোর বদলে হাজার টাকা ভরে দিয়েছিলাম খামে।
কিন্তু পরের ক্লাসে অভীক আমায় বলল, তুমি বোধহয় দুমাসেরটা একবারে দিয়ে দিয়েছ না? ওখানে দুশো কম আছে। আমার এত বাজে লেগেছিল ওই মোমেন্টে। মনে হয়েছিল, স্যার এটা খেয়াল করল? তারপর ভাবলাম, এটা হয়তো স্যারের সততা। আমি তো চেয়েছিলাম স্যারকে একটু বেশি দিতে। সেটা তো ওকে ভালোবেসে বা আদর করে দিতে পারছিলাম না, তাই ওভাবে দিতে গিয়েছিলাম। সেটা হয়তো বুঝতে পারেনি।
কয়েকদিন পরে গোলপার্কে একটা কফি-শপ থেকে বেরোনোর সময় আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্যারের। তখন আমার সঙ্গে রাকেশ। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, দিস ইজ রাকেশ, মাই ফ্রেন্ড।
রাকেশ আগ বাড়িয়ে বলল, বয়ফ্রেন্ড বলো।
অভীক অদ্ভুত চোখে তাকাল তারপর একটু নড করে সরে গেল।
আমার খারাপ লাগল। আমি রাকেশকে বললাম, তোমার অত কথা বলার কী দরকার ছিল?
রাকেশ বলল, ছুপায়েঙ্গে কিঁউ?
রাকেশের সঙ্গে অসম্ভব ঝগড়া হচ্ছিল সেদিন, ঝগড়া হচ্ছিল কমিউনিকেশন গ্যাপ থেকে। আমি ওকে বোঝাতে পারছিলাম না, হাজারবার সেক্স করার পরও মানুষ স্যাটিসফায়েড হতে পারে না, তার একটু মন-ছোঁয়া কথার দরকার হয়।
সেই কথার লোভেই তো অভীকের কাছে যেতে ইচ্ছা করত বারবার। কিছুতেই কোনো ক্লাস মিস করতাম না। তাই নিয়ে রাকেশের সঙ্গে তুমুল শো ডাউন হলো একদিন। ও আমাকে ছাড়বে না আর আমি স্যারের কাছে যাবই। নোংরা ইঙ্গিত করল রাকেশ হঠাৎ আর আমি সামলাতে না পেরে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। ব্যস, রাকেশের ভেতরের ফিউডাল, সেক্সিস্ট, মাতব্বরটা বেরিয়ে এলো। আমার চুলটা খিমচে ধরে চিৎকার করে উঠল, শালি, ফাড় দেঙ্গে তুজকো।
আমার ব্যথা লাগছিল বলে চেঁচিয়ে উঠলাম, লিভ মি, ইউ ব্রুট।
রাকেশ জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোকে আর দরকার নেই। মেরে জিন্দেগি মে কোই অর আ গয়ি হ্যায়। তোর ওই স্যার জরুর তোকে বলে দিয়েছে এতদিনে, হোয়াট আই ওয়াজ ডুইং। উসনে সাচ হি বাতায়া। এষা ইজ বেটার দ্যান ইউ ইন এভরি ওয়ে।
রাকেশ কী বলছিল আমি কিছু বুঝতে পারিনি প্রথমটা। শুনতে শুনতে ওর কথার মর্মোদ্ধার করলাম। ও একদিন কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসে এষাকে চটকাচ্ছিল। খুব একটা হাই-ফাই কিছু নয় কিন্তু বেশ আলো-আঁধারি আছে। তো সেখানে নাকি খেতে ঢুকেছিল অভীক। ওই অল্প আলোতেও অভীক রাকেশকে চিনতে পেরে হাঁ হয়ে তাকিয়েছিল। রাকেশ তখন এষাকে কোলে তুলে নিয়েছে আর ওর হাত এষার বুক-পেট-গলায় চরকি কাটছে।
রাকেশের মুখ থেকেই শুনছিলাম কথাগুলো। জানি না, আমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য ও বাড়িয়ে বলছিল কি না কিন্তু আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম না। বরং ওর ওই বর্ণনা আমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কানে ঢুকছিল শুধু সেই জায়গাটা, যেখানে ও বলছিল, তেরি স্যার তুজপে ফিদা হ্যায়। শালা এমনভাবে দেখছিল যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে আমাকে। কী আনন্দ যে হচ্ছিল আমার সেই মুহূর্তে। আছে, অভীক মিত্রের আমার প্রতি কনসার্ন আছে। তাই ও রেগে গিয়েছিল রাকেশকে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে নষ্টামি করতে দেখে।
– আমার ছেলের অভাব পড়েনি, ইউ গো টু হেল, বলে আমি রাকেশের দিকে একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে এগিয়ে এলাম। আর গোটা রাস্তা অভীকের বলা একটা কথা ঘুরতে লাগল মাথায়। অভীক একদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি ব্রোঞ্জের চুড়ি দেখেছ?
ক্লাসের সবার আগে আমি গিয়ে বসে থাকতাম বলে রোজ পাঁচ-দশ মিনিট অভীককে আমার সঙ্গে কথা বলতেই হতো। সেরকমই একটা সময়ে ওর ওই প্রশ্ন।
আমাদের বাড়িতে কারো ব্রোঞ্জের চুড়ি পরার রেওয়াজ ছিল না। তা হোক, ব্রোঞ্জের চুড়ি আমি দেখেছি। তাই ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
অভীক একটু থেমে থেমে বলল, ওই চুড়িগুলোয় বারো আনা ব্রোঞ্জ আর চার আনা সোনা। কিন্তু ওই অল্প সোনা যখন অনেকখানি ব্রোঞ্জের সঙ্গে মেশে তখন কিন্তু সোনার রংটাই ব্রোঞ্জের রং হয়ে যায়। ব্রোঞ্জের রং আলাদা করে আর দেখা যায় না।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভীকের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অভীক বলে গেল, একইভাবে পৃথিবীর সব কুশ্রিতার গায়ে যখন সুন্দরের স্পর্শ লাগে তখন কুশ্রীতা আড়ালে চলে যায়, সুন্দরই শুধু জেগে থাকে সোনার মতো।
রাকেশের সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে যাওয়া সন্ধ্যাটায় তেমন করেই রাকেশের গালাগালি কিংবা মার আমার মনের কোনো অতলে হারিয়ে গেল, জেগে রইল শুধু সেই অমোঘ সত্য, অভীক আমার ব্যাপারে উদাসীন নয়।
আমার মনে হচ্ছিল, এই কুৎসিত পৃথিবীতে অভীক মিত্রের ওই জিভটাই হচ্ছে সেই পরশপাথর, যা থেকে ক্রমাগত সোনা জন্ম নেয়। সেই সোনার জন্য পাগল হয়ে উঠলাম আমি। আর পাগল হয়ে উঠেছিলাম বলেই কয়েকদিন পরের সেই টানা বৃষ্টিতে যখন কলকাতা ভাসছে তখনো অভীকের ক্লাস মিস করার কথা ভাবতে পারিনি।
মুষলধারে বৃষ্টি সেদিনও। তার মধ্যেই আমি গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজায় বেল টিপতে, অভীকের বউদি এসে দরজা খুলল। আমি ততদিনে জেনে গেছি যে, দাদা-বউদির সংসারে একটা ঘর নিয়ে থাকা অভীক, ফুলটাইম প্রফেসর নয়, কন্ট্র্যাকচুয়াল হোলটাইমার। কত টাকাই বা মাইনে পায়? তেইশ-চব্বিশ, ম্যাক্সিমাম। আমার প্রতিমাসের পকেট মানি তার থেকে বেশি। কিন্তু সেসব কিছুই আমার মাথায় নেই তখন। ব্রোঞ্জের ওপরের সোনা আমায় টানছে।
ওর বউদি একটু বিরক্ত হলো, আমি বুঝলাম। ওই বৃষ্টিতে কেউ আসবে না ভেবেই হয়তো ঘুমোচ্ছিল অভীক। আমি গিয়ে বসতে একটা হাতকাটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা পরে সামনে এসে দাঁড়াল, চোখ কচলাতে কচলাতে। বলল, আজ তো কেউ আসেনি, আজ ক্লাস সাসপেন্ডেড।
আমি বললাম, আমি এসেছি, আমি ক্লাস করব স্যার।
– না, আর একটা দিন তো ক্লাস নিতেই হবে আমাকে, তাই আজকে আর নেব না। নেক্সট শিডিউল্ড ক্লাসের আগে কিংবা পরে ডেট দেব আমি।
– মাসে আটদিনের বদলে নয়দিন ক্লাস হলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? অসম্ভব রাগ থেকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
– কী বলছ, আমি বুঝতে পারছি না। অভীক বোকা বোকা মুখ করে বলল।
এই বৃষ্টির মধ্যে কতটা উন্মুখ হলেই একটা মেয়ে এভাবে ক্লাস করতে ছুটে আসতে পারে, সেটা অভীক বুঝতে পারছে না? বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না আমার। আমি ওর দিকে, যাকে বলে, ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে বললাম, আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। হাফ-অ্যান-আওয়ারের একটা ক্লাস হলেও চলবে স্যার।
আমার তাকানোয় এমন কিছু নিশ্চয়ই ছিল যে, অভীক আর ফেরাতে পারল না আমাকে। নিজের ঘরে নিয়ে এসে বসাল। আমি সেদিন একা ছাত্রী বলেই বোধহয় ওর বউদি একবার এসে ঘুরে গেল অভীকের ঘর থেকে। একবার নক করার ভদ্রতাটুকু না দেখিয়ে। আমার মনে হলো ভদ্রমহিলার মাথায় বাবার রিভলবারটা চেপে ধরে ট্রিগার টেনে দিই। কিন্তু উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অভীকের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলাম।
অভীক জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, আমার কোথায় অসুবিধে কিন্তু তার আগেই আমি ওর ডানহাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আমার বুকের ওপর প্লেস করে দিলাম। আর বলতে থাকলাম, আপনি বোঝেন না? আপনি যখন কথা বলতে শুরু করেন, তখন আমার নাড়িভুঁড়ি সব মাথায় উঠে যায় আর মাথায় যা ছিল সব নেমে আসে নিচে। মনে হয় পৃথিবীটা উলটোদিকে পাক খাচ্ছে আর আমি সামনের দিকে একটা স্টেপ ফেললে, পেছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এক পা। তারপরও আপনি বোঝেন না?
অভীকের মুখটা থেকে কেউ সবটুকু রক্ত শুষে নিয়েছিল। একদম ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, আমি কি তোমার কথা বলা পুতুল?
– পুতুল কেন হবেন? কথা বলা মানুষ কিংবা কথা বলা ভগবান। আমার, শুধু আমার, কথা বলা ভগবান।
– এসব বলো না, শুনলেও পাপ।
– একটুও পাপ নয়। পাপ তো তখন, যখন আপনি আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে অন্য মেয়ের সঙ্গে বদামি করতে দেখেও আমায় বলেন না।
– এক্স হয়ে গেছে?
– হ্যাঁ। ভালো লাগল শুনে?
– আমার ভালোলাগার কী আছে?
– নেই কেন? আপনি একটা পুরুষ মানুষ না? আর আমি কি দেখতে খারাপ?
– খারাপ হবে কেন? কত স্মার্ট, কত সুন্দর তুমি। কিন্তু দ্যাখো একটা কলেজে পড়াই আমি। আর সেখানে হাজারও নিয়মকানুন…
– তাতে কী? হু ইজ গোয়িং টু চার্জ ইউ? কার ক্ষমতা আছে?
– ব্যাপারটা তা নয়…
– ব্যাপারটা কী, আমি পরে বুঝব। আগে বলুন, যা দেখেছিলেন আমায় বলেননি কেন?
– ভেবেছিলাম বলব। বিশ্বাস করো, প্রেমাঞ্জনা।
– এই যে নামটা এইমাত্র উচ্চারণ করলেন, এটা আমার দিদিমার দেওয়া। আর খুব সার্থক নাম দিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা আমার। আমি প্রেমেই বাঁচি। লোকে যেমন টাকা দিয়ে মাপে, আমি প্রেম দিয়েই গোটা পৃথিবীটাকে মাপি। এবার যার সঙ্গে আমার প্রেম ছিল বলে আপনি ভাবতেন, সেই ছেলেটা আমায় চিট করছে দেখেও আপনি আমায় সতর্ক করলেন না?
– বললে যদি তুমি আমায় খারাপ ভাবতে। মনে করতে, আমি ডিজায়ার করি তোমাকে, তাই তোমার প্রেমটা ভাঙতে চাইছি?
– আপনি এত ভীতু কেন? আপনার ডিজায়ার থাকতে পারে না আমার প্রতি? আমি যদি ওই খারাপ ছেলেটার সঙ্গেই থেকে যেতাম, আপনি শান্তি পেতেন?
– আমার ভুল হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম তোমায় বলব, ওই ছেলেটার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রেখো না।
– বলেননি, ঠিক আছে। এখন একবার বলুন।
– আর কী বলব? তুমি তো জেনেই গেছ।
– ইয়েস, জেনে গেছি। রাকেশ ভেবেছে আপনি আমাকে বলে দিয়েছেন। ও ভাবতে পারেনি যে, আপনি কাপুরুষতায় গোল্ড মেডেল পেয়েছেন বলে আমাকে বলার মতো সাহস পাননি। কিন্তু এখন একবার আপনাকে বলতে হবে। বলতে হবে, প্রেমাঞ্জনা কাম আউট অব দিস শ্যাবি রিলেশনশিপ।
– বেরিয়ে তো তুমি এসেছই।
– তবু আপনাকে একবার বলতে হবে। ইউ হ্যাভ টু।
অভীক ইশারায় গলা নামাতে বলল আমায়।
– কেন, আস্তে কেন? আপনার নিজের একটা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষমতা নেই? যদি না থাকে তো আমার সঙ্গে আমার ফ্ল্যাটে
থাকবেন। মাইন্ড ইট, আমার বাবার বাড়ি নয়। একটা নতুন ফ্ল্যাট। আই উইল বাই দ্যাট ফর ইউ অ্যান্ড মি।
– তুমি কী বলছ? একটু শান্ত হও।
– না, শান্ত হব না। আর শোনো, অত আপনি-আজ্ঞে করতে পারছি না। ইনফ্যাক্ট, স্যারও বলতে পারছি না, ‘তুমি’ করে বলব তোমায়? ওকে?
অভীক কোনো জবাব না দিয়ে বলল, প্রেমাঞ্জনা তুমি বেরিয়ে এসো।
– না ওভাবে নয়। একটু প্যাশন দিয়ে। অ্যান্ড আস্ক মি টু কাম টু ইউ।
– বলতে চাইছি, কিন্তু পারছি না।
– কেন পারছ না? ইংরেজি ভুলে গেছ নাকি? তেমন হলে, বাংলায় বলো।
– তুমি ওই ছেলেটাকে ছেড়ে চলে এসো।
– কোথায় আসব?
– আমার কাছে এসো। অভীক বেশ খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে বলল, বোঝা গেল।
– আমার নামটা বলুন।
– প্রেমাঞ্জনা আমার কাছে এসো।
আমি সেই মুহূর্তে ওর খাটের এধার থেকে ওধারে গিয়ে ওর মুখটা আমার হাতের মধ্যে নিয়ে একটা সলিড কিস করলাম অভীককে। তখন, হাওয়ায় ওর ঘরের পর্দা উড়ে যেতে পারত। কিন্তু, ‘কী হতে হবে’ যখন মাথার দখল নিয়ে ফেলে তখন, ‘কী হতে পারত’ আর খেয়াল থাকে না। আমারও ছিল না। অত প্যাশনেটলি চুমু আমি বোধহয় জীবনেই কাউকে খাইনি আর। দীপ্রর ক্ষেত্রে কিছুটা আর রাকেশের সময় পুরোপুরি, দে ওয়্যার ইন চার্জ। কিন্তু সেদিন বিকেলে, আমিই যেন পুরুষ আর অভীক যেন 888sport promo code।
প্রথমটায় ও স্টিফ হয়ে ছিল। পরে সাড়া দিতে শুরু করল। একসময় জড়িয়ে ধরল আমাকে।
আমি ওই চুমুর সময়ই ডিসাইড করে নিয়েছিলাম, নো ম্যাটার হোয়াট হ্যাপেন্স, অভীকের সঙ্গেই থাকব। সেদিন ফেরার সময় ওর খাতাটা, যে-খাতাটায় ও সব নোট লিখে রাখত, যে-খাতাটা দেখে পড়াত, সেই খাতাটা ওকে কিছু না বলে নিয়ে এলাম। খুব ইচ্ছা করছিল, খাতাটা রাতে বুকের ওপর নিয়ে ঘুমোব। কাল বা পরশু ফেরত দিয়ে যাব।
সত্যি সত্যিই খাতাটা নিয়ে আমি ঘুমিয়েছিলাম সেই রাতটা। ঘুমিয়েছিলাম না জেগে ছিলাম জানি না, চোখ খুললে বা বন্ধ করলে দেখতে পাচ্ছিলাম, শেলি, কিটস, শেক্সপিয়র সবাই হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে, কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। রাতে একটু নেশা করেছিলাম, পরদিন নেশা কেটে গেলেও খাতাটার নেশা কাটল না। লেবু চায়ে চুমুক দিয়ে পাতার পর পাতা উলটে যেতে থাকলাম। একটা পাতায় এসে আমার চোখ আটকে গেল। কই, কাল এই পাতাটা দেখতে পাইনি তো। সেখানে সব স্টুডেন্টদের নাম লেখা। দেবালয়, পাশে ব্র্যাকেট করে লেখা, দুমাস ডিউ; প্রিয়া পাশে ব্র্যাকেটে, এক মাস ডিউ, নিচে স্টার দিয়ে লেখা, মাছের বাজার। আরো দু-তিনজনের নামের পাশে সবজি বাজার, ঘর রং ইত্যাদি নানান জিনিস লেখা। এমনকি আমার নামের পাশে লেখা, পেড ইন অ্যাডভান্স, পুজোয় নতুন জুতো…
আশ্চর্য! লোকটা এভাবে কমোডিফাই করেছে সবাইকে, ইনক্লুডিং মি? আমার মাইনের টাকা দিয়ে ও নতুন জুতো কিনবে আর সেটাই ঘটা করে লিখে রেখেছে? ও তার মানে আমাকেও একটা মানুষ হিসেবে ভাবে না, ভাবে শুধু জীবিকার একটা উপায় হিসেবে। যে শব্দগুলো ও তৈরি করে, সেই শব্দগুলোর বিনিময়ে ও শুধু
আলু-মুলো-পটোল-মাছ-জুতো-মোজা-রং, এসবের জন্যই চায়?
ছিঃ ছিঃ এ কাকে ভালোবাসলাম আমি। ইচ্ছা হলো খাতাটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু ওই খাতা থেকেই ওর রুজি-রোজগার তাই থমকে গেলাম। আর সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম, প্রেম গরিবের জন্য নয়, তারা প্রেমের অভিনয় করতে পারে মাত্র। পেটের খিদে না মিটলে মানুষ হৃদয়ের টান ফিল করবে কেমন করে। আমি খাতাটাকে সেদিন দু-অর্ধেক করে ছিঁড়লাম যাতে ও আবার জুড়ে নিতে পারে আর তিনদিন পর ওর ঘরে গিয়ে খাতাটা ছুড়লাম ওর দিকে, একটা খামসমেত।
অভীক ওই ছেঁড়া খাতাটা হাতে পেয়ে যেন স্বর্গ পেল। বলল, তোমার কাছে ছিল?
আমি বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু আমি আর পড়তে আসব না। তাই বলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। গোটা সেশনের জন্য ভর্তি হয়েছিলাম, পুরোটার টাকাই আপনি পাবেন। ওই খামটা খুলে গুনে নেবেন।
অভীক, কেন পড়তে আসব না ইত্যাদি কোনো প্রশ্ন না করে জিজ্ঞেস করল, আমায় আবার ‘আপনি’ করে বলছ?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই অন্য ব্যাচের দুজন স্টুডেন্ট ঢুকে গেল। মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলে যাওয়ার আগে যেভাবে নিজের ঘরবাড়ির দিকে তাকায়, সেভাবে অভীক একবার তাকাল আমার দিকে। আমি ওকে ধ্বংস করে দিয়ে যাচ্ছি বুঝলাম। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। ওই সবজি বাজার কিংবা মাছের বাজারের সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গি মিলত না।
বাবা বলে, টালির বাড়িতে দুর্মূল্য পেইন্টিং টাঙানো যায় না। কথাটার মানে চাবুকের মতো আছড়ে পড়তে লাগল, আমার মুখে। প্রেম কি তা বোঝার জন্য একটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে হয় জীবনে। ওই দাদা-বউদির সংসারে, একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা পরে থাকা লোকটা সেটা পারবে না। ওর যত বিপ্লব, যাবতীয় প্রেম, সব ওর জিভে; জিভ থেকে সঞ্চারিত হয়ে তা জীবনে আসবে না কখনো। ওর হাত আমাকে কমোডিফাই করেছে। আমাকে একটা দ্রব্য হিসেবে ভেবেছে। আমি ওর জীবনে একটা ছয়শো টাকা বা বারোশো টাকার প্রয়োজন মাত্র। আর আমি যেমন প্রেমের নিয়মে বাঁচি, অভীক তেমনই প্রয়োজনের নিয়মে বাঁচে বলে ওর আর আমার মধ্যে কোনো সেতু তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।
তারপরে ও কত মেসেজ করেছে আমায়। ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। সেই মেসেজগুলোতে শুধু ফিরে আসার অনুরোধ, যেগুলো ভিক্ষের চেহারা নিত সময় সময়। তার পাশাপাশি একটা চাপা ভয়ও যেন থাকত। ওর কন্ট্র্যাকচুয়াল চাকরি, কেউ কোনো কমপ্লেইন করলে, কলেজ ওকে ছাড়িয়ে দিতে পারে, এইসব লেখার মানে কী নইলে? আমি একদিন না পেরে লিখেছিলাম, যে ইনিশিয়েটিভ আমি নিয়েছি তা নিয়ে আমি অন্তত কিছু বলতে যাব না। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
তারপর থেকে আর ওর কোনো মেসেজের রিপ্লাই দিইনি। পাঠাতে পাঠাতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল একসময়। থেমে গিয়েছিল। আমিও আগুন খুঁচিয়ে দিইনি। বাড়ি তো দূরস্থান, কলেজেও ওর ক্লাস করতাম না আর। দু-একবার মুখোমুখি পড়ে গেলেও ‘এক্সকিউজ মি’ বলে বেরিয়ে গেছি। অভীক করুণ মুখ করে তাকিয়ে থাকত, কিছু বলতে পারত না আমায়। কী বলবে?
