কবিয়াল বিজয় সরকার : অমিত তাঁর প্রতিস্পর্ধা

বিপস্নব বালা

ছোটবেলা থেকে শহরে থাকি। কবিগান গ্রামের পৌষমেলায় হয় বলে প্রথম শুনি। মাদারীপুরের গ্রামের বাড়িতে আর মামাবাড়ি গোপালগঞ্জেও শুনি কবিয়াল-অধিকারীদের নাম : রাজেন সরকার, নকুল সরকার, ছোট রাজেন আর বিজয় সরকার। কী যে মুগ্ধ বিস্ময় আর 888sport apk download apk latest versionভরে তাঁদের নাম বলা হতো! মুখে মুখে পুরাণ-মহাকাব্য-শাস্ত্রের নানা বিষয় নিয়ে ছড়া কাটা, গান করা; বিপরীত দুই বিষয়-মতের পক্ষ নিয়ে দুই কবির লড়াই। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে যুক্তি-দ্বন্দ্ব যাত্রাগানেও হতো। তবে কবিগানে তা হতো, যাকে বলে শুদ্ধ কাব্যিক-সাংগীতিক-শাস্ত্রীয় যে-কোনো বিপরীত দুই বিষয়ে আপসপক্ষ বেছে নিয়ে : 888sport promo code-পুরুষ, রাধা-কৃষ্ণ, এমনকি হিন্দু-মুসলমান নিয়েও। তাতে হিন্দু কবিয়াল মুসলমান পক্ষ আর মুসলমান কবিয়াল হিন্দু পক্ষ নিয়ে আসরে নামতেন। দেখা যাক কোন কবির কত যুক্তি-বুদ্ধি-ছড়াগানে ন্যায়মীমাংসার ধার। গ্রামের সাধারণ মানুষ  কোনো এক পক্ষ না নিয়েই নাকি উপভোগ করতেন উভয় মত-পক্ষের ক্ষুরধার যুক্তিজাল বিস্তার। তাতে কখনো কমিক রিলিফ হিসেবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চতুরতার একশেষও করতেন কোনো কবি, আদিরসের হদ্দমুদ্দ করে ছাড়তেন। সেটা নিশ্চয়ই সীমাও ছাড়াত শস্নীলতা-মার্জিত রুচির। যদিও নাগরিক ভিক্টোরীয় কপট শুচিবায়ুগ্রসন্ততায় তার সহজ স্বাভাবিকত্বের অন্য মুক্ত রুচি-সামর্থ্যের নাগাল পাবো না আমরা।

নাটক বা পঞ্চম বেদ নাকি সাধারণের আয়ত্তে আনতেই চার বেদের সার দৃশ্যকাব্য যোগে করা হয়। পুরাণ-মহাকাব্যের আখ্যানও নাকি সাধারণ জনগণমনের নাগাল পেতেই করা। শেষ পর্যন্ত সাধারণ এ-সীমায় না পৌঁছলে কোনো জ্ঞান-888sport apk-শাস্ত্রেরই পরিণতির ব্যাপ্তি মেলে না বুঝি।

শহুরে শিক্ষিত নাগরিকজন আমরা যতই তাকে ছোট চোখে দেখে অহমিকায় আন্ততুষ্ট হই না কেন; ফরিদপুর-যশোর-খুলনা-পাবনা-বরিশাল-কুষ্টিয়ার মানবসাধারণ তাদের কাব্য-সংগীত-শাস্ত্র-ভাবের এক সমগ্রতার আস্বাদ পেত বা পায় কবিগান-কীর্তন-মঙ্গলকাব্য-তরজা-ভাবগান পরিবেশনার বিবিধ-বিচিত্র রীতি-প্রকরণে। প্রতিটি বই ভিন্ন ভিন্ন রুচি ঘরানার নানাজনের।

