মাজহারুল ইসলাম
চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে দুপা তুলে একান্ত নিজস্ব এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসলেন তিনি। পাশের চেয়ারগুলোতে আমাদের বসতে বললেন। তারপর একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
‘টিভি নাটকের ক্ষেত্রে আপনি যতটা আগ্রহী, সে-তুলনায় মঞ্চের ব্যাপারে আপনার আগ্রহ কম। এর কারণ কী?’ উত্তরে জানান, ‘একটি হিসাব দেখলেই বোধহয় পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের দেশে প্রায় তিন কোটি লোক টিভি দেখে। আর মঞ্চে প্রতি শোতে গড়ে লোক হয় তিনশোর মতো। ধরা যাক তিনশোই। সেক্ষেত্রে মঞ্চের একটি নাটক তিন কোটি লোককে দেখাতে হলে এক লাখ শো করতে হবে। যদি প্রতিদিন নাটকের শো হয় তাহলে প্রায় তিনশো বছর লেগে যাবে তিন কোটি লোককে দেখাতে। অন্যদিকে টিভি নাটক একদিনেই দেখছে তিন কোটি লোক। একজন বুদ্ধিমান লোক হিসেবে আমি কেন মঞ্চে আগ্রহী হবো? ব্রেখট, ইবসেন এঁদের সময় যদি টেলিভিশন থাকত আমার তো মনে হয় তাঁরা মঞ্চ বাদ দিয়ে টিভি নাটকই লিখতেন।’
আরেকটি প্রশ্ন : ‘আপনি শুধু লিখতেন, কিন্তু এখন আপনি নাটক পরিচালনা করছেন। একসঙ্গে এ দুটো করতে অসুবিধা হয় না আপনার?’
জবাবটা এরকম : ‘আসলে একসঙ্গে দুটো চালানো কিছুটা তো কঠিন বটেই। আমি ছবি পরিচালনাও করেছি। এত কিছু একসঙ্গে করা সম্ভবও নয়। মূলত লেখালেখিটাই আমার কাছে ভালো লাগে বেশি।’
যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে তিনি তুমুল জনপ্রিয় কথা888sport live footballিক। টেলিভিশন নাটকের যুগস্রষ্টা। তাঁর কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত প্রথম live chat 888sportটি আটটি বিভাগে জাতীয় live chat 888sport 888sport app download bd পেয়েছে কদিন আগে। সাক্ষাৎকার পাওয়াটা সহজ ছিল না। কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না তাঁর সঙ্গে। আর যোগাযোগ করা গেলেও কি তিনি সদ্য প্রকাশিত একটি পাক্ষিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হবেন? না-হওয়ারই কথা।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। এরই মাঝে ১৬ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করল অন্যদিন। সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে সূচনা888sport free betটি। 888sport live chat-888sport live football-সংস্কৃতি অঙ্গনের গুণীজনেরা ফোন করে অভিনন্দন জানান পত্রিকার সম্পাদককে।
সবার আগ্রহ ছিল দ্বিতীয় 888sport free betটি কেমন হয়, প্রচ্ছদ রচনাটি কোন বিষয়ে হয়। সম্পাদকীয় বৈঠকে সাব্যস্ত হলো : এ-888sport free betর প্রচ্ছদ রচনা হবে ‘নক্ষত্রের রাত-এর নক্ষত্রেরা’। প্যাকেজ নাটক হিসেবে নির্মিত হচ্ছে এই ধারাবাহিকটি। নাটকের শুটিং চলছে সার্কিট হাউস রোডের live chat 888sport ও প্রকাশনা অধিদফতরের (ডিএফপি) স্টুডিওতে। হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় প্রথম ধারাবাহিক নাটক এটি। ইতিমধ্যেই তাঁর রচিত বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক নাটক জনপ্রিয়তার নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময় ও কোথাও কেউ নেই Ñ ধারাবাহিক নাটকগুলো অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। একদিন হঠাৎ, অযাত্রা প্রভৃতি এক পর্বের সাপ্তাহিক নাটকগুলোও দর্শকনন্দিত হয়। ১৯৯৪ সালে তাঁর নির্মিত প্রথম live chat 888sport আগুনের পরশমণি অনেকগুলো বিভাগে জাতীয় live chat 888sport 888sport app download bd লাভ করে। শ্রেষ্ঠ live chat 888sport নির্বাচিত হয় এটি। হুমায়ূন আহমেদ পান শ্রেষ্ঠ কাহিনিকারের 888sport app download bd। এমনই প্রেক্ষাপটে নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘নুহাশ live chat 888sportে’র ব্যানারে এ-নাটকটি নির্মাণে হাত দেন হুমায়ূন আহমেদ। সংস্কৃতি অঙ্গনে তাঁর এই নতুন কাজ নিয়ে সৃষ্টি হয় তীব্র কৌতূহল। আর সে-কৌতূহল মেটাতেই অন্যদিন সিদ্ধান্ত নেয় এ-বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা তৈরির।
কোনোভাবেই যখন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না, তখন মনে পড়ল ফরিদুর রেজা সাগরের কথা। ইমপ্রেস টেলিফিল্মে হুমায়ূন আহমেদ কাজ করেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক। ফরিদুর রেজা সাগর ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ আন্তরিক সম্পর্ক। সাগরভাইকে আমাদের ইচ্ছার কথা জানালাম। এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিলেন।
