মূল : আবদুলরাজাক গুরনাহ

888sport app download apk latest version : এলহাম হোসেন

হামিদের একসময় মনে হতো, এই দোকানই ওর ঘরবাড়ি আর ওর জীবনটা বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে যাবে। একসময় ওর আর খারাপ লাগে না। গভীর রাতে বিড়বিড় করতে থাকা কথাও আর ওর কানে বাজে না। অথচ আগে এমন কথা শুনে ওর অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত। এখন ও জানে, ওরা মৌসুমি জলাধারের ওদিক থেকে আসে। জলাধারটা শহরের উপকণ্ঠকে মূল শহর থেকে আলাদা করেছে। আর ওই নিম্নাঞ্চলটা লোকে লোকারণ্য।

দোকানের লোকেশন ভালো। শহরের উপকণ্ঠ থেকে রাস্তাটা এসে যেখানে বড় রাস্তার সঙ্গে মিশেছে, দোকানটা ঠিক সেখানে। একেবারে কাকডাকা ভোরে ও দোকান খোলে আর সবশেষ লোকটা বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত সে দোকান বন্ধ করে না। হামিদ বলে, এখানে বসে ও জীবনের বয়ে চলা স্রোত দেখে। ব্যস্ততম সময়ে ও সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, ক্রেতার সঙ্গে হাস্যরস করে, ওদের মন জয় করার চেষ্টা করে, আর বেচাবিক্রিতে নিজের দক্ষতা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। একসময় ক্লান্তিতে ক্যাশবাক্সের ওপর ধপ্ করে বসে পড়ে।

একদিন সন্ধ্যায় মেয়েটা দোকানে এলো। তখন সে দোকান বন্ধ করার কথা ভাবছিল আর বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। মনে হলো, কে যেন ওর গলা চেপে ধরে মাটি থেকে শূন্যে তুলে ধরছে। মেয়েটি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে বিরক্তি।

উৎকণ্ঠার দীর্ঘ একটা মিনিট অপেক্ষা করার পর বলল, ‘ঘি।’ ‘হাফ শিলিং।’ কথা বলার সময় মেয়েটি ওর দিক থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালো। মনে হলো, ওকে দেখে বিরক্ত হয়েছে। এক ফালি কাপড় বগলের নিচ দিয়ে পেঁচিয়ে শরীরটা ঢেকেছে। নরম সুতি কাপড়ের পোশাক ওর শরীরের ভাঁজগুলো স্পষ্ট করে তুলেছে। কাঁধ খোলা। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। ওর কাছ থেকে পাত্রটা নিয়ে সে ঘিয়ের টিনে ডোবালো। মনের ভেতর কামনার আনাগোনা চলছে। হঠাৎ ব্যথা অনুভূত হলো। ঘিয়ের পাত্র ফেরত দিলে মেয়েটি ওর দিকে তাকায় চোখেমুখে অনীহা মাখিয়ে। ওর দৃষ্টি দূরে প্রসারিত হয়। চোখেমুখে ক্লান্তি অনুভব করে।  দেখলো, মেয়েটা বয়সে তরুণী। মুখটা গোলাকৃতির আর গলাটা পাতলা। কোনো কথা না বলে সে ঘুরে বড় বড় পা ফেলে বাঁধানো ড্রেনের ওপর দিয়ে চলে গেল। ড্রেনটা রাস্তা আর ফুটপাতের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। হামিদ তাকে চলে যেতে দেখে। ওর মনে হয়, পেছন থেকে ডেকে বলে, এই, সাবধানে যেও কিন্তু! ও কীভাবে জানবে যে, অন্ধকারে কোনো বিপদ ওত পেতে নেই? আবেগটা পেট থেকে গলায় এসে অস্পষ্ট শব্দ করে আটকে যায়। মনে মনে আশা করে, যদি সে পেছন ফিরে সাহায্য চাইত, কতই না ভালো হতো; কিন্তু সে শুধু ওর স্যান্ডেলের পটপট শব্দই শুনলো আর ও রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল।

