কলের গানের গল্প

স নাতন ধর্ম বলে নাদই ব্রহ্ম : জগজ্জীবন শুরু হয়েছে শব্দে, শেষও হবে শব্দে। মানুষও জন্মমাত্র শব্দই করে প্রথমে। অথচ শব্দধারণ করতে শিখেছে সে মাত্র শতাধিক বছর পূর্বে। তাই সার্ধশতাধিক বছর আগের নিধুবাবু-দাশুরায়দের গাওয়া গান আমরা তাঁদের কণ্ঠস্বরে শুনতে পাই না। কিন্তু বহুশত বছর আগের লেখকদের লেখা আমরা তাঁদের হস্তলিপিতে পড়তে পাই। কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের (১৭২০-৮১) স্বহস্তলিখিত ‘কালী কীর্তন’ কাব্যের বাণী মুদ্রিত পাই, তাঁর স্বকণ্ঠগীত ‘রামপ্রসাদী’ গানের ধ্বনি মুদ্রিত পাই না।

ধ্বনিধারণমুদ্রণ-প্রযুক্তির অনস্তিত্বহেতু, সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) সভাসদ্ ছাড়া সংগীতসম্রাট তানসেনের দৈবকণ্ঠ তাঁর স্বকালেরও আমজনতা শুনতে পায়নি – যাঁর কণ্ঠের সামান্য প্রসাদ লাভের আশায় আজকের গায়কও ওই কালজয়ী সংগীতনায়কের কবরলগ্ন তেঁতুল গাছের পাতা চিবোয়।

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মহান 888sport live chatী দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯), মিকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪), রাফায়েলের (১৪৮৩-১৫২০) ‘দ্রষ্টব্য’ 888sport live chatকর্মের মূলকপির দর্শন সম্ভব আজও। প্রতিপক্ষে তাঁদের সমান মহান 888sport live chatী, অনেক কাল পরের, বাক (১৬৮৫-১৭৫০), মোৎসার্ট (১৭৫৬-৯১), বেটোফেনের (১৭৭০-১৮২৭) ‘শ্রোতব্য’ 888sport live chatকর্মের মূল ভার্শানটির শ্রবণ তাঁদের স্বকালেও অনুপস্থিতজনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তেমনি আরো পরের ‘ভার্টুয়োসো’ পিয়ানো888sport live chatী হাঙ্গেরিয়ান জিনিয়াস ফ্রান্ৎস্ লিৎস্ট (১৮১১-৮৬) কিংবা পোলিশ ‘বিস্ময়’ ফ্রেডরিক শোপ্যাঁর (১৮১০-৪৯) দৈববাদন কনসার্ট-হলে উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী ছাড়া কেউ শুনতে পায়নি এবং পাবেও না কোনো কালে।

আজ ভাবতেও শিউরে উঠতে হয় যে, এই সেদিন পর্যন্ত মহত্তম সাংগীতিক ধ্বনিটিও সৃষ্ট হওয়ামাত্রই হারিয়ে যেত চিরতরে, বায়বীয় বলে। তাই ধ্বনিকে ধরে রাখার টকিং-মেশিন উদ্ভাবিত হওয়ামাত্রই মানবজাতির মতি লিপি থেকে ধ্বনিমুখী হয়ে চলেছে – যেন সর্বঅঙ্গকর্ণ হয়ে, যেন প্রেমসংশয়ে আকুল হয়ে, যেন চির পলায়নপর প্রিয়বরকে ধারণ করে রাখতে পারার পুঞ্জিত আবেগে ব্যাকুল হয়ে। পরিবর্তনটির গতি এতই দ্রুত যে, ইতোমধ্যেই লিপিসংস্কৃতির বহু মৌরুসী জমি দখল করে নিচ্ছে ধ্বনিসংস্কৃতি।

আসলে এটি পরিবর্তন নয়, এ হলো বস্তুত পালাবদল। কারণ আদ্যকাল থেকে প্রাধান্য ছিল শব্দেরই, যে-শব্দ উচ্চারিত হতো মন্ত্ররূপে, জাদুরূপে। মন্ত্ররূপে উচ্চারিত শব্দের ছিল সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছে আরাধ্যের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করার অপ্রতিরোধ্য শক্তি, সংগীতেরই মতো। এ-কারণেই ঊনবিংশ শতকের শেষ পুরুষের ইউরোপীয় প্রতীকীবাদী কবিগণ বাস্তবকে এড়িয়ে অধিবাস্তবে পৌঁছুনোর জন্য শব্দকে তার আদিম মন্ত্রশক্তি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁদের কাব্যে Ñ যে-শক্তির উৎস রয়েছে শ্রবণীয়ে, বচনীয়ে নয়। এ-দুয়ের মধ্যে শক্তির প্রথম পালাবদল ঘটিয়েছিল লিপির উদ্ভব।

লিপির চিত্রিত পর্বত থেকে মুদ্রিত পত্রে পৌঁছানোর যাত্রাকাল ধরা হয় দশ হাজার বছরের ওপর। মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার লিখিত 888sport live footballের বয়স সাড়ে পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি। গুটেনবার্গ থেকে মুদ্রিত 888sport live footballের বয়সও হয়ে গেল প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর। এত দীর্ঘ কালসীমাতেও ধ্বনিধারণ এবং মুদ্রণবিদ্যার অবিদ্যমানতাহেতু ধ্বনিনির্ভর সংগীত888sport live chatের সঞ্চয় পুঞ্জিত হতে পারেনি। এ-কারণেই দুই শতাধিক বছর পূর্বেকার স্যর উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬-৯৪) তাঁর মিউজিক্যাল মোড্স অভ দ্য হিন্দুজ (১৭৮৪) পুস্তকে বলে বসেছিলেন যে, কাব্যের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসার যোগ্যতাই নেই সংগীতের। ডক্টর জোন্সের সেই উদ্ভ্রান্ত উক্তিটির বয়স শত বর্ষ পূর্ণ না হতেই সংস্কৃতির পরবর্তী পালাবদলটি ঘটিয়ে ফেলল ধ্বনির ধারণ ও মুদ্রণপ্রযুক্তির উদ্ভব।

