যেন অর্ধশান্ত নদীর ঢেউ। কবির মনে পড়ছে কয়েক মাস আগে দেখা যুবকটির কথা।
উজ্জয়িনীর পাশঘেঁষে বয়ে চলা শিপ্রা নদীসৈকতের এই এলাকাটি কবির খুব প্রিয়। প্রকৃতির প্রতিটি অঙ্গ এখানে প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। আর কবি যখন আসেন, রাত্রির শেষ ছায়া আর দিনের প্রথম আলোর সন্ধিক্ষণ। কৃত্রিম কোলাহল নেই, সবুজের নৈঃশব্দ্য, পাখির গান, শিপ্রার ওপারে নেমে থাকা আকশ; যে-কারো মনে উঁকি দেবে আনন্দের আলো।
একটি গাছের পায়ের কাছে যুবকটি বসে আছে। কবি তার পাশ দিয়ে গেলেন, এলেনও। যুবকটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। উদাস দৃষ্টি, দূরত্বের আরো দূরে …। মগ্ন, মনের ভেতর থেকে যেন কিছু মনে করতে চায়!
পরের দিন সেই একই দৃশ্য।
তৃতীয় দিনও কোনো দৃশ্যান্তর নেই। আজ কবির কৌতূহল হলো, বসা যাক যুবকটির কাছে। ওর এমন ঔদাস্য কেন! একটু কাছাকাছি গিয়েছেন। এই যুবক তো কবির চেনা! আর ওর এমন বিষণ্নতার কারণও কবির জানা। এই যক্ষ যুবক কুবেরের উদ্যানরক্ষক ছিল। একদিন ওর অবহেলার সুযোগে হাতি এসে ফুল নষ্ট করে দেয়। এ-অবহেলার জন্য যুবকটির কপালে জুটেছে এক বছরের নির্বাসনদণ্ড। রামগিরি পর্বতে কাটাতে হবে নিঃসঙ্গ সময়।
এখনো যুবকটির দৃষ্টিরেখায় বিষণ্নতার ছায়া ফুটে আছে … করুণ,আর্দ্র।
কবিই নীরবতা ভাঙলেন, ‘তোমার বেদনা আমি জানি। ঘরে নববিবাহিত স্ত্রী। তাকে রেখে নির্বাসনে থাকা
অসহ্য কষ্টের। তবু রাজদণ্ড বলে কথা। আমাদের রাজার মহানুভবতা সবারই জানা। অন্য কেউ হলে হয়তো আরো
কঠিন দণ্ড হতো।’
যুবককের মনে কেমন চাঞ্চল্য। ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘রাজদায়িত্বে অবহেলা করেছি, শাস্তি হয়েছে। তবে …’
যুবকের কণ্ঠ থেমে গেল।
কবির মনে কৌতূহল, জানতে চাইলেন, ‘তবে কী?’
দৃষ্টি থেকে ঔদাস্যের ছায়াটা সরিয়ে যুবক বলল, ‘আমি আপনার লেখার ভক্ত।’
‘আমার লেখা তুমি পড়েছ?’
‘পড়েছি। আপনার ‘ঋতুসংহার’ আমার প্রায় মুখস্থ।’
ঝড়ের ঝাপটা থেকে সেরে-ওঠা গাছের দাঁড়ানোর মতো, এখন যুবকটির মুখে যথেষ্ট স্বাভাবিকতা বিরাজমান। বলল, ‘শ্রদ্ধেয় কবি, কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জানতে চাই।’
‘সংকোচ করছ কেন, বলো।’
‘আপনার 888sport app download apkয় শুধু সৌন্দর্যের কথাই থাকে।’
‘তা থাকে বটে। তবে সৌন্দর্য বা আনন্দের আড়ালটাকে তো দেখতে হয়। সেখানে বেদনার ছায়া থাকে, রোদন থাকে। এই যে তোমার জীবন, সুখের কমতি ছিল না। হঠাৎই নেমে এলো দুঃখের ছায়া। এ-ও একসময় থাকবে না, আনন্দ আসবে।’
‘আমার দুঃখ আমারই থাক।’
যাওয়ার জন্য যুবকটি হাঁটতে শুরু করলে কবি তাকে থামালেন, বললেন, ‘বিরহে সৌন্দর্য থাকে। তবে এর ছায়া-আলো উপলব্ধি করার সক্ষমতা অনেকের থাকে না। যার থাকে, প্রেমের পূর্ণতায় ভরে ওঠে তার মন। বিরহের ধিকিধিকি আগুনে থাকে নরম নিঃশব্দ আলোর ঝিলিক, অশ্রুপাতে রেখা-রেখা বিচিত্র কুসুমের হাসি।’
যুবকের উদাস দৃষ্টি অনেকটা বদলে গেছে। মৃদু উচ্ছ্বাস। জিজ্ঞাসার চিহ্ন, ‘আচ্ছা, বিরহে সৌন্দর্য থাকার কথা যে বললেন, এর প্রকাশটা কোথায় থাকে?’