মেয়েটার চেহারা আকর্ষণীয়। কতিপয় কারণে হামিদ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলা। নিজের ওপর বিরক্তবোধ করল। ওর দিকে অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে মেয়েটা তো ঠিকই করেছে। এ-কথা ভাবা মাত্রই ওর শরীর আর মুখ শুকিয়ে গেল। দিনে একবারের বেশি গোসল করার তেমন প্রয়োজন নেই। ঘর থেকে দোকানে যেতে ওর এক মিনিট লাগে। ও আর কোথাও যায় না। কাজেই গোসল করবে কেন? যথাযথ ব্যায়াম না করার কারণে ওর পাগুলোর আকৃতিও বিকৃত। দিন, মাস, বছর চলে যায় বন্দিদশায়। বোকার মতো খোঁয়াড়ে আটকে থাকা জীবন তার। রাতে ক্লান্তিতে দোকানের ঝাঁপ নামায়। ও জানে, এখন জঘন্য একটা রাত কাটবে ওর।

পরদিন বিকেলে মেয়েটা আবার ওর দোকানে এলো। হামিদ তখন একজন নিয়মিত খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলছিল। লোকটা বেশ বয়স্ক। নাম মনসুর। আশপাশে কোথাও থাকে। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যায় সে দোকানে গল্প করার জন্য আসে। চোখে তার ছানি পড়েছে। প্রায় আধা অন্ধ। তার এই অবস্থা নিয়ে লোকজন টিটকারি করে। নির্মম রসিকতা করে। কেউ কেউ বলে, মনসুর তো অন্ধ হবেই, কারণ ওর চোখভর্তি গু। ছেলেদের সে এড়াতে পারত না। হামিদ ভাবে, মনসুর ওর দোকানের আশেপাশে কিছু খুঁজছে না তো! তাকে ফলো করছে না তো! কিন্তু এটা মনসুরের প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছু নয়। মেয়েটা এগিয়ে এলে মনসুর কথা বলা বন্ধ করল। তারপর ট্যারা চোখে তাকিয়ে অল্প আলোতে ওকে ঠাহর করার চেষ্টা করল।

‘জুতা পলিশ করার রং আছে, কালো?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ’, হামিদ উত্তর দেয়। ওর গলাটা ধরে আসে। তাই একটু গলা খেকুর দিয়ে আবার বলে, ‘হ্যাঁ।’ মেয়েটা হাসে।

‘স্বাগতম আমার জানু। আজ কেমন আছো?’ মনসুর জানতে চায়। ওর উচ্চারণের স্বতঃস্ফূর্ততা আর গদগদ ভাব দেখে হামিদের সন্দেহ হয়, এটা আদৌ রসিকতা কি না, তাই ভেবে। ‘আহ! কী সুগন্ধিই না মেখেছো! কী সুরেলা কণ্ঠ তোমার, হরিণীর মতো বদন! সোনামণি, আমাকে বল, আজ রাতে তুমি কখন অবসর আছো? আমার পিঠে মালিশ করার জন্য একজন লোক দরকার।’

 মেয়েটা ওকে পাত্তা দিলো না। হামিদ দেখল, মনসুর বকবক করেই চলেছে। অশ্রাব্য রকমের প্রশংসা করছে। সময়ও ঠিক করতে চেষ্টা করছে। এসব দেখে তালগোল পাকিয়ে ফেলে হামিদ। পলিশের কৌটো খুঁজে পায় না। অবশেষে অবশ্য কৌটোটা পেয়ে যায়। ভাবে, যতক্ষণ সে কৌটো খুঁজেছে ততক্ষণ হয়তো সে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। তালগোল পাকিয়ে ওর ভালোই লেগেছে। হামিদ হাসে; কিন্তু ও ভ্রু কুচকে দামটা দিয়ে দেয়। মনসুর তার পাশে দাঁড়িয়ে বকবক করেই যাচ্ছে। মিষ্টি কথায় চিঁড়া ভেজানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। পকেটে পয়সা নাড়াচাড়া করছে। মেয়েটা একটা কথাও বলল না। বাসার দিকে রওনা হলো।

‘দেখো, দেখো, সূর্যটাও যেন ওর ওপর আলো বর্ষণ করতে সাহস পায় না। কেমন বুক ফুলিয়ে হাঁটে! কিন্তু আসল কথা হলো, ওকে কাবু করা সোজা।’ চাপা হাসিতে শরীর দোলাতে দোলাতে মনসুর বলে, ‘খুব শিগগির আমি ওকে পটিয়ে ফেলব। কত টাকা নেবে বলে তোমার মনে হয়? এ-ধরনের মহিলারা এমনই হয়। চোখে-মুখে অবজ্ঞা ছড়ায় … কিন্তু একবার যদি এদের বিছানায় নিতে পারো, তবে এরা বোঝে আসল জিনিসটা কী!’