ডিএফপির স্টুডিওতে শুটিংয়ের বিরতিতে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। সাক্ষাৎকার নিচ্ছে মাসুম আর নাসের। মাসুম অন্যদিনের প্রধান সম্পাদক, নাসের নির্বাহী সম্পাদক। হঠাৎই হুমায়ূন আহমেদ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের পত্রিকার সম্পাদক কে?’ আমি বিব্রত হয়ে মাসুম ও নাসেরের দিকে তাকাচ্ছি। মাসুম উত্তর দিলো, ‘মাজহারুল ইসলাম।’ আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন মাজহারুল ইসলাম?’ নাসের জানাল, ‘সদ্য সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করা আমাদের বন্ধু।’
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। হুমায়ূন আহমেদের এই সাক্ষাৎকারের ছবি তোলার কথা ছিল বিটিভির স্থির চিত্রগ্রাহক রকিবুল ইসলামের। হঠাৎ বিটিভির এক কাজ পড়ে যাওয়ায় ঘণ্টাখানেক আগে তিনি জানান, কোনোভাবেই আসতে পারবেন না। অন্যদিনের তখন স্থায়ী কোনো ফটোগ্রাফার নেই। রকিবুল পার্টটাইম কাজ করেন। মাঝে মাঝে ইয়াসীন কবীর জয়। তাকেও পাওয়া গেল না। সাক্ষাৎকারের সময় ছবি তো তুলতেই হবে। কী করা যায় বুঝতে পারছি না। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম আমিই ছবি তুলব, কিন্তু পরিচয় গোপন রাখা হবে। কারণ পত্রিকার সম্পাদক নিজেই ফটোগ্রাফার Ñ শুনলে হুমায়ূন আহমেদ যদি সাক্ষাৎকার না দেন! পরে যখন তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন এই গল্প আমি তাঁকে বলেছি। তিনি খুবই মজা পেয়েছেন।
সাক্ষাৎকার চলতে থাকে। আমি হুমায়ূন আহমেদের ছবি তুলি এবং একটি প্রশ্ন করি, ‘বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আপনার মন্তব্য কী ?’
উত্তর : ‘বর্তমান রাজনৈতিক সংকট তো আমাদের নানাভাবে বিপর্যস্ত করেছে। একটি সভ্য দেশে এই শতাব্দীতে দিনের পর দিন হরতাল কল্পনাতীত ব্যাপার। আমরা তো মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করতে পারি না। যখন পাকিস্তানি শাসন ছিল তখনো যে-কদিন হরতাল হয়েছে তা হাতেগোনা। তখন হরতাল মানে ছিল সরকার কলাপস হয়ে যাওয়া। কারণ সরকার অচল হয়ে যাওয়া মানে দেশ অচল হয়ে যাওয়া। আর এখন এমন হয়েছে হরতাল মানুষের গায়ে সয়ে গেছে। দেখা গেল তিনদিন হরতাল হলো, মানুষ দলবেঁধে সব বাড়ি চলে যাচ্ছে। কারণ সুবিধা একটাই, এখন হরতাল এমনভাবে দেওয়া হচ্ছে সঙ্গে শুক্রবারটিও পেয়ে যাচ্ছে সবাই। সরকারও এ-ব্যাপারে নির্বিকার। কারো যেন কিছু যায়-আসে না। এটা তো হতে পারে না। আর হরতালের রাজনীতি যখন শুরু হয়েছে, এ-রাজনীতি চলতেই থাকবে। এভাবে চললে কলকারখানা সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পরবর্তীকালে দেখা গেল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেছে, তখন বিএনপি যে দিনের পর দিন হরতাল করবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? আমাদের তো এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই সৎবুদ্ধি যদি আমাদের রাজনীতিবিদদের মাথায় না আসে তাহলে আমরা মহাবিপদের মধ্যে পড়ে যাব। নইলে এ-বিপদ থেকে বের হওয়ার পথ নেই। এটা যেমন খালেদা জিয়াকে ভাবতে হবে, হাসিনাকেও ভাবতে হবে।’
অন্যদিনের দ্বিতীয় 888sport free betয় হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার ছাপা হলো ছয় পৃষ্ঠা জুড়ে। প্রচ্ছদে তাঁর ছবি। পত্রিকার কপি পাঠানো হলো তাঁকে। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। এই যোগাযোগটা পোক্ত হয় আরও তিন বছর পরে, ১৯৯৯ সালের শুরুতেই। সে-বছর পাঁচশো পৃষ্ঠার অন্যদিন ঈদ888sport free betর সেরা আকর্ষণ ছিল হুমায়ূন আহমেদের 888sport alternative link। হুমায়ূন আহমেদের কোনো লেখা প্রথমবারের মতো অন্যদিনে ছাপা হলো। এর আগে ১৯৯৭ সালে অন্যদিন 888sport appsে সবচেয়ে বড় কলেবরে (৪০০ পৃষ্ঠা, যার ৮০ পৃষ্ঠাই ছিল চার রঙে মুদ্রিত), বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আধুনিক মুদ্রণ-সৌকর্যের ঈদ888sport free bet প্রকাশ করে। ১৯৯৮ সালে আরও আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশিত হয় অন্যদিন ঈদ888sport free bet। যা হোক, হুমায়ূন আহমেদের লেখা 888sport alternative link ছাড়াও ১৯৯৯ সালের অন্যদিন ঈদ888sport free betর আরেকটি বিশেষত্ব ছিল, প্যারিস প্রবাসী খ্যাতিমান 888sport live chatী শাহাবুদ্দিন আহমেদের করা প্রচ্ছদ। 888sport live chatী শাহাবুদ্দিনও সেবারই প্রথম কোনো পত্রিকার জন্য প্রচ্ছদ আঁকলেন। এরপর থেকে অন্যদিনের সঙ্গে এই দুই গুণীর অচ্ছেদ্য হৃদয়ের বন্ধন।
