কইন্যা-আখ্যান

পুকরীর কূল লাঙ্গলের মাটি

আমার বাপ ভাই হোক লোহার কাঠি-

ব্দগুলোর ছন্দোবদ্ধবৃন্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত হলো প্রাচ্যনাটের আলোচিত প্রযোজনা কইন্যার।

মানুষের দৈহিক উৎকর্ষতার নির্ধারিত একটি উচ্চতা আছে। কিন্তু মানসিক উৎকর্ষতা উচ্চতায় আকাশস্পর্শী হতে পারে। তেমন উচ্চতায় দাঁড়ালে ঘুচে যায় ছোটর হীনম্মন্যতা; বড়র দম্ভ; কালোর দুঃখ-গ্লানি; সাদার জাত্যাভিমান; সম্পদের অসম বণ্টনে সৃষ্ট মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। তুচ্ছ হয়ে যায় শরিয়ত-মারফত, ধর্মে-ধর্মে বহিরাঙ্গিক বিভেদ; লুপ্ত হয়ে যায় সবকিছুর মধ্যকার অনৈক্যের সুর – জেগে ওঠে সর্ব ধর্ম-সমন্বয়বাদের এক শাশ্বত সাংগীতিক দ্যোতনা – যা এই গাংগেয় ব-দ্বীপের মাটি-জলে বেড়ে ওঠা মানুষেরা তাদের অন্তরে লালন করে আসছে আবহমানকাল ধরে। সেই সাংগীতিক দ্যোতনাকে তাদের নবম নাট্য-আখ্যান কইন্যায় বাঁধতে সচেষ্ট হয়েছে প্রাচ্যনাট।

কী বলা যায় একটা নাট্যদলের আট বছরের বয়সসীমাকে? শৈশব? কৈশোর? … তার চাইতে বড় কথা, বয়স-নির্ধারণের নির্ণায়ক আসলে কী? কতগুলো সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের বাঁধাধরা হিসাব, না-কি কৃতকর্মের প্রতিফলন? প্রাচ্যনাটের সুতোয় মাপা চতুর্থ প্রযোজনা সার্কাস সার্কাস-এর বহুমাত্রিক সাফল্য তাদের এনে দেয় নাট্যাঙ্গনের পথপ্রদর্শনকারী দলগুলোর সঙ্গে একসারিতে দাঁড়ানোর মর্যাদা আর ষষ্ঠ প্রযোজনা এ ম্যান ফর অল সিজনস্-এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় – কেবলমাত্র কতগুলো সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের হিসাব-নিকেশে নির্ধারিত জ্যেষ্ঠত্বের অর্থ কোনোক্রমেই ঋদ্ধতা নয়। তখন থেকেই প্রাচ্যনাটের কাছে প্রত্যাশা বাড়তে থাকে নাট্যামোদীদের। অপেক্ষায় থাকেন তারা আরো ভিন্নধর্মী নাট্যপ্রচেষ্টা অবলোকন করবার। খুব বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি অপেক্ষার প্রহর। জাগতিক পৃথিবীর ত্রিতল সংহতি অতিক্রম করে এক অতলান্তিক বোধের জগৎ নিয়ে নাট্যকার মুরাদ খান ছবি আঁকেন কইন্যার।

