এই সময়ের বাঙালিরা সাংবাদিক কালিনাথ রায়ের নামের সঙ্গে হয়তো পরিচিত নন, তাঁদের জানার সুযোগ যেহেতু কম। কারণ কালিনাথ রায় সাংবাদিক জীবনের ৩৫ বছর কাটিয়েছেন পাঞ্জাবে, লাহোরের দুটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। অবশ্য যাঁরা জে. নটরাজনের দি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান জার্নালিজম (১৯৬৪) পড়েছেন তাঁরা জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পরে সামরিক আইনে গ্রেপ্তার হওয়া দি ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক কালিনাথ রায়ের নামের সঙ্গে পরিচিত। ১৯০০ সালে কালিনাথ রায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি-সম্পাদিত কলকাতা থেকে প্রকাশিত দি বেঙ্গলী পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতা শুরু। মাঝে এক বছর অসমের (আসাম) একটি দৈনিকের সম্পাদক ছিলেন, আবার তিনি কলকাতার দি বেঙ্গলী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১৩ সালে লাহোরে যান দি পাঞ্জাবি দৈনিকের সম্পাদক হয়ে। এরপর ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে তিনি লাহোরের দি ট্রিবিউন দৈনিকে যোগদান করেন সম্পাদক হিসেবে। হাঁপানির জন্য লাহোরে শীতকালে কষ্ট পেতেন বলে পদত্যাগ করে খুলনার বাড়িতে চলে আসেন ১৯৪১ সালে। আবার তাঁকে দি ট্রিবিউনের প্রধান সম্পাদক হয়ে লাহোরে যেতে হয়। অসুস্থতার জন্য ছুটি নিয়ে খুলনা যাওয়ার পথে ১৯৪৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর কলকাতার হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। কলকাতার দি বেঙ্গলী পত্রিকায় তিনি স্বনামে নিশ্চয়ই লিখতেন, নইলে পাঞ্জাবের ইংরেজি দৈনিক তাঁকে সম্পাদক করে লাহোরে নিয়ে যাবে কেন! আবার লাহোরের দৈনিক পাঞ্জাবিতে তাঁর লেখা পড়েই দি ট্রিবিউনের ট্রাস্টিরা তাঁকে ওই পত্রিকার সম্পাদক নিয়োগ করেন ১৯১৭ সালে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষে লাহোরের ট্রিবিউন পত্রিকা ট্রাস্ট ফ্রম মারটিয়রডম টু ফ্রিডম নামে একটি বই প্রকাশ করে। এই বইটিতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের আগে-পিছে ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত কালিনাথ রায়ের লেখা, কালিনাথ রায় সম্পর্কে খবর এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ও পাঞ্জাবের সামরিক শাসনে সন্ত্রাসের সংবাদ ও 888sport app লেখা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। বইটিতে ডায়ারের হত্যাকারী উধোম সিংয়ের লন্ডনে হত্যাকাণ্ডে খবর এবং বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের কথা জানা যায়। পরবর্তীকালে লন্ডন থেকে উধোম সিংয়ের দেহাস্থি ভারতে নিয়ে আসার খবর ওই বইটিতে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের কিছু নতুন লেখা।
এতদিন কালিনাথ রায়ের লেখা পড়তে পারার সুযোগ ছিল না। তিনি কেন ট্রিবিউন পত্রিকার সম্মানীয় সম্পাদক ছিলেন, আমরা তাঁর লেখা পড়ে এখন তা জানতে পারব। লাহোরের শীতে হাঁপানিতে কষ্ট পেতেন বলে ১৯৪১ সালে খুলনার বাড়িতে চলে গেলে সেখান থেকে সপ্তাহে দুই বা তিনদিন টেলিগ্রামে ট্রিবিউনের সম্পাদকীয় লাহোরে পাঠাতেন।
কালিনাথ রায় জন্মেছিলেন ১৮৭৫ সালে খুলনা শহরে। খুলনা তখন ছিল যশোর জেলার একটি মহকুমা শহর, জেলা হয় ১৮৮৮ সালে। নতুন শহরে ডাক্তার ও আইনজীবী হিসেবে প্রথমে আসেন যশোর জেলার পাঁজিয়া গ্রাম থেকে কায়স্থরা। শিক্ষাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে বৈদ্যরা এসেছিলেন যশোর জেলার কালিয়া গ্রাম থেকে।
