জীবন জয়ী হবে : সরদার ফজলুল করিমের সাথে কথোপকথন
শান্তনু মজুমদার
সময় প্রকাশন
888sport app, ২০০৪
দাম : ৭৫ টাকা
‘It is better- much better- to have wisdom and knowledge than gold and silver.Õ
(The Old Testament; Proverb : 16:16)
সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে কথা বলার বিপদ অনেক; এমনকি তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখারও। বিশেষ করে আমার মতন যারা ‘জ্ঞান বিহনে অন্ধ’ এবং সেই সঙ্গে ‘বৃথা বৃদ্ধ’, তাদের তো পদে-পদে বিপদ। কেননা, তিনি বলবেন এইটা পড়ছ, ওইটা পড়ছ… তারপর ‘না’ আর ‘না’ শুনে-শুনে হয়ত রেগে বলেই বসবেন, তোমরা এ-যুগের পোলা-মাইয়ারা করোডা কী? তখন মাথা নিচু করে চুপ থাকা ছাড়া আর অন্য কোনো পথ থাকে না (পালাবারও উপায় নেই)। কেননা, তাঁকে তো সাহস করে বলতে পারি না, ‘স্যার আমি ঘোড়ার ডিম’ …
দুই
শান্তনু মজুমদারের সাহস অনেক। তাই সরদার ফজলুল করিমের মুখোমুখি হতে পেরেছেন। সম্ভবত শান্তনু ভাবেন না যে, ‘Life is useless, all useless… Generations come and genertions go, but the world stays just the same.’ আমার পক্ষে আপাতত এইসব বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। শান্তনুর উপায় হয়তো আছে, তাই সরদার ফজলুল করিমের মুখ থেকে অনেক তথ্য বের করেছেন, তাঁর সঙ্গে ‘এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে’র উৎসাহ আর একাগ্রতা রক্ষা করতে পেরেছেন। সরদার ফজলুল করিমের দিক থেকেও উৎসাহের কমতি ছিল বলে মনে হয় না। সে-কারণেই তাঁর সম্পর্কে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে শান্তনু বলেন, ‘সরদার ফজলুল করিম নামের মানবযন্ত্রটির গুণে-মানে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আশি বছরের পুরনোযন্ত্র, কিন্তু কি যে ভালো!’ হ্যাঁ, ভালো তো বটেই। গিবন কী আর এমনি-এমনি সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘He is a serious man’… ছোটা হ্যায় পতা ক্যা হ্যায়, ইয়ে সরদার পতা হ্যায়।’ এবার বৈঠকগুলোর দিকে একটু তাকাই… মনি-মুক্তো ছড়ানো কথার কিছু কিছু শুনি; অনেক কিছুই মিলবে…
তিন
প্রথম বৈঠকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে বলেছেন। স্কুল-জীবনের 888sport sign up bonusচারণ করেছেন, সেই সময়ে তাঁর পাঠ-পরিক্রমা-বিষয়ে একটি ধারণা দিতে চেয়েছেন। এ-ও স্বীকার করেছেন তখনো রাজনীতি তাঁকে টানেনি। শান্তনু যখন প্রশ্ন করেন, ‘আমরা যে-সময়ের কথা আলাপ করছি ততদিনে মুসলিম লীগ অনেক পরিণত’, তখন উত্তরে সরদার ফজলুল করিম বলছেন : ‘অনেকটুকু কি matured হইছে ঘোড়ার ডিম! সব তো উপর তলার কতগুলা লোক। যারা প্রকৃত অর্থে মুসলমানদের স্বার্থ দেখেনি। এবং they were communali“ing the community. They were using the capital. তুমি দেখো জিন্নাদের অবস্থা দেখো। তুমি দেখো কয়জন মুসলিম লিডার ততদিন পর্যন্ত বরিশালে আসছে। হ্যাঁ বরিশালেও ভালো ভালো মুসলিম লিডার ছিলেন – হাশেম আলী খান, আজীজ উদ্দীন সাহেব, জমিদার ইসমাইল চৌধুরী, ওহাব খান – এঁরা ছিলেন। এঁরা সবাইতো মুসলিম লীগই ছিলেন। তাই বলে এটা বলা যাবে না যে বরিশালের মুসলিম লীগও ১৯০৬ সালে হয়েছিলো। ব্যাপারটাকে এভাবেই বুঝতে হবে। তোমাদের এও বুঝতে হবে যে বরিশালের মুসলিম লীগের নেতারাও কিন্তু মোছলমান পোলাপানদের approach করে নাই। তারা approach করছে আর পাঁচটা উকিলরে, আর পাঁচটা তালুকদাররে। এদের approach করার পেছনে central assembly -তে ভোটের ব্যাপার আছে। joint electorate হলে পরে ভোট পাইতে সুবিধা হবে – এসব বিবেচনা ছিলো। এদের সাথে যে আমি যাবো আমার কাছে তো তাদের আসতে হবে। তারা তো ছাত্রদের কাছে যান নাই’ (পৃষ্ঠা. ২০)।
মুসলিম লীগের রাজনীতি, শ্রেণিচরিত্র, উদ্দেশ্য-সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য আর কী হতে পারে? রাজ্জাক স্যার তো শুধু-শুধু তাঁর দর্শনে এম.এ পাশ করা ছাত্রটিকে রাষ্ট্র888sport apk বিভাগে নিয়ে আসেননি!
