মধু ভোরবেলা উঠে বউকে বলে, ‘বিদায় দে।’
মদিনা স্বামীর হাত ধরে কয়, ‘আজ লয়। কাল যাইয়ো।’
কড়ুই গাছের ডালে কোকিল ডেকে ওঠে। বসন্তের ভোরে কোকিলের ডাকের কী মানে হয় মধু জানে না। সে ফের শুয়ে পড়ে। আরামে নিদ্রা যায়।
পরদিন ভোরে মধু আবার বউয়ের কাছে বিদায় চায়। বউ আবার বলে, আজ লয়, কাল। মধু সুবোধ বালকের মতো ফের শুয়ে পড়ে। আরামে ঘুমায়। গাছের ডাল থেকে কোকিল ডেকে ওঠে। মধু শোনে না। সে অঘোরে নিন্ পাড়ে। কোকিলটা ক্রমেই ক্ষেপে ওঠে। কু। কুউ। কুউউ। মধু ঘুমায়, সে শোনে না। তার বউ মদিনা জেগে থাকে, সে-ও শোনে না।
কিন্তু বসন্তের ভোরে কোকিলের ডাক শোনে মফিজ। সে অতো বেরসিক নয়। গান গেয়ে ওঠে সে : হামাক এত ভোরে ক্যানে ডাক দিলু রে প্রাণ কুকিলা।
মফিজের গান মদিনা শোনে না। মফিজ ঘর থেকে বের হয়, সড়কের তেমাথার পানে চায়, যে-পথ দিয়ে লোকেরা সদরের দিকে যায়। মফিজ দেখে কেউ যায় না। সে গুটগুট করে হাঁটে। সে মধুর আঙিনায় পৈথানে পা রেখে চাপাস্বরে ডাক পাড়ে, ‘মধু ভাই 888sport appত্ গেছু?’
মধুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মদিনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মফিজের দিকে চেয়ে চোখের লাটা ঘুরায়। মফিজ বিভ্রান্ত হয়; হাপুস নয়নে পুছ করে, ‘গেছে?’
মদিনা গরু খেদায়, ‘হট্ হট্!’
‘হট্ হট্ করিস ক্যান রে, ছুড়িডা?’
মদিনা কাঠের পিঁড়ি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে মফিজের দিকে। মফিজ খ্যাঁকশিয়ালের মতন হাসতে হাসতে ফিরে যায়। যেতে যেতে আপন মনে বলে, ‘যতই মারিস আর যতই কাটিস..।’
* * *
মধুর ঘুম ভেঙে যায়, খিদা লাগে। মদিনা তাকে ভাত দেয়, নিজেও খায়। টাটকা গরম ভাত নয়; পুরান ভাত, পানি-দেওয়া। মধু খেতে খেতে বলে, ‘পান্তা আর নাই?’
মদিনা শরমে জিবাত্ কামড় দেয়। তার মানে পান্তাভাত আর নাই। আর নাই মানে, মদিনার বিচার, সে একা বেশি খেয়েছে বলে তার মানুষডার খিদা মেটার আগেই পান্তা ফুরিয়ে গেছে; তাই মদিনার শরম, তাই তার জিহ্বায় কামড়।
‘এইবার যাওয়া লাগে 888sport appত্।’ মধু সংগত কারণে এখন 888sport app যাবে।
মদিনা তাকে শুধায়, রেকশা চালাতে কষ্ট হয় না? এটা মদিনার সোহাগ, মধু জানে। 888sport app শহরে রিকশা চালানোর ঠেলা বহুত, জানে মদিনা। কিন্তু ক্ষেতখামারের কাজে দোজখের আজাব, বিনিময়ে মজুরি সামান্য, দিনে মাত্র চল্লিশ ট্যাকা। জ্যৈষ্ঠ মাসে মণ্ডলদের পাটক্ষেতে নিড়ানি দিতে দিতে একদিন মধুর প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল; ক্ষেতে পানি ছিল না, আকাশে মেঘ ছিল না, মধুর পিঠ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, গলা শুকিয়ে কাঠ, তার প্রচণ্ড পিয়াস পাচ্ছিল, সে দৌড়াচ্ছিল পানির জন্য, নিধুয়া পাথার কারবালা মরুপ্রান্তর হয়ে