যথামর্যাদায় তার সৃজন-নন্দন অনুধাবন হয়নি তো। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বুঝি নাগরিক-গোচর করেন তাঁর গভীর মহিমা। সে-পথে দীনেশচন্দ্র সেন, ক্ষিতিমোহন সেন, জসীমউদ্দীন-মনসুরউদ্দিন-আবদুল করিম 888sport live footballবিশারদ হয়ে সুধীর চক্রবর্তী-বাহিত এক সুলুকসন্ধান অনুধাবন ধারা দাঁড়িয়েছে। উত্তরাধুনিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক, নিমণবর্গীয় তত্ত্বকাঠামোয় এক মান্যতাধারাও গড়ে উঠেছে এতদিনে আজ।

তবে, কবিয়াল বিজয় সরকারের অন্যতর এক ঐতিহাসিক নন্দন-অভিযান আছে।

গ্রামসমাজের জনগণমনে কবিগানে বিপুল রসসঞ্চার সত্ত্বেও কোথাও বুঝি তাঁর 888sport live chatীজনোচিত অতৃপ্তি জাগে, শিক্ষিত নগরজন যে এহেন রসাস্বাদনে অসমর্থ; এ যেন তারই সামর্থ্যের কোনো উনতা। একধরনের অহং-অভিমানও কাজ করেছিল কোথাও মনেরও অগোচরে তাঁর; গুরুস্থানীয় রাজেন সরকার, বন্ধুবর নিশিকান্তসহ দলবেঁধে নৌকায় তাই কি যাত্রা করেন কলকাতা মহানগরী পানে – ১৯৩২ সালে?  বন্ধুস্বজন জসীমউদ্দীন তখন কলকাতায়, তাঁরই সহযোগে অ্যালবার্ট হল ভাড়া করে টানা সাতদিন শোনাবেন কবিগান শিক্ষাসংস্কৃতি-অভিমানী নাগরিকজনকে। একেই বলে বুঝি 888sport live chatীর চিরকালের স্পর্ধা, সাহসী বুকের পাটা। যখন কিনা আধুনিকতার দুন্দুভি রব অগ্রাহ্য করতে উদ্যত এযাবৎকালের মান্য যত কাব্য888sport live footballসংগীত এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও, তখন কোথাকার কোন বাঙাল অজগাঁওগ্রামের অশিক্ষিত ইতরজনমান্য হরিদাস পাল এলেন কিনা প্রাচ্যভারতীয় শিক্ষাসংস্কৃতির রাজধানী কলকাতায়!

তা হলো সেই সম্মুখসমর-বিষম দুই বিপরীত দলের। স্বভাবত মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে। জসীমউদ্দীনের মেসে সারাদিন মহড়া চলে। শহুরে কান-মনের খবর তো জানেন ভালো তিনি। চটকদার ধুয়ার সুর আর বিলম্বিত লয়ে করুণ সুর দিয়ে নতুন করে পালটি রচনা করা হয়। বেশিক্ষণ শোনার ধৈর্য নেই তো এখানে, তাই প্রত্যেক পালটি এক ঘণ্টার সময়সীমায় বাঁধা হয়। আসর বন্দনা আর একই গানের পুনরাবৃত্তিও বাদ গেল। পত্রিকায় কবিগানের ওপর 888sport liveও ছাপানো হলো। তবু শ্রোতা তত মিলল না। বরং বিরুদ্ধ বিবৃতি ছাপা হলো : আধুনিক রূপ দিয়ে কবিগানের রসান্তক দিক ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে; পুরনো অলংকার বাদ দিয়ে আসল রূপ নষ্ট করা হয়েছে। তাতে পরের দিন শ্রোতা আরো কম হলো। গুরু রাজেন সরকার উন্মত্তবৎ হলেন। সঙ্গীসাথিদের দেশে পাঠাতে তাঁর সাধের নৌকা বিক্রি করতেও হলো।