চার
দ্বিতীয় বৈঠকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর 888sport appয় আগমন, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়-পড়াশুনা পর্ব, সেই সঙ্গে কম্যুনিস্ট হয়ে-ওঠার ব্যাপারগুলো খোলাসা করে বলেন। ব্যাপারগুলো শুরু করেন এভাবে: ‘আমি ’৪১ সালে 888sport app আসছি। তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) ইমপ্যাক্টটা গ্র্যাজুয়েলি 888sport appর উপরে সেভাবে পড়েনি।… আমি কলেজে ভর্তি হলাম। 888sport app ইন্টারমেডিয়েট কলেজ হোস্টেলে থাকছি। পড়ালেখা করছি।… ততদিনে আমার বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব হয়েছে।’
তাঁর সেই বন্ধু-বান্ধব কারা? তালিকাটা এইরকম: নাসির উদ্দীন ও তাঁর ছোট ভাই গিয়াস উদ্দীন (ইতিহাসের অধ্যাপক, ১৯৭১-এ শহীদ), আবদুল মতিন (সাংবাদিক; জেনেভায় বঙ্গবন্ধু বইয়ের লেখক), নূরুল ইসলাম চৌধুরী (সাবেক রাষ্ট্রদূত), মাযহার উদ্দীন (মুসলমান হলেও ধ্যান করত, বেদ পড়ত), আবুল কাসেম (তেজগাঁও কলেজের অধ্যাপক), রবিউল ইসলাম চৌধুরী, লুৎফুল করিম (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা; সমাজ888sport apkের অধ্যাপক নাজমুল করিমের ছোট ভাই) প্রমুখ। ১৯৪২ সালে সরদার ফজলুল করিম ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন এবং ‘আশ্চর্যজনকভাবে … অনিচ্ছা সত্ত্বেও… সেকেন্ড স্ট্যান্ড’ করেন। তিনি জানাচ্ছেন, ‘রেজাল্টের ফলে বড় ভাই’র মনোভাব বদলে গেলো। মাঝে তিনি ভেবেছিলেন যে আমি বখে যাচ্ছি।’
না, বখে না গেলেও এ-সময় থেকেই তিনি বদলে যাচ্ছিলেন, এইটি কিন্তু ঠিক। এরপর তিনি 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, থাকতেন ফজলুল হক হলে। এ-সময়ে নাজমুল করিমের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নাজমুল করিমের সূত্রে রবি গুহের সঙ্গেও। সেই সে কাল গ্রন্থে সরদার ফজলুল করিম বলছেন, ‘রবি গুহ, নাজমুল করিম আর আমি খুবই মার্কড ছিলাম। মুসলিম লীগ যখন থেকে সংগঠিত হতে শুরু করল তখন থেকেই আমরা তিনজন হয়ে দাঁড়ালাম তাদের অর্থাৎ পাকিস্তানি পক্ষের আক্রমণের লক্ষ্য’ (পৃ. ২৮)।
কথোপকথনের এই পর্বে তাঁর 888sport sign up bonusচারণের সারমর্ম হচ্ছে :
‘৪৪-এর দিকে মুসলিম প্রগতিশীল ছাত্রদের সাথে কম্যুনিস্ট প্রগতি লেখক সংঘের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে আগে উল্লিখিত বন্ধুরা ছাড়াও সানাউল হক, আবদুল মতিন, সৈয়দ নূরুদ্দীন, মুনীর চৌধুরী এরা ছিলেন।’
এঁদের কথা সরদার ফজলুল করিম তাঁর সেই সে কাল গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন এবং এই পর্বে এসেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘কম্যুনিস্ট’। শান্তনু মজুমদারকে জানাচ্ছেন : ‘আমার মনতো ততদিনে কম্যুনিস্ট হয়েই গেছে। অন্য আর কোন ইচ্ছাতো ছিলো না। কোনো অলটারনেটিভ ছিলো না। বিশেষত যুদ্ধ নিয়ে আমার যে এক্সপেরিয়েন্স আর অ্যাকশন, তারপর তো আমার জন্য প্যারালাল টু কম্যুনিস্ট অন্য কিছু ভাবার ব্যাপার ছিলো না। Not that I choose to be communist but that I had to be communist. এক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রেখো, আমাদের যে কম্যুনিস্ট গ্রুপটা ছিলো they were the best students of the university.’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ১৯৪৩-এর মন্বন্তর তাঁর মানসিক জগতে যে-ভীষণ অভিঘাতের সৃষ্টি করেছিল সেইটি নানাভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে।
