খোয়াবনামা : জীবন জিজ্ঞাসা ও সমকাল

চৌধুরী শাহজাহান

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (জন্ম ১২ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৪৩, মৃত্যু ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭) সমকালীন কথা888sport live footballের  একজন ব্যতিক্রমধর্মী কথাকার। তিনি জীবনকালেই বাংলা 888sport live footballে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। জীবনোপলব্ধির সততা, সমাজ বাস্তবতা ও মৃত্তিকালগ্ন জীবন-চেতনায় সমৃদ্ধ ঔপন্যাসিক ইলিয়াস কথা888sport live footballেই বিচরণ করেছেন আমৃত্যু। তিনি লিখেছেন কম, কিন্তু ভেবেছেন বেশি। তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি বিখ্যাত ত্রিশটি ছোটগল্প, দুটো 888sport alternative link ও একটি 888sport liveগ্রন্থ। তাঁর 888sport alternative linkের পটভূমি বিশাল। দেশ-বিভাগজনিত নানা ঘটনা, উপ-ঘটনা, রাজনীতি, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, ইতিহাস ও লোকবিশ্বাস, পুরাণ-মিথ, গণ-আন্দোলন, গ্রামীণ জীবন ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার, মানবিক বিপর্যয় ইত্যাদি নানাবিধ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর রচনায়। সমকালীন মুসলমান মধ্যবিত্তের জাগতিক ও মানবিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে তিনি গ্রামীণ পরিবেশ, লৌকিক জীবনাচার, ধর্মীয় সংস্কার ও বিশ্বাসের চিত্র অংকন করেছেন। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনিবার্য সম্পর্ক, মানব-অস্তিত্বের বিচিত্র সংকট, শ্রেণি-বিভাজন ও শ্রেণি-সংগ্রাম তাঁর 888sport alternative linkের বিষয়বস্ত্তকে করেছে বিশ্বাসযোগ্য। বাঙালি জাতির আবহমান সংগ্রামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এনে ইলিয়াস নিপুণ দক্ষতার পরিচয়

দিয়েছেন। 888sport alternative link 888sport live footballের সবচেয়ে জীবনঘনিষ্ঠ 888sport live chatমাধ্যম। চিলেকোঠার সেপাই থেকে  খোয়াবনামা একেবারেই ভিন্ন মেজাজের। কারণ তিনি গতানুগতিক ধারায় 888sport live football-রচনা করতে চাননি। তিনি মনে করতেন একই বৃত্তে ঘুরপাক খেলে প্রকৃত 888sport live chatীসত্তা গড়ে ওঠে না। তাই তিনি গল্প-888sport alternative linkে সমাজের রূপান্তর ঘটাতে চেয়েছেন। খোয়াব শব্দের অর্থ স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কল্পনা বা স্বপ্ন নিয়েই মানুষ প্রাপ্তির আকাঙক্ষায় ছুটে বেড়ায়। বিপন্ন মানুষের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ইলিয়াসের  খোয়াবনামায় তেভাগা আন্দোলন, দেশবিভাগ, পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহি বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ প্রভৃতি আন্দোলন-সংগ্রাম ঐতিহাসিক ঘটনার সংমিশ্রণ ঘটেছে এ-888sport alternative linkে। বগুড়ার কাৎলাহার ও এর আশপাশের মানুষের কাহিনি রূপলাভ করেছে খোয়াবনামা 888sport alternative linkে। কাৎলাহার বিল ও তার পাশের গ্রাম গিরিরডাঙা, নিজগিরির ডাঙ্গা ও গোলাবাড়ি হাট প্রভৃতি স্থানের লোকায়ত চেতন-অবচেতন জগতের সঙ্গে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনা 888sport alternative linkটিতে চিত্রিত হয়েছে। ভারত ভাগ হয়ে গঠিত হয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। পাকিস্তানি শাসকেরা নতুন আইন তৈরি করে। দেশবিভাগের পর ঘটে মানবিক বিপর্যয়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানসের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, সংগ্রাম, স্বপ্নভঙ্গ, গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের রাজনৈতিক প্রতিঘাতও পাকিস্তানের সহযোগীদের চরিত্র উন্মোচনে লেখকের প্রগতিশীল মননের পরিচয় ফুটে উঠেছে। তেভাগা প্রসঙ্গের রূপায়ণে ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবনের প্রসঙ্গ গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের কথাবার্তায় উদাহরণ হিসেবে এসেছে। তমিজের বাবা, দাদা-পরদাদা, চেরাগ আলী, বাঘার মাঝি, কুলসুম, শরাফত ম-ল, কেরামত, ফুলজান, বৈকুণ্ঠের কাহিনি; অন্যদিকে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশত্যাগ, রিফিউজি আগমন, তেভাগা আন্দোলনের বিবরণ ৫৯টি পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে।