কিন্তু এখন খানিকটা আফসোস হয় ব্যাপারটার জন্য। মনে হয় অভীকের বলা অনেক কথা মিস করে গেছি, যেগুলো মাথার মধ্যে থাকলে মন্দ হতো না। মনে হয়, ও বোধহয় অপেক্ষা করছিল, কখন আমি ফিরে যাব তার জন্য। কেন ফালতু ফালতু ওর অতগুলো ক্লাস বাঙ্ক করলাম, নিজেকে বঞ্চিত করলাম, খারাপ লাগে ভাবলে।
আমার ওই একদিনের চুমুটা, ওই একদিনের ভালোবাসাটা, শুধুই তো একদিনের নয়। তা হলে একদিনের একটা বিচারই বা ফাইনাল হবে কেন? বুঝতে পারি কোথাও একটা একতরফা রায় দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু যখন বুঝলাম তখন সম্পর্কটার ফাঁসি হয়ে গেছে। ইদানীং খুব মনে পড়ে। আর যখন মনে পড়ে তখনই কে যেন কানে কানে জিজ্ঞাসা করে যায়, মিস করছ কেন, অভীক মিত্র তো জাস্ট আর একটা লোক।
যে বলে যায় আমি তাকে চিনি না, তবু বিড়বিড় করে বলে, আর একটা লোক নয়, অ্যাট টাইমস, অভীক ঈশ্বরই। এমন একজন ঈশ্বর যে আমার পৃথিবীটা তৈরি করছিল। কিন্তু তৈরি করার আগেই মারা গেছে।

– ও পড়ায় যখন তখন তো টাকা নেবেই। টাকার বিনিময়েই তো লেবার দিচ্ছে। তাতে এত রেগে যাওয়ার কী আছে? দলমা বলল।
– ও পড়িয়ে টাকা নেয়, তাতে কোনো প্রবলেম ছিল না আমার। টাকা ইজ এসেনশিয়াল। আমার প্রবলেম হচ্ছিল, ওই অ্যাটিটিউডটার জন্য। আমার নামের পাশে কেউ যদি সবজি বাজার বা নতুন জুতো লিখে রাখে, আমি তো তার সঙ্গে থাকতে পারি না, তাই না? প্রেমাঞ্জনা একটু হাসল।
– ফার্স্ট অব অল, ওই খাতাটা তোর চুরি করে নিয়ে এসে দেখার কথা না। সেকেন্ডলি, সবজিটাও জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইউ মাস্ট অ্যাডমিট। তোর্সা বলল।
হেসে উঠল সবাই। খাবার গরম করার নাম করে, হঠাৎ এসে পড়া কান্নাটাকে লুকোতে গেল প্রেমাঞ্জনা।
– এবার কার পালা? হিয়া জিজ্ঞেস করল।
– হিয়া বলুক। দলমা বলল।
– আমরা দুজন সিনিয়র, আর দুজন জুনিয়র। একজন সিনিয়রের পর একজন জুনিয়র বলুক তার পরে আবার আমি। হিয়া বলল।
– এক বছরের ডিফারেন্সে সিনিয়র আর জুনিয়র হয় না। তবু তোরা চাইলে আমি শুরু করতে পারি। তোর্সা বলল।
প্লিজ স্টার্ট। তবে খেতে খেতে। খাবার হাতে ফিরে এসে প্রেমাঞ্জনা বলল।
– একদম নয়। খেয়ে নিয়ে শুরু করবে তোর্সা। নইলে গলায় লাগবে। দলমা বলল।
– হ্যাঁ, পুরনো প্রেমের কাঁটা বলে কথা। হিয়া বলল।
খেতে খেতেই সবাই হেসে উঠল। শুধু তোর্সা, হয়তোবা পুরনো অনেক কিছু রিওয়াইন্ড করছিল বলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

তোর্সা
আমি অত ভালো স্টুডেন্ট নই। তাও যেটুকু ছিলাম, ইলেভেন-টুয়েলভ থেকেই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। কারণ সবাই বলত আমায় সুন্দর দেখতে। আর আমি সেটা মনে মনে বিশ্বাস করতাম। বিশ্বাস করানোর পেছনে আমার মায়ের একটা ভূমিকা ছিল। মা আমাকে কনস্ট্যান্টলি বোঝাত যে, আমি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা, আমার লুকসের জন্য। ওই সময় থেকেই সিরিয়ালের রোল পাওয়ার জন্য মায়ের হাত ধরে এই স্টুডিও থেকে ওই স্টুডিও ঘুরতে আরম্ভ করি। চান্স পেয়েছিলাম একটা-দুটোয় কিন্তু পাইনি যেগুলোতে তার 888sport free bet অনেক বেশি। আসলে শুধুই প্রশংসা থেকে আমি দুম করে শুধুই কমপিটিশনের ভেতরে গিয়ে পড়েছিলাম। আর সেখানে জিতের থেকে হার বেশি হলো বলে বুঝছিলাম, শুধু দেখা দিয়ে কিছু হয় না। আজকের দুনিয়ায়, সাজগোজ, মেকওভারের দৌলতে কেউ আর দেখার নিরিখে কারো থেকে কম নয় খুব একটা। তাই জেতা-হারা নির্ভর করে কে কতটা স্মার্ট আর ড্যাশিং তার ওপরে।
একবার একটা রিয়েলিটি শোর অডিশনে আর একটা মেয়ে নিজের স্কার্ট অনেকখানি তুলে দেখাচ্ছিল। ও সিলেক্ট হতেই মা আমাকে বলল যে, আমিও যেন ঠিক ওর কায়দা নিই। কিন্তু আমি পারলাম না, নিজেকে অতটা এক্সপোজ করতে। পারলাম না বলেই হয়তো রিজেক্টেড হয়ে গেলাম আর ফেরার পথে ভিড় একটা বাসে মায়ের বকবক শুনতে শুনতে টের পেয়ে গেলাম যে, জিততে গেলে মর‌্যালিটির দোহাই পাড়লে চলবে না। মর‌্যালিটি এই বাসের ভিড়টার জন্য। এসি গাড়িতে যে চড়তে চায় তার ন্যায়-অন্যায় বিচার করলে চলবে না।
এই বোধটা থেকেই আমার দেখার চোখ পালটে গেল। উইনার আর লুজারের মধ্যে ফারাক যেহেতু খুব কম এখানে তাই এক ইঞ্চি জমিও কাউকে ছাড়া যাবে না, সে-ই কথাটাই পাক খেতে লাগল মাথায়। পরিবর্তনের ফল অবশ্য জলদিই পেলাম। একটা সিরিয়ালে প্যারালাল লিড রোল। দুই বোনের গল্পে, আমি এক বোন। ডিরেক্টরের কথামতো যে দারুণ অ্যাক্টিং করবে, সে-ই হিরোইন এখানে। যে ততটা ভালো পারবে না, সে সেকেন্ড লিড। তখন আমার এইচএসসি পরীক্ষা সামনে। কিন্তু আমি ড্রপ দিয়ে দিলাম আগুপিছু চিন্তা না করে। আসলে তখন রাস্তার হোর্ডিংয়ে-হোর্ডিংয়ে আমার ছবি, আমি অটোয় উঠলে পাশের মহিলা বা লোকটা হাঁ করে তাকাচ্ছে আমার দিকে, কেমন একটা সপ্তম স্বর্গে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, এবার তো হোর্ডিংগুলোয় আমি দুজনের একজন কিন্তু শিগগিরই একা আমার বিরাট কাটআউট থাকবে শহরের সব জায়গায়।
অভিনয় আমি খারাপ করিনি কিন্তু কপাল বলো আর যাই বলো, সিরিয়ালটা চলল না। গল্পটা জমেনি, হিরোটা অখাদ্য ছিল। আমার প্যারালালে যে-মেয়েটা ছিল, সুমেলি, একটা মডেলিং অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে মুম্বাই চলে গেল, ফাঁপরে পড়লাম আমি। কদিন আগেও যাকে দেখে অনেকে অটোগ্রাফ চাইত, তার দিকে তাকিয়েই যদি অজস্র লোক জানতে চায় যে, সে হঠাৎ পর্দা থেকে ভ্যানিশ করে গেল কেন, কী উত্তর দেবে সে? প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম অন্য কোথাও একটা রোল পেতে কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটা সিরিয়ালেই যেহেতু ‘ফ্রেশ ফেস’ প্রেফার করা হয় তাই আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরগুলো যে চোখে তাকাচ্ছিল তার একটাই মানে, ‘এই মালটা তো এঁটো হয়ে গেছে’।
প্রশ্নগুলো খুব তাড়াতাড়ি হাসিঠাট্টায় বদলে রিলেটিভদের গেট-টুগেদার কিংবা বন্ধুদের আড্ডায়, আমি একটা হাসির খোরাকে পরিণত হলাম। আর সেই চাপটা সহ্য করতে না পেরে নার্ভাস ব্রেকডাউন হলো আমার। একটা বছর নষ্ট হলো। কিন্তু সেই বছরটার ভেতরেই ভাবনায় একটা বদলও এলো। মায়ের উন্মাদনার শরিক না হয়ে বাবার কথাগুলোকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করলাম। মনে হলো, একটা মিনিমাম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে, জিন্দেগি-ভর লাথ খেয়ে ফিরতে হবে। কারণ গ্ল্যামারের অনেক আলো থাকতে পারে কিন্তু কোনো ভরসা নেই। খেটেখুটে পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট মোটামুটি হলো। তবু একদম সব হারাতে বসেছিলাম বলে, যখন এই কলেজে ইংলিশ অনার্সে ভর্তি হলাম তখন মনটা খুশি হয়ে গেল। কেন হবে না? অভিনয় হোক না হোক, গ্র্যাজুয়েশন করে বেরোলে অনেক দরজা খোলা। হোটেল বা হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে যেতে পারি, এয়ার-হোস্টেস হতে পারি।
নতুন কতগুলো স্বপ্নের তাগিদেই পড়াশোনায় মন দিলাম। আর দিলাম বলেই মনের মধ্যে এএম-এর ছাপটাও পড়ল। প্রথম যেদিন কলেজে গেলাম সেদিন ওর ক্লাস ছিল না, আমি ওকে পেয়েছিলাম দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন। প্রথম ক্লাসটায় তেমন কিছু মনে হয়নি কিন্তু পরের ক্লাসটাতেই জমিয়ে দিলো লোকটা। ‘রেস্টোরেশন পিরিয়ড’ পড়াচ্ছিল লোকটা। আর ওর পড়ানোর মধ্য দিয়ে একটা সময়, একটা সমাজ, একটা অন্য দেশ, জ্যান্ত হয়ে উঠল চোখের সামনে। আমি কলেজে ঢোকার আগেই অন্য একজন ম্যাডামের কাছে ভর্তি হয়েছিলাম, সেই ভদ্রমহিলা ‘রেস্টোরেশন’ বোঝাতে গিয়ে বলেছিল, ‘সে একটা সময় ছিল যখন সবার বউ অন্য লোকের সঙ্গে চলে যেত, সবার স্বামী অন্যের বউয়ের সঙ্গে।’ অথচ সেই সময়ের কথাটাই কী দারুণ করে বোঝাচ্ছিল এএম। সেই মিরাবেল আর মিলামেন্টের মধ্যে ডায়ালগটা এত এক্সেলেন্টলি পোর্ট্রে করছিল লোকটা; যেখানে বউ বরকে বলছে, আমার ঘরে ঢুকতে গেলে কিন্তু নক করে ঢুকতে হবে, শুনে সারা ক্লাস হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছিল প্রায়।
বিরাট কোনো ভাবের ঘোরে অভীকের প্রতি আমার ফ্যাসিনেশন জন্মায়নি। আমায় অ্যাট্রাক্ট করেছিল ওর কমেডি করার ক্ষমতা। মনে হয়েছিল, আমার মনে যত ক্ষোভ আর ব্যর্থতার কান্না জমে আছে এই লোকটার কথায় হাসতে পারলে সেগুলো সরে যাবে। অভিনয়ের লোক বলেই বোধহয় ওর দুর্দান্ত সেন্স অব টাইমিং আমায় মুগ্ধ করেছিল। সেই সময় কে একটা যেন এসে বলল, স্যার প্রাইভেটও পড়ায়। আর আমি হাতে চাঁদ পেলাম। তৎক্ষণাৎ ম্যাডামকে ছেড়ে ওর কাছে ভর্তি হতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
ভর্তি হওয়ার পরেও, ক্লাসে কিংবা বাড়িতে কোথাও আমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেনি অভীক। আমিও নিজের থেকে বেশি কিছু বলতে যেতাম না। গ্রুপের একজন হয়েই থাকতাম সব জায়গায়। এক বছর একদম ফিল্ম লাইনের বাইরে বলে আমার চাবুক ফিগার তখন ছিল না। প্লাস আমি জানি যে, আমায় ক্যামেরায় যতটা ভালো লাগে, সামনে থেকে ঠিক ততোটা না। কিন্তু একইভাবে জানি, আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে লোক পারবে না। আর সেই লোকগুলোর মধ্যে অভীকও পড়ে জেনে কী আনন্দ যে হয়েছিল। কী ভালো যে লেগেছিল যখন দেখেছিলাম, কলেজের ক্লাসরুমে এ-মাথা থেকে ও-মাথা হাঁটতে হাঁটতে কিংবা ওর নিজের ঘরে বসে পড়াতে পড়াতে ওর চোখ নজর বুলিয়ে যাচ্ছে আমারই চোখের দিকে।
আমি পড়াশোনায় কনসেন্ট্রেট করছিলাম কিন্তু আনএক্সপেক্টেডলি তখনই একটা টেলিফিল্মের দারুণ অফার এলো আমার কাছে। সঞ্জয়দার থ্রু দিয়ে। সঞ্জয়দা ছিল, আমাকে কয়েকদিনের জন্য নেম অ্যান্ড ফেম দেওয়া মেগার ক্যামেরাম্যান। সত্যি করে নিজের বোনের মতো ভালোবাসত আমাকে। আমি যখন অসুস্থ তখন দু-তিনবার বাড়িতে পর্যন্ত দেখতে এসেছে আমাকে। আর প্রত্যেকবারই ওর কথা থেকে বুঝতে পারতাম, আমি হেরে গিয়ে সরে যাব, এটা ওর না-পছন্দ। সঞ্জয়দা চাইত যে, আবার ফাইট করে নিজের একটা জায়গা করে নিই আমি, এই ফিল্ম আর টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে। সে সময় আমায় ওর চাওয়াটা স্পর্শ করেনি। কারণ, আমি নিজের ভেতরে গুটিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে যন্ত্রণাও তো হালকা হয়। তাই মন সরিয়ে নিয়েছিলাম যেখান থেকে সেই লাইনে আর একবার পা বাড়ানোর ইচ্ছা চাগাড় দিলো মাথায়।
বাড়িতে মাকেও কিছু বললাম না। কারণ মা উৎসাহের বশে বাবাকে কিছু জানালে বাবার কষ্ট হবে, দুশ্চিন্তা করবে আবার। একেবারে চুপিচুপি কলেজ বাঙ্ক করে মেট্রোয় গড়িয়া এসে ওখান থেকে একটা অটোয় সোনারপুরে এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে রিকশায়, সঞ্জয়দার বলে দেওয়া ঠিকানায়। অডিশন দেব বলে। মাঝারি সাইজের একটা বাগানবাড়ি কিন্তু ভেতরে লোক খুবই কম। ডিরেক্টর আর প্রডিউসারকে বাদ দিলে তিন-চারজন হবে কি না সন্দেহ। ডিরেক্টর রূপকদাকে আমি আগে থেকে চিনতাম, আমার আগের মেগায় ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ছিল। ও যখন বলল যে, আমার দেরি হচ্ছে বলে যার সঙ্গে স্ক্রিন টেস্ট হওয়ার কথা সেই হিরো চলে গেছে, খুব অবাক হলাম। যে সময় আসতে বলা হয়েছিল, আমি তো তার আগেই এসেছি।
রূপকদার কথামতো অন্য একটা ঘরে গিয়ে দেখলাম একটা মেকআপ করার লোক। সে আমার মুখে জাস্ট পাউডার বুলিয়ে ছেড়ে দিলো। রূপকদা প্রডিউসারকে নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, তুমি সিলেক্টেড। আমরা জাস্ট এমনিই একবার দেখে নেব তোমাকে। তুমি, মিস্টার ঢোলাকিয়াকেই আপাতত নিজের হিরো ভেবে নাও। আমরা একটা ইন্টিমেট সিনে তোমার রিয়্যাকশন কিরকম সেটা দেখেই প্যাক-আপ করে দেব। বলে রূপকদা চোখের সামনে দুটো হাত নিয়ে ক্যামেরার ভঙ্গি করে বলে উঠল, অ্যাকশন।
আর এতক্ষণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমায় জরিপ করা লোকটা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমায়। আমি অবাক হয়ে গেলেও পুরোটা বুঝতে পারিনি তখনো। কিন্তু ঢোলাকিয়া যখন আমায় জাপটে ধরে গালে-চিবুকে-গলায় চুমু খেতে খেতে আমার টপের ভেতরে হাত ভরে দিয়ে খাবলাতে শুরু করল, আমি ছিটকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
খুব সহজে যে পারলাম তা না, কিন্তু যখন ঢোলাকিয়াকে ঠেলে দিয়ে একটু দম নেওয়ার জায়গা পেয়েছি তখনই বললাম, এসব নোংরামি বন্ধ করুন। আমি অভিনয় করব না।
– আরে তোমার এক্সপ্রেশনটা দেখার জন্য, এই সিচুয়েশনটা জরুরি। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
– আমার একটাই এক্সপ্রেশন, আমি এখান থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যাব।
– আপনি চাইলেই আমরা চলে যেতে দেব কেন? এখন তো আর অন্য হিরোইন পাব না আমরা, তাই না? ঢোলাকিয়া চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
আমি প্রচ- রেগে গিয়ে বললাম, যেতে চাইলে হোয়াট উইল ইউ ডু? যেতে দেবেন না? আটকে রেখে রেপ করবেন?
রূপক বোধহয় একটু ভয় পেয়ে গেল আমার ওই মূর্তি দেখে। ঢোলাকিয়ার কাছে গিয়ে নিচু গলায় কী সব বলল, লোকটা বিদেয় হলো ঘর থেকে। আর ও চলে যেতেই রূপক আমায় বলল, ভালো রোল পেতে হলে একটু কমপ্রো করতে হয়।
কমপ্রো? কমপ্রোমাইজেরও শর্ট ফর্ম বেরিয়ে গেছে বাজারে? আমার ওই অবস্থাতেও হাসি পেল। আমি ওকে কোনো রিপ্লাই না দিয়ে ঘরের লাগোয়া টয়লেটে চলে গিয়ে, কে জানে কেন, অভীক মিত্রকে একটা মেসেজ পাঠালাম আমার অবস্থার কথা জানিয়ে। আসলে মায়ের অ্যাম্বিশন আমার মধ্যেও ছড়িয়ে যাওয়ায় আমি এই প্রেম-ভালোবাসাকে সময় নষ্ট বলেই ভাবতাম। সুমিতাভ বলে একটা ছেলের সঙ্গে হালকা একটা রিলেশন হয়েছিল কিন্তু আমার সিরিয়াল চলাকালীন ও যেমন প্রাউড ছিল আমায় নিয়ে, সিরিয়াল বন্ধ হতেই আমি ওর কাছে একদম ফেকলু হয়ে গিয়েছিলাম। আমায় টিটকিরি দিতেও বাধত না ওর। অসুস্থ যে হয়ে পড়েছিলাম তার পেছনে ওই শয়তানটারও একটা বড় ভূমিকা ছিল। সে যাই হোক, ওই আটকেপড়া অবস্থায় সুমিতাভ তো দূর আর কোনো ছেলে-বন্ধুর
কথাই আমার মনে পড়েনি। শুধু মনে হয়েছিল, অভীক এখানে আসলে আমি সিকিওর।
আমি একাও বেরিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু আমার কেমন একটা ভয় করছিল, যদি বাইরে ওই জলহস্তীটা ঘাপটি মেরে থাকে। স্প্রে-ফ্রে কিছু ছিটিয়ে অজ্ঞান করে দেয় আমায়। তারপর কোনো একটা ঘরে ঢুকিয়ে…
অভীক ভালো করে জানতই না আমি মডেলিং করি, না অভিনয় করি; একদিন বোধহয় ওর ঘরে কোনো একটা কথা প্রসঙ্গে অন্য কোনো স্টুডেন্ট বলেছিল, তোর্সা সিরিয়াল করে আর ও একবার আমার দিকে চোখে চোখ রেখে আবারো শেক্সপিয়র বা মিলটনে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমার মেসেজটা পাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে আমায় ফোন করে অভীক জানাল যে, ও আসছে। আর ওর গলার মধ্যে যে উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তা টের পেলাম, সেটা একদম আপন কারো গলায় থাকে।
পরে শুনেছিলাম, অভীক গড়িয়ায় একটা কাজে এসেছিল আর সেখান থেকে ওর কলেজের সেমিনারে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার মেসেজটা পেয়েই ও প্রিন্সিপ্যালের অর্ডার থাকা সত্ত্বেও সেমিনারে যাওয়াটা ক্যানসেল করে। উলটোদিকে ছুটে আসে, আমায় বাঁচাতে। ততক্ষণে অবশ্য আমার অবস্থাও একটু পালটেছে। মূলত রূপকের কলকাঠি নাড়াতেই ঢোলাকিয়া নিজের লকলক করা জিভ ভেতরে ঢুকিয়ে একবার ‘সরি’ বলে গেছে আমাকে। তবু অভীকে যখন সেই বাগানবাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে চিৎকার করছে তখন কী শান্তি আর কী সাহস যে পেয়েছিলাম।
সারাপথ অভীক একটাও কথা বলল না, শুধু আমার হাতটা ধরে থাকল নিজের হাতের মধ্যে। আর আমি নেমে যাওয়ার সময় বলল, কেউ ডাকলেই দুমদাম যে-কোনো জায়গায় চলে যেও না। দিনকাল ভালো না।
দিনকাল যেমনই হোক, মনে হচ্ছিল অত সুন্দর মুহূর্ত খুব কম এসেছে আমার জীবনে। আমার চোখে জল ছলছল করে উঠল।
পরের মাসে আমি যখন প্রাইভেট পড়ার ফিসটা দিতে গেলাম অভীক নিল না। আমিও তো নিশ্চয়ই মাছের বাজার বা সবজি বাজার কিছু একটা ছিলাম, তবু আমার টাকাটা ও রিফিউজ করেছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু সেই ভালোলাগাটা আমি প্রকাশ করিনি। অভীকের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ও আমার মুখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর ভেতরে কিছু হচ্ছে।
ভেতরে কিছু কি আমারও হচ্ছিল না? সমস্ত কাজ ফেলে ও যে আমি বিপদে আছি জেনে ছুটে এসেছিল তার জন্য, আমিও কি ভালোবেসে ফেলিনি ওকে? কিন্তু আঘাত পেয়ে যতই গুটিয়ে যাই, আঘাত ফিকে হতে শুরু করলেই আমার স্বপ্ন আমার মাথায় চরকি কাটত। আর সেই স্বপ্নটা কোথাও একটা আমার ভালোবাসা কিংবা অন্য সব ইমোশনের চেয়ে স্ট্রং ছিল।
অভীক বারবার বলত, ‘ইম্যাজিনেশন’ আর ‘ফ্যানসি’র তফাৎ। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে স্বপ্ন আমরা দেখি তাই নাকি ইম্যাজিনেশন। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে যোগ না থাকলেও আমি যে তখন আবার চাইছি, রাস্তায় বেরোলে, পাঁচটা লোক আমায় চিনুক। দুজন এগিয়ে এসে অটোগ্রাফ নিক। এখন এটা যদি ফ্যানসি হয় তো তাই সই। আমি মনের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারব না।
পারব না বলেই খুরানার নতুন সিনেমায় একটা ছোট কিন্তু নজরকাড়া রোল পেয়ে আমি ওর ইউনিটের সঙ্গে লোকেশন দেখতে দিঘা চলে গেলাম। বাড়িতে মাকে বলতেই হলো এবার কিন্তু বাবা বা অভীক পর্যন্ত খবরটা পৌঁছতে দিলাম না। ভয় যে একটু লাগছিল না তা নয়, কিন্তু ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতেই তো ভয়ের মোকাবিলা করতে শেখে মানুষ। আমি গিয়ে বুঝলাম যে, খুরানা আমার সঙ্গে শুতে চায় বলেই লোকেশন দেখাতে নিয়ে এসেছে আমায়। কিন্তু ওই পৃথিবীতে থাকতে থাকতে কম ঘাগু তো আমিও হইনি। খুরানা আমার ক্লিভেজ দেখতে পেলেও ছুঁতে পারল না। আমি মিষ্টি হেসে জানিয়ে দিলাম যে, যেদিন নায়িকার রোলটা আমি পাব, সেদিন খুরানা কিছু চাওয়ার আগেই ওর বেডরুমের দরজা নক করব আমি।
খুরানার যে চামচাটাকে দিয়ে আমি ওর ঘরে রাতে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সে আমায় পরদিন জানিয়েছিল, খুরানা অসম্ভব চটে গেছে আমার ওপর। তেমনই হওয়ার কথা। কিন্তু আমায় অবাক করে, খুরানা কলকাতায় ব্যাক করার দিন, ওর চালু মেগায় একটা দমদার রোল অফার করল আমায়। আমি বিরাট অবাক হলাম। লোকটা কি তবে গল্প করবে বলে ডাকছিল আমায় অত রাতে? ভেবে নিজেই হেসে উঠলাম।
পরে জানলাম, সিরিয়ালের পরিচালক বদল হয়েছে আর নতুন ডিরেক্টর সুদীপ দত্ত আমায় চেয়েছেন। বছর পঞ্চাশের সুদীপদার আলাদা একটা সম্মান আছে বাজারে, খুরানা তাই হয়তো মুখের ওপর, ‘না’ বলতে পারেনি। নইলে রিফিউজড হয়ে দাতা কর্ণ সাজবে এমন প্রডিউসার তো সত্যযুগেও ছিল না বোধহয়।
ঘোর কলির একটা সুবিধা হচ্ছে, কোনো ব্যাপার নিয়েই বেশিক্ষণ ধানাইপানাই করা যায় না। লাইফ এত ফাস্ট, এমনভাবে দশদিকে টানছে সবসময় যে আগের ঘণ্টার কথা পরের ঘণ্টায় ক্যারি ফরোয়ার্ড করা যায় না। খুরানার সিরিয়ালে সেটল হয়ে যেতে আমি তাই আর ও কবে কী করতে চেয়েছিল, মনে রাখলাম না ততটা। উলটে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সাউথ ক্যালক্যাটায় চলে এলাম। বাবা আর মা ভিন্ন ভিন্ন কারণে অশান্তি করল। বাবা, পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে আর মা, আমি কী করছি, না করছি তার ওপরে নজর রাখতে পারবে না বলে। আমি যে খুব ছাড়তে চাইছিলাম বাড়ি, তা নয়; কিন্তু কী করতাম? সকালে কলটাইম থাকলে বাড়ি থেকে ভোরে বেরোতে হতো আমায়। খুব অসুবিধা হতো তখন।
সাউথে চলে আসায় শুটিংয়ের সুবিধা হলেও কলেজ কিংবা অভীকের বাড়ির ক্লাস মাঝেমাঝেই মিস হয়ে যেত আমার। অভীক প্রচ- রাগ করত তারপর আবার কীভাবে যেন আমার সময়ের সঙ্গে সময় মিলিয়ে পড়াতে বসত আমায়। নিজের বাড়িতেই শুধু নয়, কফিশপেও। একবার সেটা কলেজের অন্য কোনো স্টুডেন্টের চোখে পড়ে গিয়ে হালকা একটা গসিপমতো ছড়িয়েছিল। আমি ম্যানেজ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম, এক প্রডিউসারের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আবার টিভিতে আমার মুখটা দেখা যাচ্ছিল বলে, লোকে মেনেও নিল। না মানলে অভীক কিছুটা সমস্যায় পড়ত কিন্তু আমি পাত্তা দিতাম না। আমি যে অভীককে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। কেন বাসব না? এই পৃথিবীতে যেখানে প্রেম মানেই ভয়ংকর একটা খিদে, গনগনে একটা রোদ সেখানে অভীক যেন আমার চলার পথে একটা ছায়া ফেলে যেত। আমি সেই ছায়াটাকে হারাতে চাইতাম না। তাই আবার সিরিয়ালে নামা নিয়ে ও আমাকে অনেক কটু কথা শোনালেও আমি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যেতাম পুরো ব্যাপারটাকে। কারণ জানতাম, অভীক নিজের অন্তর থেকে ভালো চায় আমার।
ওদিকে খুরানার মেগায় কাজ করতে করতেই আমার বেশ একটা বন্ধুতা হয়ে গিয়েছিল সুদীপদার সঙ্গে। আমার ভালো লাগত যখন সুদীপদা বলত, ‘আমার প্রেমিকা আছে বেশ কয়েকজন কিন্তু একটাও রাঁড় নেই।’ মনে হয়েছিল লোকটার মুখোশের দরকার পড়ে না, লোকটা আমায় শুতে বাধ্য করবে না কোনোদিন।
সেই বিশ্বাস থেকেই আমি সুদীপদার শরণাপন্ন হই, যখন বুঝতে পারি খুরানা কী চাল চেলেছে আমার সঙ্গে। ততদিনে সুদীপদা অন্য একটা মেগার ডিরেক্টর হয়ে চলে গেছে, শুনতে পাচ্ছি একটা সিনেমাও নাকি করবে শিগগির। ওদিকে প্রডাকশন থেকে আমার নতুন কোনো ডেটও চাওয়া হচ্ছে না দেখে আর কিছুটা স্ক্রিপ্ট ফলো করেও আমি টের পেয়ে গেছি যে আমার ক্যারেকটারকে দুম করে মেরে ফেলা হবে।
কিন্তু আমি তো প্রায় দেড় লাখ টাকার ওপর পাই খুরানার থেকে। যে টাকা চাইতে চাইতে মুখে থুথু উঠে গেলেও ওর অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের লোক উচ্চবাচ্য করছে না। এবার আমি, আমার ফ্ল্যাটের ভাড়া, আমার সমস্ত খরচ-খরচা, কীভাবে চলবে সব? আমি কেঁদে পড়লাম সুদীপদার কাছে গিয়ে। সুদীপদা জানাল যে, খুরানার হাউস সবার টাকা মেরে দেয়। সুদীপদারও নাকি মেরেছে। কিন্তু আমি একদম নতুন একটা মেয়ে, এতোটা চিটিংবাজির সঙ্গে যুঝব কী করে? আর তাছাড়া আমার এতো পরিশ্রমের টাকা আমি খুরানার সঙ্গে শুইনি বলে মার যাবে? সুদীপদা কথা দিলো যে, আমায় আর্টিস্টস ফোরামে নিয়ে গিয়ে নালিশ করিয়ে আনবে কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে না পেলাম ওর দেখা, না ওকে পেলাম মোবাইলে। খুরানার সঙ্গে আমি লড়ব কীভাবে যদি সুদীপদার মতো কাউকে পাশে না পাই? ভাবতে ভাবতে কান্না পেয়ে গেল।
সেই কান্না নিয়েই আমি অভীকের কাছে গেলাম। তখন একটা ক্লাস পুরোদমে চলছে। অন্য কেউ হলে অভীক হাজার কথা শোনাত কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে ও শুধু বসার ইঙ্গিত করল।
ক্লাস শেষ হতে সবাই যখন চলে গেছে তখনো আমি চুপটি করে বসে রয়েছি ওর ঘরে বিদিতার খাতা দেখে নোটসগুলো টুকে নেওয়ার অছিলায়। বিদিতা বেরিয়ে গেছে, পরদিন কলেজে খাতা ফেরত দেবে বলে। আমি বসে আছি কিন্তু আমার হাতের কলম সরছে না। অভীক তখনই আমায় জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, এতো উদ্ভ্রান্ত লাগছে কেন তোমায়?