888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পরিবেশ-সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিম জানাচ্ছেন, ‘অনেক ভালো ভালো শিক্ষক ছিলো। যেমন ধরো, প্রফেসর রাজ্জাক। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রফেসর রাজ্জাক became professor Rayyaqe because of Rabi Guha, Sarder Faylul Karim -এর মতো ছাত্রদের জন্যে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন: ‘আমাকে একবার হল ইলেকশনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। সেবারই প্রথম ইলেকট্রিক মাইক্রোফোন ব্যবহার করে আমরা সভা করি। একদিন ক্লাশ নেয়া অবস্থায় আমার বক্তৃতা তাঁর (প্রফেসর রাজ্জাক) কানে ঢুকলে নিজের বক্তৃতা থামিয়ে ছাত্রদের আমার বক্তৃতা শুনতে বলেন। ভাবতে পারো, কী কাণ্ড! যা-ই হোক কম্যুনিস্ট হওয়ার কারণে আমি নির্বাচনে হেরে যাই। তবে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে গাল না দেয়ার নীতি কঠোরভাবে মেনে চলতাম। হেরে যাওয়ার পর আমার প্যান্ডেলে বক্তৃতা দেয়ার জন্যে ডেকেছিলাম। আমার সম্পর্কে বিরোধীদল বলতো যে, ওর সঙ্গে কোনো argument -এ যাওয়া যাবে না।… শিক্ষকদের মধ্যে আরো ছিলেন মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। He was pro-communist. তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ড়ৎমধহ পিপলস ওয়ার, জনযুদ্ধ এসব পত্রিকা পর্যন্ত বিক্রি করতেন। পরে এই পত্রিকার আলোকেই তিনি এবং নৃপেন চক্রবর্তীরা মিলে স্বাধীনতা পত্রিকা প্রকাশ করেন। মুসলমান শিক্ষকদের মধ্যে কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল এমন আরেকটা নাম শহীদুল্লাহ সাহেব। অর্থাৎ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।’
এই প্রসঙ্গেই মনে আসে আমাদের এখনকার শিক্ষকদের কথা। তাঁরা কী বিক্রি করেন! বিক্রি করেন তাঁদের মান-সম্মান, মর্যাদা, বিবেক, আত্মা (যদি থেকে থাকে) ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য বিনিময়ে যা-যা পেয়ে থাকেন, তাতে করে তাঁদের ইহকাল-পরকাল দুটোরই রাস্তা সাফ হয়ে যাবার কথা।
পাঁচ
তৃতীয় বৈঠকে সরদার ফজলুল করিম ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন, তৎকালীন রাজনীতি, তাঁর নিজের রাজনীতি, 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান এবং পরবর্তী সময়ে ইস্তফা, আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন-যাপন (পার্টির নির্দেশে), প্রথম গ্রেপ্তার (১৯৪৯), কম্যুনিস্টদের বন্দিদের সঙ্গে হাঙ্গার স্ট্রাইক, যুক্তফ্রন্ট গঠনের পেছনে কম্যুনিস্টদের ভূমিকা – এইসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে এড়িয়ে গিয়েছেন কমনওয়েলথ-বৃত্তির সুযোগ বাদ দেওয়ার ঘটনা। শুধু বিষয়টি উল্লেখ করেছেন মাত্র। তাঁর 888sport sign up bonusকথা থেকে সেই ঘটনার সামান্য বর্ণনা না দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। তিনি আমাদের জানান (সেই সে কাল গ্রন্থে) : “১৯৪৫ বা ’৪৬-এ একটি অফার আসে আমার কাছে বিলাত যাবার জন্য। একটা স্কলারশিপ ছিল ‘রিজার্ভড ফর মুসলিমস’। আমাকে বলা হলো কোলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এসে তুমি ইন্টারভিউতে অ্যাটেন্ড করো। ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে আমি কোলকাতা যাই। কোলকাতায় গিয়ে আমি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে না গিয়ে প্রথমে গেলাম কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। ৮নং ডেকার্স লেনে, এটাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার্স। সেখানে মুজাফফর আহমেদ (যাকে আমরা কাকাবাবু বলতাম), নৃপেন চক্রবর্তী (যিনি পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, আমার খুব প্রিয় লোক আর কি!)। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি…। আমি যেই বললাম, ‘আমি বিলেত যাবো’, ওঁরা শুনে হাসতে হাসতে ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে ভেরেন্ডা ভাজব?’ আমি বললাম, ‘আমাকে কি কি করতে হবে?’ ওঁরা বললেন, ‘কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন…’ পরদিন আমি কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে যাইনি, কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।” (পৃ. ৩৯)।
ব্যাপারটি এই সময়ে অন্তত আমার ক্ষেত্রে ঘটলে কার্ড ছিঁড়ে ফেলা দূরের কথা, প্রয়োজন হলে বাপ-দাদার পরিচয় মুছে ফেলে বিলেত যেতে দ্বিধা করতাম না; মুখে যতই ব্লেয়ার-বুশকে গালি দিই। সরদার তো সে-কারণেই সরদার স্যার। একমাত্র তিনিই বলার অধিকার রাখেন : ‘সোমেন চন্দকে জানতে চেষ্টা করো। কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো বারবার পড়ো। গ্রামসি পড়ো। পিপলকে বোঝার চেষ্টা করো। বেশি বেশি আমেরিকা, বিলাত যাওয়া বন্ধ করো।’
জেলখানায় থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির বিবরণ দিতে গিয়ে জানান :
‘আমি খুব বেশি কান্নাকাটি করি নাই। যদিও কান্নাকাটি করাটাই স্বাভাবিক। একটা লোক জেলে আসছে, তার কারণে একটা পরিবার ডুবতে বসছে – এসব যে কি মর্মান্তিক ব্যাপার তা তোমরা বুঝতে পারবা না। আমার ব্যাপার হলো এই যে আমি তো পরিবারের কোনো কাজে আসিনি। পরিবারের কথা ভাবিনি।… কিন্তু জেলখানায় আমি এত প্রীতি এত ভালোবাসা পেয়েছি যা বলবার মতো নয়। এগুলো আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ।’
যে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগকে কবরস্থ করা হয়েছিল (তার ভূত অবশ্য এখনো টিকে আছে বহাল তবিয়তে), সেই যুক্তফ্রন্ট গঠনের কৃতিত্ব তাঁর ভাষায় কম্যুনিস্টদের। তিনি বলছেন : ‘এই যে নেজামী ইসলামী, ভাসানী, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী এরা এক সাথে এসেছিলো – এই কৃতিত্ব কার? আমি বলছি। এই কৃতিত্ব কম্যুনিস্টদের।’
জেলখানায় বসে তাঁর মনে কখনো দোদুল্যমানতা এসেছিল কিনা শান্তনু মজুমদারের এই প্রশ্নের উত্তরে সরদার ফজলুল করিম বলেন :