 সেই থেকে ধ্বনিসংস্কৃতির মাত্র একশ বছরের দাপটেই আজকের বিশ্বনাগরিক পাঠ্য পড়ছে কম, শ্রাব্য শুনছে বেশি। শত বছর আগের মতো অত লোক আজ আর কাল কাটায় না লিপিসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানে, বরং রাত কাটায় ধ্বনিসংস্কৃতির অনুষ্ঠানে, পাওয়ার-স্পিকার প্রকম্পিত মুক্তাঙ্গনে। সেখানে গোষ্ঠীগানের ক্রমবর্ধিষ্ণু উন্মাদনে সর্ববয়সী মনুষ্য আজ উন্মাতাল হয় সমানে। শত বর্ষ পূর্বের প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের প্রিয়জনকে উপহার দিত বইপুস্তক, র‌্যাপিং পেপারের ওপর প্যাঁচানো রঙিন ফিতার পুষ্পিত বন্ধনসংবলিত। তার বদলে আজ নিবেদিত হচ্ছে জমাট-বাঁধা ধ্বনিরহস্যময় অ্যালবাম Ñ ভিসিডির, ডিভিডির – নজরকাড়া এবং মনকাড়া যতসব রোমাঞ্চকর রঙিন চিত্রসংবলিত। সেকালের পুস্তকের র‌্যাকে সজ্জিত সারিবদ্ধ গ্রন্থরাজিকে বেদখল করে স্থান নিয়ে নিচ্ছে একালের কমপ্যাক্ট ডিস্ক কিংবা ডিজিট্যাল ডিস্ক। ফলে পারিবারিক গ্রন্থাগারের বদলে আজ ঘরে-ঘরে স্থাপিত হচ্ছে ধ্বনিসংস্কৃতির লেটেস্ট ক্রেজ ‘ডিজিট্যাল হোম থিয়েটার’ কিংবা ‘পার্সনাল মিউজিক সিস্টেম’ – হাইফাই ধ্বনিধারণমুদ্রণ-প্রযুক্তির টপ-অভ-দ্য-লাইন উপাঙ্গ-উপাদান সমৃদ্ধ। এ যেন এক বিস্ফোরণ-প্রবাহ, সাংগীতিক ধ্বনির। এ যেন এক শতাব্দীব্যাপী লাগাতার সংগীতবিপ্লব।

এহেন সংগীতবিপ্লবের প্রধান কারণ সাউন্ডরেকর্ডিং টেকনলজি কিংবা ধ্বনিধারণ-প্রযুক্তির উদ্ভব তো বটেই Ñ তবে অন্য একটি কারণও অপ্রধান নয়। কারণটি আধুনিক জীবনধারার উপজাতক। সাম্প্রতিক জীবনের বেসামাল গতি, বিহ্বল প্রকৃতি, রুদ্ধশ্বাস তাল, ভোগাসক্ত মানুষের ভোগান্ত-ক্লান্তি, সর্বাত্মক প্রতিযোগিতার বিরামহীন চাপ – ইত্যাদি-প্রভৃতির ক্রমপুঞ্জিত টেনশন সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারে একমাত্র সাংগীতিক শ্রবণ, সে সক্রিয় হোক কি নিষ্ক্রিয়। কেবল সংগীতই পারে তার নিজস্ব চালিকাশক্তি দিয়ে ক্লিষ্ট চিত্তটিকে যথেষ্ট উদ্দীপ্ত করে নিতে। তাই পরিশ্রান্ত মনে সহজতর 888sport live footballের চেয়ে দুরূহতর সংগীতের উপভোগও অধিক প্রত্যাশিত। কারণ এই চারু888sport live chatটি মনকে না-খাটিয়েই প্রাণকে মাতিয়ে তুলতে পারে। প্রতিপক্ষে বই পড়ার সময় মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় বসে থেকে তেমন বিশ্রাম নিতে পারে না। একই কারণে ধ্বনিধারণ-প্রযুক্তির অনেক অগ্রসর উপহার সিডিরমবাদিত কাব্য-নাট্য-গল্প-888sport alternative linkও পারে না ধ্বনিমুদ্রিত সংগীতের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে। কেননা ধ্বনিধৃত 888sport live football-শ্রবণের সমান্তরাল ক্রিয়া হিসেবে অন্য কোনো কর্মই যুগপৎ সম্পাদন করা চলে না, যেমন চলে গান শোনার পাশাপাশি।

বড় আরেকটি যুগোপযোগী বৈশিষ্ট্যও আছে সংগীতের। এই সুকুমার 888sport live chatটি যে-কোনো চারু888sport live chatের তুলনায় অধিক গণতান্ত্রিক। শ্রোতাকে ব্যষ্টির বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসিত করে না সংগীতশ্রবণ, যেমন করে পুস্তকপঠন। গান শোনা চলে দলেবলেও। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিংবা আবহসংগীত, যা কর্মের সহায়ক পটভূমি রচনা করে। আরেক উদাহরণ ওয়ার্ক-সঙ্ বা কর্মগান, যা কর্মীগণ নিজেরা করে কর্মকালে প্রাণিত থাকেন। তাই অন্দরে-সদরে-হাটে-মাঠে-বাটে-ঘাটে Ñ যেখানেই যতক্ষণ মানুষ জাগে, সেখানেই ততক্ষণ সংগীত বাজে।