কবি সামান্য হেসে বললেন, ‘অনুভবে।’
‘জেনে গেছি অনেক প্রশ্নের উত্তর।’
যুবকের মন এখন যথেষ্ট শান্ত। বলল, ‘মহারাজের জয় হোক।’
‘মহারাজের জয়ধ্বনি!’ কবির চোখ-মুখে বিস্ময়।
হাসিরেখা স্পষ্ট করে যুবক বলল, ‘মহারাজ আমাকে নির্বাসনদণ্ড দিলেন, এ তো আমার সৌভাগ্য। প্রিয়তমাকে রেখে পর্বতদেশে একা থাকা তেমন কঠিন দণ্ড নয়, বরং বিরহ যাপনের বড় সুযোগ।’
দুজনের মধ্যে কিছু সময়ের নীরবতা।
যুবকের দিকে তাকালে কবির মনে ছড়িয়ে পড়ল গভীর আবেশ। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কবে রামগিরি পর্বতের দিকে রওনা হচ্ছো?’
‘কালই।’
যুবকের কাঁধে হাত রেখে কবি স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন, ‘ঈশ্বর তোমার কল্যাণ করুন। বছরটা যেন এক দিন সময়ের মতো দ্রুত শেষ হয়।’
কবি দেখছেন এক বেদনাকাতর যুবকের চলে যাওয়ার দৃশ্য। ওর উপস্থিতি মিলিয়ে গেল, কবির বুকের গভীরে জেগে থাকল ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস।
‘বিরহ যাপন’ যুবকের মুখ থেকে শোনা এই শব্দ-দুটি কবির বেশ মনে ধরেছে। এভাবে তো ভাবা হয়নি! কথার এক ফাঁকে মৃদু করে যুবকটি আরো বলেছিল, ‘আপনি তো সৌন্দর্যবিলাসী কবি।’
কবির মনে এ-প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে – সত্যি কি?
তা-ই! ‘ঋতুসংহার’ শুধু প্রকৃতি বর্ণনার কাব্য নয়। এতে রতিতৃষ্ণা আছে, আছে বিরহবেদনার কথাও। বিরহের রোদন কত তীব্র তা কবির অজানা নয়। পাঠে এবং কোনো কোনো দেখায় বুজেছেন বিরহ কতটা অনল!
কাল রাতেই তো পড়েছেন ভাসের লেখা ‘স্বপ্নবাসবদত্তা’ নাটক। কী অসামান্য বিরহবিধুর মগ্নতা!
উদয়ন বৎস রাজ্যের রাজা। কিন্তু তার চরিত্র দীপ্তি লাভ করেছে প্রেমিকরূপে। বাসবদত্তার গভীর প্রেমই তাকে মহিমান্বিত করেছে। পদ্মাবতীকে বিয়ে করলেও, কখনো ভোলেননি বাসবদত্তার প্রেমাঞ্জলির কথা। বাসবদত্তা কি ভুলেছেন উদয়নের প্রেম?
প্রিয়তমের জন্য সকল প্রাপ্য থেকে সরে বাসবদত্তা হয়েছেন আড়ালের মানুষ, বিরহের সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যময়ী।
বিরহের দহন হচ্ছে আগুনের শৈত্যপ্রবাহ। পোড়ে, জমাট করে রাখে ক্ষতযন্ত্রণা। কবি দেখেছেন, নগরের শ্রেষ্ঠীরা বাণিজ্যে গেলে, দীর্ঘ বিরহ-তাপে তাদের প্রিয়ারা কতটা করুণ ও কাতর হন!