আমি উত্তর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম। প্রথমে শব্দ করে কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আওয়াজটা ভেতরে চেপে কেঁদে চললাম। কাঁদতে কাঁদতেই অভীককে জানালাম কী হয়েছে আমার সঙ্গে।
অভীক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একদম চুপ। তারপর যতগুলো নোট ওর হাতে ছিল, দলা পাকানো পাঁচশো টাকার নোট, একশ টাকার নোট এমনকি পঞ্চাশ টাকার নোট পর্যন্ত ও আমার হাতে তুলে দিলো। তারপর বলল, আজ এই এতটাই মাইনে পেয়েছি। হাজার তিনেকের মতো হবে বোধহয়।
আটাশশো টাকা ছিল। আমি হাতে নিয়ে গুনে দেখলাম। আর ওর দেওয়ার ভঙ্গিটা এতো আন্তরিক ছিল যে, একটিবারের জন্য মনে হয়নি, কেন নেব ওর থেকে টাকা? কিসের অধিকারে? উলটে বলেছিলাম, এর মধ্যে দুহাজার আমি নিচ্ছি। বাকি টাকাটা দিয়ে আমরা বাইরে খেতে যাব কোথাও, একটা ফিল্ম দেখব।
সেই খাওয়া আর ফিল্ম মিলিয়ে খরচ অবশ্য আটশোতেই জমা থাকেনি। হাজার-বারোশো হয়ে গিয়েছিল। যাক। সেদিনের ওই কয়েক ঘণ্টা আমার মনে এমনভাবে আছে যে কোনোদিন খরচ হবে না। আমি শিওর অভীকেরও।
হলে ঢোকার মুহূর্তে ও একবার চারপাশে তাকাল, বোধহয় ভয় পাচ্ছিল চেনা কেউ দেখে ফেলল কিনা। ওর এই আতঙ্কটা বাজে লাগত আমার কিন্তু সেদিন ভালোলাগায় এতোটাই চুবে ছিলাম যে ও যা করছিল, ভালোই লাগছিল। কিন্তু হলের ভেতরে অন্ধকারে ও কিছুই করছিল না। শুধু আমার হাতটা ধরে বসেছিল।
আমার পরদিন ভোরে শুটিং, ওর বাড়িতে মিথ্যা বলে বেরোনো, ও কি এই ক্লোজনেস, এই সময়টুকুর দাম বুঝতে পারছে না? সিনেমাটা দেখছিল, সাকল্যে দশ-বারোটা লোক। আমি তাই ডেয়ারডেভিল হতে কোনো প্রবলেম ফিল করছিলাম না। জড়িয়ে ধরে প্রথম চুমুটা খেলাম অভীককে। ও প্রথমটায় একটু স্টিফ ছিল তারপর ওর অনেক চুমু আছড়ে পড়তে লাগল, আমার ঠোঁটে, গালে, গলায়। নীল অন্ধকারে দুটো চেয়ারের ভেতরকার বাধা সরিয়ে, আমাদের ডিজায়ার পরস্পরের গা বেয়ে উঠছিল, নামছিল। আমি আগুন হয়ে উঠছিলাম আবার ভিজেও যাচ্ছিলাম। চাইছিলাম অভীকের আঙুল আমার সারাশরীর স্পর্শ করুক। বাট হি ওয়াজ মোর ইন্টারেস্টেড টু কিস মি অ্যান্ড হি কিসড মি সো ডিপলি যে আমার ঠোঁটটা কেটে গেল একসময়। তখন খেয়াল করিনি কিন্তু রাতে ঘরে ফিরে ঘুমোতে পারছিলাম না, ইট ওয়াজ বার্নিং লাইক হেল। রাতে অভীককে মেসেজ করেছিলাম, শুধু শয়তানই নয়, ঈশ্বরও মাঝে মাঝে ব্যথা দেয়।
অভীক ফোন করে কিছুটা লজ্জার সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, জ্বালা করছে, কষ্ট হচ্ছে?
বলেছিলাম, না। ভালো লাগছে। পৃথিবীতে কি জ্বালা ছাড়া ভালো-লাগা হয়!
কিন্তু ভালো-লাগা যেখানে নেই সেখানেও জ্বালাটা থাকতেই পারে। সেই জ্বালাটাই ফিল করলাম, যখন নিজের নানান দুর্ভাগ্যের গল্প বলতে বলতে সুদীপদা আমার সঙ্গে শুতে চাইল। একদম গোদাভাবে নয়, একটু ঘুরিয়ে রিফাইনড ওয়েতে কিন্তু শোয়া তো শোয়াই। সে ওর বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে বলেই শুই আর আমার নিজের ওকে ভালো লাগছে বলেই শুই। ব্যাপারটা তো একই।
– আচ্ছা শোন, আমি কাল রায়চক যাচ্ছি একটা মিটিংয়ে। খুব সুন্দর একটা বাংলোয় থাকব। তুই প্লিজ চল না সঙ্গে। কাল গিয়ে পরশুই ফিরে আসব। প্রথমবার আমি হেসে এড়িয়ে যাওয়ার দিনদুয়েক বাদে একদম খোলাখুলি বলল সুদীপদা।
যদি শুধু খুরানার কাছে আটকে থাকা দেড় লাখের ব্যাপার হতো, আমি স্ট্রেট ‘না’ বলে দিতাম লোকটাকে। কিন্তু সুদীপদা ততোদিনে একটা বড় হাউসের কাস্টিং ডিরেক্টর হয়ে গেছে। আর আমার তো কাজ চাই। তাই একটা ডিলেমায় পড়ে গেলাম। হয়তো সেটা নিজেই কাটাতাম কিন্তু ভুল করলাম অভীককে কথাটা বলে। অভীক প্রায়ই আমায় ওর কমপ্রোমাইজ করার কথা বলত। যে কারণে ও নিজে যেটা সবচেয়ে ভালো পড়ায় সেই পিসটা ওর থেকে নিয়ে অন্য কাউকে পড়াতে দিলেও ও চুপ করে থাকত, সেই কারণটা বলত। আমিও ঠিক সেভাবেই অভীককে আমার ব্যাপারটা বললাম।
অভীক শুনেই ক্ষেপে উঠল, ছেড়ে দাও আড়াই লাখ টাকা, তোমাকে যেতে হবে না ওর সঙ্গে।
আমি বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই ভালোবেসে যদি কারো সঙ্গে শুই সেটা তুমিই হবে। কিন্তু তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে আমার ক্যারিয়ার আমি এমন একটা ফিল্ডে করতে চাই যেখানে কাস্টিং কাউচ ব্যাপারটা এগজিস্ট করে। আমি না চাইলেও করে। এবার এখানে করে খেতে গেলে এমন কিছু লোকের সঙ্গে মোলাকাত হবেই, যাদের একটা সন্ধ্যা বা একটা রাত্রি দিতেই হবে। না দেওয়াটা একদম সুইসাইডাল হয়ে যাবে। সুদীপদা সেরকমই একটা লোক। তাই…
অভীকের মুখটা লাল হয়ে উঠল, এটা হতে পারে না। তুমি কাউকে ভালোবেসে আমায় ছেড়ে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে কিন্তু আমি সহ্য করে নেব। বাট তুমি জাস্ট একটা কাজ হাসিল করার জন্য কারো সঙ্গে শোবে এটা একদম আনবিয়ারেবল। এটা তোমাকে শোভা পায় না।
– আমায় কি শোভা পায় না পায় তুমি ঠিক করে দেবে? প্রতি মাসে তোমার ওই টিউশনের মাইনে থেকে টাকা নিয়ে চলবে আমার? নাকি আমি ফ্ল্যাটের ভাড়া দেওয়ার জন্য, জুতো-জামা এমনকি আন্ডারগার্মেন্টস কেনার জন্য বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকব? আমার নিজের রোজগারের টাকা যদি আমি না পাই তবে…
– তোমার রোজগারের টাকা ন্যায়সঙ্গতভাবেই তোমার পাওয়ার কথা। আমরা হাইকোর্টে যাব, মামলা করব।
– তাতে একশ বছর সময় লাগবে। টাকাটা জলে তো যাবেই। ইন্ডাস্ট্রির নাম মামলায় জড়িয়েছি বলে দুর্নাম রটে যাবে আমার।
– মোটেই না। উলটে নাম হবে তোমার। প্রতিবাদ করার জন্য।
– আমার ওইভাবে নাম চাই না। কাজ চাই।
– কাজ পাওয়ার জন্য আমি তোমাকে বিক্রি হতে দেব না।
– আমি বিক্রি হচ্ছি না। কিন্তু জীবন তো একটা যুদ্ধ আর সেখানে মাঝেসাঝে এক-আধটা স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়। তাই নিয়ে অত ভাবলে চলে না।
– ভাবার কিছু নেই তো। ছেড়ে দাও। ওই দেড় লাখ টাকা ছাড়াই আমাদের জীবন চলবে।
– টাকাটা দরকার অভীক। টাকা ছাড়া আমরা সারভাইভ করতে পারি না। তুমি তো মাইনে পাও কুড়ি হাজার আর তারপর ওই টিউশনি সম্বল। আর শুধু টাকার জন্য নয়, সুদীপদাকে আমি চটাতে পারব না এই মুহূর্তে। সবাইকে শত্রু করে এখানে টেকা যায় না। খুরানা তো গেছেই, এখন সুদীপদাকেও যদি চটিয়ে ফেলি তাহলে আমার অ্যারোগ্যান্স আছে ভেবে ফেলবে সবাই। তারপর ইন্ডাস্ট্রি থেকে এক পয়সাও রোজগার করতে পারব আর?
– করবে না।
– তাহলে কী করব? রান্না করব? বাসন মাজব?
– পড়বে এখন। পরে পড়াবে। নোবলেস্ট প্রফেশন অন আর্থ বেছে নেবে।
– না, ওটা তোমার স্বপ্ন। আমার না। আমি তো আমাকে সবচেয়ে বেশি চিনি, আমি দম নিতে পারব না ওইসব কিছুর মধ্যে। আর তাছাড়া যে জিনিসটা সব থেকে ভালো পারি সেটা ফালতু এথিক্স দেখাতে গিয়ে ছেড়ে চলে আসব কেন? কাঁটা আছে বলে ইলিশ না খেয়ে আলুসেদ্ধ খাব?
– এভাবে ভাবা ঠিক নয় তোর্সা। এটা একদম ইমমর‌্যাল।
– মর‌্যাল-ইমমর‌্যাল বলে কিছু হয় না। যেটা তোমার কাছে ঠিক, আমার কাছে সেটা ভুল হতেও পারে।
– তাই বলে তুমি একরাত্রি শুতে পারো কারো সঙ্গে? তুমি কি একটা…
– থেমে গেলে কেন? ওয়ার্ডটা বলো? বলো যে, তুমি কম্প্রোমাইজ করলে সেটা নেসেসিটি কিন্তু আমি কম্প্রোমাইজ করলে, আমি প্রস্টিটিউট। তাই তো?
– দুটো কম্প্রোমাইজ এক নয়।
– আলাদা হলে আলাদা। বাট লাস্ট অবধি, দুটোই তো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা কিছুকে কিছুক্ষণ সহ্য করা।
– অত ফিলোসফি ভালো লাগছে না। তুমি ওই সুদীপের সঙ্গে যাবে না।
– অ্যা’ম সরি, আমাকে বোধহয় যেতেই হবে।
– গেলে পরে যাও। কিন্তু ফিরে এসে আমাকে আর পাবে না নিজের জীবনে।
– আমি বোধহয় এমনিও তোমাকে পাইনি। নইলে তুমি বুঝতে কেন আর কোন সিচুয়েশনে আমি কাজটা করছি। অবশ্য তোমার বোঝা সম্ভবও নয়। তুমি তো স্বপ্নে বাঁচো না, দুঃস্বপ্নে বাঁচো। তুমি তাই সারাজীবন কলেজের কনট্রাকচুয়াল টিচার হয়ে থাকবে আর প্রাইভেট টিউশন করবে। এই তোমার সীমানা। বাট আমাকে একটা উঁচু জায়গায় যেতে হবে অভীক। নিজের অধিকার, নিজের পজিশন সিকিওর করতে হবে।
– তার জন্য চরিত্র খোয়াতে পারবে?
– চরিত্রের কনসেপ্ট পার্সন টু পার্সন ভ্যারি করে। তোমার সঙ্গে আমার ধারণা না-ই মিলতে পারে।
– আমি তোমায় রিকোয়েস্ট করছি, এভাবে ভেঙে দিও না আমাদের রিলেশনটা।
– আমি ভাঙছি কোথায়? আমি তো কোনো শর্ত চাপাইনি তোমার ওপর। তুমি চাপিয়েছ।
– হ্যাঁ, আমিই চাপিয়েছি। কারণ…
– থেমে গেলে কেন, বলো।
– তুমি অন্য কারো ক্লোজ হবে আমি মানতে পারব না। কিছুতেই না।
– মানতে আমিও পারছি না অভীক। তোমার এই ফিউডাল মেন্টালিটি, আমাকে নিজের সম্পত্তি ভেবে, আমার উন্নতির পথ আগলে দাঁড়ানো, আমি মানতে পারছি না। সরি।

একটাই মানুষ এক-একজনের কাছে কিরকম আলাদা আলাদাভাবে ফুটে ওঠে তাই না? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– তাই তো হবে। মানুষ কি ফুল নাকি! দলমা হেসে উঠল।
– শতপুষ্প বিকশিত হোক। হিয়া বলল।
– শত দিয়ে আর দরকার নেই, চারজনই যথেষ্ট। এবারে কার টার্ন? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– আমি বলতে পারি। দলমা বলল।
– না। সিনিয়র-জুনিয়র যেরকম হচ্ছে সেই প্যাটার্নটাই থাক। হিয়া শুরু কর। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– আমি বলব? হিয়া তাকাল অন্যদের মুখের দিকে।
– হ্যাঁ তুই। কেন অসুবিধা আছে কিছু? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– আসলে আমার কেসটা একটু ডিফারেন্ট। হিয়া বলল।
– তা হলে তো এক্ষুনি শুনব। সবাই বলে উঠল।

হিয়া
তোদের দুজনের কথা শুনে মনে হলো তোরা কোথাও একটা স্যারের প্রেমে পড়েছিলি, স্যারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক হওয়ার আগেই। ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। আমি বলতে চাইছি, তোরা স্যারের কথায়, ওর পড়ানোয় মুগ্ধ হয়েছিলি। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম হয়নি। আমি যেতাম, ক্লাস করতাম, কিন্তু আমার মনে হতো ও একটু বেশি বোঝাচ্ছে। মনে হতো, এক্সপ্লেইন করতে লোকটা ভালোবাসে। সেই এক্সপ্ল্যানেশনটা কতদূর আমাদের পরীক্ষার কাজে আসবে, কত ভালো রেজাল্ট হবে সেটা নিয়ে ততো ভাবছে না লোকটা। মোদ্দা কথা, পড়ানোর যে প্র্যাকটিক্যাল দিকটা, সেই নোটস দেওয়া, কোয়েশ্চেন লেখানোয় অভীকের একটু খামতি ছিল বলে আমার ধারণা। তবে ও ক্লাসটা একদম জমিয়ে রাখত সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই মার্কস পাওয়ার দিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমার মনে হতো সঙ্গীতাদির বা রঞ্জন স্যারের ক্লাসটা অনেক টু দ্য পয়েন্ট ছিল। তাই দ্যাখ, তোদের মধ্যে আমিই একমাত্র যে অভীকের কাছে প্রাইভেটে পড়তাম না।
তবু ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কিন্তু তার পেছনের কারণটা একদম আলাদা ছিল। আমাদের কলেজে তো এখন ইউপি বিহারের ছেলে ভর্তি। একদিন ওরা বেশ কয়েকজন ক্লাসে বসেই হনুমান চালিশা পড়ছিল। শুনতে শুনতে আমার কী মনে হলো, বলে উঠলাম, তোদের আর তোদের লিডারকে গুলি করে মেরে দেব একদম। ওরা ধরে নিল, আমি বোধহয় ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টারকে গুলি করার কথা বলছি। আর সেটা ধরে নিয়ে ছেলেগুলো অশান্তি শুরু করল। কলেজের গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানেও ওরা আমায় শাসানি দিতে চলে এলো। অভীক ওখান দিয়ে পাস করছিল তখন। দৃশ্যটা চোখে পড়ায় থমকে গেল। সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। ছেলেগুলো একটু রং চড়িয়ে অনেক কথা বলল।
অভীক চুপ করে ওদের কথা শুনল, তারপর বলল, ও একটা কিছু বলেছে আর তোমরা অন্য কিছু শুনেছ। যাই হোক, ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে এত অশান্তি করার কিছু নেই। হনুমান সারাজীবন কী করতেন? সীতা মাইয়াকে কতটা 888sport apk download apk latest version করতেন? তোমরা যদি সত্যিই হনুমানজির পূজারি হও তাহলে আগে একটা মেয়েকে সম্মান করতে শেখো।
ছেলেগুলো একটু দমে গেল আর ওরা চলে গেলে অভীক আমাকে একটু সাইডে এনে বলল, গুলি করে মেরে ফেলবে বলেছ? হনুমান চালিশা পড়ার অপরাধে?
– ওইরকম একটা কিছু বলেছি।
– কিন্তু কেন? এসব বলার মানে কী?