খোয়াবনামা 888sport alternative linkের কাহিনির পটভূমি সমকালের তমিজের পাঁচ পুরুষ আগের। তমিজের পাঁচ পুরুষের আগের প্রজন্ম ঘন জঙ্গল সাফ করে মাটি ফেলা ভিটায় বাস করে বাঘার মাঝি। কাৎলাহার বিলের সাফ করা জঙ্গলে সোভন ধুমা চাষাবাদ শুরু করে বাঘের ঘাড়ে লাঙল চাপিয়ে। কোনো এক বিকেলবেলা মজনুশাহের অগণিত ফকিরের সঙ্গে মহাস্থানগড়ের দিকে যাওয়ার সময় করতোয়ার বাঁদিকে মুনশি বয়তুলস্নাহ শাহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই টেলরের গুলিতে মারা যায়। কাৎলাহার বিলের দুধারের মানুষের বিশ্বাস, বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে রাতভর বিল শাসন করে মুনশি। অন্ধবিশ্বাসে বিলের দুধারের মানুষ জানে দিনের বেলা সেই অশরীরী মুনশি রোদের মধ্যে রোদ হয়ে ছড়িয়ে থাকে আর রাতভর পাকুড়গাছের মাথায় বসে বিল শাসন করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে পাকুড়গাছটাও কাটা পড়ে, ইটখোলা প্রতিষ্ঠিত হয়, বনজঙ্গল পরিষ্কার করে মানুষ জনবসতি গড়ে তোলে। একসময় কাৎলাহার বিল শুকিয়ে যায়। শুকনো জমিতে মানুষ চাষাবাদ করে, আবাদি জমির ধার ঘেঁষে মানুষ বাড়িঘর তোলে। বিলের মালিকানা জমিদারের হাতে চলে যাওয়ার পর জেলেপাড়ার ৫/৬ ভাগ মানুষই চাষা হয়ে যায়। অয়েল মিল স্থাপিত হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশ কলুরা চলে যায় পুবদিকে যমুনার তীরে, নিজ পেশা বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়ে হয়ে যায় চাষা।

বিলের মালিকানা জমিদারের হাতে চলে গেলে চাষিজমি হারিয়ে মাঝিরা বিলের মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হয়ে কামলা খাটে। আকালে একশ্রেণির মানুষের কৌশলী কারসাজিতে কামারদের জমির মালিকানা হস্তান্তর হয়। সামন্ত প্রভুদের যোগসাজশে গ্রামে শরাফত ম-ল প্রভূত জমাজমির মালিক হয়ে যায়। জমির বঞ্চিত মালিকরা জীবিকার সন্ধানে গ্রামছাড়া হয়ে শহরে শ্রমজীবী হয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তন হয়। দশ-বারো বছর আগেও গিরিরডাঙ্গা গ্রামের দিনমজুরদের গ্রামের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। গ্রামের জোতদারের ধান কেটেই জীবিকা নির্বাহ হতো, এখন তারা কসিমুদ্দিনের মতোই নিঃস্ব। দুর্ভিক্ষে মানুষ মরে দেশান্তরি হয়েছে, জমি বিক্রি করে কৃষকেরা হয়েছে নিঃস্ব। চারদিকে কাজের জন্য হাহাকার। তাই তমিজকে কাজের জন্য খিয়ারে যেতে হয়েছে। এই জীবিকার জন্যই গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে যেতে হয়। গ্রামের মানুষকে বিয়ে করে সংসার পেতে ঘরজামাই হয়ে জীবনযাপন করতে হয়। আবার একই গ্রামে যখন কাৎলাহার বিল শরাফত ম-লের হাতে চলে যায়, তখন তাদের বর্গাচাষের সুযোগ আসে। অভাবের দিনে কেরোসিন তেল বেচাকেনা করে আর ইটের ভাটা দিয়ে শরাফত ম-ল ধনী হয়ে ওঠেন।