১৯৯৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রকাশিত চৌদ্দটি ঈদ888sport free betর প্রতিটিতেই ছিল হুমায়ূন আহমেদের 888sport alternative link। 888sport appsের আর কোনো পত্রিকায় এতটা দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর লেখা ছাপা হয়নি। ঈদ888sport free betর জন্য তিনি একটি 888sport alternative link লিখলেও সেটি ছাপা হতো অন্যদিনে। একাধিক লিখলে প্রথম 888sport alternative linkটি থাকত অন্যদিনের জন্য। এটা আমাদের জন্য বিশাল সৌভাগ্য আর আনন্দের বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের দেশ পত্রিকায় পরপর আটটি শারদীয় 888sport free betয় তাঁর 888sport alternative link ছাপা হয়। বাংলা 888sport live footballের কোনো লেখকের লেখা শারদীয় দেশে পরপর আট বছর ছাপা হয়নি।
হুমায়ূন আহমেদ অন্যদিন ঈদ888sport free betর জন্য 888sport alternative link লিখলেন। নাম রূপার পালঙ্ক। ঈদ888sport free betটি প্রকাশিত হলো ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে। ঈদ888sport free bet দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। সে-বছরই 888sport cricket BPL rateে গ্রন্থমেলায় 888sport alternative linkটি প্রকাশিত হলো বই আকারে। প্রকাশক অন্যদিনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘অন্যপ্রকাশ’। রূপার পালঙ্ক বইটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হলে আরেক দফা তিনি মুগ্ধ হলেন। বইমেলায় রূপার পালঙ্কের বিক্রির পরিমাণ হুমায়ূন আহমেদের পূর্ববর্তী বইগুলোর বিক্রিকে ছাড়িয়ে গেল। এই যুগল ঘটনা হুমায়ূন আহমেদ আর অন্যদিন গ্র“পকে পরস্পরের আস্থা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের ভেতর নিয়ে এলো।
হুমায়ূন আহমেদ মুগ্ধ হতে ভালোবাসতেন, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন অন্যদের মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে ফেলতে। অচিরেই তিনি জড়িয়ে ফেললেন অন্যদিন গ্র“পকে এক অদ্ভুত সম্মোহনে, যেন তিনি হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা।
নুহাশপল্লীতে যে-বাংলো বা কটেজগুলো এখন আমরা দেখি, একসময় এগুলো ছিল না। ছোট-ছোট কিছু টিনের ঘর আর একটি বড় বাংলো ছিল। বাংলোটি ছিল পাহাড়ি এলাকার আদিবাসীদের বাড়ির মতো, উঁচু মাচার ওপর। এই সুদৃশ্য বাংলোটি সংরক্ষিত ছিল বিশেষ অতিথিদের জন্য। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও ওই বাংলোয় না থেকে সাধারণ ঘরগুলোর একটিতে থাকতেন। নুহাশপল্লীতে প্রথম যেবার আমরা (মাসুম, কমল, নাসের আর আমি) রাত্রিযাপন করলাম, শতবর্ষের প্রখরতম চাঁদের আলো ছিল সে-রাতে, জোছনা উৎসব হলো সেখানে; স্যার আমাদের বললেন, ‘তোমরা বাংলোয় থাকবে।’ ওই রাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অতিথি নুহাশপল্লীতে রাত্রিযাপন করলেও শুধু আমরাই ছিলাম বাংলোটিতে।
স্যারের এই আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। এটা ১৯৯৯-এর ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। এখন যেখানে স্যার চিরনিদ্রায় শায়িত সেই লিচুতলার কাছেই ছিল বাংলোটির অবস্থান। বাংলোয় একটা লাইব্রেরি ছিল, প্রচুর দেশি-বিদেশি বই ছিল সেখানে। পরে এই বাংলোটি দুষ্কৃতকারীরা পুড়িয়ে দেয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের দাবিতে অনশন করতে যে-রাতে হুমায়ূন আহমেদ সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করেন, সে-রাতেই এই অপকর্মটি ঘটে। সে-যাত্রায় আমিও তাঁর সঙ্গে অনশনে গিয়েছিলাম। বাংলো পোড়ানোর সংবাদে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।
দিন যায়, আমাদের সম্পর্ক আরো নিবিড় হতে থাকে। কখন যেন লেখক-প্রকাশক কিংবা লেখক-সম্পাদকের সম্পর্ক চাপা পড়ে যায় গভীর এক হার্দিক সম্পর্কের আড়ালে।