মুদ্রিত সুরধ্বনি সম্প্রতি সর্বত্র এবং সর্বথা সঞ্চরমাণ থাকার কারণে সংগীত ইদানীং শ্রমের ও বিশ্রামের, উভয়েরই সমান সঙ্গী। বিশেষ করে, মানুষ যখন ফুরিয়ে গিয়ে ঘরে ফেরে তখন সংগীতের অন্তর্গত সম্মোহ তার স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতার বলে জীবন্মৃতকেও জীবন্ত করে তোলে। এ-888sport live chatটি বলে তাৎক্ষণিক এবং বলেও অধিক। তাই বিশ্ব জুড়ে মিউজিকের সঙ্গে গণমানুষের সম্পর্ক আজ একান্তই আধার আর আধেয়ের। ধারণ-মুদ্রণ-বিপণন-বাদনের ভোক্তা-সখা প্রযুক্তির সুবাদে সংগীত এখন সকলেরই প্রথম প্রণয় এবং পরম আশ্রয়। আজকের অশান্ত সমাজের যা কিছু সান্ত্বনা, তা যেন শুধু সংগীতের কাছেই পাওয়া। মোদ্দা কথা : চতুর্মুখী অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার টানটান টেনশান-শাসিত জনসাধারণের এই বিপজ্জনক বিশ্বে গণসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুটি আজ স্থানান্তরিত হয়েছে সংগীতেরই স্বস্তিকর অঙ্গনে।

সংগীতকে আমাদের নিত্যসঙ্গী করে তোলার পেছনে প্রথম এবং প্রধান অবদান যার, সে হলো কলের গান। উল্লেখ্য যে, ‘কলের গান’ শব্দবন্ধটির অর্থ কল-পরিবেশিত গান নয়, গানের রেকর্ডও নয় Ñ গান-পরিবেশক যন্ত্র, রেকর্ড-প্লেয়ার, একশব্দে গ্রামোফোন। বিংশ শতকের প্রথম বিস্ময়রূপে ১৯০১ সালেই এদেশে এসেছে গ্রামোফোন কম্প্যানি। প্রথম ধ্বনিধারণের মাধ্যমে ১৯০২ সালেই সূচিত হয়েছে, অদ্যাবধি অপ্রতিহত, আমাদের সকলের প্রিয় কলের গানের জয়যাত্রা। তাই আমি গ্রামোফোনের উদ্ভাবন ও এর বিস্ময়কর বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত ধারাবিবরণী দিয়েই এই লেখাটি শেষ করতে চাই।

টকিং-মেশিন কিংবা সবাক যন্ত্রে মনুষ্যকণ্ঠ প্রথম রেকর্ড করেন ‘উইজার্ড অভ মেন্লো’ নামে পরিচিত টমাস আল্ভা এডিসন, ১৮৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে। তাঁর ২৯ নভেম্বরে আঁকা ডিজাইন-অনুযায়ী যন্ত্রটি তৈরি করেন এডিসনের টেকনিশিয়ান জন ক্রুয়েসি, নিউইয়র্কের ২৫ মাইল দূরে মেন্লো পার্কে অবস্থিত প্রযুক্তি-জাদুকরের ‘দি ইনভেনশন ফ্যাক্টরি’তে। ক্রুয়েসি যন্ত্রটির নির্মাণ ব্যয় হিসাব করেন ১৮ ডলার এবং যন্ত্রের গায়ে লিখে রাখেন ‘দিস্ শুড টক্’।

কলের কথার প্রথম শ্রোতা হিসেবে এডিসন স্বকণ্ঠে শুনেছিলেন কিছুক্ষণ পূর্বে তাঁর উচ্চারণ করা নার্সারি রাইম :

Mary had a little lamb, its fleece was white as snwo / And everywhere that Mary went, the lamb was sure to go.’ ১৮৭৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফটির পেটেন্ট পেয়ে এডিসন নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখেন : ‘The machine does not have much value’.

যেমনি লিখেছিলেন তেমনি মেশিনটিকে তিনি ভুলেও ছিলেন পরবর্তী দশটি বছর। সম্ভবত তাঁর প্রদর্শিত টকিং-মেশিনটির উন্নয়নকল্পে নানান প্রযুক্তিবিদের নানাবিধ প্রচেষ্টার সংবাদ শুনেই এডিসন ১৮৮৮ সালে একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা নিদ্রাহীন কাজ করে একটি উন্নততর টকিং-মেশিন বানালেন এবং ফোনোগ্রাফ কম্প্যানিও প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু সবাকযন্ত্রটির বাণিজ্যিক ক্ষমতা কিংবা বিনোদন-সামর্থ্য অথবা স্বর-সংরক্ষণের সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার কথা এডিসনের উদ্ভাবনপ্রবণ মস্তিষ্কে এল না। অথচ তাঁর সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফেই সংরক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, টেনিসন ও ব্রাউনিঙের কবিকণ্ঠ এবং কম্পোজার ব্রাম্সের বাজানো একটি হাঙ্গেরীয় র‌্যাপ্সডি।

ইন্ডিয়ান রেকর্ড কালেক্টারস সোসাইটির বর্ষপত্র দ্য রেকর্ড নিউজ-এর ১৯৯৯ সালের বর্ষপত্রে প্রকাশিত অমিতাভ ঘোষের বিবরণে এবং ২০০২ সালে ‘ইন্ডিয়ান গ্রামোফোন রেকর্ডস’-এর শতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে লিখিত সমিতিটির সম্পাদক সুরেশ চাঁদভানকার-এর দ্য ফার্স্ট হান্ড্রেড ইয়ার্স-অনুশীর্ষক রচনায় সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফের উপমহাদেশীয় কিছু তথ্য দ্রষ্টব্য। যন্ত্রটি কলকাতায় প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৮৭৮ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ – অর্থাৎ আবিষ্কারের এক বছরের মধ্যেই। টকিং-মেশিনের উপমহাদেশে নিয়োজিত প্রথম এজেন্ট ‘মহারাজ লাল অ্যান্ড কোং’ ভারতবর্ষে সিলিন্ডার-রেকর্ড বিক্রয় শুরু করে ১৮৯৫ সালে। নলের আকৃতি বিধায় লোকে রেকর্ডটিকে বলত ‘চুড়ির সারি’ আর সে-রেকর্ডের গানকে বলত ‘চুড়ির শব্দ’।