দুই
তা, এতক্ষণ পাঠক যে-কবিকে জানলেন, তাঁর নাম কালিদাস। উজ্জয়িনীর রাজদরবারের ‘নবরত্ন’সভার এক রত্ন। রাজা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য কালিদাসকে ‘মহাকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ‘গুণী গুণং বেত্তি’ – সংস্কৃত এই প্রচলনবাক্যটির অর্থ ‘গুণবান ব্যক্তিই গুণ বোঝেন।’ বিক্রমাদিত্য শুধু পরাক্রমশালী রাজাই নন, শাস্ত্রালোচনায় তাঁর গভীর আগ্রহ। ভারতের বিখ্যাত পণ্ডিতবর্গ রাজদরবারে আমন্ত্রিত হন, শাস্ত্রালোচনা হয়। কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যের জন্য কালিদাসের বাড়তি গুরুত্ব ছিল। রাজকাজে রাজা যখন ক্লান্তি বোধ করেন, ডাক পড়ে কালিদাসের। কবি নিজের 888sport app download apk শোনান, শোনান অন্যদের 888sport app download apkও। একসময় রাজার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের আভা; যেন শৈবাল সরে গিয়ে জলস্থানে হেসে আছে নতুন আলোক।
একটা বিষয় কিছুতেই কালিদাসের মাথায় আসে না। সর্বময় সুখী মানুষের মনে এতো বেদনাবোধ জেগে ওঠে কেন? আনন্দে-ভরা পাত্র থেকে যা উপচে পড়ে সে কি দুঃখ? যেমন রাজা বিক্রমাদিত্য; ধনেজনে মহাসুখী মানুষ।
বহু বিস্তৃত গুপ্ত সাম্রাজে প্রজারা সুখ-শান্তি-আনন্দে বসবাস করে। রাজধানী উজ্জয়িনী সুসজ্জিত। রাজকোষে অঢেল ধনরত্ন। অন্তঃপুরে ভোজরাকন্যা ভানুমতি – রূপসী বিদূষী স্ত্রী। রাজা স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। সকালে একবার দরবারে আসেন, রাজ্ঞীর সঙ্গসুখে কাটে রাজার বাকিটা সময়। ‘তিলেক না দেখিলে ফাটে যে পরাণ’, এই যখন অবস্থা, রাজকর্তারা একটা উপায় বের করলেন। রাজ্ঞীর অনুরূপ তৈলচিত্র তৈরি করে স্থাপন করা হলো রাজসিংহাসনের পাশে।
রাজা এখন যথেষ্ট সময় দরবারে থাকেন। একদিন সবার বিদায় মিলল, কালিদাসকে রাখা হয়েছে। হাসতে হাসতে রাজা বললেন, ‘কবি, তোমাদের ব্যবস্থাটা মন্দ-না। চাঁদ ছুঁতে পারি না বটে, জ্যোৎস্না তো পাই!’