২০০০ সালের ঘটনা। ৭২ ঘণ্টা হরতালের আগের দিন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কন্যা বিপাশা ও পুত্র নুহাশকে নিয়ে কক্সবাজার যাবেন। সঙ্গে আমাকেও যেতে বললেন। বিমানে যাবেন এবং আসবেন। থাকবেন হোটেল সায়মনে। সব ব্যবস্থাই আমি করে দিলাম। তাঁর সঙ্গে গেলাম না। হরতালের প্রথম দিন অফিসে এসে খারাপ লাগছিল এতবড় মাপের একজন লেখককে ‘না’ বলার জন্য। এর মধ্যেই তাঁর টেলিফোন। ‘মাজহার, আমি খবর নিয়ে জেনেছি হরতালে বিমান চলাচল করছে। একটা টিকিট করে চলে এসো, একসঙ্গে আনন্দ করি।’ এবার আর না করতে পারলাম না, শুধু বললাম, ‘স্যার দেখি।’ সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার যাব, কিন্তু বিমানে নয়। আজ রাতে গাড়ি নিয়ে সরাসরি চলে গেলে কেমন হয়? হুমায়ূন আহমেদ অন্যদের সারপ্রাইজ দিতে যেমন পছন্দ করেন, তেমনি সারপ্রাইজ পেতেও পছন্দ করেন। অভিনেতা চ্যালেঞ্জার ও মাসুমকে রাজি করালাম আমার সঙ্গে যেতে। বাসার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও রওনা হলাম রাত ১০টায়। হরতালের রাত। রাস্তা ফাঁকা। চারদিকে অন্ধকার। হঠাৎ দু-একটা গাড়ি চলাচল করছে। মাঝে মাঝে কিছু জটলা। কোথাও কোথাও টায়ার পোড়ানো হয়েছে দিনের বেলায়। গাড়িতে সংবাদপত্র স্টিকার লাগানো। দু-একবার পুলিশের মুখোমুখি হলেও তেমন কোনো সমস্যা হলো না। 888sport app থেকে কক্সবাজার আমি একা গাড়ি চালালাম।
ভোর সাড়ে ৫টায় কক্সবাজার পৌঁছলাম। আগেই ঠিক করা ছিল আমার হাতে থাকবে আজকের পত্রিকা, মাসুমের হাতে গরম চায়ের কাপ এবং চ্যালেঞ্জারের হাতে এক প্যাকেট সিগারেট। যত রাতেই ঘুমান না কেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন হুমায়ূন আহমেদ এবং বসে যান দৈনিক পত্রিকা ও গরম চা নিয়ে। সঙ্গে সিগারেট। সকাল সাড়ে ৭টায় তাঁর হোটেল রুমের দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। খুব স্বাভাবিক গলায় 888sport appর খবর কী জানতে চাইলেন। বারান্দায় বসে চা খেলেন, পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেন। দু-একটি সাধারণ কথাবার্তা হলো আমাদের মধ্যে। কাল রাতে রুমের এসি ঠিকমতো কাজ করেনি বলে ঘুমাতে সমস্যা হয়েছে। ছেলেমেয়ে দুজন সারাদিন সাগরের পানিতে লাফালাফি করেছে। দূর থেকে এ-দৃশ্য দেখতে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘তোমরা হাতমুখ ধুয়ে রেস্টুরেন্টে আসো। একসঙ্গে নাস্তা খাব।’ এরপর তিনি পত্রিকা নিয়ে রুমে ঢুকে গেলেন।
আমার খুব মন খারাপ হলো। এতটা ঝুঁকি নিয়ে হরতালের মধ্যে সারারাত গাড়ি চালিয়ে এলাম। আর স্যার একটুও খুশি হলেন না? একবার মুখে বললেন না। আমরা যে আসব এ-কথা তো উনি জানতেন না। গতকাল টেলিফোনে শুধু বলেছি, ‘স্যার দেখি।’
নাস্তার টেবিলে বসে বললেন, ‘মাজহার, আমাদের বিমানের টিকিট বাতিল করার ব্যবস্থা করো। আমি তোমাদের সঙ্গে গাড়িতে করে 888sport app ফিরব।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আপনার কষ্ট হবে, আপনি বিমানেই যান।’ তিনি একরকম ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমরা এত কষ্ট করে আমাকে আনন্দ দিতে এসেছ, আর আমি তোমাদের সঙ্গে না গিয়ে আলাদা যাব? এটা হতেই পারে না। শোনো, আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি তোমাদের দেখে। আমি চিন্তাই করিনি হরতালের মধ্যে সারারাত গাড়ি চালিয়ে তোমরা চলে আসবে। আমার আনন্দটা ইচ্ছা করে প্রকাশ করিনি তোমাদের রিঅ্যাকশন দেখব বলে। এটাই লেখকদের কাজ। যাও টিকিট বাতিল করে আসো।…’ এই হলেন হুমায়ূন আহমেদ।
নানাভাবে আমাকে তিনি মুগ্ধ করেছিলেন পরম মমতা ও ভালোবাসায়। খুব দ্রুত ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, পারস্পরিক নির্ভরতা তৈরি হলো। বয়সের যথেষ্ট ফারাক থাকলেও তিনি পরিণত হলেন আমাদের বন্ধু, একান্ত আপনজনে। তাঁর যে-কোনো আয়োজনের দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম আমরা। বড় মেয়ে নোভার বিয়ে। খাবারের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বিয়েতে এনে মেয়েকে চমকে দিতে চান তিনি। আমাকে দায়িত্ব দিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ফোনে স্যারের ইচ্ছার কথা জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন তিনি। একবারও বললেন না, ‘হুমায়ূনের মেয়ের বিয়ে, কই হুমায়ূন তো ফোন করল না আমাকে।’
