ছেলেটা মায়ের সঙ্গেই এসেছিল হাসপাতালে। বান্দরবান সদর হাসপাতালে। চৌচির মাথা নিয়ে যশোদা ভর্তি হয়েছিল। বেহুঁশ। কে একজন হাসপাতালের গেটে রেখে গিয়েছিল। থানা-পুলিশের ভয়ে ইমার্জেন্সি পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। ওই সকালে হন্তদন্ত হয়ে কালু ডোম ঢুকছিল। রাকিবস্যার খবর পাঠিয়েছেন – এখনই আয়। ডেঞ্জেরাস কেস। ইমেডিয়েটলি পোস্টমর্টেম করতে হবে। ডা. রাকিব সকালের ডিউটিতে ছিলেন। ব্যাপারটা সত্যি বোধহয় জরুরি। নইলে ওরকম ঠান্ডাধাঁচের একজন মানুষ এরকম গরম ডাক পাঠাতেন না।
দ্রুতপায়েই ঢুকছিল কালু। কিন্তু কেন জানি চোখদুটো যশোদার ওপর আটকে গিয়েছিল। আসলে ওই ছেলেটার ওপরই চোখ পড়েছিল প্রথমে। কী রকম করে যেন কাঁদছিল সে। কোনো হাউমাউ নেই, কোনো আথালিপাথালি নেই। শুধু নীরবে চোখের জল ফেলছিল ছেলেটা। দুহাতের তালু দিয়ে নিজের চোখদুটো ডলে নিয়েছিল কালু। গতরাতে একটু বেশি টেনে ফেলেছিল সে। বন্ধু অংহ্লা খাঁটি মাল জোগাড় করেছিল। ঘোরটা তখনো কাটেনি কালুর।
একটু সুস্থির হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল কালু। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী রে কান্দস ক্যান?’
তার গলার স্বর শুনে আর লাল লাল চোখ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ছেলেটি। কান্না থামাতে গিয়ে হেঁচকি উঠেছিল তার। ছেলেটিকে ভয় দেখাবার জন্য ওরকম গলায় কথা বলেনি কালু। তার কণ্ঠস্বরটা অমনিই। আর চোখ লাল কি এমনি এমনি হয়েছে?
কিছু বলতে পারেনি ছেলেটা। শুধু দমকে দমকে গলা থেকে ‘মা’ শব্দটি বেরিয়ে এসেছিল। যশোদার মাথার পাশে রক্ত তখন ভেসে যাচ্ছে। গাঁট্টাগোট্টা কালু ঝট করে যশোদাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়েছিল। হাঁটা দেওয়ার আগে ছেলেটাকে লক্ষ করে বলেছিল, ‘আয়, আমার লগে আয়।’ তখন কোথায় গেছেন রাকিবস্যার আর কোথায় গেছে পোস্টমর্টেম! কালুই যশোদাকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। রাকিবস্যারকে অনুনয় করে বলেছিল, ‘স্যার, পোস্টমর্টেমডা একটু পরে করি! মাইডারে বাঁচান লাগব স্যার। এরে আগে ভর্তি করাইয়া লন। বেন্ডিজবুন্ডিজ কইরা দিলেই মর্গের দিকে রওনা দিমু স্যার।’
ডা. রাকিব কী বুঝেছিলেন কে জানে। কালুর ভঙ্গি দেখে ‘না’ করেননি। এমনিতে চুপচাপ ধরনের কালু ডোম। সাত চড়ে রা কাড়ে না ধাঁচের মানুষ। কিন্তু আজকে কালুর কা- দেখে ডাক্তার ভাবলেন – নিশ্চয় কিছু একটা ঘটনা আছে এর মধ্যে।
ঘটনা বলতে কিছুই না। যশোদাকে ওই অবস্থায় দেখে কালুর ভেতরটায় ঘন করে একটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল শুধু। ওই মোচড়েই যশোদাকে কোলে তুলে নিয়েছিল কালু।