– কোথাও একটা ক্ষত আছে বলেই বলেছি।
– ইচ্ছে করলে তোমার ক্ষতের কথা আমায় বলতে পারো। আমি শুনব। বাট প্লিজ, পাবলিকলি এইসব স্টেটমেন্ট কোরো না। বিপদে পড়ে যাবে।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, পড়লে পড়ব; কিন্তু অভীকের গলায় একটা জেনুইন কনসার্ন শুনলাম বলেই চুপ করে গেলাম। একটু হাসলাম, ওর দিকে তাকিয়ে। অভীকও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে এগিয়ে গেল।
ব্যাপারটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু ওই ছেলেগুলোর মধ্যে অ্যাটলিস্ট দুজনের আমার প্রতি একটু ব্যথা জেগে ওঠায় কেসটা ঘোরালো হয়ে গেল। দুজন দুভাবে পটাতে চেষ্টা করল আমায়, আর যখন পারল না তখন ওই উশখুশটাই রিভেঞ্জের চেহারা নিল। আমি ওদের রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্টে আঘাত করেছি বলে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা শুরু হলো। আমার নামে কমপ্লেইন করা থেকে শুরু করে ক্যান্টিনে আমাকে আওয়াজ দেওয়া, নানারকম হ্যারাসমেন্ট শুরু হলো। খুব লো-কিতে কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, জিনিসটা বাড়ছে। একটু ঘাবড়েই গেলাম আমি। একবার ভাবলাম, মিডিয়ায় গিয়ে জানাব, তারপর মনে হলো, তাতে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তখন মনে হলো, এএম-কে ইনভলভ করলে কেমন হয়? আফটার অল, ফার্স্ট ডে থেকে তিনি ঘটনাটা জানেন। সেই ভাবনা থেকেই, আমি ফোন করেছিলাম অভীককে আর ও ভেবেছিল, আমি বোধহয় প্রাইভেটে পড়তে চাইছি। একটা ব্যাচ ফুল হয়ে গেছে, আমি গেলে কজনকে নিয়ে যাব, এইসব জিজ্ঞেস করছিল। আমি যখন বললাম যে আমি একটু বিপদে পড়েছি, তখনো বুঝতে পারেনি। শেষে, হনুমান চালিশার রেফারেন্স দেওয়ায় কাজ হলো।
আমি দেখা করতে চাইছি জেনে অভীক বলল, তুমি শনিবার চারটে নাগাদ আসতে পারবে?
অভীক যদি রাত এগারোটায় বলত আমি তাও হয়ত যেতাম। কারণ তখন আমার অবস্থা সত্যিই একটু টাইট। বিকেল চারটে বলায় খুশি-খুশি রাজি হয়ে গেলাম।
আমরা বসেছিলাম, একদম সাধারণ একটা কফিশপ। একটু ভাঙাচোরা, খুব বেশি ভিড় নেই। মানে একদম সিসিডি টাইপ নয়। আর সেখানে বসে ‘চা’ অর্ডার করে অভীক আমায় জিজ্ঞেস করল, সেদিন তো মিটে গেল। আমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর দলের পান্ডাটা তো ‘সরি’ও বলল তোমায়। তারপর আবার নতুন করে কী সমস্যা শুরু হলো?
– সমস্যা কিছুই নয়। ওদের ভেতর থেকেই দুটো ছেলের আমায় মনে ধরেছে, কিন্তু তাদের পাত্তা দিচ্ছি না বলে, পুরনো একটা কথা খুঁচিয়ে ঘা করছে এখন। হ্যাঁ, আমি একদিন বলেছিলাম যে, গুলি করে মেরে দেব; কিন্তু সেটা নিয়ে এতো ঘাঁটাঘাঁটির কী আছে?
– কথাটা তো খুব সহজ বলোনি তুমি, তাই না?
– এমনি বলিনি। আই অ্যাম ডিসগাস্টেড। ভারতবর্ষ একটা সম্প্রীতির দেশ, এখানে সব রিলিজিয়নের সবাই শান্তিতে থাকবে, এরকমটাই তো ছোট থেকে জেনে এসেছিলাম, তাই না? কিন্তু এখন যা হচ্ছে, আই অ্যাম নট অ্যাট অল হ্যাপি উইথ দ্যাট।
– হওয়া উচিত না হলেও সর্বত্র, সবসময়, কিছু না কিছু হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় হচ্ছে না? 888sport appsে ব্লগার খুন হচ্ছে না? সিরিয়া-ইরাকে কী চলছে?
অভীককে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এক্সট্রিম ব্যাপার-স্যাপার চলছে। তার বিরুদ্ধেই তো আমি কথা বলেছি।
– কিন্তু বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তুমি নিজেও তো একটা এক্সট্রিম কথাই বলেছ। আবার দ্যাখো, এক্সট্রিমিটি সবসময় ততটা খারাপ নয় জানো তো। তুমি নিশ্চয়ই পড়েছ মার্টিন লুথারের জেল থেকে লেখা চিঠিগুলো। ওখানে একটা অদ্ভুত কথা বলেছেন তিনি, ‘জিসাস ওয়াজ এক্সট্রিম ইন লাভ’। ভেবে দেখবে কথাটা। একটা লোক বোমা বেঁধে নিজেকে উড়িয়ে দিচ্ছে, সে যদি চরম হয় তাহলে যে-মানুষ ভালোবেসে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যেতে পারে, সে চরম নয়? ঘৃণায় যেমন চরম হওয়া যায়, ভালোবেসেও হওয়া যায়। ইনফ্যাক্ট ওই হনুমানও কিন্তু ভক্তিতে চরম। তা হলে বুঝতে পারছ, চরমপন্থা ব্যাপারটা একমুখী নয়?
– জিসাসের এগজাম্পল দিলেন কেন? আপনি জানেন আমি ক্রিশ্চিয়ান?
– তোমার কী ধর্ম তাই নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে তোমায় ক্লাস টেস্টের খাতা জমা দেওয়ার আগে ক্রস কাটতে দেখেছি।
– ভালো যে আপনি খেয়াল করেছেন। সবাই খেয়াল করে না তো। খেয়াল না করলে পরে আবার আফসোস করতে হয় কাউকে কাউকে।
– কী বলছ কিছু বুঝতে পারছি না।
– আমার কথাই বলছি। আমার সারনেম দেখে হয়তো বুঝতে পারছেন আমরা গোয়ানিজ। কিন্তু মাই নেম ইজ মোর ট্রু দ্যান মাই সারনেম। আমার ঠাকুরদার বাবা এখানে এসেছিলেন। শ্রীরামপুরে বাড়ি করেছিলেন। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গোয়ানিজ পরিচয় আমরাই আর মনে রাখিনি। আমরা বাঙালিদের চেয়ে কিছু কম বাঙালি নই। আমার ঠাকুরদা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন শুনেছি। দুর্গাপুজোয় আমরা যতটা সেলিব্রেট করতাম, বড়দিনে ততোটা করতাম কিনা সন্দেহ। একেবারে মাছ-ভাত খাওয়া বাঙালি ফ্যামিলি যেমন হয়, আমরা সেরকমই। সবদিক দিয়ে।
আমি বাবার একমাত্র মেয়ে। বাবা মার্চেন্ট নেভিতে ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের দু-একজন আত্মীয়স্বজনেরই আমাদের সম্পত্তির ওপর চোখ পড়ে। আমাদের যে কাজিনের সঙ্গে বিয়ে চল আছে, এমনটা নয়। কিন্তু আমারই এক কাজিন একদিন আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অলমোস্ট মলেস্ট করল আমাকে। আর করার পর বলল যে, আমাকে নাকি ও বিয়ে করতে চায়। আই ওয়াজ শকড বললে কিছুই বলা হয় না তবু বলছি, শিউরে উঠছিলাম ক্ষণে ক্ষণে। এক সময় আর থাকতে না পেরে বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে অয়নকে একটা ফোন করলাম।
অয়ন আর আমি পাশাপাশি বসতাম ক্লাসে। একসঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল করতাম। অয়ন আমার বাড়িতে আসেনি কোনোদিন, আমিও যাইনি ওর বাড়ি। আসলে প্রতিটা মুহূর্তে আমরা দুজন দুজনের কথায় এত বুঁদ হয়ে থাকতাম যে, অন্য কাউকে ওই কনভারসেশনের মধ্যে আনতে ভালো লাগত না। অয়ন সেদিন আমাকে দেখেই বুঝতে পারল যে, আমার একটা কিছু হয়েছে। বাইকের পেছনে চাপিয়ে অনেক ঘোরাল আমায়। তারপর ওর দাদুর বাড়ি লিলুয়ায় নিয়ে গেল। সেখানে ওর প্যারালাইজড দিদিমা আর তার দুজন দেখাশোনার লোক ছাড়া কেউ নেই। দিব্যি ‘ছোটকাকুর মেয়ে, দিল্লি থেকে এসেছে’ বলে আমায় চালিয়ে দিলো অয়ন। আর তারপর আমায় নিয়ে দোতলায় উঠে গেল। একবার বাইরে বেরিয়ে বিরিয়ানি আর কোল্ড ড্রিংকস কিনে আনল। আমি বাড়িতে ফোন করে বলে দিলাম আমি পিউয়ের বাড়িতে আছি। পিউয়ের বাড়িতে দু-একবার থেকেছি আমি। পিউয়ের নামটাই মনে এলো কারণ আগের দিনই স্কুলে পিউ দুঃখ করছিল ওর মোবাইল চুরি গেছে বলে। একদিনের মধ্যেই নিশ্চয়ই মোবাইল কিনে ফেলেনি পিউ আর কিনলেও আমার মায়ের কাছে ওর নাম্বার নেই। থাকলেও মা কি আর ফোন করার সময় পেত সে-রাতে? ওই আত্মীয়রা তো তখন আমাদের বাড়িতেই। একবার ভেবেছিলাম, সবার সামনে চিৎকার করে ওই ছেলেটার কুকীর্তির কথা বলি। কিন্তু আমি তো প্রমাণ করতে পারতাম না আমার সঙ্গে কী করেছে। আর না পারলে, হুজ্জুতি আরো বাড়ত।
কিন্তু পরে আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম ছেলেটাকে। উলটে একটু কৃতজ্ঞতা ফিল করছিলাম ওর প্রতি, কারণ সেদিন ওই ঘটনাটা না ঘটলে আমি তো সারারাত অয়নের সঙ্গে কাটাতে পারতাম না। উফ সেই রাতটা যে কী অপূর্ব ছিল! বব ডিলান থেকে অঞ্জন দত্ত, মাইকেল জ্যাকসন থেকে কঙ্গনা রানাওয়াত, পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিয়ে আমরা আড্ডা দিলাম। আদর করা তো দূরস্থান, অয়ন বুড়ো আঙুল দিয়েও টাচ করল না আমাকে। গিটার বাজাত খুব ভালো, একের পর এক গিটারে গান বাজিয়ে গেল। মাঝরাতে বৃষ্টি নামল। আর বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরেই, চাঁদ নয়, অজস্র তারা উঠল। মনে হলো, অয়নের এক একটা গানই, এক একটা তারা। আর ভালোবাসা একটা চাঁদ। তাকে গলিয়ে অনেকগুলো তারা বানানো যায়। ইচ্ছা করছিল, অয়ন যদি একবার আমায় জড়িয়ে ধরে। আমার খারাপ লাগাটা যদি ভালোলাগায় বদলে দেয়। কিন্তু অয়ন ওসব কিছু করল না। গান গাইতে গাইতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম ওর কাঁধে মাথা রেখে। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি প্রায়। কিন্তু ব্যস, ওটুকুই।
তারপর থেকে অয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সমীকরণটা বদলে গেল। আমি ওর বাইকে যখন উঠতাম আর একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতাম ওকে, কোত্থেকে যেন, অনেক লজ্জা এসে জড়ো হতো আমার মধ্যে। আগের সেই সহজ ব্যাপারটা খুঁজে পেতাম না। লাভ বলুন বা ডিজায়ার, সেক্সুয়াল অ্যাপিল বা ডিজায়ার, সেটা তো আসলে একটা ফিলিংস, আমি অয়নের জন্য সেই ফিলিংসটা টের পেলাম ভেতরে। আমার মা মোটের ওপর লিবারাল ছিল, আমি অয়নকে বিয়ে করব বললে আমায় দেখতে আসত না। হ্যাঁ, দু-একজন রিলেটিভ দু-চারটে কথা বলত, তাতে কী? আমি অয়নের থেকে বয়সে একটু বড়, তাতেই বা কী? মোদ্দা কথা তো এটাই যে, অয়নের প্রেমে পড়েছি আমি। আর সেই প্রেম, না বুঝতে পারার মতো বোকা তো অয়ন ছিল না। আর তাছাড়া ও যে আমায় ভালোবাসে তা বুঝতে পারতাম ছোট ছোট ইন্সিডেন্ট থেকে। ভালো না বাসলে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস মিস করে আমার জন্য গান তুলবে কেন?
মজার ঘটনা ঘটেছিল একবার। আমার জন্মদিনের কয়েকদিন আগে, অয়ন দারুণ একটা মুক্তোর মালা কিনে এনেছিল আমার জন্য। আর পরদিন আমার কাছে চলে এসেছিল ওটা ফেরত চাইতে। আমি অবাক হয়েছিলাম, রেগেমেগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ফেরত চাইছে। অয়ন কাঁদো-কাঁদো গলায় জানিয়েছিল যে, কলকাতায় একটা দোকান আছে, সেখানে সাত দিন বা দশ দিন বা মাসখানেকের ইউজ করা মালা বিক্রি করলে ওরা কিনে নেয়। এরা দশ টাকার জিনিস দুটাকায় কেনে, তারপরে সেগুলোই আবার পাঁচ টাকায় বিক্রি করে। অয়নের মালাটা খুব পছন্দ হয়েছিল। আর ওই রেঞ্জের মালা, একদম অরিজিনাল, ওর কেনার সমর্থ ছিল না। ও তাই ইউজড মালাটাই আমার জন্য নিয়ে এসেছিল। ও না বলে দিলে আমি জানতামই না, ওটা সেকেন্ড হ্যান্ড।
– তুই আমাকে বললি কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
– তোকে ওটা দেওয়ার পর আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। মনে হয়েছে, অন্য একজনের পরা মালা কী করে দিলাম তোকে। তুই তো পৃথিবীর সবচেয়ে ফ্রেশ জিনিসটা ডিজারভ করিস। বলতে বলতে অয়নের চোখে জল এসে গিয়েছিল।
সেই মুহূর্তে আমি অয়নকে আমার সম্পূর্ণ আত্মাটা দিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তুই তো তোর পুরোটা আমাকে দিয়েছিস, তোর দেওয়া জিনিসটা সেকেন্ড হ্যান্ড হলো না থার্ড হ্যান্ড, তাতে কিছু এসে যায় না।
অয়ন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, কোনোদিন চলে যাবি না তো আমায় ছেড়ে? আমি বলেছিলাম, কখনো না।
কথাটা শুনেই অয়ন আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল। ভালোবাসার থেকেও বেশি করে নির্ভরতা ছিল তার মধ্যে। আমি একদম গলে যেতে থাকলাম। একটা তাজা কিছু যেন আমাদের দুজনকে ভেতরে নিয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে, মনে হচ্ছিল।
মাকে যখন রিলেশনশিপটার কথা জানাই, মা একবারও বাধা দেয়নি, শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, কালচার ডিফারেন্স হবে না তো? মানিয়ে নিতে পারবি তো?
আমি উত্তর দিইনি, আমার হাসি পেয়েছিল। ভাবছিলাম, যে-অয়ন আমাকে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর একটা করে এসএমএস পাঠায়, তার সঙ্গে আবার কী ডিফারেন্স হবে? সেই সময়ই একদিন ঘটনাটা ঘটল।
ছোটবেলা থেকে একটা দিন আমি উপোস করতাম। রিলিজিয়াস জায়গা থেকে নয়, জিসাসকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার জায়গা থেকে। সেই দিনটা ছিল গুড ফ্রাইডে। ওইদিনটা সকাল থেকে কিছু খেতাম না। চার্চ থেকে ফিরে এসে বাড়িতেই থাকতাম সারাক্ষণ। কিন্তু সেবার অয়নের জোরাজুরিতে বেরোতেই হলো। এমন পাগলামি করছিল যে না বেরিয়ে উপায় ছিল না।
রাস্তার একটা ধাবার ধারে বাইকটা থামিয়ে অয়ন রোল নিতে নামল। আমি যেই বললাম যে, আমি খাব না, ব্যস্ত হয়ে উঠল। পেট খারাপ হয়েছে না মাখা ধরেছে জানতে চেয়ে অতিষ্ঠ করতে শুরু করল আমায়।
– ওসব কিচ্ছু না রে বাবা, অন্য অসুবিধা আছে আমার। আমি বললাম।
– কী অসুবিধা আমায় বলতেই হবে। অয়ন জেদ ধরল।
অগত্যা বললাম ওকে গুড ফ্রাইডের ব্যাপারটা।
– গুড ফ্রাইডে তো তোর কী? অয়ন অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে।
– আমার না তো কি তোর? জানিস না আমি ক্রিশ্চিয়ান?
– ইরার্কি মারিস না তো। তোরা তো রায়।
– কে বলল?
– তুই লিখিস যে, হিয়া আর।
– ‘আর’ মানেই কি রায় কিংবা রাহা? রহমান বা রড্রিগস হতে পারে না?
– পারে কি পারে না জানি না, জানি যে তুই নোস।
– ভুল জানিস। আমার নাম হিয়া রড্রিগস। আমি ক্রিশ্চিয়ান। তাই বলে, ধর্ম-ফর্মো মানা পাবলিক ঠাওরে বসিস না আমাকে। কিন্তু এই ব্যাপারটা কী বল তো, জিসাস অত সুন্দর, আর তাকে ওইভাবে পেরেক ঠুকে ঠুকে মারার ব্যাপারটা আমাকে খুব কষ্ট দেয় জানিস। তাই আমার ইচ্ছা করে, নিজের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে-লোকটা, তার কষ্টটা ফিল করতে। অন্তত একটা দিনের জন্য।
অয়ন কীরকম চুপ করে গেল। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বলল, তুই আমায় এভাবে চিট করলি?
– আমি চিট করেছি? তোকে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
– তুই বলিসনি তো কোনোদিন যে, তুই খ্রিষ্টান।
– বলিনি তো বলিনি। আর তুই তো জিজ্ঞেসও করিসনি।
– না, করিনি। কারণ আমার জিজ্ঞেস করার কথা মনে হয়নি। ডরোথি আমাদের বড়দিনে কেক খাওয়াতো। কিন্তু তুই তো…
– আমি অত রিচুয়ালসে বিশ্বাস করি না, বললাম তো তোকে।
– কিন্তু বিয়েটাও তো একটা রিচুয়াল, তাই না? এবার তুই যদি আমাকে…
– যদির কথা উঠছে কেন? যখন সময় আসবে, আই উইল ম্যারি ইউ। অসুবিধা কোথায়?
– পুরোটাই অসুবিধা। আমি মাকে একটা কথা বলে রেখেছিলাম কিন্তু এখন কীভাবে বলব যে তুই হিন্দু নোস? আমাদের বাড়িতে নারায়ণ আছে, রোজ পুজো হয় তার। এবার তোকে সেখানে নিয়ে যাব কী করে?
– এসব কী বলছিস অয়ন? নারায়ণ থাকলে আমি ঢুকতে পারব না? বাব্বা, কীরকম ভগবান রে তোদের, মানুষকে ঢুকতে দেয় না?
– ব্যাপারটা তুই যেরকম ড্রামাটিক করে ভাবছিস, তেমনটা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা খুব কমপ্লেক্স। চল আমাদের কোথাও বসে একটা ডিসিশন নিতে হবে। কী বিপদে যে ফেললি।
– বিপদও নেই, ডিসিশন নেওয়ারও কিছু নেই। আমি শুধু একটা জিনিস আজ জানলাম, যেখানে নারায়ণ থাকে সেখানে আমরা থাকতে পারি না। তা হলে এখন থেকে আমাকে এমন একটা পৃথিবী, এমন একটা দেশ খুঁজতে হবে, যেখানে তোদের নারায়ণ নেই।
– তুই এভাবে রিয়্যাক্ট করছিস কেন বল তো? এটা ইমোশনালি ডিল করা যাবে না। আমাদের বাড়িতে গোপাল প্রতিষ্ঠিত আজ প্রায় একশ বছরের ওপর। সেই জায়গা থেকে কেউ আপত্তি করতেই পারে। কিন্তু আমরা তো কালই বিয়ে করছি না। দশ বছর পর আমার আলাদা একটা এস্ট্যাবলিশমেন্ট হবে। সিচুয়েশন চেঞ্জ করে যাবে।
হাজার বছরে যা পালটায়নি, দশ বছরেই পালটে যাবে? এস্ট্যাবলিশমেন্ট আলাদা হতে পারে। মনটা তো একই থাকবে। আমি বলতে চাইছিলাম অয়নকে। বলতে পারলাম না। কান্নায় আমার বুকের পাঁজর ভাঙছিল। অয়ন অদ্ভুত উদাসীন হয়ে একটা ঘেরাটোপের আড়াল থেকে কথা বলছিল, আর সেটা যে কতটা হিউমলিয়েটিং আমার জন্য, ও কি বুঝতে পারছিল না? একজন মানুষ হিসেবে ও টের পাচ্ছিল না, আমার অবমাননা?
গাছের গায়ে বৃষ্টি এসে লাগছে, কোথায় ধর্ম সেখানে? মাটির ওপর রোদ নামছে তাতে ধর্ম কোথায়? অয়ন বুঝতে পারল না যেদিন রাতে অয়ন ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদছিল, আর ওর চোখের জল আমার ক্লিভেজ ভিজিয়ে দিচ্ছিল, সেদিন কোনো ধর্ম ছিল না। ক্লিভেজের ধর্ম নিজেকে উন্মুক্ত করা আর চোখের জলের ধর্ম ভিজিয়ে দেওয়া। ভালোবাসারও তো একটাই ধর্ম, জড়িয়ে ধরে রাখা। অয়ন অনুভব করল না?
গল্পটা শেষ হতে অভীক অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কোনো কথা না বলে আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইওর পেন। সব পরিচয়ের আগে তো আমরা মানুষ, হিয়া। কেন যে ভুলে যাই।
– আমিও ভুলতে চাই স্যার, কেন যে পারি না। আমি ওর হাত থেকে হাত না ছাড়িয়ে বললাম।
– তোমার পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হলে বলো, আমি যতটা পারি চেষ্টা করব।
আমার খুব ভালো লেগেছিল অভীকের কথাগুলো। এত আন্তরিকভাবে বলছিল ও। না, আমি ওর বাড়ি যাইনি, তবে কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ওই কফিশপটায় বসেছিলাম আমরা, সন্ধের দিকে। আর এবার একটা মারাত্মক কা- করল অভীক। প্রথমে বলল যে, ব্ল্যাক কফি ছাড়া আর কিছু খাবে না কিন্তু একটু পরেই আমার এক-কামড় দেওয়া ব্রাউনিটা তুলে মুখে পুরল।
আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম, করছেন কী, আমার এঁটো খাচ্ছেন কেন?
– তুমি এসব এঁটো-টেটো মানো? অভীক হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল।
– আমি না মানি, আপনারা তো মানেন। এই যে আমার এঁটো খেলেন, জাত গেল না আপনার?
অভীক এবার আর হাসল না। কেমন একটা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যদি সুযোগ পাই সারাজীবন তোমার এঁটো খেতে পারি।
কথাটা এমন বুলেটের মতো বিঁধল যে, তখনকার মতো চুপ করে গেলাম। কিন্তু রাতে ফোন করে অভীককে জিজ্ঞেস করলাম, কেন বললেন তখন ওরকম?
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অভীক বলল, তোমার খারাপ লাগলে সরি। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার যা বলা উচিত মনে হয়েছিল, আমি সেটাই তোমায় বলেছি। আসলে তোমার গল্পটা আমার ভেতরে গ্রো করছে। অয়নও তো সেই ধর্মে বিলং করে যে-ধর্মে আমি বিলং করি। অয়নের ব্যর্থতাটাকে তাই কোথাও একটা আমার নিজের ব্যর্থতা বলেই মনে হচ্ছে।
– আপনি কি অয়নের হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছেন?