সত্যিই আমার দেখা আরেকজন বড়মাপের মানুষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলদা স্বাতী বউদিসহ বিয়ের আসরে যোগ দিলেন। পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদের আমন্ত্রণে আরো একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নুহাশপল্লীতে এসেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি নুহাশপল্লী। সেটা ছিল দুই দুয়ারী ছবির শুটিংয়ের সময়। স্যার একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘শুটিং শেষ উপলক্ষে একটা উৎসবের আয়োজন করা হবে। সুনীল দাকে বলো ব্যস্ততা না-থাকলে নুহাশপল্লীতে চলে আসতে। দুই-তিনটা দিন উনার সঙ্গে সময় কাটাতে চাই।’ সেবারও আমি ফোন করে সুনীলদাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। স্বাতী বউদিসহ সন্ধ্যায় 888sport app এয়ারপোর্টে পৌঁছালেন তিনি। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। বর্ষাকালে ভাওয়াল মির্জাপুর ঘাট থেকে নৌকায় নুহাশপল্লী যাওয়া হতো। নৌকার মধ্যে আমরা কয়েকজন। বিল এলাকা। ভরা বর্ষায় চারদিকে অথই পানি। সে-পানিতে ফকফকা জোছনার আলো। অসাধারণ এক নৈসর্গিক দৃশ্য।
আমি যখন বিয়ে করি ২০০০ সালে, সে-কী উচ্ছ্বাস তাঁর! এ কি পিতার উচ্ছ্বাস পুত্রের বিয়েতে? নাকি বড়ভাইয়ের উচ্ছ্বাস কনিষ্ঠের নতুন জীবনে? কিংবা ‘বন্ধু তোর বারাত নিয়া আমি যাব’? বিয়ের এক সপ্তাহের ভেতর নতুন দম্পতির জন্য নুহাশপল্লীতে বিশাল ও জমকালো এক সংবর্ধনার আয়োজন করলেন তিনি। নববধূকে নিয়ে নুহাশপল্লীর ঘাটে স্যারের বজরা থেকে আমি নেমে আসতেই বাদকদল সুরের মূর্ছনা তুলল। পালকিতে তোলা হলো নববধূকে। আর আমাকে তোলা হলো ‘হাবলংয়ের বাজারে’ নাটকের সেই হাতাওয়ালা চেয়ারে। চারজন তাদের কাঁধে করে বয়ে চলল চেয়ার। অনেকখানি পথ পেরিয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে আসা হলো সাজানো একটি বাংলোর সামনে। স্যার আমাদের উপহার দিলেন নুহাশপল্লীর চাবি। এই প্রথম কাউকে নুহাশপল্লীর চাবি উপহার দেওয়া হলো। আরো নানা আয়োজন ছিল সেবার।
২০০১-এ আমি ধানমণ্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে এসে উঠি। এই ফ্ল্যাট কিনতে তিনিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি তখন ‘দখিন হাওয়া’য় একাকী জীবনযাপন করছেন। একই ফ্লোরে পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট Ñ তাঁর আর আমার। দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টার প্রায় পুরোটা সময়ই উভয় ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আমাদের ঠিক নিচের ফ্লোরেই আরেকটি ফ্ল্যাটে থাকেন প্রকাশক ও হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘদিনের বন্ধু আলমগীর রহমান। হুমায়ূন স্যারের ফ্ল্যাটে তখনো গিজার লাগানো হয়নি। শীতের অনেক দিনে দেখেছি আলমগীর রহমান বালতিভর্তি গরম পানি পৌঁছে দিচ্ছেন বন্ধুর ফ্ল্যাটে। গৃহকর্মে সহায়তা করার জন্য অনেকদিন পর্যন্ত স্যারের কোনো লোক নেই। নুহাশ live chat 888sportের এক কর্মী এসে মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে সেই শূন্য ফ্ল্যাটে রাত কাটায়। রাতে একাকী থাকতে তিনি ভয় পেতেন। ‘বোবায় ধরা’ সমস্যা ছিল তাঁর। অনেক রাতে স্যারের সঙ্গে আমিও থেকেছি ওই ফ্ল্যাটে। রান্নাবান্না আমার ফ্ল্যাটেই হতো। আমার স্ত্রী স্বর্ণা সবসময় স্যারের খোঁজখবর রাখত। স্যার কখন নাশতা করবেন? কখন তিনি দুপুর কিংবা রাতের খাবার খাবেন? স্যারের খাবার হওয়া চাই আগুনগরম। ঠান্ডা খাবার খেতে পারেন না তিনি। লেখার সময় প্রচুর চা পান করেন। এসময় যেন তাঁর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত না ঘটে। আমার শিশুসন্তানটি তাঁকে বিরক্ত করছে কি না Ñ এই সবকিছুর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি স্বর্ণার। স্যার তাকে অচিনপুর বইটি উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘দ্বিতীয় মাতা (!) স্বর্ণা। এই মেয়েটির বয়স মাত্র বাইশ। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে আমাকে দেখে সন্তানের মতো। নিজের মাকে ছাড়া কাউকে মা ডাকা আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কী আশ্চর্য কাণ্ড, এখন ডাকতে পারছি।’ প্রায়ই বিভিন্ন আড্ডায় তিনি স্বর্ণাকে দ্বিতীয় মাতা বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন।