ছিল, দূরে বাচ্চু মণ্ডলের বাড়ির নতুন টিনের চালা রোদে ঝিলিক দিচ্ছিল, বাড়ির খলায় নতুন টিউবঅয়েল দেখা যাচ্ছিল, সেই পানে ছুটে যাচ্ছিল মধু – চষা জমির মাটির ঢেলায় হোঁচট খেতে খেতে, আর ‘মোক এক ফোঁটা পানি দ্যাও রে’ বলে হামলাতে হামলাতে। কিন্তু পানির কল অব্দি পৌঁছুবার আগেই দড়াম করে পড়ে গিয়েছিল মধু, দুচোখের লাটা উঠেছিল উলটে, মুখে ছুটেছিল গাঁজলা। মধু মরেই যাচ্ছিল সেদিন।
তাই মধু কালাই মোকামতলা বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ছাড়িয়ে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে চলে যায় দুইশ মাইল দূরের 888sport app শহরে; সেখানে সে রেকশা ঠেলে, দিনে একশ ট্যাকা কামাই করে, রাত্রে সেই ট্যাকা বার বার গোনে, ট্যাকা কোন্টে লুকে থুবে থিত্ পায় না। এই করে দিনের পর দিন, টানা পনেরো দিন মধু রেকশা চালায়; কাওরানবাজারে তারা সাত জন ডাইভর থাকে জানালাবিহীন এক ঘরে, তাদের সঙ্গে বাস করে সাত হাজার মশা; মশারা গান গায়, মধুদের রক্ত শুষে খায় আর মধুরা মরার মতন ঘুমায়। খুব ভোরে যখন ক্লান্ত মশারা একেকটা নিঃসাড় রক্তবিন্দু, ঘুম ভেঙে যায় মধুদের; প্রকৃতি তাদের ডাকে, তারা পেটের ভিতরে মেঘের গর্জন শোনে, তারা বেরিয়ে পড়ে দল বেঁধে, পাছার তবন মাথায় তুলে কালো কালো চরপটা উন্দা করে সারি ধরে বসে যায় কাজি নজরুল ইসলাম অ্যাভেন্যুর ধার ঘেঁষে, কেউ বা সোনারগাঁও হুটালের গেটের সামনে। তারা খবরের কাগজ দিয়ে গোয়া মোছে কারণ পানি নাই, খালি যে ছোঁচার পানির অভাব তা নয়, মধুরা গোসল করার পানিও পায় না; টানা পনেরো দিন মধু গা ধোয় না, নিজের গায়ের দুর্গন্ধে তার মাঝে মাঝে বমন চলে আসে, বিশেষ যখন খুব রোদ আর 888sport appর আকাশে হাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এই করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কিন্তু কী সুখ, কী সার্থকতা! টানা পনেরো দিন পর যখন মধু মদিনার কাছে ফিরে যাবে, তখন তার কোমরে কমপক্ষে পনেরোশ টাকা! তারপর অন্তত মাসখানেক আর 888sport appর কথা মুখে আসবে না মধুর।
* * *
মধু 888sport app শহরে যায়; পান্তাভাত ফুরিয়ে গেছে, ঘরে আর চাউল নাই, মদিনা শূন্যহাতে বসে থাকে ছন্নছাড়া চুলার পাড়ে। তখন গাছের ডালে কোকিল ডাকছিল, মদিনা শুনতে পাচ্ছিল না, মফিজ শুনতে পাচ্ছিল; কোকিল ডাকবে আর মজিদের কান সেই ডাক শুনতে পাবে না এমন কখনো হয় না। মধু যখন সড়কের তেমাথা পার হয়ে উপজেলা সদরের দিকে চলে যায় তখন তার ঘরের পিছন থেকে ভুলকি মারে মফিজ। চুলার পাড়ে বেকার বসে থাকা মদিনাকে দেখতে পেয়ে কুয়ারা করে, ‘মধু ভাই 888sport appত্ গেছু?’
মদিনা ঘাড় ফেরায়। পুলকিত মফিজ বলে, ‘কী সমচার, মদিনা?’
‘মতলব কী?’ মদিনা গম্ভীরভাবে ধমকায় মফিজকে, ‘পিটন খাওয়ার হাউস হোছে?’