গিরিরডাঙ্গা, গোলাবাড়ির হাটের মানুষেরা মহাজনী সুদের টাকা গুনতেই জীবন শেষ করেছে। জমি বর্গা নিতে তাদের অনেক কৌশল করতে হয়। আবদুল কাদের পাকিস্তান আন্দোলনের সপক্ষে কাজ করতে হিন্দুদের বিপক্ষে জনগণকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে এবং মুসলিম লীগের পতাকাতলে গ্রামের মানুষকে জমায়েত হতে বলে। সে বিশ্বাস করে হিন্দু জমিদার আর হিন্দু মহাজনের হাত থেকে বাঁচার জন্যই মুসলিম লীগের পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ। কাদেরের ধারণার মধ্যে পাকিস্তানপন্থীদের মতামত বোঝা যায় – ‘হিন্দু মুসলমান চাষার রক্ত চুষে শেষ করে ফেলল।… হিন্দু জমিদার ফুটানি মারে মুসলমান প্রজার রক্ত চুষে। পাকিস্তান না হলে মুসলমানের জানমাল-ইজ্জত সব বিপন্ন।’ পাকিস্তানের স্বার্থেই আবদুল কাদের মাঝি আর কৃষকদের মধ্যে পার্থক্য তুলে দিতে চায়। জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে কাদের ও তার লোকজন হিন্দু নায়েবের সমীহ আদায় করতে চায়। তেভাগা আন্দোলন ঠেকাতে জোতদাররা পুলিশের সঙ্গে আপস করে চলে।

ব্রিটিশ শাসনামল হলো খোয়াবনামার পটভূমি। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর কথা এ 888sport alternative linkে এসেছে। এসেছে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কথাও। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও  দেশ জমিদারদের আইনেই চলে। দেশত্যাগী হিন্দুদের জমি কিনে শরাফত ম-ল প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। শরাফত ম-লের আসল ঠিকানা নিজগিরিডাঙ্গা গ্রামে। কাৎলাহার বিল ভরাট শুরু হওয়ার অনেক আগেই এপারে এসে ঘর তোলে তার বাবা। কেরোসিন তেল কেনাবেচা করে আর ইটের ভাটা দিয়ে সে অনেক টাকার মালিক হয়। ফলে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবিকার মাধ্যম হয় কাৎলাহার বিল। লেখক 888sport alternative linkে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কথা বলেছেন। সন্ন্যাসীদের হাতে কোম্পানির সেপাইদের মৃত্যু যেমন হয়েছে তেমনি সৈন্যদের হাতেও সন্ন্যাসীদের মৃত্যু ঘটেছে। ভবানী পাঠকের সঙ্গে কোম্পানি-সৈন্যদের যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে ভবানী পাঠকের মৃত্যু হয়। বৈকুণ্ঠ ভবানী পাঠকের বংশধর সূত্রে আত্মীয় বলে সে গর্ববোধ করে। লেখক কৃষক ও বর্গাচাষিদের চালচিত্র নিপুণতার সঙ্গে চিত্রায়ণ করেছেন। কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার আলেখ্য উপস্থাপন করতে গিয়ে ধানকাটা, ধানমাড়াই ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেছেন।

ভারত বিভাজনের পূর্বে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বর্ণনাতে লেখক ইতিহাসকে ধারণ করেছেন। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ লেখক দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাকে অবলম্বন করে 888sport alternative linkটিকে মহাকাব্যিক রূপ দান করেছেন। ঔপন্যাসিকের চিন্তা-চেতনা তাঁর সৃজিত চরিত্রের মাধ্যমে উন্মোচন করেছেন এ-888sport alternative linkে। অজয় দত্তের বক্তব্যের মাধ্যমে লেখকের ব্যক্তি-মানসের প্রতিফলন ঘটেছে – ‘হিন্দু-মুসলমান চাষিরা একসঙ্গে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে। আমরা কম্যুনিস্ট পার্টি হিন্দু-মুসলমান চাষিদের সঙ্গে তেভাগা আদায়ের জন্য আজো লড়াই করে চলেছি। এখন আমরা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ আর তাদের তল্পিবাহক জমিদার ও জোতদারদের সঙ্গে লড়াই না করে লেগে পড়েছি নিজেদের ভাইদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামায়। নিজেদের এই সর্বনাশ করার উন্মাদনা থেকে আমাদের বিরত থাকতেই হবে। ভাইয়ে-ভাইয়ে দাঙ্গা বন্ধ করতে আমরা যে-কোনো দলের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্ত্তত। তাই রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও আমরা আজ এসেছি ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে… আমরা ভাইয়ে-ভাইয়ে সংঘাত বন্ধ করতে চাই।’ রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে দেশের স্বার্থকে দলমত নির্বিশেষে প্রাধান্য দেওয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি লেখক এখানে স্থাপন করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার।