ওই একাকী জীবনে তাঁর তিনবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়। দুইবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে, আরেকবার শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। চিকিৎসায় সেরে ওঠেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর মায়েরও হৃদরোগ দেখা দিলে মাতা-পুত্র উভয়কে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। এই দুই রোগীর সঙ্গী গুলতেকিন খান আর আমি। সেখানে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মাতা-পুত্রের হার্টের বাইপাস সার্জারি হয় একই দিনে Ñ আগে পুত্র, পরে মাতা। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে দুজনকে পাশাপাশি রাখা হয়। পরবর্তীকালে একই কেবিনে মা ও পুত্র। হাসপাতালে এ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন Ñ মাতা-পুত্রের একসঙ্গে সার্জারির এরকম ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেনি।
প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে দেশে বা বিদেশে বেড়াতে খুব পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৯-এর জানুয়ারি থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ-বিদেশে যেখানেই যতবার তিনি বেড়াতে গিয়েছেন, দু-চারবার ছাড়া প্রতিবার একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। ২০০১ সালে হুমায়ূন আহমেদ আর আমি Ñ আমরা দুজন নয়দিন ঘুরে বেড়িয়েছি জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিতে। জার্মানিতে একটা বইমেলায় অংশ নিতে আমরা গিয়েছিলাম। সেখান থেকে অন্য দুই দেশে যাওয়া। ওই বেড়ানোটা ছিল আমার জন্য 888sport app download for androidীয় একটি ঘটনা। বহু দেশ, অসংখ্য জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি একসঙ্গে। কিন্তু ওই বেড়ানো ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। কলকাতা ও দার্জিলিং ছাড়াও মেঘালয়, ত্রিপুরা, সিকিমের নানা শহর ও পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখেছি তাঁর সঙ্গে। নেপালে গিয়েছি কমপক্ষে ১০ বার। কখনো শুধু ব্যাচেলর, কখনো পরিবার-পরিজনসহ। একবার শুধু স্যার, নুহাশ ও আমি গিয়েছিলাম। সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন আর থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গা যুক্ত হয়েছে আমাদের যৌথ অভিজ্ঞতায়। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সফরের সঙ্গী হয়েছি কয়েকবার। দেশের ভেতরে যেখানে তিনি গেছেন, সঙ্গে আমার যাওয়াটা ছিল অবধারিত। কয়েকশো দিন ও রাত কাটিয়েছি তাঁর সান্নিধ্যে নুহাশপল্লীতে। জোছনা দেখা, শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভেজা, চৈত্রের প্রচণ্ড দাবদাহে সুইমিংপুলের পানিতে ডুবে থাকা, গাছ থেকে লিচু পাড়া, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা, ক্ষেতের ধান কাটা ইত্যাদি নানা উৎসব। নাটক-সিনেমার শুটিং তো আছেই। এছাড়া নতুন নতুন উপলক্ষ তৈরি করে সবসময় আনন্দ করতে পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ।
আগেই বলেছি, পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকি আমরা। ‘গর্তজীবী’ হুমায়ূন আহমেদ সারাদিনই বাসায় থাকেন। সচরাচর কোথাও বের হন না, নুহাশপল্লী ছাড়া। প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে একসঙ্গে চা খাই অথবা অফিসে আসার পথে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে বের হই। সন্ধ্যায় বা রাতে যখনই দখিন হাওয়ায় ফিরি, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকি। খানিক কথাবার্তা বলে তারপর নিজের ঘরে ফিরি। কখন কীভাবে এই অভ্যস্ততায় জড়িয়ে গেছি নিজেই জানি না।
শাওনের সঙ্গে বিয়ের পর রান্নাবান্না হচ্ছে দু-বাসাতেই। স্যারের বাসা বা আমার বাসা যেখানেই ভালো কিছু খাবার তৈরি হতো, একসঙ্গে বসে খাওয়া। কোনোদিন হয়তো স্যার বাজার থেকে একটা বড় চিতল বা পাবদা মাছ কিনে আনলেন। আমি তখন অফিসে। স্যার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করতেন, ‘মাজহার, বড় চিতল মাছ এনেছি। দুপুরে একসঙ্গে খাব, চলে এসো।’ কাজের ব্যস্ততায় কখনো যেতে পারতাম, কখনো পারতাম না। যেতে না পারলে রাতে অবশ্যই তাঁর সঙ্গে খেতে হতো। খেতে বসে দেখি সেই চিতল মাছ। ‘তুমি চিতল পছন্দ করো। তাই বড় টুকরাটি রেখে দিয়েছি তোমার জন্য।…’ এরকম ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে। স্যারের এরকম উদার স্নেহে চোখ ভিজে উঠেছে।