‘Repentance for the loss of career বলতে যা বোঝায় এটা আমার কখনো আসেনি। আমার অমুক ছিল, তমুক ছিলো, অমুক হইতে পারতাম – এইরকম ভাবনা আমার আসে নাই। আমার একটা লেখায়ও বলেছি যে আমি হলাম most non-ambitious person. ছোটবেলায় বড় ভাই একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, বড় হয়ে তুই কি হবি? আমি কুলি হতে চেয়েছিলাম।… পরবর্তীতে আমার কোনো ambition develop করেনি। চাকরি করা, ফরেন যাওয়া, মাস্টারি করা কোনোটা নিয়েই তেমন কোন ambition কাজ করেনি। মাস্টারি তো পেয়েছিলাম। তা আবার ছেড়েও দিয়েছিলাম। …জেলখানায় বসে কখনো আমার মনে হয়নি যে একটা ভুল করলাম। আমি নিজের সম্পর্কে বলি যে, আমার জীবনে ভুল বলে কোন কথা নাই। আমার জীবনে লোকসান বলে কিছু নাই। যে কাজ করতে আমি বাধ্য ছিলাম তাকে আমি ভুল বলি কেমন করে? অনুশোচনা, আফসোস, লজ্জা এগুলো আমার আসেনি। কেন আসেনি বলতে পারবো না।’
আসেনি এই কারণেই যে মানুষ হিসেবে তিনি সবসময়েই সমাজের 888sport app মানুষের জন্য কিছু করবার তাড়না বোধ করেছেন। তিনি মনে করেছেন মার্কসবাদ সেই পথ, যা দিয়ে মানুষের সার্বিক মঙ্গল সম্ভব এবং এই মতবাদের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি, পরিবার-পরিজন – এসব ত্যাগ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। যদিও দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেনি, মানুষের মুক্তি আসেনি। এদেশের কম্যুনিস্টদের অনেকেই আজ নিজের পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারপরও তিনি হতাশ নন। কেন নন? সে-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য অতি পরিষ্কার। তিনি জানান : ‘আমি মানবতার দর্শনে বিশ্বাস করি। সেজন্য আমার ভয় নাই, হতাশা নাই।’ ঔবধহ-চধঁষ ঝধৎঃৎব অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদকে সমার্থক ভেবেছিলেন। সরদার ফজলুল করিমের কাছে মার্কসবাদই হচ্ছে মানবতাবাদ।
ছয়
সরদার ফজলুল করিমের আরেকটি অবদান বাংলা ভাষায় প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো – এইসব অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে 888sport app download apk latest version করা। বিশেষ করে প্লেটোর প্রতি তাঁর দুর্বলতা সহজেই বোঝা যায়। একজন মার্কসবাদী হিসেবে এই প্লেটো-প্রীতি তাঁর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপারই মনে হয়েছে। অন্তত চতুর্থ বৈঠকের আলোচনা পাঠ করে আমাদের কাছে সেইটি পরিষ্কার। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে : ‘আমি মনে করি যে প্লেটো এবং মার্কসের মধ্যে কোনো কন্ট্রাডিকশান নাই। একটা সাধারণ কন্ট্রাডিকশান আছে, তা হলো প্লেটো হচ্ছেন আইডিয়ালিস্ট আর মার্কস হচ্ছেন রিয়ালিস্ট। কিন্তু গভীরে ঢুকলে উভয়ের সাদৃশ্যই পরিস্ফুট হয়। মার্কস প্লেটোকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইডিয়ালিস্ট ফিলোসফার মনে করেন। শব্দ ধরে ধরে এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য তুলে বের করার দরকার নেই। দুজনের মধ্যে সময়গত ব্যবধানটা খেয়াল রেখো। সক্রেটিসের জবানিতে প্লেটো যখন বলেন যে, আমি জানি যে আমি জানি না, ওরা জানে না যে ওরা জানে না। কিংবা প্লেটো যখন বলেন যে যার যা করা উচিত তা করাই হচ্ছে জাস্টিস – এগুলো তো মহা অমূল্য কথা। এগুলো আর কোথায় পাবা! মার্কসীয় দর্শনে আকৃষ্ট একজন লোক হয়েও এগুলোকে ধারণ করায় আমার কোন অসুবিধা হয় না।’