এবার, নদীমোহানার মতো কবি ও রাজার হাসি মিশেমিশে একাকার হলো।
প্রায়শই এমনটি হয়। রাজার মনে কেমন যেন খেয়ালের ঘোর চেপে বসে। শাসকের গাম্ভীর্য লুপ্ত হয়। কথায়, থেমে যাওয়া কথায়, হাসিতে উজ্জ্বল হতে থাকে মুগ্ধতার আবেশ।
‘কবি, 888sport app download apk শোনাও।’
এমন আহ্বানের জন্য কালিদাস প্রস্তুতই থাকেন। শুরু করলেন ‘রঘুবংশ’ দিয়ে। রাজা রঘু চরিত্রের আড়ালে আছেন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। কালিদাসের কবিত্বশক্তির সঙ্গে ইতিহাসরেখা ও কল্পনার মিশেলে ‘রঘুবংশ’ অপূর্ব এক মহাকাব্য। কবি নিজে যখন পাঠ করেন, এতে যুক্ত হয় নতুন ব্যঞ্জনা।
প্রশংসা শুনতে কার-না ভালো লাগে। তবে তা কতক্ষণ! কবিকে থামালেন। ‘অন্য 888sport app download apk হোক।’
চোখ বোজা, রাজা ডুবে আছেন মগ্নতার অতল তলে।
সদা প্রস্তুত, কবি পড়ছেন ‘ঋতুসংহার’ থেকে – ‘সূর্যের জটিল ক্রোধ। ক্লান্তি ওড়ে বিকট বাতাসে/ ঝরে যদি জ্যোৎস্নার ঢেউ, প্রীতিপদ হয় রাত/ স্নানরত রমণীর অসাবধান-সৌন্দর্যের মতো/ যথেষ্ট উৎসুক হয় 888sport slot gameের অতলান্ত লোভ।’
গ্রীষ্মঋতুর বর্ণনার এ-অংশটুকু পড়ার পর কবি থামলেন, বোঝার চেষ্টা – রাজার প্রতিক্রিয়া কী। রাজা হাতের ইশারায় বললেন, ‘পড়ে যাও।’
কবি আশ্বস্ত হয়ে পড়ছেন বর্ষাঋতু – ‘মেঘের কত-যে রূপ! কোনো মেঘ যেন লেপ্টেযাওয়া/ কাজলের স্রোত। যেন অভিমানে ভিজেওঠা চোখ।’
টুকরো হেসে রাজা বললেন, ‘পঠিত 888sport app download apkয় অভিমানের কথা আছে, আকুতিও আছে। কিন্তু বিরহের কোনো বিভা তো দেখলাম না! কবি, তোমার দেখার চোখ তীক্ষè বটে, কল্পলোক 888sport slot gameে তুমি যথেষ্ট পারঙ্গম। তোমার বর্ণনায় প্রকৃতি নিখুঁত এবং অপরূপ হয়ে ওঠে। কিন্তু কবিবর, তুমি বিরহ নিয়ে 888sport app download apk কেন লিখছ না?’
‘মহারাজ, 888sport app download apk তো হৃদয় থেকে স্বতোৎসারিত। আকাশে মেঘ না-জমলে বৃষ্টি হয় না।’
‘তা বটে। তোমার হৃদয়-আকাশে কি কোনো মেঘ জমেনি?’
‘মাঝে মাঝে মেঘের শব্দ শুনি, দূরের আকাশে বিদ্যুৎরেখা, মিলিয়ে যায়। মানুষের জীবনে বিচ্ছেদের ঘটনা থাকে। কিন্তু সব বিচ্ছেদে বিরহ থাকে না।’
‘এ তো তত্ত্বকথা হয়ে গেল। আজ থাক। আবার কথা হবে।’
তিন
মহারাজ বিক্রমাদিত্য পশ্চিম ভারতের দুর্ধর্ষ শাসকদের পরাজিত করে রাজধানীতে ফিরছেন। উজ্জয়িনী এখনো কয়েক দিনের পথ।
গ্রীষ্মের কড়া রোদ। একটানা বেশিদূর চলা যায় না। খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রামের জন্য থামতে হয়।
আজ দুপুরে, নদীর ধারের একটা বনস্থানে রাজবহর আশ্রয় নিয়েছে। ভোজনপর্বশেষে যে-যার মতো আলাপচারিতা, গল্পগুজবে ব্যস্ত।
রাজ্যজয়ের এতো বড় আনন্দসংবাদের মধ্যেও রাজার মন ভালো নেই। গতকাল উজ্জয়িনী থেকে খবর এসেছে মহারানি কিছুটা অসুস্থ। অবশ্য রাজবৈদ্য বলেছেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, শিগগিরই তিনি সেরে উঠবেন। তবু সংবাদটা শোনার পর থেকে রাজাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে।