যুগ যুগ ধরে কিছু প্রেমিক মানুষ করে গেছে প্রেম নিজেকে উজাড় করে। তাদের এই প্রেম, এই মায়া, এই ইশ্ক্ প্রকৃতির সাথে, প্রাণীকুলের সাথে, সর্বোপরি ঈশ্বরের সাথে। ঈশ্বরকে খুঁজেছে এরা সাবলীল স্বাভাবিকতায়; খুঁজেছে তার অতি সাধারণ দৈনন্দিন জীবনচারিতায়। খোদায়ী প্রেমের এই প্রেমিকরা তাদের প্রেম বা ইবাদত করেননি প্রথাগত কোনো আনুষ্ঠানিকতায়। গভীর এই প্রেম করেছে তারা নিজের মতো করে, খুঁজেছে ঈশ্বর নিজেরই মাঝে। তাদের কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা তথা আটপৌরে জীবনাচরণেও তারা করতে চেয়েছে ঈশ্বরের ইবাদত। ঈশ্বরের নৈকট্যলাভের প্রত্যাশী এই মানুষগুলো খুব সহজেই গ্রহণ বা বর্জন করেছে অনেক জটিল মানবিক সম্পর্ক; সমাজের অনেক জটিলতা; অনেক অসাবলীলতা। প্রেম, যৌনতা, নির্লিপ্ততা, মানবিকতায় তাদের সহজ গ্রহণ-বর্জন, দ্রব্যগুণে একাগ্রতা তাদের জীবনাচার ও জীবন-দর্শনকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। দৈনন্দিন জীবনাচার হয়ে ওঠে 888sport live chat।

কইন্যা কালারুকা নামের এক জনপদের সবুজ

অস্তিত্বে, ধূসর ধূলিতে পা রাঙিয়ে পরি888sport slot gameের কাহিনী। এই জনপদের মানুষ মনে করে কইন্যাপীর তাদের দেখে রাখেন। কাহিনীর শুরু কইন্যাপীরের দেহ থেকে সূক্ষ্মদেহে রূপান্তরের উৎসব উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে। কইন্যাপীর গত হয়েছেন তা-ও যুগ যুগ আগে। তবু এমত বিশ্বাস বর্তমান, তার সঙ্গী বহুরূপীকে তিনি রেখে যান খালি বাড়ির এক পুকুরে – মাছরূপে।

বেজে ওঠে জলজ শঙ্খ, ড্রিম ড্রিম বেজে ওঠে আফ্রিকার আদিবাসী ড্রাম; সঙ্গী হয় মন্দিরা, বাঁশি, তাদের সঙ্গে তাল মেলায় ফকিরি চিমটা আর

দণ্ডের অদ্ভুত ধ্বনি – প্রতিধ্বনিত হয় মঞ্চগৃহের

দশ কোণে।

খালি বাড়িতে এখন থাকেন নাইওর আর দিলবর – দুই ভাই। জনপদের সবাই জানেন বিপত্নীক নাইওরের উপর কইন্যাপীরের ভর আছে। ইশ্কে মাতোয়ারা নাইওর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন জলের বহুরূপীর সাথে। যেন বহুরূপীর কাছে নিজেকে জানার দীক্ষা নেন। এই খালি বাড়িতে আশ্রিত মেছাব, নাইওরের ছোটভাই দিলবরের সাথে বিয়ের আয়োজন করে নিজ গ্রামের এক কইন্যার, যাকে সে নিজেই একসময় বিয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, যার প্রতি এখনো রয়েছে তার আসক্তি। যৌনতার ভিন্ন-ভাবনায় বিশ্বাসী দিলবরকে বিবাহে সে রাজি করায় হরিরামপুরের এক মৌলভি সাহেবজাদার বানানো ওষুধের কথা বলে – কইন্যার আগমন ঘটে কালারুকায়। দুই গ্রামের বিচ্ছিন্নতার প্রতীক এক খাল – চেঙ্গের খাল। চেঙ্গের খালের পশ্চিমপারের মৌলভি সাহেবজাদার ধর্মচিন্তা পূর্বপারের কালারুকার নাইওর আলীর ধর্মচিন্তা থেকে আলাদা। তিনি চান এ-পাড়ে কালারুকায় তার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে।

অপূর্ণ কইন্যাও একসময় আত্মিক ও আঙ্গিক নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে ইশ্কে মজে বহুরূপীর সঙ্গে। বহুরূপী রূপ বদলায়; কইন্যা ধরতে পারে না কে