তাঁর এই প্লেটো-অনুরাগ এবং প্লেটো-888sport app download apk latest version আমাদের অধ্যাপক Benjamin Jowett (1817-1893)-এর কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি বলতেন, ‘Plato is a most faithful friend to me – too faithful, for indeed I can’t get rid of him.’ সরদার ফজলুল করিমের ক্ষেত্রে অবশ্য দুজন – প্লেটো ও মার্কস; মার্কস ও প্লেটো। তাই বলে তিনি অন্যদের কৃতিত্ব বা মহত্ত্বকেও অস্বীকার করেননি। এই বৈঠকেই তিনি কম্যুনিস্ট, কম্যুনিস্ট পার্টি-সম্পর্কে যে- মন্তব্য করেছেন তা প্রত্যেক কম্যুনিস্টেরই (আমি কম্যুনিস্ট নই!) মুখস্থ করে রাখা উচিত। তাঁর বক্তব্য :
‘আমি তো কম্যুনিস্ট পার্টির কেউ ছিলাম না। I was a communist by myself. I was not a communist by membership. এখানে একটা পার্থক্য আছে। আমি মনে করি আগে কম্যুনিস্ট হওয়ার ব্যাপার, তারপরে আসবে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদানের প্রসঙ্গ। কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েও কম্যুনিস্ট হওয়ার গ্যারান্টি নাই। আগে conception about humanity, conception about man এগুলো।… পার্টি যেটা পারে তা হলো ব্যক্তির মধ্যকার যে conception সেটাকে প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা। সুতরাং পার্টির ব্যাপারটা আসবে conception -এর পরে। যখন মার্কস কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো লেখার জন্য এত পরিশ্রম করেন তখন কি তিনি পার্টির মেম্বার ছিলেন? যারা বিত্তহীন, অসহায় তাদের জন্য মার্কসের যে বোধ সেটাই আগের কথা। বোধ স্পষ্ট না থাকলে পরে একটা সংগঠন যদি ভেঙে যায় তখন সংগঠনের সদস্য মনে করে যে তার আদর্শই ভেঙে গেছে! কতগুলো পার্টি গড়ে উঠলো বা ভেঙে পড়লো তার সাথে কম্যুনিস্ট থাকা না থাকার ব্যাপারটা জড়িত থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। একজন কম্যুনিস্ট তার বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই কম্যুনিস্ট।’
সাত
উপর্যুক্ত উপলব্ধি সরদার ফজলুল করিমকে হতাশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। এবং সেই যুদ্ধে তাঁকেই জয়ী মনে হয়। পঞ্চম বৈঠকে তাঁর হতাশা, হতাশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা – এইসব নিয়ে আলোচনা করেছেন। যদিও হতাশা ছাড়া আমাদের জীবনে কিছুই নেই এখন। আগামী একশ বছরেও এই হতাশা, এই অন্ধকার কাটবে বলে মনে হয় না। এটা শুধু 888sport appsেরই ব্যাপার নয়, বরং সারা বিশ্বেরই ব্যাপার। তিনিও ব্যাপারটি স্বীকার করেছেন। তারপরেও তিনি আশাবাদী :‘আমার চারিদিকে হতাশার সর্বগ্রাসী একটা ব্যাপার দেখি। হতাশাবোধ হচ্ছে এক সংক্রামক ব্যাধি। ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়। জীবনের মধ্যে হতাশাকে অন্বেষণ করতে হয় না। জীবনের মধ্যে আশার বীজ অন্বেষণ করতে হয়।… হতাশার বিবরে আবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না।… আমি তো জীবন ছাড়া আর কিছু দেখি না। গোর্কির কথাই আমাদের জীবনদর্শন হোক – ‘মানুষ ছাড়া কোনো দেবতা নাই।’
কথাগুলো শুনতে ভালো; কিন্তু বাস্তবজীবনে প্রয়োগ অত্যন্ত কঠিন। আর মানুষ-দেবতা যেভাবে প্রতি মুহূর্তে ‘অপদেবতা’ হয়ে উঠছে, তাতে করে বরং কুকুর-বিড়ালের প্রতি ভক্তি বাড়ে – মানুষের প্রতি নয়। James Kirkup তো এমনি-এমনিই এ-কথা বলেননি যে
We are all prisoners of one another,
And all our captors are ourselves.