কবি সবসময় রাজার কাছাকাছিই থাকেন। ডাক পেয়ে সামনে এসে বসলেন। আগেই বলা ছিল, আজ কবি যেন বাল্মীকি রামায়ন থেকে পাঠ করেন। কোনো ভনিতা নয়, কবি শুরু করলেন – ‘দিবাকর নিশাকর দীপ্ত তারাগণ/ দিবানিশি করিতেছে তমো নিবারণ/ তারা নাহি হারিতে পারে
তিমির আমার/ এক সীতা বিহনে সকল অন্ধকার।’
রাজা কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে আছেন। একটু থেমে কবি আবার শুরু করলেন – ‘দশ দিক্ শূন্য দেখি সীতা অদর্শনে/ সীতা বিনা কিছু নাহি লয় মম মনে/ সীতা ধ্যান, সীতা জ্ঞান, সীতা চিন্তামণি/ সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী/ কান্দিয়া বিকল রাম জলে ভাসে আঁখি/ রামের ক্রন্দনে কান্দে বন্য পশুপাখি।’
কবির দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে আদি কবি বাল্মীকির শ্লোকগুলো নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাজার মুখে বিষাদের ছায়া, চোখে চিকন অশ্রুর আভাস।
‘দেখ রে লক্ষ্মণ ভাই, কর অন্বেষণ/ সীতারে আনিয়া দিয়া বাঁচাও জীবন’ –
রাজা ভেজাকণ্ঠে বললেন, ‘কবি, এ তো রামচন্দ্রের একার নয়, সকল বিরহী মনের চির হাহাকার।’
কবি টের পাচ্ছেন, নিজের মনও ভিজে উঠেছে। দু-মাস যায়। যুদ্ধ আর জয়ের উন্মাদনায় কাটছে। যুদ্ধযাত্রা কবির ভালো লাগে না। কিন্তু মহারাজ তো তাকে ছাড়া এক কদমও হাঁটেন না। প্রিয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে। রাজার চোখ এড়াল না। বললেন, ‘কবিবর, মনে কি মেঘ জমেছে?’
কবি মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘ভিজিল কি আঁখি?’
চার
বেশ চনমনে সকাল। প্রতিদিনের অভ্যেস। কবি এসেছেন, শিপ্রা নদীর ধারে, তার প্রিয় জায়গাটায়। সূর্যের উদয়টা বেশ স্বচ্ছই ছিল। কোনো সুদর্শনার হঠাৎ কটাক্ষ যেন – আকাশে বিদ্যুৎরেখা। মোষের পালের মতো ধাবমান মেঘ। শুরু হলো বৃষ্টি। আকাশ আর থামছেই না।
দ্রুত পা চালিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়া যেত। কিন্তু কবি একটা গাছের নিচে দাঁড়ালেন। ভিজছেন। যুবক যক্ষের কথা মনে এলো। রামগিরি পর্বতের কোনো নির্জনে কী করছে এখন? ওর আকাশে কি নবীন মেঘ জমেছে? নেমেছে কি বৃষ্টির ধারা? কবি যেন শুনতে পাচ্ছেন যুবকের বিপুল ব্যাকুল বিরহবিধুরধ্বনি – ‘হায় অলকাপুরী, পাষাণে গড়া, তবু তুমি পাষাণ তো নও। আমার বিরহী বাহুর মতো প্রিয়তমাকে আগলে রেখো।’
কবির মনে অজানা শূন্যতা এসে ভর করেছে – বিচলিত, ব্যাকুল। মেঘ তো শুধু প্রকৃতির ঘনজলের চঞ্চলতা নয়, বিরহের বার্তাবাহকও। কণ্ঠে তুলে দেয় শতজনমের কান্নার সুর। মগ্ন, বিস্মিত কবি বলে উঠলেন – ‘মেঘালোকে ভবতি সুখিনোপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ।’
আজ আর রাজদরবারে যাওয়া হবে না। কবি ঘরমুখো হলেন। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল মুগ্ধকর নানা দৃশ্য। বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ পেয়ে বসেছে অনেককে। সর্বত্র জলের খেলা। কোনো কোনো বাড়ির ছাদে যুবক-যুবতীরা কলহাস্যে মেতেছে, জানালার শিক গলে কেউ ছুঁয়ে নিচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। জোড়মেলানো পাখির মতো ভেজা শব্দে হেঁটে গেল দুজন। আজ নিশ্চয় ওদের বৃষ্টি-অভিসার!