– না। সেরকম কিছুই করতে আসিনি। আমি শুধু বলতে চাইছি আমার কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে। আর সেটা বাড়ছে তার কারণ, আমার তোমাকে ভালো লাগে।
আবারো একটা বুলেট ছুটে এলো আমার দিকে কিন্তু যেন শুনতেই পাইনি এভাবে বললাম, আপনি পরে আবার ছেলেগুলোকে নরমে-গরমে কড়কে দিয়েছেন তাই না? ওরা কিন্তু আর একদম জ্বালাচ্ছে না আমাকে।
– কিন্তু আমাকে যে জ্বালাচ্ছে? অভীক কেটে কেটে বলল কথাগুলো।
– কী জ্বালাচ্ছে? জিজ্ঞেস করলাম।
– তোমার মুখটা, হিয়া।
ভাবলাম বলি, এখতিয়ার রেখে কথা বলবেন। এমন কোনো অধিকার আপনাকে দিইনি যে, এত কথা আপনি বলতে পারেন। কিন্তু কিছু বললাম না। ভালো লাগছিল আসলে। যাই হোক না কেন, একটা লোক কোথাও কিছু ফিল করছে। তার মধ্যে কতটা আসল কতটা নকল তাতে কী এসে যায়? ওই যে একটা মানুষের প্রতি আর একটা মানুষের টান, এটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক, সবচেয়ে অনিবার্য বিষয়, যার ভেতরে ভগবান আসে না, শয়তান আসে না, স্বর্গ বা নরক আসে না। আমি তো একটা ঘৃণার পৃথিবীতে একবার গুটিয়ে ছিলাম। স্যারের কথাটা আমায় সেখান থেকে টেনে বের করে নিয়ে এলো। আমি সম্মতি বা অসম্মতি কিছুই জানালাম না, জানাতে হলো না। সমুদ্রের ঢেউ যেমন কারো গোনার কিংবা দেখারও অপেক্ষা করে না, আছড়ে পড়ে তটে, পড়তেই থাকে, অভীকের ভালোবাসা যেন আমার কোনোরকম দ্বিধার তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নিল। আমি নতুন করে ভালোবাসতে শিখলাম, এরকম কিছু বলব না। কিন্তু নতুন করে আগ্রহ ফিরে পেলাম বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্তের ওপর। সত্যি-সত্যি।
আর তার চেয়েও বড়, অন্য দিকটাও দেখতে শিখলাম হয়তো। একদিন এমনিই যখন মার্চেন্ট অব ভেনিস নিয়ে বলছিল অভীক, শাইলকের বেদনাও, আমারই বেদনা হয়ে উঠছিল। শাইলককে যে খ্রিষ্টানরা অপমান করেছে, শাইলক ইহুদি না হয়ে খ্রিষ্টান সুদখোর হলেও কি তারা একইরকম অপমান করত লোকটাকে? ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা অন্য ধর্মের মানুষকে অপমান করে, তারা জানে নিজের ধর্মের কেউ অন্য কোথাও অপমানিত হচ্ছে কিনা? কবে আমরা বুঝব যে ধর্ম মানুষের পরিচয় হতে পারে না, ধর্ম খুব বেশি হলে একটা গেট-পাস, যা দিয়ে কোনো কোনো জায়গায় একটু সুবিধা হয় কারো কারো। মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে, তার ভালোবাসায়। যে ভালোবাসার জোরে পোর্শিয়া ছুটে গিয়েছিল তার বরকে আর বরের বন্ধুকে বাঁচাতে। এতো ভালোবেসে অভীক বোঝাচ্ছিল, এত ভালোবেসে আমার কষ্ট অনুভব করছিল, এত ভালোবেসে আমার হাতটা ধরল যে, টের পেলাম ওকে বিনিময়ে কিছুই দিতে পারি না আমি, ভালোবাসা ছাড়া। একটা ঘৃণার থেকে ছুটে পালাতে পালাতে আমি কিছুটা যেন ঘোরের মধ্যেই একটা ভালোবাসার কাছে সমর্পণ করলাম নিজেকে।
প্রেম হলো আমাদের কিন্তু সেটা পাহাড়ি ঝরনার মতো নয়। খুব শান্ত একটা নদীর মতো কিছু বয়ে যেতে থাকল আমাদের ভেতর দিয়ে। একদিন পাশাপাশি হাঁটছি, এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামল আর দুজনেই ঝুপ্পুস ভিজে গেলাম। একটা শাটার ফেলা দোকানের শেডের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। বলা ভালো, শেল্টার নিয়েছিলাম। একজনের গা থেকে গড়ানো জলের বিন্দু আর একজনের গায়ে গিয়ে লাগছিল। কিন্তু অভীক তখনো জড়িয়ে ধরেনি আমাকে। শুধু নিজের আঙুল দিয়ে ছুঁয়েছিল আমার হাত। আর আমার দিকে তাকিয়েছিল। সেই দৃষ্টিটা এমনই যে, যাকে দেখছে তারও মনে হবে, লোকটা অন্তর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে, শুধু বাইরেটা নয়। আমার এতো পবিত্র মনে হলো নিজেকে, এত ভালো লাগল অভীককে। ভালো লাগল, ওর সংযম, কিছু নেওয়ার আগে যা সবটা দিয়ে ভালোবাসতে চায়।
মাঝখানে ওর শরীর খারাপ হয়েছিল, তোরাও জানিস হয়তো। কলেজেও আসতে পারেনি, বেশ কিছুদিন। আমি সে সময় ওর বাড়ি গিয়েছিলাম একদিন। ওর ঘরে ঢুকে, বিছানায় আধশোয়া যে-মানুষটাকে দেখলাম, তাকে অভীক ভাবতে কষ্ট হলো। আমার সঙ্গে যখন ও কথা বলছে তার মধ্যেই দুবার ঘরে ঢুকলেন ওর বউদি। আমার দিকে কেমন একটা চোখে তাকিয়ে অভীককে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি টিউশন নিতে আসতাম কিনা। অভীকের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে, বাইরের কোনো খাবার খেয়ে অভীকের শরীর খারাপ হয়েছে, তার এক লম্বা ফিরিস্তি শোনালেন। এমনভাবে বলছিলেন যেন, আমার সঙ্গে বেরিয়েই পৃথিবীর যত অখাদ্য খেয়েছে অভীক।
ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, অভীক ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের নারায়ণ বোধহয় আমাকেও বাড়িতে থাকতে দেবে না জানো।
আমি হেসে ফেললাম। কিন্তু সেই হাসিটার গায়ে পৃথিবীর যাবতীয় সিরিয়াসনেস এসে লাগল, যখন সেরে ওঠার পর, আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনই অভীক বলল, হিয়া আমরা দুজন যদি কোথাও মুভ করে যাই?
সেক্স হয়নি, তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতাও নয় তবু, মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দিলাম আমি। মনে হলো, একসঙ্গে থাকতেই তো পারি আমরা। এমন একটা ঘর তো হতেই পারে আমাদের, যেখানে বউদির শাসন নেই, ধর্মের অনুশাসন নেই। শুধু ভালোবাসায় বিশ্বাস করে, ভালোবেসে…
ঠিক হলো যে, আমরা রেজিস্ট্রির নোটিশ দেব। আর ঠিক একমাস পর, দুটো সই আমাদের একজনকে আর একজনের করে দেবে চিরতরে। ফোন-টোন করে অভীকই সব ঠিক করেছিল, আমি শুধু ওর কথামতো উল্টোডাঙা পৌঁছে, কী মনে হলো, ওভারব্রিজটায় উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর ওখানে দাঁড়িয়েই এদিক-ওদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখে পড়ল, বাস থেকে নেমেই অভীক রাস্তা ক্রস করছে, চারদিকে গাড়ি-ঘোড়া কিছু না দেখেই। আমার একবার ভয় লাগল। তারপর একটু ভালোও লাগল, ওর ওই ছটফটানি দেখে। রাস্তা পার হয়ে ও যখন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম যে, ওভারব্রিজ থেকে নেমে আসব কিনা। ও নামতে বলতেই পারত কিন্তু তা না বলে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে ওভারব্রিজে উঠতে লাগল। আর কয়েকটা সিঁড়ি উঠেই বসে পড়ল। হয়তো অসুখ থেকে উঠেছে বলে, হয়তো আমাদের থেকে বয়সে অনেকটা বড় বলে, আমি জানি না… কিন্তু ওর ওই হাঁপানোটা, গরমকালের কুকুরদের মতো একদম। ওপর থেকে কিরকম ঘোলাটে লাগছিল ওর চোখদুটো, কেমন দরদরিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল ওর কপাল থেকে, আর ভিজিয়ে দিচ্ছিল ওর গোটা মুখ।
এই লোকটা অভীক নাকি? এ তো মৃত্যুর কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক। আমার স্বপ্ন, পরিকল্পনা, প্রেম, সব মুহূর্তের মধ্যে চুরমার হয়ে গেল। অভীক যখন আলটিমেটলি আমার সামনে এসে দাঁড়াল তখন আমি ভয় আর দ্বিধা আর বিরক্তির একটা মিক্সচার। আর, কী আশ্চর্য, এই প্রথম অভীক জড়িয়ে ধরল আমাকে। ব্রিজের ওপরেই। ওই অত লোকের মধ্যে; আর জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে শুরু করল আবার। আমি জানি না, তোরা আমায় কী ভাববি, কিন্তু, সে-সময় পৃথিবীর সমস্ত খারাপ-লাগা এসে জড়ো হয়েছে আমার মধ্যে। হবে নাই বা কেন? খ্রিষ্টান মুসলিম হতে পারে, মুসলিম হিন্দু হতে পারে, কিন্তু একটা বুড়ো কখনো জোয়ান হতে পারে না। বার্ধক্য আর যৌবনের ধর্ম আলাদা আলাদা আর আমার সামনে তখন সব ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, যৌবনের ধর্ম। যৌবনের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে আমি কার সঙ্গে জীবন কাটাব? একটা বুড়োর সঙ্গে? সেই তো সবচেয়ে বড় বিধর্মী। অয়নের কাছে যেমন আমি ফিরতে পারি না, অয়ন আমার আত্মাকে অপমান করেছে বলে, ঠিক তেমন করে অভীকের কাছে আমি থেকে যেতে পারি না। তাতে আমার শরীরের, আমার এগজিস্টেন্সের অপমান। আমি মেনে নেব কী করে! এই শরীরের সঙ্গে এই শরীর মেলে না তো। চার্চের স্থাপত্য মন্দিরের স্থাপত্যের সঙ্গে মিলে যেতে পারে কিন্তু ওই ধুঁকতে থাকা শরীরটার সঙ্গে আমার তাজা শরীরটা মিলবে না, মিলতে পারে না। মেলে না বলেই গা গুলিয়ে উঠছিল আমার। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম অভীকের থেকে। বললাম যে, আজ গিয়ে কোনো লাভ নেই। রেজিস্ট্রারের অফিস বন্ধ হয়ে গেছে এতক্ষণে।
– না না, খোলাই আছে। চলো জলদি। আজই কথা সেরে নেব। অভীক বলল।
আমি জীবনের সমস্ত নিষ্ঠুরতা একত্রিত করে বললাম, আজ থাক অভীক। আমার একটু সময় দরকার।
– নোটিশ দেওয়ার পর একমাস সময় পাব তো। তার মধ্যে সব গুছিয়ে নেব। অভীক শিশুর সারল্যে বলে উঠল।
– না, নোটিশ দেওয়ার আগেই সময় চাই আমার। বিয়েটা তো ছেলের হাতের মোয়া নয়, তাই না?
অভীক যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, এভাবে বলল, এসব কথা এখন উঠছে কেন? আমাদের এতদিনের সম্পর্ক…
– কদিনের সম্পর্ক বলো তো? আর কতটা ডিপ আমাদের সম্পর্ক? উই জাস্ট লাভ টকিং উইথ ইচ আদার। কিন্তু তার মানে আমরা তো একটা অবিচ্ছেদ্য কমিটমেন্টে ঢুকে যাইনি।
– তুমি কী বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না হিয়া।
– একটু প্র্যাকটিক্যালি চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে। তখনই তোমার মাথায় খেলবে যে, এভাবে কারো বাড়িতে কিছু না জানিয়ে…
– বাড়িতে জানাতে যাব কেন? বাড়িতে জানালে যদি না মানে?
– যদি না মানে, তা হলে বুঝতে হবে, সেই না মানার পেছনে কোনো কারণ আছে। তারা হয়তো র‌্যাশনালি বিচার করে বুঝছে যে, তোমার-আমার যা এজ ডিফারেন্স তাতে আমাদের দুজনের পক্ষে সুস্থভাবে সংসার করা সম্ভব নয়।
– এটা কি তোমার বাড়ির লোকের কথা, না, তোমারই কথা? আজ নতুন করে রিয়ালাইজ করলে?
– কথাটা যারই হোক, এজ ডিফারেন্সের ব্যাপারটা তো মিথ্যে নয়। সেটা যদি না মানো তাহলেই বরং একটা মিথ্যাচার হবে।
– এই ডিফারেন্সটা তো প্রথম থেকেই ছিল। অভীক কিরকম একটা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল।
– তা হলে প্রথম থেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা দরকার ছিল।
– কিন্তু তুমি তো…
আমি অভীককে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি তো অনেক ছোট তোমার থেকে বয়সে। আমি যদি একটা ভুলও করি, তুমি করতে দেবে? আমি ভাবিনি বলে তুমিও ভাববে না?
আমার শেষ কথাগুলো শোনার পর অভীক আর চোখ তুলে তাকাতে পারল না আমার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, হয়তো তুমিই ঠিক বলছ।
কথাটা বলেই আর একবারও পেছনে না তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। অভীকের ওই নামাটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, একটা ভেঙে যাওয়া মানুষ, বুড়ো হয়ে যাওয়া মানুষ যেন শ্মশানের দিকে এগিয়ে চলেছে। আসলে আমরা সবাই শ্মশানের দিকে, কবরের দিকেই এগিয়ে যাই। তবু মানুষ ক্রমাগত ইয়াং হতে চায়। অভীকের ওই ফিরে যাওয়াটার দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার, চোখ ফেটে জল আসছিল কিন্তু তাও ওকে পিছু ডাকলাম না আমি। কারণ টের পাচ্ছিলাম যে, ওই কষ্ট বা যন্ত্রণাটা নিতে পারব কিন্তু ওই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লোকটার সঙ্গে জীবন জড়াতে পারব না। কিছুতেই না।
তবে ভয় করছিল আমার। ওভারব্রিজের ওই রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে অভীকের যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, অভীক সামলাতে পারবে তো? নাকি একটা খাদের কিনার থেকে খাদের মধ্যে গিয়ে ঝাঁপ দেবে? ওহ জিসাস, অভীক কি সুইসাইড করবে? কিন্তু আমার ভয় ভেঙে দিয়ে অভীক এবার ডাইনে-বাঁয়ে দেখেই রাস্তা ক্রস করল। তারপর একটা ভিড় বাস ছেড়ে দিয়ে পরের বাসটায় উঠে পড়ল। আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম আর তখনই আরো একবার উপলব্ধি করলাম, অভীকের ধর্মটা ফান্ডামেন্টালি আমার থেকে আলাদা। ও বুড়ো হয়ে গেছে, আর বুড়োকে তো সুইসাইড করাও মানায় না। তাকে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে হয়। একটা পুরনো জীবনের মধ্যে।
আমি ওভারব্রিজ থেকে নামতে থাকলাম। একটা নতুন রাস্তা আর একটা নতুন জীবনের খোঁজে।

– আমার সত্যিই কিছু বলার নেই। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– আমার হয়তো আছে কিন্তু এখনই বলব না। আগে দলমার কথা শুনি। তোর্সা বলল।
– হ্যাঁ, দলমা বললেই আমাদের সার্কেলটা কমপ্লিট হবে। হিয়া বলল।
– তুই গুম হয়ে আছিস কেন দলমা? নার্ভাস লাগছে? প্রেমাঞ্জনা জিজ্ঞেস করল।
– নার্ভাস? হেসে ফেলল দলমা।

দলমা
স্যার কী-রকম পড়ায়, টিচার হিসেবে দুর্দান্ত নাকি খাজা, এগুলো আমার কাছে ম্যাটারই করেনি। করবে কেন? আমি তো পড়তে যেতাম না কলেজে। জাস্ট নাম লিখিয়েছিলাম। আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল আমার নাচ। দিনের মধ্যে তিন ঘণ্টা অন্তত প্র্যাকটিস করতাম আর বাকি সময়টাও আমাদের ট্রুপ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে, কলেজ বা পড়াশোনা কোনোটাই প্রায়োরিটি ছিল না। হ্যাঁ, গ্র্যাজুয়েট হতে হবে, বাড়ির একটা চাপ ছিল, তাই নামকাওয়াস্তে… ক্লাসে যখন বসে থাকতাম তখনো মাথার মধ্যে নাচের স্টেপস ঘুরত। যেটা তোলা হয়ে গেছে, যেটা তোলা হয়নি এখনো। এখানে একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, আমার স্বপ্নটা কিন্তু মুখ দেখানোর স্বপ্ন ছিল না, অভিনয়ের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়ে থাকে। নাচের পৃথিবী আলাদা। সবাই আমাকে চিনবে, রাস্তায় চারজন অটোগ্রাফ নেবে, এমনটা নয়। দারুণ কিছু করতে পারলে দেশে-বিদেশে অনেক ঘোরার অপারচুনিটি আছে কিন্তু বেসিক্যালি আমাদের কস্টিউম, মেকআপ, ইনফ্যাক্ট কাজটাই এমন যে, নাচের প্রোগ্রাম খুব হিট হলেও কেউ আমাকে রাস্তায় দেখলেই পিছু-পিছু আসবে এমনটা নয়। মমতাশঙ্কর যদি অভিনয় না করতেন কটা লোক ওনাকে চিনত? এক কথায় আমরা যারা ক্ল্যাসিক্যাল ডান্সের সঙ্গে যুক্ত তারা গ্ল্যামার কোশেন্টের জন্য নয়, প্যাশনের জন্যই নাচি।
এই প্যাশনের জায়গা থেকেই আমি অভীক মিত্রকে পটাতে শুরু করি। লিটারালি। কী করব, ফেঁসে গিয়েছিলাম যে। রাধার ওপর একটা দারুণ প্রোগ্রাম নামাচ্ছিলাম আমরা। সেখানে রাধা, কখনো বাঙালি, কখনো তামিল, কখনো গুজরাতি, কখনো ফ্রেঞ্চ কিংবা আমেরিকান। মোদ্দা কনসেপ্টটা হচ্ছে রাধা। রাধার বিরহ, ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা সর্বত্রই এক, এই পয়েন্টটা হাইলাইট করা। এবার এমন একটা বিষয়ের স্ক্রিপ্ট তো ইংলিশেই হবে। কিন্তু সেই স্ক্রিপ্টটা পড়বে কে? আমাদের ট্রুপের সায়ন্তনদা তো পক্স বাধিয়ে বসে আছে। এদিকে প্রোগ্রামের ডেট এগিয়ে আসছে, হল ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে, কার্ড ছাপাতে দিতে হবে ইমিডিয়েটলি কিন্তু স্ক্রিপ্ট পড়ার লোক আমি পাই কোথায়? তখনই একদিন অন্যমনস্ক হয়ে ক্লাসে বসে আছি আর অভীক অনর্গল বকে যাচ্ছে, ক্লিক করে গেল আইডিয়াটা। আরে, এই লোকটাকে বললে কেমন হয়? আর দশ মিনিটের মধ্যে আমার ভাবনাটা জেদে পালটে গেল। ইয়েস, অভীক মিত্র ইজ দ্য ম্যান। আমাদের ডুবতে বসা নৌকাটাকে যদি ভাসিয়ে তুলতে হয় তো এই লোকটাকে চাই-ই চাই।
ক্লাস শেষ হওয়ার পরই আমি ওর পিছু নিলাম। আর ও সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছে তখন একদম ওভারটেক করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অভীক প্রথমে ভেবেছিল, আমি বোধহয় প্রাইভেটে পড়ার কথা বলতে গেছি। আমাকে, অন্য একটা ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলল। কিন্তু যে-মুহূর্তে বুঝল আমার দরকারটা অন্য, কাটিয়ে দিতে চাইছিল। আর আমিও কি ছাড়ার বান্দা? ও যত ব্যস্ততার অজুহাত দিক, ততক্ষণে আমার মাথায় ও সেট হয়ে গিয়েছে। তাই সেদিন গোটা দিনটা ওর সঙ্গে লেগে থেকে অবশেষে ওকে পাকড়াও করলাম টিচার্স রুমেই। ক্লাসের পর ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত অভীক কিছুটা বিরক্ত গলায় বলল, কি দরকারটা কী তোমার?
আমি স্ট্রেট ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে বাঁচাতেই হবে আপনাকে।
কথাটা শুনেই অভীক চমকে গেল টের পেলাম। আড়চোখে ওর সামনে বসা কলিগের দিকে তাকাল একবার। তারপর গলা নামিয়ে বলল, কেন, কী হয়েছে তোমার?
আমার যে কী হয়েছে সেটা শুনে অভীক একদম মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ভাগিয়ে দিলো আমাকে। আমি যত রিকোয়েস্ট করি ও ততই বলে যে, ‘অ্যাঙ্কারিং-ফ্যাঙ্কারিং’ ওর দ্বারা হবে না। একটা সময় হাল প্রায় ছেড়ে দিচ্ছিলাম আমি। শেষে কী মনে হলো বললাম, উৎপল দত্ত যদি না বলতেন তাহলে কি ‘সপ্তপদী’র ওখেলো সিকোয়েন্সটা ওরকম জমত বলুন? আমি আর কার কাছে যাব? আমি যে আপনার মতো ইংলিশ বলতে আর কাউকে শুনিনি। সেজন্যই আপনাকে চাইছি। এবার আপনি, ‘না’ বলে দিলে, প্রোগ্রামটা ডুবে যাবে।
উৎপল দত্তের রেফারেন্সে কিংবা আমার ঘোর অসহায়তার কথা শুনে অভীক একটু গলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি কিন্তু স্টেজে উঠতে পারব না।
– স্টেজে ওঠার দরকার নেই তো! স্টেজে যা করার আমি করব। আপনি উইংসের আড়াল থেকে ভয়েস-ওভার দেবেন।
– সেটা তো তোমরা রেকর্ড করেও চালাতে পারো।
– নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু সেই মুহূর্তে যদি করেন, তা হলে যতটা লাইভলি হয় ব্যাপারটা রেকর্ড চালালে ততটা হয় না।
অভীক আমার দিকে তাকাল, এক্ষুনি কথা দিতে পারছি না। আমাকে আগে স্ক্রিপ্টটা একটু পড়তে হবে।
আমি তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে চলে এলাম আর পরদিনই স্ক্রিপ্টের একটা জেরক্স, কলেজেই ওর হাতে তুলে দিলাম। আমাকে সামনে দাঁড় করিয়েই অভীক উলটাতে লাগল স্ক্রিপ্টটা আর মাঝেমধ্যে সেনটেন্স কনস্ট্রাকশন কিংবা প্রিপোজিশনের ভুল ধরছিল। কিন্তু ওর সেই ভুল ধরার কায়দা থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম যে, আমি ঠিক রাস্তাতেই এগিয়েছি।
দুদিন পর স্ক্রিপ্টের কপি আমায় ফেরত দেওয়ার সময় অভীক বলল, কনসেপ্টটা খুবই ভালো। দু-একটা মাইনর চেঞ্জ করতে পারো, তবে ওভারঅল ইটস ভেরি গুড।
– তাহলে আপনি করছেন তো? আমি পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক জিজ্ঞেস করলাম।
অভীক আমার সামনে থেকে চলে যেতে যেতে বলল, উইল সি।
সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঘর যেমন আলোয় আলো হয়ে যায়, ওই ‘উইল সি’ শব্দ দুটোও তেমন করেই আমার সব দুশ্চিন্তা ভাগিয়ে দিলো একপলকে। আমি বুঝলাম যে, অভীক করবে কাজটা। বাস্তবে অবশ্য আর একটু বেশি সময় লেগেছিল ওকে রাজি করাতে। কিন্তু আলটিমেটলি ও এলো আমাদের রিহার্সাল রুমে। মন দিয়ে দেখল আমাদের, পার্টিকুলারলি আমার পারফরম্যান্স। আমিই তো ‘রাধা’ করছিলাম। আমার ওই ‘ফ্রেঞ্চ’ রাধা থেকে ‘গুজরাতি’ রাধায় ট্রান্সফরমেশন ওকে মুগ্ধ করছিল, আমি নাচতে নাচতেই বুঝছিলাম। কিন্তু ও যে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে, অ্যানালিসিস করছে মনে মনে, সেটা টের পেলাম রিহার্সাল রুম থেকে বেরোনোর আগে ওর কথায়।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার কেমন লাগল?
