এ নাট্য দর্শনান্তে ক্ষমা ও প্রাচ্য দুটি ভিন্ন শব্দ পারস্পরিক বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয়ে দর্শকের মনে সমান্তরাল হয়ে যায়। ক্ষমা মানবের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের একটি আর প্রাচ্য ভৌগোলিক সীমানার দিকনির্দেশক। কিন্তু সেলিম আল দীন রচিত ‘প্রাচ্য’ নাটকে এ দুটি শব্দ একে অন্যের যথার্থ বিকল্পরূপে সমার্থক শব্দমালায় অঙ্গীভূত হয়। প্রাচ্য মূলত একটি ভৌগোলিক ধারণা, এর বিপরীত ধারণা হলো পাশ্চাত্য। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এই যুগল ধারণা যখন এক সরলরেখায় দাঁড়ায় তখন তা ভৌগোলিক বিভক্তির সীমা ছাড়িয়ে এই দুই প্রান্তের মানুষ, তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম ও আচার, তাদের মূল্যবোধ ও মানবিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিবেচনায় বিস্তার লাভ করে। সেলিম আল দীনের ‘প্রাচ্য’ও তেমনি তার নিজস্ব ভূখণ্ডের দেয়াল টপকিয়ে প্রাচের ভূমিতে বিস্তৃত হয়। প্রাচ্য তখন এই গাঙ্গেয় অববাহিকারই বর্ধিত জনপদে পরিণত হয়। আর এই সমগ্র জনপদকে এক সূত্রে গেঁথে দেয় যে মানবীয় মহত্ত্ব তা হলো ক্ষমা। ‘প্রাচ্য’ নামের নাট্যকর্মটি আমাদের 888sport app download for android করিয়ে দেয় প্রাচ্যতটের মানুষেরা ক্ষমাশীল। চরম অপ্রাপ্তি বা ভাঙনের মুখে কিংবা প্রচন্ড ক্রোধ ও আক্রোশকেও তারা প্রতিহিংসার আগুনে নয় বরঞ্চ ক্ষমার শীতল লড়াইয়ে জয় করে নেয়।
‘প্রাচ্য’ নাটকের মূল চরিত্র সয়ফর চান। কোনো এক ভাসান পালার আসরে দর্শকের সারিতে বসে থাকা নোলক নামের মেয়েকে কোন নিমিত্তে সয়ফর চান সেদিন দেখেছিল সে তা জানে না। তবে নোলকের সরল সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে। দরিদ্র দিনমজুরের সন্তানের সেই মুগ্ধতা পরিণতি পায় পরিণয়ে। সয়ফর আর নোলক বিবাহের বর ও কনে। বিবাহস্থান কাজলাকান্দি। বরযাত্রীর বিলম্বিত আগমনে উত্তীর্ণ মধ্যরাতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। তারপর কনেসহ বরযাত্রীদের ফিরতি যাত্রা। বিবিধ কথা, পদ আর নাচাড়ির দীর্ঘ গীতল বর্ণনার ভেতর দিয়ে সয়ফরের বরযাত্রা কাজলাকান্দি থেকে নানা পথ, নদী বাঁক আর মাঠ পার হয়ে নোলককে নিয়ে তাদের নিজস্ব গ্রামে ফেরে। অতঃপর সয়ফর-নোলকের বাসর। বুনো জোছনা দরিদ্র দিনমজুরের বেড়ার ফাঁক গলে সঙ্গী হয় তাদের। টিমটিমে কুপিটাকে দীর্ঘ ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে সয়ফর এক অজানা ভীতি ও শঙ্কা নিয়ে পাশ ফেরে নোলকের দিকে। আর লক্ষিন্দরের সপডঙ্কের পুরাণ পাশ ফিরে শোয় একই পালঙ্কে তখন। সেলিম আল দীনের পাঁচালী ঢঙের বর্ণনাংশের নাচড়িতে শোনা যাক এর বর্ণনা