হামিদ হাসে। তবে ওর মনে হয়, মেয়েটা এমন নয় যে, তাকে পয়সার বিনিময়ে ভোগ করা যাবে। সে তার কাজেকর্মে এতটাই চালু যে, সে বিশ্বাস করে না যে, মনসুর তাকে দিয়ে ওর মনোবাঞ্ছা চরিতার্থ করতে পারবে। ওর মন বারবার মেয়েটির দিকে ছুটে যায়। একা থাকলে ওর সঙ্গে হামিদ অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কল্পনা করে।

দোকান বন্ধ করার পর ফাজিরের সঙ্গে দেখা করতে যায়। কয়েক মিনিট সময় কাটায়। ফাজির বুড়ো। দোকানের মালিক সে। থাকে দোকানের পেছনে। ফাজির নিজের যত্ন নিতে পারে না। এক মহিলা এসে দিনের বেলা ওর সেবা-শুশ্রƒষা করে। বিনিময়ে দোকান থেকে বিনা পয়সায় জিনিসপত্র নিয়ে যায়; কিন্তু রাতে অসুস্থ বুড়ো মানুষটা চায় হামিদ কিছুক্ষণ ওর কাছে বসুক। যখন ওরা গল্পগুজব করে তখন মুমূর্ষু মানুষের গায়ের গন্ধ ঘরময় ভেসে বেড়ায়। ছোটখাটো ব্যবসায় নিয়ে বা স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করার জন্য বা গল্প করার মতো তেমন বেশি কিছু থাকে না। যখন মন খারাপ থাকে তখন ফাজির অশ্রুসিক্ত চোখে মৃত্যু এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনের কথা বলে। এরপর হামিদ বুড়োটাকে টয়লেটে নিয়ে যায়। ময়লার পাত্রটা পরিষ্কার আছে কি না, তা নিশ্চিত করে। তারপর চলে যায়। শেষ রাতের দিকে বুড়ো একা একা বিড়বিড় করে। কখনো কখনো মৃদু স্বরে ‘হামিদ’, ‘হামিদ’ বলে।

বাড়ির ভেতরে উঠোনে হামিদ ঘুমায়। বৃষ্টি হলে ছোট দোকানটার একপাশ খালি করে সেখানে ঘুমায়। রাতে ও একাই থাকে। কখনো বাইরে যায় না। এক বছরেরও বেশি সময় হলো ও দোকান ছেড়েছে। ফাজিরকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে যায়। ফাজির এখন বৃদ্ধ, শয্যাশায়ী। ফাজির তার সঙ্গে করে প্রত্যেক শুক্রবার ওকে মসজিদে নিয়ে যায়। লোকজনের ভিড়ের কথা হামিদের মনে পড়ে। ফেটে যাওয়া মেঝের যেদিক দিয়ে বৃষ্টির পানি বের হয়, তার কথাও হামিদের মনে পড়ে। ফেরার পথে বাজারে যায় ওরা। বুড়ো টসটসে ফলের কথা বলে; কখনো বা রঙিন সবজির কথা বলে। দোকান থেকে টুপ করে তুলে নিয়ে বৃদ্ধ এগুলোর গন্ধ নেয়।

তরুণ বয়স থেকেই, যখন সে প্রথম এই শহরে আসে, হামিদ ফাজিরের চাকরি করছে। ফাজির তাকে আশ্রয় দিয়েছে। তার দোকানে কাজ দিয়েছে। দিনশেষে রাতে ও একাই থাকে। বাবা-মায়ের কথা ভাবে। যে-শহরে ওর জন্ম, সে-শহরের কথাও ভাবে। যদিও এখন আর ও শিশু নয়, তবুও 888sport sign up bonusগুলো ওকে কাঁদায়। 888sport sign up bonusগুলো ওকে ছেড়ে পালায় না।