কালিনাথ রায় খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে এফ. এ. ক্লাসে ভর্তি হন; কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় কলেজের পড়া ছেড়ে দেন। পরে ১৯০০ সালে দৈনিক দি বেঙ্গলীতে চাকরি নেন। মাঝে এক বছরের ঁজন্য তিনি অসমের ডেইলি সিটিজেনের সম্পাদক হন। আমাদের জানার উপায় নেই, বেঙ্গলীতে তাঁর স্বনামে লেখা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কি না। যাই হোক, পরে কলকাতায় ফিরে আবার বেঙ্গলীতে যোগদান করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ডেইলি পাঞ্জাবির সম্পাদক হয়ে লাহোরে যান। তারপর ১৯১৭ সালের মার্চে তিনি সম্পাদক হিসেবে দ্য ট্রিবিউন পত্রিকায় যোগদান করেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রথম থেকেই ট্রিবিউন পত্রিকার সঙ্গে বাঙালিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিখিল ভারত কংগ্রেস সংগঠন গড়ে তোলার জন্য লাহোরে গিয়ে দানবীর সর্দার মাজিথিয়ার সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি তাঁকে একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে তাঁরই প্রেরণায় মাদ্রাজ থেকে হিন্দু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সর্দার মাজিথিয়ার অনুরোধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রিবিউন পত্রিকার জন্য কলকাতা থেকে প্রেস কিনে লাহোরে পাঠান। এছাড়া সর্দার মাজিথিয়ার অনুরোধে প্রস্তাবিত পত্রিকা সম্পাদনার জন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বেঙ্গলী পত্রিকা থেকে সাংবাদিক শীতল চট্টোপাধ্যায়কে লাহোরে পাঠান। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। আর্থিক অসুবিধার জন্য বিপিনচন্দ্র পাল ওই পত্রিকায় কিছুদিন সাব-এডিটরের চাকরি নিয়েছিলেন। তাঁর জ্বালাময়ী ভাষা পত্রিকার জনপ্রিয়তা ও প্রচার888sport free bet বৃদ্ধি করেছিল। কালিনাথ রায় যখন ট্রিবিউনের সম্পাদক হন, তখন পত্রিকার দৈনিক প্রচার888sport free bet ছিল পাঁচ হাজার। সর্দার মাজিথিয়া ট্রিবিউনের সম্পাদকের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য ট্রিবিউন ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন। পত্রিকার মালিকানায় অংশ আছে এমন কেউ ওই ট্রাস্টের সদস্য হতে পারতেন না, ওই ট্রাস্টের নজরদারির জন্য কালিনাথ রায় স্বাধীনভাবে দ্য ট্রিবিউন পত্রিকা সম্পাদনা করতে পারতেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক আইনের শাসনে দেশদ্রোহের অভিযোগে সম্পাদক কালিনাথ রায়ের সঙ্গে ট্রিবিউন ট্রাস্টের এক সদস্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের প্রথম বিভাগীয় প্রধান ও প্রথম মিন্টো প্রফেসর ড. মনোহর লালও গ্রেফতার হয়েছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, যুদ্ধের অবসানে ভারতীয়দের শাসনক্ষমতায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে। তখন চরমপন্থী, নরমপন্থী সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। সরকারের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে সকলেই টাকা ও ঋণ দিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করেছিলেন। একমাত্র পাঞ্জাবের কৃষকরা গদর পার্টির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করে। যাই হোক, যুদ্ধের অবসানে কাঙ্ক্ষিত আইনের বদলে ব্রিটিশ সরকার বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখতে রাওলাট বিল আইনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সময়েই কালিনাথ রায় ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক হন। কালিনাথ রায় প্রস্তাবিত আইনটিকে ‘আইনহীন আইন’ আখ্যা দেন। সর্বস্তরের মানুষ, সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও কাউন্সিলে সরকারিপক্ষের ভোটে ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে রাওলাট বিল আইনে (124A of I.P.C.) পরিণত হয়। কালিনাথ রায় তাঁর লেখার মাধ্যমে পাঞ্জাবের জনমতকে উত্তপ্ত করেন। বিলটি আইনে পরিণত হলে মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যমে আইনটি প্রত্যাহার করার কথা ভাবেন এবং বোম্বেতে এই উদ্দেশ্যে সত্যাগ্রহ সমিতি গঠন করেন। তিনি সত্যাগ্রহ সমিতির নামে ১৯১৯ সালের ৬ই এপ্রিল রাওলাট আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সারা ভারতে বয়কট ও ভুখা দিবস পালনের আহ্বান জানান। সব অফিস-কাছারি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা বন্ধ থাকবে, সকলে উপবাস করে প্রতিবাদ করবে। এই নতুন ধরনের প্রতিবাদে সারা ভারতের জনগণ এই প্রথম একসঙ্গে প্রতিবাদ করে। গান্ধী বোম্বেতে ওইদিন এক লাখ মানুষের জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। পাঞ্জাবেও শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। গান্ধী উত্তর ভারত, অসম, কলকাতা, চট্টগ্রাম, দক্ষিণ ভারতে গিয়ে হরতালের জন্য প্রচার করেছিলেন, কিন্তু পাঞ্জাবে যাননি। দি ট্রিবিউনে কালিনাথ রায়ের ‘ন্যাশনাল প্রোটেস্ট’ লেখাটি সেই কাজটি করে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সারা ভারত কংগ্রেস গঠনের সময় লিখেছিলেন, ‘অ্যা নেশন ইন মেকিং’। গান্ধীর আহ্বানে ১৯১৯-এর ৬ই এপ্রিল ‘নেশন’ বাস্তবে পরিণত হলো। লেনিনের পরামর্শে মানবেন্দ্রনাথ রায় মস্কোতে অবনী মুখোপাধ্যায়ের সহায়তা নিয়ে ১৯২২ সালে লেখেন ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’। গান্ধী-নিন্দুক মানবেন্দ্রনাথ রায় ওই গ্রন্থে লেখেন, এই প্রথম ভারতের জনগণকে সরাসরি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। বারুদ তৈরি ছিল, গান্ধী তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। বারুদ যে আগুনের অপেক্ষায় ছিল, তার প্রমাণ মিলল পাঞ্জাবে। রাওলাট আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ৬ই এপ্রিল পাঞ্জাবে শান্তিপূর্ণ হরতাল, অরন্ধন, শোভাযাত্রা, জনসভা হওয়ায় লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ডায়ার পাঞ্জাবের মানুষকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি দেন। তার জবাব কালিনাথ রায় দি ট্রিবিউনে দিয়েছিলেন (যে-লেখাটির জন্য কালিনাথ রায় দেশদ্রোহের অভিযোগে সামরিক আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন)। কালিনাথ রায়ের ওই লেখার সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় হতে পারে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে 888sport appর ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত তফাজ্জল হোসেনের (মানিক মিয়া) ‘কলম’-এর প্রতিবাদের ভাষা।
যা হোক, ১০ই এপ্রিল অমৃতসরের তিন কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করে ভিন্ন রাজ্যের জেলে পাঠানো হয় এবং গান্ধীকে পাঞ্জাবে ঢুকতে না দিয়ে পাঞ্জাব সীমান্ত থেকে ট্রেনে বোম্বাইয়ে (মুম্বাইয়ে) ফেরত পাঠানোর সংবাদে অমৃতসরে বিক্ষোভ হয়। সরকার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোয় মারমুখী জনতা ইউরোপীয়দের পিটিয়ে মারে। এই মারমুখী জনতাকে শায়েস্তা করার জন্য লেফটেন্যান্ট গভর্নর মার্শাল ল’ জারি করে গোটা প্রদেশকে মিলিটারির হাতে তুলে দেন। তারই পরিণতিতে ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে কোনো রকম সতর্ক না করে মাইকেল ডায়ারের সেনারা গুলি না শেষ হওয়া পর্যন্ত নিরস্ত্র সমবেত জনতাকে গুলি করে মারে। আহতদের অনেকেই চিকিৎসার অভাবে মারা যান। ১১ই এপ্রিল প্রেস সেন্সরশিপ চালু হয়। প্রতিবাদে একটি দৈনিক ছাপানো বন্ধ করে। সারা প্রদেশে সামরিক বাহিনীর সন্ত্রাস অব্যাহত থাকে। হাজার হাজার নিরীহ ব্যক্তিকে জেলে পোরা হয় এবং সামরিক ট্রাইব্যুনাল বিচারের নামে কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড দেয়। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বিরুদ্ধে লেখার জন্য সম্পাদক কালিনাথ রায়কে গ্রেফতার করে লাহোর জেলের নির্জন ছোট কুঠুরিতে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। দিনে আধঘণ্টার জন্য জেলের বাইরে আনা হতো। অসুস্থ হওয়ায় তিনবার তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল। সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে তাঁর পছন্দের আইনজীবীকে কলকাতা থেকে পাঞ্জাবে আসতে দেওয়া হয়নি। বিচারের সময় নোট করার জন্য এক টুকরো কাগজ ও পেনসিলও দেওয়া হয়নি।
কালিনাথ রায়ের পছন্দের আইনজীবীকে কলকাতা থেকে পাঞ্জাবে আসতে না দেওয়ার প্রতিবাদ করার জন্য গান্ধী সারাদেশের কংগ্রেস কমিটির কাছে আবেদন করেন। দেশের সর্বত্র জনসভা করে কালিনাথ রায়ের মুক্তির দাবিতে প্রস্তাব পাশ করিয়ে ভাইসরয়ের কাছে পাঠানোর অনুরোধ করেন। তিনি ওই বিবৃতিতে জানান, সংযম ও শালীনতা কালিনাথ রায়ের লেখার বৈশিষ্ট্য। সারা ভারতের মতো বাংলার মানুষ এই প্রথম কালিনাথ রায়ের নাম শুনল। গান্ধী তখনো কংগ্রেসের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন হোমরুল লীগের সভাপতি। ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতের সর্বত্র কংগ্রেস কালিনাথ রায়ের মুক্তির দাবিতে জনসভা করে এবং তা প্রস্তাবাকারে পাশ করে ভাইসরয়কে পাঠিয়ে দেয়। খুলনা শহরে প্রথম প্রকাশ্য রাজনৈতিক জনসভা হয় কালিনাথ রায়ের মুক্তির দাবিতে। কালিনাথ রায়ের মুক্তির জন্য জনসভার উদ্যোগ নেওয়ায় এক যুবককে তাঁর বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেন। কালিনাথ রায় লাহোরের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বিশ্রামের জন্য খুলনার বাড়িতে এসে ওই ঘটনাটি জানতে পারেন এবং ওই যুবক জ্ঞান ভৌমিককে নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত জ্ঞান ভৌমিক ছিলেন খুলনা জেলায় একমাত্র সারাক্ষণের কংগ্রেস কর্মী। ১৯২২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত হলে খুলনা শহরে তিনি পত্রিকার এজেন্ট হন। সেটাই ছিল তাঁর জীবিকা। যে-মাঠে গান্ধীর আবেদনে কালিনাথ রায়ের মুক্তির দাবিতে জনসভা হয়েছিল, সেই মাঠেই জ্ঞান ভৌমিক গান্ধীর জন্য জনসভা করেছিলেন ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন। ওইদিন চিত্তরঞ্জন দাশ দার্জিলিংয়ে মারা যান। গান্ধী বক্তৃতা করার সময়েই চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুসংবাদ বয়ে আনা টেলিগ্রামটি পান। ওইদিন রাত্রের ট্রেনে তিনি খুলনা থেকে রওনা দেন। পরের দিন দার্জিলিং মেইল শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই তিনি শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে শোকগ্রস্তদের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করেন। খুলনা পৌরসভা মাঠটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে পার্কটির নাম রেখেছিল গান্ধী পার্ক *। পাকিস্তানে ও 888sport appsের স্বাধীনতার পর ওই পার্কের নাম বারবার বদলে গেছে। এখন কী নাম জানি না।