নিজের সন্তান ছাড়া অন্য কারো বাচ্চা তিনি কোলে নিতেন না। বলতেন, ‘অন্যের বাচ্চা কোলে নিতে পারি না।’ কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমি দেখেছি, আমার দুই শিশুসন্তানকে তিনি কীভাবে আদর দিয়েছেন, অসংকোচে কোলে বা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাদের কত শিশুতোষ জ্বালাতন হাসিমুখে সয়ে গেছেন। একবার কোনো একটা পত্রিকায় তিনি ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। পাশে নিরীহ মুখ করে আমার পুত্র অমিয় বসে আছে। হঠাৎ স্যারের গালে প্রচণ্ড এক চড়। চড় দিয়েছে অমিয়। এরপর সে-প্রশ্নকর্তার ক্যামেরার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি শুরু করে। এ-ঘটনার উল্লেখ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দেখা না-দেখা গ্রন্থে। লিখেছেন, ‘অমিয়র চড় খেয়ে আমি তেমন কিছু মনে করিনি। তার কারণ সে আমাকে ডাকে Ñ বুব বু। বুব বু’র অর্থ বন্ধু। বন্ধু বলতে পারে না, বলে বুব বু। একজন বন্ধু আরেক বন্ধুর গালে চড়-থাপ্পড় মারতেই পারে।’
হুমায়ূন আহমেদ আমাকে একটি বই উৎসর্গ করেন। বইটির নাম কুহুরানী। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘একজীবনে অনেক বই লিখেছি। প্রিয়-অপ্রিয় অনেককেই উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রায়ই ভাবি কেউ কি বাদ পড়ে গেল? অতি কাছের কোনো বস্তুকে ক্যামেরা ফোকাস করতে পারে না। মানুষও ক্যামেরার মতোই। অতি কাছের জন ফোকাসের বাইরে থাকে। ও আচ্ছা, পুত্রসম মাজহার বাদ পড়ছে।’
আসলে তাঁর সঙ্গে আমার একটা বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কখনো ছিল ভ্রাতৃ-সম্পর্ক, কখনো পিতৃ-সম্পর্ক, আবার কখনো তা গভীর বন্ধুত্বের। তখনো ভেবেছি, এখন আরো বেশি করে ভাবি Ñ কী অদ্ভুত সম্মোহনে তিনি আমায় কাছে টেনেছিলেন। সর্বঅর্থেই তিনি একজন জাদুকর ছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। আমজনতা জানে তাঁকে গল্পের জাদুকর হিসেবে। কেউ কেউ এও জানেন, তিনি ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ানসের সদস্য ছিলেন। বন্ধুদের আড্ডায় তিনি কখনো কখনো নানারকম জাদু দেখাতেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদু888sport live chatী জুয়েল আইচ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর জাদুতে জুয়েল আইচও মুগ্ধ হয়েছেন বহুবার। আর একটি জাদু জানতেন তিনি Ñ কাউকে আপন করে নেওয়ার জাদু। সেই জাদুতেই আমি আচ্ছন্ন হই।
স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, দুই পুত্র নিষাদ ও নিনিত এবং আমাকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘ষষ্ঠ সংসার’ পেতেছিলেন নিউইয়র্কে। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় এসে শুরু হয়েছিল এই সংসার। তিন রুমের একটা আলাদা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হলো। হাঁড়ি-পাতিল কেনা হলো। টিভি কেনা, বিছানা-বালিশ Ñ সে এক বিরাট হইচই। বাড়ির ছাদঘরে বসে তিনি ছবি আঁকেন। জলরং ছবি। তাঁর ধারণা, ছবি ভালো হচ্ছে না। রঙে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। অথচ আমি দেখছি অসাধারণ সব ছবি এঁকে চলেছেন তিনি একের পর এক। তাঁর আরেকটা প্রিয় জায়গা বাড়ির পেছনের ব্যাকইয়ার্ড। প্রতি সন্ধ্যায় কিছুটা সময় এখানে কাটান। বাড়ির পাশেই একটা পাবলিক লাইব্রেরি। ওদের মেম্বার হলেন। নানারকম বই এনে পড়েন। কানাডার টরন্টো থেকে সুমন রহমান একবার হারুকি মুরাকামির একটা বই পাঠালেন। বইটা পড়ে খুব আনন্দ পেলেন তিনি। একথা সুমনকে জানাতেই মুরাকামির একগাদা বই পাঠিয়ে দিলেন। চিকিৎসাকালে বইগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন তিনি।
চিকিৎসা শুরুর বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘শাওন ও মাজহার দুজনেরই দেখি মুখ শুকনো। নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। যেহেতু তারা আমাকে বলেছে টাকা-পয়সার বিষয় নিয়ে আমি যেন চিন্তা না করি, আমি তাই চিন্তা করছি না।
কেমোথেরাপি দিতে এসেছি। কেমোথেরাপির ডাক পড়বে, ভেতরে যাব। ডাক পড়ছে না। একা বসে আছি। শাওন আমার সঙ্গে নেই। সে মাজহারের সঙ্গে ছোটাছুটি করছে। শাওন চোখ লাল করে কিছুক্ষণ পর পর আসছে, আবার চলে যাচ্ছে।