গিরিডাঙ্গা, নিজগিরিডাঙ্গা গ্রামের মানুষেরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিন্তু জাতিগতভাবে তাদের মধ্যে একটা টান আছে। তাই তো আফসার কলকাতার দাঙ্গার কথা শুনে কাতারপাড়ায় আগুন লাগায়। জুমার নামাজের পর কুদ্দুস মৌলভি মোনাজাতে কলকাতা আর বিহারের মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে আলস্নাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন। কাৎলাহার বিলের পত্তন চলে যায় ব্যক্তিমালিকানায়। কালাম মাঝির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে কারো জাল ফেলার অধিকার নেই। 888sport alternative link ও সমাজ বাস্তবতা 888sport liveে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন – ’ধর্ম ও রাজাকে ডিঙিয়ে ব্যক্তি যখন নিজের বিকাশ ঘটাবার মহা-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখনই 888sport alternative linkের জন্ম।’ তিনি তাঁর গল্প-888sport alternative linkে ব্যক্তির আত্মবিকাশকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেন ব্যক্তির মুক্তি প্রয়াসের উদ্যোগ ব্যাপক। বাংলা 888sport live footballে ব্যক্তি বিকাশের প্রথম সুযোগ দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তমিজের বাবা, তমিজ ও কুলসুমের আর্থিক বিপর্যয়ের কথা উঠে আসে এ-888sport alternative linkে। কুলসুম কামনা-বাসনা বিবর্জিত নয়। তার শরীরে রয়েছে শারীরিক চাহিদা। আয়নায় মুখ দেখে তাই সে অতীতের খোঁজ করে। কুলসুমের মাতৃত্ববোধ অনেক বয়সী সৎপুত্র তমিজের প্রতি মমত্ববোধে জড়িয়ে যায়। কুলসুম ও তমিজ একে অপরের প্রতি মিলিত হওয়ার আসক্তি ইলিয়াস উপমা ও প্রতীকের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন এভাবে – ‘অসন্তুষ্ট জমি হলো কিপটার একশেষ। শালার জগদীশ সাহার ছায়াও কিপটা।’ কৃপণতায় মানুষের সঙ্গে জমির তুলনা শুনে কুলসুম হেসে গড়িয়ে পড়ে। তমিজের এই উপমাটি তার হাসির কারণ, নাকি তার হাসির অছিলা তা না বোঝে তমিজ। কুলসুমের হাসিতে তমিজের উৎসাহ বাড়ে। সে ঘোষণা করে, এবার জমির যে সেবাটা সে করছে তাতে ওই শালা হুরমতুলস্নার মুখটা আন্ধার না করে ছাড়বে না। অনেক ধান পাওয়ার সম্ভাবনায় হতে পারে, আবার কুপির শিখার কালচে হলুদ আঁচেও হতে পারে, – তমিজের কালো মুখে বেগুনি রঙের আভা ফুটতে দেখে কুলসুমের সারাটা শরীর শিরশির করে ওঠে। খুব ঝাপসা এই কাঁপনকে কথায় গড়িয়ে নিতে পারলে কুলসুম শুনত : তমিজের বাপের মুখেও এমনি ছায়া-ছায়া আভা কখনো-কখনো ফুটে ওঠে। কখন? কখন গো? সেই দিনক্ষণ খুঁজে বার করতে কুলসুম শোঁ-শোঁ করে নিঃশ্বাস নিতে থাকে, গন্ধ শুঁকে-শুঁকে তমিজের এই চেহারায় তার বাপের ঠিক সময়ের আদলটা দেখতে পারবে। কয়েকটি বড়-বড় নিঃশ্বাসেই পাওয়া গন্ধে কুলসুম সত্যি বুঝতে পারে, তমিজের বাপের মুখে হলুদ-বেগুনি ও কালো ঝাপটা টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার আগে। না, সব দিন নয়, মাঝে-মাঝে। কখন? কুলসুম আরো কয়েকবার গন্ধ নেয়। – হ্যাঁ, মানুষটা যে রাতে ঘুমের মধ্যে হেঁটে-হেঁটে বাইরে যায়, সেসব সন্ধ্যায় এসব গাঢ় রঙের ঝাপটা লেগে মুখটা তার ঝাপসা হয়ে আসে। তমিজ তরুণ বয়সের ছেলে। তার মধ্যে জৈবিক আকাঙক্ষা প্রবলভাবে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। লেখক ফ্রয়েডীয় চেতনায় তার চরিত্রকে রূপায়ণ করেছেন। তার যৌন-ক্ষুধার কাছে তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকেও সে ভোগ করতে ধর্মীয় বিধিবিধানের ধার ধারেনি। এক সন্তানের মা কেরামতের স্ত্রীকেও নিজের করে নিতে তার কোনো লজ্জাবোধ হয়নি। আর তা সম্ভব হয়েছে মানুষের স্বভাবজাত জৈবিক তাড়নার জন্য।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা 888sport alternative linkে মিথের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। 888sport alternative linkটি শুরু হয়েছে মিথ দিয়ে। প্রথম পরিচ্ছেদে আমরা পাচ্ছি অতীত ইতিহাসের নানা ঘটনা ও লোকবিশ্বাস। কথা888sport live footballিক সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্র 888sport live footballে লোকবিশ্বাস ও মিথের ব্যবহার এসেছে, কিন্তু ইলিয়াসের মতো মিথের ব্যবহার বাংলা 888sport live footballে বিরল। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