লাহোরের সামরিক আদালত কালিনাথ রায়কে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন এবং দু-হাজার টাকা জরিমানা করেন। তিনি স্থানীয় আদালতে এবং ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে সামরিক ট্রাইব্যুনালের শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করেন। প্রথমত, সামরিক ট্রাইব্যুনালের বেসরকারি ব্যক্তিদের বিচার করার আধিকার নেই এবং তাঁর লেখার জন্য অমৃতসরে অশান্তি হয়েছে, সেটাও প্রমাণ করা হয়নি। স্থানীয় আদালত তাঁকে নিরপরাধ ঘোষণা করেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। প্রিভি কাউন্সিলও তাঁর যুক্তি মেনে কালিনাথ রায়কে নির্দোষ ঘোষণা করে। প্রিভি কাউন্সিলে তাঁর আপিলে জানা যায়, সামরিক ট্রাইব্যুনাল অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। যাঁরা প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করেছিলেন তাঁরা কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছিলেন, অন্য শাস্তিপ্রাপ্তরা প্রিভি কাউন্সিলে আপিল না করায় তাঁদের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তির পর ট্রিবিউনে প্রকাশিত কালিনাথ রায়ের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য তিনি লাহোর জেলে দেখেছিলেন। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ভিন্নমত প্রকাশের ব্যাপারে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার প্রশ্ন কালিনাথ রায় প্রিভি কাউন্সিলে তুলেছিলেন। কিন্তু প্রিভি কাউন্সিল এই প্রশ্নে নীরব থাকে। সামরিক শাসন জারির পর পাঞ্জাব সারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। দ্য ট্রিবিউনের পুনর্মুদ্রিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ভিন্ন রাজ্যে পাঞ্জাবের নৃশংসতার খবর ছাপানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন হয়, বোম্বে ক্রনিকলের ইংরেজ সম্পাদক নিজের নামে পাঞ্জাবের নৃশংসতার নিন্দা করায় তাঁকে ভারত থেকে বহিষ্কার করে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকার জামানত দুবার বাজেয়াপ্ত করা হয়। গান্ধী পাঞ্জাবে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে পাঞ্জাবে যান ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে। কংগ্রেস তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের এক ভাগ্নি সরলা দেবী চৌধুরানীকে নিয়ে বিভিন্ন জেলার ৩৭৪টি ঘটনার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। কংগ্রেস তদন্ত কমিটিতে মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ সদস্য থাকা সত্ত্বেও একা গান্ধীই পাঞ্জাবের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন। তাঁর জন্য জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা সর্বভারতীয় বিষয়ে পরিণত হয় এবং গান্ধী কংগ্রেসের প্রধান নেতা হন। সেন্সরের জন্য পাঞ্জাবে ঘটনা ঘটার সময় সংবাদপত্রে কিছু ছাপানোর সুযোগ ছিল না। কালিনাথ রায় নিজের লেখা এবং সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দি ট্রিবিউনকে জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা এবং পাঞ্জাবের নৃশংস ঘটনাগুলির তথ্যভাণ্ডারে পরিণত করেছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জালিয়ানওয়ালাবাগ ও পাঞ্জাবের নৃশংস ঘটনার বিতর্কে কালিনাথ রায়ের লেখা এবং দ্য ট্রিবিউনে প্রকাশিত তথ্য উদ্ধৃত হতো।