এই ব্যর্থতা তো সাময়িক। হাল ছাড়েননি বিজয় সরকার। আকাশবাণীতে জসীমউদ্দীনের সঙ্গে কবিগানের পাল্লা দেন। ১৯৩৭ সালে ১ অক্টোবর অ্যালবার্ট হলে একরাতে কবিগানের পাল্লা শুনে সুনীতিকুমার, সুকুমার সেন মুগ্ধও হন, প্রশংসাপত্র লিখে দেন। কলকাতা ও আশেপাশে বায়নাও হলো গানের। মুকুন্দ দাস, নজরুল ইসলাম, আববাসউদ্দীন – সবার সঙ্গে মোলাকাত হয় তাঁর। সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও।

একেই বলছি 888sport live chatীর প্রতিস্পর্ধা। সেটি আরো এজন্যে যে, নাগরিক উচ্চমন্যতার দুর্ভেদ্য কেল্লা তাতে লঙ্ঘিত হতেও পারে। নাগরিকজন একবারই মাত্র উদ্যোগী হয়েছিল এক বিনিময় যোগের। চলিস্নশের দশকে গণনাট্য সংঘের তরফ থেকে – ইতিহাসে নাগরিকজনের সেই হলো স্বদেশের সঙ্গে যোগবিনিময়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য একক অভিনিবেশে সম্পন্ন করে চলেছেন যা জীবনভর; কিশোরবেলা কলকাতায় স্বদেশি মেলায় সে-মনের বীজ বপন হয়েছিল বুঝি। তাঁরই প্রবর্তনায় শিলাইদহ, সাহজাদপুরে সমবায় পদ্ধতি, গ্রামসমাজ গঠনব্রত, কৃষি ব্যাংক স্থাপন আর সবশেষে শিক্ষা-সংস্কৃতি-কৃষি-888sport live chat-কারিগরি বিনিময় শামিন্তনিকেতন, শ্রীনিকেতনে।

পূর্ববাংলায় গত শতকে পাঁচের দশকের শেষ থেকে 888sport appর বাংলা একাডেমির লোকসংগীত সম্মেলনে কবিগান করেন বারকয়েক; স্বাধীনতার পর সত্তরের শেষদিকে 888sport live chatকলা একাডেমিতেও আসর জমান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, দার্শনিক গোবিন্দ দেব, আবদুল হাই মুগ্ধ শ্রোতা হয়েছেন – জসীমউদ্দীন তো পাশেই থেকেছেন সর্বদা; খুলনা সম্মেলনে তো তাঁকে দেওয়া মালা পরিয়েছেন বন্ধুবর বিজয় সরকারকে; চোখের জলে বলেছেন : বিজয় রাক্ষস, আমাকে শেষ করে দিয়েছে; ওর জন্য আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারলাম না, ও তো গ্রামের মানুষের মনে শক্তভাবে ঢুকে গিয়েছে। ১৯৭৮ সালে খুলনায় জারি গানের শ্রেষ্ঠ বয়াতি মসলেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিলেন, বিষয় হিন্দু ও মুসলমান। বিজয় সরকার মুসলমান পক্ষে, মসলেম বয়াতি হিন্দুর পক্ষ হয়ে পাল্লা দেন কবিগানের। বাঙালি সংস্কৃতির এই তো ছিল চরিত্র। তার মৌল জোরের জায়গা। নাগরিক সমাজে যার যোগ নেই বলেই তার যত সম্প্রীতি-বুলি কোনো কাজে লাগেনি, আজো লাগে না। গ্রামসমাজ আজো বেঁচেবর্তে আছে বাঙালির আদি এই স্বভাব-সংস্কৃতি বলে।