দিনপাঁচেক বেঁচে ছিল যশোদা। একদিন যমে-মানুষে টানাটানি। একদিন পর হুঁশ এসেছিল যশোদার, চোখ খোলেনি। ডান হাতটা দিয়ে কী যেন হাতড়েছিল। হাতের কাছে ছেলেটাকে পেয়ে তৃপ্তির একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছিল যশোদার মুখে। দ্বিতীয় দিন থেকে অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল যশোদার। বিকালের ডিউটিতে ছিলেন ডাক্তার মীরা শঙ্কর। কালুকে ডেকে বলেছিলেন, ‘কালু, অবস্থা তো ভালো ঠেকছে না। ওকে তো চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার।’ কালু ডোমই যেন যশোদার মা-বাপ।
কালু বলেছিল, ‘ওই পিচ্ছিডা ছাড়া ওর তো কেউ নেই মেডাম। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ওরে নিয়া যাইব কে? আর ওইখানে হেরে দেখবে কেডা?’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে কী যেন ভাবল কালু। তারপর বলল, ‘এইখানেই রাইখা দেন মেডাম, বাঁইচলে এইখানেই বাঁইচব।’
ডাক্তার মীরা শঙ্করের আর কী করা। বলেছিলেন, ‘তাহলে তাই হোক। এখানে অন্তত তুমি তো দেখভাল করছো।’ কথা শেষ করে অন্য রোগীতে মন দিয়েছিলেন ডাক্তার মীরা।
একদিন মায়ের বেডের কাছেই বসেছিল ছেলেটি। যশোদার জন্য হাসপাতাল থেকে যে খাবার দেওয়া হতো, তা-ই
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেত। যশোদা তো আর খেতে পারতো না। স্যালাইনের ওপরই যশোদার দমটা আটকে ছিল।
শেষরাতের দিকে মারা গিয়েছিল যশোদা। মায়ের বুক ঘেঁষেই ঘুমিয়ে ছিল ছেলেটি। অনেকটা রাত পর্যন্ত ছিল কালু। কী রকম যেন একটা মমতা ধরে গিয়েছিল তার। হাসপাতালে যতক্ষণ থাকত, যশোদার বেডের কাছে কাছেই থাকত। নার্স-ডাক্তাররা অবাক হতেন, যে-কালুকে কাজের সময় ডেকে আনতে হয়, গত পাঁচদিন হাসপাতালটাই যেন কালুর ঘরবাড়ি হয়ে গিয়েছে।
এই যে পাঁচটা দিন যশোদা চোখ বুজে ছিল, কেউ দেখতে আসেনি। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে কিছু জানাও যায়নি। বছরচারেকের ছেলে কী আর বলবে! তার তো ভালো করে বোধবুদ্ধিও হয়নি। মায়ের নাম বলতে পারলেও বাবার নাম বলতে গিয়ে শুধু বাবাই বলেছে। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে ডান হাতের আঙুল কপাল পর্যন্ত উঁচিয়ে বলেছে – ‘উ-ই পাহাড়ে।’
বান্দরবানে কত পাহাড়। উ-ই পাহাড় মানে কোন পাহাড়? কোন পাহাড়ের মাথায় বা গায়ে যশোদাদের বাড়ি, হদিস দিতে পারে না ছেলেটি। একসময় বাঙালিরা এসে যেখানে পেরেছে ঘরবাড়ি তুলেছে। যশোদার স্বামীও সেরকম কোনো একটা পাহাড়ের
কাছে-নিকটে ঘর তুলেছিল। ওই জায়গাটার নিশ্চয়ই নামনিশানা আছে, চার বছরের ছেলেটির হয়তো তা মুখস্থ করা হয়ে ওঠেনি। তার বাড়ির ঠিকানা বলতে সে জানে – উ-ই পাহাড়ে।