০১. পায়ের পাতা কাদায় একটুখানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাঢ় ছাই রঙের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাতদুটো নাড়ছিল, ওই জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার। অনেকদিন আগে, তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার বাপেরও জন্ম হয়নি, তার দাদা বাগাড় মাঝিরই তখনো দুনিয়ায় আসার ঢের দেরি, বাগাড় মাঝির দাদার বাপ না-কি দাদারই জন্ম হয়েছে, কি হয়নি, হলেও বন কেটে বসত করা নতুন মাটি ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, ওইসব দিনের এক বিকেলবেলা মজনুশাহের বেশুমার ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান কেলস্নায় যাওয়ার জন্য করতোয়ার দিকে ছোটার সময় মুনশি বয়তুলস্নাহ শাহ গোরা সেপাইদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিল ঘোড়া থেকে। বন্দুকের গুলিতে ফুটো গলা তার আর পুরট হলো না। মরার পর সেই গলায় জড়ানো শেকল আর ছাইভস্মমাখা গতর নিয়ে মাছের নকশা আঁকা পান্টি হাতে সে উঠে বসল কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মাথায়। সেই তখন থেকে দিনের বেলা রোদের মধ্যে রোদ হয়ে সে ছড়িয়ে থাকে সারাটা বিল জুড়ে। আর রাতভর বিল শাসন করে ওই পাকুড়গাছের ওপর থেকে। তাকে যদি এক নজরে দেখা যায় – এই আশায় তমিজের বাপ হাত নাড়াতে-নাড়াতে আসমানে মেঘ খেদায়।

০২.       সন্ধ্যা থেকে আবছা কালো একটা জাল পড়ে বিলের ওপর, সন্ধ্যা গড়ায় রাত্রিতে আর ওই অদৃশ্য জালের বিস্তার বাড়ে ওই সঙ্গে। অন্ধকার গাঢ় হতে-হতে সেই বেড়জালের নিচে ধরা পড়ে সমস্ত এলাকা। রাত বাড়ে, রাত আরো বাড়ে। কেউ টের পাওয়ার আগেই শুরু হয় জাল গোটানো। পাকুড়গাছ থেকে টান পড়ে জালের দড়িতে, আসেত্ম-আসেত্ম দুই পাড়ের গ্রাম নিয়ে গোটা বিল তিরতির করে কাঁপতে-কাঁপতে সে থিতু হয় বিলের মাঝখানে।… অমাবস্যার ঘনঘোর অন্ধকার কি পূর্ণিমার হলদে জ্যোৎসণার কিংবা