সে? এরই মধ্যে সে টের পায় নিজের দেহে অন্যদেহের উপস্থিতি।

দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় যখন সাহেবজাদা তার কার্য হাসিল করতে মেছাবকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। মেছাবও তথাকথিত এই খালি বাড়িতে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সাহেবজাদাকে সহযোগিতা করে। সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মোক্ষলাভে প্রত্যাশী নাইওর আকাক্সক্ষী নিজেকে বিলীন করে দিয়ে আত্মায় আত্মায় মিলন ঘটাতে, অহিংস নাইওর যেন খুঁজে নেন তার করণীয়, ঘোষণা দেন স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার কথা। কইন্যাও যেন তার প্রতি এক অজানা আকর্ষণ বোধ করে।

সাহেবজাদা খোঁজে কর্তৃত্ব, মেছাব খোঁজে প্রভাব আর অস্তিত্ব, কইন্যা খোঁজে বহুরূপী, আর নাইওর প্রশান্ত মনে মিলিত হতে চায় পরম আত্মার সাথে। যবনিকায় নিরুপায় কইন্যা শুধু তার গর্ভের শিশুর প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসায় প্রত্যাশা করে অন্যরকম তাৎপর্যময় এক ভবিষ্যতের।

নাটকটির বিষয়বস্তুর ভিন্নতা; মানুষের অন্তর্লোকের গহিনে ডুব দিতে চাওয়ার আকুলতা নিঃসন্দেহে সাধুবাদের দাবি রাখে। ভিন্নধর্মী প্রচেষ্টা চিরকালই 888sport live chatরূপকে রূপাতীত অনুভবে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তবে চমৎকার একটি নাটক মঞ্চকাঠামোতে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা ভীষণ এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ, মঞ্চ কোনো একক 888sport live chat নয়, 888sport live chatের যূথবদ্ধ উপস্থাপন। তাই প্রোসেনিয়ামে সত্যিকার অর্থে থিয়েট্রিক্যাল টাইম আর স্পেস সৃষ্টি করতে হলে প্রয়োজন অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন 888sport live chatপ্রচেষ্টাকে এক সুতোয় গাঁথা। কঠিন এই দায়িত্বটি নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম সাবলীলভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। উপস্থাপন-পদ্ধতি, দেহভাষা, আলোক, সংগীত, পোশাক, মঞ্চসজ্জার ভিন্ন ভিন্ন ধারাস্রোতকে অত্যন্ত কুশলতার সাথে টেনে এনে মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি বিষয়বস্তুর ফল্গুপ্রবাহে। উপলব্ধির এক জগতে পূর্ণ বিশ্বাস রেখে যৌক্তিকতার বাইরে এক পরি888sport slot gameে সঙ্গী করেছেন কইন্যার গ্রন্থিক, 888sport live chatী, কলা-কুশলীসহ দর্শকদের।

মঞ্চ ও আলোক-পরিকল্পনায় সাইফুল ইসলামের অভিজ্ঞতা ও মনন পথ চলেছে পাশাপাশি, হাতে হাত ধরে। পলিথিনের মধ্যে এক ধরনের জলজ ঢেউ পেইন্ট করে পৃথিবীর তিনভাগ জুড়ে থাকা জলজ অংশের বিভ্রম সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তিনি; চেষ্টা করেছেন তারই কিয়দংশের গভীরতা ও দূরত্বের ধারণা দিতে; তৈরি হয়েছে পুকুরের সাজেশন, ফর্ম ভেঙে পুকুরের ঘাটের সাজেশনে তৈরি করেছেন দুটি জলচৌকি আর ঘাট-সিঁড়ি। ভার্টিক্যালি লেয়ার বাই লেয়ার সাজিয়ে রেখেছেন ঢেউ-অঙ্কিত পলিথিন। এই লেয়ারের ভেতর দিয়েই নাটকের পাত্র-পাত্রীদের এন্ট্রি-এক্সিট। বিষয়টি অনেকটা এ-রকম – পাত্র-পাত্রীরা জলের ভেতর দিয়ে ভূমিতে প্রবেশ করে আবার হারিয়ে যাবে জলজ কোনো জগতের মধ্যে। জন্ম থেকে মৃত্যু-প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী ধূসর অনতিবোধ্য জীবনাচারের উপস্থাপনে দারুণভাবে সফল হয়েছেন তিনি। চরিত্র ও দৃশ্যের মনস্তত্ত্ব অনুসরণ করে বিভিন্ন বর্ণ ও প্রখরতার আলোকের প্রয়োগ সূক্ষ্ম নান্দনিকবোধের পরিচয়বাহী।