যশোদার লাশ বেশ কদিন মর্গে রেখে দেওয়া হয়েছিল। তার আগে পোস্টমর্টেম। যশোদাকে কাটাছেঁড়া না করার জন্য বেশ ঝোলাঝুলি করেছিল কালু। কালু পষ্ট জানে – আহত হয়ে আসা কোনো রোগী হাসপাতালে মারা গেলে পোস্টমর্টেম করতেই হয়। তার পরও কালু কী রকম যেন নাছোড় হয়ে উঠেছিল। বেপরোয়াও অনেকটা। না হলে কেন আরএমও থেকে আরম্ভ করে সিভিল সার্জন পর্যন্ত ধরনা দিয়েছিল কালু। অনেক বলেকয়ে নিরস্ত করা হয়েছিল কালুকে। সিভিল সার্জন বলেছিলেন, ‘দেখো কালু, বহুদিন ধরে কাজ করছ তুমি এই হাসপাতালে। নিয়মকানুন তো তোমার অজানা নয়। যশোদার পোস্টমর্টেম না করলে আমরা যে বেকায়দায় পড়ে যাবো।’
যশোদার শরীরে ছুরি-হাতুড়ি চালাতে চালাতে অঝোরে কেঁদেছিল কালু। অশ্রম্নতে বুক ভেসে যাচ্ছিল তার। যেন নিজের কোনো নিকটাত্মীয়ের বুকে-পেটে-মাথায় দাও-ছুরি চালাচ্ছে সে। 888sport app দিন পোস্টমর্টেমশেষে বাড়ি ফিরে সাঙ্গুর জলে ডুব দিয়ে ধোয়া কাপড় পরে খেতে বসে কালু। তখন কালুকে দেখে মনেই হয় না এই কিছুক্ষণ আগে আস্ত একজন মানুষকে ফালাফালা করে এসেছে। বউয়ের সঙ্গে তরকারির স্বাদ নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, ছাপোনাদের খোঁজখবর নেয়। আজ কিন্তু কিছুই করল না কালু। দাওয়ায় বসে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে সাঙ্গুর জলের দিকে তাকিয়ে থাকল।
হাসপাতাল থেকে মাইলখানেক দক্ষক্ষণে সাঙ্গু নদী। নদীপাড়ে ক্যাচিংঘাট। দূরদূরামেত্মর আদিবাসীরা ওই ঘাট ধরেই শহরে ঢোকে। তাদের একগাছি নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। কাজশেষে আদিবাসীরা বিকেলে যার যার বাড়িতে ফিরে যায়। আজ থেকে বহু বছর আগে এই ঘাটঘেঁষেই একটা কুঁড়ে তুলেছিল কালু। সরকারি জায়গা, কেউ বাধা দেয়নি। পরে পরে বসতির পরিসর বাড়িয়েছে কালু। শুধু কালাকোলা বউটিকে নিয়েই বান্দরবান এসেছিল। পরে বেশ কজন ছানাপোনা। সবদিন যে কালুর মন ভালো থাকে, এমন নয়। ধানের বিষ খাওয়া কোনো কিশোরীর দেহ যেদিন কাটতে হয় বা গুলি-খাওয়া সতেরো-আঠারো বছরের আদিবাসী কোনো তরুণের, মনটা বড় বেচাইন হয়ে যায় কালুর। বড় উদাস উদাস লাগে তখন। বুকের ভেতরটা একেবারে খালি হয়ে যায়। তখন কাউকে ভালো লাগে না, কিচ্ছুকে ভালো লাগে না। বউকে বিস্বাদ মনে হয়, সন্তানদের শত্রু মনে হয়। তখন সাঙ্গুকেই তার বন্ধু বলে মনে হয়। সাঙ্গুর জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে তখন তার ভালো লাগে।
আজো তা-ই করল কালু। কাপড়চোপড় ছাড়ল না। বউকে হাঁকডাক দিয়ে বসার পিঁড়ি দিতে বলল না। ঝুপ করে দাওয়ার মেটে-মেঝেতে বসে পড়ল। সে যেন আজ নির্বাক, নিথর। সে যেন রক্তমাংসের কালু নয়। সে যেন পাথুরে কালু!
মিন্টুকে খুঁজতে এসে দাওয়ায় সোয়ামিটাকে এমন করে বসে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেল কাজলি। চুপচাপ দাঁড়িয়েও থাকল একটুক্ষণ। তারপর ত্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এমন কইরে বইসে আছো যে! কখন আইলা! কোনো সাড়াশব্দ দিলা না আইজ! কী হইছে? কিছু হইছে নি? বড় ডাক্তর বইকছে নি কুনু?’