সেই দূর অতীতে চন্দ্র বণিকের
শব ভাসানের গল্প
বাসর জাগর সুতানলী সৰ্পডঙ্ক
দিন মজুরের ঘরে
পাশ ফিরে শোয়
এখানে বিপরীত পুরাণ
বেহুলাকে ডংশিছে নাগ
কাঁদে লখিন্দর
নোলক সর্পডঙ্কগ্রস্ত সয়ফরের জীবনপণ সেই ডঙ্ককারী বাস্তুসাপ সোমত্ত গোক্ষুরের বিষ নামাবে।
মালেক ওঝা আসে,
প্রণমহ বিষহরি। বিশ্বরূপা বিশ্বেশ্বরী। তুমি দেবী জগন জননী। তুমি দেবী হরসুতা। আস্তিকস্য মুনির মাতা। নাগমাতা ভুবন মোহিনী। তুমি শিবের নন্দিনী। ত্রিভুবনে উদ্ধারিণী। যোগ নিদ্রা যোগ সনাতনী। অষ্টনাগ সঙ্গে লয়ে। পূজা স্থানে নাম গিয়ে। সেবকের নিস্তারকারিণী। চতুর্থে প্রজাপতি। তোমাকে করেন স্তুতি। স্তব করে।
মালেক ওঝার মন্ত্র, অশোক বৈদ্যের প্রতিবেশীর তুকতাক ব্যর্থ হয় সকলি। নোলকের মৃত্যু হয়। কাফন দাফনের সকল কৃত্য সম্পন্ন হয় যথারীতি। নয়া বৌয়ের অকাল অপপ্রয়াণে তখন হঠাৎই সয়ফর প্রচণ্ড ক্রোধগ্রস্ত খুন করবো তরে। খুন খুন করবো তবে। দিনমজুরের শ্যাষ জমি বন্ধক রাইখ্যা যে বিয়া করছি তার শেষ কড়ির বৌটারে ছিনায়ে তুললি তুই। সয়ফর প্রতিজ্ঞা করে ইন্দুরের গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে মাটির অন্তরে প্রবেশ করে ধরে আনবে সেই বাস্তুসাপ গোক্ষুরাকে, তারপর তাকে খুন করে তবে সে অন্ন স্পর্শ করবে। শুরু হয় খনন। নাট্যকার এই খননকে আখ্যা দিয়েছেন আমাদের জীবনেরই এক অনিবার্য খননরূপে। সারা রাত্রির দীর্ঘ খনন শেষে সয়ফর সাপটিকে খুঁজে পায়; দুজন দুজনের মুখোমুখি। একজনের ফণা আছে অন্যজনের মাথা ফণার চেয়ে তীক্ষ্ণ। কে কাকে খুন করবে! সাপটি হিশশ করে একবার ছোবল হেনে দেয়। ত্বরিত সরে যায় সয়ফর। সয়ফর আবার একটু এগিয়ে যায়। সাপটি সরে যায় আর একটু। সেও শক্তি সঞ্চয় করে সয়ফরকে আরো নিশ্চিতভাবে আঘাত হানার নিমিত্ত। পুরো গর্ত থেকে গা বার করা তার। নিশ্চিত হয়ে ছেনি ঘুরাবে এমন সময় দাদির হাত এসে খপ করে ধরে সয়ফরের হাত। না এইটা বাস্তুসাপ। খবদ্দার। সয়ফর জানত না তাকে ঘিরে পেছনে দাঁড়ানো দাদি সাইদল সুরুতালি রত্না রূপালি। দাদি অদূরবর্তী উদ্যত ফণা সাপটির উদ্দেশে বলে- অই হারামজাদা। ফণা নামা। একটারে খাইছাস আর কী চাস? যা যা।। সয়ফর বুঝতে পারে সে এপারে সাপটি ওইপারে। মাঝখানে শাদা শাড়ি পরা দাদি প্রশান্ত জলস্রোত। ওই পারে বহুদূরে সাপ। দিগন্তরেখার কাছে কালবৈশাখির ক্রুদ্ধ রঙে রাঙা মেঘ। যে যার স্থানে থাকে। এই ছেনি অত দীর্ঘ না যে সে এক গাঙ পারায়া দিগন্তরেখার কাছে উদ্যত সাপের মাথা কাটবে। থরথর করে কাঁপে সে। শ্রমে অনাহারে অনিদ্রায় তার জ্বর উঠে শরীরে। দাদি কপালে হাত দেয়। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে সাপটাকে। এমনকি চড় থাপড় দেবার ভয়ও দেখায়। তখন সাপটি ধীরে ফণা নামায়। তারপর নোলকের নতুন কবরের উপর দিয়ে শ্লথ গতিতে বন্য অন্ধকারে চলে যায়। সৌন্দর্য ভয় ও রহস্য সবার অন্তরে সম্ভ্রম জাগায়। হত্যা ভুলে যায় তারা। সবাই অপলক সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