 মেয়েটা যখন শিম আর চিনি কিনতে এলো হামিদের ঔদার্য আর দেখে কে। ও ওজনে একটু বেশিই দিলো। মেয়েটি লক্ষ করে মুচকি হাসি দেয়। আনন্দে হামিদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তবে, সে জানে, মেয়েটির হাসিতে অবজ্ঞা আছে। পরের বার সে এসে হামিদকে সম্বোধন করল। নরম করে কথা বলল। তারপর ওকে বলল, ওর নাম রোকেয়া এবং সম্প্রতি এই এলাকায় সে তার আত্মীয়ের বাসায় থাকতে এসেছে।

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ হামিদ জিজ্ঞেস করে।

‘মোয়েম্বেমারিঙ্গো’, হাত ছুড়ে এমনভাবে দেখিয়ে বলে যেন এটি অ-নে-ক দূরে। ‘তবে যেতে চাইলে তোমাকে ভিন্ন পথে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যেতে হবে।’

সেদিন ওর পরনের নীল সুতি পোশাক দেখে হামিদ বোঝে, সে আসলে হাউস মেইড হিসেবে ওই বাড়িতে কাজ করে। যখন ও তাকে জিজ্ঞেস করল, সে কোথায় কাজ করে, তখন সে কেমন জানি নাক সিটকাল, যেন বোঝাতে চায়, এই প্রশ্ন তার কাছে গুরুত্বহীন। তারপর বলল, একটা ভালো কাজ না পাওয়া পর্যন্ত শহরের একটা নতুন হোটেলে মেইড হিসেবে কাজ করছে।

‘সবচেয়ে ভালো হোটেল হলো ‘ইকুয়েটর’।’ ও বলল। ‘ওখানে  একটা সুইমিংপুল আছে আর পুরো হোটেল কার্পেটে মোড়ানো। ওখানে যারা থাকে তারা প্রায় প্রত্যেকেই ইউরোপ থেকে আসা পর্যটক। অল্প কিছু ভারতীয়ও আসে। তবে গরিব কোনো লোক এখানকার ব্যবস্থাপনাকে নষ্ট করতে আসে না।’

রাতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে এর পেছনে ওর শোবার ঘরে যায় হামিদ। রাস্তাগুলো শূন্য, সুনসান। দিনে যেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে, রাতে তেমন নয়। হামিদ প্রায়ই রোকেয়ার কথা ভাবে। মাঝে মাঝে ওর নাম উচ্চারণ করে; কিন্তু ওর কথা ভাবলে বরং ওর শুধু একাকিত্বই বাড়ে আর আবর্জনা চোখে পড়ে। মনে পড়ে, সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় হারিয়ে যাওয়ার সময় ও কীভাবে ওর দিকে প্রথমবারের মতো তাকিয়েছিল। ও চেয়েছিল ওকে স্পর্শ করতে। বছরের পর বছর অন্ধকারে কাটানোর ফলে ওর মধ্যে এমন আকাক্সক্ষা বাসা বেঁধেছে। শহরটা ওর কাছে অচেনা মনে হয়। ভাবে, ওকে স্পর্শ করতে পারলেই সব মুশকিল আসান।

এক রাতে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ধীরে ধীরে সব থেকে কাছের ল্যাম্পপোস্টের কাছে গেল। তারপর এর পরেরটার কাছে গেল। তবে অবাক করার ব্যাপার হলো, ও কিন্তু ভয় পেল না। কী যেন নড়াচড়ার শব্দ শুনল; কিন্তু ও তাকাল না। ও যদি না-ই জানে যে ওর গন্তব্য কোথায়, তবে ভয় পাওয়ার দরকার নেই, কারণ এমন পরিস্থিতিতে যে-কোনো কিছুই ঘটতে পারে। এমন ভাবনাতেই স্বস্তি।

