কালিদার চলে যাওয়া

অক্টোবর, তাঁর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে, কালিদাস কর্মকার ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। গায়ে টকটকে লাল জামা, লাল রুমাল দিয়ে চোখ মোড়া, দুই হাতের পাঁচ আঙুলে অজ্ঞাত কোনো নৃত্যের মুদ্রা। পেছনে টকটকে লাল ফুলের তোড়া, তাতে হালকা হলুদের ছোঁয়া।
ছবি দেখে মন্তব্য করেছিলাম, কালিদা, এত উচ্ছ্বাস, এত আনন্দ কোত্থেকে পান? উত্তরে কালিদা লিখে পাঠিয়েছিলেন, আর পারি না, চুয়াত্তর বছরের হাড়ে ক্লামিত্ম এসে গেছে। কথাটা বিশ্বাস করিনি। এই লোকটাকে যতদিন ধরে দেখেছি তাঁর জীবনোচ্ছ্বাস বিস্মিত করেছে। যেন অতি-আগ্রহী এক কিশোর, প্রতিদিন সে নতুন বিস্ময় আবিষ্কার করে, আর সে-আবিষ্কার সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয়। তিনি যেন বলছেন, দেখো, দেখো, জীবন কী অবাক সুন্দর, প্রতিটি সকাল কী নতুন প্রতিশ্রম্নতিতে পূর্ণ। জীবন সুন্দর, চোখ বন্ধ করেও সেই সুন্দরকে তিনি আহবান জানাতে পারতেন।
সেই কালিদা চলে গেলেন। জ্বলজ্বলে একটা আলো নিভে গেল।
যাতেই হাত দিতেন কালিদা, তাতে নতুনের ছোঁয়া থাকত। তিনি পুরনোকে ভাঙতে ভালোবাসতেন, তা ছবিতে হোক অথবা ব্যবহারিক জীবনে। মনে পড়ছে, তাঁর এক মেয়ের বিয়েতে তিনি মাটিতে আল্পনা এঁকেছিলেন; রঙের বদলে হরেকরকম ডাল দিয়ে। সে-আল্পনা মাড়িয়ে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আমরা দেশি-বিদেশি সবাই হাঁ হয়ে দেখছিলাম কী অপূর্ব কারুকর্ম নির্মিত হয়েছে নিত্যদিনের ব্যবহার্য আটপৌরে ডাল দিয়ে। আমার সবাই একমত হয়েছিলাম, কন্যাকে দেওয়ার জন্য এরচেয়ে অধিক সুন্দর বিদায়ী উপহার হতে পারে না।
বছরদশেক আগে নিউইয়র্কের ব্রম্নকলিনে মাসতিনেকের জন্য রেসিডেন্সি করতে এসেছিলেন কালিদা। যেদিন তাঁর বিদায়ী প্রদর্শনী, আমাদের সপরিবারে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ঘরটি একই সঙ্গে রাত্রিবাস ও ছবি অাঁকার কর্মশালা। আরো কয়েকজন 888sport live chatীও সেখানে থাকেন ও কাজ করেন। সেদিন তাঁরা পুরো ঘরটি কালিদার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে নানা মাধ্যমে কাজ করতে ভালোবাসতেন কালিদা। সেই কর্মশালায় সেদিন যেসব ছবি দিয়ে সাজিয়েছিলেন তার মধ্যে ছাপচিত্র তো ছিলই, আরো ছিল
ছোট-বড় ক্যানভাসে অসংখ্য ছবি, তার কোনোটা তেলরং, কোনোটা বা মিশ্রমাধ্যম। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে নিয়ন আলো নিয়ে একটি কাজ, নিউইয়র্কের আরেক চিত্র888sport live chatী মোস্তফা আরশাদ তারুর সঙ্গে যৌথভাবে নির্মিত। ছোট ফ্রেমে একটি জানালা, পেছনে নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে ‘১৯৭১’ এই কথাটি। মনে হলো যেন বলছেন, এই জানালাটা খুলে রাখো, আলো-বাতাস আসতে দাও। একাত্তরকে বাঁচিয়ে রাখো।
শুধু ছবি নয়, সেদিন নিজের বিদায়ী অনুষ্ঠানে তিনি সবার আপ্যায়নের জন্য রেঁধেছিলেন। হরেক পদের রান্না, কোনোটা দেশি-কোনোটা বিদেশি। সেসব তিনি সাজিয়ে রেখেছিলেন একটি লম্বা কাঠের টেবিলের ওপর। আমরা সেখান থেকে খাবার তুলে নেব কী, যে অপূর্ব শৈলীতে তাদের সাজিয়ে রেখেছিলেন, মাঝে ফুল বা অন্য কিছু দিয়ে, তা দেখেই আমরা মুগ্ধ।
সেদিন আমাকে নিজের একটি আত্মপ্রতিকৃতি উপহার দিয়েছিলেন কালিদা, সামান্য কয়েকটি রেখায় অাঁকা ছবি, এত নিরাভরণ অথচ কী অনায়াসে নিজের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নিজেই উদ্ধার করলেন তিনি। ছবিটির কেন্দ্র – তার ভর – কেশবিহীন মস্তকের নিচে তাঁর চোখ জোড়া। খোলা চোখ অথচ বিষণ্ণ। এটাই কালিদার আসল পরিচয়। অসংখ্য আত্মপ্রতিকৃতি আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি, কোনোটা অতি সরল ও তির্যক – যেমন আমার উপহার পাওয়া ছবিটি। কোনোটা জটিল ও সবিসত্মার। আমরা জানি বিমূর্ত আলঙ্কারিক নকশায় তিনি সিদ্ধহস্ত, রং ও রেখার খেলায় তিনি তুলনাবিহীন। কিন্তু ‘ফিগারেটিভ’ অঙ্কনেও যে তিনি অসাধারণ, তার প্রমাণ এইসব আত্মপ্রতিকৃতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রতিকৃতিসমূহে যে কালিদাকে পাই, কখনো কখনো তা আমার কাছে পরাজিত একজন মানুষের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বহিরঙ্গে তিনি যতই বহির্মুখ বা এক্সট্রোভার্ট হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করুন না কেন, একটি নিভৃত নিঃসঙ্গতা তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল, এ-কথায় কোনো ভুল নেই।