সংগীত-পরিকল্পক রাহুল আনন্দ সংগীতকে নাটকের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে ভাবেননি। না ভেবে চেষ্টা করেছেন তিনি সমগ্র নাটকটিকেই একটি সংগীতে পরিণত করার। এক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করেছেন অখণ্ডতার সামগ্রিক নীতি। যে-মানুষদের নিয়ে এই লীলাক্ষেত্র – দেহযন্ত্র আর সুরযন্ত্র অভিন্ন তাদের কাছে, গান আর প্রাণ মিলেমিশে একাকার। এ-ছবি আঁকতে কাছে টেনে নিয়েছেন তিনি আফ্রিকার আদিবাসী ড্রাম, মন্দিরা, আদি ভেরিযন্ত্র জলজ শঙ্খ, তিনটি বাঁশি, ফকিরি চিমটা, ‘গিলা বাদা, ফকিরি দণ্ড, দু-আঙুল মুখে পুরে শরীরযন্ত্রের কানফাটা শিস, আর তার সাথে গান-প্রাণের অনুভূতি।

আন্তরিক এই প্রচেষ্টার সাথে একাত্ম হয়েছেন দর্শকরা।

পোশাক-নির্বাচনে তৌফিকুল ইসলাম ইমন ধরতে চেয়েছেন কিছু রঙের ছায়া ছায়া, ধোঁয়া ধোঁয়া খেলা। সমগ্র নাটকটির উৎসমূলে কুণ্ডলায়িত ধোঁয়া আর সমাহিত জলের প্রকৃতিকে স্পর্শ করতে তিনি নাট্যে ব্যবহৃত সব পোশাক ডাই করেছেন ভ্যাট কালার দিয়ে। বিভিন্ন রঙের চাদর আর পাগড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে চরিত্রের বিভিন্নতা, বৈচিত্র্যতা, অন্তরস্থিত সুখ-দুঃখ-দ্বিধা-দ্বন্দের প্রকাশ ঘটাবার চেষ্টা অবশ্যই উল্লেখযোগ্যতার দাবি রাখে।

কইন্যা প্রযোজনায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মঞ্চ-পদচারণা ছিল দ্বিধাহীন। নাইওর আলী-চরিত্রে আজাদ আবুল কালামের প্রচেষ্টা প্রায় ত্রুটিবিহীন। বিশেষত বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে তার ভাবান্তর প্রশংসনীয়। দিলবর আলী-চরিত্রটি রূপায়ণে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন শতাব্দী ওয়াদুদ। মস্তুরা-চরিত্রায়ণে শাহনাজ জেরিন সাত্তার সাবলীল। তৌফিকুল ইসলাম ইমন তার উপস্থিতির একটি মুহূর্তও বুঝতে দেননি তিনি আসলে মেছাব নন। কইন্যার সরল অভিব্যক্তির সাথে শাহানা রহমান সুমি একাত্ন হয়েছেন, একাত্ম করেছেন দর্শকদের। বহুরূপী আর ইশাদ চরিত্রে রাহুল আনন্দের উৎকর্ষতা নাড়া দিয়েছে অন্তরের গভীরে। সর্বোপরি প্রায় সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীর চর্চিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সাহায্য করেছে নাটকটিকে সফল করে তুলতে।