মোড় ঘুরে আর একটা রাস্তায় গেল। দুপাশে সারিবদ্ধ দোকানপাট। দু-একটা দোকানে তখনো আলো জ্বলছে। আলো এড়ানোর জন্য মোড় ঘুরে আরেক রাস্তায় চলে গেল হামিদ। ওখানে কেউ নেই। পুলিশও নেই, নাইটগার্ডও নেই। চত্বরের ধারে কাঠের বেঞ্চিতে কয়েক মিনিটের জন্য বসল। ভেবে অবাক লাগে, সবকিছু কেমন জানি অতি চেনা চেনা লাগছে। এক কোণে উঁচু দালানে ঘড়ি ঝুলছে। রাতে নীরবতার বুক চিড়ে টিক্ টিক্ শব্দ করে চলেছে। ধাতব খুঁটিগুলো চত্বরের ধারঘেঁষে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধভাবে। শেষ প্রান্তে বাসগুলো পার্ক করা। দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন কানে ভেসে আসে।

শব্দের উৎসের উদ্দেশে হামিদ হাঁটতে থাকে। দেখে, কাছেই সমুদ্রতট। জলের গন্ধে পিতৃভূমির 888sport sign up bonus মনে পড়ে যায়। ওর জন্ম-শহরও সমুদ্রের ধারে। অন্য ছেলেমেয়েদের মতো ও সমুদ্রের সৈকতে, অগভীর জলে খেলাধুলা করত। এখন আর এসবের কথা ভাবে না, কারণ এখন তো ও অন্য শহরের বাসিন্দা। জলের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ধারে। জল পাথরের দেয়ালে আঘাত করে উপচে পড়ছে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে। একটা জেটিতে এখনো আলো জ্বলজ্বল করছে। কলকব্জার চাপা শব্দ কানে আসছে। এত রাতেও কেউ কাজ করছে – এটি ওর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না।

উপসাগরের ওপারে আলো জ্বলছে। অন্ধকারের গায়ে লেগে থাকা কিছু বিন্দু মনে হচ্ছে। ওখানে কারা থাকে? ও অবাক হয়ে ভাবে। গায়ে কাঁটা দেয়। শহরের ওই অন্ধকার কোণে বসবাসরত লোকজনের জীবনচিত্র মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করে। শক্তসমর্থ ও নির্মম কিছু মুখ ওর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। সেই মুখগুলো ওকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। আধো আলো ছড়ানো অলিগলির কথা ওর মনে পড়ে। ওখানে ছায়াগুলো আগন্তুকের অপেক্ষায় থাকে। ওখানে লোকজন মৃতদেহের ওপর হামলে পড়ে। প্রাচীন উৎসবের উন্মত্ত পদধ্বনি শোনে।

শত্রুর রক্ত নিয়ে হোলি খেলার উন্মাদনা আর শোরগোল শোনে; কিন্তু ওপারে অন্ধকারে বসবাসরত লোকগুলো যে শুধু শরীরের জন্য হুমকি, তা নয়। কারণ হলো, ওরা জানে ওরা আসলে কোথায়, আর হামিদ জানে, ও নিজে আসলে কোথাও নেই; ও এক মহাশূন্যতায় আটকা পড়েছে।

এবার দোকানের দিকে রওনা দিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও। উপায় নেই। রাতে দোকান বন্ধ করে ফাজিরের সঙ্গে দেখা করার পর সমুদ্রপাড়ে ঘুরতে আসা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফাজিরের এটা পছন্দ নয়। একা ছেড়ে আসে বলে সে অভিযোগ করে; কিন্তু হামিদ তার তর্জন-গর্জনকে পাত্তা দেয় না।