দেশভাগের পর দিলিস্নর সর্বভারতীয় সংগীত সম্মেলনে নানা ঘরানার শাস্ত্রীয় 888sport live chatীর পাশাপাশি গেয়েছেন তিনি। লোকায়ত ধ্রম্নপদীর যোগ বিনিময়ই তো রক্ষা করে, বিকশিত করে সংগীতের এক সমগ্রতার আদল। তার থেকেই তো পরিবর্তমান সময় ও বাসন্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় আধুনিক গানেরও উদ্ভব ও পুষ্টি। পঞ্চকবি তারই সিদ্ধি দেখিয়েছেন। পরবর্তী আধুনিক গানের স্বর্ণযুগও একই কারণে। সলিল চৌধুরী-হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার অন্যতর আদল দেন। এসবের সঙ্গে পশ্চিমি যোগও স্বভাবত সৃজন-সহায় হয়েছে।

ষাটের দশক থেকে নগরে বিজয় সরকার পরিচিত হন তাঁর বিখ্যাত বিচ্ছেদি গানের আকুল মর্মভেদী কথা-সুরের কারণে। কবিগানের মুখপাঁচালিতে জনপ্রিয় রবীন্দ্র-নজরুল-জসীমউদ্দীনের গানের ধুয়া দিতেন তিনি। সেটা শ্রোতাসাধারণের পরিচিত প্রিয় বলেও। কবিগানের পাল্লায় শাস্ত্রীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ থেকে একধরনের সহজ গানের আরাম তাতে পেত শ্রোতা। এসব ধোয়াগান দিয়েই তার বিচ্ছেদি গান রচনার সূচনা। নগরে তারই সম্প্রচার ঘটে। আজো তার ভিন্ন আবেদন নাগরিকমনে। ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন নাকি তিনি রবীন্দ্রনাথ-অতুল প্রসাদ-নজরুলকে সামনে রেখেই রচনা করেছেন। কবিগান-নিরপেক্ষ নানা ধরনের গানও রচনা করেছেন তিনি। আধ্যাত্মিক গান, লোকগান, প্রকৃতি গান, আন্তবোধন গান, দেশগান, 888sport cricket BPL rateের গান, জাত্যাভিমানবিরোধী গান, ইসলামি গান, আধুনিক গান, নিবেদিত গান আর শ্রাবণী গান – শ্রাবণ মাসে প্রথমা স্ত্রীর প্রয়াণ 888sport app download for androidে প্রতিবছর যা রচিত হতো; ‘আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনি একদিন ভাবি নাই মনে’, ‘এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে’…

সমন্বয় সাধক এই কবিয়াল কবিগানে-গানে বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ, পুরাণ, মহাকাব্যদ্বয়, বৈষ্ণব পদাবলি থেকে ইসলামি শাস্ত্রের এক উদার মিশ্র ভাব-যুক্তির সারাৎসার দিয়ে তাঁর সংগীত-আয়ুধ সৃজন করেছেন – বাংলা মনের যা ছিল চিরকালের অমোঘ রসনিষ্পত্তি।

এমন যে কবিয়াল, আজো তাঁর কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি 888sport apps কি ভারতে। একেই বলে বুঝি উপনিবেশী নাগরিক মনের চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধিতা! গত শতকের ত্রিশের দশক থেকে আশির দশকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত উভয় বঙ্গে তাঁর কবিয়াল-কৃতি তবু উপেক্ষেত হয় – পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত কবিয়াল-পরিচিতি গ্রন্থে। ছিলেন কি তিনি কেবলই নিমণবর্গীয় হিন্দু আর মুসলমান শ্রোতার আসরে, মনে?

সে কি তবে ভারতীয় সভ্যতার আদি পাপ : জাতপাতের বর্ণবাদ, যার ফলে অনিবারণীয় আন্তঘাত চিরস্থায়ী এক বিনাশ-মাতন ঘটে চলেছে উপমহাদেশ জুড়ে?

রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলেছেন – ‘যারে তুমি নীচে ফেল/ সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে/ সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ কোনো হুঁশ তাতে ফেরেনি এমন রক্তমজ্জাময় সে-বিষক্রিয়ার সংক্রমণে। r