কলকাতার প্রথম ফোনোগ্রাফ-ব্যবসায়ী ছিলেন ‘দেলখোশ’ সেন্ট এবং ‘কুন্তলীন’ কেশতেল-খ্যাত সুরভি-ব্যবসায়ী প্রফেসর হেমেন্দ্র মোহন বসু। তিনি সিলিন্ডার-রেকর্ড বিপণন করেছিলেন ঐ. ইড়ংব জবপড়ৎফং ব্যানারে। তাঁর ১৯০৬ সালের ক্যাটালগে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি সিলিন্ডার-রেকর্ডের উল্লেখ ছিল। কবিকণ্ঠে গীত সেই কলের গানগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘বন্দে মাতরম’ ছাড়া সবই আজ বিলুপ্ত।

সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফসহ সিলিন্ডার-রেকর্ড কার্যকর অবস্থায় কোনো সংগ্রাহকের কাছে আছে বলেও এখন আর শোনা যায় না। সেসবের ভগ্নাবশেষই কেবল অ্যান্টিক হিসেবে পড়ে আছে কোনো কোনো মিউজিয়ামে কিংবা আরকাইভে। অথচ ১৯১০ সালে দুই-পেশে ফ্ল্যাটডিস্ক রেকর্ড বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্তও সিলিন্ডার-রেকর্ড বাজারে চালু ছিল। তবে প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, এডিসন কিন্তু তাঁর আবি®কৃত ফোনোগ্রাফ ব্যাপক হারে ছাঁচে-ঢালা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গণ-উৎপাদন করতে পারেননি কিংবা চাননি। তাঁর তেমন ব্যবসা-প্রতিভা ছিল না বলেই মনে হয়। সে-প্রতিভা ছিল গ্রামোফোন-উদ্ভাবক এমিল বার্লিনারের। তাঁকে আসলে বিজনেস-জিনিয়াসই বলা চলে। এবার তাঁর কথাই বলা যাক। কেননা, তাঁর কথাই আমাদের কলের গানের কথা।

১৮৭৭ সাল থেকে পরবর্তী দশ বছরে এডিসন-উদ্ভাবিত টকিং-মেশিনের গরম খবর সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে এবং যন্ত্রটির প্রতি অনেক তরুণকেই আগ্রহী করে তোলে। তেমনি এক উৎসাহী তরুণ ছিলেন ওয়াশিংটন সিটির বাসিন্দা বিশ বছর বয়সী এমিল বার্লিনার, জার্মানির হ্যানোভার থেকে আসা অভিবাসী। ১৮৮৭ সালে তিনি উদ্ভাবন করেন সম্পূর্ণ ভিন্নজাতের টকিং-মেশিন। বেলনাকার রেকর্ডের বদলে চাকতিসদৃশ চ্যাপটা আকৃতির রেকর্ডসংবলিত ছিল এই ফোনোগ্রাম। ‘ফোনোগ্রাম’ শব্দটিকে উলটিয়ে বার্লিনার তাঁর সবাকযন্ত্রের নাম রাখেন ‘গ্রামোফোন’ এবং এই নামে তিনি সে-বছরই মেশিনটির পেটেন্ট পান। গ্রামোফোনের রেকর্ডে পুনর্বাদিত কথার প্রথম শ্রোতা হিসেবে তিনি শুনেছিলেন নিজের কণ্ঠের ভাঙা ভাঙা ইংরেজি উচ্চারণে :

Twinlke twinkle little star

Hwo I wonder what you are

মনুষ্য-উচ্চারিত শব্দের যান্ত্রিক পুনর্বাদন শোনামাত্রই এই জার্মান ‘ভুন্ডার কিন্ট্’ নির্ভুল বুঝে ফেলেছিলেন গ্রামোফোনের ব্যবসা-সম্ভাবনা। এমনকী গায়কদের গান রেকর্ড ও মার্কেট করে সাউন্ড-রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রির পথিকৃৎ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি অনতিবিলম্বেই। ক্ষণজন্মা এই ক্ষুদে উদ্ভাবককে ব্যবসারও ‘বিস্ময় বালক’ বলতে হবে, তাঁর পরবর্তী কর্মপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে। ১৮৮৮ সালের মে মাসের ১৬ তারিখে তিনি তাঁর সবাকযন্ত্রের উন্নততর মডেল প্রদর্শন করেন এবং ফ্ল্যাট ডিস্ক গ্রামোফোন কেন সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফের চেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় এক উৎকৃষ্টতর কৌশল, সেটি ব্যাখ্যা করেন। বস্তুত তিরিশ আর.পি.এম ও সাত ইঞ্চি ব্যাসের দুই মিনিট মেয়াদি একপেশে চ্যাপটা চাকতি রেকর্ড-সংবলিত, ফ্র্যাংকলিন ইনস্টিটিউটে প্রদর্শিত, এই মডেলটিকেই গ্রামোফোন বা কলের গানের প্রোটোটাইপ বা আদিরূপ বলে গণ্য করা যায়। প্রদর্শিত রেকর্ডের মাপটি আটাত্তর আর.পি.এম রেকর্ডেরই মাপ – তেত্রিশ ও পঁয়তাল্লিশ আর.পি.এম রেকর্ডের মাপ এর চেয়ে যথাক্রমে বড় এবং ছোট। ছোট এই ফ্ল্যাট ডিস্ক রেকর্ডটির চেয়ে বেশি ছোট নয় হালের কমপ্যাক্ট ডিস্ক এবং ডিজিট্যাল ডিস্ক। ভাবতে অবাক লাগে যে, আজকের লেটেস্ট অপটিক্যাল পদ্ধতির রেকর্ড সিডি-ডিভিডিও ফ্ল্যাট ডিস্কের আবিষ্কারক বার্লিনারের মেকানিক্যাল পদ্ধতির রেকর্ডের আদিরূপেরই প্রতিরূপ। মধ্যবর্তী ম্যাগনেটিক পদ্ধতির যুগটিই যেন অন্ধকার যুগ – মধ্যযুগের মতোই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, সিলিন্ডার-রেকর্ড-আবিষ্কারক এডিসনও হার স্বীকার করে সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফ ছেড়ে ডায়মন্ড-ডিস্ক রেকর্ড ও প্লেয়ার বিক্রি শুরু করেন ১৯১৩ সাল থেকে।