We are all beasts. But beast
Do not disgrace each other as do men.
(Not Cricket)
এই কথাগুলো সরদার ফজলুল করিম শুনলে কষ্ট পাবেন; তবুও বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায় না – করা উচিতও নয়। এবং তিনি নিজেও একাদশ বৈঠকে এসে স্বীকার করে নিয়েছেন –
‘আজকে অবস্থা এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে নিজের মনের কথা নিজের কাছে বলতে ভয় নাই (ঝরপ; পাই)। কেবলই মনে হয় দেয়ালেরও কান আছে। আমি ভয়ার্ত। না হয়ে উপায়ও নেই।’
তবে সেই সঙ্গে এ-ও বলেছেন বেশ জোর দিয়ে : ‘এটাই কিন্তু আমার শেষ কথা নয়।… সেজন্যই যতই চিৎকার করি না কেন শেষ বিচারে আমি হতাশাবাদী নই, আশাবাদী।’ সূত্রধর শান্তনু মজুমদারও সরদার স্যার-সম্পর্কে শেষ কথাটি বলেছেন এইভাবে :
‘প্রতিটি আলোচনাপর্বে বারবার এ-কথাটিই মনে হয়েছে যে সরদার ফজলুল করিম হতাশার পূজারী নন। আশার কাণ্ডারী। আশার ফেরিওয়ালা।’
আট
এই কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে এসে সরদার এমন একটি মন্তব্য করেন যা শুনে মনে হয় মানুষটি সত্যিই অসাধারণ। আমার অন্তত সৌভাগ্য যে এমন মানুষের কথা শুনতে পেয়েছি, লেখা পড়তে পেরেছি। নিজের পরিচয় যেখানে আমরা সবসময়ে মুছে ফেলে অন্যরকম করে সাজাতে চাই, সেখানে তিনি বলছেন –
‘আমার পরিচয় আমি তৈরি করি নাই। রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী এসব পরিচয় আমার দেয়া নয়। আমি কৃষকের পোলা। আমি শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে চাই।’
আমি হলে বলতাম – ‘আমি জমিদারের পোলা। তবে বাপের নামখানা ভুলতে চাই। বাপের নাম ভুলতে চাইলেও এই গ্রন্থখানা পাঠশেষে সরদার ফজলুল করিমকে অবশ্য আমার ভারতীয় দর্শনের দিক থেকে বিচারে ‘মুনি’ বলে মনে হয়েছে। তাঁর জীবন-যাপন, সংগ্রাম – এসবও মহামূল্যবান গ্রন্থ। গৌতম বুদ্ধ ধম্মপদ-এ বলেছেন : By (observing) silence a man does not become a sage if he be foolish and ignorant; but that wise man, who, holding (as it were) the scale, takes what is good, and avoids the evil, he is the sage, is a sage for that (very) reason. He who in this world weighs both sides, is called a sage on that (very) account.
The Righeous (Dhamm-atthavaggo) : 268-269 ভগবান বুদ্ধের এই কথার সঙ্গে সরদার ফজলুল করিমকে মিলিয়ে দেখেছি, তাতে করে বলাই যায় উনি মুনি, প্রাজ্ঞ – মহাপ্রাজ্ঞ।
নয় সরদার ফজলুল করিম প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে যেভাবে এবং যে-ভঙ্গিতে প্রফেসর রাজ্জাককে তুলে ধরেছিলেন, শান্তনু মজুমদার সেই আলাপচারিতার ভঙ্গিটি ব্যবহার করে সরদার ফজলুল করিমকে অনেকটাই আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। শান্তনুকে আবারো আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে এই গ্রন্থের মুদ্রণ-প্রমাদ ও মুদ্রণ-বিভ্রাট বেশ অস্বস্তির সৃষ্টি করবে পাঠকের মনে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.