অভীক উত্তর দিলো, ভালো বা মন্দ বললে খুব ক্লিশে শোনাবে। তাই ওসব কিছুই বলব না। জাস্ট বলব যে, এটা এক্সেলেন্ট হতে পারে।
আমি অভীকের দিকে তাকালাম, কীভাবে?
অভীক পাঁচ সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, দ্যাখো, তুমি ড্রেস চেঞ্জ করার পাশাপাশি অভিব্যক্তিগুলোও চেঞ্জ করছ। কিন্তু আমার মনে হয়, জাপানি হোক, কোরিয়ান হোক, বাঙালি বা ব্রিটিশ হোক, ‘রাধা’ অরিজিনালি একটা মেয়ে নয় শুধু, রাধা একটা কনসেপ্ট; আর সেই কনসেপ্টটা হলো বিরহ। এবার সেই বিরহ তো প্রত্যেকটা মেয়ের ক্ষেত্রে একই হবে, তাই না? রাধা বিরহী, মীরা বিরহী, কিটসের ‘ওড টু দা নাইটিঙ্গেল’-এ রুথ বলে যে মেয়েটার কথা আছে, ভিনদেশের ফসল ক্ষেতে দাঁড়িয়ে যার চোখ কান্নায় ভিজে যায়, সেও কি বিরহী নয়? তুমি একটা স্ট্রেটলাইন তৈরি করো, বিরহের; আর সেখানে এক একটা বিন্দুর মতো প্লেস করো তোমার এক একটা রাধাকে। ভুল বললাম?
কথাগুলো শুনতে শুনতে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল অভীককে। আমি তো শুধু রিহার্সাল দেখানোর জন্য ডেকে এনেছিলাম লোকটাকে আর ও দেখতে দেখতে এতটা ইনভলভড হয়ে গেছে ব্যাপারটার সঙ্গে? আমায় গাইড করতে শুরু করেছে?
তারপর থেকে অভীক মাঝেমাঝেই আসত রিহার্সাল দেখতে, এক-আধদিন টিউশন না করিয়েও। আমাদের ট্রুপের ঘরে বসেই ও ফোনে ঢপ দিচ্ছিল স্টুডেন্টদের, আমি নিজের কানে শুনেছি। ওর নাকি খুব জ্বর, আজ ক্লাস নিতে পারবে না, আরো কত কী। আমার হাসি পাচ্ছিল শুনতে শুনতে, আবার একই সঙ্গে ভালোও লাগছিল এইটা ভেবে যে, থোড়-বড়ি জীবনের মধ্যে অভীক কোথাও একটা 888sport live chatকে অনুভব করছে এখন, প্রতিটা মুহূর্তে। আর সে-টানেই ছুটে আসছে বারবার। টান একটা আমার দিক থেকেও তৈরি হয়েছিল ওর প্রতি কিন্তু সেই টানের রিমোটটা ছিল ‘নাচে’র হাতেই। কীভাবে আমাদের প্রেজেন্টেশনটাকে একদম সুপার্ব করে তোলা যায় আর অভীককে কতটা ইউজ করা যায় সেই কাজে, এর বাইরে কিছু মাথাতেই আসেনি তখনো। হ্যাঁ, ও যত মিশে যাচ্ছিল আমাদের ট্রুপটার সঙ্গে, কাজটাকে ‘কাজ’ না ভেবে জড়িয়ে পড়ছিল, তত ভালো লাগছিল আমার। সম্পর্কের মধ্যে লেজেগোবরে জড়িয়ে যাওয়াটায় আমার সত্যিই কোনো ভালোলাগা ছিল না, আমার ভালোলাগা আমি খুঁজে পেতাম অভীককে দেখে। যখন ওই বারো-চোদ্দোটা মেয়ের কোমরের দুলুনি, হাতের ভঙ্গিমা, একসঙ্গে নিচু হয়ে আবার একসঙ্গেই উঠে দাঁড়ানো, আর তার মধ্যেই আলাদা আলাদা টার্ন নেওয়া দেখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠত অভীকের চোখে, আমি ভীষণ আনন্দ পেতাম। মনে হতো, ওর মনে নাচের প্রতি ভালোবাসাটা জাগিয়ে তুলতে পেরেছি।
আমার মনে হওয়াটা যে ভুল নয়, তার প্রমাণ পেলাম খুব শিগগিরই। আমাদের রিহার্সাল রুমটার পেছনেই একটা ঝিল ছিল আর সেটা আবার এলাকারই এক খতরনাক প্রোমোটার বুজিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করছিল। অনেক লোক গিয়ে বাধা দেওয়ায়, সেই চক্রান্ত ফ্লপ করে। আবারো যাতে ঝিল বোজানোর চেষ্টা না শুরু হয় তার জন্য ওই ‘ঝিল বাঁচাও কমিটি’ উদ্যোগ নিয়ে আলো দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল ঝিলের চারধার। আমরাও চাঁদা-টাদা দিয়েছিলাম। একদিন রিহার্সালের পর বাকিরা বেরিয়ে গেছে, আমি আর অভীক হাঁটছি ঝিলের পাশ দিয়ে, অভীক হঠাৎ বলল, আজ পূর্ণিমা, তো? আমি ঘাড় নাড়তেই বলে উঠল, এই জলের নিচে যেমন চাঁদটা, মানুষের ভেতরেও তেমন নাচ। আদিম মানুষের চলার যে-ছন্দ সেটাই তো নাচ, বলো? আমরা জীবনটাকে এমন মেকানিক্যাল করে ফেলেছি যে, এই ছন্দটা হারিয়ে গেছে। থ্যাংকস টু ইউ দলমা, এই ছন্দটা ফিরে আসছে আমার মধ্যে। আমি তো সারাজীবন শুধু 888sport app download apk আর গল্প ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সবাইকে দিয়ে এলাম, কিন্তু তোমাদের মধ্যে বসে মনে হয়, তোমরা একটা কিংবদন্তিকে দু-আদ্ধেক করছ না, বরং কথার বদলে শরীরের এক্সপ্রেশন দিয়ে নতুন প্রাণ দিচ্ছ তাতে। যে-ইমোশনগুলো মুখে বললে মরে যায়, একদম পিরামিডে মমি হয়ে শুয়ে থাকে, তোমাদের নাচের মধ্য দিয়ে তাতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছে, আমি দেখতে পাই। আই সোয়্যার।
সেদিন বোধহয় অল্প একটু প্রেমে পড়েছিলাম অভীকের। কিন্তু অনেক বেশি প্রেমে পড়েছিলাম ওই ঘটনাটার, যে, আমাদের প্রজেক্টটা দারুণভাবে শেপ নিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম প্রোগ্রামটা স্টেজে পড়লেই ফেটে যাবে। আর তারপর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে ডাক পাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময়, সময় আর সময়। সময়ই তো সব। তাই সে যখন স্মুথলি চলতে চলতে ঠোক্কর খায় পাথরে আর চুরমার হয়ে যায় এবড়োখেবড়ো মুহূর্তে, তখন ঠিক থাকে না মাথার। স্টেজ রিহার্সালের দিন ঠিক সেটাই হলো আমার।
আমাদের কলেজেরই দু-তিনটে মেয়ে উইশ করতে এসে খালি খোঁচাচ্ছিল, স্যার রাজি হয়ে গেল ভয়েস-ওভার দিতে? তুই বললি আর অমনি রাজি হয়ে গেল?
শুনতে শুনতে আমি, কিছুটা বিরক্তিতে, আর কিছুটা ক্যাজুয়ালি বলে বসলাম, ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে, আমি ডেকেছি তারপরেও আসবে না? আমাকে রিফিউজ করবে অত ক্ষমতা আছে নাকি অভীক মিত্রের?
কথাটা বলতে বলতেই দেখলাম আমার সামনের মেয়ে দুটোর মুখ দুটো পালটে যাচ্ছে। সেই পালটে যাওয়ার কারণ খুঁজতে পেছন ঘুরে দেখলাম অভীক দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ে দুটো সরে পড়ল প্রম্পটলি। আর আমি অভীকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে টের পেলাম যে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত বরফ হয়ে গেছে, আর কোনোদিন কোমর কিংবা পা তো দূরস্থান, হাতের একটা আঙুলও নাড়াতে পারব না। অভীক আমার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে বলল, আমার ঘাড়ে তো একটাই মাথা, তাই না?
আমি একদম বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অভীকের হাতে আমাদের স্ক্রিপ্টের একটা জেরক্স ছিল। ও সেটা আলতো করে মাটির ওপর ফেলে দিয়ে বলল, তুমি অন্য লোক দেখে নিও। যার ঘাড়ে একটার বেশি মাথা আছে। বলেই হাঁটা লাগাল।
অভীককে চলে যেতে দেখেই আমার গলায় আওয়াজ ফিরে এলো আবার। আমি ওর পেছন-পেছন ছুটে গেলাম, ‘ক্ষমা করে দিন’ বলতে বলতে।
অভীক আমায় একটুও পাত্তা না দিয়ে অডিটরিয়াম থেকে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। আমার ট্রুপের দু-একজন আমার সঙ্গে আসতে চাইছিল। আমি ওদের প্রায় ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে অভীকের পেছনে ছুটে গেলাম। যখন ওকে ধরতে পারলাম তখন হাঁপাচ্ছি। দম নিতে নিতে বললাম, আমার জন্য আমার দলটাকে ডোবাবেন না প্লিজ। আপনি যা ভাবছেন আমি আদৌ সেরকম কিছু বলতে চাইনি।
– তুমি কী বলতে চেয়েছিলে সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তুমি কী বলেছ সেটা আমি নিজের কানে শুনেছি। তারপরে এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তো এখানে টাকা রোজগার করতে আসিনি যে তোমার অপমান সহ্য করে থাকব। সরি।
– আমি আপনাকে অপমান করতে চাইনি। বিলিভ মি।
– আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। বলেই অভীক জোরে হাঁটা লাগাল।
হাঁটতে হাঁটতে ও একটা অন্ধকার গলির ভেতর ঢুকে গেল। আমিও পেছন পেছন যেতে লাগলাম। শেষে গলিটা যখন রাস্তার মুখে চলে আসবে, দেখলাম আর উপায় নেই। আমার ওই একটা কথার জন্য আমার সর্বনাশ হতে চলেছে। সেই সর্বনাশটা হতে দিতে চাই না বলে পেছন থেকে জাপটে ধরলাম অভীককে। জাপটে ধরে বলতে থাকলাম, আমি আপনাকে যেতে দেব না। কিছুতেই আপনি যেতে পারেন না এভাবে আমাদের ডুবিয়ে।
– দলমা তুমি ছাড়ো, রাস্তার মধ্যে এভাবে সিনক্রিয়েট করো না। অভীক কথাগুলো বলতে বলতে আমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আমি পেছন থেকে ওর গলায়-ঘাড়ে অজস্র চুমু খেতে লাগলাম। কীভাবে কী করছিলাম আজো জানি না। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার আদরের ঝাঁপটায় অভীকের রেসিস্ট্যান্স একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ও শেষমেশ আর না পেরে আমার দিকে ঘুরল, কী করছ এগুলো? ছাড়ো। আমি কিছুতেই ওখানে যাব না। বলতে বলতে আমায় ছাড়িয়ে দিলো নিজের থেকে।
– আপনাকে আসতেই হবে। বলে আমি আবার জড়িয়ে ধরলাম ওকে। আর জড়িয়ে ধরে বুঝতে পারলাম শুধু আমার বুক নয়, ওর বুকটাও হাঁপরের মতো ধকধক করছে। সাইকেলে বা রিকশায় যেতে যেতে দু-একজন দেখে গেল। অভীক শিউরে-ওঠা গলায় বলল, চেনা কেউ দেখে ফেললে আমার সর্বনাশ হবে।
আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, কিচ্ছু হবে না। আপনার চাকরি কেউ কাড়তে পারবে না। আর কাড়লেই বা কী? আপনি এত ভালো পড়ান, দশটা কলেজ আপনাকে লুফে নেবে।
অভীক এত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল যে, কিছু বলতে পারল না। শুধু আমার হাতটা ধরল একবার।
উলটোদিকে আমারও কি টেনশন হচ্ছিল না? হচ্ছিল। কিন্তু সেই টেনশন ছাপিয়ে একটা আনন্দ বল্গাহীন উচ্ছ্বাসের মতো ফেটে বেরোতে চাইছিল। কারণ, প্রোগ্রামটাকে কেউ ডোবাতে পারবে না আর। আমরা জিতবই। জিতলামও। পরদিন অভীক এতো ভালো পারফর্ম করল যে, প্রোগ্রামের পর সাহেবরা এসে ওর গালে গাল ঠেকিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। মিডিয়ায় খুব ভালো কভারেজ পেলাম। নাচের কভারেজ তো আর হানি সিংয়ের গানের কভারেজের মতো হবে না। যে কর্নারগুলোতে পাওয়ার কথা, সেইসব জায়গাতে পেলাম। এখানেও অনেক পলিটিক্স, অনেক গ্রুপবাজি, কিন্তু আমাদের ওই রাধার প্রোগ্রামটা হিট হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে সাত-আটটা কল-শো পেয়ে গেলাম। বিদেশ থেকে দুটো কল-শোর প্রতিশ্রুতি পেলাম। ঠিক কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য নয়, একসঙ্গে সাকসেসটা সেলিব্রেট করব বলেই একদিন অভীককে সঙ্গে নিয়ে খেতে গেলাম কোয়েস্ট মলে। নতুন একটা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট হয়েছে ওখানে, কস্টলি কিন্তু দুর্দান্ত। ওখানে বসেই আমার মনে হলো, বিদেশে প্রোগ্রাম করতে গেলেও আমার অভীককে চাই। ‘রাধা’ প্রোগ্রামটা নিয়ে আমাকে যদি বিশ্বজয়ে বেরোতে হয় আমার দলের মধ্যে অভীকের থাকা দরকার। একটা ফুটবল টিমের ম্যানেজার যেভাবে একজন দারুণ ফুটবলারকে দলে তুলে নিতে চায় আমি অভীককে তুলে নিতে চাইলাম। বুঝতে পারছিলাম এই তুলে নেওয়াটা খুব সহজ হবে না, কারণ একটা নাচের ট্রুপের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোটা একজন ইংরেজির অধ্যাপকের প্রায়োরিটি হতে পারে না। আমাকে কোথাও অভীককে ইমোশনালি আনস্টেবল করতে হবে। আমি হয়তো ওকে ব্যবহার করছিলাম বাট স্টিল, আমি সদ্ব্যবহার করছিলাম। নিজের জন্য তো নয়, আমার 888sport live chatটাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমার ওকে দরকার মনে হচ্ছিল। সেই মনে হওয়ার ভেতরে 888sport live chat বেশি, না স্বার্থ, কে সেই বিচার করবে? আর তাছাড়া আমি উনিশটা মেয়েকে নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াব, আমার তো গার্জিয়ানের মতো কাউকেও চাই।
রাস্তায় বেরিয়ে অভীককে বললাম, আমার সঙ্গে বিদেশে যেতে হবে তোমাকে। তুমি না থাকলে আমি একা পারব না। সেদিনের সেই জড়িয়ে ধরার পর থেকে আমি ওকে আর আপনি করে বলতাম না।
– কিন্তু আমার আলাদা টিকিট, আলাদা খরচ, কি দরকার! ওগুলো রেকর্ড করে নিয়ে গেলেই তো হয়। অভীক বলল।
– রেকর্ড করে নিয়ে গেলে সেই আমেজটা আসে না তোমাকে আগেও বলেছি। তাছাড়া তুমি আমায় একা ছেড়ে দেবে, দুনিয়ায় ঠোক্কর খাওয়ার জন্য?
অভীক শেষ কথাটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আমার হাতটা ধরে বলল, আমি কাউকে ছেড়ে যাই না, আমাকেই ছেড়ে চলে যায় সবাই।
আমার একটু বেশি সেন্টিমেন্টাল লাগল কথাটা তাও একটু হেসে বললাম, আমি কোথাও যাচ্ছি না; উই উইল ওয়াক টুগেদার, উই উইল মুভ টুগেদার, উই উইল এনজয় টুগেদার।
অভীক এবার তাকাল আমার দিকে। কিছু বলল না।
এর কয়েকদিন পরেই আমাদের বাড়িতে এসেছিল ও। আমিই ডেকেছিলাম। দুপুরে। মা আর ড্যাডি অফিসে, কাজের মাসি দেশে গেছে, ফ্ল্যাট পুরো ফাঁকা। কিন্তু না, তাও তেমন কিছুই হয়নি। ওই জড়িয়ে ধরা, একটু-আধটু চুমু। আর একটু বেশিও হতে পারত কিন্তু অভীকই আমায় আদর করতে করতে থেমে গিয়ে বলল, তুমি একটু নাচো না, আমি একা দেখব।
আমি হেসে ফেললাম, এভাবে কি নাচ হয় নাকি, মেকআপ নেই, মিউজিক নেই।
অভীক আমার কথা পাত্তা না দিয়ে গুনগুন করে একটা গান ধরল, ‘হতাম যদি তোতাপাখি তোমায় গান শোনাতাম, হতাম যদি বনময়ূরী তোমায় নাচ দেখাতাম’। আমার মনে হলো, ওই ঘরটাই যেন জঙ্গল। একদিকে নদী, ঝরনা, আর একপাশ ধরে ছোট্ট রাস্তা চলে গেছে। বিবিসির একটা প্রোগ্রামে একবার দেখেছিলাম, হাতির দল কীভাবে একটা জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে চলে যায়; দক্ষিণ ভারতে যে-হাতির জন্ম সে খাবারের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে কখন ডুয়ার্সে পৌঁছে যায়। আবার ডুয়ার্সের হাতি কর্ণাটকের প্রত্যন্তে চলে যায়। জঙ্গল থেকে জঙ্গলে ওই যে যাত্রা, মনে হচ্ছিল আমিও যেন ওই যাত্রাটার মধ্যে আছি। আমি যেন সেই বনময়ূরী, যে একটা জঙ্গল থেকে আর একটা জঙ্গলে উড়ে বেড়াচ্ছে।
অভীক মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখছে, টের পাচ্ছিলাম। আর আমি নাচের মধ্য দিয়ে আমার ভেতরের সমস্ত আকাক্সক্ষা, সবটুকু প্যাশন, এমনকি যন্ত্রণাও তুলে আনছিলাম। আসলে অনেকগুলো রোল করে দেখাচ্ছিলাম তো অভীককে। যশোদার ভূমিকাটা নিতেই সেই আছোঁয়া দুঃখের জায়গাটা অনেক দিন পর সামনে চলে এলো। ভেতরের পাঁজরগুলো যেন ভেঙে যাচ্ছিল। আমি নাচছিলাম আর আমার প্রত্যেকটা ভঙ্গিমার ভেতরে সেই যন্ত্রণাটা ফুটে উঠছিল। আমি একটা অশরীরী অবয়বকে ননী-মাখন তুলে দিচ্ছিলাম। যে নাচে সে তো তাই করে। গোপাল কাল্পনিক হলেও যশোদা তো নয়। কিন্তু আমার গোপালকে তো আমি শেষ করে দিয়েছি। সেই অদ্ভুত কষ্টটা কতদিন পর আবার আমার মধ্যে ফিরে এলো। কষ্টটা আমায় ওভারকাম করছিল। 888sport live chatীর ভেতরের যন্ত্রণাটা কি 888sport live chatী সবসময় লুকিয়ে রাখতে পারে? সাধারণ মানুষ হওয়ার অধিকার নেই তার? সে কাঁদতে পারবে না? কেন?
নাচটা শেষ হওয়ার আগেই আমি হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। একটা মুহূর্ত পর্যন্ত অভীক ভেবেছিল যে, আমার কান্নাটা, আমার নাচেরই একটা অঙ্গ। তারপর, বুঝতে পেরে মেঝেয় বসেপড়া আমার সামনে উবু হয়ে বসল। আমি ওর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, আমি পারছি না। ওকে হারানোর বেদনাটা সহ্য করতে পারছি না।
– কাকে? তোমার বয়ফ্রেন্ডকে?
– নো, নট মাই বয়ফ্রেন্ড। আই হেট হিম।
সেই মুহূর্তে আমি অভীকের কাছে কিছু চাপা রাখতে পারিনি। আমার সেই অ্যাফেয়ারের কথা, দীপ্তেশের কথা আর যে-বাচ্চাটা আমার পেটে চলে এসেছিল তাকে অ্যাবর্ট করার কথা। আজ তোদেরও বলছি, তিন বছর আগে, আই ড্রপড দা বেবি। আই হেট দীপ্তেশ, ও আমাকে ডমিনেট করতে চাইত, ভোগ করত; কিন্তু আমি তো ওর সঙ্গে ভালোবাসা নিয়ে মিশেছিলাম, আর ভালোবাসার সময়ে সারাক্ষণ প্রটেকশন নেওয়ার কথা খেয়াল রাখতে পারিনি। তাই একটা নতুন প্রাণ চলে এসেছিল আমার ভেতরে, তাকে ড্রপ না করে কি উপায় ছিল আমার! নার্সিংহোমের একটা ঠান্ডা ঘরে যখন আমার মধ্য থেকে টিস্যুটাকে নিয়ে নিচ্ছিল, তখন যেন আমার ভেতর থেকে নাচটাকে নিয়ে নিচ্ছিল। ও আসছিল, আমাকে বিশ্বাস করে আসছিল। কিন্তু ওকে মরতেই হলো।
শুনতে শুনতে আমার দিকে তাকিয়ে অভীক বলল, মরে গেল? কী করে মরল? জন্মের আগেই মৃত্যু! সম্ভব?