এমিল বার্লিনারই প্রথম গণউৎপাদন-পদ্ধতিতে ব্যাপকভাবে রেকর্ড কপি করতে সক্ষম হন – জিংক বা দস্তার মাস্টার ডিস্ক থেকে শক্ত রাবারের ওপর। ১৮৯৩ সালে তিনি গ্রামোফোন কম্প্যানি প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকায়। সহকারী ফ্রেডরিক উইলিয়াম গেইসবার্গকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী তিন-চার বছরের মধ্যেই বার্লিনার তাঁর মেশিনে মোটর, ¯িপ্রং ইত্যাদি জুড়ে দেন, অসংখ্য রেকর্ড কপি করার সহজ পদ্ধতি বের করেন এবং বহু ফাইন্যান্সার ও রেকর্ডিং-আর্টিস্ট যোগাড় করে বিশাল এক অডিও-ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলেন। দ্রুত বর্ধিষ্ণু চাহিদা দেখে তিনি তাঁর ভাগ্নে জো স্যান্ডার্সকে স্বদেশে পাঠিয়ে তার মাধ্যমে হ্যানোভারে একটি রেকর্ড-কপিং বা প্রেসিং প্লান্ট স্থাপন করেন। যথাসময়ে ইউরোপের বাজার হাত করার জন্য বার্লিনার গেইসবার্গকে লন্ডন পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে তিনি ১৮৯৮ সালেই গ্রামোফোন-রেকর্ডিং শুরু করেন। ১৮৯৯ সালে লন্ডনেই প্রথম রেকর্ড করা হয় এই উপমহাদেশের দুই নাগরিকের কণ্ঠ – জনাব কারী আহমেদের কণ্ঠে কোরান শরীফের আয়াত আর ডক্টর হরনাম দাসের কণ্ঠে রামায়ণের গান।

গ্রামোফোন কম্প্যানি কলকাতায় শাখা খোলে ১৯০১ সালে। উপমহাদেশের বাজার কব্জা করার জন্য বার্লিনার গেইসবার্গকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন স্থানীয় 888sport live chatীদের গান রেকর্ড করার উদ্দেশ্যে। ১৯০২ সালে কলকাতায় এসেই গেইসবার্গ রেকর্ডিং শুরু করেন তদানীন্তন সংগীতসম্রাজ্ঞী গহরজানকে দিয়ে – শতবর্ষ পরেও যিনি উপমহাদেশীয় সংগীতের অবি888sport app download for androidীয়  কিংবদন্তি। এর পরে ১৯০৮ সালের মধ্যে আরো দুবার ভারতবর্ষে এসে গেইসবার্গ তিন দফায় মোট পাঁচ হাজার গান রেকর্ড করেন। অন্য কথায় বলা যায় : গ্রামোফোন উদ্ভাবন করেছেন বার্লিনার আমেরিকায়। সেটিকে ভারতবর্ষে এনে এদেশে কলের গানের যুগ প্রবর্তন করেছেন তাঁর সহকারী গেইসবার্গ।

প্রথম দিকে রেকর্ড কপি করার জন্য কলকাতা থেকে মাস্টার কপি পাঠিয়ে দিতে হতো হ্যানোভারে, বার্লিনারের ভাগ্নে স্যান্ডার্সের কারখানায় – এদেশে রেকর্ড-প্রেসিং কারখানা ছিল না বিধায়। এতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল রেকর্ডের লেবেলে 888sport live chatীদের নাম ছাপার ব্যাপারে। জার্মান টেকনিশিয়ানরা বুঝতে পারত না কোন রেকর্ডে কোন নামটি ছাপতে হবে। এ-সমস্যার সমাধানকল্পে গানের শেষে 888sport live chatীকে নিজের নামটিও রেকর্ড করে দিতে হতো, ইংরেজিতে ঘোষণা করে – যেমন, ‘আই অ্যাম মন্তা ঘোষ, ‘মাই নেম ইজ বেদানা দাসী’। জার্মানি থেকে রেকর্ডগুলো বাজারের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আসত বলে রেকর্ডের গায়ে লেখা থাকত ‘মেড ইন জার্মানি’।

ইতোমধ্যে মাস্টার রেকর্ডের মাধ্যম জিংক কিংবা দস্তা থেকে ওয়াক্স অথবা মোমে উন্নীত হলো। কপির মাধ্যমও হয়ে গেল লাক বা গালা। বিশ্বের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ গালা মধ্যপ্রদেশসহ বঙ্গ-বিহার অঞ্চলে উৎপাদিত হতো বলে ১৯০৮ সালেই রেকর্ড-প্রেসিং প্লান্ট স্থাপিত হলো কলকাতার শিয়ালদহে। কেবল হারমোনিয়ম-বাজনা-সহযোগে গাওয়া হতো বলে লোকমুখে গানের কারখানাটির নাম হয়ে যায় ‘বাজাখানা’। দাওয়াখানা-ছাপাখানার মতো ওটি যেন বাজনার জিমখানা। রেকর্ড কপি করার এই স্থানীয় ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই মাস্টার কপি জার্মানি প্রেরণ করা এবং রেকর্ডে 888sport live chatীদের নাম ঘোষণা করার ঝামেলাগুলো দূর হলো।