এভাবেই শেষ হয় 888sport app থিয়েটারের প্রযোজনা সেলিম আল দীন বিরচিত ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত নাটক ‘প্রাচ্য’। মূলে ‘প্রাচ্য’ একটি বিদিত পুরাণের বিপরীত পাঁচালী। এ নাট্যের পাঁচালীকে নাট্যকার যেমন কালের সামনে ঘষামাজা করেছেন নির্দেশকও তেমনি মঞ্চে তা প্রয়োগে এনেছেন আধুনিকতা। নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ এ নাটকের প্রয়োগপূর্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে:
‘প্রাচ্য’ নাটকটিকে এযাবৎকালে আমার নির্দেশিত নাটকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল বলে মনে করি। মূলত তিনটি কারণে এই জটিলতার উদ্ভব হয়েছে। প্রথমত, এর ভাষা, দ্বিতীয়ত, এর রচনাশৈলী এবং তৃতীয়ত, এর দর্শনগত উপস্থাপনা কৌশল। এর বক্রতা, বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্য ক্রমাগত গঠনগত দিক থেকে নাটকটির মঞ্চে উপস্থাপন প্রক্রিয়াকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে। কিন্তু বাংলা লোকনাট্যের একজন একান্ত অনুগত শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি, যা কবির মনন, কল্পনা ও লেখনীতে সম্ভব বাংলা নাট্যমঞ্চ তা ধারণের ক্ষমতা ধরে।
‘প্রাচ্য’-র মঞ্চ প্রয়োগ দেখলে নির্দেশকের এ দাবি অকপটে মেনে নিতে হবে। মহিলা সমিতির দর্শক বসবার সমতলে আড়াআড়ি একটি সামান্য উঁচু কাঠামো যার মাঝখানটা নদীর ঢাল হয়ে আবার সমতলে মিশে গেছে। ‘প্রাচ্য’ নিমিত্তে নির্মিত এরকম একটা মঞ্চে এর অভিনয় হয়। এখানেই জনপদ, নদী, বিবাহবাসর, ভাসানপালা এবং মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ইঁদুরের গর্ত খোঁড়া, গোক্ষুরের সাথে ভয়াল মৃত্যুখেলা সবই হয় অনায়াসে। বাংলা নাট্যমঞ্চে নাসির উদ্দিন ইউসুফের হাতে এইসব প্রায় অসম্ভব উপাদান নাট্যক্রিয়ায় সৃজিত হয়ে অংশ নেয় প্রাচ্যের অভিনয়ে। প্রাচ্যের প্রয়োগ ভাবনায় তিনি যোগ করেছেন তার পূর্ববর্তী নাট্যকলার সাথে এক নতুন মাত্রা। বর্ণনাত্মক রীতির কথকের চোখকে তিনি দর্শকের চোখ থেকে ফিরিয়েছেন চরিত্রের দিকে। এ নাট্যে কথক হয়েছে অধিকতর চরিত্রঘনিষ্ঠ। এ বিষয়ে তাঁর নিজের ব্যাখ্যাটা এরকম,
আমার কাছে মনে হয়েছে একজন কথক যদি হয়ে ওঠেন তাঁর মুখোচ্চারিত কথাসংশ্লিষ্ট চরিত্রটির গভীর অনুভূতি বা অনুভবের চিত্রকল্প তাতে কথক নামক অভিনেতার অভিনয়ে একটি বিশেষ নান্দনিক মাত্রা যোগ হতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, এর মাধ্যমে আমি আমাদের চিরায়ত ও লোকজ অভিনয়রীতির সাথে স্তানিস্লাভস্কি প্রবর্তিত অভিনয়রীতির সংমিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছি।