কথাটা আমাকেও ঘা দিলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে চুপ করে গেলাম।
অভীকও চুপচাপ আমার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল সেদিন। তারপর পারতপক্ষে ফোন করছিল না আমাকে, দেখাও নয়। মনে হচ্ছিল ও আমাকে অ্যাভয়েড করছে। একদিন কলেজেই ওকে একা পেয়ে বললাম, একবার বলে দিলেই হতো, এভাবে অ্যাভয়েড করার দরকার নেই।
অভীক চোখ না সরিয়েই বলল, নিজেকে নিজে অ্যাভয়েড করছি। কাল আমার অফ ডে আছে। কাল যাব তোমার বাড়িতে।
– কাল আমি বাড়িতে থাকব না, বলে সরে এলাম। তারপরই অভীকের ফোন। ফোন না ধরতেই মেসেজের পর মেসেজ। আমি উত্তর দিচ্ছিলাম না কিন্তু একই সঙ্গে উত্তর দিতে চাইছিলাম। জীবনের এত বড় একটা ঘটনা, যেটা দীপ্তেশ আর আমার খুব ক্লোজ একজন বন্ধু ছাড়া কেউ জানত না, অভীকের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম। আর শেয়ার করেছিলাম বলেই ভালনারেবল হয়ে গিয়েছিলাম।
পরদিন অভীক যখন আমার বারণ সত্ত্বেও আমার ফ্ল্যাটে এলো, আমায় জড়িয়ে ধরল, আমি বাধা দিতে পারলাম না ওকে। বরং কেমন একটা শান্তি লাগছিল ওর বুকে মাথা রেখে। মনে হচ্ছিল, ও যেন সরে না যায় আমার থেকে।
যেন আমার মনের কথা আঁচ করেই অভীক বলল, সবসময় সঙ্গে আছি।
সেই দিন থেকে ও আমার প্রত্যেকটা দরকারে অ-দরকারে, আমার সঙ্গে থাকতে লাগল। দলের অনেকেই ফিসফাস আরম্ভ করল, আমার কানেও আসত সেসব। ওরা জানত দীপ্তেশের কথা; কিন্তু আমার যন্ত্রণার কথাটা জানত না। জানত না বলেই, ওদের কাছে ব্যাপারটা একটা নতুন অ্যাফেয়ার ছিল, কিন্তু আমার কাছে ওটা ছিল রিটার্ন টু লাইফ।
সেই আনন্দেই ডুবেছিলাম আমি, কিন্তু একদিন ফেরার পথে অভীক আমায় বলল, বিদেশ থেকে ফেরার পরই আমরা কিন্তু প্ল্যান করব।
– কিসের প্ল্যান? আমি খুব সরলভাবে জানতে চাইলাম।
– আমাদের বিয়ের। বাচ্চার।
– বাচ্চা? আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকালাম অভীকের দিকে।
– হ্যাঁ, অবশ্যই। না হলে, তোমার এই যন্ত্রণা তো নাচে মিটবে না দলমা। যে চলে গেছে তাকে না পারি, যে আসতে পারে তাকে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের দুজনের মধ্যে একটা বাচ্চা যখন হামাগুড়ি দেবে, হাঁটতে শিখবে তখন দেখবে, আর সেই পুরনো মৃত্যু আমাদের ছুঁতে পারবে না।
আমি স্টানড হয়ে গেলাম একদম। আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল আর তার জন্য আমার একটা যন্ত্রণা আছে ঠিকই। ঠিক যেমন আমার তৈরি করা একটা পুতুল ভেঙে গেলে যন্ত্রণা হতো। জ্যান্ত পুতুলের জন্য যন্ত্রণা অনেক বেশি কিন্তু তার মানে কি 888sport cricket BPL rate বছর বয়সে আমি বিয়ে করে মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত নাকি? ‘বাচ্চা’ ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটা অভীক জানে? কোনো পুরুষ জানে? তাদের কাছে বাচ্চা একটা অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু সেই অ্যাচিভমেন্টটা যার মাধ্যমে হয়, তার কী হয়? ওই যে লোপামুদ্রাদি কি অসম্ভব ভালো নাচত, কিন্তু মেয়ে হওয়ার পরও শ্বশুরবাড়ির চাপে একটা ছেলের জন্য আবার কনসিভ করতে হলো ওকে। আর দুটো বেবি হওয়ার পর একেবারে লেজেগোবরে হয়ে বসে আছে। দুটো সিজার, আর আরো একটা কীসের অপারেশন করানোর পরে আসে যায় নাচের দলে, কিন্তু নাচের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই আর। পুরুষের কাছে যেটা থিওরি, মেয়েদের কাছে সেটাই প্র্যাকটিক্যাল। তাছাড়া আমি এখন ওভাবে ভাববই বা কেন? কিন্তু আমাদের সম্পর্কের শুরু থেকে অভীক ক্রমাগত ওইসব বলতে শুরু করল। বলতে বলতে ও যে কী সাধারণ হয়ে গেল আমার কাছে। ওকে আমি একটা অসাধারণত্বের জায়গা দিয়েছিলাম, ওর ভাবনা-ভাষা-লেখা, আমার 888sport live chatটা আরো উঁচু আকাশে নিয়ে যাবে, এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু যখনই ও কেবলমাত্র একজন ‘বাবা’ হতে চাইল, যে ঘরে পাজামা বা লুঙ্গি পরে বসে আছে আর বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং দিচ্ছে, অভীকের প্রতি আমার টানটা হারিয়ে যেতে শুরু করল। অভীক, ওই ‘জন্মের আগেই মৃত্যু’ কথাটা বলে আমাকে বারবার খোঁচা দিত। শুনতে শুনতে একদিন মনে হলো মৃত্যুটাই তো স্বাভাবিক, প্রতিটা মানুষের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। জন্মটাই একটা অ্যাকসিডেন্ট, আমরা হতে পারতাম, নাও হতে পারতাম। কিন্তু হয়েছি যখন মরতেই হবে তখন। অ্যাবরশন না করিয়ে আমি যদি জন্মও দিতাম, সেই বাচ্চাটাও তো একদিন মরত। একশ বছর পরে হলেও মরত। ডেফিনিটলি। কিন্তু এই বাচ্চাটা নাই পেতে পারতাম আমরা। তাই প্রতিটি মুহূর্ত এই বাচ্চাটাকে এনজয় করা জরুরি। আর অভীক সেই এনজয়মেন্ট থেকে সরিয়ে এনে, রুটি বেলা একটা মহিলায় ট্রান্সফর্ম করতে চাইছিল আমায়। আমি ওকে এমনভাবে দাবড়ে দিতে পারতাম যে, দ্বিতীয় দিন ও আর এই প্রসঙ্গ তুলতে সাহস পেত না। কিন্তু তখন আমার ওকে প্রয়োজন ছিল, ও তখন আমার দলের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে, স্ক্রিপ্ট থেকে ফরেন ট্যুর সমস্ত কিছুতে আমি এমনভাবে ওর ওপরে নির্ভরশীল যে, ঘাঁটাতে চাইছিলাম না।
জার্মানি যাওয়ার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল অভীক বলতে লাগল, আমরা জার্মানি বা ইংল্যান্ডে সেটল করে যেতে পারি না? তাহলে তোমার নাচটা আরো ফ্লারিশ করে। আমিও নিশ্চয়ই ওখানে টিচিং রিলেটেড কাজ পাব। ব্যস, তারপর আমি-তুমি আর আমাদের বাচ্চা!
সবকিছুর মধ্যে ওর ওই বাচ্চার কথা এলেই আমার গা জ্বলে উঠত। কেন, আমি বিদেশে সেটল করব কেন? কোনো একটা জায়গায় সেটল করে যাওয়া মানেই গায়ে শ্যাওলা জমে যাওয়া। আমি 888sport live chatী, আমি কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী, টার্কি থেকে টরন্টো নেচে বেড়াব। কত স্টেজ, কত কত দর্শক, তাদের ভেতরে আমি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে দিতে যাব।
সেই অনেক দর্শকের মধ্যে কোথায় যেন আভাসও ছিল। আভাস কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, জার্মানিতে চাকরি করে। ছুটিতে কলকাতায় এসে, ও যে আমার নাচ দেখেছে আমি জানতাম না। ফেসবুকে আমায় পাঠানো ওর মেসেজ পড়ে জানলাম। ফেসবুকের আলাপ আস্তে আস্তে ঘন হতে শুরু করল। ও আমার জার্মানির প্রোগ্রামের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নিতে শুরু করল আর আমার ওর প্রতি ইন্টারেস্ট জন্মাতে শুরু করল, এত স্মার্ট, এত মডার্ন একটা ছেলে। আভাস হয়তো নাচের ব্যাপারে কিছু বুঝত না কিন্তু ও সেই স্পেসটা আমায় দিত, যেটা আমি অভীকের থেকে পাচ্ছিলাম না। মাথার মধ্যে কী খেলে গেল, আমি আভাসের গলাটা শুনতে চাইলাম। স্কাইপেতে আমাদের যোগাযোগ শুরু হলো। একদিন-দুদিন পর থেকেই আমি আভাসকে দিয়ে অভীকের করা স্ক্রিপ্ট পড়াতে শুরু করলাম। প্রথমে ও পারছিল না কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল ও ডেভেলপ করছিল। ডেভেলপ করছিল আমাদের রিলেশনটাও। স্কাইপেতে একে অন্যকে আদর করা শুরু করলাম আমরা। একদিন যখন ভালো করে পড়ার পর আর একটু বেশি দাবি করল আভাস, আমার অসুবিধা হলো না। খালি গায়ে বারমুডা পরে বসে ছিল আভাস। আমি আমার
টি-শার্টটি খুললাম। শুধু টি-শার্টটাই। লজ্জা করছিল কোথাও। কিন্তু মনে হচ্ছিল, এটুকু ইনসেন্টিভ না পেলে, আভাসই বা আমার জন্য করবে কেন? আভাস আর একটু দেখতে চাইছিল কিন্তু আমি ওকে নিরস্ত করলাম আর আশাতেও রাখলাম। বললাম, যেদিন ও স্টেজে পারফর্ম করবে, সেদিন আমায় সম্পূর্ণ দেখতে পাবে।
ল্যাপটপ থেকে সরে এসে ভাবছিলাম, আমি কি দুটো ছেলেকেই ব্যবহার করছি? কিন্তু দুটো ছেলেও কি আমাকে পালটা ব্যবহার করছিল না? অভীক আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাইছিল না? আর আভাস আনন্দ পাচ্ছিল না আমায় দেখে? তাহলে শুধু আমার দোষ হবে কেন?
দোষ-গুণের বিচার পরে, যে-সম্পর্কটা আমায় ক্রমাগত পেছনে টানছে, বিরক্ত করছে, নিজের কাজে কনসেনট্রেট করতে দিচ্ছে না, সেখান থেকে আমার বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। আমি কিছু বুঝতে দিলাম না অভীককে। শুধু ও যখন বলল যে, কলেজ থেকে ছুটি ম্যানেজ করে ফেলেছে তখন একটু হেসে বললাম যে, একটা ট্রাভেল এজেন্সি টিকিটটা করছে, ওটা নিয়ে আর ওকে মাথা ঘামাতে হবে না।
আমাদের সতেরো দিনের ট্যুর, তার মধ্যে ছয়টা শহর, দলের সবাই আনন্দে ফুটছিল। অভীক একটা ইংলিশ টু জার্মান ডিকশনারি কিনেছিল। আমাদের রিহার্সাল রুমে এসে মাঝেমাঝে একটা-দুটো জার্মান শব্দ বলত। সবাই এনজয় করত সেটা। কেউ বুঝতে পারেনি, আমি কেন একটা প্লেনে বারোজনের টিকিট কেটেছিলাম আর অন্য একটা প্লেনে তিনজনের।
অভীক ব্যাপারটা শুনে বলেছিল, আমরা দুজনই তো যেতে পারি। লোপাদিকে নিতেই হবে?
আমি হেসে বলেছিলাম, সঙ্গে একজন না গেলে কথা রটবে না?
অভীক ঘাড় নেড়েছিল, সত্যি তুমি খুব ইনটেলিজেন্ট।
আমি যে কী, তা অভীক জানত না। আমি লোপাদিকে আমার প্রবলেমটা বুঝিয়ে বলে পুরো প্ল্যানটা করে নিয়েছিলাম। লোপাদি আমি যা বলতাম তা করত। কারণ ও জানত আমি না থাকলে, দুই বাচ্চার মাকে জার্মানি ঘুরিয়ে আনবে না কেউ। শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যেতেই মিউমিউ করতে থাকা বরের হাতে প্রায় কুড়িদিনের জন্য বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে বেরোতে পারবে বলে লোপাদির মনে তখন প্রবল মুক্তির আনন্দ। তাই, আমারও যে মুক্তি চাই সেটা চট করে ধরে ফেলল ও।
আমাদের টিম বেরিয়ে যাওয়ার বারো ঘণ্টা পর আমাদের ফ্লাইট, অভীক এমনটাই জানত। এয়ারপোর্ট থেকেই ফোনে ওকে বললাম যে, আমরা এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু বাড়ি ফেরার প্রশ্নই ছিল না। কারণ আমি ঠিক দুঘণ্টা পরের একটা ফ্লাইটে আমার আর লোপাদির টিকিটটা করেছিলাম। টিকিট আমার কাছে আছে জেনে নিশ্চিন্ত অভীক একবার দেখতেও চায়নি সেটা। এবার ফ্লাইট ধরার জন্য বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে যখন ও ফোন করে আমাকে পাবে না, উ™£ান্তের মতো এয়ারপোর্টে ছুটে এসে যখন কোথাও দেখবে না আমাকে, টিকিট সঙ্গে নেই বলে যখন ঢুকতেই পারবে না ভেতরে, তখন কী করবে?
রানওয়ে ধরে যখন আমাদের প্লেনটা দৌড়োচ্ছিল তখন এইসবই ভাবছিলাম আমি। তার আগেই পুরনো সিমটা ফোন থেকে বের করে নতুন একটা সিম ভরে নিয়েছি মোবাইলে। জার্মানিতেই নয়, ইন্ডিয়াতে ফেরার পরও অভীকের আর আমার খোঁজ পাওয়ার দরকার নেই। যদি নির্লজ্জের মতো আসে তাও আমাদের রিহার্সালে? তা হলে কী বলব, সেটাও জানা। কলেজের চাকরি থাকুক সেটা চাও, না, চাও না?
নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে? তাহলে আমি নিষ্ঠুর। কিন্তু ক্রুয়েল কার প্রতি? অভীক তো আমাকে চায়নি। আমার ভেতর দিয়ে অন্য কাউকে চাইছিল। সেই অন্য কেউ এসে আমার যা আছে সেই সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়ে যেত। আমি অভীকের সাহায্য চেয়েছিলাম। সান্নিধ্য চেয়েছিলাম। নিজের জীবন ডেসট্রয় করার জন্য তো অভীককে জীবনে আনিনি। প্লেনটা আকাশে সেটল করতে মনে হলো, আমি ওর সঙ্গে কী করেছি সেটা টের পাওয়ার পর, অভীক কাঁদবে, চিৎকার করবে, তারপর আবার ওর সাধারণ জীবনে মানিয়ে নেবে। সে-জীবনে বউ থাকলেই বাচ্চা থাকতে হয়। সংসার থাকলেই হাতে থলি নিয়ে বাজার করতে যেতে হয়। সেখানে বিরাট কোনো পৃথিবীর ইশারা নেই। শুধু কাদামাটি, কোনো আকাশ নেই।
আমি মাঝআকাশে ভাবতে থাকলাম নতুন এক একটা স্টেপসের কথা। একটা করে স্টেপসই একটা করে আলো, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে নতুন একটা পথ। আভাস ওদিকে নিশ্চয়ই প্রস্তুত হচ্ছে। অভীকের মতো না পারলেও ও ঠিক চালিয়ে দেবে। ওকে আমার ভালোই লাগছে। ও আমার বুক অবধি দেখেছে, হৃদয় অবধি পৌঁছতে যদি নাও পারে ক্ষতি নেই। আমি আমার হৃদয়ে কোনো মানুষকে আর জায়গা দিতে চাই না। জায়গা দিতে চাই সেই নাচটাকে যা আমাকে বোঝে, আমাকে জড়িয়ে রাখে। আমি আর কাউকে বলব না, কোথায় আমার কষ্ট। যাকেই বলব সে কষ্টটা দূর করতে গিয়ে কষ্টটা বাড়িয়ে তুলবে। আর প্রতিটা সম্পর্কই তো ছাইদানিতে রাখা কিছু ব্যক্তিগত ছাই, যেগুলোকে একটা সময়ের পর গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয়। আমি চোখ বুজলাম। টের পাচ্ছিলাম, সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে। নতুন সময় আসছে। আমার হাত থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য নতুন নতুন খাতা আসছে আমার সামনে। আমি নিজের স্বপ্নটাকে নিজে ছুঁতে পারছিলাম।

দলমা চুপ করে যাওয়ার পর সময়টা যেন থেমে রইল কিছুক্ষণ। জানালার বাইরে তখন আকাশ ড্রেস চেঞ্জ করছে। বিকেল গিয়ে সন্ধে হচ্ছে। একটা পর্ব শেষ হয়ে আর একটা পর্ব।
– আবার একটু গলা ভেজাতে হবে মনে হচ্ছে। প্রেমাঞ্জনা উঠে দাঁড়াল।
– আমাকে ফিরতে হবে। কাল ভোরে শুটিং আছে। তোর্সা বলল।
– আচ্ছা, ও যাকে বিয়ে করেছে সে নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে আমাদের মতো কিছু করেনি। হিয়া বলল।
– আই অবজেক্ট। তোর্সা বলে উঠল। – আমাদের মতো কিছু করেনি মানে? দলমা যেটা করেছে সেটা আমি সাপোর্ট করতে পারছি না। কিন্তু আমার মনে হয় না আমি এমন কিছু করেছি যেটাকে লিগ্যালি বা মরালি রং বলা যায়।
– ন্যায়-অন্যায় তো আপেক্ষিক। তাই এই বিচারগুলো থাক। আমরা প্রত্যেকেই হয়তো নিজের কাছে ঠিক ছিলাম। শুধু আমরা…
– সবাই অভীকের কাছ থেকে আলাদা হওয়ার একটা এক্সকিউজ খুঁজে নিয়েছিলাম। প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল।
– শুধু এক্সকিউজ নয়। প্রয়োজনও ছিল। দলমা বলে উঠল।
– থাকতে পারে। কিন্তু সেটা আমাদের প্রয়োজন। তার ফলে অভীকের কী হয়েছিল আমরা ভেবে দেখেছি কখনো? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– ও নিশ্চয়ই সামলে নিয়েছে। নইলে একটা রিলেশন থেকে আর একটা রিলেশনে অত দ্রুত মুভ করল কীভাবে? ও তো আমার কাছে প্রেমাঞ্জনার কথা বলেনি বা তোর্সার কাছে দলমার কথা। বলেছে কি? হিয়া বলে উঠল।
– না। বলেনি। একটা অদ্ভুত গুণ ছিল লোকটার মধ্যে। অতীত নিয়ে বসে থাকত না। যখন যে-সম্পর্কে বাঁচত, সেটায় একশভাগ দিত। দলমা বলল।
– সম্পর্কগুলো হয়তো অনেকটা ওর ক্লাসের মতো ছিল। প্রতিটা ক্লাসে গিয়ে যেমন নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, এখানেও তাই। তোর্সা বলল।
– কিন্তু আমাদের চারজনের ক্ষেত্রেই তো ও ব্যর্থ হলো। আলটিমেটলি যে-মেয়েটার সঙ্গে ওর ক্লিক করল, সে কি ওকে বুঝতে পারবে? প্রেমাঞ্জনা জিজ্ঞেস করল।
– আমার মনে হয় মেয়েটা খুব সাধারণ। তাই হয়তো বা অভীকের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন বলে ধরেছে। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্বপ্ন ছিল। দলমা বলল।
– ওভাবে সাধারণ বা অসাধারণ দেগে দেওয়া যায় না কাউকে। ওর নিশ্চয়ই কারণ ছিল অভীককে অ্যাকসেপ্ট করার। যেরকম আমাদের প্রত্যেকের কিছু কারণ ছিল অ্যাকসেপ্ট না করতে পারার। হিয়া বলল।
– এই যে আমরা পাইনি, আমাদের মনে কোথাও কি একটু ব্যথা নেই? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– মাঝে মাঝে মিস করি কোথাও। আবার এটাও বুঝি ও আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে বাঁচতে পারতাম না। সাপোকেটিং লাগত। দলমা বলল।
তোর্সা বলল, এই জায়গাটায় আমিও এগ্রি করি দলমার সঙ্গে। অভীক আসলে সবটা দিয়ে ভালোবাসত বলেই হয়তো আমার চলার রাস্তাটা ওর আলোয় 888sport app পড়ে যেত।
– আমাদের সবাইকে ভালোবাসার পর ওই মেয়েটাকেও সবটা দিয়ে ভালোবাসছে? এত ভালোবাসা আছে ওর কাছে? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– সেটা জানার জন্য, ওই মেয়েটার সঙ্গে আমাদের একবার কথা বলা দরকার। হিয়া বলল।
– অভীক ওই মেয়েটাকে আমাদের কথা বলেনি, শিওর? দলমা বলল।
– না বলাটাই তো সেও। প্রত্যেকটা সম্পর্কের মধ্যেই তো অভীকের জন্য কিছুটা লজ্জা মিশে ছিল। আমি মুখের ওপর খাতা ছুড়ে দিয়ে এলাম, হিয়া ওভারব্রিজ থেকে নামিয়ে দিলো, দলমা প্লেনের অন্য টাইম বলে পালাল, সবকটাই তো অপমানের ইতিহাস। ও বলবে কী করে? প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল।
– হয়তো তাই। কিন্তু এটাও হতে পারে যে, সেই অপমান আর অবজ্ঞার কথা শুনেই মেয়েরা ওকে ভালোবেসেছে। সিমপ্যাথিও তো জেনারেট হয়, তাই না? হিয়া বলল।
– অভীক ঠিক সিমপ্যাথি আদায় করার লোক ছিল না জানিস। প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল।
– কী ছিল তার চাইতে ঢের ইমপোর্ট্যান্ট, কেমন হয়েছে। সেটা একমাত্র ওর বউই বলতে পারবে। কী যেন নাম মেয়েটার? হিয়া বলল।
– অন্ত্যাক্ষরী। আমার কাছে ওর ফোন নাম্বার আছে। ইউনিয়নের একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করতেই পেয়ে গেলাম। তোরা চাইলে ফোন করতে পারি। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– ডেফিনিটলি কল কর। আর স্পিকারটা অন রাখ। আমরা সবাই শুনব, কী বলে। তোর্সা বলল।
– আগে এক মিনিট কথা বলে নিই, তারপর। বলেই প্রেমাঞ্জনা ফোন লাগাল কিন্তু এনগেজড পেল।
খানিকক্ষণ পরে ওই ফোন থেকেই একটা ফোন এলো। প্রেমাঞ্জনা কলটা রিসিভ করে বলল, আমি অভীক স্যারের স্টুডেন্ট বলছিলাম। স্যারের নাম্বারটা বোধহয় চেঞ্জ হয়েছে, পাচ্ছি না। তাই তোমাকেই ফোন করলাম। তুমি তো আমাদের কলেজের, তোমার সঙ্গে পরিচয় নেই। স্টিল, মেনি কনগ্র্যাচুলেশনস। তুমি তো এখন স্যারের ওয়াইফ। ও, তুমি আমার কথা জানো? হিয়ার কথাও? দলমারও? মাই গড! তুমি তো আমাদের সবাইকেই চেন দেখছি। স্যার আমাদের সবার কথা বলেছে তোমাকে? আমরা সবাই একসঙ্গেই আছি। সবার গলাই শুনবে? ওকে।
ফোনটা স্পিকারে দিলো প্রেমাঞ্জনা। সবাই, ‘হাই’, ‘হ্যালো’ করার পরই তোর্সা বলল, স্যার তোমায় পছন্দ করল, না তুমি স্যারকে?
– পছন্দ তো ফার্নিচারকে করে মানুষ। মানুষকে তো ভালোবাসতে হয়। অন্ত্যাক্ষরী বলল।
– তুমি ভালোবেসেছ অভীককে? হিয়া জিজ্ঞেস করে উঠল।
– নিশ্চয়ই।
– আর অভীক?
– জানি না। বলতে পারব না।
– জানো না তো বিয়ে করলে কীভাবে? প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল।
– কারণ আমি ভালোবেসেছি। আর আমার ভালোবাসা আমাকে সেই জোরটা দিয়েছে।
– তাই বলে অভীক তোমায় ভালোবাসে কিনা সেটা না বুঝেই…
প্রেমাঞ্জনাকে থামিয়ে দিয়ে অন্ত্যাক্ষরী বলে উঠল, ভালোবাসা কি বোঝার জিনিস?
– তাও, তোমার পক্ষে একটু বেশি রিস্ক হয়ে গেল না? তোর্সা জিজ্ঞেস করল।
– একটুও না। ওকে না পেলেই রিস্ক হতো। আর তাছাড়া ও তো আমার মধ্যে তোমাদের পেয়েছিল। তাই আমাকে ভালো না বেসে অভীকেরই বা কী উপায় ছিল?