গ্রামোফোন রেকর্ড বলতেই তার ওপরকার প্রভুর সংগীত শ্রবণরত কুকুরের যে-ছবিটি আমাদের মনের মুকুরে ভেসে ওঠে, সেটি অঙ্কন করেছেন ফ্রান্সিস ব্যারড। ‘His Master’s Voice’-এর অ্যাক্রনিম ঐগঠ লোগো হিসেবে ব্রিটেনে চালু হয় ১৯০৯ সালে এবং উপমহাদেশে প্রবর্তিত হয় ১৯১৫ সালে।

সাউন্ড-রেকর্ডিং টেকনলজি কিংবা শব্দধারণ-প্রযুক্তির উন্নতির গতি অত্যন্ত দ্রুত। কলের গানের ‘মেকানিক্যাল এরা’ শেষ হয়ে যায় ১৯২৫ সাল নাগাদ এবং প্রবর্তিত হয় কার্বন-মাইক্রোফোন সংবলিত ‘ইলেকট্রিক্যাল এজ’। ধ্বনি888sport live chatের ইতিহাসে ১৯৩১ সালটি যেন একাই একশ। এই সালেই উপমহাদেশের সিনেমা হয়ে গেল টকি। অর্থাৎ সবাক হয়ে গেল live chat 888sport। অবিলম্বে টকিকে সমৃদ্ধ করল প্লে-ব্যাক এবং শুরু হলো কলের গানের স্বর্ণযুগ। এ-বছরেই গ্রামোফোন কম্প্যানি আর কলম্বিয়া কম্প্যানি মার্জ হয়ে নাম নিল Electrical and Musical Industries – সংক্ষেপে EMI। একই বছর জার্মানি আবিষ্কার করল ‘ম্যাগনেটিক টেপ’, হাত দিল টেপ-রেকর্ডার-নির্মাণের কাজে এবং সেদেশে সেটি চালুও হয়ে গেল চল্লিশের দশকের শুরুতে। ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে কর্তব্যরত মার্কিন সিগন্যাল কোরের এক ক্যাপ্টেন দুটি টেপরেকর্ডার আর ৫০ রিল টেপ পাঠিয়ে দিল স্বদেশে। সেই সুযোগে মার্কিন টেপ-রেকর্ডারও নির্মিত হয়ে গেল ১৯৪৮ সাল নাগাদ, অর্থাৎ একই দশকের পরিসরে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী দশটি বছরের মধ্যেই অ্যাম্পলিফায়ার, স্পিকার ইত্যাদির বিপুল বিবর্তন হাই-ফাই যুগের সূচনা করল উচ্চবিত্ত সমাজে। এর ‘ডেমন্স্ট্রেশন ইফেক্ট’ বা প্রদর্শনী-প্রভাবে আক্রান্ত হলো উচ্চ মধ্যবিত্তের সংসারও। সংক্রামক জ্বরের মতো ছড়িয়ে পড়ল প্রতিযোগিতামূলক ‘ড্রয়িং রুম কালচার’। এতে ইন্ধন যুগিয়ে চলল গ্রুন্ডিক্-টেলিফুঙ্কেন-মার্ফি-আর.সি.এ ইত্যাদি অভিজাত ব্র্যান্ডের পারস্পরিক প্রতিযোগিতাও। একটি পরিবারে স্টেটাস-সিম্বল হয়ে দাঁড়াল এর বৈঠকখানায় প্রদর্শিত রেডিওগ্রামটি। রেডিও আর গ্রামোফোনের সুশোভন এই কম্বিনেশনের সঙ্গে অচিরেই যুক্ত হলো টেপরেকর্ডার। ঘরের ‘বেস্ট পিস অভ ফার্নিচার’ হয়ে উঠল এই অডিও-সিস্টেমের ক্যাবিনেটটি। কিন্তু বৃহদাকার এই ‘মর্যাদার প্রতীক’টিকে তো বহন করে বাইরে নেওয়া যায় না। অতএব এর বাইরের প্রতিরূপটিও হাতে এসে গেল অনতিবিলম্বে – পোর্টেবল ট্রানজিস্টার টেপ প্লেয়ার ও রেকর্ডার। স্ট্র্যাপযুক্ত ব্যাগবাহিত হ্যান্ডি এই মিউজিক-সিস্টেমটি মানুষের দোসর হয়ে উঠল কর্মক্ষেত্রেও। অনতিপরে ওয়াকম্যান হয়ে লোকের পকেটে ঢুকে এটি সর্বক্ষেত্রেই হয়ে উঠল অনেকেরই নিত্যসহচর। এ-কাহিনী অতি দীর্ঘ। অতএব কাভার-স্টোরিতেই ফেরা যাক, কলের গানের গল্পে।

দুপাশে মোট সাত মিনিটের দুটি গানের আটাত্তর আরপিএম রেকর্ডের বিদায়-ঘণ্টা বাজিয়ে ই.এম.আই ১৯৫২ সালে বাজারে নিয়ে এল দুপাশে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বারোটি গানের রেকর্ড তেত্রিশ আরপিএম লং প্লে, সংক্ষেপে এল.পি.। উপমহাদেশে কলের গানের ভাগ্যনিয়ন্তা এই কম্প্যানিটি ১৯৫৪ সালে ছাড়ল ভাইনিল্ বা প্লাস্টিক রেকর্ড – পঁয়তাল্লিশ আরপিএম এক্সটেন্ডেড-প্লে, সংক্ষেপে ই.পি.। ১৯৫৮ সালে বিপণিত হলো স্টেরিও এল.পি। দমদমে স্থাপিত উপমহাদেশের প্রথম এলপি প্লান্টটি ১৯৫৯ সালে উদ্বোধন করলেন পণ্ডিত রবিশংকর।