অভিনয়রীতির এরকম সফল নিরীক্ষা মঞ্চকে ঋদ্ধ করেছে, বিস্তৃত করেছে এর সীমানা। যারা এই অভিনয়রীতি মেনে অভিনয় করে সফল করেছেন এই নিরীক্ষা, তারা প্রত্যেকেই একেকজন মহৎ 888sport live chatী। মহত্তর 888sport live chat গঠনে 888sport live chatীর মহৎ প্রাণের প্রয়োজন অনিবার্য। 888sport appsের নাট্যমঞ্চের ‘মঞ্চকুসুম’ খ্যাত শিমুল ইউসুফ সেই অনিবার্যতাকে সম্যক বুঝে তার প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন কখনো বেউলা, কখনো কনিকা বা কখনো কথকের ভেতর। সয়ফর নোলকের প্রণয় ও নোলকের প্রয়াণের দুঃখ-বেদনা দর্শকের মনে যে সুরে বাজে যে লয়ে যে তালে যে মূর্ছনায়, শিমুল ইউসুফ তার কণ্ঠ তার সুর তার সঙ্গীত ভাবনা যথার্থই সেই তাল-লয়-মূর্ছনায় বাজিয়েছেন। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় খুব বড় মাপের অভিনেতা। তিনি মঞ্চে উঠলে মঞ্চটা ভরে যায় যেন। এ নাটকে কথকরূপে তিনি প্রকৃত কথক আর জিতু মাতব্বরের প্রাণ নিজের অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রকৃত জিতু মাতব্বর হয়ে উঠেছেন। চরিত্রের প্রাণকে নিজের প্রাণে প্রতিষ্ঠা করায় তার তুলনীয় 888sport live chatী হাতে গোনা। যারা মঞ্চে শহীদুজ্জামান সেলিমের অভিনয় দেখেননি তারা ‘প্রাচ্য’ দিয়ে শুরু করতে পারেন তার মঞ্চাভিনয় দেখা। মঞ্চে তিনি অসাধারণ। সয়ফর রূপী সেলিম এ নাটকে অনন্য। সয়ফর ও সেলিম, প্রাচ্য ও ক্ষমার মতোই সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। সয়ফর-এর প্রাণ এসে স্থাপিত হয় শহীদুজ্জামান সেলিমের প্রাণে। সে কারণেই সেলিম অভিনয়ের সহজ কৌশলে অনায়াসেই সয়ফর হয়ে যায়। একেই বলে জাত অভিনেতা। আর রোজী সিদ্দিকী? অভিনয়শেষে আমার তাকে বারবার নোলক বলে ডাকতে ইচ্ছে করেছে। নোলকের মৃত্যুর সমবেদনা তাকে জানাতে ইচ্ছে হয়েছে বারবার। তিনি নোলকের সারল্যকে যথাযথ ধারণ করতে পেরেছেন বলেই আমার এরকম মনে হয়েছে। দাদির চরিত্রে নাসরিন নাহার দাদির অর্ধবয়সী হলেও অভিনয়ে দাদিরই প্রকৃত অনুরূপ। তিনি প্রমাণ করেছেন বয়স নয়, অভিনয় মন দিয়ে করতে হয়। এ নাটকের সহকারী নির্দেশক ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন দেশ নাটক-এর ইশরাত নিশাত আর দ্রব্য সম্ভারে রাহুল আনন্দ। তিনি প্রাচ্যনাট-এর। এক দলে অন্যদলের গুণী কর্মীর এই নিবেদন 888sport appর মঞ্চের একটা চল। বিষয়টা খুব আনন্দের। ‘প্রাচ্য’ নিয়ে আজ এটুকু।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.