অন্যদিন হলে হা-হা করে হেসে উঠত কালু। হাসি থামিয়ে বলত, ‘কোন ডাক্তারের এত সাহস যে আমারে বইকবে! তেরি মেরি বাত কইরলে বেবাক হাসপাতাল অচল কইরা দিমু না। এই কালু ডোম ছাড়া বান্দরবান হাসপাতাল একদিনও চইলব নি?’
কিন্তু আজ কিছুই বলল না কালু। শুধু মরা চোখ দুটো দিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেই দৃষ্টিতে জমাটবাঁধা একদলা কষ্ট।
বউটা কাছে এগিয়ে এলো। গায়ে সামান্য ঠেলা দিয়ে বলল, ‘আরে, কী হইছে তোমার? এই রকম কইরতাছ ক্যান?’
বড় বড় দুফোঁটা অশ্রম্ন কালুর গাল বেয়ে নিচে নেমে এলো। বউটি ভড়কে গেল খুব। কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে গেল। তারপর একেবারেই নরম গলায় বলল, ‘রক্তলাগা কাপড়-চোপড় ছাড়ো। নদীতে যাও। স্নান কইরে আসো। ভাত দিতাছি।’
কালু স্নান করে এলো বটে, কিন্তু সে-বেলা কিছুই মুখে তুলল না। বউকে বলল, ‘ভালো লাইগতাছে না আমার। ঘুমাইতে যাইতাছি। খাইতে ডাইকো না আমারে।’
তারপর কী রকম যেন একটা ঘোরে পড়ে গেল কালু। কারো সঙ্গে কথা বলে না, তেমন করে মেশেও না কারো সঙ্গে। নদীকূলে গিয়ে বসে থাকে আর দুঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে কীসব বলে।
সকালের দিকে আপনাতেই চলে আসে হাসপাতালে। মর্গের সিঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকে। হঠাৎ উঠে রুমে ঢুকে পড়ে। চাবি তো তার কোঁচড়েই থাকে। সাদা কাপড়ে-888sport app যশোদার দেহটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তার বিড়বিড়ানি বেড়ে যায়।
একদিন হাসপাতাল ঠিক করে – যশোদার দেহটাকে আঞ্জুমানে মুফিদুলকে দিয়ে দেওয়া হোক।
কালু বড় ডাক্তারের সামনে গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে জোর হাতে দাঁড়ায়। বলে, ‘যশোদার তো কেউ নাই স্যার। যশোদারে আমার কাছে দিয়া দেন স্যার। আমি ওর দেহটারে শ্মশানে লইয়া গিয়া পোড়ামু। কিছু লাগব না স্যার, টেকা-পইসা যা লাগে শ্মশানের সবডা খরচ আমি মিটামু স্যার।’
বড় ডাক্তার কী যেন ভাবতে বসলেন। ডাক্তার মীরা শঙ্কর রুমেই ছিলেন। বললেন, ‘স্যার, আইনগত তেমন অসুবিধা না থাকলে যশোদার ডেডবডিটা কালুকে দিয়ে দেন। তাতে কালু সুখ পাবে, আর যশোদার আত্মা শান্তি পাবে।’
ডাক্তার মতিন উদ্দিন আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে গিয়ে বললেন না। পরে বললেন, ‘কাগজপত্রে স্বাক্ষর …।’
‘আমি দিমু স্যার, যেখানে যেখানে টিপসই দেওন দরকার, আমি দিমু স্যার।’ ব্যাগ্র হয়ে বলল কালু।
ডাক্তার বললেন, ‘ঠিক আছে। ও হ্যাঁ কালু, যশোদার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল না, সে কোথায়?’
‘সত্যই ত, সে কোথায়! তার কথা ত আমি একেবারে ভুইল্লা গেছিলাম স্যার!’ বলতে বলতে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল কালু। তারপর সে হাসপাতালের চারদিকে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াল। একে জিজ্ঞেস করল, ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছাওয়ালডা কই, তোমরা কেউ দেখছ নি হেরে?’