এদেশে ম্যাগনেটিক টেপে ক্যাসেটের গানও প্রথম বের করে ই.এম.আই, ১৯৬৬ সালে। কিন্তু ষাটের দশক শেষ হবার আগেই ধ্বনি-রেকর্ডিং পদ্ধতি অপটিক্যাল স্তরে উন্নীত হয়ে ম্যাগনেটিক পদ্ধতির ধ্বনিধারণ প্রযুক্তিকে অতীতের স্মারকে পর্যবসিত করে দ্যায়। এরই জের ধরে তিনটি প্রজন্মের 888sport sign up bonusবিজড়িত কলের গানের আটাত্তর আরপিএম রেকর্ডের উৎপাদন এদেশেও বন্ধ হয়ে যায় সত্তরের দশকের শেষার্ধে। অবশ্য ব্রিটেনে এর প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সেখানে এই আদি মডেলটির শেষ রেকর্ডটি বের হয় ১৯৬০ সালে। কলের গানের এই প্রধান বাহনটি তার আশি বছরের জীবনে উপমহাদেশকে উপহার দিয়েছে আড়াই লাখ রেকর্ডে প্রায় পাঁচ লাখ গান। তার মধ্যে জনপ্রিয় রেকর্ডের এক একটির কপিই বিক্রি হয়েছে লাখ লাখ এবং এখনও হচ্ছে ক্যাসেটে-সিডিতে, ডিভিডি-অডিওতে।

সে যাক। যে-টেপরেকর্ড এলপি-ইপি-কে সিংহাসনচ্যুত করেছিল, সেও রাজত্ব করতে পারেনি বিশ বছরের বেশি। কারণ ১৯৮৬ সালেই ই.এম.আই এদেশে কমপ্যাক্ট ডিস্ক কিংবা সিডি-বিপণন শুরু করে ব্যাপক হারে এবং বিদেশী সিডির তুলনায় অনেক সুলভে। লেজার-বিম-ভিত্তিক অপটিক্যাল পদ্ধতিতে নির্মিত এই রেকর্ডের মান গুণগতভাবেই ভিন্ন এবং বহুগুণ উন্নত। এমনিতেও একটি সিডিতে একটানা গান শোনা যায় প্রায় আশি মিনিট। সিডি-প্লেয়ার ছাড়াও এটি বাজানো যায় পিসিতে এবং শোনা যায় কম্পিউটারটিতে অন্য কাজ করতে করতেও। বস্তুতপক্ষে সিডির আবির্ভাবকে ত্বরান্বিতও করেছে আশির দশকের জগজ্জয়ী পার্সনাল কম্পিউটার।

অডিও এবং ভিডিও Ñ উভয় সিডির রাজত্বই প্রমাণিত হলো ক্ষণস্থায়ী। কারণ নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধেই ঘটে গেল ডিজিট্যাল বিপ্লব। বিপণিত হলো ডিভিডি। এই ডিস্কটিকে প্রথমে বলা হতো ডিজিট্যাল ভিডিও ডিস্ক। পরে ডিজিট্যাল অডিও ডিস্ক এবং ডিজিট্যাল ডেটা ডিস্কও বেরিয়ে গেলে, ১৯৯৫ সালে সর্বসম্মতভাবে লেটেস্ট এবং অত্যগ্রসর এই রেকর্ডটির স্ট্যান্ডার্ড নামকরণ হলো ‘ডিজিট্যাল ভার্সেটাইল ডিস্ক’। সংক্ষেপে অবশ্য ডিভিডি অপরিবর্তিতই থাকল।

বার্লিনার প্রবর্তিত ফ্ল্যাট ডিস্কটির আদলে নির্মিত ডিভিডির চ্যাপ্টা চাকতিটি দেখতে সিডির মতো হলেও – ডিভিডির ধ্বনিধারণক্ষমতা সিডির চেয়ে ঢের বেশি। কারণ সিডির ট্র্যাক অনেক বেশি প্রশস্ত – ওয়ান পয়েন্ট সিক্স মাইক্রন। প্রতিপক্ষে ডিভিডির খাত অনেক বেশি সরু – মাত্র পয়েন্ট সেভেন ফোর মাইক্রন। বর্তমানে সাধারণত ব্যবহৃত হচ্ছে ডিভিডি-ফাইভ এবং ডিভিডি-নাইন, যেগুলোর ক্যাপাসিটি যথাক্রমে ৪.৭ ও ৮.৫ গিগাবাইট। ডবল সাইড ডবল লেয়ার ডিভিডির ধারণ-ক্ষমতা ১৮ গিগাবাইট। তুলনায় সিডির ক্যাপাসিটি লজ্জাকর – মাত্র ৬৫০ থেকে ৭০০ মেগাবাইট, মানে এক গিগাবাইটের চেয়েও ৩২৪ মেগাবাইট কম। তবে ডিভিডির মাথাও নত করতে তৈরি হচ্ছে ২৭ গিগাবাইট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ‘ব্লু রে ডিস্ক’। কারণ, হাই-ডেফিনিশন টিভি কিংবা HDTV’র প্রোগ্রাম ধারণ করার জন্য ডিভিডির ক্ষমতাও যথেষ্ট নয়। যা হোক, ডিভিডির আরেকটি বড় গুণ হলো রেকর্ডিংয়ে এর বিশ্বস্ততা। সিডির চেয়ে ডিভিডি দ্বিগুণ মূলানুগ। অনেক বেশি গুণ ধারণ-ক্ষমতার সঙ্গে দুই গুণ মূলানুগতা – এই দুটি বাহুর জোরেই সিডির ঘরবাড়িগুলো দ্রুতগতিতে দখল করে নিচ্ছে ডিভিডি।