কৃষ্ণপক্ষের ঘোলা লাল আলোয় সেই মস্তছায়া গতরে মুড়ে কাৎলাহার বিল, বিলের ওই পাশে গ্রাম, বিলের কাছে খাল, বিলের সিথানে পাকুড়তলা, ওদিকে দক্ষিণে শরাফত ম-লের টিনের বাড়ি এবং বাড়ির পূর্বে সাদা বকে-যাওয়া শিমুল গাছ-সব, সবই মায়ের কাছে ভাতের জন্য কাঁদতে-কাঁদতে গায়ে মাথায় জাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মাঝিপাড়ার বালকের মতো একটানা নিঃশ্বাস নেয়। সেই নিঃশ্বাসের টানে ফোঁপানির রেশ। সব একসঙ্গে দেখার তখন ভারি জুত। এই সময় বেড়জালের দড়ি টানতে-টানতে বিলের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মুনশি বয়তুলস্নাহ শাহ। তার আগে সাঁতার কেটে-কেটে চলে যায় ভেড়ার পাল। মুনশিকে একনজর দেখার সুযোগটা নিতেই তমিজের বাপের এখানে আসা। ওপরে আসমান আর নিচে পানি ও জমিন একেবারে একাকার, মাঝখানে মুনশির ইচ্ছামতো বিচরণ। সবাইকে একটি লহমার জন্য একজায়গায় ঠাঁই করে দিয়ে জাল নিয়ে সে উড়াল দেবে উত্তরের দিক।

০৩.      বোঝা অতো সহজ নয়। কোনো ফকিরে নিজের কথা কয় না। তার লিজের কী, পরের কী? কাৎলাহার বিলের চারোপাশের ব্যামাক মানুষ জানে, ওই ফকিরের খুঁটি হলো পাকুড়গাছের মুনশি, বুঝিছো?

০৪. তুমি ভিনজাতের মানুষ। তোমাকে কি কওয়া যাবে? কিন্তু না বলেও তার উপায় থাকে না। তখন সে জানায়, এই যে পোড়াদহের মেলা এই মেলা প্রথম চালু করে ভবানী পাঠক, আহা-বড়ো শখের মেলা তার। দেহ রাখার পর তিনি প্রস্থান করেছেন কৈলাসে, কিন্তু বছরকার একটি দিন তাঁকে এখনো দেখা যায়। কে দেখে? যে সে জাতের মানুষ কি আর দেখতে পারবে? এদিকে এখন সব মোসলমান আর সাহা আর কুমোর আর কামার আর মাঝি আর কলু-ঠাকুরকে তারা দেখবে কোথ্থেকে। বামুন-কায়েতকেও ঠাকুর দর্শন দেবেন না। দেবতা হলে কি হয়। বামুন-কায়েতরাও ওই যুদ্ধের সময় দাসখত লিখে দিয়েছিল।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা 888sport alternative linkের কুশীলবরা সবাই খোয়াব বা স্বপ্ন দেখে। শরাফত ম-ল খোয়াব দেখে আরো বেশি ভূ-সম্পত্তির মালিক হওয়ার, ম-লের ছেলে আবদুল কাদের স্বপ্ন দেখে স্বাধীন পাকিস্তানের। তমিজ স্বপ্ন দেখে এক টুকরো ধানী জমির। স্বপ্ন ব্যাখ্যায় চেরাগ আলী ব্যবহার করে ছেঁড়াখোঁড়া বইটি। এই ছেঁড়াখোঁড়া বইটি যেন বাঙালি জাতির খোয়াবনামা। একটা জাতির প্রায় বারোশো বছরের বিশ্বাস, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিবরণ, বৈচিত্রপূর্ণ শোলোক চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুনশির শেস্নাক গেয়ে ঘুরে বেড়াত চেরাগ আলী ফকির। তার বাপ-মা-নাতনি কুলসুমের হাত ধরে সে শেস্নাক শুনিয়ে বেড়াত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। সে মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারত। স্বপ্ন ব্যাখ্যার একটি কিতাব ছিল তার যা সবার কাছে অলৌকিক গ্রন্থ বলে মনে হতো। তারপর একদিন নাতনি বিবাহযোগ্য হলে বুড়ো তমিজের বাপের সঙ্গে বিয়ে দেয়। চেরাগ আলীর মৃত্যুর পর সেই বইয়ের মালিক হয় তমিজের বাপ। এই শেস্নাকের কয়েকটি বেরিয়ে আসত কুলসুমের মুখ দিয়ে আবার কখনো বৈকুণ্ঠ গিরির মুখ থেকে। বৈকুণ্ঠ গিরিও বোহেমিয়ান স্বভাবের লোক। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে তার পূর্বপুরুষ অংশ নিয়েছিল। চেরাগ আলীর মুখের শেস্নাক সে গাইতে পারত। চেরাগ আলীর গাওয়া সেই গান শোনা যায় তমিজের বাপের মুখেও। একদিন এই শেস্নাক শুনে কেরামত ম-ল। কুলসুমের গলায় শেস্নাক শুনে কেরামতের মনে হয় চেরাগ আলীর আত্মা ভর করেছে তার নাতনির ওপর। তার গলা থেকে পুরুষালি স্বরে দাদার গাওয়া গান বের হয়ে আসত। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