মাঝে মাঝে পথে দু-একজনের দেখা মিলল। তবে কারো দিকে না তাকিয়ে ওদের পাশ কেটে সে চলতে লাগল। দিনের বেলা মেয়েটাকে দেখার জন্য এক চোখ খোলাই রাখে। এখন তার পুরো দিন আর রাত জুড়ে শুধুই ওই মেয়েটি। রাতে কল্পনায় মেয়েটার সঙ্গেই থাকে। নিস্তব্ধ রাস্তায় চলতে থাকে। কল্পনা করে, মেয়েটি যদি সঙ্গে থাকত, কথা বলত, হাসত আর মাঝে মাঝে কাঁধে হাত রাখত, তবে কতই না ভালো হতো! মেয়েটি দোকানে কিছু কিনতে এলেই হামিদ ওজনে একটু বেশি দেয়। ওর মুখে হাসির ঝিলিক দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকে। প্রায়ই সম্বোধন ও বন্ধুত্বসূচক একটু-আধটু বাক্যালাপ হয়। কাক্সিক্ষত পণ্যের ঘাটতি হলে হামিদ ওর গোপন স্থান থেকে এনে দেয়। বিশেষ বিশেষ ক্রেতার জন্য সে কিছু পণ্য গোপন স্থানে সরিয়ে রাখে। সাহসে কুলালে সে ওর চেহারার প্রশংসা করে। তখন ও বিব্রত ও লজ্জাবোধ করে ওকে এক টুকরো উজ্জ্বল হাসি উপহার দেয়। মেয়েটাকে নিয়ে মনসুরের তর্জন-গর্জন হামিদকে হাসায়। ও এমন কোনো মেয়ে নয় যাকে কয়েক শিলিং দিয়ে কেনা যায়। ও এমন এক মেয়ে যাকে গান গেয়ে, বীরত্ব প্রদর্শন করে জয় করতে হয়। ওকে জয় করার মতো কথার জাদু আধকানা আর চোখে ময়লা জমা মনসুরেরও নেই, হামিদেরও নেই।

এক সন্ধ্যায় রোকেয়া চিনি কিনতে দোকানে এলো। সে তখনো নীল ইউনিফর্ম পরা ছিল। বগলের নিচ ঘেমে ভিজে আছে। দোকানে আর কোনো খদ্দের ছিল না তখন। মেয়েটাকেও ব্যস্ত মনে হলো না। ও হামিদকে উত্ত্যক্ত করতে লাগল। বলল, ‘আহারে বেচারা, কী কঠোর কাজই না সে করে।’

‘যত সময় তুমি দোকানে দিয়েছ, তাতে তো তোমার অবশ্যই ধনী হওয়ার কথা। তুমি কি ঘরের মেঝে খুঁড়ে টাকা-পয়সা পুঁতে রেখেছ? সবাই কিন্তু জানে যে, দোকানদারের গোপন ভাণ্ডার থাকে। তুমি কি নিজ শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য টাকা জমাচ্ছ?’

‘আমার কিছু নেই।’ হামিদ বাধা দিয়ে বলে। ‘এখানকার কোনো কিছুই আমার নয়।’ ও সন্দেহ প্রকাশ করে হাসে। ‘কিন্তু তুমি তো অনেক পরিশ্রম কর।’ মেয়েটি বলে, ‘তুমি তেমন রসিক নও।’ হামিদ এক চামচ চিনি বেশি দিলে মেয়েটি হাসে। সামনের দিকে হেলে চিনির প্যাকেট নিতে নিতে বলে, ‘ধন্যবাদ।’ প্রয়োজনের তুলনায় আর একটু বেশি সময় এই ভঙ্গিতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় দাঁড়ায়। ‘তুমি সবসময়ই আমাকে বেশি বেশি জিনিস দাও। আমি জানি, বিনিময়ে তুমি কিছু একটা চাইবে। যখন চাইবে তখন কিন্তু এই ছোট্ট ছোট্ট গিফট দিয়ে চলবে না।’

হামিদ উত্তর দেয় না। লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে পড়ে। মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়। অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পূর্বে শুধু একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসে।

লেখক পরিচিতি

আবদুলরাজাক গুরনাহর জন্ম ১৯৪৮ সালে তানজানিয়ার জাঞ্জিবারে। বর্তমানে বাস করছেন ইংল্যান্ডে। সেখানকার কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তাঁর উল্লেখযোগ্য 888sport alternative linkগুলো হলো Memory of Departure (১৯৮৭), Pilgrims Way (১৯৮৮), Paradise (১৯৯৪), By the Sea (২০০১), Desertion (২০০৫) ইত্যাদি। তিনি ২০২১ সালে 888sport live footballে নোবেল 888sport app download bd পান। অনূদিত গল্পটি তাঁর `Cages’-এর বঙ্গানুবাদ।