তবে এহেন শক্তিশালী ডিভিডি-অডিওকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে অডিও কমপ্রেসর এম.পি.থ্রি আর ডিভিডি-ভিডিওকে অতীতে ঠেলে দিচ্ছে ভিডিও-কমপ্রেসর এম.পি.ফোর। বক্ষ্যমাণ এই কলের গানের গল্পে আমি কেবল ধ্বনি-সংকোচক MP-3 -র কথাই বলব, তাও সংক্ষেপে। এর পুরো নাম হলো Motion Picture Experts Group I Layer 3। প্রথম দুটি শব্দের গচ এবং লেয়ারের থ্রি নিয়ে সংক্ষেপে MP-3| MPEG হলো ISO’র অধীনস্থ একটি সাব-প্যানেল বা স্ট্যান্ডার্ড। থাক ওসব বৃত্তান্ত। এই সফল অডিও কমপ্রেশনের উদ্ভাবক জার্মান ফ্রাউনহোফার গেসেলশ্যাফ্ট। সংস্থাটি এই প্রোগ্রামের কাজ শুরু করে ১৯৮৭ সালে এবং এম.পি.থ্রি নামক ধ্বনির ফাইল-ফর্ম্যাটটির পেটেন্ট পায় জার্মানিতে ১৯৯২ সালে এবং আমেরিকায় ১৯৯৬ সালে। এম.পি.থ্রি ফাইল-ফরম্যাট একটি সিডিকে সংকুচিত করে বারো ভাগের এক ভাগে কমিয়ে এনেও সিডিটির সব গান সমান সুশ্রাব্য রাখতে পারে।

শুনতে বিস্ময়কর বোধ হলেও, সাউন্ড কমপ্রেশনের ফরমুলা কিন্তু খুবই সিম্পল। সিডিতে ধৃত অনেক ধ্বনিকেই এই সংকোচন-প্রযুক্তি অকার্যকর-অতএব-অদরকারি প্রমাণ করেছে, কয়েকটি বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তি দিয়ে। আমি এখানে কেবল দুটির কথাই বলব, তাও একটু করে। এক. সিডির মধ্যকার অনেক ধ্বনিই মনুষ্যকর্ণে শ্রুত হয় না। আমাদের শ্রবণশক্তির দুটি দ্বারপ্রান্ত আছে, যে-দুটির মধ্যকার ধ্বনিই কেবল কর্ণগোচর হয়। প্রান্তদ্বয়-বহির্ভূত ধ্বনিগুলোর সঙ্কোচন সম্ভব, ক্ষতি ব্যতিরেকেই। কারণ মানুষের কানে শব্দ ঢোকে বক্ররেখায়। দুই. আড়ালে পড়ে যাওয়া শব্দ আমরা শুনতে পাই না। সূর্যরশ্মি বীক্ষণকারীর দৃষ্টিপথে পড়ে-যাওয়া, সূর্য থেকে কম আলো বিকীরণকারী, পাখিটি যেমন দৃষ্টিগোচর হয় না – তেমনি হারমোনিয়ামের প্রবলতর শব্দের তলে পড়ে-যাওয়া বেলোর দুর্বলতর শব্দটিও আমাদের শ্রুতিগোচর হয় না। অতএব শ্রুতির অগোচর এই সমস্ত ধ্বনি সংকুচিত করে ফেললে, একটি এম.পি.থ্রি ফাইল-ফরম্যাটে একটি সিডির সমান জায়গায় সিডিটির কুড়িটি গানের বারো গুণ অর্থাৎ দুইশত চল্লিশটি গানই আঁটানো যায়। অতএব এম.পি.থ্রি ফরম্যাটে ডাউনলোড করতে সময়ও খরচ হয় অনুরূপ হারে কম। এ-কারণেই এম.পি.থ্রির টেকনিক সৃষ্টি করেছে, রেকর্ড ইন্ডাস্ট্রি নয়, ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড – যে-ইন্টারনেট-বিশ্বে নেটবন্ধুদের সৌজন্যে এ-মুহূর্তেই প্রায় আশি মিলিয়ন গান পাওয়া যাচ্ছে, ডাউনলোড করে নিজের স্টকে নেওয়ার মতো। গানের এই বিশাল ফাইল-ফরম্যাটটি যখন তখন যত্রতত্র বাজানোর জন্য ডেডিকেটেড এম.পি.থ্রি প্লেয়ারও বেরিয়ে গিয়েছে ছোট ছোট।

ভেবে হয়রান হতে হয় যে, একালের ডিভিডি-অডিও প্লেয়ার এবং এম.পি.থ্রি ফাইল-ফরম্যাট প্লেয়ার সেকালের গ্রামোফোন বা কলের গানেরই প্রতিরূপ। এদের ডিস্ক এবং মেমারি-চিপ্স, রাবার বা গালার রেকর্ডেরই ভাইবোন। গুণগত তফাতগুলোই শুধু মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। সে-প্রান্তে আটাত্তর আরপিএম রেকর্ডের সাত মিনিটের দুটি গান। আর এ-প্রান্তে এম.পি.থ্রি ফরম্যাটের শত শত মিনিটের শত শত গান। গালার রেকর্ডের একদিক বাজাতেই একটি পিন শেষ হয়ে যেত। কমপ্যাক্ট এবং ডিজিট্যাল ডিস্কে পিনই নেই, তাই শেষ হওয়াও নেই। পিনের ঘষায় ক্ষয়ে গিয়ে অল্পদিনেই অস্পষ্ট হয়ে যেত গালার রেকর্ড। সিডি-ডিভিডি কোনোকিছুরই স্পর্শ ছাড়াই বাজে বলে এসব রেকর্ডের গুণগত ক্ষয় নেই।

চলতি শতকে কলের গানের বিশ্ব-লাইব্রেরিটিই চলে আসবে সমর্থজনের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে – ইন্টারনেটওয়ার্ক আর ডেস্কটপ-ল্যাপটপ, এমনকী পাম্টপ পিসির সৌজন্যে। কিন্তু এমন বিপুল সঞ্চয়ও কি একবিংশ শতকের মানুষদের সেই বিরল রোমাঞ্চ উপহার দিতে পারবে? যে-বিপুল পুলক বিংশ শতকের মানুষদের যুগিয়েছিল রসিকজনের মালিকানাধীন নিরাভরণ একটি গ্রামোফোন? কিংবা গ্রামোফোনটির রহস্যগর্ভ ওই মেগাফোন?