০১.       চান্দ কোলে চাগে গগন  পাশে বিবি নিন্দে মগন

খোয়াবে কান্দিলো বেটা না রাখে হদিস।

(ফকির) না রাখে হদিস।

(হায়রে) সিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাসের বালিস।

দুয়ারে দাঁড়ায়ে ঘোড়া করিলো কুর্নিশ।

(ফকির) ঘোড়ায় চড়ি বাহিরিলো নাহিকো উদ্দিশ।

 

০২.       সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি

তলায় গজার মাছ অতি হিংস্র মতি।

গভীর নিশিতকালে মুনসির আদেশে।

বিলের গজার মাছ রূপ লয় মোষে।

 

০৩.      মজনু হাঁকিয়া কয় ভবানী সন্ন্যাসী।

গোরাগণে ধরো আর দাও সবে ফাঁসি।

গিরিবৃন্দ অসি ধরে ভবানী হুংকারে।

গোরাগণে পাঠাইয়া দেয় যমদ্বারে।

 

দেশবিভাগের ফলে মানবিক বিপর্যয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। হিন্দুদের এপার ছেড়ে চলে-যাওয়া এবং ওপার থেকে কিছুসংখ্যক মুসলমান 888sport appsে চলে আসা, হিন্দুদের জায়গাজমি নামেমাত্র দামে বিক্রি করে ভারতে চলে যাওয়া – এসব প্রসঙ্গ লেখক তুলে ধরেছেন। তিনি পুঁজিবাদী সমাজের ভাবধারার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন। পুঁজিবাদকে এড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় উত্তরণ ঘটাতে পারেননি। এই দ্বৈতসত্তায় তিনি ঘুরপাক খেয়েছেন। চলিস্ন­শোত্তর সময়ের দাঙ্গা, মন্বন্তর, ধর্মঘট, রক্তপাত, জিন্নাহর দ্বিজাতি-তত্ত্ব, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন ইত্যাদি প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ইলিয়াস রূপায়ণ করেছেন খোয়াবনামা 888sport alternative linkে।  কাহিনি আখ্যান চরিত্র-সৃজনে লেখকের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ উঠে এসেছে এ-888sport alternative linkে। ঔপন্যাসিক ইতিহাস রচনা করেন না, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও করেননি। তাঁর চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা 888sport alternative linkে আমাদের ইতিহাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বকে অপূর্ব 888sport live chatম–ত করে তুলে ধরেছেন। ইতিহাস ও লোকশ্রম্নতি, মিথের ব্যবহার ও পুনর্নির্মাণে তাঁর দক্ষতা তাঁকে একজন অনন্যসাধারণ 888sport live footballিকের মর্যাদা এনে দিয়েছে। বলা যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা বাংলা 888sport alternative link 888sport live footballে মহাকাব্যোচিত একটি শ্রেষ্ঠ আখ্যান।

 

সহায়ক পত্রিকা ও গ্রন্থাবলি :

ঊষালোকে, মোহাম্মদ শাকেরউলস্নাহ, নবম পর্যায় অষ্টম 888sport free bet, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৪।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা888sport live footballে ভিন্নমাত্রা অন্যসুর – মোস্তফা মোহাম্মদ, 888sport live footballিকা, মার্চ ২০০৩।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প – জাফর আহমদ রাশেদ, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশন, ফেব্রম্নয়ারি ২০১২।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ২, খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯।

খোয়াবনামা-র মিথ : তৃণমূলে যাবার এক পথ – শওকত আলী, ঊষালোকে, অষ্টম 888sport free bet, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৪।