আমি কোনো এক লেখায় বলেছিলাম, কালিদাস কর্মকার একজন যাযাবর। কোথাও স্থির হয়ে বসা তাঁর স্বভাবে নেই। কিন্তু নিজের শেকড় কোথায় সে-কথা কখনো এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতেন না। সারা
পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন, কিন্তু মন পড়ে থাকত 888sport appsে। এমনকি ম্যানিলায় তাঁর শেষ যে-প্রদর্শনী – ‘ফ্রম ম্যানিলা টু 888sport app’ – তারও মূল বিষয় ছিল 888sport sign up bonusর 888sport apps। ‘পলিমাটি’ নামে যে সিরিজের জন্য তিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পরিচিত, তার কেন্দ্রীয় বিষয় একটিই – স্বদেশ। এই সিরিজের অধিকাংশ ছবিই প্রতীকী, যাকে বলা যায় বিমূর্ত ভাববাদী। কাদামাটির ছোপ তো থাকতই, প্রায় প্রতিটি ছবিতে আরো যা থাকত তা হলো টকটকে লাল রঙের ছোপ। সে-ছোপ রক্তের, একাত্তরের রক্তক্ষরণের। একই সঙ্গে তা প্রভাতি সূর্যেরও। 888sport appsের গতকাল ও আগামীকাল, এই উভয় অনুভূতিকে তিনি এভাবেই একই সুতোয় গাঁথতেন – বেদনায় ও আনন্দে তারা মাখামাখি। এই পর্যায়ের ছবিগুলো স্পষ্টতই প্রবল ব্যক্তিগত, কিন্তু ব্যক্তি তো কখনো তার সময়ের সামষ্টিক চরিত্রের বাইরে নয়। কালিদাসের মতো সংবেদনশীল 888sport live chatী তো নয়ই। ফলে এইসব ছবিতে প্রকাশিত হয় একই সঙ্গে ব্যক্তির ও সমষ্টির বেদনা, তার বিস্ময় ও প্রত্যাশার উদ্ভেদ। গভীর ইতিহাসবোধ ছাড়া সময়প্রবাহের এই দ্বৈততা – তার ‘বাইনারি’ – চরিত্র উদ্ধার সম্ভব নয়।
আমার যঙ্গে যতবার কালিদার দেখা হয়েছে, যতবার আড্ডা হয়েছে, ঘুরেফিরে বারবার দেশের কথা উঠে এসেছে। যখনই 888sport appsের কোনো ঘটনায় মন খারাপ হয়েছে, রাতবিরেতে ফোন করতেন। নিজের উদ্বেগের কথাটা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে না নেওয়া পর্যন্ত যেন তাঁর স্বস্তি নেই। হয়তো একটা কিছু পড়েছেন, ভালো লেগেছে – অথবা ভালো লাগেনি – সে-কথাটা তাঁকে বলতেই হবে। সবসময়েই কথা শেষ করতেন এই বলে, ‘যত ষড়যন্ত্র হোক, পতাকা তো নিতে পারবে না।’
কালিদার একটি শিশুসুলভ মন ছিল। তিনি যে নিজেকে অনবরত গড়ছেন ভাঙছেন, অনেকের কাছে তা সহজে বোধগম্য হতো না। প্রায় চলিস্নশ বছর আগে তিনি 888sport appয় ইন্সটলেশনের কাজ করেছেন, ভাঙা গাড়ি বা কোনো কোনো আসবাব সাজিয়ে বিচিত্র 888sport live chatবস্ত্ত নির্মাণ করেছেন। ইনস্টলেশন আর্টের সঙ্গে অপরিচিত অনেকের কাছে সেইসব কাজকে হালকা বা লোক-দেখানো মন হয়েছে। অথচ কিছুটা অভিনিবেশ দিয়ে দেখলে বোঝা অসম্ভব নয়, কালিদা আসলে বাস্তবতার বহিরঙ্গ ঠেলে আমাদের গভীরতর সত্যতর কোনো বাস্তবতার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন।
এমন একজন বিস্ময়-বালক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর জীবনের অনেক কাজই অপূর্ণ রয়ে গেল। 888sport live chatীবন্ধু তারুকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক 888sport live chat-কর্মশালা শুরুর প্রস্ত্ততি নিয়েছিলেন। বছরদশেক আগে নিউইয়র্কে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে 888sport appsি 888sport live chatীদের একটি যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার অন্যতম প্রাণপুরুষ। ইচ্ছা ছিল এমন প্রদর্শনী যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে নিয়ে যাবেন। সংগীত ও 888sport live chatকলার নৈকট্য নিয়ে একটি সিরিজের ছবি অাঁকার কথাও ভেবেছিলেন।
সেসব কাজ অপূর্ণ রয়ে গেল। কিন্তু যা তিনি দিয়ে গেলেন,
কৃতজ্ঞ বাঙালি তাঁর জন্য কালিদাস কর্মকারকে ভুলবে না।