সারাদিনই কেমন সন্ধ্যা-সন্ধ্যা দিন। কবি তার লেখার ঘরে। জানালা খোলা, উছলে পড়ছে বৃষ্টির মনোরম শব্দের ঢেউ। উজ্জয়িনীর এক কৃতী কারিগরের তৈরি বিশেষ নকশাকাটা কলমে লিখছেন – ‘জনেক যক্ষের কর্মে অবহেলা ঘটলো ব’লে শাপ দিলেন প্রভু,/ মহিমা অবসান, বিরহ গুরুভার ভোগ্য হ’লো এক বর্ষাকাল;/ বাঁধলো বাসা রামগিরিতে, তরুগণ স্নিগ্ধ ছায়া দেয় যেখানে এবং জলধারা জনকতনয়ার স্নানের 888sport sign up bonus মেখে পুণ্য।’
যক্ষের বিরহগাথা এভাবেই শুরু।
নির্বাসিত যুবকটির মনে বিচ্ছেদ-বেদনা জাগিয়ে দিলো আষাঢ়ের প্রথম দিনের মেঘ। দিন কাটে তো রাত কাটে না। প্রতিটি মুহূর্ত যেন বিরহ-বিষে জর্জরিত এক-একটি পাথর হয়ে চেপে আছে বুকে। এখনো চার মাস বাকি। কার কাছে বলি আমার এ-বেদনার বয়ান? বলি-না মেঘের কাছে! শুনেছি, জলভরা মেঘ হচ্ছে তাপিতের আশ্রয়। দুহাত প্রসারিত, যুবকের কণ্ঠে কাকুতিধ্বনি, ‘হে মেঘ, তোমার কাছে আমি প্রার্থী। যক্ষের অলকাপুরীতে এক বিরহিণী অপেক্ষায় আছে। তার কাছে আমার তাপিত হৃদয়ের বার্তা পৌঁছে দিও।’
কোন পথ গেছে অলকাপুরীর পথে? মেঘের যাতে কষ্ট না-হয়, বিরহী যুবক বাতলে দিচ্ছে সব চিহ্নরেখা, ‘পেরিয় হিমালয়তটের বিস্ময়, হংসদ্বার পাবে সমুখ,/ ক্রৌঞ্চরন্দ্র সে, পরশুরাম যাতে যশের পেয়েছেন পন্থা -/ দীর্ঘ, তির্যক তুমিও সেই পথে আবার উত্তরে চলবে,/ শোভন যেন শ্যাম চরণ বিষ্ণুর, সমুদ্যত বলিদমনে।’
এ-পর্যন্ত লিখে কালিদাস থামলেন। নিজের মনে জমেওঠা মেঘ প্রবাহিত করতে পেরেছেন বিরহী যক্ষের মেঘস্বরে। আরো তৃপ্ত, তার কলমে আষাঢ়ের নবীন মেঘ হয়ে উঠেছে যক্ষের প্রতিরূপ; পৌরুষে প্রদীপ্ত, কামুকতায় উন্মুখ।
পথে যেতে যেতে ক্লান্ত হলে মেঘের বিশ্রামস্থান হবে পর্বতচূড়া। 888sport promo codeতে প্রকৃতি বিরাজমান। পর্বত হচ্ছে 888sport promo codeর স্তনের প্রতিরূপ। ‘… তুমি আরূঢ় হলে শৃঙ্গে -/ দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমর মিথুনে ভোগ্য, গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পাণ্ডুর ছড়ানো।’
মেঘেরও তৃষ্ণা থাকে। পথে পথে সে নদীতে নেমে আসবে। কোনো নদীর ঢেউ কামিনীর ভ্রুভঙ্গির মতো বাঁকা, কারো জলের আবর্ত যেন নগ্নিকার বর্তুল নাভি, ফেনারাশি চুমুর উচ্ছ্বাস।
বিরহকাতর হলে নদী হয় কৃশ। যখন আসে নতুন জোয়ার, নদীর বুকে বয়ে যায় রতিবাসনার স্রোত।
সম্ভোগে মেঘ যেমন তৃপ্ত হয়, নদীরও হয় বাসনামোচন।
কবি লিখলেন মেঘ। যক্ষ আছে – লিখলেন বিরহের নতুন যাপন। * উদ্ধৃত কোনো কোনো 888sport app download apkংশ বুদ্ধদেব বসু-অনূদিত কালিদাসের মেঘদূত থেকে নেওয়া।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.