‘তুই যদি লিজ হাতে পিটিস,’ মফিজ সব দাঁত বের করে নির্ভয়ে এগিয়ে আসে আর বলে, ‘জিন্দেগি মোর সুভাগ্য হয়া যাবে।’
‘বাড়িত্ যা।’ মদিনা আরো গম্ভীর।
‘চাকরি করবু, মদিনা?’ মফিজ ফুসলায়।
মদিনা কিছুই শুনতে রাজি নয়, সে মফিজকে শাসায়, ‘চলে যা কনু।’
মফিজ রাগান্বিত হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘গায়ে পড়ে উপকার করব্যা আসনু, আর তুই গরুর মতন খেদায়া দেস?’
মদিনা গুরুতর ভঙ্গিতে বলে, ‘কিসের উপকার?’
মফিজ রহস্য করে, ‘ট্যাকা পাবু, গম পাবু। করবু নাকি চাকরি?’
‘কী চাকরি?’
‘বকরি খেদাবু।’ বলে মফিজ, বলার পর সে হেসে ফেলে, কিন্তু হাসতে চায়নি।
মদিনা রেগে যায় খুব, ‘দূর হ হারামজাদা! কুয়ারা করার আর মানুষ পাসনি?’
মফিজ তড়িঘড়ি ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করে; হাসি বন্ধ করে খুব কেজো একটা ভঙ্গি নেয়, ‘কুয়ারা লয় মদিনা, সত্যি! কুনো কাম নাই, খালি গরু-বকরি খেদাবু।’
‘খুলে ক দিনি, এডা আবার ক্যাংকা চাকরি?’
মফিজ খুলে কয়, ‘সড়কের দুই ধার দিয়ে গাছ লাগাছে দেখিসনি? ওই গাছগুলা পাহারা দেওয়া লাগবে, গরু-বকরি য্যান খায়া না ফালায়। এই হলো চাকরি। ট্যাকা দিবে, গমও দিবে। গম বেচে চাউল কিনবু। ট্যাকা দিয়ে কিনবু গরুর গোশ্ত, তেলাপিয়া মাছ…’
‘থাম থাম।’ মদিনা মফিজকে থামায়, তার চোখেমুখে সন্দেহের ঢেউ খেলে যায়, সে চোখ ছোট করে কপালে ভাঁজ তুলে জেরা আরম্ভ করে, ‘এত মানুষ থাকতে এই চাকরি মোক কে দিবে রে?’
‘ক্যা, মুই বেবস্তা করে দিমু। চিয়ারম্যানের হাত-পাও ধরে মুই কমু…।’ মফিজ অকারণে থামে।
‘ক, থামলু ক্যা?’
মফিজ হাসে আর কয়, ‘চিয়ারম্যানের হাত-পাও ধরে মুই কমু, চাচা মিয়া চাকরিডা মদিনাক্ দ্যাও, মদিনার মতন ভালো মেয়া আর ঢুঁড়ে পাবিন না…।’
খিল খিল করে হেসে ওঠে মদিনা। পগারের উপর দিয়ে শীতল বাতাসের ঢেউ এসে চলে যায়। কড়ুই গাছের ডালে কোকিল ডেকে ওঠে। মফিজ সে গাছের দিকে চেয়ে একবার কোকিলকে দেখে নেয়। তারপর মদিনার মুখের দিকে চেয়ে উদাস সুরে বলে, ‘কুকিলে কী কয়, জানিস?’
‘কী কয়?’ মদিনার মুখে হাসি, সে জানে মফিজ এখন কী বলবে।
মফিজ বলে, ‘কুকিল কান্দে। কান্দে আর কয়, মোর কুকিলা কোন্টে চলে গেল?’
খিল খিল করে হেসে ওঠে মদিনা। তার হাসি শুনে ক্ষেপে যায় কড়ুই গাছের কোকিল।
কোকিলের মনের কথা বলে মফিজ, ‘ইংকা কোরে হাসিস ক্যান, মদিনা?’
‘মুই হাসলে তোর কী হয়?’ নটীর মতন ভুরু নাচিয়ে শুধায় মদিনা।
‘বুকের হাড়হাড্ডি ভ্যাঙ্গেচুরে জিউ উড়ে যাবার চায় রে!’