তথাপিও অনন্য সাধারণ একটি নাট্যপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ছোটখাট বিচ্যুতি জন্ম দেয় বড় আক্ষেপের। অত্যন্ত সুন্দর, প্রায় ত্রুটিবিহীন এই নাট্যসম্ভাবনায় সুপরিকল্পিত আঙ্গিক অভিনয়ের পাশাপাশি তাল মিলিয়ে চলতে মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হয়েছে বাচিক অভিনয়। প্রক্ষেপিত স্বর মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলেছে শেষ দর্শক-সারি পর্যন্ত পৌঁছুবার সক্ষমতা। বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের ভিন্নতার পাশাপাশি যেহেতু নাটকটিতে ব্যবহার করা হয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রান্তিক পর্যায়ের ভাষারূপ, সেহেতু 888sport app অঞ্চলের দর্শকদের বোধগম্যতার সুবিধার্থে উচ্চারণের স্পষ্টতা ও স্বর-প্রক্ষেপণের বলিষ্ঠতার বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে। বিষয়টি কোনোক্রমেই সমালোচনামূলক বা ত্রুটিনির্দেশক নয় – একজন দর্শকের সামগ্রিক উপলব্ধি এবং একটি অত্যন্ত সুন্দর সৃষ্টির 888sport live chatরূপ নিখুঁত ও সর্বাঙ্গসুন্দর দেখতে চাওয়ার আকুতি।

পরিশেষে এটিই কাম্য, ঋদ্ধতার হিমালয়-শীর্ষে আরোহণ করুক প্রাচ্যনাট; পার করুক কইন্যার শততম অভিনয়-রজনী। আমরা প্রত্যাশায় রইলাম – তাদের হাত ধরে আরো ভিন্নধর্মী, আরো ব্যতিক্রমধর্মী নতুন নতুন প্রযোজনা অবলোকনের। য়ভেঙে পুকুরের ঘাটের সাজেশনে তৈরি করেছেন দুটি জলচৌকি আর ঘাট-সিঁড়ি। ভার্টিক্যালি লেয়ার বাই লেয়ার সাজিয়ে রেখেছেন ঢেউ-অঙ্কিত পলিথিন। এই লেয়ারের ভেতর দিয়েই নাটকের পাত্র-পাত্রীদের এন্ট্রি-এক্সিট। বিষয়টি অনেকটা এ-রকম – পাত্র-পাত্রীরা জলের ভেতর দিয়ে ভূমিতে প্রবেশ করে আবার হারিয়ে যাবে জলজ কোনো জগতের মধ্যে। জন্ম থেকে মৃত্যু-প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী ধূসর অনতিবোধ্য জীবনাচারের উপস্থাপনে দারুণভাবে সফল হয়েছেন তিনি। চরিত্র ও দৃশ্যের মনস্তত্ত্ব অনুসরণ করে বিভিন্ন বর্ণ ও প্রখরতার আলোকের প্রয়োগ সূক্ষ্ম নান্দনিকবোধের পরিচয়বাহী।

সংগীত-পরিকল্পক রাহুল আনন্দ সংগীতকে নাটকের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে ভাবেননি। না ভেবে চেষ্টা করেছেন তিনি সমগ্র নাটকটিকেই একটি সংগীতে পরিণত করার। এক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করেছেন অখণ্ডতার সামগ্রিক নীতি। যে-মানুষদের নিয়ে এই লীলাক্ষেত্র – দেহযন্ত্র আর সুরযন্ত্র অভিন্ন তাদের কাছে, গান আর প্রাণ মিলেমিশে একাকার। এ-ছবি আঁকতে কাছে টেনে নিয়েছেন তিনি আফ্রিকার আদিবাসী ড্রাম, মন্দিরা, আদি ভেরিযন্ত্র জলজ শঙ্খ, তিনটি বাঁশি, ফকিরি চিমটা, ‘গিলা বাদা, ফকিরি দণ্ড, দু-আঙুল মুখে পুরে শরীরযন্ত্রের কানফাটা শিস, আর তার সাথে গান-প্রাণের অনুভূতি।