একটা পর্যায়ে শাওন ও মাজহার দুজনকে ডেকে বললাম, মার্ফিস ল’ বলে একটা অদ্ভুত আইন আছে। মার্ফিস ল’ বলে – If anything can go wrong, it will go wrong. আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বলো। টাকা কম পড়েছে?’(নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, পৃ ২০-২১)
সমস্যার সমাধান হলো। তাঁর কেমোথেরাপি চলল। ১২টি কেমো দেওয়া হলো। তারপর অপারেশনের আগে তিন সপ্তাহের জন্যে তিনি দেশ থেকে ঘুরে এলেন। ১২ জুন তাঁর অপারেশন হলো। ১৯ জুন ফিরে এলেন জ্যামাইকার বাসায়, তাঁর ‘ষষ্ঠ সংসারে’। দুদিন পর অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায় আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাঁকে। ২১ জুন হলো দ্বিতীয় অপারেশন। ২৯ জুন রাতে ডিলেরিয়াম হলে পরদিন থেকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেওয়া শুরু হলো। এ-ক্রিয়াটি শারীরিকভাবে অস্বস্তিকর বলে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। ১২ থেকে ১৯ জুন এবং ২১ থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত প্রতি রাতে একদিন আমি, একদিন শাওন ভাবি হাসপাতালে থাকতাম। অধিকাংশ রাতেই স্যার ঘুমাতে পারতেন না। কেমোর কারণে হাতপায়ের আঙুলে একধরনের অস্বস্তি বোধ করতেন। প্রায় সারারাতই হাত-পা-মাথা টিপে দিতাম।
কখনো বলতেন, ‘মাজহার, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও।’ এই কাজটি কখনই শাওন ভাবি ছাড়া কাউকে দিয়ে করাতেন না তিনি। আমি জানি চরম অস্বস্তি, ঘুমের ওষুধ দেওয়ার পরও ঘুম না আসার কষ্ট থেকে অথবা ‘মাজহার তো আমার পুত্রের মতোই’, সেই বোধ থেকেই হয়তো আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে বলতেন। আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব গভীর মমতা দিয়ে স্যারের অস্বস্তি দূর করতে। চোখ বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে গেলে হয়তো পাশের চেয়ারটায় বসেছি, ১০ মিনিট না হতেই ঘুম ভেঙে যেত তাঁর। আবার সেই আকুল করা স্বর, ‘মাজহার, ঘুম পাড়িয়ে দাও।’ সেই স্বরের মধ্যে কী যে স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা আর আকুতি ছিল, আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব নয়। যে ভালোবাসা, স্নেহ ও মমতা গত ১৩ বছরে আমি পেয়েছি তার ঋণ শোধ করার আগেই এলো ১৯ জুলাই, সেই ভয়ঙ্কর দিন। প্রচণ্ড ভয়াবহতায় দুলে উঠলো আমার পৃথিবী। ‘সপ্তম সংসারে’ পাড়ি জমালেন হুমায়ূন আহমেদ। যে-সংসারে তিনি একা, অথবা একা নন। সেখানে আছে তাঁর পুত্র রাশেদ হুমায়ূন, কন্যা লীলাবতী; পিতৃস্নেহ পায়নি যারা একটি দিনের জন্যেও। আছেন পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ, বন্ধু আনিস সাবেত। বগুড়ার স্কুলজীবনের বন্ধু সেহেরী আর প্রিয় অভিনেতা চ্যালেঞ্জারও আছেন সেখানে। কোনো কোনো সংসারে এঁরাই তো ছিলেন তাঁর সুখ-দুঃখের সাথি।
একই গ্রন্থের ৩১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দুটি ছেলে নিতান্ত অল্প বয়সে হোয়াইট হাউসে মারা যায়। আব্রাহাম লিংকন তারপর হতাশ হয়ে লিখলেন, গডের সৃষ্টি কোনো জিনিসকে বেশি ভালোবাসতে নেই। কারণ তিনি কখন তাঁর সৃষ্টি মুছে ফেলবেন তা তিনি জানেন। আমরা জানি না।’
বিধাতা কেন এত অকরুণ!
নিউইয়র্ক থেকে 888sport appয় ফিরছি। তাঁর ষষ্ঠ সংসারের সবাই। বিমানের আসনে বসে আছি আমরা Ñ শাওন ভাবি, তাঁর দুই পুত্র, মা তহুরা আলী, বোন সেঁজুতি আর আমি। একই ফ্লাইটে আছেন আমাদের প্রিয় মানুষটিও। আমাদের আশপাশের কোনো আসনে নয়। এখানে তাঁর জায়গা হয়নি। তিনি যে এখন তাঁর সপ্তম সংসারে। বাক্সবন্দি নিথর দেহ মালামাল রাখার প্রকোষ্ঠে। নিউইয়র্ক থেকে 888sport app Ñ বহুবার যাতায়াত করেছি এই পথে। কিন্তু আজ কী করে এই দূরত্ব বেড়ে গেল বহুগুণ! নাকি নিঃসীম আকাশে স্থবির হয়ে আছে আমাদের আকাশযান। অনন্তকাল ধরে ভেসে আছি এ-শূন্যতায়। মনে পড়ে, ১৯৯৬ সালেও একবার এরকম হয়েছিল। বিমানে কলকাতা থেকে 888sport appয় আসতে মিনিট চল্লিশেক লাগলেও সেবার কত সহস্র মিনিট যে পেরিয়ে গিয়েছিল তা ঘড়ির কাঁটায় ধরতে পারিনি। সে-ফ্লাইটে বাক্সবন্দি ছিল আমার পিতার শবদেহ। আজ 888sport sign up bonusর সেই দুঃসহ বেদনা আর বর্তমানের দুঃসহতা আমাকে নিঃস্ব করে দেয়।
প্রিয়জন যদি চলেই যাবে চিরতরে, তবে কেন এই মিছে মায়ায় জড়ানো!

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.