মদিনা শরীর দুলিয়ে হাসে, মফিজ কড়ুই গাছের দিকে চেয়ে দেখে কোকিলটা উড়ে চলে গেছে।
* * *
888sport appয় দিনভর বৃষ্টি হচ্ছিল, রিকশা চালাতে চালাতে মধুর গোসল হয়ে যাচ্ছিল। সারা দিন ভিজতে ভিজতে মধুর শরীরের সমস্ত তাপ বেরিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় তার শরীর এত তাপ কোত্থেকে ফিরে পায় মধুর মালুম হয় না। মধুর শীত লাগে, তার গা থর থর কাঁপে। মধু অন্ধকার ঘরের মেছেতে গড়াগড়ি খায়, বাচ্চা ছেলের মতো মা মা বলে গোঙায়। তখন শিমুলিয়া গ্রামে বৃষ্টি হচ্ছিল না, আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল আর কড়ুই গাছের ডালে কোকিল ডাকছিল। মফিজ মদিনার ঘরের জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে ডাকছিল, ‘মদিনা, ও মদিনা!’ মদিনা ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসেছিল, নিজের বুকে থুক থুক করে থুথু দিয়ে সে ভয় তাড়াবার চেষ্টা করেছিল আর মফিজ ‘এডা মুই, মফিজ, মফিজ!’ বলে বাতাসে শিস কেটে চলেছিল। 888sport app শহরে বিদ্যুৎ নিভে গিয়েছিল, বাক্সের মতন জানালাহীন যে-ঘরের মেঝেতে মধু একলা গড়াগড়ি খাচ্ছিল, কাঁপছিল আর গোঙাচ্ছিল, সেখানে দোজখের আঁধার নেমে এসেছিল, মধুর মনে হচ্ছিল সে মারা যাচ্ছে। শিমুলিয়া গ্রামে কড়ুই গাছের ডালপাতার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে কয়েক টুকরা জ্যোৎøা এসে পড়েছিল মদিনার ঘরের জানালায়, যার বাইরে ভূতের মতন দাঁড়িয়ে ছিল মফিজ আর ভিতরে মদিনা। জ্যোৎøার আবছায়ায় তখন মদিনার সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছিল, তার চোখের তারাদুটি জ্বলছিল, সে মফিজের সঙ্গে কপট রাগারাগি করছিল আর বলছিল যে, মধু ফিরে এলে সে তার কাছে নালিশ দেবে, মধু মফিজের হাড়হাড্ডি গুঁড়া করে পাউডার বানিয়ে গায়ে মাখবে। এই কথা বলতে বলতে মদিনা মুখ চেপে হেসেছিল আর মফিজ বলেছিল যে মধু আর শিমুলিয়া ফিরে আসবে না, সে 888sport appয় মরে যাবে; কারণ, মফিজ মদিনাকে বলেছিল, ‘তোর আর মোর কপাল একসাথে লেখা হোছে। মোক ছাড়া তোর গতিক নাই মদিনা।’ তখন জানালার শিক গলে ডান হাত বের করে মদিনা মফিজের বুকে ঠেলা মেরে বলেছিল, ‘বাড়িত্ যা রে গরুডা!’ মদিনার হাতটি খপ করে চেপে ধরে মফিজ বলেছিল, ‘তুই জানিস না, কিন্তুক মুই ঠিকি জাঁনো মদিনা, তোর কপালত্ মুই আর মোর কপালত্ তুই ছাড়া আর কেচ্ছু নাই।’ মদিনার মনে হয়েছিল মফিজের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মফিজ নিজের ঘরে ফিরে যেতে যেতে স্বপ্ন দেখছিল যে মধু 888sport appয় মারা গেছে। ‘মারা গেছে, হারামজাদা মধু মারা গেছে’ বলে মদিনার স্বামীর মৃত্যু-কামনা করতে করতে মফিজ নিজের ঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছিল। মধুর যখন খুব শীত লাগছিল আর গা ভীষণ কাঁপছিল, তখন সে আল্লাকে ডেকে ডেকে বলেছিল, ‘জানে মারিস না খোদা। এবারের মতন বাঁচায়ে দে। জিন্দেগিতে আর 888sport appত্ আস্মু না।’ পরদিন সকালেই মধুর জ্বর সেরে যায়, সে দেখে বৃষ্টি নাই, আকাশ ঝকঝকে নীল, দালানকোঠাগুলো হাসছে। মধু আল্লার কাছে খাওয়া কসমের কথা ভুলে যায়, সেদিন বিকালেই রেকশা নিয়ে বের হয়, আগের রাতের হাড়কাঁপানো জ্বরের কথা 888sport app download for android করে সে মনে মনে হাসে। ওইদিন ভোরে মফিজ মধুর বাড়ির আঙিনার পৈথানে পা রেখে চাপা স্বরে ডাক দিয়ে বলেছিল, ‘মধু ভাই, 888sport appত্ থে ফিরে আছু?’ কিন্তু মফিজ বিলক্ষণ জানত, মধু যদি ঠিক ঠিক পনেরো দিন পর ফিরে আসে তবে আরো তিন দিন পড়ে রয়েছে সামনে।
* * *
মধু যেদিন শিমুলিয়া ফিরে আসবে তার ঠিক দুই দিন আগে গুলশান দুই নম্বরের ভিতরের দিকে এক পেসেনজার নামিয়ে দিয়ে রাস্তার পাশের একটা দোকানে চা খেতে যায়। চায়ের কাপে দুই চুমুক দিয়ে সে পিছু ফিরে দেখে তার রিকশাটি উধাও। প্রথমে মধুর বিশ্বাস হয় না, ভাবে কেউ হয়তো মশকরা করে তার রিকশাটি কাছেই কোথাও সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু না, ঘটনা ওরকম সরল নয়। রিকশা উধাও মানে গুরুতরভাবে উধাও। মধু রিকশার মালিকের কাছে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করে। মালিক মধুর দিকে আঙুল তুলে তার লোকজনকে হুকুম দেয়, ‘হালারে বান্দ্!’ এবং হুকুমপ্রাপ্তরা কাজে নামার আগেই মালিক স্বয়ং মধুর পেটে দড়াম করে একটা লাথি বসিয়ে দেয়, ‘বান্দীর পুত, আমার গাড়ি কো?’ মধুর মুখ দিয়ে ‘ওক্’ ধ্বনি বেরিয়ে আসে, সামনে ঝুঁকে পড়ে সে একহাতে নাকমুখ চেপে ধরে। মালিকের এক চ্যালা ছুটে এসে মধুর ঘাড়ের উপর প্রায় চড়ে বসে ঝাঁকাতে শুরু করে, ‘ক হালার পুত, ওস্তাদের গাড়ি তোর কোন বাপের কাছে বেইচ্যা দিছস?’ ওস্তাদ চিৎকার ছাড়ে, ‘হালারে আচ্ছামতন বানায়া ল আগে।’
মধুকে প্রায় লাশ বানিয়ে ১৩ শ ২৫ টাকা, মানে তার রোজগারের সমস্তটাই কেড়ে নিয়ে পুলিশের হাতে মধুকে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ মধুকে থানায় নিয়ে টাকার লোভে আরো দুটা বাড়ি মারে, কিন্তু শিগগিরই তারা বুঝতে পারে যে ওকে ছাড়ানোর জন্য টাকা নিয়ে কেউ আসা দূরে থাক, রিকশার মালিক ও তার লোকেরা পিটিয়ে ওর যে হাল করেছে তাতে থানার ভিতরেই ওর মৃত্যু হতে পারে। তাহলে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে খবরের কাগজে লেখালেখি, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হৈচৈ…কী দরকার। মধুকে থানার দরজা থেকে বের করে দেওয়া হয়। মধু হাঁটতে পারে না, থানার সামনের রাস্তায় পড়ে পড়ে গোঙায়। পুলিশের তাতে অসুবিধা ও বিরক্তি বোধ হয়; তারা একটা পিক-আপ ভ্যানে মধুকে তুলে নিয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরপাক খায়, আর এদিক-সেদিক টর্চ মেরে মধুকে ফেলে দেওয়ার জন্য সুবিধামতো জায়গা খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ তাদের একজনের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় : ‘কী রে?’ সে তার সহকর্মীদের বলে, ‘কার দোষে এই মাঝরাতে আমাগো এত কষ্ট?’ তারপর তারা মধুসুদ্ধ পিক-আপ ভ্যানটি নিয়ে বেগুনবাড়িতে সেই রিকশা-মালিকের বাড়ি কাম গ্যারেজে হানা দেয় এবং হুঙ্কার দিয়ে বলে, ‘আপনে তো মিয়া মাডার কইরা আসামিরে পুলিশে সোপর্দ করছেন!’ রিকশা-মালিক পুলিশের হুঙ্কারে তেমন বিকার দেখায় না, মুহূর্তেই ভিতরে গিয়ে বিশ হাজার টাকা নিয়ে ফিরে আসে, একজনের হাতের মুঠোর মধ্যে সে-টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, ‘বাইত্তে ক্যাশ আর নাই স্যার। ম্যানেজ কইরা লইয়েন।’ পুলিশের এক সদস্য ক্ষেপে ওঠে, ‘মিয়া ফাজলামো পাইছেন?’ এই ধমকের তাৎপর্য ঠিক ধরতে পারে না রিকশা-মালিক; তবে প্রবৃত্তিবশে সে আবার ভিতরে যায় এবং আরো বিশ হাজার টাকা নিয়ে আসে। তখন সে আরো জোরে ধমক খায়; এক পুলিশ ‘আন্ডার অ্যারেস্ট’ পর্যন্ত উচ্চারণ করে ফেলে, ফলে রিকশা-মালিক আবার ভিতরে যায়, এবার তার ফিরতে দেরি দেখে পুলিশের সদস্যরা সন্দেহভরা চোখে পরস্পরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। তবে তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আগেই রিকশা-মালিক ফিরে আসে হাতে ব্যাংকের চেক বইয়ের একটা পাতা নিয়ে। এসে বলে, ‘স্যারেরা, একসিডেন একটা হইয়া গেছে, দোষ আমারই, কিন্তু আমি চাইনি যে হে মইরা যাউক। এই যে তিন লাখ লেইখ্যা দিছি।’ পুলিশ সদস্যরা তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘মিয়া, যদি বাঁচবার চাও, কাল সকালে ক্যাশ পাঁচ লাখ নিয়া থানায় আসবা। চেক-ফেক আমরা লই না।’ রিকশা-মালিক বলে, ‘লাশের বেবস্থা?’ পুলিশ সব ভার নিজের কাঁধে নেয়, ‘সেটা আমরা দেখতাছি।’ কিন্তু মধু তখনো লাশে পরিণত হয়নি। পিক-আপ ভ্যানের পিছনে মেঝেতে ঘাড়টা একটুখানি বাঁকা করে চিৎপাত পড়ে থেকে সে অশক্ত, পীড়িত বিড়ালছানার মতো জুলজুলে চোখে তাকাচ্ছিল। তার নিভন্ত চোখের তারায় তখনও প্রাণের শিখা একটুখানি ছিল। রমনা পার্কের এক কোণে পুলিশের পিক-আপ ভ্যান থেকে মধুকে যখন সযত্নে নামিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে শুইয়ে রেখে যাওয়া হয় তখন শেষ রাত। পিক-আপ ভ্যানের যান্ত্রিক শব্দ দূরে মিলিয়ে যাওয়ার পর কয়েক মুহূর্ত নৈঃশব্দ, তারপর হঠাৎ মসজিদের মাইকে ফুঁ এবং জলদগম্ভীর কণ্ঠে আল্লাহু আকবর। আজানের শব্দে মধুর চোখদুটি একটুখানি খুলে যায়। সে দূরে কম্পমান আলো দেখতে পায়। একটি হাত নাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু হাত নড়ে না। মধু পা নাড়ানোর চেষ্টা করে, পা নড়ে না। মধু মুখে শব্দ করার চেষ্টা করে; জোর করে বলে ওঠে, আল্লাহ্। কিন্তু বাতাসে মধুর কণ্ঠ বাজে না।
* * *