– আমাদের পেয়েছিল? কী বলতে চাইছ তুমি? দলমা গলা তুলল।
অন্ত্যাক্ষরী কিছু না বলে হাসল একটু।
প্রেমাঞ্জনা বলল, ও যখন অভীকের বউ, তখন অভীক নিশ্চয়ই ওর কাছে আমাদের গল্প করেছে। সেই গল্পে সত্যি আর মিথ্যার রেশিওটা কী আমরা জানি না; কিন্তু তুমি যখন আমাদের বিষয়ে জানো তখন বলি, আমাদের সবার সঙ্গেই কোনো-না-কোনো সময়ে স্যারের একটা রিলেশন ছিল। আমি সেই সম্পর্কগুলোকে, আমাদের ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ বা এএম-এর ক্রাশ বলে ছোট করব না, জাস্ট বলব যে, তার কোনোটাই ম্যাচিওর করেনি। ডানা মেলে ওড়ার আগেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অন্ত্যাক্ষরী একটু চুপ থেকে বলল, যে-পাখিটা ডানা মেলে ওড়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে তারও কিন্তু দুটো ডানা থাকে। মুখ থুবড়ে পড়েছে বলেই ভালোবাসা ছিল না কে বলেছে? প্রতিটা সম্পর্কেই ছিল। অন্তত অভীকের দিক থেকে তো বটেই।
– আমাদের দিক থেকেও ছিল। প্রেমাঞ্জনা প্রায় চিৎকার করে উঠেই চুপ করে গেল।
– আমি তো একবারও বলিনি যে ছিল না। অব কোর্স ছিল।
– আচ্ছা ওর ভালোবাসাটা তোমার দিকে শিফট করল কীভাবে?
– কারণ ও আমার মধ্যে তোমাদের খুঁজে পেয়েছে কোথাও। তোমাদের কাছ থেকে এক-একটা মুহূর্তে ও যা এক্সপেক্ট করেছিল সেটা পেয়েছে হয়তো আমার ভেতরে।
– কী বলছ ঠিক বুঝতে পারছি না।
– ইন দ্যাট কেস, একটু খুলে বলতে হবে।
– বলো প্লিজ। আমরা একটু বুঝি ব্যাপারটা। হিয়া বলে উঠল।
– কাকে দিয়ে শুরু করব?
– যাকে দিয়ে খুশি। আমায় দিয়েই করো। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– এই কলেজে জয়েন করার পর, তোমার সঙ্গেই প্রথম ওর সম্পর্ক হয়, প্রেমাঞ্জনা। সেই সম্পর্ক কীভাবে ভেঙে গেল, অভীক আমায় বলেছে। আমি অন্য একটা কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছিলাম সেকেন্ড ইয়ারে। আসতে গিয়ে খুব অসুবিধের মধ্যে পড়েছিলাম আমি। আমার বাবা ভিআরএস নিয়েছেন, যতটা টাকা পাওয়ার কথা ততটা পাননি। আমাকে যখন ইউনিয়নের ছেলেরা ডেকে বলল, ট্রান্সফার হওয়ার জন্য আমায় কুড়ি হাজার টাকা দিতে হবে, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যে ভর্তি হতে পারব না, আমাকে ওই দূরের কলেজটাতেই ফিরে যেতে হবে কারণ অ্যাট অ্যা টাইম কুড়ি কেন, পাঁচ হাজার টাকা বের করার ক্ষমতাও আমার ছিল না। সেই সময় অভীকের সঙ্গে আমার প্রথম কথা। তার আগে আমি একটা সেমিনারে ওর লেকচার শুনেছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল। ও যখন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল যে, কেন এই কলেজে আসতে চাইছি তখন আমি ওকেও সেই কথাটা বলেছিলাম। ওর কথা শোনার আগে লিটারেচার পড়তাম, ওর কথা শুনতে শুনতে লিটারেচারকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু ওই কুড়ি হাজার টাকার কী হবে?
ইউনিয়নের ছেলেদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে অভীক সেটা পাঁচ হাজারে নামিয়ে এনেছিল। আর আমার জন্য যে এতোটা করেছিল তার কারণ তুমিই প্রেমাঞ্জনা। তুমি ওকে ওভাবে অপমান করেছিলে বলেই ও বুঝতে পেরেছিল আমার কন্ডিশনটা। বুঝতে পেরেছিল যে, ভালো লাগা বা ভালোবাসার সঙ্গে গরিবিয়ানার ততো কিছু বিরোধ নেই। একটা মানুষ যত অসুবিধের মধ্যেই থাকুক, যত নিম্নমধ্যবিত্ততার মধ্যে থাকুক তার প্রেমটা মরে যায় না। হয়তো সে প্রেমটা এক্সপ্রেস করতে পারে না, কিন্তু প্রেমটা থাকে। আমি আমার অসমর্থতা নিয়েও ওর ক্লাসের একজন হতে চাইছি, সেটা অভীক অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিল। কিন্তু তুমি ওর অবস্থাটা বুঝতে পারোনি। চাওনি হয়তো বুঝতে।
প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল, তাই বলে ওভাবে কমোডিফাই করবে?
– কমোডিফাই? তোমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়তো তোমার সেটা মনে হয়েছে কিন্তু ভেবে দ্যাখো একটা লরি সবসময় হাইওয়ে দিয়ে যেতে পারে, একটা সাইকেলকে এঁকেবেঁকে গলির ভেতর দিয়ে যেতেই হয়। ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড খুব স্ট্রং না হলেই একটা লোক প্রেম ফিল করতে পারে না, এমন কিন্তু নয়। এই বোধটা তোমার মধ্যে পায়নি বলেই ও আমার মধ্যে নিজের একটা ছায়া দেখতে পেয়েছিল। অন্ত্যাক্ষরী একটু থামল।
– আর আমি? আমার কথা কী বলেছে অভীক? হিয়া বলে উঠল।
প্রেমাঞ্জনা একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, দাঁড়া না আমার ব্যাপারটা।
– তোমার কথাতেই আসছিলাম। হিয়া তুমি তো ক্রিশ্চিয়ান। অভীক একটা জিনিস তোমায় বলেছিল, তোমার মনে আছে? অন্ত্যাক্ষরী বলল।
– কী কথা বলো তো? হিয়া জানতে চাইল।
– কথাটা এই যে, জেসাসকে মেরে ফেলার সময় লোকে এতো ক্রুদ্ধ হয়েছিল কেন? মানুষ মারা গেলে মানুষ এত রেগে যায় না, মানুষ ফিউরিয়াস হয়ে যায় যখন সৌন্দর্যকে ক্রুসিফাই করা হয়। জেসাসের ক্ষেত্রে বিউটি ওয়াজ ক্রুসিফায়েড। খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, সাধারণ দেখতে একটা মেয়ের প্রতি খারাপ ব্যবহার হলে লোকেরা একরকম রিয়্যাক্ট করবে আর ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে একই ঘটনা ঘটলে, লোকে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। তার মানে এটা তো সত্যি যে, সৌন্দর্যকেই সুপ্রিম বলে মেনে নেয়, আপামর জনতা। আর সেই সৌন্দর্য তো যৌবনেরই ধর্ম। সেই জায়গা থেকে তুমি ঠিকই করেছ, হিয়া। তোমার ধর্ম মেনেছ। কিন্তু আমি আবার একটু বিধর্মী জানো তো! কেন বলছি, শোনো। একদিন ওর বাড়ি গিয়ে দেখি চুল কলপ করার একটা ছোট্ট প্যাকেট। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওটা হাতে তুলে নিয়ে ওকে বললাম, স্যার প্লিজ চুলে কালার করবেন না। কথাটা শুনে অভীক একটু লজ্জা আর একটু জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, একটা ফিল্ম দেখেছিলাম যেখানে অনেকগুলো গাছের মধ্যে শুধু একটা গাছের পাতায় বরফ পড়েছে। কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল গাছটাকে। এই যে আপনার মাথার চুল একটু একটু পেকে গেছে, আপনাকে অনেক গাছের মধ্যে ওই গাছটার মতো লাগছে, যে আর সবার থেকে আলাদা।
– তুমি সত্যিই মনে করো দুটো আলাদা জেনারেশনের মানুষের মধ্যে, বয়সের অনেক ফারাক আছে এমন দুজনের মধ্যে একটা রিলেশন হতে পারে? হিয়া জিজ্ঞেস করল।
– দুটো আলাদা বয়স আসলে কী বলো তো? দুটো অসম সময় তো! আর সময় যে চলে যাচ্ছে সেটা কি সময় দিয়ে বোঝা যায়? আমরা সময়ের যাতায়াত বুঝতে পারি কী করে? যখন আকাশটা আলো থেকে অন্ধকার হয়ে যায় বা যখন আবহাওয়া পালটায়। তা হলে সময় এমন একটা জিনিস যার নিজেকে বোঝানোর জন্য একটা এজেন্ট লাগে। হাওয়া দিলে বুঝি বসন্ত এসেছে, গায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি পড়লে বুঝি বৃষ্টি এসেছে। কিন্তু হৃদয় তো নিজেকে দিয়েই নিজেকে বোঝাতে পারে। আমার তোমার জন্য যন্ত্রণা হচ্ছে বা খুব ভালো লাগছে তোমাকে, এটা বোঝানোর জন্য তো থার্ডপার্টির দরকার নেই। তা হলে আমি সময়ের কাছে হৃদয়কে হেরে যেতে দেব কেন? আমার এটাই মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তে। যখন হাঁপাচ্ছিল অভীক তখন ওকে, ঘেন্না না করে, একটু ধরে বসাতেও পারতে তুমি। একটু পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে পারতে, যতক্ষণ না ওর নিশ্বাসটা নর্মাল হয়ে যায়। হয়তো অভীক এটুকুই এক্সপেক্ট করেছিল। তুমি একটা পেরিয়ে যাওয়া সময়কে ফেলে দিয়ে আগামী সময়ের দিকে তাকিয়েছিলে। কিন্তু একটা মানুষ তো শুধু এ-সময় নয়, একটা মানুষ তো হৃদয়ও। যেদিন ওর হাত থেকে ওই কলপের প্যাকেটটা কেড়ে নিয়েছিলাম, সেদিন ও আমায় তোমার কথা বলেছিল। তোমার কাছ থেকে যেটা পাবে ভেবেছিল সেটাই কি পেয়েছিল আমার থেকে?
– আর আমার থেকে কী এক্সপেকটেশন ছিল অভীকের? তোর্সা বলল।
– সেটা বলার আগে আমার একটা ঘটনা বলি। ইউনিয়নের একটা মাস্তান না আমাকে অনেক সুবিধা পাইয়ে দেবে বলে আমার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল একবার। আমি ঠাটিয়ে একটা চড় মেরেছিলাম ছেলেটাকে। ওই চড়টা মারার জন্য, আমি রেপড হয়ে যেতে পারতাম, কলেজ থেকে হাওয়া হয়ে যেতে তো পারতামই। তবু মেরে বসেছিলাম চড়টা। যার সঙ্গে আমার কোনো লেনাদেনা নেই, তেমন কেউ আমার কাছে আসছে, এটা মানতে পারিনি।
– তুমি যাই বলো, তোমার ব্যাপারটার সঙ্গে আমার ব্যাপারটার তুলনা হয় না। তোর্সা বলে উঠল।
– জানি হয় না। হয়তো সেই সময় ওই দেড় লাখ না দুলাখ টাকা তোমার কাছে ভীষণ জরুরি ছিল। আর তার জন্য নাইট স্টেও হয়তো বিরাট কিছু অপরাধ নয়। কিন্তু আমি কেন ওই ছেলেটাকে চড় মেরেছিলাম জানো? ঘোর বিপদ হতে পারে জেনেও মেরেছিলাম কারণ মনে হয়েছিল, ওর থেকে সুবিধেটা নিলে আমি এক্সপোজড হয়ে যাব।
– মানে বুঝতে পারলাম না।
– আমিও বোঝাতে পারলাম না। তোমরা হয়তো দেখেছ ইউটিউবে একটা মেয়ে একটা ম্যাজিক দেখানোর সিন আপলোড করেছে। তো সেই মেয়েটা গাউন পরে স্টেজে আসছে আর তার ভেতর থেকে একটা রুমাল বের করছে। তার পরে হঠাৎ করে গাউনটা খুলে দিচ্ছে। এবার দেখা যাচ্ছে গাউনের নিচে একটা গেঞ্জি পরে আছে মেয়েটা আর এবার ও গেঞ্জির ভেতর থেকেও রুমাল বের করছে। তারপর গেঞ্জিটা খুলে ফেলছে। এবার শুধু ব্রা আর প্যান্টি পরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। সেই ইনারের ভেতর থেকেও রুমাল বেরোচ্ছে একটা। ও যখন ব্রা-টা খুলতে যাচ্ছে সেই জায়গাটায় ভিডিওটা স্টপ হয়ে যাচ্ছে। আসলে মেয়েটা দেখাতে চাইছে যে, ও রুমালটা কোথাও লুকিয়ে রাখেনি। হাওয়ার ভেতর থেকে উড়িয়ে আনছে। এটাই ওর ম্যাজিক। কিন্তু এই ম্যাজিকটা দেখাতে গিয়ে ও নিজেকে উলঙ্গ করে ফেলছে। অদ্ভুত না?
– এটার কথা কেন বলছ তুমি? প্রেমাঞ্জনা বলে উঠল।
– ভাবো কেন বলছি! আমরা সবাই তো এক্সপেক্ট করি আমাদের জীবনে কতগুলো ম্যাজিক ঘটবে। সাকসেসের ম্যাজিক, পেয়ে যাওয়ার ম্যাজিক। সেই ম্যাজিকটা ঘটাতে গিয়ে আমরা বোধহয় অনেক সময় নিজেদের উলঙ্গ করে ফেলি, তাই না? তখন আর আমার নিজের কোনো আইডেন্টিটি থাকে না।
অভীক হয়তো চেয়েছিল যে, তোর্সা ম্যাজিকের বদলে রিয়্যালিটিকে আঁকড়ে ধরবে। সেই বাস্তবের ভেতরে হয়তো অনেক অভাব কিন্তু একই সঙ্গে অনেকটা বিশ্বাস আর কনফিডেন্স। পরস্পরের ওপর নির্ভর করার মতো অনেকটা জমি।
– ওভাবে ভালোবাসা হতে পারে। কিন্তু ওভাবে কি সাকসেস পেয়েছে কেউ? তোর্সা বলল।
– হয়তো পায়নি। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, তুমি যেভাবে চাও সেভাবে কি সাফল্য চেয়েছে সবাই?
তোর্সার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ও কিছু বলল না।
দলমা একটু ধরা গলায় বলে উঠল, আর আমি?
– তোমার দেওয়া আঘাতটাই হয়তো ওকে বুঝিয়েছিল যে আমাদের হাতটা উঁচু করে রাখার জন্য নয়, আমরা হাত উঁচু করে
চাঁদ-সূর্য অ্যারোপ্লেন কিচ্ছু ধরতে পারি না। আমাদের হাতের পজিশনটা কাঁধ থেকে নিচের দিকে। তবু আমি বলব, তুমি ওকে চিট করোনি, তুমি ওকে সরিয়ে দিয়ে তোমার নিজের জীবনটা আর একটু রিল্যাক্সডভাবে বাঁচতে চাইছিলে। ওদিকে ওর অনুভবের জায়গাটা এত গভীর যে, ও ওই জন্মানোর আগেই মরে যাওয়া বাচ্চাটার কান্না শুনতে পেত। অভীক বুঝতে পারেনি যে, আজকের পৃথিবীতে বেশিরভাগ লোকের কানে ইয়ার ফোন গোঁজা থাকে, যাতে বাইরের কান্না ভেতরে শোনা যায় না। আমার একটু ছবি আঁকার নেশা আছে, আমাদের সম্পর্কটা যখন দানা বাঁধছে তখন আমি একটা ছবি এঁকেছিলাম। আমার আর অভীকের; আমরা দুজন হাত ধরে হাঁটছি আর সেই ছবিটায় আমি প্রেগন্যান্ট। অভীক অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল, ছবিটা দেখে। কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আমি বলেছিলাম যে, আমি সেই মুহূর্তটাকে ধরতে চাই যখন আমার ভেতরও আপনি, বাইরেও আপনি। ওর চোখে জল দেখেছিলাম তৎক্ষণাৎ। ইনফ্যাক্ট সেদিনই ও দলমার কথা বলে আমায়। দলমা যেটা করেছে সেটাও হয়তো একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঠিকই। আবার এটাও ঠিক, যখন একটা গোলাপকে কেউ হাতে করে এগিয়ে দেয় কারো দিকে তখন সে আর ফুল থাকে না, স্বপ্ন হয়ে যায়, মন হয়ে যায়। অভীক ভেবেছিল, ব্ল্যাকবোর্ডে একটা 888sport app download apk অর্ধেক লিখে মুছে দেওয়া হয়েছে। যদি সেটা আবার লেখা যায়। তোমার প্ল্যান-প্রোগ্রামের সঙ্গে যে সেটা খাপ খায় না, তুমি যে সেটার জন্য প্রস্তুত নও, ও বুঝতে পারেনি।
– তুমি তো আমাদের প্রত্যেকের অভাব পূর্ণ করে দিয়েছ দেখছি। এত ভালোবেসেছ অভীককে? প্রেমাঞ্জনা বলল।
– সে তো বেসেছিই। আর এটা জেনেও বাসছি যে, অভীক তোমাদের চারজনকেই খুব ভালোবেসেছিল। এখনো বাসে। আর যেভাবে পেতে চেয়েছিল সেভাবে পায়নি বলে, আমার মধ্যেই তোমাদের আবিষ্কারের চেষ্টা করে। যখন আমার ভেতরে তোমাদের কাউকে খুঁজে পায় তখন ও যেন আরো বেশি করে আমার কাছে আসে। আর আমি তাতে রাগ করতে পারি না কেন বলো তো? সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসছে একটা পাখি সে তো সাঁতরাগাছি না এসে মুম্বাই কিংবা রাজস্থানও চলে যেতে পারত। এবার সাঁতরাগাছিতে সে হয়তো তার ছেড়ে আসা দেশের কিছু চিহ্ন পায়। তাতে সাঁতরাগাছির অসুবিধে কোথায়? আমি সত্যি বলছি, আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে যদি ওর আগের 888sport sign up bonus কাজ করে, তাতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।
– তুমি কি সত্যিই এতোটা ভালো? এতটা ফিলজফিকালি ভাবতে পারো এই বয়সে? জেলাস লাগে না? পজেসিভ হও না কখনো? হিয়া বলল।
– আমার থেকে যদি তোমরা ওকে ছিনিয়ে নিতে চাইতে তাহলে পজেসিভ হওয়ার একটা মানে থাকত; কিন্তু ওকে তো তোমরা রিজেক্ট করেছ, আর যা রিজেক্টেড তাকে তো কুড়িয়ে নিতে হয়। তোমাদের প্রত্যেকেরই ওকে একটা সময় দরকার হয়েছিল, কাছে এসেছিলে, ভালোবেসেছিলে। তারপর একজন ফেলে দিলে ও আর একজনের হাত ধরেছে গিয়ে। কিছুদিন পর সেও ওকে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। এবার রাস্তা থেকেই এমন একজন ওকে কুড়িয়ে নিয়েছে যে আর ওকে ফেলে দেবে না। তাহলে কী দাঁড়াল? ও তো আমারই রয়ে গেল, তাই না? অন্ত্যাক্ষরীর গলা কেমন একটু উত্তেজিত শোনাল।
প্রেমাঞ্জনা বলল, তোমরা কোথায় এখন?
– আমরা হানিমুনে এসেছি। অন্ত্যাক্ষরী এই এতক্ষণে একটু হাসল।
– হানিমুনে কোথায়? গোয়া? কেরালা?
– না, না, অত টাকা কোথায়? যেহেতু আমি এই কলেজেই ভর্তি হয়েছি, ও প্রিন্সিপ্যালের কাছে গিয়েছিল। চাকরি ছেড়ে দিলেও আমি ওকেই বিয়ে করতাম। টিউশন করত, তাতেই চালাতাম যেভাবে পারি। কিন্তু যে-কারণেই হোক, ওকে চাকরি ছাড়তে হয়নি। আর আমরা ওর দাদার ফ্ল্যাট ছেড়ে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। হানিমুনে এসেছি তাজপুরে। ওর পরিচিত একজন স্যার একটা লজ দেখে দিয়েছেন, সেখানেই উঠেছি। এখানে ভালো মাছ পাওয়া যায়। অভীক আনতে গেছে। এক্ষুনি চলে আসবে।
– হানিমুনে এসে রান্না? হিয়া বলে উঠল।
– সবাইকেই কি ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে হবে? আর ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে কী স্পেশাল হয় বলো তো? সেই একটা হাওয়া দেবে, মোমবাতিটা নিভে যাবে; তার চেয়ে নিজেদের রান্নাটা নিজেরা করে নিয়ে যদি মুখোমুখি বসে খাওয়া যায়, মন্দ কী?
– কবে ফিরছ কলকাতায়?
– তিন-চার দিন পরে। আমি তোমাদের প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে পারলাম কিনা জানি না, বাট আই হোপ, তোমরা কেউ, আমার কথায় কিছু মনে করোনি।
– মনে করলেও ভালো মনে করেছি। আর একটা কথা আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি যে, ইউ টু ওয়্যার মেড ফর ইচ আদার। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– জানি না মেড ফর ইচ আদার কিনা, শুধু এটুকু জানি যে যাই হয়ে যাক, অভীককে ছেড়ে কোথাও যাব না। টিল ডেথ ডু আস পার্ট।
– আমি এই কথা কোনোদিন কারো জন্য বলতে পারতাম না। তুমি যে পারছ তার জন্য তোমায় স্যালুট জানাই। তোর্সা বলল।
– আমিও। হিয়া বলে উঠল।
অন্ত্যাক্ষরী হেসে উঠল জোরে। হাসি থামিয়ে বলল, আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে তোমাদের কাছে। কলকাতায় ফিরে একটু গুছিয়ে নিয়ে যদি একদিন তোমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করি, তোমরা আসবে আমাদের বাড়িতে?
– হোয়াট? দলমা বলে উঠল।
– তোমাকেও আসতে হবে দলমা। অ্যান্ড আই প্রমিজ, তুমি এমব্যারাসড ফিল করবে না। আমরা সবাই মিলে একটু খাওয়া-দাওয়া করব, আড্ডা দেব। একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেলেই সেই সম্পর্কটা সব সময় মরে যায় বলো?
– মরে না তো। আমাদের মনগুলো মিউজিয়ামের মতো। সেখানে সব থাকে। প্রেমাঞ্জনা বলল।
– তাহলে দুদিক থেকে মিউজিয়ামের দরজা খুলে দেখি না আমরা?
– মিউজিয়াম-টিউজিয়াম দেখতে যেতে পারব না। তবে তোমার নতুন সংসার দেখতে যেতেই পারি একদিন। হিয়া বলল।
– আমার একটা শর্ত আছে। ইনফ্যাক্ট দুটো। প্রথমটা হলো যে, আমি যা করেছি তার জন্য তোমরা দুজন মিলে আমায় মারবে না। এটা প্রমিজ করতে হবে। আর সেকেন্ডটা হলো, আমরাই বাজার করে নিয়ে যাব। দলমা বলল।
হিয়া বলল, আমারও একটা শর্ত আছে। আই থিঙ্ক সেটা আমাদের সবারই। আমরা যে যাব সেটা স্যারের কাছে লুকোনো থাক। তোমাকে জানিয়ে আমরা সবাই মিলে একদিন গিয়ে হাজির হব। যাকে বলে সারপ্রাইজ ভিজিট। আর আমাদের মেসেজ পেলেই তুমি একটা কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমরা চাই অভীক মিত্রই দরজাটা খুলুক। দরজা খোলার পরপরই আমরা স্যারের মুখটা দেখতে চাই। বুঝতে চাই, তোমাকে পাওয়ার পর অভীকের মুখে কতটা আলো আর আমাদের দেখে ঠিক কতটা অন্ধকার হয় সেই মুখ।
অন্ত্যাক্ষরী আবারো হাসল ফোনের ওপাশ থেকে। বলল, ভুল করছ, তোমাদের আলোটাই তো আমি। আমার কি নিজের কোনো আলো আছে নাকি?