অপরিচিতরা বলে, ‘কোন ছেলেটা! নাম কী তার?’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কালু। হায় হায়! ছেলেটার নামটাও তো সে জানে না। পাঁচ-পাঁচটা দিন আর রাত ছেলেটা তো তার চোখের সামনেই ছিল! একবারের জন্যও তো তার নাম জিজ্ঞেস করেনি কালু। শুধু একটা দিন, শুধু একটিবার তার বাপের নাম আর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করেছিল কালু। কিন্তু ছেলেটার নাম তো সে জানতে চায়নি। কেন জানতে চাওনি কালু? ঠা-ঠা রোদে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিল কালু। ভেতরটা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। আসলে যশোদাকে নিয়ে সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, ছেলেটা তখন তার কাছে কোনো মূল্য পায়নি। বড় ডাক্তারের কথা শুনে সংবিৎ ফিরেছে কালুর। হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের আনাচে-কানাচে ছুটতে শুরু করেছে।
পরিচিতরা অবাক চোখে বলে উঠেছে, ‘এ কী হলো কালুর! কালুর মধ্যে আগের কালু যে নেই!’
একসময় মর্গের বাইরে ঘুপচি যে-জায়গাটা আছে, সেখানে পেয়ে যায় ছেলেটাকে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে প্রথমেই কালু বলে ওঠে, ‘তোর নাম কী রে?’ বলেই সে তার ভুলটা বুঝতে পারে। উদ্বেগের কারণে তার গলা দিয়ে যে-ধমক বেরিয়ে এসেছে, নিজের কণ্ঠস্বর শুনে সে নিজেই বুঝতে পারে। ক্ষণকাল থমকে দাঁড়ায় সে। তারপর পায়ে পায়ে ছেলেটার কাছে যায়। ভালো করে তাকিয়ে চমকে ওঠে কালু। ধুলোমলিন চেহারা। জামাটার ডান কাঁধের দিকে ছিঁড়ে বেশটুকু ঝুলে গেছে। হাফপ্যান্টটার প্রকৃত রং কী বোঝার কোনো উপায় নেই। উস্কোখুস্কো চুল, জটাজটা। দেখলেই বোঝা যায় – বেশ কবেলা খায়নি।
খপ করে হাত ধরে টেনে তুলল কালু। হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। ছোট ছোট পা আর দুর্বল শরীর নিয়ে কালুর সঙ্গে পা মেলাতে পারছিল না ছেলেটা।
হাসপাতাল ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়েছিল ছেলেটাকে। পেট পুরিয়ে খাইয়েছিল। কাউন্টার থেকে নবীদুল গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী কালু, পোলাটা কে? কোনানত্তোন ধরি লই আইলা? তোমার কিছু অয় নি?’
তিনটা প্রশ্নের কোনোটারই জবাব দিলো না কালু। শুধু চেয়ারটা টেনে ছেলেটার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল।
খাওয়া শেষে পানির গস্নাসটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে কালুর দিকে তাকালে কালু জিজ্ঞেস করল, ‘তোর নাম কী, তোর নামডা একটু কবি আমায়?’
‘কালি, কালিপদ।’ ক্ষীণস্বরে বলল ছেলেটি।
হা হা হা করে হেসে উঠল কালু। গমগমে হাসির ঢেউ ক্যান্টিনের চার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে খেয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যারা খাচ্ছিল, খাবার রেখে অবাক চোখে তারা কালুর দিকে তাকিয়ে থাকল। ভদ্দরকিসিমের মানুষেরা বিরক্ত হলো – খোঁচা খোঁচা দাড়ির কালাঝোলা চেহারার এ আবার কে? ক্যান্টিনে বসে অভদ্রের মতো হাসছে! কালুর কোনো দিকে খেয়াল নেই। তার সমস্ত মনোযোগ তখন কালিপদের ওপর। কালি -, কালিপদ – বলতে চাইছে কালু। কিন্তু হাসির দমকে শব্দদুটো আটকে যাচ্ছে। একদিকে হাসি চাপতে চাইছে, অন্যদিকে শব্দদুটো বেরিয়ে আসতে চাইছে। বর্ষাকালে কোমরডোবা জলে দাঁড়িয়ে ডাকতে গিয়ে ব্যাঙগুলোর গালের যে-অবস্থা হয়, কালুকেও দেখাচ্ছে সেরকম – গাল ফোলা, চোখদুটো বের করানো।
কালুর কা- দেখে কুঁকড়ে গেল কালিপদ। জড়সড় হয়ে চেয়ারের কোনায় আরো বেশি করে গুটিয়ে নিল নিজেকে।
কালিপদের নাম শুনে যেমন হঠাৎ করে হাসতে শুরু করেছিল কালু, তেমনি আচমকা হাসি থামিয়ে দিলো।
নরম গলায় বলল, ‘কী রে, ভয় পাইছস?’