মধু মারা যাবে আর মদিনাকে চিরজীবনের জন্য পেয়ে যাবে মফিজ – এই কথা লেখা আছে মদিনা ও মফিজের নসিবে। মদিনা বিশ্বাস করে না, কিন্তু মফিজের বিশ্বাসে এক রতি খাদ নাই। কিন্তু কেন যে মফিজ মধুর ফিরে আসার দিন গোনে, তা একমাত্র সে-ই জানে। ঠিক পনেরো দিন পর ফিরে এলে যেদিন মধুর বাড়ি পৌঁছার কথা, তার দুই রাত আগে মদিনার জানালায় দাঁড়িয়ে মফিজ আরো একবার বলেছিল যে মধু আর ফিরবে না। সে 888sport app শহরেই মারা যাবে; আর গরিব মানুষ অত দূরে গিয়ে মারা গেলে তাদের লাশ পাওয়া যায় না, সুতরাং মদিনার সঙ্গে মধুর আর দেখা হচ্ছে না। মফিজ যখন মদিনাকে এইসব কথা বলছিল, তখন 888sport appর রাস্তায় পিক-আপ ভ্যানের মেঝেতে মধু চেতন-অচেতনের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। মফিজের এসব অলক্ষুণে নিষ্ঠুর কথার প্রতিবাদে মদিনা তার বুকে ও ঘাড়ে খামচিয়ে রক্ত বের করে; আবার মফিজ আর্তনাদ করে উঠলে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ‘আহারে, জ্বলে যাওছে?’ বলে সোহাগ প্রকাশ করে। মফিজ অভিমান করে চলে যেতে চাইলে মদিনা তার কাঁধ আবার খামচে ধরে বলে, ‘কাল আসিস, পরদিন তাঁই কিন্তুক চলে আসপে!’
পরদিন রাতে কড়ুই গাছে কোকিল ডেকে ওঠার আগে মদিনার ঘরে তিনটা ভূত আসে। রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে তারা ফিসফিস করে বলাবলি করছিল যে মধু নাই, ‘চ, মধুর বউওক্ খায়া আসি।’ এই ভূতেরা শুধু স্ত্রীলিঙ্গের মানুষ খায়; ৮ বছর বয়েস থেকে ৫৮ বছর বয়েসি 888sport promo codeদের যাকে যেখানে মওকামতো পায়, খেয়ে ফেলে। এই তিন বিখ্যাত ভূত উপজেলা সদরে থাকে, মধু নাই এ-খবরের সত্যাসত্য যাচাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর তারা শিমুলিয়া আসে, মধুর ঘরে মদিনাকে সত্যই একলা পায়, পেয়ে খাওয়া শুরু করে। তারা মদিনাকে পালাক্রমে খেতে থাকে। প্রথম ভূতের পর দ্বিতীয় ভূত, তারপর তৃতীয় ভূত, তারপর আবার প্রথম ভূত। এভাবে পালাক্রমে মদিনাকে খাওয়ার এক পর্যায়ে মফিজের আবির্ভাব ঘটে, মদিনা মফিজকে দেখে সাহায্যের আশায় আর্তনাদ করে, এক ভূত তার নাকমুখ এমন করে চেপে ধরে যে শব্দ কেন, নিশ্বাসও বেরুতে পারে না। তার উপর আরেক ভূত দুই হাতে দশটা আঙুলে চেপে ধরে মদিনার টুঁটি; মদিনা চারদিকে হাত-পা আছড়ায়, গোঁ গোঁ করে, তার জিভ বেরিয়ে আসে, তার চোখের তারা দুটি খুলে বেরিয়ে আসতে চায়; তাই দেখে এক মফিজ চড়াও হয় তিন ভূতের উপর, দুই ভূত মফিজকে পাঁজাকোলা করে ধরে তুলে মাটিতে আছাড় মারে; মফিজের গলা থেকে কোঁৎ শব্দ বেরিয়ে আসে, সে চোখে আন্ধার দেখে; এক ভূত আধখানা ইট তুলে নিয়ে মফিজের মাথায় মারে, ফটাস শব্দে ফেটে যায় মফিজের খুলি, তাতে ভূতের উৎসাহ বেড়ে যায়, সে ইটটি দিয়ে মফিজের মাথা মেঝের সঙ্গে ছেঁচতে থাকে।
তখন কড়ুই গাছের ডালে কোকিল ডেকে ওঠে। বসন্তের রাতে কোকিলের ডাকের কী মানে হয় ভূতেরা জানে না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.