কালিনাথ রায় কলকাতায় ও লাহোরে থাকলেও তাঁর বাড়ির লোকজন খুলনায় থাকতেন। লাহোরে শীতকালে হাঁপানিতে কষ্ট পেতেন বলে তিনি ওই সময় খুলনার বাড়িতে চলে আসতেন। তাঁর একমাত্র ছেলে সমরেন্দ্র রায় খুলনা জিলা স্কুল থেকে পাশ করে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমিতে আইএমসিতে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএসসি পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অঙ্কে অনার্স নিয়ে বিএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। এমএসসিতেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ড. প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের অধীনে রাশি888sport apk নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু গবেষণার ফল প্রকাশের ব্যাপারে ড. মহলানবীশের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে আমেরিকায় নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার দৈনিক হিন্দুস্থানের জন্য তাঁর ওবিচুয়ারি আমাকেই লিখতে হয়েছিল। খুলনার বাড়িতে থাকতেন তাঁর এক বিধবা বোন এবং চার ছেলে সমেত অসুস্থ ছোট ভাই এবং তাঁর স্ত্রী। তাঁদের দেখাশোনা করতেন জ্ঞান ভৌমিক। প্রতি মাসে টাকা আসত কালিনাথ রায়ের কাছ থেকে। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে সমর রায়ের কাছ থেকে প্রতি মাসে টাকা যেত। ভারত সরকার পাকিস্তানে টাকা পাঠানো বন্ধ করায় তাঁদের খুলনার বাড়ি বদলি করে কলকাতায় চলে আসতে হয়।
১৯৪৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় কালিনাথ রায় মারা যান। তখন কলকাতায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন চলছিল। তাঁর মৃত্যুর পরের দিন অমৃতবাজার পত্রিকায় দুই পৃষ্ঠায় কালিনাথ রায়কে 888sport apk download apk latest version জানিয়ে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখ সর্বভারতীয় নেতার বিবৃতি ছাপা হয়। আমরা জানতে পারি তিনি কত বড় সাংবাদিক ছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির সভা, কংগ্রেস নেতাদের জনসভা এবং সোদপুরে গান্ধীজীর আস্তানার খবর সংবাদপত্রের সব জায়গা নিয়ে নেওয়ায়, কালিনাথ রায় সম্পর্কে কিছু ছাপানোর জায়গা ছিল না। কালিনাথ রায়ের প্রায় সমসাময়িক বসুমতী-সম্পাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ নিশ্চয়ই কিছু লিখেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকা এবং দৈনিক বসুমতী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই দুটি পত্রিকা থেকে কালিনাথ রায় সম্পর্কে জানার সুযোগ নেই।
স্টেটসম্যান পত্রিকার পুরনো খবরের জন্য প্রতি পৃষ্ঠার জেরক্স কপি পেতে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ পড়ে। তাই কোনো স্বাভাবিক গবেষকের পক্ষে কালিনাথ রায় সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।
এখন মনে হয়, স্বাধীনতা লাভের আগে কালিনাথ রায়ের মারা যাওয়া ঠিকই হয়েছিল। পাকিস্তানে স্বাধীনতার আগের দিন লাহোরে মুসলিম লীগপন্থীদের তাণ্ডবের ছবি ১৪ই আগস্ট ছাপা হওয়ায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে দি ট্রিবিউনের অফিস বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কালিনাথ রায় ততদিন বেঁচে থাকলে হয়তো ওই সময় তিনি লাহোরেই খুন হয়ে যেতেন।
* ‘গান্ধী পার্কে’র নাম এখন ‘শহীদ হাদিস পার্ক’। ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের সময় আইয়ুববিরোধী মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত শেখ হাদিসুর রহমান বাবুর নামে এই নামকরণ করা হয়েছে। – কালি ও কলম


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.