কালিপদ ওপরে-নিচে মাথা নাড়ল। এই বুঝি কেঁদে দেবে।
কালুর আফসোস হতে লাগল বড়। তার এরকম বিকটভাবে হেসে ওঠা উচিত হয়নি।
চট করে বুকের কাছে টেনে নিল কালিপদকে। বলল, ‘তুই তো জানস না, ক্যান আমি এই রকম কইরা হাইসা উঠছি!’
‘এই রকম ভডভডাইয়া হাইসা উইঠলা কিয়ল্লাই কালু?’ কোন সময় ক্যাশ ছেড়ে প্রবীণ নবীদুল নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি কালু।
গলা শুনে চমকে নবীদুলের দিকে তাকিয়েছিল কালু। শরমের একটা আভা তার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। নিজেকে সংযত করেছিল কালু। নবীদুলকে টেনে সামনের চেয়ারে বসিয়েছিল। বলেছিল, ‘ওর নাম কী, জানো তুমি নবীদা। এই ছাওয়ালডার নাম হইল কালি – পদ।’ টেনে টেনে বলল কালু। বলেই আবার খটখট করে হাসতে শুরু করল সে।
বিরক্তকণ্ঠে নবীদুল বলল, ‘ওর নাম কালিপদ হইছে ত কী হইছে? মহাভারত অশুদ্ধ হইছে নি?’
‘আরে না না নবীদা, অশুদ্ধ হইব ক্যান! ওর নাম কালিপদ আর আমার নাম কালিশঙ্কর। কালিপদ কালিশঙ্কর, কালিপদ কালিশঙ্কর! কী অদ্ভুত মিল না নবীদা?’
‘তোঁয়ার নাম কালিশঙ্কর, জাইনতাম না ত। এই ক্যান্টিন দেওনর পরত্তোন হুনি আইছি, তোঁয়ার নাম কালু। আর কালু এই হাসপাতালের মর্গে মরা কাডে।’ অবাকভঙ্গিতে বলে গেল নবীদুল।
‘আমার পুরা নাম শুইনবে ক্যামনে? ডোমদের আবার পুরা নাম আছে নি? পুরা নাম থাকা উচিত নি? তাইলে ডাইকতে যে অসুবিধা! পুরা নাম ধইরা তাচ্ছিল্য করা যায় নি?’ তারপর আপনমনে বলল, ‘হায়রে কালিশঙ্কর দাশগুপ্ত, কীসের জন্য যে এইখানে আইসা কালু ডোম হইয়া গেছি, তা খুলে বললে কি এরা বিশ্বাস কইরবে! পেটের জ্বালা যে কী, তা তো এরা জানে না।’
আমতা আমতা করে নবীদুল জিজ্ঞেস করল, ‘তা এই পোলার লগে তোমার কী সম্পর্ক?’
‘কী সম্পর্ক!’ বলে থেমে গেল কালু। ঝট করে কালিপদকে চেয়ার থেকে টেনে নামাল। পেছন ফেরার আগে বলল, ‘এই ছাওয়ালডার লগে আমার কী সম্পর্ক তা না হয় আর একদিন কই নবীদা। আজ আমারে তাড়াতাড়ি যাইতে হইব। পাড়ার মানুষরে একত্র করা, জিনিসপত্তরের জোগানযন্তর করা, যশোদারে শ্মশানে লইয়া যাওন কী কম ঝক্কির কাম! আইজ যাই নবীদা, আর একদিন কমু নে সব।’
নবীদুল কালুর কথার মাথামু-ু কিছুই বুঝল না। কালু আর কালিপদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল শুধু।
হঠাৎ কালুর কণ্ঠস্বর নবীদুলের কানে ভেসে এলো, ‘চলরে বাপ। তোরে আগে ঘরে লইয়া যাই। কাজলির যে আর একখান পোলা বাইড়ছে, কওন লাইকব তারে।’


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.