আন্তরিক এই প্রচেষ্টার সাথে একাত্ম হয়েছেন দর্শকরা।

পোশাক-নির্বাচনে তৌফিকুল ইসলাম ইমন ধরতে চেয়েছেন কিছু রঙের ছায়া ছায়া, ধোঁয়া ধোঁয়া খেলা। সমগ্র নাটকটির উৎসমূলে কুণ্ডলায়িত ধোঁয়া আর সমাহিত জলের প্রকৃতিকে স্পর্শ করতে তিনি নাট্যে ব্যবহৃত সব পোশাক ডাই করেছেন ভ্যাট কালার দিয়ে। বিভিন্ন রঙের চাদর আর পাগড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে চরিত্রের বিভিন্নতা, বৈচিত্র্যতা, অন্তরস্থিত সুখ-দুঃখ-দ্বিধা-দ্বন্দের প্রকাশ ঘটাবার চেষ্টা অবশ্যই উল্লেখযোগ্যতার দাবি রাখে।

কইন্যা প্রযোজনায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মঞ্চ-পদচারণা ছিল দ্বিধাহীন। নাইওর আলী-চরিত্রে আজাদ আবুল কালামের প্রচেষ্টা প্রায় ত্রুটিবিহীন। বিশেষত বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে তার ভাবান্তর প্রশংসনীয়। দিলবর আলী-চরিত্রটি রূপায়ণে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন শতাব্দী ওয়াদুদ। মস্তুরা-চরিত্রায়ণে শাহনাজ জেরিন সাত্তার সাবলীল। তৌফিকুল ইসলাম ইমন তার উপস্থিতির একটি মুহূর্তও বুঝতে দেননি তিনি আসলে মেছাব নন। কইন্যার সরল অভিব্যক্তির সাথে শাহানা রহমান সুমি একাত্ন হয়েছেন, একাত্ম করেছেন দর্শকদের। বহুরূপী আর ইশাদ চরিত্রে রাহুল আনন্দের উৎকর্ষতা নাড়া দিয়েছে অন্তরের গভীরে। সর্বোপরি প্রায় সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীর চর্চিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সাহায্য করেছে নাটকটিকে সফল করে তুলতে।

তথাপিও অনন্য সাধারণ একটি নাট্যপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ছোটখাট বিচ্যুতি জন্ম দেয় বড় আক্ষেপের। অত্যন্ত সুন্দর, প্রায় ত্রুটিবিহীন এই নাট্যসম্ভাবনায় সুপরিকল্পিত আঙ্গিক অভিনয়ের পাশাপাশি তাল মিলিয়ে চলতে মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হয়েছে বাচিক অভিনয়। প্রক্ষেপিত স্বর মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলেছে শেষ দর্শক-সারি পর্যন্ত পৌঁছুবার সক্ষমতা। বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের ভিন্নতার পাশাপাশি যেহেতু নাটকটিতে ব্যবহার করা হয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রান্তিক পর্যায়ের ভাষারূপ, সেহেতু 888sport app অঞ্চলের দর্শকদের বোধগম্যতার সুবিধার্থে উচ্চারণের স্পষ্টতা ও স্বর-প্রক্ষেপণের বলিষ্ঠতার বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে। বিষয়টি কোনোক্রমেই সমালোচনামূলক বা ত্রুটিনির্দেশক নয় – একজন দর্শকের সামগ্রিক উপলব্ধি এবং একটি অত্যন্ত সুন্দর সৃষ্টির 888sport live chatরূপ নিখুঁত ও সর্বাঙ্গসুন্দর দেখতে চাওয়ার আকুতি।

পরিশেষে এটিই কাম্য, ঋদ্ধতার হিমালয়-শীর্ষে আরোহণ করুক প্রাচ্যনাট; পার করুক কইন্যার শততম অভিনয়-রজনী। আমরা প্রত্যাশায় রইলাম – তাদের হাত ধরে আরো ভিন্নধর্মী, আরো ব্যতিক্রমধর্মী নতুন নতুন প্রযোজনা অবলোকনের।